মূল: এলসপেথ ডেভি
অনুবাদ: নূরুননবী শান্ত
আমার মনে হয়, একজন লেখক নিজে কীভাবে লেখেন বা অন্য কোন লেখক কীভাবে লেখেন এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দিতে পারবেন না। কেননা লেখার সময় উচ্চমার্গীয় সচেতনতা যেমন কাজ করে তেমনি সম্পূর্ণ অবচেতন থেকেও উঠে আসতে পারে একটি রচনা। অর্থাৎ লেখা কীভাবে হয়ে ওঠে তা নিয়ে আংশিক কথা বলা যায়, ব্যাখ্যাও করা যায় অংশত, কিন্তু সম্পূর্ণ করে কিছু বলা মুশকিল। কেউ হয়তো কারো লেখার টেকনিক, ফর্ম, লেখকের সৃষ্টিশীলতা, উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত কল্পনাশক্তি কোথা থেকে আসে এবং এটা আসলে ঠিক কী তা এক রহস্য বটে। অনেকেই এসব বিষয় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শেকসপিয়ারের কল্পনাশক্তি সম্পর্কে কলরিজ বলেছেন, ‘সৃষ্টিশীলতা ও বুদ্ধির শক্তি যেন তাঁর (শেকসপিয়র) মধ্যে কুস্তি লড়াইয়ে রত’।
তবে যেহেতু আমরা এখানে লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি, বিনয়ের সঙ্গে বলা ভালো যে, এই ব্যাখ্যা না করতে পারার ব্যাপারটা একটা সীমাবদ্ধতা— অনেক সময় এটা খুব যন্ত্রণাদায়ক—একজন লেখককে (যেকোন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিকে) আক্রান্ত করে। এই সীমাবদ্ধতাই একজন লেখককে এক ধরনের স্বাধীনতা দান করে এবং তার ভেতরে বন্দী থাকা কল্পনাশক্তিকে মুক্ত করে দেয়, যেন শক্ত করে এঁটে রাখা কোন ফোয়ারার মুখ হঠাৎ খুলে জলের তীব্র ধারাগুলো মুক্তিলাভ করে। একজন লেখক ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এই সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা হয়তো করতে পারেন।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রে, যদিও এটা আকারে হ্রস্ব অথবা সম্ভবত হ্রস্ব বলেই এর ভেতরে অনেক উপাদান ভরে দেওয়ার মতো শূন্যতা থাকে। এর ভেতরে থাকতে পারে বিরাট হ্রদের সমান স্পেস। এই স্পেসে থাকে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের সমাহার। এই স্পেস হতে পারে অনেক গভীর। অথবা ব্যবহৃত শব্দগুলো ধারণ করতে পারে গভীর অর্থ। প্রায়ই ছোটগল্পের শব্দগুলো কিছু বলে না, নীরব থাকে; তারপর নীরবতার ভেতরের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার মতো ঝলক বা শক্তিকে চেনা বা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় হয়তো। সত্যিকারের বড়মাপের লেখকের ভেতরে কল্পনা ও সচেতনতা এতটাই শক্তিশালী যে, তা বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসে পাঠককে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার মতোই আবিষ্ট করে দেয়। ইউজিন ইওনেস্ক বলেছেন :
‘যেসব প্রাত্যহিকতা ও মানসিক আড়ষ্টতা বাস্তবের বিস্ময় উপলব্ধি করা থেকে আমাদের বঞ্চিত রাখে, সেগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আমাদের অবশ্যই এমনকিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে যা অনেক সময় মনের উপর কঠিন মুগুরের আঘাত হানতে পারে।’
ভালো কোন রচনা থেকে পাওয়া এই আঘাত আমাদের সংবেদশীলতায় ক্ষত তৈরি করে না। অনেক সময় এ ধরনের আঘাত সত্যিই নিরীহ—লেখার সেই উপাদানগুলোকে অবদমিত রাখে যেগুলো গভীর নীরবতা, শূন্যতা বা আবেগ প্রকাশ করতে উদ্যত। কখনো কখনো আমাদের চরিত্ররা কোন শব্দই উচ্চারণ করতে সক্ষম নয়। হেনরি জেমসের এক ‘নারীর প্রতিকৃতি’র সেই জায়গাগুলো আমার মনে পড়ছে যেখানে একজন পুরুষ ও একজন নারী পরস্পরের সঙ্গে বাক্যালাপরত। পুরুষটি নারীকে কিছু একটা বলছে। নারী উত্তর দিচ্ছে না, আদৌ কিছু বলছে না, কেবলমাত্র তার হাতপাখা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে অভিব্যক্তি আড়াল করছে। এই প্রকাশভঙ্গি আমাদের আলোড়িত করে, কারণ, এই প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে আমরা একাত্ম হতে পারি—ভাব প্রকাশের শব্দের অভাব থেকে উৎসারিত ভয় আমাদের বাধ্য করে আবেগের তীক্ষ্ণতাকে ছদ্মবেশী রূপ দিতে।
এমনও হয় যে, উন্মত্ত ও বিক্ষুব্ধ প্রেক্ষাপটের বিপরীতে গড়ে তোলা পরিকল্পিত বা পরিশীলিত উপাদানের আনন্দদায়ক বা বিয়োগাত্মক সন্নিধির মধ্যে হঠাৎ আবির্ভূত হতে পারে সচেতনতার আঘাত। জোসেফ কনরাডের ‘টাইফুন’ সম্পর্কে ভেবে দেখা যেতে পারে। ‘টাইফুন’ দীর্ঘ গল্প হলেও এর মধ্যে আছে ছোটগল্পের স্বভাবসুলভ সীমা। ক্যাপ্টেন ম্যাকওয়ারের একটা ছবি আমরা পাই—একজন খাঁটি, দায়িত্ববোধসম্পন্ন আধিপত্যবাদ-বিরোধী মানুষ, নিজের চার্টরুমে বসে বাড়িতে স্ত্রীর কাছে পত্র লিখছে, যেমনটা সে অসংখ্য লোক লিখে থাকে। চিঠি লিখছে সেই স্ত্রীকে যে সিরিয়াসলি জানতে চায় ম্যাকওয়ার কোন্ সমুদ্রে আছে এবং প্রত্যাশা করে যেন ম্যাক এত দ্রুত ফিরে না আসে যাতে তার টি-পার্টির উত্তেজনা ভেঙে যায়। একটা ভয়ঙ্কর টাইফুন শুরুর ঠিক আগে ম্যাক স্ত্রীকে চিঠি লিখছে। ‘প্রিয়তমা আমার’, ম্যাক চিঠি শুরু করেছে, যেভাবে সে প্রতিটি চিঠি শুরু করে, ‘এ যাত্রায় আবহাওয়া অত্যন্ত চমৎকার’। সঙ্গে সঙ্গেই সামুদ্রিক ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ে জাহাজের উপর এবং আমরা ক্যাপ্টেনের নিম্নরূপ গার্হস্থ্য প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই:
‘প্রবল বিষণ্নতা বুকে নিয়ে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ঘাড়টাকে টেনে সোজা রেখে সে তার আড়ষ্ট হয়ে আসা আঙুলগুলো দিয়ে থুঁতনির ঠিক নিচে সামুদ্রিক ঝড় থেকে নিজেকে রক্ষা করার জ্যাকেটটার দড়ি শক্ত করে বাঁধতে লাগলো। আয়নার সামনে একজন নারীর মাথার স্কার্ফ বাঁধতে বাঁধতে কান পেতে থাকার মতো সে প্রতি মূহুর্তে কান পেতে প্রতীক্ষা করতে থাকলো শোনার জন্য যে জাহাজের উপর আছড়ে পড়া তীব্র ঝঞ্ঝার আওয়াজের ভেতর দিয়ে কেউ তাকে নাম ধরে ডাকে কি না।’
অবশ্যই এরকম মোচড় ও আকস্মিক স্পৃষ্ট করার মতো উপাদানের অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, যেগুলো আমাদের সচকিত করে তোলে এবং যেগুলো ছেটগল্পের মূল উপাদান—যা অনেক সময় নীরবতাকে বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো প্রকাশ করে। হারমেন ম্যালভিলের ‘বিলি বাড’-এর দীর্ঘ প্যাসেজগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত সহজ বাক্য আমাদের হঠাৎ সচকিত করে: ‘কী ব্যাপার সশস্ত্র প্রভুর সঙ্গে?’ এবং এক আতঙ্কগ্রস্ত অনুভূতির মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি যে, এই ব্যক্তির ভেতরে কিছু একটা গভীর রহস্যময়তা আছে। পরে আবিষ্কার করি যে, জাহাজে নতুন যোগদান করা তরুণ নাবিক বিলি বাডের ভালো দিকগুলো তাকে ঈর্ষাতুর করে তুলেছে—এমন এক ঈর্ষায় সে আক্রান্ত যা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সশস্ত্র প্রভু ক্লেগার্টকে ম্যালভিল এইভাবে বর্ণনা করেন যে, স্বাভাবিক স্বভাব থেকে এই লোকের স্বভাবে পৌঁছাতে গেলে একজনকে ‘এই দুই স্বভাবের মধ্যস্থ মারাত্মক স্পেস’ অতিক্রম করতে হবে। আমি সব সময় অনুভব করেছি যে, এই ‘কী ব্যাপার...’ দিয়ে শুরু হওয়া বাক্যটি কিছুটা সশঙ্ক বিস্ময় সঞ্চারি—শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থের কারণেই—সম্ভবত এ কারণেই যে, এই শব্দবন্ধ আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যখন-তখন ব্যবহার করে থাকি।
কৌতুহলের বিষয় এই যে, এ রকম বেশি ঘটে সেইসব লেখকদের ক্ষেত্রে যারা ব্রিটিশ নন, কিন্তু ব্রিটিশদের ভাষার প্রতি বিশেষ যত্নশীল। নবকভের কথাই ধরা যাক; জীবনের প্রথম দিককার গল্পগুলো তিনি রাশিয়ান ভাষাতেই লিখে গেছেন। অথচ পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষার স্টাইলের ওস্তাদ হয়ে উঠেছেন। আরো যাদের নাম বলা যায়, যেমন, আর্হেন্তিনার বর্জেস, ক্যারেন বিক্সেন বা আসাক দিনেসন—যিনি তার বেশিরভাগ গল্পই ইংরেজিতে লিখেছেন; এবং অবশ্যই জোসেফ কনরাড, যিনি আসলে পোলিশ এবং আইজাক বশেভিস সিঙ্গার যিনি তার প্রথম দিককার গল্পগুলো ঈদ্দিস ভাষায় রচনা করেছিলেন। সম্ভবত ভিন্ন একটি ভাষার উপর দখল আনার জন্য যে সহিষ্ণুতা ও শৃঙ্খলা থাকা দরকার সেগুলোর ভেতর দিয়ে তারা যেতে পেরেছিলেন বলেই সেই ভাষার স্টাইল বিষয়ে তারা একটু বেশিই সচেতন। যে শব্দগুলো তাদের কাছে জন্মগতভাবে পরিচিত নয়, সেগুলোর চমৎকার ব্যবহারের বিষয়টা সম্ভবত তাদের বিশেষ আনন্দ দেয়।
শক্ত আবরণে আবৃত শঙ্খের মতো শব্দের সীমা কোনো শক্ত খোলসের মধ্যে বন্দী নয়। সুদূর অতীত থেকে ব্যবহৃত, বিবর্তিত হতে হতে শব্দগুলো লাভ করেছে জটিল প্যাটার্ন। শব্দগুলো যেন এমন সব বস্তু যার চারিদিকে প্রাগৈতিহাসিক কালের নানান বস্তুর পাথুরে প্রলেপ জমেছে—উদ্ভিদ, গুল্ম, খনিজ পদার্থ এবং শঙ্খ জাতীয় বস্তুর স্তর : বস্তুগুলো একসময় প্রাণ ধারণ করতো, সেই প্রাণ হলো নির্দিষ্ট যুগের সমসাময়িক ভাষার প্রাণ, এমনকি সেই যুগের বহু আগে বিলুপ্ত ভাষার প্রাণও। হয়তো সেগুলোর অর্থ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য বা পেশার উপর ভিত্তি করে। কিছুদিন আগে আমি ‘প্রোথিত’ শব্দটির অর্থ করেছিলাম ‘অনুন্মূলনীয়’। শব্দটি আসলে এসেছে রঞ্জক পদার্থের ব্যবসা থেকে। এক ধরনের পতঙ্গের শুষ্ক মৃতদেহ থেকে উৎপাদন করা হতো টকটকে লাল রঙ। শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফথ নাইট’ থেকে উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ভায়োলার সামনে অলিভিয়া তার মুখের আবরণ সরিয়ে নেয় এবং পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকা ভায়োলা বলে,‘চমৎকার, যদি ঈশ্বর এসবকিছু করে থাকেন।’ অলিভিয়া উত্তর দিচ্ছে,‘এ হলো শস্যদানা, জনাব, হাওয়া ও আবহাওয়াকে টেকসই রাখে।’
আমরা সেই শূন্যতা ও নীরবতার কথা ভেবেছি যা কোনো ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা যায় এবং আমি জেমস জয়েসের ‘দ্য ডেড’ গল্পের কথা ভাবছি, যেখানে অবশেষে রাতে গ্যাব্রিয়েল একটি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আয়ারল্যান্ডের বিরাট শুন্য প্রান্তরের বুকের উপর ধীরে ধীরে তুষারপাত হতে দেখছে :
‘ধুসর সমতল আর ঊষর পাহাড়গুলোর প্রতিটি অংশের সবখানেই নীরবে তুষারপাত হচ্ছে, তুষার পড়ছে অ্যালেন হ্রদের উপর, আরো পশ্চিম দিকে—বিক্ষুব্ধ শ্যাননের ঢেউয়ের উপরেও। পাহাড়ের উপরে যেখানে মাইকেল চিরনিদ্রায় শায়িত সেখানকার নিঃসঙ্গ গীর্জার প্রতি অংশের উপর পতিত হচ্ছে হালকা তুষার। কুঁকড়ে যাওয়া ক্রুসের উপর, প্রধান প্রস্তরখণ্ডের উপর, ছোট্ট সদর দরোজার ফলাগুলোর উপর, ন্যাড়া কাঁটাগাছগুলোর উপর পড়ে পাক খেয়ে খেয়ে গলে পড়ছে তুষারপাত। যখন সে শুনতে পাচ্ছে যে, মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে অবসন্ন তুষারপাত হচ্ছে, যেন অবসন্ন অন্তিম তুষার-পতন হচ্ছে সমস্ত জীবিত ও জড়ের উপর, তখন তার আত্মাও ধীরে ধীরে অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে।’
কিন্তু সবসময় পঠিত বিষয়ে বলার জন্য মুখিয়ে থাকা আমার জন্য সমিচীন হবে না। এই রচনার শিরোনাম অনুযায়ি ছোটগল্প লেখার আনন্দ ও বিপদের ফাঁদ নিয়েই আমাদের কথা বলতে হবে। সম্ভবত প্রথম পরমানন্দ তখনই পাওয়া যায় যখন অনুভব করি যে, একটি গল্প লেখার চমৎকার আইডিয়া পাওয়া গেছে। আমরা উত্তেজিত হই। আমরা বলি, ‘শূন্য থেকে’ এটা আমার উপর ভর করেছে। সেই শূন্যতা সম্পর্কেই আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, সবরকম আনন্দের মতোই এই আকস্মিক আনন্দকে আমরা সবখানে ছড়িয়ে দিতে চাই, বড় করে তুলতে চাই তাৎক্ষণিকভাবে। আমাদের আইডিয়ার সবটাই আমরা কাজে লাগাতে চাই, আমরা যা জানি এবং অনুভব করি সবই লিখে ফেলতে চাই, বিষয়ের ভিতর-বাহির সবদিকেই দৃষ্টি দিতে চাই এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার সম্ভবত এই যে, এ সম্পর্কে সবাইকে বলে বেড়াতে থাকি। বিনয়ের সঙ্গে আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করবো: ‘আপনার গল্পটি আসলে কী নিয়ে হতে যাচ্ছে?’ ফ্ল্যানারি ও’কনর বলেন:
‘মানুষের অভ্যাস আছে এরকম প্রশ্ন করার: ‘আপনার গল্পের থিম কী?’ আর তারা প্রত্যাশা করে যে আপনি এরকম একটি বিবৃতি প্রদান করবেন: “আমার থিম হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর যন্ত্রসভ্যতার অর্থনৈতিক চাপ” বা এইরকম কিছু। আর এরকম একটা বিবৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা খুব খুশি হয়ে আপনার কাছ থেকে বিদায় নেবে এবং ভাববে যে আর আপনার গল্পটি পাঠ করার আর প্রয়োজন নেই। কিছু মানুষের এরকম অপধারণা হতে পারে যে, গল্পটি পাঠের সময় প্রতিটি স্থানের অর্থ আলাদা করে তারা বুঝবেন, কিন্তু একজন লেখকের জন্য পুরো গল্পটাই একটা অর্থ বহন করে, কারণ একটি গল্প লেখকের জন্য একটি অভিজ্ঞতা, বিমূর্ততা নয়।’
সমস্যা হলো আমরা যদি আইডিয়ার উপর মাত্রাতিরিক্ত জোর দেই, আইডিয়াকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে থাকি এবং বিশ্লেষণ করে এর অর্থের বহুমাত্রিকতা বের করতে থাকি—তাহলে জীবন জেরবার হয়ে যেতে পারে। এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে বেঢপ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। ছোটগল্প যাইহোক না কেন, এর অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট রূপ থাকবে। সম্ভবত এটাকে একটি সুষম মৃৎপাত্র তৈরি করার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পাত্রটিকে অবশ্যই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অর্থাৎ (পাত্রের গঠনে) সঠিক ভারসাম্য থাকতে হবে।
সব রকম সৃষ্টিশীল শিল্প, এমনকি সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সাবলীল বলে মনে হয় যেগুলো, সেগুলো সম্পর্কে দুর্বোধ্য কিংবা বলা চলে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো এই যে, সেগুলো সৃষ্টি করতে এক ধরনের নির্লিপ্ততা ও দূরতর দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষা করতে হয়। আমার মাঝে-মধ্যে মনে হয় যে, গল্প লেখা হলো পথ চলতে চলতে কোনো জানালা দিয়ে আলো-ঝলমলো ঘরের অভ্যন্তরে তাকানো—আপনি হয়তো কৌতুহল জাগানিয়া, মনোমুগ্ধকর, গভীর কোনকিছু দেখবেন, তবে তা এক ফ্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আপনি দর্শক হিসেবে যতো দূরে থাকবেন, ফ্রেমটি সেই দূরত্বের সাপেক্ষে নির্দিষ্ট হবে। অর্থাৎ বাইরে থেকে জানালা গলিয়ে ভেতরটা দেখতে হলে আপনাকে সামান্য দূরত্ব রক্ষা করতে হবে। আপনি জানালার ভেতরের দৃশ্যের অংশ নন। সব ধরনের শিল্পের প্যারাডক্স হলো এই যে, সত্যি সত্যিই লিখতে সক্ষম হওয়ার জন্য লেখকের ভেতরে সর্বদাই উত্তাপ ও উত্তেজনা অবশ্যই থাকতে হবে। সুতরাং, একটি আইডিয়া মাথায় এলেই সেটা নিয়ে পুরোপুরি আত্মহারা না হয়ে বরং সেই আইডিয়ার উত্তাপ ও উত্তেজনা ভেতরে যদি অনুভব করা যায়, তবেই সেটা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। ‘আত্মহারা হওয়া’ কথাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একটি গল্পের ভেতর দিয়ে আমরা আসলে কোথায় পৌঁছাতে চাই, সেই লক্ষ্যবিন্দুতে আমাদের স্থির ও সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে, গল্পের পরিণতি-বিন্দুর একটা ধারণা আমদের মনে অবশ্যই থাকতে হবে, যদিও হতে পারে যে শুরুতে সেটা অনেকটা কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখা বস্তুর মতো ঝাপসাভাবে ধরা দেবে। অন্যথা, আসল উত্তেজনাকর আইডিয়া আমাদের দিব্যদৃষ্টিতে স্বচ্ছরূপে ধরা দেবে না। আইডিয়াটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই এমনকি আমাদের আতঙ্কিত করে দিয়ে আমাদের চিন্তা থেকে বহুদূরে সরে যেতে পারে। সত্যি বলতে কি, ছোটগল্প নির্দিষ্ট চিহ্ন দিয়ে স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়া পথে কালেভদ্রে স্বচ্ছন্দে চলতে পারে। ছোটগল্প লেখা মানে অনেকটা শূন্যে টানটান করে বাঁধা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা, যেন মাদকতাময় গর্জন ও ইন্দ্রিয়কাতর নায়াগ্রা জলপ্রপাতের দৃশ্য নিচে (দৃষ্টির আড়ালে) রেখে ভারসাম্য বজায় রেখে (দড়ির উপর দিয়ে) হাঁটা। শূন্যে ঝোলানো টান টান দড়ির উপর দিয়ে এইভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে হাঁটতে হাঁটতে নিচে তাকিয়ে একবার অন্তত দেখতে ইচ্ছে করবে অথচ দেখা সম্ভব হবে না, কারণ ভারসাম্য হারিয়ে দড়ি থেকে পড়ে গিয়ে জলপ্রপাতের অতলের গভিরে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে যেতে পারে। দড়ির দৈর্ঘ্য পেরিয়ে আমাদের পৌঁছাতে হবে অপর প্রান্তে এবং এটা করতে পারতে হবে কাজের স্বাভাবিক মাধুর্য বা সৌষ্ঠব বজায় রেখে। আমি এ বিষয়ে সচেতন যে, লেখালেখি সম্পর্কে কেউ একজন যেসব কথা বলবেন তার প্রতিটি কথারই বিরোধী কথা বলার সুযোগ আছে, কারণ লেখকদের উদ্দেশ্যে ও প্রবণতায় নানামাত্রার পার্থক্য আছে। যখন আমি আবেগ বর্জন করা ও নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে বিষয়কে দেখার কথা বলি, তখন আমার কাফকার কিছু কথা মনে পড়ে। কথাগুলো তিনি একজন তরুণকে বলেছিলেন যিনি তার লেখা কিছু গল্প কাফকাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন:
‘তোমার এগুলো অন্ধের মতো দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে পৃথিবীকে হাতড়ে বেড়ানোর সামিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হাতড়ে বেড়ানো থেমে যাবে এবং তারপর সম্ভবত তোমার প্রসারিত হাত গুটিয়ে আসবে, যেন হাতে আগুন ধরে গেছে। সম্ভবত তখন তুমি আর্তচিৎকার দেবে, তোমার কথাবার্তা অসংলগ্নভাবে জড়িয়ে যাবে বা দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি খাবে এবং তোমার চোখ বিস্ফারিত হবে, অনেক বিস্ফারিত হবে। এখন এগুলো কেবলমাত্র শব্দের সমাহার। কিন্তু শিল্প হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের ব্যাপার।’
অতএব পিছন ফিরে বলা যায়, একজন ছোটগল্পকারকে সময় ও স্পেসের বিভিন্ন সীমার ভেতরে কাজ করতে হয়, এবং এইসব পরিস্থিতিতে তিনি যোগাযোগের কঠিন সমস্যা অনুভব করেন। তিনি কী করার চেষ্টা করেন, যদি তিনি একজন শিল্পী হয়েই থাকেন তাহলে তার অবশ্য-কর্তব্য কী? তার চারদিকের ধ্বনি, ইমেজ, শব্দসমূহ এবং মানুষের পরষ্পরের মধ্যকার নীরবতা ইত্যাদি হট্টগোলে পরিপূর্ণ রকমারী উপাদান থেকে নির্দিষ্ট উপাদান নির্বাচন করতে হবে সেই নির্দিষ্ট উপাদান, যেগুলো তাকে আলোড়িত করে, স্পর্শ করে। সেইসব বিষয়, যেগুলোর সঙ্গে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন এবং সেগুলোকে সাজিয়ে একটি সম্পূর্ণ গল্প রচনা করতে পারেন। অনেকটা যেন এইরকম যে, তিনি নিজের শক্ত ভিত্তির উপরে দাঁড়ান। যে অনুসঙ্গগুলো তার মূল গল্পের কোন অংশই নয় সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামিয়ে মাথা ভারি করার তার কোন দরকারই নেই। আন্তন শেখভ তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখতে গিয়ে এ বিষয়ে লেখেন:
‘তুমি লিখেছ যে আমার গল্পের (দ্য নেম ডে পার্টি) নায়ক চরিত্রটি উন্নয়নযোগ্য। হায় ইশ্বর, আমি তো অনুভূতিশূন্য পিশাচ নই। সত্যি বলতে কি, এই গল্পের পেছনে অর্ধবর্ষ ব্যয় করে আমি অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি আনন্দের সঙ্গে আমার সমস্ত নায়ক চরিত্রের বিবরণদান করবো, তার বর্ণনা দেবো আমার উপলব্ধি, বোধ ও বিবেচনার উপর ভিত্তি করে। আমি তার সেই সময়কার আবেগানুভূতির বিবরণ দেবো যখন তার স্ত্রী প্রসব-বেদনায় ছটফট করে। আমি মধ্যরাতে ধাত্রী ও ডাক্তারের চা-পানের ঘটনা বর্ণনা করবো। আমি বৃষ্টিপাতের বিবরণ দেবো... এটা আমার জন্য অতি আনন্দের হবে; কারণ আমি যা চাই তা গভীরে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতে ভালোবাসি। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমি গল্পটি শুরু করেছিলাম সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে এই ভেবে যে খুব বেশি হলে অক্টোবরের ৪ তারিখের মধ্যে আমাকে গল্পটি শেষ করতে হবে।’
একদিক থেকে শেখভ অবশ্যই তার কাজ শেষ করার সর্বশেষ সময়ের কথা বলছেন, কিন্তু অনেক কিছু থেকে নির্দিষ্ট কিছু নির্বাচনের কথাও বলছেন। তিনি বলছেন যে, তার মনে যে গল্পটি আছে সেটি সম্পূর্ণ করে তুলতে অনেক আকর্ষণীয় উপাদান নির্মমভাবে বর্জন করে প্রযোজ্য উপাদান তিনি বেছে নেবেন।
শেখভ তার লেখালেখি সম্পর্কে অনেক চিঠি লিখেছেন—বেশিরভাগই লিখেছেন সম্পাদকদের কাছে, অন্য লেখকদের কাছে এবং হবু লেখকদের কাছে। আজকে এটা ভাবলে অবাক হতে হয় যে, তিনি তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তিনি একজন ভালো ডাক্তার ছিলেন এবং তার গল্পগুলোর ডিটেইল ও কিছু ঘটনা একজন চিকিৎসক হিসেবে তার পর্যবেক্ষণ থেকে উৎসারিত। এরকম এক সমালোচনার জবাব তিনি দিয়েছেন এভাবে:
‘কিন্তু লেখক কোনো পেস্ট্রি-শেফ নন, তিনি প্রসাধনী সামগ্রী প্রস্তুতকারকও নন এবং বিনোদনদানকারীও নন। লেখক তার দায়িত্ববোধের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি একজন সাধারণ সাংবাদিকের মতো। একজন সাংবাদিক তার পাঠকদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা সাংবাদিক হিসেবে তার খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে সৎ নগরপিতা, সুশীল নারী ও রেলওয়ের একনিষ্ঠ কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা মাথায় রেখে তার বিবরণকে সীমাবদ্ধ রাখবেন এরকম : একজন কেমিস্টের কাছে দুনিয়ায় কিছুই দুষিত নয়। এইরকম একজন কেমিস্টের মতোই একজন লেখকের অবস্থান। একজন লেখক অনায়াসেই মেনে নিতে পারেন যে, বিস্তির্ণ ল্যান্ডস্ক্যাপের মধ্যে জৈবসারের স্তুপগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং এই জীবনের ভালো দিকগুলোর মতোই প্রত্যেকটি মন্দ দিকও জীবনেরই অংশ।’
এটা সব সময় মনে থাকে না যে, যখন আমরা হাতে কলম নিয়ে সাদা কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকি, একজন লেখক হিসেবে অব্যাহতভাবে শুনে যেতে হয়—অন্তরের কান দিয়ে—সেইসব কথা যা তিনি লিখতে যাচ্ছেন—সে লেখা হ্রস্বই হোক কিংবা দীর্ঘ। লেখক কান পেতে শুনতে থাকেন ছন্দ। তিনি নৈঃশব্দ সম্বন্ধে সচেতন। কারণ শব্দ বা গুচ্ছশব্দ উচ্চারণ করলে যে ধ্বনি পাওয়া যায় সেই ধ্বনির সময়কাল সেগুলোর অর্থকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি প্রভাবিত করে আমাদের হৃদযন্ত্রকে। ধ্বনি উচ্চারণের গতি, ভঙ্গি, এমনকি অর্থের সাপেক্ষে আমাদের হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ে অথবা কমে। এই শোনার কাজে বাড়াবাড়ি ঘটে যেতে পারে। একটি লেখা অতিসচেতনতার কারণে বাড়াবাড়ি রকমের ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় স্থূল উপাদানের প্রয়োজন হয়, যাতে করে লেখাটিকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে। আজকালকার অনেক লেখকই এরকম করেছ্নে।
এবং একটি লেখা মানে কেবল শোনাই নয়, দেখাও বটে। একজন ফরাসি লেখিকার একটি সংকলনের ভূমিকায় কোলেট বলেছেন:
‘যদি তার আত্মজীবনীতে কোনো গল্প থেকে থাকে তো সেটা একজন জন্মগত পর্যবেক্ষণকারীর গল্প। জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি একজন ঋষির দৃষ্টিভঙ্গির মতোই, নিরাবেগ, এমনকি কঠোর। তিনি জানতেন যে, আমরা যে নিষ্পাপ অভিব্যক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করি তা একদিন না একদিন অপসৃত হবে এবং সেইজন্য আমরা দূর থেকে শিশুদের দিকে তাকিয়ে সেই নিষ্পাপ অভিব্যক্তির খানিকটা অবলোকন করতে পারি; এবং মানবসভ্যতা বিকাশ-পূর্ব কালের উপাদানগুলোর দিকে তাকিয়েও—পশু-পাখি, উদ্ভিদ ও খনিজ উপাদান। তিনি লেখালেখি সম্পর্কে বলেছেন : ‘শুধু তারই বিবরণ দাও যা তুমি দেখেছ। যে বিষয়গুলো তোমাকে আনন্দ দেয় সেগুলো দেখ দীর্ঘ সময় ধরে ও তীক্ষ্ণভাবে এবং যে বিষয়গুলো তোমাকে বেদনার্ত করে সেগুলো দেখ অধিকতর দীর্ঘসময় ধরে ও তীক্ষ্ণতরভাবে। অপ্রচলিত প্রকাশভঙ্গি অনুসরণ করো না, আলঙ্কারিক ভঙ্গি ও সুস্পষ্ট কাব্য করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করো।”
আমার মনে হয়, সার্বিভাবে একজন লেখকের প্রবণতা হলো এই যে, তিনি চারদিকে একটু ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন, সম্ভবত তার কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী তাকে বেশিরভাগ সময় নিঃসঙ্গ হয়ে স্থিরভাবে বসে থাকতে হয় বলে। লেখকের মনের মধ্যে আলসেমি পেয়ে বসার একটা ভয়ও কাজ করে—এর আংশিক কারণ হয়তো লেখার ধীরগতি। একবার ডিকেন্স সুইজারল্যান্ড থেকে তার এক প্রকাশককে লিখেছিলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আলস্য পেয়ে বসেছিল—এমন আলস্য যে মরিচা ধরে যাচ্ছে, গিলে খাচ্ছে আমাকে, পুরোপুরি আলসেমি, কোনভাবেই এই আলসেমি ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না।’ ‘আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না’, তিনি বলে চলেছেন :
‘কী অশেষ যন্ত্রণা পাচ্ছি, আলস্যের পর তাড়াহুড়ো করে কোন কাজ করা কতো কঠিন। পৃথিবীতে মনে হচ্ছে কিছু একটা আবিষ্কার করা সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু দ্রুততালে (লেখার) কাজ করার সংগ্রাম করা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এটা প্রায় অসম্ভব। আমার মনে হয় এখানে শহরের ব্যস্ত সড়কগুলো এবং মানুষের কোলাহল না থাকা এর পেছনে অংশত দায়ী। মনে হচ্ছে, নগরের ঐ বিষয়গুলো আমার করোটিকে সমৃদ্ধ করে। এরকম নির্জন স্থানে এক সপ্তাহ ধরে বা একরাতে আমি হয়তো কিছু একটা লিখতে পারি, তবুও লন্ডনের একটা দিন আমাকে স্বাভাবিক রাখে এবং আমাকে উজ্জীবীত করে। কিন্তু (লন্ডনের) সেই যাদুর প্রদীপ ছাড়া লেখার যে পরিশ্রম ও ক্লান্তি তা অনতিক্রম্য! আমার চরিত্রগুলো তাদের চারদিকের ভীড় ছাড়া যেন পুরোপুরি নিশ্চল।’
এটা কৌতুহল উদ্দীপক যে, নিজেকে জীবন-যাপনের প্রচণ্ড চাপ থেকে মুক্ত করতে এবং লেখায় মনোনিবেশ করতে ডিকেন্স প্রায়ই রাতে একা একা শহরের রাস্তায় বের হতেন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটতেন। তবে ভি.এস. প্রিচেট যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন তা ডিকেন্সের উল্টো : ‘নগরে মাত্রাতিরিক্ত বহুমত বিরাজ করে।’ তিনি একে তুলনা করেছেন এমন এক দেশে বসবাস করার সঙ্গে, যেখানে, তিনি বলেন : ‘একজন তার ভাবের নৌকা বেয়ে অবচেতনের অতলে চলে যেতে পারে।’
এতক্ষণে ছোটগল্প লেখার আনন্দ ও সঙ্কট নিয়ে আমি খুব বেশিকিছু বলিনি, আরো অনেক কম বলেছি এই বিষয়ে যে—কীভাবে ছোটগল্প লিখতে হয়। কিন্তু যদি সত্যি কথা বলি তাহলে বলতে হয় যে, কীভাবে লিখতে হয় তা কেউ কাউকে বলতে পারে না। আমি আংশিক জানি, কেন একজন মানুষ লেখে। এর কারণ এ-রকম হতে পারে যে, এই কোলাহলে পূর্ণ ছোট্ট জীবনকে পূর্ণতা দেওয়ার অভিপ্রায়ে আমরা কম হোক বেশি হোক একটা সম্পূর্ণ বা সম্পন্ন কিছু সৃষ্টি করতে চাই, আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিজ্ঞতালাভ করি তা একত্রিত করে তোলার জন্য—সে অভিজ্ঞতা জীবনের প্রেম, বেদনা, হতাশা, হাস্যরস, মিলনাত্মক বা বিয়োগাত্মক ঘটনা যাইহোক না কেন—এগুলোকে সংগ্রহ করে লিখে রাখা, যাতে পুরোপুরি হারিয়ে না যায়।
সবশেষে, এখন বিনয়ের সঙ্গে আমি ছোটগল্পের সীমার প্রকৃতি বিষয়ে আমার ধারণা নিয়ে কথা বলবো এবং কীভাবে এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগানো যায় তা বলবো। লেখিকা ফ্ল্যানারি ও’কনর সম্পর্কে আবার বলি—তিনি গল্প লিখেছেন প্রকটভাবে সীমাবদ্ধ মানুষদের নিয়ে যারা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, অথবা অসহিষ্ণুতা আক্রান্ত, আত্মকেন্দ্রিক এবং এইরকম সব অসম্পূর্ণতা-সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু তিনি অধিকতর দৃশ্যমান সীমাবদ্ধতায় থামেন নি। তিনি বলেন যে, প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অভিজ্ঞতা হলো মানুষ হিসেবে তার সীমাবদ্ধতার অভিজ্ঞতা। এই ‘হিউম্যান লিমিটেশন’ বা ‘মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা’, আনন্দের, বেদনার উভয়রকমই, আমার কাছে মনে হয়, একজন লেখক তার কাজের মধ্য দিয়ে এ-ই প্রকাশ করেন। এবং মহান লেখকেরা মানব জীবনের এই সীমাবদ্ধতা ও হতাশাগুলোই আমাদের সামনে পরিবেশন করেন।
এইভাবে এক গভীর প্রক্রিয়ায় আমাদের স্থির ও মুক্ত হওয়ার বোধ দান করা হয়। এটা জীবন থেকে পালানোর বিষয় নয়। সম্ভবত এই স্থিরতা, এই সম্পূর্ণতা আসে উৎকৃষ্টতম গল্প বা উপন্যাসের মতো যেকোন শিল্পকর্ম উপভোগের অভিজ্ঞতা থেকে, যা প্রকৃতিগতভাবে সম্পূর্ণ হয়েও সীমা মেনে চলে। আমি বলেছি যে আমরা একটা সময়ের জন্য মুক্ত কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই কেবল নয়। আমাদের ভেতরের এবং আমাদের চারপাশের হট্টগোল প্রতিহত করার একটা সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো পড়াশুনা করা। সত্যি বলতে কি, ‘কীভাবে পড়তে হয়’ সেটা শিখতে পারাই হচ্ছে ‘কীভাবে লিখতে হয়’ তা শেখার একমাত্র উপায়। এটা এমন নয় যে একজন লেখকের স্টাইল দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়া এবং তা অনুকরণ করা। বরং, এটা হলো গ্রন্থের সঙ্গে আবেগময় সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া—উদ্দীপিত হওয়া, সেই উদ্দীপনাকে বহন করে চলা, প্রশান্তিবোধ করা, উত্তেজনা লাভ করা এবং অধিকতর সাহসি হয়ে ওঠা। এবং যেহেটু জীবন ছোট, সুতরাং কেবলমাত্র শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহ পাঠ করার সময়ই আমাদের আছে—অন্যকথায় বলা যায়, খানিকটা নাকউঁচু করে নিয়ে ‘ভালো বই’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া গন্থগুলোর কথা ভেবে আমরা হাসতে পারি।
আসলে ‘ভালো বই’ কাকে বলে? কীভাবে আমরা একটি বইকে—বা এর গল্পকে—ভালো হিসেবে চিহ্নিত করব? এটা বললে আমাকে অহঙ্কারি মনে হতে পারে যে, একটি ভালো বই কখনোই জনপ্রিয় বেস্ট-সেলার নয় বা এর থেকে অনেক টাকা আয় হয়েছে বলেই সেটা ভালো বই নয়। নবোকভ তার একটি প্রবন্ধে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হয়তো ভালো বইয়ের সংজ্ঞার কাছাকাছি যে, একটি ভালো লেখা আমরা চিহ্নিত করতে পারি ‘মনন ও মেধা দিয়ে, শিরদাঁড়ায় অনুভূত চরম শিরকম্পন দ্বারা।’ একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক তিনটি চরিত্রের সমন্বয়—তার মধ্যে আছে কথক, শিক্ষক ও সম্মোহক—তবে তার ভেতরের সম্মোহনকারীই তাকে নিয়ন্ত্রন করে এবং সম্মোহন করার ক্ষমতা আছে বলেই তিনি একজন লেখক। সৌভাগ্যবশত আমরা স্বতস্ফূর্তভাবেই একটি ভালো বই চিনতে পারি, যদি আমাদের প্রচুর পড়ার অভ্যাস থাকে এবং পড়ার অভ্যাসকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা সীমাবদ্ধতা নিয়ে আর কথা না বললেও পারি। সর্বোৎকৃষ্টের কোনো সীমা থাকে না। যদি আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি মিনিট পড়াশুনার পিছনে ব্যয় করি তবুও এ বিষয়ে শেষ কথা বলতে পারবো না।
যদি আপনি লেখালেখি করার বাসনা পোষণ করে থাকেন এবং আমারই মতো শব্দের পর শব্দ সাজাতে গিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হন, তবে স্টাইলের ওস্তাদ ফরাসি লেখক ফ্লবার্টের কথা মনে রাখবেন, যিনি তার একটি চিঠিতে একবার উল্লেখ করেছিলেন, ‘ভাষা হচ্ছে একটি ভাঙ্গা কেটলির মতো যা বাজিয়ে আমরা ভালুক নাচানোর বোল তুলতে পারি, যখন সবসময় আমরা প্রতীক্ষা করি একটি তারা দয়া করে খসে গিয়ে (আমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে)।’
এলসপেথ ডেভি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর কালে স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী কথাশিল্পী। তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পী এবং এর শিক্ষকও। ১৯১৮ সালের ২০ মার্চ আয়ারশায়ারে তাঁর জন্ম। ১৯৯৫ সালের ১৪ নভেম্বর, ইডেনবার্গে তিনি লোকান্তরিত হন। এডিনবার্গ কলেজ অফ আর্টে পড়াশুনা এবং শিক্ষকতা করেছেন। প্রভাইডিং (১৯৬৫) ও ক্রিয়েটিং আ সেন্স (১৯৭১), আ ট্রাভেলার’স রুম—তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তবে তিনি গল্প সংকলন—দ্য স্পার্ক (১৯৬৮) এবং দ্য ম্যান হু ওয়ান্টড টু স্মিল বুকস এণ্ড আদার স্টোরিস (২০০১)—এর জন্য তিনি অধিক সমাদৃত। গল্পের জন্য ১৯৭৮ সালে ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড পুরস্কার পান। তার অধিকাংশ বই-ই বিখ্যাত ক্যালডার পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত। বৈবাহিক জীবনে তিনি আরেক স্কটিস লেখক ও দার্শনিক জর্জ এলডার ডেভির সঙ্গে গাঁট বেঁধে ছিলেন।
নূরুননবী শান্ত : কলামিস্ট, অনুবাদক, আবৃত্তিকার। জন্ম: ১৯৭১। শিক্ষা: ইংরেজি সাহিত্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। একশনএইড বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমে কর্মরত। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : গ্রামে প্রচলিত গল্প (২০০৯), মাওলা ব্রাদার্স; রাস্তা (২০১১), মাওলা ব্রাদার্স; মেঘের ওপারে আকাশ (২০১৪), ইছামতি প্রকাশন।
আকাশডাক : santonabi@yahoo.com
অনুবাদ: নূরুননবী শান্ত
আমার মনে হয়, একজন লেখক নিজে কীভাবে লেখেন বা অন্য কোন লেখক কীভাবে লেখেন এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দিতে পারবেন না। কেননা লেখার সময় উচ্চমার্গীয় সচেতনতা যেমন কাজ করে তেমনি সম্পূর্ণ অবচেতন থেকেও উঠে আসতে পারে একটি রচনা। অর্থাৎ লেখা কীভাবে হয়ে ওঠে তা নিয়ে আংশিক কথা বলা যায়, ব্যাখ্যাও করা যায় অংশত, কিন্তু সম্পূর্ণ করে কিছু বলা মুশকিল। কেউ হয়তো কারো লেখার টেকনিক, ফর্ম, লেখকের সৃষ্টিশীলতা, উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত কল্পনাশক্তি কোথা থেকে আসে এবং এটা আসলে ঠিক কী তা এক রহস্য বটে। অনেকেই এসব বিষয় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শেকসপিয়ারের কল্পনাশক্তি সম্পর্কে কলরিজ বলেছেন, ‘সৃষ্টিশীলতা ও বুদ্ধির শক্তি যেন তাঁর (শেকসপিয়র) মধ্যে কুস্তি লড়াইয়ে রত’।
তবে যেহেতু আমরা এখানে লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি, বিনয়ের সঙ্গে বলা ভালো যে, এই ব্যাখ্যা না করতে পারার ব্যাপারটা একটা সীমাবদ্ধতা— অনেক সময় এটা খুব যন্ত্রণাদায়ক—একজন লেখককে (যেকোন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিকে) আক্রান্ত করে। এই সীমাবদ্ধতাই একজন লেখককে এক ধরনের স্বাধীনতা দান করে এবং তার ভেতরে বন্দী থাকা কল্পনাশক্তিকে মুক্ত করে দেয়, যেন শক্ত করে এঁটে রাখা কোন ফোয়ারার মুখ হঠাৎ খুলে জলের তীব্র ধারাগুলো মুক্তিলাভ করে। একজন লেখক ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এই সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা হয়তো করতে পারেন।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রে, যদিও এটা আকারে হ্রস্ব অথবা সম্ভবত হ্রস্ব বলেই এর ভেতরে অনেক উপাদান ভরে দেওয়ার মতো শূন্যতা থাকে। এর ভেতরে থাকতে পারে বিরাট হ্রদের সমান স্পেস। এই স্পেসে থাকে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের সমাহার। এই স্পেস হতে পারে অনেক গভীর। অথবা ব্যবহৃত শব্দগুলো ধারণ করতে পারে গভীর অর্থ। প্রায়ই ছোটগল্পের শব্দগুলো কিছু বলে না, নীরব থাকে; তারপর নীরবতার ভেতরের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার মতো ঝলক বা শক্তিকে চেনা বা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় হয়তো। সত্যিকারের বড়মাপের লেখকের ভেতরে কল্পনা ও সচেতনতা এতটাই শক্তিশালী যে, তা বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসে পাঠককে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার মতোই আবিষ্ট করে দেয়। ইউজিন ইওনেস্ক বলেছেন :
‘যেসব প্রাত্যহিকতা ও মানসিক আড়ষ্টতা বাস্তবের বিস্ময় উপলব্ধি করা থেকে আমাদের বঞ্চিত রাখে, সেগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আমাদের অবশ্যই এমনকিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে যা অনেক সময় মনের উপর কঠিন মুগুরের আঘাত হানতে পারে।’
ভালো কোন রচনা থেকে পাওয়া এই আঘাত আমাদের সংবেদশীলতায় ক্ষত তৈরি করে না। অনেক সময় এ ধরনের আঘাত সত্যিই নিরীহ—লেখার সেই উপাদানগুলোকে অবদমিত রাখে যেগুলো গভীর নীরবতা, শূন্যতা বা আবেগ প্রকাশ করতে উদ্যত। কখনো কখনো আমাদের চরিত্ররা কোন শব্দই উচ্চারণ করতে সক্ষম নয়। হেনরি জেমসের এক ‘নারীর প্রতিকৃতি’র সেই জায়গাগুলো আমার মনে পড়ছে যেখানে একজন পুরুষ ও একজন নারী পরস্পরের সঙ্গে বাক্যালাপরত। পুরুষটি নারীকে কিছু একটা বলছে। নারী উত্তর দিচ্ছে না, আদৌ কিছু বলছে না, কেবলমাত্র তার হাতপাখা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে অভিব্যক্তি আড়াল করছে। এই প্রকাশভঙ্গি আমাদের আলোড়িত করে, কারণ, এই প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে আমরা একাত্ম হতে পারি—ভাব প্রকাশের শব্দের অভাব থেকে উৎসারিত ভয় আমাদের বাধ্য করে আবেগের তীক্ষ্ণতাকে ছদ্মবেশী রূপ দিতে।
এমনও হয় যে, উন্মত্ত ও বিক্ষুব্ধ প্রেক্ষাপটের বিপরীতে গড়ে তোলা পরিকল্পিত বা পরিশীলিত উপাদানের আনন্দদায়ক বা বিয়োগাত্মক সন্নিধির মধ্যে হঠাৎ আবির্ভূত হতে পারে সচেতনতার আঘাত। জোসেফ কনরাডের ‘টাইফুন’ সম্পর্কে ভেবে দেখা যেতে পারে। ‘টাইফুন’ দীর্ঘ গল্প হলেও এর মধ্যে আছে ছোটগল্পের স্বভাবসুলভ সীমা। ক্যাপ্টেন ম্যাকওয়ারের একটা ছবি আমরা পাই—একজন খাঁটি, দায়িত্ববোধসম্পন্ন আধিপত্যবাদ-বিরোধী মানুষ, নিজের চার্টরুমে বসে বাড়িতে স্ত্রীর কাছে পত্র লিখছে, যেমনটা সে অসংখ্য লোক লিখে থাকে। চিঠি লিখছে সেই স্ত্রীকে যে সিরিয়াসলি জানতে চায় ম্যাকওয়ার কোন্ সমুদ্রে আছে এবং প্রত্যাশা করে যেন ম্যাক এত দ্রুত ফিরে না আসে যাতে তার টি-পার্টির উত্তেজনা ভেঙে যায়। একটা ভয়ঙ্কর টাইফুন শুরুর ঠিক আগে ম্যাক স্ত্রীকে চিঠি লিখছে। ‘প্রিয়তমা আমার’, ম্যাক চিঠি শুরু করেছে, যেভাবে সে প্রতিটি চিঠি শুরু করে, ‘এ যাত্রায় আবহাওয়া অত্যন্ত চমৎকার’। সঙ্গে সঙ্গেই সামুদ্রিক ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ে জাহাজের উপর এবং আমরা ক্যাপ্টেনের নিম্নরূপ গার্হস্থ্য প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই:
‘প্রবল বিষণ্নতা বুকে নিয়ে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ঘাড়টাকে টেনে সোজা রেখে সে তার আড়ষ্ট হয়ে আসা আঙুলগুলো দিয়ে থুঁতনির ঠিক নিচে সামুদ্রিক ঝড় থেকে নিজেকে রক্ষা করার জ্যাকেটটার দড়ি শক্ত করে বাঁধতে লাগলো। আয়নার সামনে একজন নারীর মাথার স্কার্ফ বাঁধতে বাঁধতে কান পেতে থাকার মতো সে প্রতি মূহুর্তে কান পেতে প্রতীক্ষা করতে থাকলো শোনার জন্য যে জাহাজের উপর আছড়ে পড়া তীব্র ঝঞ্ঝার আওয়াজের ভেতর দিয়ে কেউ তাকে নাম ধরে ডাকে কি না।’
অবশ্যই এরকম মোচড় ও আকস্মিক স্পৃষ্ট করার মতো উপাদানের অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, যেগুলো আমাদের সচকিত করে তোলে এবং যেগুলো ছেটগল্পের মূল উপাদান—যা অনেক সময় নীরবতাকে বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো প্রকাশ করে। হারমেন ম্যালভিলের ‘বিলি বাড’-এর দীর্ঘ প্যাসেজগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত সহজ বাক্য আমাদের হঠাৎ সচকিত করে: ‘কী ব্যাপার সশস্ত্র প্রভুর সঙ্গে?’ এবং এক আতঙ্কগ্রস্ত অনুভূতির মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি যে, এই ব্যক্তির ভেতরে কিছু একটা গভীর রহস্যময়তা আছে। পরে আবিষ্কার করি যে, জাহাজে নতুন যোগদান করা তরুণ নাবিক বিলি বাডের ভালো দিকগুলো তাকে ঈর্ষাতুর করে তুলেছে—এমন এক ঈর্ষায় সে আক্রান্ত যা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সশস্ত্র প্রভু ক্লেগার্টকে ম্যালভিল এইভাবে বর্ণনা করেন যে, স্বাভাবিক স্বভাব থেকে এই লোকের স্বভাবে পৌঁছাতে গেলে একজনকে ‘এই দুই স্বভাবের মধ্যস্থ মারাত্মক স্পেস’ অতিক্রম করতে হবে। আমি সব সময় অনুভব করেছি যে, এই ‘কী ব্যাপার...’ দিয়ে শুরু হওয়া বাক্যটি কিছুটা সশঙ্ক বিস্ময় সঞ্চারি—শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থের কারণেই—সম্ভবত এ কারণেই যে, এই শব্দবন্ধ আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যখন-তখন ব্যবহার করে থাকি।
কৌতুহলের বিষয় এই যে, এ রকম বেশি ঘটে সেইসব লেখকদের ক্ষেত্রে যারা ব্রিটিশ নন, কিন্তু ব্রিটিশদের ভাষার প্রতি বিশেষ যত্নশীল। নবকভের কথাই ধরা যাক; জীবনের প্রথম দিককার গল্পগুলো তিনি রাশিয়ান ভাষাতেই লিখে গেছেন। অথচ পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষার স্টাইলের ওস্তাদ হয়ে উঠেছেন। আরো যাদের নাম বলা যায়, যেমন, আর্হেন্তিনার বর্জেস, ক্যারেন বিক্সেন বা আসাক দিনেসন—যিনি তার বেশিরভাগ গল্পই ইংরেজিতে লিখেছেন; এবং অবশ্যই জোসেফ কনরাড, যিনি আসলে পোলিশ এবং আইজাক বশেভিস সিঙ্গার যিনি তার প্রথম দিককার গল্পগুলো ঈদ্দিস ভাষায় রচনা করেছিলেন। সম্ভবত ভিন্ন একটি ভাষার উপর দখল আনার জন্য যে সহিষ্ণুতা ও শৃঙ্খলা থাকা দরকার সেগুলোর ভেতর দিয়ে তারা যেতে পেরেছিলেন বলেই সেই ভাষার স্টাইল বিষয়ে তারা একটু বেশিই সচেতন। যে শব্দগুলো তাদের কাছে জন্মগতভাবে পরিচিত নয়, সেগুলোর চমৎকার ব্যবহারের বিষয়টা সম্ভবত তাদের বিশেষ আনন্দ দেয়।
শক্ত আবরণে আবৃত শঙ্খের মতো শব্দের সীমা কোনো শক্ত খোলসের মধ্যে বন্দী নয়। সুদূর অতীত থেকে ব্যবহৃত, বিবর্তিত হতে হতে শব্দগুলো লাভ করেছে জটিল প্যাটার্ন। শব্দগুলো যেন এমন সব বস্তু যার চারিদিকে প্রাগৈতিহাসিক কালের নানান বস্তুর পাথুরে প্রলেপ জমেছে—উদ্ভিদ, গুল্ম, খনিজ পদার্থ এবং শঙ্খ জাতীয় বস্তুর স্তর : বস্তুগুলো একসময় প্রাণ ধারণ করতো, সেই প্রাণ হলো নির্দিষ্ট যুগের সমসাময়িক ভাষার প্রাণ, এমনকি সেই যুগের বহু আগে বিলুপ্ত ভাষার প্রাণও। হয়তো সেগুলোর অর্থ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য বা পেশার উপর ভিত্তি করে। কিছুদিন আগে আমি ‘প্রোথিত’ শব্দটির অর্থ করেছিলাম ‘অনুন্মূলনীয়’। শব্দটি আসলে এসেছে রঞ্জক পদার্থের ব্যবসা থেকে। এক ধরনের পতঙ্গের শুষ্ক মৃতদেহ থেকে উৎপাদন করা হতো টকটকে লাল রঙ। শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফথ নাইট’ থেকে উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ভায়োলার সামনে অলিভিয়া তার মুখের আবরণ সরিয়ে নেয় এবং পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকা ভায়োলা বলে,‘চমৎকার, যদি ঈশ্বর এসবকিছু করে থাকেন।’ অলিভিয়া উত্তর দিচ্ছে,‘এ হলো শস্যদানা, জনাব, হাওয়া ও আবহাওয়াকে টেকসই রাখে।’
আমরা সেই শূন্যতা ও নীরবতার কথা ভেবেছি যা কোনো ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা যায় এবং আমি জেমস জয়েসের ‘দ্য ডেড’ গল্পের কথা ভাবছি, যেখানে অবশেষে রাতে গ্যাব্রিয়েল একটি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আয়ারল্যান্ডের বিরাট শুন্য প্রান্তরের বুকের উপর ধীরে ধীরে তুষারপাত হতে দেখছে :
‘ধুসর সমতল আর ঊষর পাহাড়গুলোর প্রতিটি অংশের সবখানেই নীরবে তুষারপাত হচ্ছে, তুষার পড়ছে অ্যালেন হ্রদের উপর, আরো পশ্চিম দিকে—বিক্ষুব্ধ শ্যাননের ঢেউয়ের উপরেও। পাহাড়ের উপরে যেখানে মাইকেল চিরনিদ্রায় শায়িত সেখানকার নিঃসঙ্গ গীর্জার প্রতি অংশের উপর পতিত হচ্ছে হালকা তুষার। কুঁকড়ে যাওয়া ক্রুসের উপর, প্রধান প্রস্তরখণ্ডের উপর, ছোট্ট সদর দরোজার ফলাগুলোর উপর, ন্যাড়া কাঁটাগাছগুলোর উপর পড়ে পাক খেয়ে খেয়ে গলে পড়ছে তুষারপাত। যখন সে শুনতে পাচ্ছে যে, মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে অবসন্ন তুষারপাত হচ্ছে, যেন অবসন্ন অন্তিম তুষার-পতন হচ্ছে সমস্ত জীবিত ও জড়ের উপর, তখন তার আত্মাও ধীরে ধীরে অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে।’
কিন্তু সবসময় পঠিত বিষয়ে বলার জন্য মুখিয়ে থাকা আমার জন্য সমিচীন হবে না। এই রচনার শিরোনাম অনুযায়ি ছোটগল্প লেখার আনন্দ ও বিপদের ফাঁদ নিয়েই আমাদের কথা বলতে হবে। সম্ভবত প্রথম পরমানন্দ তখনই পাওয়া যায় যখন অনুভব করি যে, একটি গল্প লেখার চমৎকার আইডিয়া পাওয়া গেছে। আমরা উত্তেজিত হই। আমরা বলি, ‘শূন্য থেকে’ এটা আমার উপর ভর করেছে। সেই শূন্যতা সম্পর্কেই আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, সবরকম আনন্দের মতোই এই আকস্মিক আনন্দকে আমরা সবখানে ছড়িয়ে দিতে চাই, বড় করে তুলতে চাই তাৎক্ষণিকভাবে। আমাদের আইডিয়ার সবটাই আমরা কাজে লাগাতে চাই, আমরা যা জানি এবং অনুভব করি সবই লিখে ফেলতে চাই, বিষয়ের ভিতর-বাহির সবদিকেই দৃষ্টি দিতে চাই এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার সম্ভবত এই যে, এ সম্পর্কে সবাইকে বলে বেড়াতে থাকি। বিনয়ের সঙ্গে আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করবো: ‘আপনার গল্পটি আসলে কী নিয়ে হতে যাচ্ছে?’ ফ্ল্যানারি ও’কনর বলেন:
‘মানুষের অভ্যাস আছে এরকম প্রশ্ন করার: ‘আপনার গল্পের থিম কী?’ আর তারা প্রত্যাশা করে যে আপনি এরকম একটি বিবৃতি প্রদান করবেন: “আমার থিম হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর যন্ত্রসভ্যতার অর্থনৈতিক চাপ” বা এইরকম কিছু। আর এরকম একটা বিবৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা খুব খুশি হয়ে আপনার কাছ থেকে বিদায় নেবে এবং ভাববে যে আর আপনার গল্পটি পাঠ করার আর প্রয়োজন নেই। কিছু মানুষের এরকম অপধারণা হতে পারে যে, গল্পটি পাঠের সময় প্রতিটি স্থানের অর্থ আলাদা করে তারা বুঝবেন, কিন্তু একজন লেখকের জন্য পুরো গল্পটাই একটা অর্থ বহন করে, কারণ একটি গল্প লেখকের জন্য একটি অভিজ্ঞতা, বিমূর্ততা নয়।’
সমস্যা হলো আমরা যদি আইডিয়ার উপর মাত্রাতিরিক্ত জোর দেই, আইডিয়াকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে থাকি এবং বিশ্লেষণ করে এর অর্থের বহুমাত্রিকতা বের করতে থাকি—তাহলে জীবন জেরবার হয়ে যেতে পারে। এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে বেঢপ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। ছোটগল্প যাইহোক না কেন, এর অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট রূপ থাকবে। সম্ভবত এটাকে একটি সুষম মৃৎপাত্র তৈরি করার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পাত্রটিকে অবশ্যই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অর্থাৎ (পাত্রের গঠনে) সঠিক ভারসাম্য থাকতে হবে।
সব রকম সৃষ্টিশীল শিল্প, এমনকি সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সাবলীল বলে মনে হয় যেগুলো, সেগুলো সম্পর্কে দুর্বোধ্য কিংবা বলা চলে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো এই যে, সেগুলো সৃষ্টি করতে এক ধরনের নির্লিপ্ততা ও দূরতর দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষা করতে হয়। আমার মাঝে-মধ্যে মনে হয় যে, গল্প লেখা হলো পথ চলতে চলতে কোনো জানালা দিয়ে আলো-ঝলমলো ঘরের অভ্যন্তরে তাকানো—আপনি হয়তো কৌতুহল জাগানিয়া, মনোমুগ্ধকর, গভীর কোনকিছু দেখবেন, তবে তা এক ফ্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আপনি দর্শক হিসেবে যতো দূরে থাকবেন, ফ্রেমটি সেই দূরত্বের সাপেক্ষে নির্দিষ্ট হবে। অর্থাৎ বাইরে থেকে জানালা গলিয়ে ভেতরটা দেখতে হলে আপনাকে সামান্য দূরত্ব রক্ষা করতে হবে। আপনি জানালার ভেতরের দৃশ্যের অংশ নন। সব ধরনের শিল্পের প্যারাডক্স হলো এই যে, সত্যি সত্যিই লিখতে সক্ষম হওয়ার জন্য লেখকের ভেতরে সর্বদাই উত্তাপ ও উত্তেজনা অবশ্যই থাকতে হবে। সুতরাং, একটি আইডিয়া মাথায় এলেই সেটা নিয়ে পুরোপুরি আত্মহারা না হয়ে বরং সেই আইডিয়ার উত্তাপ ও উত্তেজনা ভেতরে যদি অনুভব করা যায়, তবেই সেটা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। ‘আত্মহারা হওয়া’ কথাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একটি গল্পের ভেতর দিয়ে আমরা আসলে কোথায় পৌঁছাতে চাই, সেই লক্ষ্যবিন্দুতে আমাদের স্থির ও সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে, গল্পের পরিণতি-বিন্দুর একটা ধারণা আমদের মনে অবশ্যই থাকতে হবে, যদিও হতে পারে যে শুরুতে সেটা অনেকটা কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখা বস্তুর মতো ঝাপসাভাবে ধরা দেবে। অন্যথা, আসল উত্তেজনাকর আইডিয়া আমাদের দিব্যদৃষ্টিতে স্বচ্ছরূপে ধরা দেবে না। আইডিয়াটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই এমনকি আমাদের আতঙ্কিত করে দিয়ে আমাদের চিন্তা থেকে বহুদূরে সরে যেতে পারে। সত্যি বলতে কি, ছোটগল্প নির্দিষ্ট চিহ্ন দিয়ে স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়া পথে কালেভদ্রে স্বচ্ছন্দে চলতে পারে। ছোটগল্প লেখা মানে অনেকটা শূন্যে টানটান করে বাঁধা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা, যেন মাদকতাময় গর্জন ও ইন্দ্রিয়কাতর নায়াগ্রা জলপ্রপাতের দৃশ্য নিচে (দৃষ্টির আড়ালে) রেখে ভারসাম্য বজায় রেখে (দড়ির উপর দিয়ে) হাঁটা। শূন্যে ঝোলানো টান টান দড়ির উপর দিয়ে এইভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে হাঁটতে হাঁটতে নিচে তাকিয়ে একবার অন্তত দেখতে ইচ্ছে করবে অথচ দেখা সম্ভব হবে না, কারণ ভারসাম্য হারিয়ে দড়ি থেকে পড়ে গিয়ে জলপ্রপাতের অতলের গভিরে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে যেতে পারে। দড়ির দৈর্ঘ্য পেরিয়ে আমাদের পৌঁছাতে হবে অপর প্রান্তে এবং এটা করতে পারতে হবে কাজের স্বাভাবিক মাধুর্য বা সৌষ্ঠব বজায় রেখে। আমি এ বিষয়ে সচেতন যে, লেখালেখি সম্পর্কে কেউ একজন যেসব কথা বলবেন তার প্রতিটি কথারই বিরোধী কথা বলার সুযোগ আছে, কারণ লেখকদের উদ্দেশ্যে ও প্রবণতায় নানামাত্রার পার্থক্য আছে। যখন আমি আবেগ বর্জন করা ও নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে বিষয়কে দেখার কথা বলি, তখন আমার কাফকার কিছু কথা মনে পড়ে। কথাগুলো তিনি একজন তরুণকে বলেছিলেন যিনি তার লেখা কিছু গল্প কাফকাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন:
‘তোমার এগুলো অন্ধের মতো দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে পৃথিবীকে হাতড়ে বেড়ানোর সামিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হাতড়ে বেড়ানো থেমে যাবে এবং তারপর সম্ভবত তোমার প্রসারিত হাত গুটিয়ে আসবে, যেন হাতে আগুন ধরে গেছে। সম্ভবত তখন তুমি আর্তচিৎকার দেবে, তোমার কথাবার্তা অসংলগ্নভাবে জড়িয়ে যাবে বা দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি খাবে এবং তোমার চোখ বিস্ফারিত হবে, অনেক বিস্ফারিত হবে। এখন এগুলো কেবলমাত্র শব্দের সমাহার। কিন্তু শিল্প হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের ব্যাপার।’
অতএব পিছন ফিরে বলা যায়, একজন ছোটগল্পকারকে সময় ও স্পেসের বিভিন্ন সীমার ভেতরে কাজ করতে হয়, এবং এইসব পরিস্থিতিতে তিনি যোগাযোগের কঠিন সমস্যা অনুভব করেন। তিনি কী করার চেষ্টা করেন, যদি তিনি একজন শিল্পী হয়েই থাকেন তাহলে তার অবশ্য-কর্তব্য কী? তার চারদিকের ধ্বনি, ইমেজ, শব্দসমূহ এবং মানুষের পরষ্পরের মধ্যকার নীরবতা ইত্যাদি হট্টগোলে পরিপূর্ণ রকমারী উপাদান থেকে নির্দিষ্ট উপাদান নির্বাচন করতে হবে সেই নির্দিষ্ট উপাদান, যেগুলো তাকে আলোড়িত করে, স্পর্শ করে। সেইসব বিষয়, যেগুলোর সঙ্গে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন এবং সেগুলোকে সাজিয়ে একটি সম্পূর্ণ গল্প রচনা করতে পারেন। অনেকটা যেন এইরকম যে, তিনি নিজের শক্ত ভিত্তির উপরে দাঁড়ান। যে অনুসঙ্গগুলো তার মূল গল্পের কোন অংশই নয় সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামিয়ে মাথা ভারি করার তার কোন দরকারই নেই। আন্তন শেখভ তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখতে গিয়ে এ বিষয়ে লেখেন:
‘তুমি লিখেছ যে আমার গল্পের (দ্য নেম ডে পার্টি) নায়ক চরিত্রটি উন্নয়নযোগ্য। হায় ইশ্বর, আমি তো অনুভূতিশূন্য পিশাচ নই। সত্যি বলতে কি, এই গল্পের পেছনে অর্ধবর্ষ ব্যয় করে আমি অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি আনন্দের সঙ্গে আমার সমস্ত নায়ক চরিত্রের বিবরণদান করবো, তার বর্ণনা দেবো আমার উপলব্ধি, বোধ ও বিবেচনার উপর ভিত্তি করে। আমি তার সেই সময়কার আবেগানুভূতির বিবরণ দেবো যখন তার স্ত্রী প্রসব-বেদনায় ছটফট করে। আমি মধ্যরাতে ধাত্রী ও ডাক্তারের চা-পানের ঘটনা বর্ণনা করবো। আমি বৃষ্টিপাতের বিবরণ দেবো... এটা আমার জন্য অতি আনন্দের হবে; কারণ আমি যা চাই তা গভীরে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতে ভালোবাসি। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমি গল্পটি শুরু করেছিলাম সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে এই ভেবে যে খুব বেশি হলে অক্টোবরের ৪ তারিখের মধ্যে আমাকে গল্পটি শেষ করতে হবে।’
একদিক থেকে শেখভ অবশ্যই তার কাজ শেষ করার সর্বশেষ সময়ের কথা বলছেন, কিন্তু অনেক কিছু থেকে নির্দিষ্ট কিছু নির্বাচনের কথাও বলছেন। তিনি বলছেন যে, তার মনে যে গল্পটি আছে সেটি সম্পূর্ণ করে তুলতে অনেক আকর্ষণীয় উপাদান নির্মমভাবে বর্জন করে প্রযোজ্য উপাদান তিনি বেছে নেবেন।
শেখভ তার লেখালেখি সম্পর্কে অনেক চিঠি লিখেছেন—বেশিরভাগই লিখেছেন সম্পাদকদের কাছে, অন্য লেখকদের কাছে এবং হবু লেখকদের কাছে। আজকে এটা ভাবলে অবাক হতে হয় যে, তিনি তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তিনি একজন ভালো ডাক্তার ছিলেন এবং তার গল্পগুলোর ডিটেইল ও কিছু ঘটনা একজন চিকিৎসক হিসেবে তার পর্যবেক্ষণ থেকে উৎসারিত। এরকম এক সমালোচনার জবাব তিনি দিয়েছেন এভাবে:
‘কিন্তু লেখক কোনো পেস্ট্রি-শেফ নন, তিনি প্রসাধনী সামগ্রী প্রস্তুতকারকও নন এবং বিনোদনদানকারীও নন। লেখক তার দায়িত্ববোধের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি একজন সাধারণ সাংবাদিকের মতো। একজন সাংবাদিক তার পাঠকদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা সাংবাদিক হিসেবে তার খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে সৎ নগরপিতা, সুশীল নারী ও রেলওয়ের একনিষ্ঠ কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা মাথায় রেখে তার বিবরণকে সীমাবদ্ধ রাখবেন এরকম : একজন কেমিস্টের কাছে দুনিয়ায় কিছুই দুষিত নয়। এইরকম একজন কেমিস্টের মতোই একজন লেখকের অবস্থান। একজন লেখক অনায়াসেই মেনে নিতে পারেন যে, বিস্তির্ণ ল্যান্ডস্ক্যাপের মধ্যে জৈবসারের স্তুপগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং এই জীবনের ভালো দিকগুলোর মতোই প্রত্যেকটি মন্দ দিকও জীবনেরই অংশ।’
এটা সব সময় মনে থাকে না যে, যখন আমরা হাতে কলম নিয়ে সাদা কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকি, একজন লেখক হিসেবে অব্যাহতভাবে শুনে যেতে হয়—অন্তরের কান দিয়ে—সেইসব কথা যা তিনি লিখতে যাচ্ছেন—সে লেখা হ্রস্বই হোক কিংবা দীর্ঘ। লেখক কান পেতে শুনতে থাকেন ছন্দ। তিনি নৈঃশব্দ সম্বন্ধে সচেতন। কারণ শব্দ বা গুচ্ছশব্দ উচ্চারণ করলে যে ধ্বনি পাওয়া যায় সেই ধ্বনির সময়কাল সেগুলোর অর্থকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি প্রভাবিত করে আমাদের হৃদযন্ত্রকে। ধ্বনি উচ্চারণের গতি, ভঙ্গি, এমনকি অর্থের সাপেক্ষে আমাদের হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ে অথবা কমে। এই শোনার কাজে বাড়াবাড়ি ঘটে যেতে পারে। একটি লেখা অতিসচেতনতার কারণে বাড়াবাড়ি রকমের ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় স্থূল উপাদানের প্রয়োজন হয়, যাতে করে লেখাটিকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে। আজকালকার অনেক লেখকই এরকম করেছ্নে।
এবং একটি লেখা মানে কেবল শোনাই নয়, দেখাও বটে। একজন ফরাসি লেখিকার একটি সংকলনের ভূমিকায় কোলেট বলেছেন:
‘যদি তার আত্মজীবনীতে কোনো গল্প থেকে থাকে তো সেটা একজন জন্মগত পর্যবেক্ষণকারীর গল্প। জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি একজন ঋষির দৃষ্টিভঙ্গির মতোই, নিরাবেগ, এমনকি কঠোর। তিনি জানতেন যে, আমরা যে নিষ্পাপ অভিব্যক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করি তা একদিন না একদিন অপসৃত হবে এবং সেইজন্য আমরা দূর থেকে শিশুদের দিকে তাকিয়ে সেই নিষ্পাপ অভিব্যক্তির খানিকটা অবলোকন করতে পারি; এবং মানবসভ্যতা বিকাশ-পূর্ব কালের উপাদানগুলোর দিকে তাকিয়েও—পশু-পাখি, উদ্ভিদ ও খনিজ উপাদান। তিনি লেখালেখি সম্পর্কে বলেছেন : ‘শুধু তারই বিবরণ দাও যা তুমি দেখেছ। যে বিষয়গুলো তোমাকে আনন্দ দেয় সেগুলো দেখ দীর্ঘ সময় ধরে ও তীক্ষ্ণভাবে এবং যে বিষয়গুলো তোমাকে বেদনার্ত করে সেগুলো দেখ অধিকতর দীর্ঘসময় ধরে ও তীক্ষ্ণতরভাবে। অপ্রচলিত প্রকাশভঙ্গি অনুসরণ করো না, আলঙ্কারিক ভঙ্গি ও সুস্পষ্ট কাব্য করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করো।”
আমার মনে হয়, সার্বিভাবে একজন লেখকের প্রবণতা হলো এই যে, তিনি চারদিকে একটু ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন, সম্ভবত তার কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী তাকে বেশিরভাগ সময় নিঃসঙ্গ হয়ে স্থিরভাবে বসে থাকতে হয় বলে। লেখকের মনের মধ্যে আলসেমি পেয়ে বসার একটা ভয়ও কাজ করে—এর আংশিক কারণ হয়তো লেখার ধীরগতি। একবার ডিকেন্স সুইজারল্যান্ড থেকে তার এক প্রকাশককে লিখেছিলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আলস্য পেয়ে বসেছিল—এমন আলস্য যে মরিচা ধরে যাচ্ছে, গিলে খাচ্ছে আমাকে, পুরোপুরি আলসেমি, কোনভাবেই এই আলসেমি ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না।’ ‘আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না’, তিনি বলে চলেছেন :
‘কী অশেষ যন্ত্রণা পাচ্ছি, আলস্যের পর তাড়াহুড়ো করে কোন কাজ করা কতো কঠিন। পৃথিবীতে মনে হচ্ছে কিছু একটা আবিষ্কার করা সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু দ্রুততালে (লেখার) কাজ করার সংগ্রাম করা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এটা প্রায় অসম্ভব। আমার মনে হয় এখানে শহরের ব্যস্ত সড়কগুলো এবং মানুষের কোলাহল না থাকা এর পেছনে অংশত দায়ী। মনে হচ্ছে, নগরের ঐ বিষয়গুলো আমার করোটিকে সমৃদ্ধ করে। এরকম নির্জন স্থানে এক সপ্তাহ ধরে বা একরাতে আমি হয়তো কিছু একটা লিখতে পারি, তবুও লন্ডনের একটা দিন আমাকে স্বাভাবিক রাখে এবং আমাকে উজ্জীবীত করে। কিন্তু (লন্ডনের) সেই যাদুর প্রদীপ ছাড়া লেখার যে পরিশ্রম ও ক্লান্তি তা অনতিক্রম্য! আমার চরিত্রগুলো তাদের চারদিকের ভীড় ছাড়া যেন পুরোপুরি নিশ্চল।’
এটা কৌতুহল উদ্দীপক যে, নিজেকে জীবন-যাপনের প্রচণ্ড চাপ থেকে মুক্ত করতে এবং লেখায় মনোনিবেশ করতে ডিকেন্স প্রায়ই রাতে একা একা শহরের রাস্তায় বের হতেন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটতেন। তবে ভি.এস. প্রিচেট যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন তা ডিকেন্সের উল্টো : ‘নগরে মাত্রাতিরিক্ত বহুমত বিরাজ করে।’ তিনি একে তুলনা করেছেন এমন এক দেশে বসবাস করার সঙ্গে, যেখানে, তিনি বলেন : ‘একজন তার ভাবের নৌকা বেয়ে অবচেতনের অতলে চলে যেতে পারে।’
এতক্ষণে ছোটগল্প লেখার আনন্দ ও সঙ্কট নিয়ে আমি খুব বেশিকিছু বলিনি, আরো অনেক কম বলেছি এই বিষয়ে যে—কীভাবে ছোটগল্প লিখতে হয়। কিন্তু যদি সত্যি কথা বলি তাহলে বলতে হয় যে, কীভাবে লিখতে হয় তা কেউ কাউকে বলতে পারে না। আমি আংশিক জানি, কেন একজন মানুষ লেখে। এর কারণ এ-রকম হতে পারে যে, এই কোলাহলে পূর্ণ ছোট্ট জীবনকে পূর্ণতা দেওয়ার অভিপ্রায়ে আমরা কম হোক বেশি হোক একটা সম্পূর্ণ বা সম্পন্ন কিছু সৃষ্টি করতে চাই, আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিজ্ঞতালাভ করি তা একত্রিত করে তোলার জন্য—সে অভিজ্ঞতা জীবনের প্রেম, বেদনা, হতাশা, হাস্যরস, মিলনাত্মক বা বিয়োগাত্মক ঘটনা যাইহোক না কেন—এগুলোকে সংগ্রহ করে লিখে রাখা, যাতে পুরোপুরি হারিয়ে না যায়।
সবশেষে, এখন বিনয়ের সঙ্গে আমি ছোটগল্পের সীমার প্রকৃতি বিষয়ে আমার ধারণা নিয়ে কথা বলবো এবং কীভাবে এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগানো যায় তা বলবো। লেখিকা ফ্ল্যানারি ও’কনর সম্পর্কে আবার বলি—তিনি গল্প লিখেছেন প্রকটভাবে সীমাবদ্ধ মানুষদের নিয়ে যারা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, অথবা অসহিষ্ণুতা আক্রান্ত, আত্মকেন্দ্রিক এবং এইরকম সব অসম্পূর্ণতা-সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু তিনি অধিকতর দৃশ্যমান সীমাবদ্ধতায় থামেন নি। তিনি বলেন যে, প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অভিজ্ঞতা হলো মানুষ হিসেবে তার সীমাবদ্ধতার অভিজ্ঞতা। এই ‘হিউম্যান লিমিটেশন’ বা ‘মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা’, আনন্দের, বেদনার উভয়রকমই, আমার কাছে মনে হয়, একজন লেখক তার কাজের মধ্য দিয়ে এ-ই প্রকাশ করেন। এবং মহান লেখকেরা মানব জীবনের এই সীমাবদ্ধতা ও হতাশাগুলোই আমাদের সামনে পরিবেশন করেন।
এইভাবে এক গভীর প্রক্রিয়ায় আমাদের স্থির ও মুক্ত হওয়ার বোধ দান করা হয়। এটা জীবন থেকে পালানোর বিষয় নয়। সম্ভবত এই স্থিরতা, এই সম্পূর্ণতা আসে উৎকৃষ্টতম গল্প বা উপন্যাসের মতো যেকোন শিল্পকর্ম উপভোগের অভিজ্ঞতা থেকে, যা প্রকৃতিগতভাবে সম্পূর্ণ হয়েও সীমা মেনে চলে। আমি বলেছি যে আমরা একটা সময়ের জন্য মুক্ত কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই কেবল নয়। আমাদের ভেতরের এবং আমাদের চারপাশের হট্টগোল প্রতিহত করার একটা সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো পড়াশুনা করা। সত্যি বলতে কি, ‘কীভাবে পড়তে হয়’ সেটা শিখতে পারাই হচ্ছে ‘কীভাবে লিখতে হয়’ তা শেখার একমাত্র উপায়। এটা এমন নয় যে একজন লেখকের স্টাইল দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়া এবং তা অনুকরণ করা। বরং, এটা হলো গ্রন্থের সঙ্গে আবেগময় সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া—উদ্দীপিত হওয়া, সেই উদ্দীপনাকে বহন করে চলা, প্রশান্তিবোধ করা, উত্তেজনা লাভ করা এবং অধিকতর সাহসি হয়ে ওঠা। এবং যেহেটু জীবন ছোট, সুতরাং কেবলমাত্র শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহ পাঠ করার সময়ই আমাদের আছে—অন্যকথায় বলা যায়, খানিকটা নাকউঁচু করে নিয়ে ‘ভালো বই’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া গন্থগুলোর কথা ভেবে আমরা হাসতে পারি।
আসলে ‘ভালো বই’ কাকে বলে? কীভাবে আমরা একটি বইকে—বা এর গল্পকে—ভালো হিসেবে চিহ্নিত করব? এটা বললে আমাকে অহঙ্কারি মনে হতে পারে যে, একটি ভালো বই কখনোই জনপ্রিয় বেস্ট-সেলার নয় বা এর থেকে অনেক টাকা আয় হয়েছে বলেই সেটা ভালো বই নয়। নবোকভ তার একটি প্রবন্ধে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হয়তো ভালো বইয়ের সংজ্ঞার কাছাকাছি যে, একটি ভালো লেখা আমরা চিহ্নিত করতে পারি ‘মনন ও মেধা দিয়ে, শিরদাঁড়ায় অনুভূত চরম শিরকম্পন দ্বারা।’ একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক তিনটি চরিত্রের সমন্বয়—তার মধ্যে আছে কথক, শিক্ষক ও সম্মোহক—তবে তার ভেতরের সম্মোহনকারীই তাকে নিয়ন্ত্রন করে এবং সম্মোহন করার ক্ষমতা আছে বলেই তিনি একজন লেখক। সৌভাগ্যবশত আমরা স্বতস্ফূর্তভাবেই একটি ভালো বই চিনতে পারি, যদি আমাদের প্রচুর পড়ার অভ্যাস থাকে এবং পড়ার অভ্যাসকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা সীমাবদ্ধতা নিয়ে আর কথা না বললেও পারি। সর্বোৎকৃষ্টের কোনো সীমা থাকে না। যদি আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি মিনিট পড়াশুনার পিছনে ব্যয় করি তবুও এ বিষয়ে শেষ কথা বলতে পারবো না।
যদি আপনি লেখালেখি করার বাসনা পোষণ করে থাকেন এবং আমারই মতো শব্দের পর শব্দ সাজাতে গিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হন, তবে স্টাইলের ওস্তাদ ফরাসি লেখক ফ্লবার্টের কথা মনে রাখবেন, যিনি তার একটি চিঠিতে একবার উল্লেখ করেছিলেন, ‘ভাষা হচ্ছে একটি ভাঙ্গা কেটলির মতো যা বাজিয়ে আমরা ভালুক নাচানোর বোল তুলতে পারি, যখন সবসময় আমরা প্রতীক্ষা করি একটি তারা দয়া করে খসে গিয়ে (আমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে)।’
এলসপেথ ডেভি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর কালে স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী কথাশিল্পী। তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পী এবং এর শিক্ষকও। ১৯১৮ সালের ২০ মার্চ আয়ারশায়ারে তাঁর জন্ম। ১৯৯৫ সালের ১৪ নভেম্বর, ইডেনবার্গে তিনি লোকান্তরিত হন। এডিনবার্গ কলেজ অফ আর্টে পড়াশুনা এবং শিক্ষকতা করেছেন। প্রভাইডিং (১৯৬৫) ও ক্রিয়েটিং আ সেন্স (১৯৭১), আ ট্রাভেলার’স রুম—তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তবে তিনি গল্প সংকলন—দ্য স্পার্ক (১৯৬৮) এবং দ্য ম্যান হু ওয়ান্টড টু স্মিল বুকস এণ্ড আদার স্টোরিস (২০০১)—এর জন্য তিনি অধিক সমাদৃত। গল্পের জন্য ১৯৭৮ সালে ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড পুরস্কার পান। তার অধিকাংশ বই-ই বিখ্যাত ক্যালডার পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত। বৈবাহিক জীবনে তিনি আরেক স্কটিস লেখক ও দার্শনিক জর্জ এলডার ডেভির সঙ্গে গাঁট বেঁধে ছিলেন।
নূরুননবী শান্ত : কলামিস্ট, অনুবাদক, আবৃত্তিকার। জন্ম: ১৯৭১। শিক্ষা: ইংরেজি সাহিত্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। একশনএইড বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমে কর্মরত। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : গ্রামে প্রচলিত গল্প (২০০৯), মাওলা ব্রাদার্স; রাস্তা (২০১১), মাওলা ব্রাদার্স; মেঘের ওপারে আকাশ (২০১৪), ইছামতি প্রকাশন।
আকাশডাক : santonabi@yahoo.com
0 মন্তব্যসমূহ