মোস্তাক আহমাদ দীন'এর প্রবন্ধ : দেশভাগ, দেশ ভাগ নয়

অমিতাভ ঘোষের দ্য শ্যাডো লাইন্স উপন্যাসের ঠাকুমা দুটি ক্রিয়াপদের পার্থক্য বুঝতেন না, সেই ক্রিয়াপদ দুটি হচ্ছে ‘যাওয়া’ ও ‘আসা’; কিন্তু আসলেই কি বুঝতেন না? সাতাশ বছর শিক্ষকতার পর যিনি অবসরপ্রাপ্ত ও পরিণত, তিনি সত্যিই কি জানতেন না ক্রিয়াপদ দুটির ব্যবধান! উপন্যাসটিতে ঠাকুমা চরিত্রটি যেভাবে চিত্রিত, বোঝা যায়, এখানে তিনি দারুণ এক বিভ্রমের শিকার। জানি না একে বিভ্রম না বিহ্বলতা বলা উচিত, যার প্রভাবে জগতের অনেক কিছুই তাঁর কাছে অন্যরকম-ধাঁধাময়। একপর্যায়ে ঢাকায় যাওয়ার/আসার পরিকল্পনা শুরু হতেই তাঁদের পারিবারিক আলোচনায় ‘সীমান্ত’-এর প্রসঙ্গ ওঠে, কিন্তু ঠাকুমা জানেন না সীমান্ত কাকে বলে, আর তাকে কী দিয়েই বা¬ চিহ্নিত করা হয়; তাই আলোচনা চলাকালে একসময় তাঁর ছেলেকে বলে বসলেন, ‘দুটো দেশের মধ্যে কিছু তো একটা থাকবে।
যেমন ধরো, ট্রেঞ্চ থাকতে পারে, কিংবা দু-দিকে বন্দুক উঁচিয়ে সৈন্যরা থাকবে, তাই না?’ কিন্তু বহু দেশ ঘুরে নানাবিধ অভিজ্ঞতা-অর্জনকারী ছেলে হাসতে-হাসতে বলল, প্লেন থেকে মেঘ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, সৌভাগ্য হলে যা দেখা যেতে পারে তা হলো, সবুজ মাঠ আর ধানক্ষেত, অন্য কিছূ নয়। কিন্তু এমন জবাবে দেশকাল-বিযুক্ত ঠাকুমার সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়, তিনি তাঁর লায়েক ছেলের প্রতি-নাকি রাজনীতির সেই ‘বুড়ো খোকা’দের প্রতি জানি না-প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘কিন্তু যদি ট্রেঞ্চ কিংবা কোনোকিছুই না থাকে, তাহলে কোন দেশ লোকে বুঝবে কী করে? মানে বলতে চাইছি তফাতটা তাহলে কোথায়? যদি কোনোই তফাত না থাকে, তাহলে তো আগের মতো ট্রেনে করেই চলে যাওয়া যায়! আগে আমরা ঢাকায় ট্রেনে চেপে পরদিন কলকাতায় এসে পৌঁছাতাম। কেউ থাকতে বলত না, কিংবা কোনো প্রশ্নও করত না। আর তাই যদি হয়, মানে মাঝখানে যদি কিছুই না থাকে, তাহলে দেশভাগ, এত রক্তপাতের কি দরকার ছিল?’ এ-প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ছেলে? পুরো দেশভাগটাই যেখানে উত্তেজনা আর ক্লান্তিরই এক পরিণতি-আরেকটু এগিয়ে বললে যাকে একটি দুর্ঘটনাও বলা যেতে পারে-সেখানে দু-এক বাক্যে এর উত্তর দেওয়া কীভাবে সম্ভব? ‘উত্তেজনা’ শব্দটি আমার নিজের নয়, শব্দটি লিওনার্দ মোজলে-র। তাঁর দ্য লাস্ট ডে’জ অব দি ব্রিটিশ রাজ’ বইটির শুরুই হয়েছে এই তথ্য দিয়ে যে, ভারতীয় জনগণের মধ্যে নানা বিষয়ে বৈসাদৃশ্য থাকলেও একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে সাদৃশ্য, আর তা হলো, রাজনৈতিক স্বভাবের ক্ষেত্রে তাঁরা অতিমাত্রায় উত্তেজনাপ্রবণ। এর নজির হিসেবে তিনি বয়ান করেছেন নানা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উত্তেজনাসৃষ্টিকারীর আহ্বানে উন্মত্ততা আর ক্ষিপ্ততার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে-পড়ার কথা, এরপরই ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার ভয়াবহ দাঙ্গার কথা।

এ-ছাড়াও, দেশভাগের পট-পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলেই দেখা যায়, এখানে গান্ধীর সূক্ষ্মদর্শিতা-ব্রিটিশ শাসকের কাছে যা মনে হতো দুর্বোধ্য, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের দূরদর্শিতা- যা কারও-কারও কাছে মনে হতো হিন্দুম্মন্যতা-তা, কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বিবেচিত হলেও, দুই পক্ষের দুই নেতা ও তাদের অনুসারীদের কাছে এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবসম্মত ও অনুসরণযোগ্য মনে হয়নি। নতুন ডোমিনিয়নকে আবাহন করার জন্যে দিল্লিতে বিধানসভার হাস্যোচ্ছল সদস্যরা যখন পাটভাঙা ধুতি আর গান্ধী-টুপি পড়ে উপস্থিত, তখন মাওলানার চেহারায় বিষণ্ণতার ছায়া, আর গান্ধী অবস্থান করছিলেন কলকাতার নোংরা বস্তি বেলেঘাটায়। হিন্দু-মুসলমান-এর অব্যাহত দাঙ্গা নিরসনের অজুহাতে দেশভাগ/স্বাধীনতা যেখানে যুগলরূপ ধারণ করল, সেখানে, সেই দিনই পাঞ্জাবে ও লাহোরে- যা পরে আরও বহু জায়গায় বহু রূপে অব্যাহত-চলল রোমহর্ষক দাঙ্গা। যে-নেহরু সেদিনের বিধানসভায় নতুন করে শপথ নেওয়ার কথা বলছেন, নবজীবনের সাড়ার কথা বলছেন, জাতির আত্মার মুক্তির স্বাদ গ্রহণের কথা বলছেন, তিনিই পরে এই স্বীকারোক্তি করেছিলেন যে, ‘আসল কথা এই যে, আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং আমাদের বয়সও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই আবার কারাবরণের কথা চিন্তা করতে পারতেন। আর আমরা যদি আমাদের আকাঙ্ক্ষিত অখণ্ড ভারতের দাবির ওপর অনড় থাকতাম, তাহলে আমাদেরকে আবারও জেলে যেতে হতো। যে-আগুনে পাঞ্জাব পুড়েছিল, তা আমরা দেখেছি। প্রতিদিনই সেখানকার নরহত্যার খবর আমরা পেয়েছি। দেশভাগই ছিল এর একমাত্র বিকল্প। কাজেই আমরা দেশ বিভাগকে মেনে নিয়েছি।’ জেলে-যাওয়ার প্রসঙ্গে পদ্মানদীর মাঝি-র শেষদৃশ্যে কপিলাকে নিয়ে কুবেরের ময়না দ্বীপ-যাত্রার কথা মনে পড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, যে-জিন্নাহ পাকিস্তান সৃষ্টির প্রধান হোতা হিসেবে নিজেকেই মনে করতেন, তিনিও ভাইসরয়কে নিয়ে রাজধানীর রাস্তা প্রদক্ষিণের সময় ছিলেন উত্তেজিত ও আতঙ্কিত এবং পরে তার এডিসিকে বলেছিলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি যে, এমন একটা কিছু ঘটবে। আমার জীবদ্দশায় আমি পাকিস্তানের জন্ম দেখতে পাব, এটা আমি কখনো আশা করিনি।’ অভাবিত না হলেও, মনে হয়, জিন্নার কাছে এ-যেন এক হঠাৎপ্রাপ্তি; আর নেহরুর কাছে, তাঁর নিজের যুক্তিতে, ‘অবিকল্প’ হিসেবে বিবেচিত হলেও আসলে তা ছিল না; এ-নাহলে তিনি এমন স্বীকারোক্তি কেন করবেন যে, দেশবিভাগের প্রস্তাব-গ্রহণে গান্ধী আপত্তি করলে তারা সংগ্রাম চালিয়ে যেতেন এবং অপেক্ষা করতেন। দেশভাগ মেনে নিয়ে তাঁরা আশা করেছিলেন পাকিস্তান আবার তাদের কাছে ফিরে আসবে, এবং তাঁরা এও ভাবতে পারেননি যে দেশে এমন হত্যাকাণ্ড শুরু হবে, আর কাশ্মীর-সংকট নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে এমন তিক্ততার সৃষ্টি হবে। দেখা গেল, দেশভাগের পরবর্তী নয় মাসের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি হিন্দু, শিখ ও মুসলমান জীবন বাঁচানোর জন্যে তাদের পিতৃভিটের মায়া ছেড়ে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। শেষবাক্যটি সহজেই বলা হলো যদিও, দৃশ্যত ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত কঠিন, আর অদৃশ্যত তা ছিল অতিশয় ভয়াবহ : একদিকে স্মৃতি বয়ে-বেড়ানোর যন্ত্রণা, অন্যদিকে, মাটি ও নাড়ির প্রতি, সর্বস্ব-হারানোর পরেকার এক অব্যক্ত পিছুটান-এ-ক্ষেত্রে আত্মপরিচয়গত সংকটকেও মনে হয় মামুলি। সাহিত্যে আমরা এই সূক্ষ্ম অনুভবেরই প্রতিফলন দেখি-কখনো ইশারায়, রূপক-প্রতীকের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গে, কখনো বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর আলাদা ব্যঞ্জনা মিশিয়ে, আর, তখনই মনে হয়, লেখকের শিল্পসত্য/বাস্তব, দেশভাগের বাস্তবের চেয়েও সত্য-মনে হয়, দেশভাগের সত্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা স্থানগত, আর হৃদয় ও মননের যে-দেশ, তা কখনো ভাগ হয় না, ভাগ হতে পারে না।




ওই বিষয়ের লিখিত নজির রয়েছে শঙ্খ ঘোষের কবিতায়। শঙ্খ ঘোষ জন্মেছিলেন চাঁদপুরে, তাঁর মাতুলালয়ে; পিতৃভিটে বরিশালের বাণারিপাড়া। শঙ্খ ও তাঁর পরিবারকে একসময় চলে যেতে হয়েছিল কলকাতায়, কিন্তু তিনি কি কখনো ভুলতে পেরেছিলেন সেই দেশ সেই মাতৃভূমির কথা যেখানে কেটেছে তাঁর অমলধবল শৈশব? ভোলা যে সম্ভব নয় তা ফুটে উঠেছে তাঁর অন্তরঙ্গ ভাষায় :


তুমি মাটি? কিংবা তুমি আমারই স্মৃতির ধূপে ধূপে
কেবল ছড়াও মৃদুগন্ধ আর কিছু নও?
রেখায় রেখায় লুপ্ত মানচিত্র-খণ্ডে চুপিচুপি-
তোমার সত্তাই শুধু অতীতের উদ্দাম উধাও
বাল্য সহচর। তুমি মাটি নও দেশ নও তুমি।


কবিতাটি জটিল নয়, আবার সহজও নয়; কবিতাটির নাম ও তার ভেতরকার সম্বোধন আর সরাসরি উচ্চারণে বোঝা যায়, যার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন তাকে আর আগের মতো ফিরে পাচ্ছেন না বলেই এই প্রশ্ন। অথবা, অন্যভাবে আরেকটি অর্থও এখানে দাঁড়ায় যে, তুমি দেশ বা মাটি না হতে পারো, কিন্তু তোমার সত্তা আমার ‘উদ্দাম উধাও’ বাল্যসহচরের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ-কবিতাটির আলোচনায় সুতপা ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ভূগোলের জ্ঞান দিয়ে দেশের একটা পরিচয় জানি বটে, সেই জ্ঞান বলে দেয়, ১৯৪৭-এর পর আর পুববাংলা বলে কোনো দেশ নেই, আছে পূর্ব পাকিস্তান, আর তারপর আছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলায় যার জন্ম, বড়ো-হওয়া, বাল্যের সমস্ত অভিজ্ঞতার সমস্ত প্রতীতির ধারক সেই পুববাংলা তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও তাঁর চৈতন্যে সেই পুববাংলাই চিরদিনের জন্যে তাঁর দেশের প্রতিমা।’

একই উদাহরণ খুঁজে পাব শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতায়ও -যেখানে কবি নানা পরম্পরায় উজ্জ্বল শ্রীহট্ট-কে খোঁজ করেন। শক্তিপদ জন্মেছিলেন তৎকালীন শ্রীহট্টের হবিগঞ্জ মহকুমার সোনাইতা গ্রামে, ১৯৩৭ সালে। কিন্তু শক্তিপদ ও তাঁর পরিবারকে চলে আসতে/যেতে হয়েছিল শিলচরে; কিন্তু এখানে এসে পূর্ব বাংলা আর সেই আদি শ্রীহট্টকে কি ভুলতে পেরেছিলেন কখনো? জেনেছি, একবার একা-একা সোনাইতা ঘুরে গিয়েছিলেন, আর মৃত্যুর আগে বাংলাদেশের মানচিত্র সামনে ঝুলিয়ে শয্যায় শুয়ে শুয়ে লাঠি দিয়ে তাঁর জন্মভিটে চিহ্নিত করতেন শক্তিপদ; কিন্তু কেন করতেন? তাঁর ‘অন্য এপিসল্’ কবিতাটি হয়তো তার উত্তর দিতে পারবে :


আমরা তখন চিঠির বান্নামার শেষ পংক্তিতে লিখতাম, জেলা শ্রীহট্ট।
বান্নামা মানে যে বারনামা অর্থাৎ ঠিকানা অর্থাৎ অ্যাড্রেস
তখন, অর্থাৎ আমাদের ইজেরের কষি ঢিলে থাকার বয়সে
একেবারেই জানতে পারিনি।

এখন ভূ-ভারতে শ্রীহট্ট নামে কোনো জেলা নেই
এখন আমাদের জেলার নাম কাছাড়
আমাদের পশ্চিমের জেলার নাম করিমগঞ্জ
তারও পশ্চিমে একটা জেলার নাম সিলট মানে সিলেট।

তখন ভূ-ভারত বলতে শ্রীহট্ট-সমেত গোটা পৃথিবীকেই বোঝাত কি না জানি না
কারণ, তখন আমাদের জানাশোনার বয়স খুব একটা বাড়েনি
কেবল একটা কথা আমরা জেনেছিলাম,
যা শ্রীহট্টে নেই, তা গোটা ভূ-ভারতেই নেই।

অবশ্য যখন আমরা ইংরাজী অক্ষরে ঠিকানা লিখতে শিখেছিলাম
তখন নিবের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে লিখতাম ডি টি সিলেট
আমার ফুলমাসীকে আমি আমার প্রথম পত্র লিখেছিলাম
দাঁতে ঠোঁটে এবং হাতের আঙুলে কালি মাখতে মাখতে আমার
বান্নামায় লেখা হয়েছিল-


শ্রীযুক্তা সুভাষিণী দেবী শ্রীচরণ কমলেষু
পো : ও গ্রাম...
জেলা-শ্রীহট্ট, আসাম।


বোঝা যায়, এটিও স্মৃতি-খননের কবিতা, এতে সেই হারানো শ্রীহট্টকে খুঁজে ফিরছেন শক্তিপদ, যে-শ্রীহট্ট তাঁর চেতনায়ই জেগে আছে শুধু, অন্য কোথাও নেই; তিনি যে একসময় চিঠির বান্নামা বা বারনামায় লিখতেন ‘জেলা-শ্রীহট্ট, আসাম’, তাও যেন একটি মিথ্যে তথ্য শুধু, কারণ, বড় হয়ে জানলেন-বলা উচিত জানানো হলো ‘আসাম নামে কোনো রাজ্যের সঙ্গে সিলেটের কোনো সম্পর্কই নেই’, এবং আরও কৌতুককর তথ্যও জানানো হলো যে :


আমরা আরো জেনেছি, আসলে রাজ্যটির নাম আসাম নয়, অসম
এবং আরো জানানো হচ্ছে যে, অসম একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র.....
কিন্তু না এসব লিখতে নেই, পলিটিক্স হয়ে যাবে
আর আজকাল শিশুও জানে কবিদের পলিটিক্স করতে নেই।

কিন্তু ‘লিখতে নেই’ বললেও শেষপর্যন্ত যা লেখার তা ঠিকই লিখে ফেলেন তিনি, আর সে-ব্যাপারটিও যে তিনি মেনে নিতে পারছেন না, সেটিও তাঁর লেখায় অস্পষ্ট নয়। শক্তিপদ এই কবিতাটি শেষ করছেন একটি প্রশ্ন রেখে :

কিন্তু আমার জীবনের শেষ চিঠিখানি কাকে লিখব?
কারণ, ফুলমাসীদের বংশে বাতি দিতেও কেউ নেই
সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।

সত্যিই তো, কাকে লিখবেন তিনি চিঠি? যাদের লিখবার কথা, তাদেরকে তো মেরে ফেলা হয়েছে বহু আগে, কিন্তু তাই বলে তিনি তো আর স্মৃতিহারা নন-আদি শ্রীহট্ট, আর সেই দেশ তো এখনো জাগ্রত তাঁর অস্তিত্বে, চেতনায়, আর সেই জন্য তাঁকে লিখতে হয়েছে এমন মর্মান্তিক কবিতা, যা পড়ে আজো আলোড়িত না হয়ে উপায় নেই আমাদের।

এরকমই এক স্মৃতিচিত্র নিয়ে একটি ইঙ্গিতময় কবিতা লিখেছেন রণজিৎ দাশও। তাঁর কবিতার নাম ‘ইতিহাস’; এটি এমন এক আবহে তৈরি হয়েছে যে, মনে হবে দেশভাগের প্রসঙ্গটি এখানে যেন লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ্যমাত্র। কবিতাটি শুরু হয়েছে ছাদে বসে রাত্রির আকাশ দেখার বর্ণনার মধ্য দিয়ে, তখন দুঃসহ বৈশাখ মাস, ছাদের অন্ধকার কোণে শুকিয়ে যাওয়া ‘টবের ফুলগাছটি দাঁড়িয়ে আছে’ আর ‘বৃষ্টির প্রতীক্ষা করছে সমস্ত শহর’, রাত্রির আকাশপথে খণ্ড খণ্ড শাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। এর পর উপলক্ষ্যের মতো করে, মূল লক্ষ্য-ইতিহাসের অনুষঙ্গ :

বিরামহীন, গত দু’রাত ধরেই চলেছে এই মেঘের দল। যেন ৪৭ সালের সীমান্ত-পেরিয়ে-আসা উদ্বাস্তুদের মিছিল। ঐ লম্বাটে মেঘটি আমার ঠাকুর্দা, ঐ দ্রুতগামী মেঘটি আমার বাবা, ঐ পিছিয়ে-পড়া ক্লান্ত মেঘটি আমার মা।

অনেক রাতে ভেসে গেল সুঠাম, অভিজাত দুটি মেঘ পাশাপাশি-মনে হল নেহরু আর এডুইনা মাউন্টব্যাটেন।

বৃষ্টি আসার পূর্বেকার মেঘকে বহুভাবেই ব্যাখা করা যায়, কিন্তু এখানে মেঘের প্রতীকায়ন ইতিহাসের অর্থাৎ স্বাধীনতা আর দেশভাগের কার্যকারণ ও প্রভাবের তাৎপর্যে বর্ণিত। লম্বাটে, দ্রুতগামী আর পিছিয়ে-পড়া-এই তিনটি বিশেষণ যাদের জন্য বর্ণিত এরা সকলেই দেশভাগের শিকার। আর শেষের স্তবকটির সুঠাম ও অভিজাত বিশেষণ দুটি প্রভাবগত কারণেই উল্লিখিত। স্বাধীনতার ইতিহাসে মাউন্টব্যাটেনের সক্রিয় যোগসূত্রের কথা সকলেরই জানা-ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল পদে মাউন্টব্যাটেনের নিয়োগপ্রদানে ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন নেহরু, আর, মনে রাখা জরুরি যে, ১৪ আগস্ট করাচির স্বাধীনতা দিবসের প্রাথমিক অনুষ্ঠানে যে-ব্যক্তির অংশগ্রহণ চেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, সেই ব্যক্তির নামও মাউন্টব্যাটেন। দেশভাগ ও স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে নেহরুর প্রভাবের কথাও সকলের জানা। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে কলকাতা থেকে শতাধিক কিলোমিটার দূরে একটি ছোট্ট স্কুলে বসে কান পেতে, জওহরলাল নেহরুর বেতারবক্তৃতা-‘নিয়তির অভিসার’-এর উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও-শুনে আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন অমর্ত্য সেন, তিনি তর্কপ্রিয় ভারতীয় (Argumentative Indian) বইটিতে নেহরুর সেই বক্তৃতায় দারিদ্র্যবিমোচন, অবহেলা, রোগভোগ ও সুযোগের বৈষম্য দূরীকরণের যে-উল্লেখ করেছিলেন তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়নও করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতার পাশাপাশি দেশভাগের মতো একটি দুর্ঘটের শিকারও তো হয়েছিল দুই দেশের অসংখ্য মানুষ। তাই রণজিৎ দাশের কবিতাটিতে উদ্বাস্তুদের মিছিল আর ইতিহাসের এই দুই চরিত্র বিপরীত তাৎপর্যে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশভাগের ঘটনাটি যে এখানে সমালোচনার দৃষ্টিতেই বিদ্ধ হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

এমন সমালোচনা শুধু কবিতায় নয়, অন্য ধরনের লেখায়ও রয়েছে। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আলোচনা করা জরুরি যে, তাহলে দেশের হিন্দু মুসলমান কি স্বাধীনতা ও দেশভাগ চায়নি? কতিপয় স্বার্থান্ধ ব্যক্তি বাদে, বলা যায় ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্তি/স্বাধীনতা সকলেই চেয়েছিল, কিন্তু দেশভাগের বিনিময়ে সবাই এই স্বাধীনতা চায়নি। মহাত্মা গান্ধীও চাননি, মাওলানা আবুল কালাম আজাদও চাননি। গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমি বরাবরই বলেছি, (হিন্দু ও মুসলিম) দুইয়ের মধ্যে কোনও তফাত নেই। তাদের পর্যবেক্ষণ হয়ত পৃথক। কিন্তু তা ওদের পৃথক করে দেয় না। নিঃসন্দেহে তাদের ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু অন্যদের মতো তারাও একই মূল হতে জাত।’ আরও বলেছিলেন, ‘মুসলিমরা যদি সত্যিই জোর দেয়, তাহলে একজন অহিংস হিসাবে আমি প্রস্তাবিত দেশভাগে সবল প্রতিরোধ জানাতে পারি না। তবে এ-অঙ্গচ্ছেদে আমি কিছুতেই রাজি হতে পারি না।’ আর ভারতের নয় কোটি মুসলমানের প্রতি মাওলানা আজাদের সমবেদনা ছিল প্রশ্নাতীত, এরপরও জিন্নাহর পাকিস্তান-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে সংকটের সুরাহা সম্ভব, তা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করে কীভাবে অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ ভারত প্রতিষ্ঠা করা যায়; তারই প্রতিফলন ছিল ১৯৪৬ সালে ১৫ এপ্রিলে দেওয়া তাঁর বিবৃতিতে। তিনি বলেছিলেন, ‘মুসলিম লীগের পাকিস্তান পরিকল্পনাটির সম্ভাব্য সব দিক আমি ভেবে-চিন্তে দেখেছি। এই পরিকল্পনাটি গৃহীত হলে ভবিষ্যতে গোটা ভারতের উপর এর প্রতিক্রিয়া কী হবে একজন ভারতীয় হিসেবে সেটাও আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয় মুসলমানদের জীবনে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও আমি একজন মুসলমান হিসেবে পরীক্ষা করে দেখেছি। পাকিস্তান পরিকল্পনাটির সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করে আমি এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এই পরিকল্পনাটি গোটা ভারতবর্ষের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে।’ কিন্তু একই ক্ষেত্রে নেহরুর বক্তব্যে দেশভাগের অনিবার্যতার স্বরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা এলো। দেশভাগ হলো। এবং রোপিত হয়ে গেল বিষবৃক্ষের বীজ। ১৯৪৯ সালের শেষে ডাক্তার বিধানচন্দ্র ১৬ লক্ষ উদ্বাস্তুর কথা লিখেছিলেন; ৬ লক্ষ মৃত, ১ কোটি ৪০ লক্ষ গৃহচ্যুত, ১ লক্ষ অপহৃতা নারী; আর, ১৯৫০ সালের ৫ মার্চে, মাউন্টব্যাটেনকে লেখা চিঠিতে নেহরু লিখছেন, প্রায় প্রত্যেক হিন্দু পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করতে চাইছে কারণ সেখানে কোনো নিরাপত্তা নেই।

পরিণতি যে কী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, তার নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে দেশভাগ-পরবর্তী ১৯৫১-৫২ থেকে ১৯৬১-৬২ পর্যন্ত দশ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষ বইটিতে। এই বইয়ের পটভূমি হচ্ছে, দেশভাগের আগে-পরে কোনো সহায়সম্পদ না থাকায় যারা ও-পারে যেতে পারেনি, তারা এপারে কীভাবে বেড়ে উঠেছিল তারই অন্তরঙ্গ আলেখ্য। বইয়ে তফসির মিঞা নামে একটি চরিত্র আছে যাকে সরকার পল্লিতে পাঠিয়েছে পল্লি-অঞ্চলের স্বাস্থ্য, শিক্ষা পরিচ্ছন্নতা, পশুপালনপদ্ধতি-বিষয়ে লোকজনদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, কিন্তু তার নিজের মতে, ‘কাজের জন্য যে-পরিকাঠামো দরকার, তার কোনও ব্যবস্থা নেই। আমার মনে হয় যেখানে গ্রামের শিকড়টাই উপড়ে গেছে, সেখানে এ-প্রচেষ্টার কোনও অর্থ নেই।’ কিন্তু গ্রামের যতীন বাবুর মত ভিন্ন-তিনি তফসির মিঞাকে লক্ষ্য করে বলতেন, গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য দরকার ভূমির সুষম বণ্টনব্যবস্থা, আপনারা যা করছেন তাতে পরিত্যক্ত/ছাড়াভিটে দখলকারী এবং নব্য তালুকদারদের কিছু উপকার হবে হয়তো, কিন্তু তাও অল্পদিনের জন্য। যতীন বাবুর এসব কথায় পরিত্যক্ত ভিটে-দখলকারী বলতে মুসলমানদেরকেই বোঝায় বলে অপ্রস্তুত বোধ করতেন তফসির মিঞা; কিন্তু যতীনবাবু বলতেন, ‘ভাববেন না যে আমি ছাড়াভিটের দখলদারি বলতে আপনার সম্প্রদায়ের উপর কটাক্ষ করছি। আমি যে-সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের মধ্যেও ছাড়াভিটের দখলদার আছে। হয়তো সংখ্যাগতভাবে কম। কিন্তু তারা যদি সংখ্যাগুরু হতেন, তাঁরাও একই কাজ করতেন।’ এই সব আলোচনা শেষপর্যন্ত কোনো সমাধানে পৌঁছত না, কিন্তু তফসির মিঞা বলতেন, ‘এখানে সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বুনিয়াদটাই ধসে গেছে। শুকনো গাছে পানি দিলে কি পাতা গজায়?’

এছাড়াও হিন্দুরা এ-দেশ ছেড়ে যেতে কীভাবে বাধ্য হন, তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিবরণ রয়েছে এই বইয়ে, আবার এতে এমন অনেক সৎ ধার্মিক মুসলমানের কথাও রয়েছে, যারা সম্পত্তির লোভে প্রতিবেশীদের তাড়াতে চাননি, বরং তাঁদের মধ্যে অনেকেই হিন্দুদের সঙ্গে মিলে নানা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলে। দেখা অভিজ্ঞতার এমন নিরপেক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টিময় বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভই বলা চলে। মিহির নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, জারিগানের বয়াতিরা কীভাবে আল্লা-নবি বন্দনার আগে লোকায়ত দেবী বিপদনাশিনীর বন্দনা করেন, তাঁর ভাষায়, ‘অপবর্ণীয় মানুষদের ধর্মীয় আচারের পরম্পরা ওই পিছারার খালধারের মনুষ্যের মধ্যে সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রায় এক অভিন্নতা বিরাজিত ছিল’, এছাড়াও নানা অভিজ্ঞতা ও দরবেশ ফকির সুফিদের কথা ও চেষ্টায় তাঁর এ-বিশ্বাস জন্মেছে যে, যখনই হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায় এক হতে চেয়েছে এক প্রবল আঘাত তাঁদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এসবের বাইরে দেশভাগের শিকার আরও বহু নিষ্ঠুর ও অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন বইটিতে-দেখেছেন একসময়কার সচ্ছল ডাক্তার জ্যাঠার ভিক্ষাবৃত্তি, দেখেছেন পরিবারের মেয়েদের পতিতাবৃত্তিগ্রহণে খুড়িমার প্ররোচনা। পড়তে-পড়তে মনে পড়ে যায় হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের দেশভাগ-পরিস্থিতির শিকার সেই বৃদ্ধ, তার কিশোরী মেয়ে আর উচ্ছন্নে-যাওয়া তিন যুবকের কথা। গল্পটিতে মেয়ের এ-পরিণতিতে বৃদ্ধের প্রশ্রয় গোপন নয়, তবু তার অসহায়ত্বের কথাই মনে পড়ে; বিষাদবৃক্ষ বইয়েও এমনটি লক্ষ করেছেন তপন রায়চৌধুরী, এবং লিখেছেন, ‘ব্যাপক, ভরসাহীন, সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের, সমূহ সর্বনাশের বিবরণ এই বইয়ের বিষয়বস্তু। কিন্তু এর ভাষা বা তার পেছনে যে প্রেরণা তাতে কোনও তিক্ততার ছোঁওয়া নেই।... এই নিষ্ঠুর কাহিনীতে কোথাও কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই’। এরপরও মিহির সেনগুপ্ত তাঁর বইয়ে জেনারেল আইয়ুব খানের সমালোচনা করেছেন, তাতে অভিযোগের স্বরও অস্পষ্ট নয়; তিনি লিখেছেন, মিলিটারিদের স্বার্থরক্ষার জন্যে যে-মোল্লাতন্ত্রের হাত পোক্ত করা হয় তার জন্য এদেশের লোকায়ত ও আবহমান সংস্কৃতি লোপ পেতে শুরু করে। যদিও এর আগে থেকেই সে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু ‘এদেশের নিম্নবর্গের মানুষেরা, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, তাদের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার শক্তির দ্বারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল।

মিহির সেনগুপ্তের এই মন্তব্যের সত্যতা মিলবে বাউলকবি শাহ আবদুল করিমের গানে। করিম তাঁর বহুলশ্র“ত একটি গানে লিখেছেন সেই ‘সুন্দর দিন’-এর কথা, যখন গ্রামের হিন্দু-মুসলমান যুবকেরা একসঙ্গে গান গাইত, খেলাধূলা ও উৎসবাদিতে অংশগ্রহণ করত আর তাদের জীবনে বইত ‘আনন্দের তুফান’ :

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম ॥
...
হিন্দু বাড়িন্ত যাত্রাগান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার কে হবে গ্রামসরকার
আমরা কি তার খবর লইতাম ॥

মুখপদে রয়েছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক বাস্তব উদাহরণ আর প্রথম অন্তরায় সেই সম্প্রীতির দৃষ্টান্তের পাশাপাশি একটি বাড়তি তথ্য : ক্ষমতার প্রতি তাচ্ছিল্য-যা একমাত্র সুখী সমাজের মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব। এ সেই সময়, সেই দেশের কথা, যখন দেশভাগ হয়নি, মিহির যে-‘সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার শক্তি’র কথা বলেছেন, তার কথা। তাঁর ধলমেলা পুস্তিকাতেও একই কথা বলেছেন করিম, লিখেছেন, ‘সুখে দুঃখে ছিল একে অন্যের সাথি/হিন্দু এবং মুসলমানে ছিল সম্প্রীতি।’ কিন্তু যখন দেশভাগ হলো, তখন কী হলো, তা পড়ে দেখা যেতে পারে সরাসরি করিমের ভাষায় :

ব্রিটিশ আমলে মেলার পূর্ণরূপ ছিল
দেশ বিভক্ত হয়ে যখন পাকিস্তান এল।
ধনী-মানী-জ্ঞানী-গুণী হিন্দু ছিল যারা
ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল তারা।
শহর বন্দরে কেহ দেশের বাহিরে।
চলে গেল যে-যাহা ভালো মনে করে।

বিভিন্ন অসুবিধায় পড়লেন জনগণ
বাড়িয়া চলিল দেশে অভাব অনটন।
...
সততা নাই সৎ মানুষের অভাব পড়েছে
দেশ জুড়ে অসৎ লোকের মাত্রা বেড়েছে।
...
সামাজিক অশান্তি লোভ-লালসার ফলে
গ্রামীণ সমাজ এখন ভেঙে গেছে মূলে।
...
মানুষে মানুষে যে সুসম্পর্ক ছিল
ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হলো।
স্বার্থপর দল যখন পাইল দখলদারি
তখন আসিল দেশে স্বার্থের মারামারি।

এ-হলো দেশভাগ-পরবর্তী করিমের দেখা ভাটি অঞ্চলের ভগ্নমূল সমাজের চিত্র। অনেকটা এমন অভিযোগই করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক তাঁর ট্রিলজি মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, ও সুবর্ণরেখা-র প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে; তিনিও লিখেছিলেন, ‘রাজনীতি ও অর্থনীতির কারণে যে-সাংস্কৃতিক অপূর্ণতা ঘটে গেছে তাতে আমার কোনো সায় নেই, কারণ আমি অখণ্ড সংস্কৃতির চিন্তা করি সবসময়। এই অখণ্ড সংস্কৃতির বিষয় নিয়েই তৈরি হয়েছে আমার ঐ তিনটি ছবি। বর্তমান বাংলার অর্থনৈতিক সমস্যা বোঝাই কঠিন। কিন্তু সুস্থিত মুহূর্তগুলোতে বোঝা যায় যে, বর্তমানে (বর্তমান শব্দটি বাদে) যে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা চলছে-তার জন্য দায়ী এই দেশভাগ। বলকানাইজেশনের মাধ্যমে আমাদের দেশ নিয়ে সকলে ছিনিমিনি খেলছে।’ এই সব মন্তব্যের ক্ষোভের কারণ স্পষ্ট, কিন্তু এ-কথা তো ঠিক যে, দেশ তো আর জোড়া লাগবার নয়, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এরা সকলেই সেই স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় খুঁজে বেড়াচ্ছেন, হাহাকার করছেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, তাঁর কৈশোর ও যৌবন পূর্ব বাংলায় কেটেছে বলে সেই স্মৃতি তাঁকে উন্মাদের মতো নিয়ে গেছে তিতাসে; আরও লিখেছেন, একবার রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে তিনি, সত্যজিৎ ও আরও কয়েকজন বিমানে করে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশে, কিন্তু পদ্মা পার-হয়ে-যাওয়ার সময় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, পাশে-বসা সত্যজিৎ-কে লক্ষ করে বললেন, সেই বাংলাদেশ আপনারা দেখেননি, সেই প্রাচুর্যময় সুন্দর জীবন, এখনো যেন সব আগের মতো আছে ‘ঘড়ির কাঁটা যেন এর মাঝে চলেনি’।

শিলঙ-এ বেড়ে-ওঠা সিদ্ধার্থ দেব লিখিত দ্য পয়েন্ট অফ রিটার্ন উপন্যাসের ঠাকুর্দার মনেও তাঁর ছেড়ে-আসা দেশ যেরকম ছিল, সেরকমই রয়ে যায়, কোনোকিছু পালটায় না, সময়ও সেখানে স্থির : My grandfather's reference to the behind as East Pakistan had secede from Pakistan to become the independent nation of Bangladesh revealed something more than a grasp of geopolitical shifts. It showed that the landscape of his past would forever be permanent and unchanging, not something that was historical and therefore open to perpetual revision, but place beyond the vagaries of time.

ঋত্বিক অবশ্য শেষমেশ সেই কঠিনকরুণ বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘ইতিহাস ভয়ঙ্কর, নিষ্ঠুর, ও-হয় না, কিস্সু নেই, সব হারিয়ে গেছে।...তখন ক্রমশ দেখলাম সমস্ত জিনিসটা ফুরিয়ে গেছে মানে একেবারেই গেছে, আর কোনদিন ফিরবে না, এটা খুবই দুঃখজনক আমার কাছে।’ এরপরও, সেই স্মৃতির তাড়নাই তো তাঁকে দিয়ে তিতাস একটি নদীর নাম-এর মতো ছবি বানাতে বাধ্য করে এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি খুঁজে ফেরেন তাঁর শৈশব যৌবন, তাঁর হারানো পূর্ববাংলা...

আলোচিত সকলেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই দেশ, যে-দেশ ভেঙে যায়, যে-দেশ রাজনীতিবিদদের দেশ, যে-দেশ ভূগোলবিদদের দেশ; দ্য শ্যাডো লাইন্স উপন্যাসের ঠাকুমা যেমন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই স্থিরবিন্দু যাকে কেন্দ্র করে যাতায়াতের ক্রিয়াপদগুলোর সঠিক ব্যবহার সম্ভব, তা তো সেই দেশেরই কোনো-না-কোনো স্থান। কিন্তু একথা সত্য যে, এই দেশ শুধু রাজনীতির ‘বুড়ো খোকা’দের দেশ নয়, শুধু ভূগোলবিদের দেশ নয়, এই দেশ, স্মৃতির দেশও-রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন স্মৃতিলোক : মানুষের দ্বিতীয় জন্মভূমি, অতীতকাল থেকে পূর্বপুরুষদের কাহিনী নিয়ে কালের নীড়’ তৈরি করে যে-জন্মভূমি, যে-‘স্মৃতিলোকে সকল মানুষের মিলন’প্রয়াসী, যে-‘লোকে বিশ্বমানবের বাসস্থান’,২৫ সেই দেশে পৌঁছাতে-এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি সহায় হতে পারে কি না ভেবে দেখা যেতে পারে-এমন এক অখণ্ড চৈতন্যের শরিক হতে পারি আমরা, যা কোনো জাতিধর্মদেশ-এর ওপর নির্ভর করে চলবে না, কিন্তু মনে হবে, সকলেই সকলের পাশে, আর, সকলের হৃদয় সকলের কাছে বিনিসুতায় বাঁধা...


তথ্যসূত্র

১. Amitav Gosh, The Shadow Lines, Oxford, New Delhi, 1995, p. 153
২. লিওনার্দ মোজলে, ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিনগুলো, ( মোয়াজ্জেম হোসেন অনুদিত), বাংলা
একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১;
৩. প্রাগুক্ত, লিওনার্দ মোজলে, পৃষ্ঠা ৩০৪;
৪. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মানদীর মাঝি, সৈয়দ আজিজুল হক সম্পাদিত, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা ২০০৮,
পৃষ্ঠা ১১৪;

৫. লিওনার্দ মোজলে, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩০৪;
৬. শঙ্খ ঘোষ, কবিতাসংগ্রহ ১, দে’জ, কলকাতা, ১৪০১, পৃষ্ঠা ৪৭;
৭. সুতপা ভট্টাচার্য, গাঢ় শঙ্খের খোঁজে, প্যাপিরাস, কলকাতা, ২০০৩, পৃষ্ঠা ৫৮-৫৯;
৮. শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, কাঠের নৌকা, খ প্রকাশনী, শিলচর, ৯৪, পৃষ্ঠা ৪১-৪২;
৯. রণজিৎ দাশ, রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ, কলকাতা, ২০০২, পৃষ্ঠা ৬৮;
১০. অমর্ত্য সেন, তর্কপ্রিয় ভারতীয়, আনন্দ, কলকাতা, ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৮৭;

১১. আর. কে. প্রভু ও ইউ. আর রাও সম্পাদিত (মহাশ্বেতা দেবী অনুদিত) গান্ধী-মানস, ন্যাশনাল
বুক ট্রাস্ট, নয়াদিল্লি, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ২৬৮-২৬৯;
১২. লিওনার্দ মোজলে, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭-১৮;
১৩. অমলেশ ত্রিপাঠী (কর্তৃক উদ্ধৃত) স্বাধীনতার মুখ, আনন্দ, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ২৮;
১৪. মিহির সেনগুপ্ত, উজানি খালের সোঁতা, ‘বিষাদবৃক্ষ’, আনন্দ, কলকাতা ২০০৭, পৃষ্ঠা ২৫০;
১৫. প্রাগুক্ত, মিহির সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১৪৪ ;
১৬. প্রাগুক্ত, মিহির সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা;
১৭. হাসান আজিজুল হক, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ মুক্তধারা, ঢাকা,
১৯৯১, পৃষ্ঠা ১৬-১৭;
১৮. তপন রায়চৌধুরী, প্রবন্ধসংগ্রহ, আনন্দ, কলকাতা ২০০৯, পৃষ্ঠা ৬২;
১৯. মিহির সেনগুপ্ত, উজানি খালের সোঁতা, ‘বিষাদবৃক্ষ’, আনন্দ, কলকাতা ২০০৭,
পৃষ্ঠা ২৪৩- ২৪৪;
২০. শাহ আবদুল করিম, রচনাসমগ, ‘কালনীর ঢেউ’, খান বাহাদুর ওয়াকফ এস্টেট, সিলেট
২০০৯, পৃষ্ঠা ৪৩১;

২১. প্রাগুক্ত, শাহ আবদুল করিম, রচনাসমগ্র, ‘ধলমেলা’, পৃষ্ঠা ৩০০-৩০১;
২২. রবীন ঘোষ সম্পাদিত বিজ্ঞাপনপর্ব, ‘সাক্ষাৎকার ৬’, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা
১৪০;
২৩. রবীন ঘোষ সম্পাদিত বিজ্ঞাপনপর্ব, (মহাশ্বেতা দেবী কর্তৃক উদ্ধৃত) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৬;
২৪. Siddhartha Deb, The Point of Return, Basingstoke and Oxford: Picador, 2002.

২৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানুষের ধর্ম, ‘মানবসত্য’, বিশ্বভারতী কলকাতা, ১৩৯৩, পৃষ্ঠা ৮৩।


লেখক পরিচিতি :
মোস্তাক আহমাদ দীন
কবি। প্রবন্ধকার।
জন্মস্থান : সিলেট। বাংলাদেশ। 

প্রকাশিত বই 
ভিখিরিও রাজস্থানে যায় (এইচএসবিসি-কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার ২০১২)
কবিতাযাপন 
ছহি ফকির বিলাশ 
আট কুঠুরি
কামালগীতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়েছিলো বলেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একাত্তুরে এসে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ভারত প্রথমে ভাগ না হলে এটা সম্ভব ছিলনা।

    উত্তরমুছুন
  2. সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়েছিলো বলেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একাত্তুরে এসে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ভারত প্রথমে ভাগ না হলে এটা সম্ভব ছিলনা।

    উত্তরমুছুন
  3. 1905 বঙ্গভঙ্গ আইন ইংরেজ হিন্দু মুসলমানদের যৌথ আন্দোলনের মাথার উপরে রবীন্দ্রনাথের ঋষি তুল্য নেতৃত্বে ফিরিয়ে নিলেন বঙ্গভঙ্গ আইন, ইতিহাসের পরিহাস মুষ্টিমেয় শক্তিশালী চতুর শয়তান প্রকৃতির ক্ষমতা লোভী মানুষ জনগন সেই আবহমান কালের জুলিয়াস সিজার নাটকের জনতা নির্বোধ উন্মাদ অশিক্ষিত গোঁয়ার সুযোগ সন্ধানী হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক অবক্ষয়ে ক্ষয়িষ্ণু চৈতন্য হীন উত্তেজিত করার সহজ উপায় ধর্মের ধ্বজাধারী দের অর্থের বিনিময়ে বা উসকে দিয়ে খুন ধর্ষণ, আগুনে ঘর বাড়ি গোয়াল পুড়িয়ে মারার দাউ দাউ করে জ্বলছে ঘরের চালা,
    শিশু কোলে জননী মৃত্যু পুত্রের ধর্ষণ করছে বাপের সামনে মেয়েকে স্বামীকে খুন হত্যা করছে পরস্পরকে দুই সম্প্রদায় মানুষ অথচ আশ্চর্য ব্যাপার মাত্র এই বাঙালী মুসলমানের পূর্ব পুরুষেরা সকলেই একসময়ে হিন্দু ধর্ম জাতিভেদ প্রথার শিকার অত্যাচারিত নিষ্ঠুর অপমানিত হতদরিদ্র অশিক্ষিত শেষে নবাবের ধর্মে ধর্মান্তরিত
    ইসলাম ধর্ম কবুল করে খেয়ে পড়ে বেঁচে শুধু বিবি নিয়ে পোলাপাইন গুলারে পান্তা ভাত
    আর কাফের জমীন শত্রু ঐ হিন্দু যারা দীর্ঘ বহু বছর ধরে শোষণ করে এসেছেন এমন কি জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৈত্রিক সম্পত্তি রক্ষার জন্য খাজনা আদায় করতে ঘুরছেন, আশ্চর্য লিখন ক্ষমতা জমিদারের কঠোরতা আবার সোনার তরী আর বহু ছোট গল্প উপন্যাসের খরা বা কাব্য চর্চায় সাহিত্যে শাশ্বত লেখায় ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন।
    ইতিহাসের ধারাবাহিকতার স্খলন রক্তক্ষরণ আজও এই ভারতবর্ষে পাকিস্তানে, ও বাংলাদেশে মুসলমান বাঙালী জাতির দেশ, বাঙালি আত্মঘাতি পরিহাস ছলে বলা হয়ে থাকে ভাতৃঘাতি দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা শরনার্থী বহু জননী কন্যা গৃহ বধুঁ ধর্ষিতা বা দু নম্বর বিবি, কেউ বেশ্যা বহু ভিখারী হয়ে গেল ধর্মের নামে রাজনীতি গদি লড়াইয়ে ভাগ হয়ে গিয়েছিল অখন্ড ভারতবর্ষ সে পাপের শাস্তি ও মাতৃভুমির অভিশাপে বহু যুগ যুগান্তর ধরে বহু করে যেতে হবে বংশানুকরমে।
    পূনঃশচ ---:
    1946 16th,Direct Action Day Communal Riot কংগ্রেসের তরফে
    মুসলমানদের নিজস্ব পরিচিতি মানতে অস্বীকার তাই সোনার পাথরবাটি মিত্র
    শত্রুদের মোকাবিলা না করে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতবর্ষ অথচ এই ধর্মের নামে সত্তর বছর প্রায় বহু রকরক্ত পাত, হত্যা

    উত্তরমুছুন
  4. 1905 বঙ্গভঙ্গ আইন ইংরেজ হিন্দু মুসলমানদের যৌথ আন্দোলনের মাথার উপরে রবীন্দ্রনাথের ঋষি তুল্য নেতৃত্বে ফিরিয়ে নিলেন বঙ্গভঙ্গ আইন, ইতিহাসের পরিহাস মুষ্টিমেয় শক্তিশালী চতুর শয়তান প্রকৃতির ক্ষমতা লোভী মানুষ জনগন সেই আবহমান কালের জুলিয়াস সিজার নাটকের জনতা নির্বোধ উন্মাদ অশিক্ষিত গোঁয়ার সুযোগ সন্ধানী হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক অবক্ষয়ে ক্ষয়িষ্ণু চৈতন্য হীন উত্তেজিত করার সহজ উপায় ধর্মের ধ্বজাধারী দের অর্থের বিনিময়ে বা উসকে দিয়ে খুন ধর্ষণ, আগুনে ঘর বাড়ি গোয়াল পুড়িয়ে মারার দাউ দাউ করে জ্বলছে ঘরের চালা,
    শিশু কোলে জননী মৃত্যু পুত্রের ধর্ষণ করছে বাপের সামনে মেয়েকে স্বামীকে খুন হত্যা করছে পরস্পরকে দুই সম্প্রদায় মানুষ অথচ আশ্চর্য ব্যাপার মাত্র এই বাঙালী মুসলমানের পূর্ব পুরুষেরা সকলেই একসময়ে হিন্দু ধর্ম জাতিভেদ প্রথার শিকার অত্যাচারিত নিষ্ঠুর অপমানিত হতদরিদ্র অশিক্ষিত শেষে নবাবের ধর্মে ধর্মান্তরিত
    ইসলাম ধর্ম কবুল করে খেয়ে পড়ে বেঁচে শুধু বিবি নিয়ে পোলাপাইন গুলারে পান্তা ভাত
    আর কাফের জমীন শত্রু ঐ হিন্দু যারা দীর্ঘ বহু বছর ধরে শোষণ করে এসেছেন এমন কি জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৈত্রিক সম্পত্তি রক্ষার জন্য খাজনা আদায় করতে ঘুরছেন, আশ্চর্য লিখন ক্ষমতা জমিদারের কঠোরতা আবার সোনার তরী আর বহু ছোট গল্প উপন্যাসের খরা বা কাব্য চর্চায় সাহিত্যে শাশ্বত লেখায় ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন।
    ইতিহাসের ধারাবাহিকতার স্খলন রক্তক্ষরণ আজও এই ভারতবর্ষে পাকিস্তানে, ও বাংলাদেশে মুসলমান বাঙালী জাতির দেশ, বাঙালি আত্মঘাতি পরিহাস ছলে বলা হয়ে থাকে ভাতৃঘাতি দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা শরনার্থী বহু জননী কন্যা গৃহ বধুঁ ধর্ষিতা বা দু নম্বর বিবি, কেউ বেশ্যা বহু ভিখারী হয়ে গেল ধর্মের নামে রাজনীতি গদি লড়াইয়ে ভাগ হয়ে গিয়েছিল অখন্ড ভারতবর্ষ সে পাপের শাস্তি ও মাতৃভুমির অভিশাপে বহু যুগ যুগান্তর ধরে বহু করে যেতে হবে বংশানুকরমে।
    পূনঃশচ ---:
    1946 16th,Direct Action Day Communal Riot কংগ্রেসের তরফে
    মুসলমানদের নিজস্ব পরিচিতি মানতে অস্বীকার তাই সোনার পাথরবাটি মিত্র
    শত্রুদের মোকাবিলা না করে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতবর্ষ অথচ এই ধর্মের নামে সত্তর বছর প্রায় বহু রকরক্ত পাত, হত্যা

    উত্তরমুছুন