মেহেদী উল্লাহ
হেমন্তের মাঠ, পাকা ধান কৃষকের হাতে তুলে দিয়ে বুক খালি করে, আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করতো। মাস তিন-চারেক পানিবন্দি থাকার পর গ্রামের ল্যান্ডা-প্যান্ডাগুলোর সামনে তখন রাজ্যের গোল্লাছুটের মাঠ। মক্তব, স্কুল-মাদ্রাসায় গিয়ে এসে, বাবা-মার কড়া পাহারায় পড়ার টেবিল পার করে, গরুর জন্য মাঠ থেকে ঘাস আর ডোবা কি পুকুর থেকে কচুরিপানা কাটার দুপুর পার করে সবাই হাজির থাকতো হেমন্তের মাঠের অবাধ স্বাধীনতার পৃথিবীতে। গোল্লাছুটের নিয়ম জানেন তো? একদল ছুটবে, অন্যদল রুখবে, দাগ পার হওয়ার আগে ছুঁয়ে দিতে পারলেই ‘মরা’। দাগ পার হতে পারলে ‘পাক্কা’।
এ অবশ্য আটানব্বই কি নিরানব্বইয়ের এক গ্রাম্য খেলা, অন্যত্র কেমন জানিনা। তবে মন্দকপাল অতিরিক্ত কারো নিয়মটা বোধ হয় বেবাকে আছে। ধরুন,‘সাম বাটলেন’. দুটো দল হলো, এর আগে প্রতি জোড়া ‘সাম’ থেকে একজন এ দলে তো আরেকজন ও দলে ‘নাম বেটে’ বাছাই হতো। নয় জন নয় জন করে আঠারো জনের পর দেখলেন বেজোড় একজন রয়ে গেছে, তাকে কেউ নেয়নি, একটু ল্যাবা গোছেরও--তাকে আমারা নিতাম দুদলেই। বলতাম, ‘অই, তুই দুধভাত, দুই দলের লগেই খেলবি।’ বেচারা দুধভাতের মুখখানা আর পড়ন্ত বিকেলের নিস্তেজ সূর্যের দশা তখন এক। তখন ভাবতাম, দুধভাত হইলেই তো ভালা, বেশি খেলা যায়। এখন বড় হয়ে বুঝি যন্ত্রণা, দুধভাতের মুখে কেন উৎপাত দেখা দিত, হার-জিতের আনন্দ দুধভাতের কপালে নাই, যে দল হেরেছে তারই দল, যে দল জিতেছে ওটাও তারই। তাকে দেখতাম, জিতলেও তার কোন হৈ চৈ নাই, হারলেও মুখচুরি নাই। আমাদের দহুলিয়া গ্রামের নব্বই দশকের দুধভাত এমনই। তো, দুধভাতের হারেও ক্ষতি নাই, জিতেও লাভ নাই, পুরো খেলাটায় সে বলতে গেলে একটা ‘ফ্লাট কারেকটার’। দুধভাতের রোগও নাই, ক্ষয়ও নাই, হারাবার ভয়ও নাই। তাহলে তো বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তির উত্থানের যে আখ্যান, ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কিংবা ব্যক্তিসর্বস্বতা-- তার কোনো মানেই দুধভাতের নাই, সে উৎপাত বৈকি। আমাদের এই দুধভাত ‘ছোট প্রাণ’ও নয়, ‘বড় প্রাণ’ও নয়, এমনকি নাই প্রাণও নয়, তাহলে কি? সে হচ্ছে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ টাইপের প্রাণ। এই দুধভাতের সঙ্গে আমাদের বর্তমান বাংলা ছোটগল্প চর্চার একটা সম্বন্ধ কিন্তু আছে, সেই কথায় পরে ঢুকলেই সুবিধে।
ও, এর মধ্যে কথায় ঢুকে গেছে ‘ছোটপ্রাণ’। এই সময়ে বাংলা গল্প কি মরে যাচ্ছে না বেঁচে আসছে, আছে কি নেই-- তার সঙ্গে ‘ ছোটপ্রাণে’র সাজশ আছে। তাই বলি, ছোটগল্পের যারা খোঁজ খবর রাখছেন,ছোট প্রাণের সঙ্গে তারা কম বেশি পরিচিত। আমি স্পষ্ট বলছি, বাংলা ছোট গল্পে ছোটপ্রাণের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে, সেই সঙ্গে ছোট ব্যথা অথবা ছোটকথারও। কিন্তু আমি দেখছি, এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমার সঙ্গে একটু লাগতে বসেছেন। তিনি বলছেন, ছোট প্রাণটা আছে ঠিকই কিন্তু ছোট ব্যথা বা কথাটা আর নাই। অর্থাৎ ছোটপ্রাণের অধিকারী নিম্নবিত্তের হাজার হাজার সমস্যা। ইলিয়াস শোনাচ্ছেন, ‘নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী তাই ছোট থেকে আরও ছোটও হয়, এই মানুষটির সংস্কৃতির বিকাশ তো দূরের কথা; তার আগের অনেক অভ্যাস পর্যন্ত লুপ্ত হয়, কিন্তু নতুন সংস্কৃতির স্পন্দন সে কোথাও অনুভব করে না। এখন এই লোকটিকে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কি ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’র আদর্শ দিয়ে কাজ হবে?’ ধরে নিলাম হবে না। ইলিয়াসের কথা বোঝা গেল, লোকটির উপরে-নিচে-সামনে-পেছনে-উঠতে-বসতে-শয়নে-স্বপনে খালি সমস্যা আর সমস্যা। ছোটগল্পের সীমারেখা যা, তাতে নাকি শত শত সমস্যার ভেতর থেকে গল্পকারকেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ছোট প্রাণের বড় বড় সমস্যার ভীড়ে ছোটগল্প লেখার কাজটি নাকি জটিল হয়ে পড়েছে। আসলে কি তাই?
তবে আমরা দেখছি আর বাস্তবতা বলে কিছুই তো থেমে নেই, ছোটপ্রাণ কে এখন ৫০ টাকা দরে চাল কিনে খেতে হচ্ছে, ঋণের ফন্দিফিকিরে সুদ হয়ে উড়ে যাচ্ছে দিনমানে খাটুনির টাকা, লোকাল বাসে গরুর মতো সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে হাতল ধরে, বাচ্চ-কাচ্চার শিক্ষার অনিশ্চয়তাই নিয়ম-- এসবের ভেতর থাকতে থাকতে লোকটার প্রাণ কি আসলে ছোট প্রাণ? সমাজের শ্রেণী কাঠামোর বিচারে ছোট প্রাণ ঠিকই, কিন্তু মানুষ প্রাণ হিশেবে, অভিজ্ঞতার বিচারে, সহ্যের ক্ষমতায় লোকটা নিশ্চিত ‘কই মাছের প্রাণ’(এই অভিব্যক্তির দ্বারা ‘ছোটপ্রাণ’ কনসেপ্ট অকার্যকর হয়)।
ইলিয়াস গল্পের সংকটের কথায় চরিত্রকে দুষছেন, কিন্তু আমি দোষ দেবো লেখকের। মধ্যযুগে জীবন আরো সহজ ছিল, জীবনে এত জটিলতা ছিল না। তবে কেন গল্প-উপন্যাস লেখা হয়নি? হয়নি কারণ লেখক লেখেন নি। দায়টা পুরোপুরি লেখকের। সামাজিক কোনো দায় ছিল না তাঁদের। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে কালে তো গদ্যের চর্চা ছিল না, আপত্তি মাথায় নিয়েও বলা যায়, মানুষের সমস্যা, যারা ছোটগল্পে চরিত্র বা বিষয়ের প্রয়োজনে আসেন আর লেখকের সমস্যা এক নয়। চরিত্রের জটিলতার কারণে লেখককে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হলে বাংলা গল্প আর এগুবে না। বড় বড় সমস্যা, যা ব্যক্তিকে ছুঁয়ে গেছে আরো বড় প্রভাব দিয়ে, দৈনন্দিন হাজারটা সমস্যার চেয়ে এসমস্যার রেশ এক ধাক্কায় বেশি আঘাত দিয়ে গেছে-- এর ফলেই গল্পে ভালো ভালো সমাধান মিলেছে। যেমন ধরুন, উপনিবেশ বা পরাধীনতার সমস্যা। বাংলা গল্পের মোটাদাগের বিষয়বস্তু এরা। আবার সবগল্পকেই যে সমস্যামুখর করে তুলতে হবে এমন কি নিয়ম আছে। লেখকের যদি সামাজিক দায় থেকে থাকে. লেখক নিজেই ঠিক করবেন আসলে তিনি কি চাচ্ছেন, তিনি কি সমস্যার স্বরূপ আনবেন, সমস্যার সমাধানে কোনো মেসেজ দেবেন, না সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার ভিন্নমাত্রার যা চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়--এরকম কিছু নিয়ে আসবেন। এটা ঠিক যে, চরিত্রকে তার অনুযায়ী সমস্যার মধ্যে রেখেই বিকাশ করতে হয়। তখন একটা সমস্যার কথা বললে, দশটা সমস্যা ধাক্কাধাক্কি করে, কারণ এই যুগ সমস্যার যুগ। লেখকের কপালে-চিবুকে ঘাম জমে, তিনি আসলে কোন সমস্যার রাস্তা ধরে চরিত্রটিকে পাঠাবেন বা চরিত্র হাঁটবে নিজের মতো করে।
তবে আমি জোর দিয়ে বলছি, বাংলা ছোট গল্পের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’; যাকে আমাদের সমালোচকরা বা ছোটগল্পের আঙ্গিক বিশারদরা ছোটগল্প সহজে বোঝার শর্টকার্ট একটা রাস্তা ধরেছেন, সেই কবিতাটি( বর্ষা যাপন) ক্ষতিকর।
আমরা একাদশ শ্রেণীতে পরার সময়, রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পটি পড়ানোর আগেই শিক্ষককে ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’ আওড়ানো শুরু করতে দেখেছি, এখনো দেখছি। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এই কবিতার বাছাইকৃত অংশটুকুর চাপানো ব্যাখ্যা বাংলা গল্পের ক্ষতি করেছে, এখনো করছে।
কবিতাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যে ছোটপ্রাণের কথা বলেছেন, তা তো ‘পিঁপড়া’। বর্ষার জলে এই ছোট প্রাণটি এমন ভাবে ভেসে যায়, মনে হয় তা প্রকৃতিরই অংশ। তাতে দুঃখও ছোটখাটো, ব্যাথাও ছোটখাটো। পিঁপড়া তো আর হাতি নয়, মরার আগে রাগে গজগজ করে কলার বাগান মাথায় নিয়ে নাচবে। অবশ্য, পিঁপড়ারও তো সংসার আছে, খাদ্যের অন্বেষণ আছে, নাকি! সেই পিঁপড়াকে হঠাৎ বর্ষার জলে ভেসে যেতে দেখলে রবি বাবুর মতো সংবেদনশীল মানুষ তো একটু গাইবেনই। আর শেষটুকু, ওই যে,‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ ওহ, সাহিত্যের সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার। ওতে পিঁপড়ার জীবন চলে, গল্পের নয়। কারণ, জলে ভাসা পিপড়াটা যেই না পথের ধারে একটা খুটা পেল ওমনি জাপটে ধরলো, আর বেঁচে গেল। রবি ঠাকুরের তখন বলা উচিত ছিল,‘হা হা... পিঁপড়াটা শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ মানে ‘মরিতে গিয়াও বাঁচিয়া গেল।’ কিন্তু এটা তো কবিতা, সুযোগ পেয়ে সমালোচকও ‘ভূগোল’ বোঝালেন। আমরা এখন যাকে ঠিকটাই বুঝবো, ছোট প্রাণটা শেষ হয়েও শেষ হয়নি।
সে যাই হোক, ইলিয়াস ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে’, হাসান আজিজুল হক ‘ ছোটগল্প আছে নেই’ তে যাই বলুন না কেন,এটা ঠিক রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রচলিত এই সংজ্ঞা মানলে বাংলা ছোটগল্পের কপালে দুঃখ আছে। গল্প আর এগুবেনা, নতুন গল্পও তৈরি হবে না। ‘কাহিনী’ কেই আশ্রয় করে পড়ে থাকতে হবে বাংলা গল্পকে।
ইলিয়াস ছোটগল্পের খরখরে নতুন শরীরের কথা বলেছেন। ‘নতুন শরীর’ আসলে কি তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি।
এখন যারা গল্প লিখছেন, তারা আসলে পথ খুঁজছেন। নতুন গল্প তৈরির পথ। এখন প্রধান সংকট এটিই। কেউ কেউ বলছেন, অনেকদিন ভালো ছোটগল্প লেখা হয় না, ছোটগল্পের সেই দিন আর নাই।’ কথাটা কিন্তু মিথ্যা বলেন না, কিন্তু কেন? রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের দিকে যদি নজর দিই, তবে দেখি অধিকাংশ গল্পই তাঁর কাহিনী প্রধান। তিনি সমাজের ভালো-মন্দ মিশ্রিত একটা কাহিনী শুনিয়েছেন, তাতে অবশ্য চিন্তা একটা ছিল। গল্পটি পড়ার পর চিন্তার সঙ্গে পাঠকের দেখা হয়। যেমন ধরুন, ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পটি, পুরো গল্পে রতন আর পোস্ট মাস্টারের একটা ঘটনাই শুনতে হচ্ছে, শুধু সেই বাক্যটি, যেটি--‘পৃথিবীতে কে কাহার?’
এই বাক্যটি পাঠকের মনে একটা চিন্তা ধরায়। আবার, ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই.’ অথবা ধরুন, শাস্তি, আছে-- একটা সংলাপ--মরণ। গল্পগুচ্ছের শেষে আছে কোন গল্প কিভাবে লেখা হল, যাকে বলে প্রেক্ষাপট বা প্লট কথন। সেখানটা ভালো করে দেখলে মনে হয়, রবি বাবু বাস্তবতার একআনাকে কাহিনীতে ষোলআনায় মিটিয়েছেন। এভাবে অনেকেই, শরৎ বাবু তো ‘কাহিনী’ সাগর; যদিও তিনি দাবী করেন তিনি প্রথমে চরিত্র ঠিক করে নেন লেখার জন্য, তবু শেষে দেখা যায় চরিত্র কাহিনীতে হাবুডুবু খাচ্ছে। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেলায় মানিকে একটু প্রখরতা দেখি, চিন্তার রোদেলা দুপুর আর কাহিনীর সকাল। আমি বলছি না, কাহিনী এবং চিন্তা আলাদা, কিন্তু আমি বলছি, কে প্রধান? মানে, আপনি যদি সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ গল্পটি পড়েন তাহলে ধরতে পারবেন বিষয়টি। কিছু গল্প আপনি পড়েছেন, যে গুলোতে ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে, শুধুমাত্র ঘটনা শোনানোর জন্য ঘটনার পথে কিছু চরিত্রের হাত-পা বেঁধে ফলাফলের দিকে নিয়ে গেছে তাদের। উদাহরণ হতে পারে রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার, শরৎ. নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নজরুল। গল্পকার ঠিক করেছেন একটা ঘটনা আপনাকে শোনাবেন, ঘটনার প্রয়োজনেই একটা একটা চরিত্র গল্পে ভীড় জমালো, যেমন ধরুন ‘বিলাসী’, ‘রামের সুমতি, ‘রস’ ইত্যাদি। কিন্তু, একই সঙ্গে আপনি চরিত্র প্রধান গল্পও দেখছেন। আপনি ধরছেন একটা, চরিত্র করছে আরেকটা। আমরা বলি না যে, গল্পের শেষ না করে বোঝার উপায় নেই কি হবে? কেন বলি, বলি এজন্য, গল্পের ঘটনার আধিক্য এত কম যে আপনি বুঝতে পারছেন না ঘটনাটি কোথায় গড়াবে, কারণ পুরো মাঠ চরিত্রের দখলে। চরিত্র মাঝপথে এসে এমন কাণ্ড করলো যা আগের ঘটনাকে এলোমেলো করে সম্পূর্ণ নতুন একটা এন্ডিং এনে দিলো। এমন গল্প পড়ে আপনি ‘ভূতের কিচ্ছা’র মত কাউকে গিয়ে কাহিনী শোনাতে পারবেন না। কারণ, দেখছেন কাহিনী তো কিছুই নেই ওতে শুধু চরিত্র আর তার চিন্তার বিচরণ থাকছে। ওটা শোনাতে না পেরে আপনি কিন্তু বলছেন, গল্পটা আসলে কিছুই না, কিন্তু পড়তো ভালো লাগবে। এর অর্থ চরিত্র ও চিন্তা আপনার মন-মগজ দখল করেছে। চিন্তার কথা এজন্য বললা, একই রকম চিন্তার উপর নির্ভর করে একাধিক গল্পকার নতুন নতুন প্লট সাজাতে পারেন। যেমন ধরুন, ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পটি তো লেখা হয়ে গেছে, ওতে আর কিছু নেই; যা আছে তা চিন্তা, ‘পৃথিবীতে কে কাহার’ এই চিন্তার উপর দাঁড়ানো আপনি অন্য গল্প পড়েছেন, এখনো পড়ছেন। চিন্তা কিন্তু একটা থাকছেই।
আপনি লাতিন আমেরিকার গল্পগুলো পড়লে টের পাবেন, সেখানে প্রধান হচ্ছে ‘থিংকিং’ আমাদের এখানে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের কথা উঠলেই আমরা প্রথমেই বলি, জাদুবাস্তবতার কথা। আসলে ওই গল্পগুলো মোটেই জাদুবাস্তবতাসর্বস্ব নয়। বরং আমরাই এ কথা বলে ওই গল্পের অন্য জানালাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছি। লাতিন গল্পের থিংকিং বলতে আমি আরো একটি বিষয় আনছি, ওদের অধিকাংশ গল্পই দেখবেন, ‘বিশ্বজনীন’। এখানে বিশ্বজনীন শব্দটিকে একটু অন্যভাবে বুঝলে সুবিধে। যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথের গল্পের নারীরা, পদ্মাপারের; ‘শাস্তি’গল্পের নারীটি যে ধরণের সামাজিক অবস্থার শিকার অন্যদিকে অ্যাডগার এলান পোর ‘দ্যা ব্ল্যাক ক্যাট’ গল্পের নারীটির মৃত্যু পরিণতি কিন্তু ভিন্ন,আরো টেকনিক্যাল। পদ্মাপারের নারীটি যেমন, এর আগেই ইউরোপের নারী কিন্তু অনেক এগিয়েছে। এটা যে শুধু নারী বিষয়ক তাও নয়। এটা ঠিক, রবীন্দ্রনাথের সব গল্প কিন্তু বিশ্বজনীন নয়, অর্থ্যাৎ এধরণের একটি গল্প যদি অনুবাদ হয়ে পাশের দেশ নেপালেই যায়, তাহলেও ধরা, কারণ এই গল্প নেপালের মানুষ পড়বে কেন? প্রতিবেশ বলি,চরিত্র নির্মাণ বলি কিছুতেই খাপ খাবে না। অথচ রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিক লেওপোলদো লুগোনেস এর কথাই যদি ধরেন, তার একটি গল্প ‘ইসুর’। এই গল্পের কথক তাঁর পোষা বানরটিকে ভাষা শেখাতে চায়, শেষ পর্যন্ত বানরটি মারা যায়, অথচ মরার আগে মুখের ভাষা না ফুটলেও কথকের সঙ্গে বানটির মনের ইশারা ঘটে। এই গল্পটিকে আপনি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে নিয়ে যাবেন, সবার আগ্রহ থাকবে। একে আমি চিন্তা প্রধান গল্পই বলবো। বাংলায় যে এমন গল্প নেই তাও নয়, রবীন্দ্রনাথেরই আছে। আসলে গল্প বিভিন্ন রকম, নানা বৈচিত্র্যে পরিণত বাংলা গল্প।
মূলত কথাটা হচ্ছিল বাংলা গল্পের সনাতন শরীর নিয়ে। আমার কথা গল্পের প্লট, চিন্তা এবং চরিত্র নিয়ে। এগুলো পরস্পর এজন্য আলাদা, চরিত্র কাকে বেশি বহন করে, প্লট না চিন্তাকে। একটি ভালো গল্পে সব কিছুই থাকবে, তবে কে কার উপর প্রধান হবে তা বিবেচিত হতে পারে।
চরিত্র কিন্তু সব গল্পেই থাকছে, চরিত্র ছাড়া তো গল্প সম্ভব নয়। তবে গল্পভেদে ঘটনা প্রধান না চিন্তা প্রধান তার ভেদ অবশ্যই পাবেন। গল্প লিখতে এদের লাগবে কিন্তু এরা কে কার ওপর কত ডিগ্রি কোণে পরস্পরে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তাই হলো কথা। আর এদের কেন্দ্রে অবস্থান করে ভাষা। লেখকভেদে ভাষাও আলাদা আলাদা, ভালো গল্প পাঠকের কাছে এসব অবশ্য কোনো কাজের কথা নয়, তবে পঞ্চাশ দশকের আগের বাংলা গল্পকে বুঝতে এই কাঠামো খুব জরুরী।
বাংলা গল্পের হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কেন দরকারি মানুষ? হাসানের গল্পে কি আছে? কাজের কাজটি করেছেন ভাষায়। ‘ আত্মজা ও একটি করবী গাছ’র কথাই যদি ধরি--গল্পটিতে কাহিনী সামান্য, চরিত্রের চিৎকার বা শীৎকার অল্প, আছে যা ভাষা। নতুন ধরণের ভাষা। কিন্তু গল্প বলার ধরণ (স্টোরি টেলিং) পুরনো ধাঁচের। অর ইলিয়াস স্বয়ং, নতুন তার ভাষা , নতুন চরিত্রকে চালনা করার শক্তিটা, চরিত্র এত শক্তিশালী, ঘটনা কোনো ব্যাপার না। ইলিয়াসের চিন্তা ও যে খুব একটা বিশ্বজনীন তাও বলবো না। কিন্তু তিনি খেয়ে যাচ্ছেন ‘ভাষা’ দিয়ে। তাঁর ভাষার দক্ষতা ভালো, এ কারণে তার বর্ণনার শক্তিও ভালো। ইলিয়াসের একটি প্যারায় শব্দের যত শক্তি থাকে, তা বাংলা সাহিত্যে আর কারো নেই, সেই ভাষাও তাঁর চরিত্রের সংলাপের শক্তি। ইলিয়াসের চরিত্রের সংলাপ প্লট নির্মাণে কমই সাহায্য করে, চরিত্ররা যে যা তাই, ধরুন ড্রাইভারকে তিনি ড্রাইভার করেই সৃষ্টি করেন। বাস্তবের ড্রাইভার গালাগাল দেয়া ছাড়া কথা জানে না, গল্পের ড্রাইভারও তাই (কীটনাশকের কীর্তি)।
এই দেশ পাল্টেছে, মানুষ পাল্টেছে, বুর্জোয়া ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দিয়েছে, অথচ আমাদের গল্পের বদলে যাওয়া টা কি রীতিশুদ্ধ ছিল না? প্রথম দশকে শত-শত কবি পাই, অথচ গল্পকারের দেখা নাই। বাংলা কবিতা নিয়ে চারিদিকে চিৎকার-চেঁচামেটি-দলবাজি, অথচ গদ্যকারের গদ্য কই, সে তুলনায় নেই।
গল্পের নতুন ধরণ নিয়ে সমস্যায় লেখক, একশ বছরের সেই পুরনো গল্পই বার বার ঘুরে ফিসে আসে এই আঙ্গিনায়, প্রকাশকের গল্পের বই ছাপতে অনীহা, পত্রিকার পাতায় গল্পের জন্য শব্দ ধরা, আর আর পাঠক গল্প পড়েন না--বর্তমানে গল্পের সমস্যা এগুলো। তাহলে কি বাংলা গল্পের অবস্থাটা গোল্লাছুটের দুধভাতের মতো।
ইলিয়াস বলেছেন, লিটল ম্যাগাজিনে তিনি নতুন লেখকের নতুন ধরণের শরীরের গল্পের সন্ধান পান, কিন্তু ভয়, এদের কেউ পিঠ চাপড়ে বলবে না, ভালো ভালো। খ্যাতিমান লেখকের কাছে নিজের ব্যবহƒত রীতিটি বড় পোষমানা, নিজের রেওয়াজ ভাঙতে তাঁর মায়া হয়। ফলে তাঁরা নিরীক্ষাধর্মী গল্পের জন্য তরুনদের বাহবা দেন না, কিংবা প্রশংসা করেন না সমালোচকরাও। ফলে উল্টো ‘অ্যাভাগার্ড’ তরুণটিকে বেছে নিতে হয় আত্মহনণের পথ, তরুণ অল্পদিনে ঝরে পড়েন, কেউ কেউ আবার প্রশংসা পাবার জন্য চলতে শুরু করেন গল্পের সনাতন পথে।
তাই আর ছোটগল্পের মুমূর্ষু শরীরে প্রাণসঞ্চার সম্ভব হয় না। আমাদের ষাট কি সত্তর দশকের কবিতা থেকে প্রথম দশকের কবিতার ফারাক কত ষ্পষ্ট,তা নতুন নতুন, কবিরাই জায়গাটা তৈরি করেছেন, দলবাজি করে হলেও করেছেন, এতো কবিতার জন্য ভালো, অথচ গল্প, সেই রবীন্দ্রনাথেই পড়ে আছে, বড়জোড় কেউ কেউ সুবোধ ঘোষ বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হতে চেয়েছেন।
এত কিছুর মধ্যেও কেউ কেউ পুরনো-নতুন ধারা মিলিয়ে একটা অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন, এজন্যই কি তরুণদের ভালো লাগে শাহাদুজ্জামান, শহিদুল জহির, মামুন হুসাইন, সেলিম মোর্শেদ কিংবা অদিতি ফাল্গ–নীর গল্প?
আপনার যদি কাহিনী ফাঁদা-গদবাঁধা বাংলা গল্প পড়তে আর ভালো না লাগে, একঘেয়েমী লাগে তবে ছোটকাগজ উল্টে-পাল্টে দেখুন, পাবেনই পাবেন নানা সংকটের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত ছোটগল্পের খরখরে নতুন শরীর। বাংলা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই ‘খরখরে নতুন শরীর’ দরকার এখন। একটি গল্প নতুন ভাবে বলবার ঢং(আঙ্গিকের নিরীক্ষা), আর চিন্তার অনুরনণে শানিত ভাষার মাধুর্য্য--সেখানে রইল আপনার জন্যে। ভেবে দেখুন, বাংলা ছোটগল্পকে বেঁচে থাকতে হলে, দুধভাত দশা কাটাতে হলে একে ভাষা আর আঙ্গিকের নিরীক্ষার ক্ষত বিক্ষত দাগ নিয়েই চলতে হবে সামনে।
বি: দ্র:
লেখাটির রচনাকাল আগস্ট, ২০১১। স্থানে স্থানে অনিবার্য রেফারেন্স বা দৃষ্টান্ত নাই বিধায় আমার বক্তব্যের ওপরই বিশ্বাস রেখে আমল করতে হবে। প্রাসঙ্গিক ভাবে বলা প্রয়োজন, এটি কোনো গবেষণামূলক লেখা নয়, নিতান্তই বৈঠকি ঢংয়ের। আমার গল্প বিষয়ক নিজস্ব অনুধাবন, ফলে রেফারেন্স দিলে নিজেকেই হালকা করা হয়ে যায়। তারপরও যদি কারো মনে হয় রেফারেন্স দিলে ভালো হতো, তবে সরি, সময় করে উঠতে পারি নাই।
লেখক পরিচিতি
তরুণ গল্পকার।
‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার।
হেমন্তের মাঠ, পাকা ধান কৃষকের হাতে তুলে দিয়ে বুক খালি করে, আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করতো। মাস তিন-চারেক পানিবন্দি থাকার পর গ্রামের ল্যান্ডা-প্যান্ডাগুলোর সামনে তখন রাজ্যের গোল্লাছুটের মাঠ। মক্তব, স্কুল-মাদ্রাসায় গিয়ে এসে, বাবা-মার কড়া পাহারায় পড়ার টেবিল পার করে, গরুর জন্য মাঠ থেকে ঘাস আর ডোবা কি পুকুর থেকে কচুরিপানা কাটার দুপুর পার করে সবাই হাজির থাকতো হেমন্তের মাঠের অবাধ স্বাধীনতার পৃথিবীতে। গোল্লাছুটের নিয়ম জানেন তো? একদল ছুটবে, অন্যদল রুখবে, দাগ পার হওয়ার আগে ছুঁয়ে দিতে পারলেই ‘মরা’। দাগ পার হতে পারলে ‘পাক্কা’।
এ অবশ্য আটানব্বই কি নিরানব্বইয়ের এক গ্রাম্য খেলা, অন্যত্র কেমন জানিনা। তবে মন্দকপাল অতিরিক্ত কারো নিয়মটা বোধ হয় বেবাকে আছে। ধরুন,‘সাম বাটলেন’. দুটো দল হলো, এর আগে প্রতি জোড়া ‘সাম’ থেকে একজন এ দলে তো আরেকজন ও দলে ‘নাম বেটে’ বাছাই হতো। নয় জন নয় জন করে আঠারো জনের পর দেখলেন বেজোড় একজন রয়ে গেছে, তাকে কেউ নেয়নি, একটু ল্যাবা গোছেরও--তাকে আমারা নিতাম দুদলেই। বলতাম, ‘অই, তুই দুধভাত, দুই দলের লগেই খেলবি।’ বেচারা দুধভাতের মুখখানা আর পড়ন্ত বিকেলের নিস্তেজ সূর্যের দশা তখন এক। তখন ভাবতাম, দুধভাত হইলেই তো ভালা, বেশি খেলা যায়। এখন বড় হয়ে বুঝি যন্ত্রণা, দুধভাতের মুখে কেন উৎপাত দেখা দিত, হার-জিতের আনন্দ দুধভাতের কপালে নাই, যে দল হেরেছে তারই দল, যে দল জিতেছে ওটাও তারই। তাকে দেখতাম, জিতলেও তার কোন হৈ চৈ নাই, হারলেও মুখচুরি নাই। আমাদের দহুলিয়া গ্রামের নব্বই দশকের দুধভাত এমনই। তো, দুধভাতের হারেও ক্ষতি নাই, জিতেও লাভ নাই, পুরো খেলাটায় সে বলতে গেলে একটা ‘ফ্লাট কারেকটার’। দুধভাতের রোগও নাই, ক্ষয়ও নাই, হারাবার ভয়ও নাই। তাহলে তো বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তির উত্থানের যে আখ্যান, ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কিংবা ব্যক্তিসর্বস্বতা-- তার কোনো মানেই দুধভাতের নাই, সে উৎপাত বৈকি। আমাদের এই দুধভাত ‘ছোট প্রাণ’ও নয়, ‘বড় প্রাণ’ও নয়, এমনকি নাই প্রাণও নয়, তাহলে কি? সে হচ্ছে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ টাইপের প্রাণ। এই দুধভাতের সঙ্গে আমাদের বর্তমান বাংলা ছোটগল্প চর্চার একটা সম্বন্ধ কিন্তু আছে, সেই কথায় পরে ঢুকলেই সুবিধে।
ও, এর মধ্যে কথায় ঢুকে গেছে ‘ছোটপ্রাণ’। এই সময়ে বাংলা গল্প কি মরে যাচ্ছে না বেঁচে আসছে, আছে কি নেই-- তার সঙ্গে ‘ ছোটপ্রাণে’র সাজশ আছে। তাই বলি, ছোটগল্পের যারা খোঁজ খবর রাখছেন,ছোট প্রাণের সঙ্গে তারা কম বেশি পরিচিত। আমি স্পষ্ট বলছি, বাংলা ছোট গল্পে ছোটপ্রাণের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে, সেই সঙ্গে ছোট ব্যথা অথবা ছোটকথারও। কিন্তু আমি দেখছি, এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমার সঙ্গে একটু লাগতে বসেছেন। তিনি বলছেন, ছোট প্রাণটা আছে ঠিকই কিন্তু ছোট ব্যথা বা কথাটা আর নাই। অর্থাৎ ছোটপ্রাণের অধিকারী নিম্নবিত্তের হাজার হাজার সমস্যা। ইলিয়াস শোনাচ্ছেন, ‘নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী তাই ছোট থেকে আরও ছোটও হয়, এই মানুষটির সংস্কৃতির বিকাশ তো দূরের কথা; তার আগের অনেক অভ্যাস পর্যন্ত লুপ্ত হয়, কিন্তু নতুন সংস্কৃতির স্পন্দন সে কোথাও অনুভব করে না। এখন এই লোকটিকে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কি ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’র আদর্শ দিয়ে কাজ হবে?’ ধরে নিলাম হবে না। ইলিয়াসের কথা বোঝা গেল, লোকটির উপরে-নিচে-সামনে-পেছনে-উঠতে-বসতে-শয়নে-স্বপনে খালি সমস্যা আর সমস্যা। ছোটগল্পের সীমারেখা যা, তাতে নাকি শত শত সমস্যার ভেতর থেকে গল্পকারকেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ছোট প্রাণের বড় বড় সমস্যার ভীড়ে ছোটগল্প লেখার কাজটি নাকি জটিল হয়ে পড়েছে। আসলে কি তাই?
তবে আমরা দেখছি আর বাস্তবতা বলে কিছুই তো থেমে নেই, ছোটপ্রাণ কে এখন ৫০ টাকা দরে চাল কিনে খেতে হচ্ছে, ঋণের ফন্দিফিকিরে সুদ হয়ে উড়ে যাচ্ছে দিনমানে খাটুনির টাকা, লোকাল বাসে গরুর মতো সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে হাতল ধরে, বাচ্চ-কাচ্চার শিক্ষার অনিশ্চয়তাই নিয়ম-- এসবের ভেতর থাকতে থাকতে লোকটার প্রাণ কি আসলে ছোট প্রাণ? সমাজের শ্রেণী কাঠামোর বিচারে ছোট প্রাণ ঠিকই, কিন্তু মানুষ প্রাণ হিশেবে, অভিজ্ঞতার বিচারে, সহ্যের ক্ষমতায় লোকটা নিশ্চিত ‘কই মাছের প্রাণ’(এই অভিব্যক্তির দ্বারা ‘ছোটপ্রাণ’ কনসেপ্ট অকার্যকর হয়)।
ইলিয়াস গল্পের সংকটের কথায় চরিত্রকে দুষছেন, কিন্তু আমি দোষ দেবো লেখকের। মধ্যযুগে জীবন আরো সহজ ছিল, জীবনে এত জটিলতা ছিল না। তবে কেন গল্প-উপন্যাস লেখা হয়নি? হয়নি কারণ লেখক লেখেন নি। দায়টা পুরোপুরি লেখকের। সামাজিক কোনো দায় ছিল না তাঁদের। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে কালে তো গদ্যের চর্চা ছিল না, আপত্তি মাথায় নিয়েও বলা যায়, মানুষের সমস্যা, যারা ছোটগল্পে চরিত্র বা বিষয়ের প্রয়োজনে আসেন আর লেখকের সমস্যা এক নয়। চরিত্রের জটিলতার কারণে লেখককে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হলে বাংলা গল্প আর এগুবে না। বড় বড় সমস্যা, যা ব্যক্তিকে ছুঁয়ে গেছে আরো বড় প্রভাব দিয়ে, দৈনন্দিন হাজারটা সমস্যার চেয়ে এসমস্যার রেশ এক ধাক্কায় বেশি আঘাত দিয়ে গেছে-- এর ফলেই গল্পে ভালো ভালো সমাধান মিলেছে। যেমন ধরুন, উপনিবেশ বা পরাধীনতার সমস্যা। বাংলা গল্পের মোটাদাগের বিষয়বস্তু এরা। আবার সবগল্পকেই যে সমস্যামুখর করে তুলতে হবে এমন কি নিয়ম আছে। লেখকের যদি সামাজিক দায় থেকে থাকে. লেখক নিজেই ঠিক করবেন আসলে তিনি কি চাচ্ছেন, তিনি কি সমস্যার স্বরূপ আনবেন, সমস্যার সমাধানে কোনো মেসেজ দেবেন, না সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার ভিন্নমাত্রার যা চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়--এরকম কিছু নিয়ে আসবেন। এটা ঠিক যে, চরিত্রকে তার অনুযায়ী সমস্যার মধ্যে রেখেই বিকাশ করতে হয়। তখন একটা সমস্যার কথা বললে, দশটা সমস্যা ধাক্কাধাক্কি করে, কারণ এই যুগ সমস্যার যুগ। লেখকের কপালে-চিবুকে ঘাম জমে, তিনি আসলে কোন সমস্যার রাস্তা ধরে চরিত্রটিকে পাঠাবেন বা চরিত্র হাঁটবে নিজের মতো করে।
তবে আমি জোর দিয়ে বলছি, বাংলা ছোট গল্পের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’; যাকে আমাদের সমালোচকরা বা ছোটগল্পের আঙ্গিক বিশারদরা ছোটগল্প সহজে বোঝার শর্টকার্ট একটা রাস্তা ধরেছেন, সেই কবিতাটি( বর্ষা যাপন) ক্ষতিকর।
আমরা একাদশ শ্রেণীতে পরার সময়, রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পটি পড়ানোর আগেই শিক্ষককে ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’ আওড়ানো শুরু করতে দেখেছি, এখনো দেখছি। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এই কবিতার বাছাইকৃত অংশটুকুর চাপানো ব্যাখ্যা বাংলা গল্পের ক্ষতি করেছে, এখনো করছে।
কবিতাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যে ছোটপ্রাণের কথা বলেছেন, তা তো ‘পিঁপড়া’। বর্ষার জলে এই ছোট প্রাণটি এমন ভাবে ভেসে যায়, মনে হয় তা প্রকৃতিরই অংশ। তাতে দুঃখও ছোটখাটো, ব্যাথাও ছোটখাটো। পিঁপড়া তো আর হাতি নয়, মরার আগে রাগে গজগজ করে কলার বাগান মাথায় নিয়ে নাচবে। অবশ্য, পিঁপড়ারও তো সংসার আছে, খাদ্যের অন্বেষণ আছে, নাকি! সেই পিঁপড়াকে হঠাৎ বর্ষার জলে ভেসে যেতে দেখলে রবি বাবুর মতো সংবেদনশীল মানুষ তো একটু গাইবেনই। আর শেষটুকু, ওই যে,‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ ওহ, সাহিত্যের সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার। ওতে পিঁপড়ার জীবন চলে, গল্পের নয়। কারণ, জলে ভাসা পিপড়াটা যেই না পথের ধারে একটা খুটা পেল ওমনি জাপটে ধরলো, আর বেঁচে গেল। রবি ঠাকুরের তখন বলা উচিত ছিল,‘হা হা... পিঁপড়াটা শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ মানে ‘মরিতে গিয়াও বাঁচিয়া গেল।’ কিন্তু এটা তো কবিতা, সুযোগ পেয়ে সমালোচকও ‘ভূগোল’ বোঝালেন। আমরা এখন যাকে ঠিকটাই বুঝবো, ছোট প্রাণটা শেষ হয়েও শেষ হয়নি।
সে যাই হোক, ইলিয়াস ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে’, হাসান আজিজুল হক ‘ ছোটগল্প আছে নেই’ তে যাই বলুন না কেন,এটা ঠিক রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রচলিত এই সংজ্ঞা মানলে বাংলা ছোটগল্পের কপালে দুঃখ আছে। গল্প আর এগুবেনা, নতুন গল্পও তৈরি হবে না। ‘কাহিনী’ কেই আশ্রয় করে পড়ে থাকতে হবে বাংলা গল্পকে।
ইলিয়াস ছোটগল্পের খরখরে নতুন শরীরের কথা বলেছেন। ‘নতুন শরীর’ আসলে কি তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি।
এখন যারা গল্প লিখছেন, তারা আসলে পথ খুঁজছেন। নতুন গল্প তৈরির পথ। এখন প্রধান সংকট এটিই। কেউ কেউ বলছেন, অনেকদিন ভালো ছোটগল্প লেখা হয় না, ছোটগল্পের সেই দিন আর নাই।’ কথাটা কিন্তু মিথ্যা বলেন না, কিন্তু কেন? রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের দিকে যদি নজর দিই, তবে দেখি অধিকাংশ গল্পই তাঁর কাহিনী প্রধান। তিনি সমাজের ভালো-মন্দ মিশ্রিত একটা কাহিনী শুনিয়েছেন, তাতে অবশ্য চিন্তা একটা ছিল। গল্পটি পড়ার পর চিন্তার সঙ্গে পাঠকের দেখা হয়। যেমন ধরুন, ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পটি, পুরো গল্পে রতন আর পোস্ট মাস্টারের একটা ঘটনাই শুনতে হচ্ছে, শুধু সেই বাক্যটি, যেটি--‘পৃথিবীতে কে কাহার?’
এই বাক্যটি পাঠকের মনে একটা চিন্তা ধরায়। আবার, ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই.’ অথবা ধরুন, শাস্তি, আছে-- একটা সংলাপ--মরণ। গল্পগুচ্ছের শেষে আছে কোন গল্প কিভাবে লেখা হল, যাকে বলে প্রেক্ষাপট বা প্লট কথন। সেখানটা ভালো করে দেখলে মনে হয়, রবি বাবু বাস্তবতার একআনাকে কাহিনীতে ষোলআনায় মিটিয়েছেন। এভাবে অনেকেই, শরৎ বাবু তো ‘কাহিনী’ সাগর; যদিও তিনি দাবী করেন তিনি প্রথমে চরিত্র ঠিক করে নেন লেখার জন্য, তবু শেষে দেখা যায় চরিত্র কাহিনীতে হাবুডুবু খাচ্ছে। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেলায় মানিকে একটু প্রখরতা দেখি, চিন্তার রোদেলা দুপুর আর কাহিনীর সকাল। আমি বলছি না, কাহিনী এবং চিন্তা আলাদা, কিন্তু আমি বলছি, কে প্রধান? মানে, আপনি যদি সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ গল্পটি পড়েন তাহলে ধরতে পারবেন বিষয়টি। কিছু গল্প আপনি পড়েছেন, যে গুলোতে ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে, শুধুমাত্র ঘটনা শোনানোর জন্য ঘটনার পথে কিছু চরিত্রের হাত-পা বেঁধে ফলাফলের দিকে নিয়ে গেছে তাদের। উদাহরণ হতে পারে রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার, শরৎ. নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নজরুল। গল্পকার ঠিক করেছেন একটা ঘটনা আপনাকে শোনাবেন, ঘটনার প্রয়োজনেই একটা একটা চরিত্র গল্পে ভীড় জমালো, যেমন ধরুন ‘বিলাসী’, ‘রামের সুমতি, ‘রস’ ইত্যাদি। কিন্তু, একই সঙ্গে আপনি চরিত্র প্রধান গল্পও দেখছেন। আপনি ধরছেন একটা, চরিত্র করছে আরেকটা। আমরা বলি না যে, গল্পের শেষ না করে বোঝার উপায় নেই কি হবে? কেন বলি, বলি এজন্য, গল্পের ঘটনার আধিক্য এত কম যে আপনি বুঝতে পারছেন না ঘটনাটি কোথায় গড়াবে, কারণ পুরো মাঠ চরিত্রের দখলে। চরিত্র মাঝপথে এসে এমন কাণ্ড করলো যা আগের ঘটনাকে এলোমেলো করে সম্পূর্ণ নতুন একটা এন্ডিং এনে দিলো। এমন গল্প পড়ে আপনি ‘ভূতের কিচ্ছা’র মত কাউকে গিয়ে কাহিনী শোনাতে পারবেন না। কারণ, দেখছেন কাহিনী তো কিছুই নেই ওতে শুধু চরিত্র আর তার চিন্তার বিচরণ থাকছে। ওটা শোনাতে না পেরে আপনি কিন্তু বলছেন, গল্পটা আসলে কিছুই না, কিন্তু পড়তো ভালো লাগবে। এর অর্থ চরিত্র ও চিন্তা আপনার মন-মগজ দখল করেছে। চিন্তার কথা এজন্য বললা, একই রকম চিন্তার উপর নির্ভর করে একাধিক গল্পকার নতুন নতুন প্লট সাজাতে পারেন। যেমন ধরুন, ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পটি তো লেখা হয়ে গেছে, ওতে আর কিছু নেই; যা আছে তা চিন্তা, ‘পৃথিবীতে কে কাহার’ এই চিন্তার উপর দাঁড়ানো আপনি অন্য গল্প পড়েছেন, এখনো পড়ছেন। চিন্তা কিন্তু একটা থাকছেই।
আপনি লাতিন আমেরিকার গল্পগুলো পড়লে টের পাবেন, সেখানে প্রধান হচ্ছে ‘থিংকিং’ আমাদের এখানে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের কথা উঠলেই আমরা প্রথমেই বলি, জাদুবাস্তবতার কথা। আসলে ওই গল্পগুলো মোটেই জাদুবাস্তবতাসর্বস্ব নয়। বরং আমরাই এ কথা বলে ওই গল্পের অন্য জানালাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছি। লাতিন গল্পের থিংকিং বলতে আমি আরো একটি বিষয় আনছি, ওদের অধিকাংশ গল্পই দেখবেন, ‘বিশ্বজনীন’। এখানে বিশ্বজনীন শব্দটিকে একটু অন্যভাবে বুঝলে সুবিধে। যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথের গল্পের নারীরা, পদ্মাপারের; ‘শাস্তি’গল্পের নারীটি যে ধরণের সামাজিক অবস্থার শিকার অন্যদিকে অ্যাডগার এলান পোর ‘দ্যা ব্ল্যাক ক্যাট’ গল্পের নারীটির মৃত্যু পরিণতি কিন্তু ভিন্ন,আরো টেকনিক্যাল। পদ্মাপারের নারীটি যেমন, এর আগেই ইউরোপের নারী কিন্তু অনেক এগিয়েছে। এটা যে শুধু নারী বিষয়ক তাও নয়। এটা ঠিক, রবীন্দ্রনাথের সব গল্প কিন্তু বিশ্বজনীন নয়, অর্থ্যাৎ এধরণের একটি গল্প যদি অনুবাদ হয়ে পাশের দেশ নেপালেই যায়, তাহলেও ধরা, কারণ এই গল্প নেপালের মানুষ পড়বে কেন? প্রতিবেশ বলি,চরিত্র নির্মাণ বলি কিছুতেই খাপ খাবে না। অথচ রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিক লেওপোলদো লুগোনেস এর কথাই যদি ধরেন, তার একটি গল্প ‘ইসুর’। এই গল্পের কথক তাঁর পোষা বানরটিকে ভাষা শেখাতে চায়, শেষ পর্যন্ত বানরটি মারা যায়, অথচ মরার আগে মুখের ভাষা না ফুটলেও কথকের সঙ্গে বানটির মনের ইশারা ঘটে। এই গল্পটিকে আপনি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে নিয়ে যাবেন, সবার আগ্রহ থাকবে। একে আমি চিন্তা প্রধান গল্পই বলবো। বাংলায় যে এমন গল্প নেই তাও নয়, রবীন্দ্রনাথেরই আছে। আসলে গল্প বিভিন্ন রকম, নানা বৈচিত্র্যে পরিণত বাংলা গল্প।
মূলত কথাটা হচ্ছিল বাংলা গল্পের সনাতন শরীর নিয়ে। আমার কথা গল্পের প্লট, চিন্তা এবং চরিত্র নিয়ে। এগুলো পরস্পর এজন্য আলাদা, চরিত্র কাকে বেশি বহন করে, প্লট না চিন্তাকে। একটি ভালো গল্পে সব কিছুই থাকবে, তবে কে কার উপর প্রধান হবে তা বিবেচিত হতে পারে।
চরিত্র কিন্তু সব গল্পেই থাকছে, চরিত্র ছাড়া তো গল্প সম্ভব নয়। তবে গল্পভেদে ঘটনা প্রধান না চিন্তা প্রধান তার ভেদ অবশ্যই পাবেন। গল্প লিখতে এদের লাগবে কিন্তু এরা কে কার ওপর কত ডিগ্রি কোণে পরস্পরে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তাই হলো কথা। আর এদের কেন্দ্রে অবস্থান করে ভাষা। লেখকভেদে ভাষাও আলাদা আলাদা, ভালো গল্প পাঠকের কাছে এসব অবশ্য কোনো কাজের কথা নয়, তবে পঞ্চাশ দশকের আগের বাংলা গল্পকে বুঝতে এই কাঠামো খুব জরুরী।
বাংলা গল্পের হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কেন দরকারি মানুষ? হাসানের গল্পে কি আছে? কাজের কাজটি করেছেন ভাষায়। ‘ আত্মজা ও একটি করবী গাছ’র কথাই যদি ধরি--গল্পটিতে কাহিনী সামান্য, চরিত্রের চিৎকার বা শীৎকার অল্প, আছে যা ভাষা। নতুন ধরণের ভাষা। কিন্তু গল্প বলার ধরণ (স্টোরি টেলিং) পুরনো ধাঁচের। অর ইলিয়াস স্বয়ং, নতুন তার ভাষা , নতুন চরিত্রকে চালনা করার শক্তিটা, চরিত্র এত শক্তিশালী, ঘটনা কোনো ব্যাপার না। ইলিয়াসের চিন্তা ও যে খুব একটা বিশ্বজনীন তাও বলবো না। কিন্তু তিনি খেয়ে যাচ্ছেন ‘ভাষা’ দিয়ে। তাঁর ভাষার দক্ষতা ভালো, এ কারণে তার বর্ণনার শক্তিও ভালো। ইলিয়াসের একটি প্যারায় শব্দের যত শক্তি থাকে, তা বাংলা সাহিত্যে আর কারো নেই, সেই ভাষাও তাঁর চরিত্রের সংলাপের শক্তি। ইলিয়াসের চরিত্রের সংলাপ প্লট নির্মাণে কমই সাহায্য করে, চরিত্ররা যে যা তাই, ধরুন ড্রাইভারকে তিনি ড্রাইভার করেই সৃষ্টি করেন। বাস্তবের ড্রাইভার গালাগাল দেয়া ছাড়া কথা জানে না, গল্পের ড্রাইভারও তাই (কীটনাশকের কীর্তি)।
এই দেশ পাল্টেছে, মানুষ পাল্টেছে, বুর্জোয়া ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দিয়েছে, অথচ আমাদের গল্পের বদলে যাওয়া টা কি রীতিশুদ্ধ ছিল না? প্রথম দশকে শত-শত কবি পাই, অথচ গল্পকারের দেখা নাই। বাংলা কবিতা নিয়ে চারিদিকে চিৎকার-চেঁচামেটি-দলবাজি, অথচ গদ্যকারের গদ্য কই, সে তুলনায় নেই।
গল্পের নতুন ধরণ নিয়ে সমস্যায় লেখক, একশ বছরের সেই পুরনো গল্পই বার বার ঘুরে ফিসে আসে এই আঙ্গিনায়, প্রকাশকের গল্পের বই ছাপতে অনীহা, পত্রিকার পাতায় গল্পের জন্য শব্দ ধরা, আর আর পাঠক গল্প পড়েন না--বর্তমানে গল্পের সমস্যা এগুলো। তাহলে কি বাংলা গল্পের অবস্থাটা গোল্লাছুটের দুধভাতের মতো।
ইলিয়াস বলেছেন, লিটল ম্যাগাজিনে তিনি নতুন লেখকের নতুন ধরণের শরীরের গল্পের সন্ধান পান, কিন্তু ভয়, এদের কেউ পিঠ চাপড়ে বলবে না, ভালো ভালো। খ্যাতিমান লেখকের কাছে নিজের ব্যবহƒত রীতিটি বড় পোষমানা, নিজের রেওয়াজ ভাঙতে তাঁর মায়া হয়। ফলে তাঁরা নিরীক্ষাধর্মী গল্পের জন্য তরুনদের বাহবা দেন না, কিংবা প্রশংসা করেন না সমালোচকরাও। ফলে উল্টো ‘অ্যাভাগার্ড’ তরুণটিকে বেছে নিতে হয় আত্মহনণের পথ, তরুণ অল্পদিনে ঝরে পড়েন, কেউ কেউ আবার প্রশংসা পাবার জন্য চলতে শুরু করেন গল্পের সনাতন পথে।
তাই আর ছোটগল্পের মুমূর্ষু শরীরে প্রাণসঞ্চার সম্ভব হয় না। আমাদের ষাট কি সত্তর দশকের কবিতা থেকে প্রথম দশকের কবিতার ফারাক কত ষ্পষ্ট,তা নতুন নতুন, কবিরাই জায়গাটা তৈরি করেছেন, দলবাজি করে হলেও করেছেন, এতো কবিতার জন্য ভালো, অথচ গল্প, সেই রবীন্দ্রনাথেই পড়ে আছে, বড়জোড় কেউ কেউ সুবোধ ঘোষ বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হতে চেয়েছেন।
এত কিছুর মধ্যেও কেউ কেউ পুরনো-নতুন ধারা মিলিয়ে একটা অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন, এজন্যই কি তরুণদের ভালো লাগে শাহাদুজ্জামান, শহিদুল জহির, মামুন হুসাইন, সেলিম মোর্শেদ কিংবা অদিতি ফাল্গ–নীর গল্প?
আপনার যদি কাহিনী ফাঁদা-গদবাঁধা বাংলা গল্প পড়তে আর ভালো না লাগে, একঘেয়েমী লাগে তবে ছোটকাগজ উল্টে-পাল্টে দেখুন, পাবেনই পাবেন নানা সংকটের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত ছোটগল্পের খরখরে নতুন শরীর। বাংলা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই ‘খরখরে নতুন শরীর’ দরকার এখন। একটি গল্প নতুন ভাবে বলবার ঢং(আঙ্গিকের নিরীক্ষা), আর চিন্তার অনুরনণে শানিত ভাষার মাধুর্য্য--সেখানে রইল আপনার জন্যে। ভেবে দেখুন, বাংলা ছোটগল্পকে বেঁচে থাকতে হলে, দুধভাত দশা কাটাতে হলে একে ভাষা আর আঙ্গিকের নিরীক্ষার ক্ষত বিক্ষত দাগ নিয়েই চলতে হবে সামনে।
বি: দ্র:
লেখাটির রচনাকাল আগস্ট, ২০১১। স্থানে স্থানে অনিবার্য রেফারেন্স বা দৃষ্টান্ত নাই বিধায় আমার বক্তব্যের ওপরই বিশ্বাস রেখে আমল করতে হবে। প্রাসঙ্গিক ভাবে বলা প্রয়োজন, এটি কোনো গবেষণামূলক লেখা নয়, নিতান্তই বৈঠকি ঢংয়ের। আমার গল্প বিষয়ক নিজস্ব অনুধাবন, ফলে রেফারেন্স দিলে নিজেকেই হালকা করা হয়ে যায়। তারপরও যদি কারো মনে হয় রেফারেন্স দিলে ভালো হতো, তবে সরি, সময় করে উঠতে পারি নাই।
লেখক পরিচিতি
মেহেদী উল্লাহ
তরুণ গল্পকার।
‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার।
0 মন্তব্যসমূহ