কাজী লাবণ্য'র গল্প : আসিয়া

আশ্বিন মাস চলছে। কিছুদিন আগেও যে অসহনীয় গরম ছিল তা অনেকটাই কমে এসেছে। বরং এখন শেষ রাতের দিকে হালকা শীত শীত লাগে। গায়ে কাঁথা জড়াতে হয়। রাতের দিকে প্রায়ই কুয়াশা দেখা যায়। পুর্ণিমার অমিয় সুধা পান করার বা তার নান্দনিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার অবস্থা আসিয়া বেগমের নয়। তবে হ্যাঁ, ফকফকা জোনাক হলে রাত বিরেতে বের হতে ভয় লাগেনা, কেরোসিন তেলের খরচটাও কিছুটা কমে। গ্রামের মানুষ জোছনাকে এমনভাবেই দেখে অভ্যস্ত। তাছাড়া জোছনার সময় চোর আসেনা, এটা একটা অনেক বড় সুবিধা।


গত দুদিন ধরে ঘরের পেছনের এই জায়গাটায় লেবু গাছটার ঝোপের আড়ালে বসে আছে আসিয়া বেগম। দিন রাত তার এখানেই কেটে যাচ্ছে খেয়ে না খেয়ে। ৩দিন আগে তার জীবনে ঘটে গেছে এক অভাবনীয় চরম দুর্ঘটনা। আসিয়া কল্পনাও করতে পারে না তার জীবনে এমন ঘটনার কথা, একি হল ওর!

গ্রামের নাম চান্দের ডাঙ্গা। গ্রামের একেবারে পুর্ব সীমানায় প্রামাণিক পাড়া। পুরো পাড়ায় অবস্থাপন্ন প্রামাণিকদের বাস। তাদের বৃহৎ পরিবারের প্রায় সকলেই শহরে চলে গেছে। কারো বাড়িতে হয়ত তালা দেয়া, কারো বাড়িতে কেবল দুই বুড়োবুড়ি, কেউবা কাজের লোক রেখে চলে গেছে। আর কিছু পরিবার আছে যারা শিক্ষাদীক্ষায় তেমন কিছু করতে পারেনি তারা তলানী হিসেবে এই গ্রামের ভিটায় রয়ে গেছে।

পাড়ার পশ্চিম প্রান্তে কয়েক ঘর প্রান্তিক মানুষের বাস। যারা বংশাণুকক্রমিক ভাবে এই বসত ভিটায় আছে। অনেক বছর আগে প্রামাণিকদের কোন এক পুর্বপুরুষ এদেরকে এই জায়গাটুকু বাস করার জন্য দিয়েছিল। ক্রমে এরা এখানে কয়েকঘর হয়ে গেছে, জায়গা সংকুলান না হওয়ায় কেউ কেউ উঠে অন্যত্র চলে গেছে।

আসিয়ার স্বামীরা এখানে ৩ ভাই পরিবার নিয়ে থাকে। সকলেরই ঘরে বাঁশ ও পাটখড়ির বেড়া উপরে খড়ের চাল। বাড়ির পেছনে পুরাতন আমলের কর্তাদের তৈরি করে দেয়া একটি ইঁদারা আছে, সবাই সেখান থেকে পানির প্রয়োজন মেটায় আবার ক বছর আগে শহরের ডাঃ ভাইজান এসে পান করার জন্য একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে দিয়েছেন। এই বাড়ির পেছন থেকে যতদুর চোখ যায় সব ভাইজানদের জমি, এগুলা দেখাশোনা করাই আসিয়ার স্বামীদের কাজ।

তার বিনিময়ে ভাইজানরা যা দেয় তাই দিয়ে কোনমতে চলে যায় তাদের জীবন সংসার। বাড়ির ঠিক পাশেই একটি বিরাট উঁচু ছাতার মতো মহীরুহ আছে, যেটি একটি সিঁদুরে আমের গাছ। এই অতি বৃহদাকার প্রাচীন গাছটি যেন কোমল ছায়ায় ঘিরে রাখে এদের বসতভিটা সহ দুটি বাঁধানো অতি প্রাচীন কবর। কবরের গায়ে লেখা আছে, যারা এখানে শুয়ে আছেন তাদের নাম, তারিখ, সন। কবরের পরেই শুরু হয়েছে এক গহীন বাঁশঝাড়। যেখানে মনে হয় সুর্যালোক ঢোকেই না। কাটা হয় না বলেই এটি একটি নিবিড় ঘন অরণ্যের মতো হয়ে গেছে। সবাই বলে এর ভিতরে সাপ খোপ তো আছেই, জীন আছে ভুতও আছে। সকলেই এই বাঁশঝাড় এড়িয়েই চলে। তবে জীনভুত না থাকলেও সাপ, বেজী, বড় বড় লাল কালো পিঁপড়া, বিভিন্ন পাখি, চামচিকা, পেচা, বাদুর ইত্যাদি আছেই। আর আছে কিছু কিছু উইয়ের ঢিবি।

আসিয়া কিছুতেই এই বাঁশঝাড়ের ধারে কাছে যায় না, বাচ্চাদেরকেও যেতে দেয় না। আসিয়ার স্বামী মোজাফফর, তাকে গ্রামের সবাই মোজা বলেই ডাকে। বেশ পরিশ্রমী বোকা সোকা নির্ভেজাল মানুষ। নির্ভেজাল না হলে জমির মালিক ডাঃ ভাই, প্রফেসর ভাই ওকে এত ভালোবাসত না বা বিশ্বাস করত না। জমি জিরেতের বর্তমান মালিকেরা কয়েক ভাই তারা সকলেই বিভিন্ন শহরে থাকে। কেউ ঢাকায় থাকে। কেউ দেশের বাইরে থাকে। একজন রংপুর শহরে থাকে সেই মাঝে মাঝে আসে দেখাশোনা করে, কিছু নির্দেশ দিয়ে টিয়ে চলে যায়।

আসিয়ার ৩ কন্যা। ওদের স্বামী স্ত্রীর ইচ্ছা এবার সন্তান নিলেই একটি পুত্র হবে। এবং পুত্রের আশায় আশায় এক এক করে ৩ কন্যা এসেছে ওদের সংসারে। গ্রামে বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়েদের নাম এবং মায়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে পুত্র সন্তানের নাম রাখার রেওয়াজ অনুযায়ী ৩ কন্যার নাম রেখেছে যথাক্রমে- ময়না, মরিয়ম কিন্তু তিন নম্বরে এসে আর মিল না পেয়ে ছোটটির নাম রাখা হয় ডায়না।

৩ টি মেয়েই স্কুলে পড়ে। গ্রামে আজকাল বেশ কিছু নানা ধরনের স্কুল হয়েছে, এবং স্কুলে আনার জন্য গ্রামের বাচ্চাদেরকে নানারকম সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়। তাদের উৎসাহ দেবার জন্য বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখানো হয়। লেখাপড়ার জন্য না হলেও টাকা, গম বা অন্যান্য সুবিধার জন্য প্রায় সবাই বাচ্চাদেরকে স্কুলে পাঠায়। আজকাল পাড়াগাঁয়ের হতদরিদ্র ঘরের বাচ্চারাও জানে জাতীয় মাছ, পশু, পাখি ইত্যাদির নাম। অনেকেই জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারে, বিজয় দিবস স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে পার্থক্য না জানলেও দিন তারিখ গুলো অনেকেই জানে। তাদের অনেকেই জানে খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়।

বাচ্চাদের কাপড় চোপড়ের ব্যাপারে ভাইজান বা ভাবীকে বললে তারা পুরনোটার সাথে নতুনটাও দিয়ে দেয়। শীতের সময় কিছু গরম কাপড়, ঈদের সময় কাপড় চোপড় তারাই শহর থেকে পাঠায়। এই মানুষগুলোর অভাব আছে কিন্তু এরা তেমন ভাবে অভাবের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনা বলেই সকল অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে এবং নিজের অবস্থা মেনে নিয়ে মোটামুটি হাসিখুশিতেই জীবন পার করে দিতে পারে।

বিকেলে বাচ্চারা সবাই সিঁদুরে আম তলায়, এলাকার লোকজন যাকে বলে সেন্দুরাই আমের তলা সেখান থেকে আরো সংক্ষিপ্ত করে সেন্দুরার তলা বলে, সেখানে হাডুডু, কিতকিত, কাবাডি, বউচি ইত্যাদি খেলে। গ্রামের অনেক বিচার আচার হয় এই সেন্দুরার তলেই। ছোট বড় সকলের আড্ডার জায়গাও এই সেন্দুরার তলা, প্রতি শুক্রবারে এখানে বসে একটি অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র কাজেই এই জায়গাটি প্রায় সময়ই সরগরম থাকে।

দিন তিনেক আগের সন্ধ্যাবেলা। আসিয়া সংসারের সমস্ত কাজ কাম শেষ করে দুপুরে স্বামী বাচ্চাদেরকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে ঘরের পেছনে বসে নারিকেল পাতা থেকে ঝাড়ু বানানোর কাঠি তুলছিল। এমন সময় ময়নার বাপ হাঁক পারে

-ঐ ময়নার মা মুই আড়াবাড়িত গেনু বাঁশ কাটিতে, কান খাড়া থুস, কাটা হইলে ডাক দেইম আসিস, বাঁশ টানি বাইর করা নাগবে।

প্রতি বছর এই সময়ে মানে এই আশ্বিন মাসে বাঁশ কেটে বেড়া দিয়ে জমিতে শীতের শাক সবজি লাগাতে হয়। বেড়া না দিলে গরু ছাগল খেয়ে শেষ করে ফেলে। বাঁশ কাটার সময় দরকার হলে মোজা একজন কাউকে ডেকে সাহায্য নেয়। কিন্তু আজ ময়নার মাকেই ডাকছে, যেটা আসিয়ার একদম পছন্দ নয়।

মোজা বলে গেল কিন্তু আসিয়া কোন উত্তর দিল না, মোজা আবার বলল

-কোনটে শুনছিস? মুই গেনু কিন্তু, এই ডাকা মাত্র টপ করি আসিস। নাইলে পিঁপড়া কামড়ে এলা শ্যাষ করি দেবে।

- তা তোমরা আর কাকো ডাকান নাই ক্যানে, মুই ওগুলা পাও? ওগুলা কি মাইয়া মাইনষের কাম? আসিয়ার গলায় ঝাঁঝ ফুটে ওঠে।

-আরে কাইল সানজোত পাগলার হাটত ওই বান্দর বাবলুটাক কচনু যে কাইল এনা আসিস ত বাঁশ কাটিম, অরে বাদে ত সারাদিন বসি থাকনু, তা কই সে শালা ত আসিল না। আর আজ না কাটলে মেলা দেরি হয়া যাইবে। এই বাঁশ কাটিয়া বেড়া বানবার নাগবে তেমনি শাগের বিচি ছিটাইম, ধুনিয়া ছিটাইম, টামাটোর চাড়া আনি নাগাম। বলতে বলতে মোজা বাঁশঝাড়ের দিকে চলে যায়, আসিয়ার বড় রাগ হয়, সে সংসারের কোন কাজটা করেনা, গরুর জন্য ঘাস কাটা, গরুড় খাবার তৈরি করা রান্নার জন্য খড়ি টরি জোগাড় করা এছাড়া ঘড়ের কাজ, রান্না, ঘর-দোর পরিষ্কার করা সবই তো করে। কিন্তু এই বাঁশঝাড়ের ধারে কাছেও ওর যেতে ইচ্ছে করেনা। এই কথাটা বহুবার বলার পরেও ময়নার বাপের মনে থাকে না।

কিছুক্ষণ পরেই বেশ কবার ডাকলেও আসিয়া ওঠেওনা, কোন সাড়াও দেয়না। এবারে গলা আরো তুলে গর্জন দিয়ে ওঠে মোজা-

-ওই ময়নার মাও! এতবার ডাকোচো শুনিসনা? শালী কতা তোর কানত ঢোকে না? হাজারবার ডাকাওচো, তুই যে নড়িসে না, এ্যাটে মোক পিঁপড়া কামড়ে শ্যাষ করি দেইল নবাবের বেটি বসি খায়া খায়া তোর গাওত চরব নাগচে। আসিয়ার আর সহ্য হয়না। ওকি বসে খায়! সংসার সংসার করে মুখে ফেনা তোলার পরও এত কথা!

-মুই পাবান্নাও, কয়া দিচুনা বাঁশ টানির পাইম না। সওগ কাম করির পাইম ওই আড়াবারিত যাইম না, যাইম না, আর মুই বসি খাঁও, এ্যা? মুই বসি খাঁও, মোর গাওত চরব হইচে, বাপরে এত বড় কতা, দিন রাইত কাম করি করি মোর জেবন শ্যাষ আর তোমরা এগিলা কতা কন। মুই আর কোন কামে করিম না, দেখো তোমরা কি করেন।

মোজারও আর সহ্য হয়না। বাঁশ কাটা হয়ে গেছে, কেবল গোড়াটা ধরে দুজনে টান দিলেই হড়হড় করে বেড় হয়ে আসতো। কাল পাগলার হাটে, সেদিন হাটখোলার হাটে সে বাবলুকে আসতে বলেছিল, সে এলোনা সেকি মোজার দোষ? এদিকে সারা গায়ে পিঁপড়া, মশা একেবারে ছেকে ধরেছে। রাগ একেবারে মাথায় উঠে গেল...

-ওই হারামজাদি! মোর কতা তোর গাওত নাগোচে না, কামাই করি তোক খিলায় কায়? এ্যা? কার কামাই খায়া এত ত্যালেং ত্যালেং করি বেড়াস, অস হইচে? এ্যা? অস এক্কেরে বাইর করি দেইম ফকিন্নীর বেটি...

-খবরদার যা মোকত আইসে তাই কন্না ময়নার বাপ মুই ...

-ওই চুপ! এক্কেরে চুপ! একটা কতাও কবুনা...

-ক্যানে তোমরা দুনিয়ার কতা কওচেন, তাতে দোষ নাই আর মুই কইলে দোষ...

-ওই চুপ!

-চুপ না করলে কি করমেন! এ্যা! কি করমেন! সমান তেজে উত্তর দেয় আসিয়া

-দেকপার চাস কি করিম, দেকপার চাস! রাগে একেবারে অন্ধ হয়ে যায় মোজা । হঠাত ওর কি হয়-

-হারামজাদী যাহ তোক তালাক দিনু। এক তালাক! দুই তালাক!! তিন তালাক !!!

বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে আসিয়া। আচমকা কি দুনিয়াটা শব্দহীন হয়ে গেল! থেমে গেল জীবনের সকল কোলাহল! তা না হলে আসিয়ার কানে কিছুই ঢুকছে না কেন, সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায়, বাঁশঝাড়ের মাথা থেকে কিছু পাখি ডানা ঝাপটিয়ে ঊড়ে যায়। একি হলো! কি ঘটল! মোজাও কিছু ভেবে এমন করে নাই বা এমন কিছু ওর মাথাতেও ছিলনা, কিন্তু কেমন করে মুখ দিয়ে যেন বের হয়ে গেল! ঘটনার আগা মাথা কিছুই আর মাথায় ঢোকে না মোজার- সে বাঁশ, দা সব আছাড় মেরে ফেলে বাঁশটিতে একটা লাত্থি মেরে ঘটনাস্থল থেকে হনহনিয়ে চলে যায়। ততক্ষণে বাড়ির ছোটবড় সবাই এসে জড়ো হয় এবং বাতাসের আগে এ কথা রাষ্ট্র হয়ে যায় যে মোজা আসিয়াকে তালাক দিয়েছে।

এরপর থেকেই আসিয়া আর বাড়ি ঢোকেনি। নানা মানুষ নানা কথা বলতে লাগল। প্রথম দুদিন আসিয়া কিছু খায়নি, বড় মেয়েটি থালায় ভাত সাজিয়ে গ্লাসে পানি সহ নিয়ে এসেছিল, কিন্তু আসিয়া ছুয়েও দেখেনি। এবং এখান থেকে সে বুঝতে পারছিল ময়নার বাপও কিচ্ছু খায় নাই। প্রথম রাত পরের সারাদিন গত হবার পর পরদিন রাতে সবাই যে যার কত ঘুমিয়ে পড়লে মোজা পা টিপে টিপে এসে আসিয়ার পাশে হাত পা ছড়িয়ে বসে পরেছিল, বসেছিল সারারাত। দুজনের কেউই কোন কথা বলেনি কারো সাথে। আসিয়া কেবল নীরবে কেঁদেছে। গ্রামের মানুষ একেকজন একেক কথা বলাবলি শুরু করেছে। এক সময় আসিয়ার বড় জা এসে বসে খুব দরদ নিয়ে বলে-

-শুন ময়নার মাও কি আর করবু, আর তো কিছু করার নাই, যা হবার হয়া গেইচে, এটা তো আর ফিরানো যাইবেনা। তুঁই তোর ভাইয়ের বাড়ি চলি যা। আর এইটে না থাকিস। ছাওয়ারা থাকিল, মুই দেখাশোনা করিম। তুঁই চিন্তা না করিস। আসিয়া কোন কথা বলে না বা মুখ থেকে ঘোমটাও সরায়না, ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে মাটির দিকে। এরকম আরো দুচারজন দরদি পাড়া প্রতিবেশী সময় অসময়ে এসে নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ দিতে লাগল। পরদিন সকাল সকাল ময়নার বাপ কোথায় যেন চলে যায়, আসিয়া ওখানে বসেই সব কিছু টের পায়। মানুষটা আজ আড়াইদিন ধরি কিচ্ছু খায় নাই। না খাওয়া মানুষটা এই সাত সকালে কোনটে গেল ফির তাক কায় জানে। মোজার বড়ভাই বয়সের ভারে একেবারে ন্যুজ হয়ে পড়েছে, সেও আজ ঘরের বাইরে এসে একা একাই রাগের সুরে বলে-

-এই হারামজাদা একটা বলদ, একটা গাধা, বেটি সিয়ান হইছে এখন তার বিয়া শাদি দেওয়া নাগবে কোনটে সেগুলা চিন্তা করবে, নামাজ কালাম পড়বে, আল্লাক ডাকাইবে, তানা এই বুড়া বয়সে এখন এরা আজাইরা নাটক শুরু কচ্ছে... গাধাটাক ধরিয়া উচিত মতোন খড়ম দিয়া ডাঙ্গা দরকার...

গ্রামে এত বড় কাণ্ড ঘটে গেছে, ঘটারও আজ ৩ দিন হয়ে যাচ্ছে, কেবল বলাবলি, কানাঘুষার মধ্যেই কি আর সীমাবদ্ধ থাকবে! এর বিহিত করা লাগবে না! তালাক দেওয়ার পরও আসিয়া বেগম বেগানা পুরুষের ভিটায় বসে আছে, এ কেমন বেলেল্লাপনা, নাহ এসব তো চলতে দেয়া যায়না। আল্লাহর দুনিয়া থেকে ধর্ম কর্ম কি উঠে গেল! এসব দেখার কি কেউ নাই! বিকেলের দিকে আসরের নামাজের পর প্রায় সকল নামাজি এবং মসজিদের হুজুর সহ বেশ কিছু মানুষ এসে বসে সেন্দুরার তলে। এসেই তারা মোজা! মোজা! বলে হাক ছাড়ে কিন্তু মোজা তো নাই। কেউ বলে মোজা পালিয়ে গেছে। কেউ বলে হারামজাদা আবার কোনটে মরবার বাদে গেইচে। অনেকেই হুজুরকে জিজ্ঞেশ করে- এখন উপায় কি ? মোজা তো বউকে তিন তালাক দিছে সব্বাই শুনছে কাজেই আর তো কোন উপায় নাই, তাইনা হুজুর? একেক জন একেক কথা, নিজের মতামত, প্রশ্ন ইত্যাদি করে, আর কানাঘুষা চলতেই থাকে।

আশ্বিনের সংক্ষিপ্ত বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসার আগেই অনতিদূর থেকে শোনা যায় গাড়ির আওয়াজ। সবাই উৎকর্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে, সকলের জোড়া জোড়া কৌতূহলী চোখের সামনে গাড়ি এসে থামলে দেখা যায় আরোহী আর কেউ নয় শহরের ডাঃ ভাইজান আর মোজা। সকলের কলগুঞ্জন থেমে যায়। এই ডাঃ থাকেন শহরে, তাঁর পুর্বপুরুষ এই প্রামাণিক পাড়াতেই থাকতেন। তিনি থাকেন শহরে কিন্তু প্রতি শুক্রবারে এসে গ্রামের সব মানুষের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেন। ফি তো নেনই না উলটা আরো সবার ঔষধ দেন পথ্যের জন্য টাকা দিয়ে যান। গ্রামের মানুষের বিপদে আপদে সব সময় তিনি পাশে থাকেন। সবার ছেলেমেয়েরা যেন স্কুলে যায় সেদিকে তিনি কঠিন নজর রাখেন। পুরো গ্রামের মানুষ তাঁকে দেবতা জ্ঞান করেন। তিনি কারো ভাইজান, কারো চাচা, কারো দাদু আবার বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ কেউ তাঁকে নাম ধরেই ডাকে।

ডাঃ কে দেখা মাত্রই যে যার মত ছুটে গেল চেয়ার বেঞ্চ আনার জন্য। ডাঃ এলে কি করতে হয় সবাই জানে, কেবল সবার মনে মনে প্রশ্ন আজতো শুক্রবার নয়, তাহলে আজ কেন? এযে মোজার জন্যই আসা তা মনে মনে সবাই টের পায়। বাতাসের আগে খবর ছুটে যায়, কাজেই যে যেখানে আছে সব্বাই এসে জমা হয় সেন্দুরাই আমের তলায়।

ডাঃ এসেই লেবু দিয়ে শরবত খায় সে শরবতও এসে যায়, খাওয়ার পর সকলের সাথে টুকটাক কুশল বিনিময় করেই আসল কথায় আসে ডাঃ। একজন মুরব্বীর দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করে-

-আর বলেন না চাচা, এই গাধা মোজা গিয়ে আমার হাতে পায়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না... কিছুই বলতে পারেনা খালি কাঁদে তারপর ওর মুখে শুনলাম এখানকার ব্যাপার স্যাপার। আবার মোজার দিকে তাকিয়ে বলে

-এই মোজা! যা আসিয়াকে বাইরে এসে বসতে বল, আমি যা বলি তোরা মন দিয়ে শোন। আমার হাতে সময় খুব কম, কে যেন আসিয়াকে ডেকে এনে বাইরে বসায়, সে লম্বা ঘোমটা টেনে একটু দূরে বসে। ডাঃ সাহেব বলতে শুরু করেন-

-আরবিতে ‘তালাক’ শব্দের অর্থ হলো কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলা বা ছিন্ন করা। বিয়ের মাধ্যমে যে সম্পর্ক দুজন মানুষের মধ্যে হয় তা আইনসিদ্ধ উপায়ে ভেঙ্গে দেয়াকে মুসলিম আইনে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ বলে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাঁদের পক্ষে একসাথে থাকা আর কিছুতেই সম্ভনব নয়, সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যেতে পারে। কিন্তু বিচ্ছেদের জন্য কিছু সঠিক নিয়ম আছে।

ডাঃ ধীরে ধীরে বলতে থাকেন যেন সবাই শুনতে পায়-

রাগের মাথায় মুখে পর পর তালাক বললেই অথবা একসাথে ‘বায়েন তালাক’ কথাটি বললেই তালাক কার্যকর হয়না। যদিও এই ভুল ধারনাটি সবার মধ্যে আছে। এসময় ডাঃ সাহেবের চোখ যায় হুজুরের দিকে। হুজুর আস্তে করে মাথা নামিয়ে নেয়। আমাদের গ্রাম দেশে স্বামীরা অহরহই মুখে মুখে তালাক দিয়ে থাকে। আসলে তালাকের নিয়ম অনুযায়ী তালাক দেবার পর নোটিশের মাধ্যমে স্ত্রীর এলাকার চেয়াম্যানকে জানাতে হবে। নোটিশ পাবার পর ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং তাদের মধ্যে সমঝোতা আনার প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা নেবে। এ পর্যন্ত বলে ডাঃ সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন আমার কথা কি খুব কঠিন লাগছে, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? ভিড়ের মাঝ থেকে বয়স্ক দুচারজন বলে ওঠে না না কঠিন কিছু না। ডাঃ এবারে মোজার দিকে তাকিয়ে বলে

-ঐ হাঁদারাম বুঝতে পারছিস? না বুঝলে আমাকে জিজ্ঞেস করবি। মোজা ঘাড় কাঁত করে হ্যাঁ জানায়। ডাঃ বলতে থাকেন-

ওই সালিশীতে কাজ না হলে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকরী হবে। ৯০ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত তারা আইনসিদ্ধ স্বামী স্ত্রীই থাকবে। এখানে আরো একটি গুরত্তপুর্ণ কথা আছে- সেটি হলো আইন অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে তালাক হওয়া দম্পতি চাইলে পুনরায় বিয়ে করতে পারে, তবে তার জন্য মধ্যবর্তী বা ‘হিল্লা’ বিয়ের কোন প্রয়োজন নাই। আবার তালাকের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকে তবে তালাক কার্যকরী হবে না।

ডাঃ থেমে গিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলেন-

-মোজা আমাকে বলেছে সে রাগের মাথায় ওইসব কথা বলে ফেলেছে সেটা ওর মনের কথা নয়। ও ওর বউকে নিয়ে আগের মত সংসার করতে চায়। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নিয়ম অনুযায়ী মোজা –আসিয়ার মধ্যে তালাক হয় নাই। কাজেই ওদের সংসার করতে কোন অসুবিধা নাই। কি বলেন সবাই ? কণ্ঠস্বর উঁচু করে তিনি সবার দিকে তাকান। বয়স্করা বলে উঠে-

-অয় যদি সংসার করতে চায় হামরা আর কি কই?

-হ্যাঁ, ও সংসার করতে চায় বলেই আমার কাছে ছুটে গেছে। অনেক অনুরোধ করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমার হাতে সময় একদম নাই, কিন্তু ওর আকুলতা দেখে না এসে পারলাম না, কারো মনে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন আছে কি, মওলানা সাব কি বলে? মওলানা মাথা নেড়ে বলে, না কিছু বলার নাই। আচ্ছা বেশ, তাহলে তো এ নিয়ে আর কোন সমস্যা রইল না। এই মোজা! যা আসিয়াকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যা। ফের যদি এমন কিছু করিস তখন কিন্তু আমি নিজে তোর ব্যবস্থা নেব। মোজা একগাল হাসি দিয়ে ওর দেবতার মত ভাইজানের দিকে তাকিয়ে হে হে করে হেসে উঠে ...

এতবড় একটা ঘটনার পরিসমাপ্তি হলো একদম পানসে ভাবে, নাটক জমে উঠলনা- আজকের জমায়েত মানুষের অর্ধেক মানুষ এমন ভাবনা মাথায় নিয়ে আর বাকি মানুষ – যাক ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেল, সংসারটা রক্ষা পেল, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক এমন ভাবনা নিয়ে বহু ঘটনা অঘটনার সাক্ষী সেন্দুরার তল ত্যাগ করল। ডাঃ সাহেবের গাড়ির শব্দও দূরে মিলিয়ে গেলে আসিয়া-মোজার বড় মেয়ে ময়না যে এই ডাঃ সাহেবের পরামর্শ ও সগযোগিতায় এবারে ৯ম শ্রেণির ছাত্রী, গত ৩দিন ধরে কেঁদে কেঁদে চোখদুটি করমচার মত লাল করে, ঠোঁট মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে, গত ৩দিন মেয়েটি সংসারের সব কাজ করেছে, ভীত, অসহায় ছোট বোন দুটোকে আগলে রেখেছে আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে মায়ের উপর কারণ প্রতি বছর এ পাড়ায় ও পাড়ায় এমন ঘটনায় বহু মায়েরা হয় গলায় ফাঁস নেয় অথবা জমিতে দেওয়ার কীটনাশক পান করে মারা যায়। ময়না ভাবে আল্লাহর দয়ায় হামার সংসারটা বাঁচি গেইছে, সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলে-

-“ ডাঃ দাদু মানুষ নয় ফেরেস্তা। হে আল্লাহ তার ভালো করো”।












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. ঝগড়াটা ভালই লাগছিল, অনেকদিন পর রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় ঝগড়া শুনলাম.. তবে তালাক দেয়ার পর বিষয়টা গুরুতর হয়ে যায়। গ্রামের মানুষদের কিছু জানার কমতি এবং কুসংস্কার এর কারনে প্রতিদিন এরকম অনেক পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। প্রতি গ্রামে একজন করে ডাক্তার ভাই থাকলে ভাল হত। :)
    -ইসতিয়াক

    উত্তরমুছুন