নরেন্দ্রনাথ মিত্র এর গল্প - বিকল্প





তিনজনের ছোট্ট সংসারে কোন অশাস্তি ছিল না। সুধা, তার বাবা হরগোবিন্দ আর সুধার ছোট ভাই হাবুল—তিনজনে মিলে শহরের সীমান্তে যে একটুখানি সংসার রচনা করেছিল তাতে অভাব অনটন অসুবিধে অনেককিছুই ছিল,কিন্তু অশাস্তির কথা কারও মনে হয় নি। সরু গলির মধ্যে পুরনো দোতলা ভাড়াটে বাড়ি। তার একতলায় একখানি মাত্র ঘর তিনজনের ভাগে জুটেছে। এই ঘরখানির মধ্যেই রান্না খাওয়া শোওয়া সব। আবার এই ঘরে বসেই হাবুল তার স্কুলের পড়া পড়ে। অসুবিধে খুবই হত। সুধা মাঝে মাঝে হরগোবিন্দকে বলত, “বাবা, আর একটা ভাল বাড়ি দেখ। এই একখানা ঘরে কি চলে?”

হরগোবিন্দ বলতেন, তা ঠিক। তোদের ভারি কষ্ট হচ্ছে। বাড়িটা বদলাতে হবে।”


কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যে বদলানো আর হয়ে ওঠে নি। অবশ্য ভাল বাড়ির খোঁজ অনেকবারই এসেছে। দুখানা ঘর আর রান্নাঘর, বাথরুম সমেত ফ্লাটের খবর কয়েকবারই নিয়ে এসেছে হাবুল। হরগোবিন্দ চাটুয্যে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িও দেখে এসেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাড়া, সেলামি আর অ্যাডভান্সের অঙ্ক শুনে আর এগোন নি। পুরনো বাসায় ফিরে এসে ছেলে-মেয়েকে বলেছেন, “দূর মিছিমিছি কতকগুলো টাকা নষ্ট করা। তার চেয়ে এই কুড়ি টাকার ঘর আমাদের ঢের ভাল। আর এর চেয়ে বেশি জায়গায় আমাদের হবেই বা কি?

সুধা হেসে বলত, আমি, জানতুম বাবা। তুমি এ ঘর ছেড়ে কোথাও নড়বে না।’

হরগোবিন্দ জবাব দিতেন, নড়ব রে নড়ব। আগে দায়মুক্ত হই, তারপর অন্য দিকে তাকাব। এখন কি আমার বাজে খরচ করবার সময় আছে?"

বাবার কথার মানে যে কি তা ভাইবোন দুজনেই বুঝতে পারত। হাবুল পড়তে পড়তে দিদির দিকে একবার তাকিয়ে মুখ মুচকে হেসে ফের বইয়ে মন দিত।

সুধা লজ্জিত হয়ে বলত, বাবা আমি বুঝি তোমার একটা দায় ? তুমি কেবলই ওই এক কথা বল।"

হরগোবিন্দ বলতেন, দায়ই তো। পিতৃদায়, মাতৃদায়, কন্যাদায়। কিন্তু তোকে বিদায় দিয়ে কি ক’রে যে আমি থাকব তাই ভাবি।’

সুধা একটুকাল চুপ করে থেকে বলত, আমাকে বিদায় দেওয়ার কথা তোমাকে অত ভাবতে হবে না। আমি চ’লে গেলে তোমাদের চলবে কি ক’রে । হাবুল তো এখনও কত ছোট। ও কি তোমার যত্ন-আত্তি করতে পারবে? ও বড় হোক, বিয়ে-থা করুক, তারপর—’

হরগোবিন্দ হাসতেন, ‘পাগলী। ততদিনে তুই যে একেবারে বুড়ী হয়ে যাবি।’

 সুধা বলত, তা হলে তো ভাবনাই চুকে গেল। চিরকালের জন্যে তোমার বুড়ীমা হয়ে তোমাব কাছে থেকে যাব। আমাকে কাছছাড়া করবার কথা তুমি আর তখন ভাবতেই পারবে না।"


কিন্তু ওই একটিমাত্র কথা ছাড়া হরগোবিন্দের আর কোন ভাবনাই যেন নেই। দিনের বেশির ভাগ সময় অফিসের কাজে কাটে। বাকি সময়টুকু সুধার বিয়ের চিন্তা, চেষ্টা আর আলোচনা নিয়েই থাকেন হরগোবিন্দ।

পাড়ায় কৃপণ বলে বদনাম আছে তার। কোন অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের জন্যে চাঁদা চাইতে গেলে সিকি-আধুলির বেশি তার হাত দিযে গলে না। নিজের জামা কাপড় জীর্ণ হয়, ময়লা হয় ; সে সম্বন্ধে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু ছেলের পোশাক আর মেয়ের শাড়ি গয়না কিনে দেওয়ার দিকে দারুণ ঝোঁক। ফুরসৎ পেলেই মেয়েকে নিযে স্যাকরার দোকানে যান। পুরনো গয়না ভেঙে নতুন ডিজাইনের ফরমায়েস দেন। বছরে দু-চারখানা করে নতুন গয়না না গড়ালে হরগোবিন্দের তৃপ্তি হয় না। সুধা প্রায়ই আপত্তি করে, এত গয়না কেন করছ বাবা?

হরগোবিন্দ জবাব দেন, সব তো এক সঙ্গে করতে পারব না, আস্তে আস্তে করে রাখি। তোর মার তো কিছুই পেলিনে।’

প্রায় বছর তিনেক যক্ষ্মায় ভুগে সুধার মা নির্মলা মারা গেছেন। সেও বছর দশেক হ’ল। তখন মাইনে বেশি ছিল না হরগোবিন্দের। স্ত্রীর ওষুধ-পথ্যেব খরচ জোগাতে তার গায়ের গয়না থেকে শুরু করে নিজের ঘড়ি বোতাম পর্যন্ত গেছে। আরও প্রায় সাত-আট শ টাকা দেনা হয়েছিল। কষ্ট করে থেকে বিলাস-বাসন ত্যাগ করে সব দেনাদায় শোধ দিয়ে আবার মাথা তুলে দাড়াতে পেরেছেন হরগোবিন্দ। তারমত একজন দেড় শো টাকার কেরানীর পক্ষে এ বড় কম কৃতিত্বেব কথা নয়। সুধাকে ভাল ঘরে-বরে দেবেন—এখন এই  তার একমাত্র  সাধ। সেই সাধ মেটাবার জন্যে তিনি অসাধ্য সাধন করছেন। অফিসের চাকরিব পরে একটি পার্টটাইম কাজ নিয়েছেন। সংসার খরচের জন্যে যা লাগে মেয়ের হাতে তুলে দেন, বাকী টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখেন। গযনাও অল্প স্বল্প মেয়ের গায়ে থাকে। পাছে হারিয়ে যায কি চুরি যায, সেই আশঙ্কায বিদেশী ব্যাঙ্কে বেশি ভাড়া দিয়ে বাকীগুলি নিরাপদে রাখেন হরগোবিন্দ।


মাঝে মাঝে হাবলু সুধাকে বলে, দিদি, বাবা তোকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন।

সুধা হেসে জবাব দেয়, ভারি হিংসুটে তো তুই, কিসে প্রমাণ পেলি বাটখারায় ওজন ক'রে দেখেছিস ?

হাবলু বলে, ‘দেখেছি বইকি। আমার যেখানে এক পো, তোর সেখানে এক সের। তোর বিয়ের জন্যেই তো বাবা কেবল টাকা জমাচ্ছেন।'

সুধা বলে, ও, তোর বুঝি সেই দুঃখ! তোর বিয়ের জন্যেও আর একজনের বাবা এর চেয়ে বেশি টাকা জমিয়ে তুলছে তা জানিস?

টাকাও জমে, গয়নাও জমে। বিয়েই শুধু হয় না সুধার। তিন-চাব বছর ধরে এত সন্মন্ধ এল গেল, কিন্তু হরগোবিন্দের মোটে পছন্দই হয় না। যে ছেলের রূপ আছে তার বিদ্যা কম, যার বিদ্যা আছে তার আবার বিদ্যা বিক্রির সামর্থ কম, যার অর্থ আছে তার আবার কুল নেই, এমনি বাছাই করতে করতে সুধার বয়স কুড়ি পেরিয়ে গেল।

সুধার মাসীমা থাকেন বউবাজারে। তিনি প্রায়ই এসে হরগোবিন্দকে তিরস্কার করে যান, জামাইবাবু, এ করছেন কি? দেখে শুনে মেয়ের এবার বিয়ে দিন। বয়স হয়ে গেছে! এখন বেশি বাছবিচার করা কি ভাল ?’

হরগোবিন্দ জবাব দেন, কি করব বল কমলা? তোমার মত চার-পাঁচটি তো নয, আমার ওই একটি মাত্রই মেয়ে। বাছবিচার একেবারে ছেড়ে দিলে কি চলে? তাছাড়া হিন্দুর ঘর। একবার ভুলভ্রাস্তি হ’লে তো আর শোধরাবার জো নেই।’

সুধাও বাপের পক্ষ টেনে কথা বলে। তারও বিয়েতে ভারি অমত। হাবুল আরও বড় হোক, স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকুক। নিজের শরীরের আর জিনিসপত্রের যত্ন নিতে শিখুক, তাবপর বিযে করবে সুধা। এখন দিদিকে না হ’লে হাবুলের যে একদিনও চলে না।

মেয়ের এই যুক্তিতর্কে মনে মনে খুশিই হন হরগোবিন্দ। শুধু বাইরের চেহারাই নয়, হৃদয়টাও মায়ের মতই পেয়েছে সুধা। ভারি কোমল মন, স্নেহভরা বুক। হরগোবিন্দ অফিসে বেরুবার আগে লন্ড্রী থেকে ধুইয়ে আসা শার্টে যখন বোতাম পরাতে বসে সুধা, কি উপুড় হয়ে তার পায়ের জুতা ব্রাশ করতে থাকে, দেয়ালে টাঙানো নির্মলার প্রথম যৌবনের ফোটোর সঙ্গে মেয়েকে মিলিয়ে দেখেন হরগোবিন্দ। আকৃতি-প্রকৃতিতে ঠিক  একেবারে দ্বিতীয় নির্মলা। তেমনি পিঠভরা কালো চুলের রাশ, তেমনি শ্যামলা গায়ের রঙ, আর ঠিকক তেমনি নাক চোখ ঠোঁটের চিবুকের ছাদ। সুধার মাযের সঙ্গে তার যে এত মিল আছে, তা ওর মাসী মেসো স্বীকার করতে চায না। কিন্তু নির্মলাকে কি হরগোবিন্দর চেয়ে তারা বেশি দেখেছে, না, বেশি জেনেছে ?

শুধু বাপকেই নয়, ভাইকেও ভারি যত্ন করে সুধা। হরগোবিন্দের মনে হয়, নির্মলা বেঁচে থাকলেও যেন হাবুলের এত বেশি যত্ন হত না। এই সেদিন পর্যন্ত গামছা দিয়ে ভিজে মাথা মুছে তার টেরি কেটে দিয়েছে সুধা। আজকাল হাবুল দিদির চেয়ে ইঞ্চি দুই লম্বা হয়ে গেছে বলে সুধার পক্ষে ভাইয়ের মাথা আঁচড়ে দেওযার সুবিধে হয় না। কিন্তু এখনও নাওয়া খাওয়ার সব ব্যাপাবেই হাবুল দিদির ওপব নির্ভরশীল। থার্ড ক্লাসে পড়লে হবে কি, বয়স চোদ্দ উতরে পনেরোয় পড়লেই বা কি হবে, স্বভাবে এখনও হাবুল প্রায় আট-দশ বছরের বালক। যেমন অগোছালো, তেমন অন্যমনস্ক। ওর বইপত্তর খাতা-কলম কোথায় থাকে, স্কুলের সময় সব খোঁজ পড়ে। অফিসে যাওয়ার সময় হরগোবিন্দ যেমন ব্যস্ত হতে থাকেন— সুধা, সুধা , হাবুলও তেমনি স্কুলে যাওযার সময় ডাকে – দিদি, দিদি।



রান্না রেখে, কি হাতের অন্য কাজ ফেলে সুধাকে তৎক্ষণাৎ উঠে আসতে হয়। বিয়ের কথায় ও যে হাবুলের নাবালকত্বের দোহাই দেয় তা একেবারে অযথা বলা চলে না।

হরগোবিন্দও সন্তানবৎসল কম নন। ঠিকে-ঝি যেদিন কাজ কামাই করে তিনি নিজের হাতে বালতিতে ক’রে জল টানেন, মেযের উনুন ধরিয়ে দেন।

সুধা আপত্তি করে বলে, “আচ্ছা বাবা, তুমি যদি এসব করবে তো আমি আছি কি জন্যে দু বালতি জল কি আমি তুলতে পারি না? হরগোবিন্দ মাথা নেড়ে বলেন, না পার না। জল তুলতে গিয়ে তোমার মোমের মত তুলতুলে হাতে যদি কড়া পড়ে যায় তোমার শ্বশুর শাশুড়ী কি আমাকে খোটা দিতে ছাড়বেন? আর শুধু কি শ্বশুর শাশুড়ী : তাদের সুপুত্রটিও আমাকে ছেড়ে কথা কইবেন না। সুধা লজ্জিত হয়ে মুখ নীচু ক’রে বলে, কি যে বল বাবা!"

উনুন ছাড়াও একটি স্টোভ আছে ঘরে। কিন্তু পারতপক্ষে সেটা সুধাকে হরগোবিন্দ ধরাতে দেন না। যদি কোন বিপত্তি ঘটে। যদি কোন খুঁত হয়ে যায় মেয়ের, তা হলে কি রক্ষা আছে! প্রথম প্রথম ঘরের মেঝেয় ঢালা বিছানা করে ছেলেমেয়েকে নিয়ে একসঙ্গেই শুতেন হরগোবিন্দ। এক পাশে তিনি, মাঝখানে হাবুল, আর একপাশে সুধা। কিন্তু একদিন ঘুমের ঘোরে ‘গোল’ ‘গোল করে দিদির গায়ে লাথি ছুড়ল হাবুল। সুধা না ঠেকালে হাবুলের কপালে যে সেদিন কি হ’ত তা বলা যায় না। মেয়ের জন্যে ছেলেকে মারতে পারলেন না হরগোবিন্দ, কিন্তু আচ্ছা করে বকুনি লাগালেন। তারপর ছোট একখানা তক্তপোশ কিনে এনে সুধার আলাদা বিছানার ব্যবস্থা ক’রে দিলেন। তার কোনও আপত্তি শুনলেন না। কেবলই বলতে লাগলেন, যদি চোখেমুখে লেগে যেত তা হ’লে কি হ’ত!

সুধা বললে, ম’রে যেতাম একেবাবে। আমার কি এমনই মোমের শরীর যে, একটা টোকা পর্যন্ত সইতে পারি না।’

হরগোবিন্দ বললেন, ‘কেন সইবি মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস জীবনভোর কত কি সইতে হবে। কিন্তু আমার কাছে যতদিন আছিস, একটু আঁচডও তোর গাযে আমি লাগতে দেব না।’


তক্তপোশে শোয় সুধা। আর নীচে হাবুলকে নিয়ে থাকেন হরগোবিন্দ। কিন্তু হরগোবিন্দ ঘুমোন না। শুয়ে শুয়ে মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে থাকেন। তার সেই প্রথম জীবনের গল্প, প্রথম যৌবনের গল্প।স্কুল-কলেজ, বন্ধু-বান্ধব,সাঁতার,শিকার, দেশভ্রমণ, আর দুঃসাহসিকতার কাহিনী। সুধার মায়ের কথাও ওঠে। মেযের কাছে কিছুই গোপন করেন না হরগোবিন্দ। মেয়ে এখন তার বান্ধবীর মত। নির্মলার সেই প্রথম বয়সের মান-অভিমান, শাডি-গযনার আবদার, খুঁটিনাটি নিয়ে কলহ-মিলনের কাহিনী। এসব গল্প সুধা বহুবার শুনেছে। কিন্তু কোন কথা বলে বাবাকে একবারও বাধা দেয় না। তারপর অতীত থেকে ভবিষ্যতে চলে যান হরগোবিন্দ। সুধার ভাবী ঘর-সংসারের চিত্র আঁকেন। মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে কত ছলে কতবার করে যাবেন, শ্রদ্ধাভাজন হয়েও জামাইয়ের সঙ্গে কি রকম বন্ধুর মত ব্যবহার করবেন, বছরে কবার কবে মেযে-জামাইকে নিয়ে কলকাতার বাইরে সমুদ্র কি পাহাড়ের ধারে বেড়াতে বেরুবেন, তার জল্পনাকল্পনা চলে। জামাই পেশায় কি হবে—ডাক্তার না উকিল, প্রফেসার না ইঞ্জিনিয়ার, সে সম্বন্ধে মেযের মতামত জিজ্ঞেস করেন হরগোবিন্দ। তার গায়ের রঙ, চোখ-মুখের গড়ন, শরীরের দৈর্ঘ্য সম্বন্ধেও মেয়ের মত নিতে ছাড়েন না।

হরগোবিন্দের এত জিজ্ঞাসার, এত জল্পনা-কল্পনার উত্তরে সুধা সংক্ষেপে বলে, “তোমার পছন্দেই আমার পছন্দ বাবা। তুমি যেমন চাইবে তেমনি হবে।

ছেলে-মেয়ে নিযে হরগোবিন্দ বেশ ছিলেন। তাদের এই ছোট্ট সংসারে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কাররই বিশেষ কোন স্থান ছিল না। যেন বাইবের জগতের কাউকে দিয়ে তেমন কোন প্রয়োজন নেই হরগোবিন্দর। কিংবা যেটুকু প্রয়োজন আছে সেটুকু শুধু বাইরেরই প্রয়োজন। কাগজে্র হকার, দুধওযালা, কয়লাওয়ালা, মুদী  ট্রামবাসের কণ্ডাক্টারের মতই স্বজনবন্ধু পাডাপড়শীর সঙ্গে ব্যবহার করতেন হরগোবিন্দ। তারা কেউ এলে দুমিনিট যেতে না যেতেই তিনি তাদের বুঝিয়ে দিতেন,তৃতীয় কি চতুর্থ মিনিটে তাদের ঘবে আগন্তুকের আর থাকবার দরকার নেই। হরগোবিন্দের ঘনিষ্ঠ আত্নীয়দের মধ্যে সবচেয়ে যারা কাছে থাকেন-তার শালিকা কমলা আর ভাযরাভাই মণিময় চক্রবর্তী—তারা পর্যন্ত এসে অস্বস্তি বোধ করতেন। বেশিক্ষণ টিকতে পারতেন না। কমলা বোনপো-বোনকে মাঝে মাঝে নিয়ে নিজের কাছে রাখতে চাইতেন, কিন্তু আজ নয, কাল’ বলে একটা-না-একটা অজুহাতে হরগোবিন্দ প্রায়ই তার অনুরোধ এড়িয়ে যেতেন। ইদানীং অভিমানে কমলা আর তাদের নেওযার কথা মুখে আনতেন না।

ছুটিছাটার দিনে হরগোবিন্দ নিজেই মাঝে মাঝে ছেলে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে বেরুতেন। কোনদিন আত্মীযস্বজনদের বাড়ি, কোনদিন চিড়িযাখানা, যাদুঘর, কোনদিন বা গঙ্গার ধার দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। বছরে একবার করে সিনেমা আর একবার করে সার্কাস বরাদ্দ ছিল সুধা-হাবুলের জন্যে। হরগোবিন্দ নিজেই ওদের সঙ্গে ক’রে নিয়ে যেতেন। তাদের মাঝখানে আর কেউ আসুক আর কেউ থাকুক, তা তিনি বড় একটা পছন্দ করতেন না। তবু চতুর্থ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল।

ডাক্তার নয, উকিল নয, প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার কিছু নয, সে নেহাতই সাধারণ একজন প্রাইভেট টিউটর, নাম ইন্দুভূষণ দাস। তার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ, রঙ কালো,আকার মাঝারি, চোখ ছোট, নাক চ্যাপ্টা। সুপুরুষ তাকে কিছুতেই বলা চলে না, বরং স্বভাৰ এত শান্ত আর নিরীহ যে পুরুষ বলতেও দ্বিধা হয়।

থার্ড ক্লাস থেকে সেকেণ্ড ক্লাসে প্রমোশন পেল বটে হাবুল, কিন্তু কোন বিষয়েই নম্বর ভাল পেল না। ইংরেজীতে টেনে-টুনে পাশ করেছে, অঙ্কে পাশের নম্বর পর্যন্ত পায় নি।

সুধা বলল, “বাবা, আমাকে না হয় সেকেণ্ড ক্লাস থেকেই পড়া ছাডিয়ে এনে ঘরে বসিযে রেখেছ, হাবুলকে তো আর তা পারবে না। ওকে পড়াতেই হবে। কিন্তু শুধু স্কুলের ওপব যদি ভরসা কর, ওর কিছু হবে না তা বলে দিচ্ছি।’


হরগোবিন্দ বললেন, তা হলে কি করতে হবে ?
সুধা বলল, প্রাইভেট টিউটর রাখ।
হরগোবিন্দ বললে, ‘ওরে বাবা, সে যে বহু টাকার ধাক্কা।
সুধা বলল, “হোক। ও যদি মানুষ না হয়, টাকা দিয়ে করবে কি তোমার দেখবার যখন সময় নেই, মাস্টার একজন না রাখলে চলবে না।"

প্রথম খোঁজ পড়ল পাকা দাড়িওয়ালা অভিজ্ঞ শিক্ষকের, কিন্তু তাদের দক্ষিণা অনেক। চল্লিশ-পঞ্চাশের কমে কেউ সব বিষয়ে পড়িয়ে যেতে রাজী নন। শেষ পর্যন্ত দরকষাকষি ক'রে কুড়ি টাকায় ইন্দুভূষণকে পাওয়া গেল। সে শ্যামবাজারের একটা মেসে থাকে। ওদিকেই কোন একটা হাই-স্কুলে পড়ায় আর টিউশনি করে। বেলগাছিযার এদিকে আরও দু-একবাড়িতে ছেলে পড়িযে সুনাম কিনেছে। হরগোবিন্দের দুতিনজন প্রতিবেশী তার জন্য সুপারিশ করলেন।

হরগোবিন্দ ইন্দুভূষণকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর হেসে বললেন, “আপাতত কুড়ি টাকা করেই দেব। তারপর ছেলের রেজাল্ট যদি ভাল হয় তখন আলাদা বকশিস আছে। মিথ্যে বলছিনে, তখন যা চাইবেন—

ঘরের এক কোণে বসে তবকারি কুটছিল সুধা, বাবার কথা শুনে ভারি লজ্জা পেল! ছিছি, একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কি অমন ক'রে কথা বলতে হয়।

ইন্দুভূষণ হেসে বলল, ও যদি ভাল রেজাল্ট করে, সেই তো আমার সবচেযে বড় বকশিস হরগোবিন্দবাবু।

 বঁটি থেকে চোখ তুলে ইন্দুভূষণের দিকে তাকাল সুধা। তার ঠোটে তখন একটু হাসি লেগে রযেছে। সুধার মনে হ’ল, এমন শান্ত সুন্দর হাসি সে জীবনে আর কারও মুখে দেখে নি। তাছাড়া পাল্টা জবাবটাও ভারি চমৎকার লাগল। এমন কথা যে-কোন পেশাদার শিক্ষকই হয়তো বলেন, বলতেন। কিন্তু সুধার মনে হ’ল, এমন অন্তর দিয়ে কেউ বলতে পারতেন না।

পরদিন থেকে রোজ সন্ধ্যায় ইন্দুভূষণ হাবুলকে পড়াতে আসে। সুধা নিজের খাটের ওপর ফরসা চাদর পেতে শিক্ষক-ছাত্রের বসবার আসন করে দেয়। ইন্দুভূষণ হাবুলকে একমনে পড়াতে থাকে। ঘরে যেন আর দ্বিতীয় কেউ নেই। এতটা মনোযোগ সুধার কেন যেন ভাল লাগে না। ডালে সম্বরা দিতে দিতে সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, রান্নার গন্ধে আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

ইন্দুভূষণ হাবুলের অঙ্কের ভুল বার করে দিয়ে সুধার দিকে তাকায, আমাকে বলছেন?

সুধা হেসে বলে, নযতো কাকে আপনি কি ভেবেছেন হাবুলের সঙ্গে এতক্ষণ ভদ্রতা করছিলাম।

 ইন্দুভূষণও না হেসে পারে না ; বলে, ও ভদ্রতা, তা হলে তো ভদ্রতা করে আমাকেও জবাব দিতে হয়—না, না, মোটেই কষ্ট হচ্ছে না, ভারি চমৎকার লাগছে।’

সুধা হাসিমুখে বলে, আর যদি ভদ্রতা বাদ দিযে বলেন, তাহলে?

 ইন্দুভূষণ জবাব দেয়, তা হলেও আমার বক্তব্যটা বদলায় না। আপনি মোটেই উদ্বিগ্ন হবেন না। রান্নার গন্ধ আমার সত্যিই খুব ভাল লাগে।

আপনি ঠাট্টা করছেন। এমন জায়গায় বসে কেউ পড়াতে পারে?

ইন্দুভূষণ একটু চুপ করে থেকে বলে, না ঠাট্টা নয়। আপনাকে রাঁধতে দেখে নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন পড়াতুম না, পড়তুম। বাবা ছিলেন ওষুধের ক্যানভাসার। বাইরে বাইরে ঘুরতেন। মার ওপর ছিল সব ভার। তিনি জোর করে টেনে নিয়ে রান্নাঘরে বসাতেন। হলুদ-মাখা হাতে কালো শ্লেটেব ওপর অঙ্ক লিখে দিতেন। অনেক দিন পরে ঠিক সেই রান্নার ঝাঁঝ, রান্নার  গন্ধ আজ পেলাম এখানে।

শুনতে শুনতে সুধার গা কেন যেন সিরসির করে ওঠে। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার মা এখন কোথায় আছেন ?"
ইন্দুভূষণ জবাব দেয়, আমার স্মৃতিতে।'
আর বাবা
প্ৰায় বছর পাঁচেক হল তিনিও চলে গেছেন।
 সুধা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। কড়ার মধ্যে অনড় হয়ে থাকে খুন্তি। একটু বাদে ফের সে জিজ্ঞাসা করে, আর কে কে আছেন আপনার ? ভাই বোন ?
ইন্দুভূষণ বলে, ‘কেউ না।
সুধা যেন আর্তনাদ করে ওঠে, কেউ না! কেউ না-থাকলে মানুষ থাকে কি করে?
আমারও মা নেই, কিন্তু বাবা আছেন, ভাই আছে। আর আপনার সত্যিই কেউ নেই?
ইন্দুভূষণ এ কথার কোন জবাব না দিয়ে সুধার সেই মমতাভরা করুণা-ভরা কালো বড় বড় চোখ দুটির দিকে অবাক হয়ে একটুকাল তাকিয়ে থাকে। তারপব চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ছাত্রকে বলে, হাবুল, এবার রেকরিংয়ের অঙ্কটা করতো।
এমনি করে আস্তে আস্তে আলাপ জমে, আলাপ এগোয়।
একদিন সুধা বলে, “আপনি তো রোজ শুধু রান্নার গন্ধ নিয়েই যান। আজ আপনাকে খেয়ে যেতে হবে।’
ইন্দুভূষণ আপত্তি করে, না, না। তারপর একটু হেসে বলে, ঘ্রাণেই তো রোজ অর্ধভোজন হয়ে যায়।’
সুধা বলে, কিন্তু দু-একদিন পূর্ণভোজনও হতে পারে। তাতে আপনার জাত যাবে না।’
ইন্দুভূষণ বলে, “আমার জাতের জন্যে তো ভয় নেই।’
সুধা বলে, আমাদের জাতের জন্যেই বুঝি ভয! আপনি ভাববেন না, অত বাছবিচার আমবা করি নে। তা হ’লে কি আর এ ভাবে থাকতে পারি ?

পড়ানো হযে গেলে ইন্দুভূষণকে খেতে বসতে হয়। আয়োজনে পরিবেশনে খুবই যত্ন নেয় সুধা। দু-একটা নতুন তরকারি রাঁধে। যেন কোন উৎসবের দিন এসেছে। এ ধরনের নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ মাসে দু-তিন দিন লেগেই থাকে।

একদিন অফিসে বেরুবার সময় হরগোবিন্দ ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি রে হাবুল, মাস্টার মশাই কেমন পড়াচ্ছে তোক?
হাবল বললে, ভালই পড়াচ্ছেন বাবা।’
হরগোবিন্দ বললেন, “আচ্ছা, তুই আমার জন্যে একটা সিগারেট নিয়ে আয় তো।
হাবুল বেরিয়ে গেলে মেয়েকে বললেন, সুধা, তোকে একটা কথা বলি।
-বল।
হরগোবিন্দ বললেন, মাস্টার যাতে ফাঁকি না দেয়, যতক্ষণ থাকে যাতে মন দিয়ে পড়ায় তুইই তা দেখবি। কিন্তু তুই নিজে নিজেই নাকি তার সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করিস?

বাপের শাসনে সুধার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। একটু চুপ করে থেকে বললে, এ নালিশ তোমাব কাছে কে করেছে বাবা ? হাবুল ?

হাবুল কেন করবে? সে করলে কোন দোষের হত না। কলতলার অন্য ভাডাটেরা সব আলোচনা করছিল, তাই কানে গেল।’

সুধা বললে, এর আগে অন্য কারও কথা তো তুমি কানে তুলতে না বাবা।’
হরগোবিন্দ বললেন, ‘এখনও তুলি নে। তবে জানিস তো, বাড়িটায় যত সব বাজে লোকের আড্ডা। তা ছাড়া আমার ঘরে আর তো কোন মেয়েছেলে নেই। তাই আমাদের একটু সাবধান হয়ে চলাই ভাল।
‘বেশ তুমি যদি বল, তাই চলব বাবা।"


হ্যা, তাই চলিস। আর অত খাওয়ানো-দাওয়ানোরই বা দরকার কি! কোন উপলক্ষ টুপলক্ষ হলে বললি, সে এক কথা।
সুধা বলল, “বেশ।

কলতলায়, বাথরুমে, বাডির আরো সব ভাড়াটের ঘরে ইন্দুভূষণের সঙ্গে তার এই ঘনিষ্ঠতা নিয়ে যে ফিসফিস গুজগুজ শুরু হয়েছে, তা সুধারও কানে গেছে। তারই প্রায় সমবয়সী কোণের ঘরের রেণু সেদিন গায়ে পড়ে হেসে বলেছে, কি ভাই, মাস্টারমশাই শুধু হাবুলকে পড়ান, না তোমাকেও পড়ান ?
সুধা গম্ভীরভাবে জবাব দিয়েছে, আমাকেও পড়ান।

দোতলার সরকারদের ছোট বউ সুলতা কাছেই ছিল, সে সঙ্গে সঙ্গে হেসে জিজ্ঞাসা করেছে ও মা, তাই বল। তা কোন ক্লাসের পড়া পড়ান তোমাকে— বি.এ ক্লাসের বুঝি ? বলতে বলতে হেসে রেণুর গায়ে গড়িয়ে পড়েছিল সুলতা।

সুধা কোন কথা না বলে জল নিযে ঘরে চলে এসেছে।
কিন্তু শুধু বউ-ঝিরাই নয়, এ বাড়ির পাঁচঘর ভাড়াটের নানাবয়সী পুরুষরা পর্যন্ত ব্যাপারটা সম্বন্ধে উৎসুক হয়ে উঠেছে । সুধা যাদের কাকাবাবু আর মেসোমশাই বলে সেই প্রৌঢ় কম্পাউণ্ডার পঞ্চানন সরকার, পোস্ট-অফিসের কেরানী হীরালাল গাঙ্গুলি, রেল-অফিসের বীরেশ্বব মিত্র , সুধা যাদের নামের সঙ্গে দাদা যোগ করে ডাকে, সেই বাসু, রণজিৎ আর সুরেন সকলেরই কানে গেছে, চোখে পড়েছে বিষয়টা। তাদের ভাবভঙ্গি,হাসি আর তাকাবার ধরণ দেখলেই সুধা টের পায়, সকলেই যেন কিছু একটা মনে মনে আন্দাজ করেছে।

এতদিন হরগোবিন্দকে সবাই বলত দাম্ভিক, অমিশুক,অসামাজিক। সুধাকেও তাই বলত। বেশি রকম দেমাকী, অহংকারি। তারপর সকলেই তাদের সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে থাকত। সুধা আজও সেই উদাসীনই রয়েছে, কিন্তু অন্য সবাই যেন আগের মত আর দূরে সরে থাকতে পারছে না। বাবা আর ভাই ছাড়া তৃতীয় আর একটি পুরুষের সঙ্গে সুধার সামান্য আলাপ হয়েছে বলে এই গোটা বাড়িটা যেন তার ছোট্ট ঘরখানির মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইছে। শুধু যে তারাই সুধার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে তাই নয, সুধাও তাদের সম্বন্ধে অচেতন থাকতে পারছে না। এ বাড়িতে যে এতগুলি লোক থাকে তা কি সুধাই এতদিন টের পেয়েছে: শুধু এ বাডিটাই বা কেন, তাদের গলির আরও দু-তিনখানা বাডির মেয়ে-পুরুষে পর্যন্ত জেনে ফেলেছে কথাটা। ইন্দুমাস্টার সম্বন্ধে তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার ধরন দেখেই সুধা তা বুঝতে পেরেছে। যেন প্রাইভেট টিউটর আর কারও বাডিতে আসে না, তার সঙ্গে বাড়ির আর কোন মেয়ে কি বউ কথা বলে না, যেন এ পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেযের এই সর্বপ্রথম আলাপ হযেছে।

কিন্তু অন্য কারও বাকা কটাক্ষে, খোচা দেওয়া কথায় সুধার কিছু এসে যায না। বাবা যে তাকে আরও একদিন সতর্ক করে দিলেন, তাতেই সুধার মনে একটু লাগল।

হরগোবিন্দ বললেন, সুধা, একটু সাবধান হয়ে চলিস্। তোর ঘরে তো মা নেই, আর কাজকর্ম ফেলে বেশিক্ষণ ঘরে বসে থাকা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। তোর নিজেকেই বুঝে সমঝে চলতে হবে।
সুধার ভারি দুঃখ হল, মনে মনে ঠিকক করল ইন্দুভূষণের সঙ্গে সে আর কোন কথা বলবে না। চায়ের কাপটি পর্যন্ত হাবুলকে দিয়ে দেওয়াবে।

কিন্তু সঙ্কল্প রাখা গেল না। সুধা কথা না বললে কি হবে, আজ অন্যপক্ষ থেকে কথা শুরু হ’ল। হাবুলকে এক প্যাসেজ ট্রান্সিলেশন করতে দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইন্দুভূষণ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আজ বড় গম্ভীর হয়ে রয়েছেন যে শরীর খারাপ করেছে নাকি?’

শেষের কথাটুকুতে ভারি মমতা প্রকাশ পেল ইন্দুভূষণের। সে নিজে থেকে সহজে আগে আলাপ করে না। আজ করল। এটাও ভারি নতুন লাগল সুধার, ভারি ভাল লাগল। বাড়িসুদ্ধ লোকের বিরূপতা ইন্দুভূষণের ওই এক ফোটা দরদে যেন সব ধুয়ে মূছে গেছে।

প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়ে সুধা বলে ফেললে, “মানুষের শবীরটাই বুঝি সব?

সুধার অভিযোগের ভঙ্গিতে ইন্দুভূষণ মৃদু হাসলো "ও, আপনি বুঝি মন খাবাপ করার কথা বলছেন। সত্যি মন খারাপ হওয়াটা শরীর খারাপ হওয়ার চেয়ে ঢের কষ্টের।’

মন খারাপ হওযার কথা শুনতেও এত ভাল লাগে! সুধা হেসে বলল, আপনি কি করে জানলেন? আপনারও মাঝে মাঝে মন খারাপ হয নাকি?’

হয় বৈকি।

তখন কি করেন?'

চুপচাপ বসে থাকি, না হয় বই পড়ি। আচ্ছা, আপনি কি কেবলই রান্নাবান্না ঘরসংসার নিয়ে থাকেন, বইটই পড়েন না?

পড়ি বই কি, হাতের কাছে যা পাই তাই পড়ি।

ইন্দুভূষণ হাসল,আপনি বুঝি প্রতিজ্ঞা করেছেন,হাতের কাছে যা পাবেন শুধু তাই পড়বেন?

সুধা মুখ তুলে একবার তাকাল, তারপর চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল, কেউ যদি খুঁজে পেতে এনে দেয় তাও পড়তে পারি'।

ইন্দুভূষণ যেন শুধু এইটুকুর অপেক্ষায় ছিল। তারপর থেকে প্রায় রোজ সে বই আনতে লাগল। সব গল্প-উপন্যাস নয়। জীবন-চরিত, ভ্রমণ-কাহিনীও আছে। কিন্তু সুধার গল্প উপন্যাস ছাড়া আর কিছুতে মন ওঠে না।

আস্তে আস্তে সুধার কাছে আর এক জগতের দ্বার খুলে যেতে লাগল। সে জগৎ এই ভাড়াটে বাডির লোকজনের মত অনুদার নয়, প্রতিকূল নয়, সে জগৎ বড় মনোরম আর মধুর। এর আগে কে জানত পৃথিবীতে এত ভাল ভাল বই আছে। আর সে সব বইয়ের লেখকেরা সুধারই মনের কথা চুরি করে নিয়ে লিখেছে। এর আগে কে জানত তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট পুকুরটার ধারে যে দুটো নারকেল গাছ রয়েছে তাদের পাতাগুলি সবুজ, বোসেদের বাড়ির ছাদে সাদা সাদা চন্দ্রমল্লিকার টবগুলি এত সুন্দর। তারও ওপরে অগুণিত তারাভরা আরও সুন্দর আকাশ কি চোখে পড়েছে এর আগে!

মাঝে মাঝে দশ-বারো বছরের একটি ছেলে এই রাস্তায় ফুল ফিরি করতে আসে, তার নাম সুখন। ওর নামটি যে এত ভাল, এমন ধ্বনিময়, অর্থময়, কই, এর আগে তো সুধার খেয়াল হয় নি। তার কাছ থেকে প্রায়ই চার আনা ছ' আনার ফুল কিনে নেয় সুধা। কোনদিন সাদা বেল কি রজনীগন্ধা। কোনদিন বা রক্তগোলাপ। কোনদিন সে ফুলে ফুলদানি সাজায়, কোনদিন নিজের খোপায় গোঁজে।

হরগোবিন্দের কিছুই চোখ এড়ায় না। মনে মনে ভাবেন, আজকালকার মেয়েগুলির লজ্জা-শরম বড় কম। একদিন স্পষ্ট করেই বললেন, মিছিমিছি ফুলের পেছনে এত পয়সা নষ্ট করিস কেন সুধা?”
সুধা জবাব দেয়, কই ফুল তো বেশি কিনি নে বাবা।’

হরগোবিন্দ ভিজে গামছা দিয়ে গা রগড়াতে রগড়াতে বলেন, এতেও তোর বেশি কেনা হয় না। তুই কি বাগান সুদ্ধ কিনতে চাস হ্যা,আর এককথা। গয়না যদি পরতে ইচ্ছা হয়, বল, ভল্ট থেকে সব নিয়ে আসি। ওসব ফুলের সাজ-টাজ ভাল না। ভদ্রলোকের মেয়েরা ওভাবে সাজে না। ও সব করে—’, রূঢ় কথাটা পালটে নিয়ে হরগোবিন্দ বলেন, ইয়েরা।

সুধা হয় নিরুত্তর থাকে, না হয় অন্য কথা পড়ে। মনে মনে খুবই রাগ হয় তার। বাবা যেন আজকাল কি রকম হয়ে যাচ্ছেন। সে খোপায় ফুলের মালা জড়াল কি না জড়াল কেন বাবা দেখতে আসবেন। সংসারের কাজ-কর্ম কি সেবাযত্নের যদি কোন ক্রটি হয় তবেই তিনি রাগ করবেন। মেয়ের সাজসজ্জার দিকে কেন তার চোখ পড়বে।

কিন্তু হরগোবিন্দ পছন্দ না করলে কি হয়, ইন্দুভূষণ যে ফুল খুব ভালবাসে তা সুধার বুঝতে বাকি নেই। সে প্রশংসা-ভরা চোখে সুধার ফুলদানির দিকে তাকায, ছাত্রকে জ্যামিতির উপপাদ্য বোঝাতে বোঝাতে এক-একবার খোপার গোলাপটির দিকে আপলকে চেয়ে থাকে। সুধা সন্ধ্যার আগেই রান্নার পাট চুকিয়ে দিয়ে টুল পেতে বোনার কাজ নিয়ে বসে, বা ইন্দুভূষণের এনে-দেওয়া গল্পের বই পড়তে থাকে।

হরগোবিন্দ এক-একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে সুধাকে অমন ইন্দ্রাণীর মত বসে থাকতে দেখে গম্ভীর হয়ে যান। মেয়েকে কাজের ফরমায়েস করে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দেন। তারপর ইন্দুভূষণের দিকে চেয়ে বলেন, কি মাস্টা্র, পড়ানো-টড়ানো কেমন চলছে?

ইন্দুভূষণ সংক্ষেপে বলে, ভাল।
 কি রকম ভাল, ছেলের পরীক্ষার ফল দেখলেই তা টের পাব।
ইন্দুভূষণ হেসে বলে, বেশ তো, দেখবেন।

ওর এই নিশ্চিত্ত হাসিতে ভিতরে ভিতরে হরগোবিন্দ কেমন যেন একটা অপমান বোধ করেন। মনে মনে ভাবেন, এত জোর ও কোথেকে পায! ও কি বোঝে না হরগোবিন্দ সব টের পেয়েছেন। বামন হয়ে যদি চাদে হাত দেওয়ার স্পর্ধা হয়ে থাকে হরগোবিন্দ যে কোন মূহুর্তে সেই হাত মুচড়ে ভেঙে ফেলতে পারেন। মিটমিটে শয়তান ছোকরা। কি করে সুধার সঙ্গে কথা বলবে সেই ছল খোঁজে। সুধা যখন হরগোবিন্দের সঙ্গে কথা বলে, ও কান খাড়া করে থাকে , সুধা যখন ওকে কিছু বলে, ও যেন হাতে স্বৰ্গ পা্য।

যে কোন সময় হরগোবিন্দ ওকে তাড়িয়ে দিতে পারেন, বলতে পারেন, তোমার পড়ানো ভাল হচ্ছে না মাস্টর, তোমাকে দিয়ে আমার কাজ চলবে না।

কিন্তু এইটুকু অপমানে যেন বড় লঘু শাস্তি হয়ে যায়। হরগোবিন্দর ইচ্ছা আরও কঠিন শাস্তি দেন ওকে। শূদ্র হয়ে বামুনের মেয়ের দিকে তাকাবার গুরুদণ্ড। না, কাজ থেকে ওকে ছাড়িয়ে দেবেন না হরগোবিন্দ। কাজে বহাল রেখেই ওকে অপমান করবেন। ওর চোখের সামনে সুধার বিয়ে দিয়ে দেবেন। বিয়ের দিন নিমন্ত্রণ করে এনে চাকরের মত ফাই-ফরমায়েস খাটবেন। সুধা শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে ওর আরও পাঁচ টাকা মাইনে বড়িয়ে দিয়ে টিউটরের চাকরিতে বহাল রাখবেন। তারপর ছোকরা খালি ঘরে কি ভাবে ছটফট করেন দেখবেন চেয়ে চেয়ে। তার আগে মশা মেরে হাত নষ্ট করে লাভ নেই।



শক্ৰনির্যাতনের সহজ পথ হরগোবিন্দের মনঃপূত নয়। অফিসে যারা তার বিকদ্ধে ক্লিক করে তাদেরও তিনি এমনি বহু দিন ধরে ঘুরিযে ঘুরিয়ে জব্দ করেন। তাতে শক্রকে শাস্তি দেওযার সুখানুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। যে লজেনস চুষে খাওয়ার জন্যে, তা তিনি চিবিয়ে খেতে চান না। বরাহনগরে মুখুয্যেদের সঙ্গে যে সম্বন্ধটা চলছিল তা তিনি পাকা করে ফেললেন। ছেলেটি এ. জি. বেঙ্গলে চাকরি করে। নিজস্ব বাড়ি আছে শহরে। তার বাবা মেয়ে দেখে পছন্দ করে গেছেন। ছেলে নিজেও এসে দেখবে কি না জিজ্ঞাসা করায় বলেছেন, ওসব বেয়াডাপনা আমাদের ফ্যামিলিতে নেই মশাই। ছেলে আগে দেখবে কি দেখবে সেই শুভদৃষ্টির সময়। সুধার ঠিকুজী নিয়ে মুখুজ্যে মশাই কুলপুরোহিত দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে জেনেছেন একেবারে রাজযোটক। এমন মিল আর কোন কনের ঠিকুজিতে পান নি। সুধার মত এমন সুলক্ষণ আর কোন মেয়ের মধ্যে মেলেনি। ঠিকুজী আর মেয়ের মুখশ্রী দেখেই এগিয়েছেন মুখুয্যে মশাই। নইলে হরগোবিন্দের সামাজিক অবস্থা বিচার করলে এতদূর অগ্রসর হওয়ার কারণ ছিল না।

রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরের মেঝেয় যখন বাবা আর হাবুলের জন্যে বিছানা পাতবার উদ্যোগ করছিল সুধা, হরগোবিন্দ তক্তপোশে পা ঝুলিয়ে সিগারেট টানতে টানতে বললেন, বরানগরের সম্বন্ধটাই ঠিক   করলাম সুধা। বেশি বড়লোকের পেছনে ছুটোছুটি করে লাভ নেই। নিজের শক্তিসামর্থে যা কুলোয় তাই করা ভাল। দেখেশুনে মনে হল ওরা আমাদের মতই গেরস্থ। ঠাকুর-দেবতা ধর্ম-কৰ্ম মানে। আমাদের সঙ্গে বেশ মিলবে। পাকা দেখার দিন ঠিক করার আগে তোর মাসীকে একবার খবর দিতে হবে।শত হলেও এসব কাজ মেযেছেলে না হ’লে –

হাবুলের জনো একটি আর হরগোবিন্দের জন্য জোড়বালিশ পেতে দিয়ে সদ্য সাবান-কাচা পরিষ্কার ঢাকনি সেই বালিশের ওপর বিছিয়ে দিল সুধা। ছোট ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললে, বসে বসে ঝিমুচ্ছিস কেন হাবুল, এবার শুয়ে পড়।’

তারপর ফের বিছানার চারদিকে চাদর শুক্তে দিতে লাগল।
হরগোবিন্দ বললেন, আমার কথার জবাব দিচ্ছিস নে যে ?
সুধা বললে, জবাব দেওয়ার আর কি আছে? ওসব বিয়ে-টিয়ের মধ্যে তোমার গিয়ে কাজ নেই।’

গিয়ে কাজ নেই মানে ? কেন, সম্বন্ধ কি তোর পছন্দ হচ্ছে না? ছেলেটির ফোটো তো আমি তোকে দেখিয়েছি। বেশ সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা। আমার অফিসের বন্ধুরাও এ সম্বন্ধর বেশ তারিফ করল।’
সুধা বললে, সে জন্যে নয় বাবা। আমি কোনদিন বিয়ে করব না। আমি তোমার কাছেই থাকব।

হরগোবিন্দ সস্নেহে বললেন, তাই কি হয় রে পাগলী। তুই চলে যাবি ভেবে আমারও কি কষ্ট হয় না? খুবই হয়। কিন্তু হলে কি করব! এই তো সংসারের নিয়ম। মেয়েকে পরের ঘরে পাঠাতেই হবে। সেই পরই তার আপন। সেই ঘরে গিয়ে তুই যদি স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে পারিস সুধা, আমার তাতেই সুখ, তাতেই শান্তি।

সুধা বাবার মশারি টাঙিয়ে দিতে দিতে বললে, “তুমি এবার শুতে যাও বাবা।’
হরগোবিন্দ বললেন, যাচ্ছি রে যাচ্ছি। আমার কথার জবাব দে। তা হলে বরানগরের-
 ' সুধ বললে, না বাবা। আমি ও-ধরনের সুখশান্তি চাই নে।

সিগারেটের টুকরোটা জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার জন্যে হরগোবিন্দ তক্তপোশ ছেড়ে উঠে এসেছিলেন, সেই অবসরে আলো নিবিয়ে নিজের মশারিটা ফেলে দিয়ে সুধা নিজেই শুয়ে পড়ল যেন সব আলোচনার এতেই ছেদ পড়ে যাবে।

মেযের এই অভব্যতা দেখে মনে মনে ভারি চটলেন হরগোবিন্দ। এত স্পর্ধা ওর হ’ল কোথেকে। অবশ্য বিয়ের নামে সুধা এর আগেও আপত্তি করত।কিন্তু সে আপত্তির সুর ছিল অন্য ধরনের, এখনকার মত এমন একগুঁযে স্বভাব তো তখন ছিল না সুধার! এমন উদ্ধত ভঙ্গিও তখন দেখা যায় নি।

হরগোবিন্দ শুতে গেলেন না। মেয়ের মশারির কাছে দাড়িযে গলা যথাসাধ্য নরম কবে বললেন, “তুই না চাইলেই তো আমি না চেয়ে পারি নে। বাপ হয়ে নিজের স্বার্থের জন্য তোকে চিরকাল আইবুড়ো করে রাখব, তোর জীবনটাকে নিষ্ফল করে দেব-এ কথা যে আমি ভাবতেও পারি নে সুধা। তোর কিসে অমত তাই বল, বরানগরের ওই সম্বন্ধ যদি তোর পছন্দ না হয়, ভবানীপুরের সেই ওভারসীয়ার ছেলেটিরই তা হলে ফের খোঁজ করি।

সুধা মশারির ভেতর থেকে বললে, না বাবা, তোমার আর কোন খোঁজখবর করতে হবে না।

হরগোবিন্দ ধৈর্য হারিয়ে হঠাৎ বলে ফেললেন, তার মানে ? তুমি নিজেইই বুঝি খোজখবর করে রেখেছ? গুণবতী মেয়ে কিনা। বেশ, কাকে পছন্দ করেছ তুমিই বল। সুধা চুপ করে রইল।


হরগোবিন্দ বললেন, বলে ফেল। আজই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। বলি, তার নামধাম তো আমাকে জানাবি, না কি?’

সুধা বললে, তুমি শুয়ে পড় বাবা। চেঁচামেচিতে হাবুলের ঘুম ভেঙে যাবে।'

 হরগোবিন্দ বললেন, ভাঙে ভাঙুক। আমি সব জানতে চাই। তুই সব আমাকে খুলে না বললে আমি কিছুতেই আজ ঘুমোতে পারব না।’

সুধা মৃদুস্বরে বললে, “তোমার সে সব কথা জেনে দরকার নেই বাবা।’ হরগোবিন্দ বললেন, ‘জেনেও দরকার নেই। আমাকে না জানিয়ে শুনিযেই বুঝি তুই বিয়ে করবি?’

সুধা বললে, না বাবা, তা কোনদিনই করব না। আমি কোনদিনই জীবনে বিয়ে করব না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার।

হরগোবিন্দ চটে উঠে বললেন, বিয়ে করবি কেন, দিনরাত সেই মাস্টারের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করবি। নিন্দেয় পাড়া ভরে গেল। কাকে পছন্দ করেছিস তাই শুনি ?

 সুধা তেমনি মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল, “তোমার শুনে লাভ নেই বাবা। তার সঙ্গে তুমি কোনদিন আমার বিয়ে দেবে না। আর তোমার অমতে আমিও তাকে বিয়ে করব না। যেমনি আছি তেমনিই থাকব।'

দাঁতে দাত ঘষলেন হরগোবিন্দ, বললেন, থাকা না-থাকা বুঝি তোমার ইচ্ছে হারামজাদী। ওই হতভাগা মাস্টার ছোকরাকে তুমি সব সমর্পণ করে বসেছ। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম।

সুধা শান্তভাবে বলল, “বুঝতে তুমি অনেক আগেই পেরেছ বাবা। রাতদুপুরে আর চেঁচামেচি করো না—বাড়িসুদ্ধ লোক সব শুনতে পাচ্ছে। তুমি যাও, শুয়ে ঘুমোও গিয়ে।'

হরগোবিন্দ বললেন, ‘হ্যা, ঘুমোব। ঘুমোবার তুমি কত ব্যবস্থা করে রেখেছ!’

সুধা কোন কথা না বলে পাশ ফিরল। যেন গভীর ঘুম পেয়েছে তার। হরগোবিন্দ ফিরে এসে নিজের বিছানায় ঢুকলেন। হাবুল ঘুমের ঘোরে পাশবালিশ ভেবে বাপকে জড়িযে ধরল। বছর চোদ্দ-পনের হ’ল বয়স। কিন্তু এই  বয়সেও ওর মুখ থেকে লালা পড়ে। সেই লালা লাগল হরগোবিন্দর গায়ে। কিন্তু তার মনে মোটেই বাৎসল্যবস উদ্রিক্ত হ’ল না। ঘৃণা বিরক্তি আর বিদ্বেষে তিনি ঠেলে দূরে সরিযে দিলেন ছেলেকে। সব শত্ৰু, সব শত্রু। অল্পবয়সে সুধাও তো এমনি করে তাকে জড়িয়ে ধরত। তার বুকের সঙ্গে মিশে না থাকলে, তার বুকের মধ্যে মুখ গুজে না থাকলে সুধার ঘুম আসত না। সুধার মা নির্মলা হাসত, কি পাজী আর হিংসুটে মেয়ে দেখেছ হরগোবিন্দের সেই বুকের সুধা আজ বিষ হয়ে গেছে।

একটা মশা কি করে যেন ঢুকেছে মশারির মধ্যে। গুণ গুণ করে অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত করছে কানের কাছে। হরগোবিন্দ সোজা হয়ে উঠে বসলেন। তারপর সেই অন্ধকারেই দু হাতের তালুতে প্রচণ্ড শব্দ করে স্তব্ধ করে দিলেন সেই গুণগুণানি। মনে মনে হাসলেন হরগোবিন্দ। তার লক্ষ্য অব্যৰ্থ।

ভোর-ভোর সময়ে ডেকে তুললেন ছেলেকে, এই ওঠ ওঠ। কত আর ঘুমাবি ?

হাবুল বললে, আর একটু পরে উঠব বাবা।
ना, ওঠ, সকালে ওঠা ভাল।
হাতমুখ ধোয়ার পর হাবুলকে বললেন, চল, বেড়িযে আসি। সকালের হাওয়া গায়ে লাগলে শরীর ভাল থাকে। - পুকুর ছাড়িয়ে ছোট্ট মাঠ। সেই মাঠে নেমে হঠাৎ ছেলের হাতখানা নিজের মুঠির মধ্যে তুলে নিলেন হরগোবিন্দ।

হাবুল ভয়ে আঁতকে উঠল, বলল, আমার কোন দোষ নেই, আমাকে মেরো না। আমি দিদিকে গোড়াতেই বারণ করেছিলাম।

হরগোবিন্দ তীক্ষ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। পরনে হাফপ্যান্ট, ছিপছিপে রোগ চেহাবা। গায়ের রঙ খুব ফরসা। মাথার চুলগুলি কাটা আর কেঁকড়ানো। ছেলেটার চোখ দুটাে ঠিক ক ওর মার মত বড় বড় হয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে স্নেহের পবিবর্তে নির্মম কৌতুক আর কৌতুহল উদগ্র হয়ে উঠল হরগোবিন্দের। মৃদু হেসে বললেন, আমি জানি, তোর কোন দোষ নেই। তুই খুবই ভাল ছেলে। আমাকে সব খুলে বল। ভয় নেই, সুধা কিছু জানতে পারবে না।’

হাবুল তবু বলতে চায় না। কেবল আমতা আমতা করে। কিন্তু ঝানু উকিলের মত জেরা করে সব বের ক’রে নিলেন হরগোবিন্দ। বই এনে দেওয়ার আর ফিরিয়ে দেওয়ার সময় কি করে টুকরো চিঠির আদান-প্রদান চলেছে দুইজনের মধ্যে, কবে সহপাঠিনী সখীর সঙ্গে দেখা করার নাম করে দেশবন্ধু পার্কে সুধা সাক্ষাৎ করেছে ইন্দু মাস্টারের সঙ্গে। কবে একদিন মাটিনি শোতে ওরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, হাবুলের যাওয়ার কথা ছিল সেই সঙ্গে, কিন্তু হঠাৎ ওরা তাকে আর এক বন্ধুর সঙ্গে চিড়িয়াখানায় নতুন বাঘ দেখতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। হাবুল কিছুই গোপন করল না, গোপন করতে পারল না।

 ফেরবার সময় মোড়ের দোকান থেকে এক ঠোঙা কচুরি, জিলিপি আর হালুয়া কিনে নিলেন হরগোবিন্দ। এসব খাবারের ওপর হাবুলের দারুণ লোভ। কিন্তু কোনদিন তিনি ছেলেমেয়েকে এগুলি খেতে দেন না। আজ দিলেন।

হাবুল কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করলে, ওসব কেন নিচ্ছ বাবা ?
হরগোবিন্দ বললেন, ‘খা একদিন। এসব তো তোরা ভালবাসিস।

হাবুলের মনে হল মুখে ও-কথা বলছেন বটে বাবা, কিন্তু চোখ দুটো সদ্য-ধরে-আনা চিডিয়াখানার সেই বাঘের মতই জুলজুল করছে। ভয়ে ভয়ে বাপের পিছনে পিছনে সে বাড়িতে ঢুকল। না জানি কি কাণ্ড ঘটে চা খাওয়ার সময়।

কিন্তু হরগোবিন্দ সুধাকে কিছু বললেন না। শুধু চা আর খাবার খেতে খেতে মেযের দিকে বার কয়েক চোখ তুলে তাকালেন। সেই চোখের দিকে চেয়ে সুধা একবার শুধু শিউরে উঠল। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর ভয় পেল না। তার দু চোখ থেকেও ঘৃণা আর বিদ্বেষ আগুনের হলকা্র মত বাপের ওপর ঝরে পড়তে লাগল। বাপ আর মেয়ের মধ্যে যেন কোনদিন কোন মধুর সম্পর্ক ছিল না, স্নেহ  শ্রদ্ধার স্বাদ যেন কেউ কোনদিন পায় নি। দুজনে যেন দুজনের শক্র হয়েই জন্মেছে।

হরগোবিন্দ মুখে কিছুই বললেন না, মেয়ের কাছে কোন কৈফিযত চাইলেন না। অন্য দিনের মতই বাজার করলেন, ফিরে এসে দাড়ি কামালেন, নাওয়া-খাওয়া শেষ করে অফিসের জন্য তৈরি হলেন। সুধা অন্য দিনের মতই ঘরের কাজকর্ম ও রান্নাবান্না সারল, ঠাই ক’রে বাপ আর ভাইকে ভাত বেড়ে দিল। তবু হাবুলের মনে হতে লাগল আজকার দিনটা আলাদা। কেমন যেন থমথমে ভয়-ভয ভাব তাকে সারাদিন আচ্ছন্ন করে রাখল। খেয়েদেয়ে স্কুলে যাওয়ার পরেও বাবার জুলন্ত চোখ আর দিদির নিরন্ত মুখের কথা হাবুলের বার বার মনে পড়তে লাগল।

হরগোবিন্দ বলে গিয়েছিলেন, অফিস থেকে তার ফিরতে অনেক রাত হবে। কিন্তু দেখা গেল অন্য দিনের চেয়ে অনেক সকাল সকাল, সন্ধ্যার বেশ একটু আগেই ফিরে এলেন তিনি। সুধা বাবাকে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে একটু বিস্মিত হ’ল। কিন্তু কোন কৌতুহল প্রকাশ করল না, কি কোন কারণ জিজ্ঞাসা করল না, নিঃশব্দে চা করল, খাবারের প্লেট হরগোবিন্দর সামনে ধরে দিল, কিন্তু অন্য দিনের মত কোন কথা বলল না। হরগোবিন্দ ভেবেছিলেন মেয়ে ক্ষমা চাইবে, ভিত্তিহীন কৈফিযং দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেসব কিছুই করল না। মৌনতার মধ্যে সুধার যে বেপরোয়া ভাব ফুটে বেরুল তাতে ভিতরে ভিতরে হরগোবিন্দ জলতে লাগলেন একসময় জিজ্ঞাসা করলেন, কই, হাবুল ফিরল না? সুধা বললে, "খেলতে গেছে, ফিরবে এখনি


খানিক বাদেই হাবুল ফিরে এল বাবাকে দেখে চমকেও গেল একটু কিন্তু হরগোবিন্দ সংক্ষেপে শাস্তভাবে বললেন, ‘পড়তে বস

আর তার একটু পরেই এল ইন্দুভূষণ হাতে এক ডজন রক্তনীগন্ধা দিনকয়েক আগে সুধার খালি ফুলদানি লক্ষ্য করে ইন্দুভূষণ বলেছিল, কি, ফুলের সখ মিটে গেল নাকি আজকাল যে আর ফুল দেখি নে!”
সুধা জবাব দিয়েছিল, সখ মিটবে কেন? কিন্তু কদিন ধরে সুখন এ পাড়ায় আসে না, ফুলও রাখতে পারি নে বোধ হয় অসুখ-বিসুখ হয়েছে ওর । ইন্দুভূষণ হেসে বলেছিল, যদি আপত্তি না থাকে সুখনের অসুখ না সারা পর্যন্ত তার কাজটা আমিও নিতে পারি
সেই ফুল আজ নিয়ে এল ইন্দুভূষণ কিন্তু ঘরের ভিতরে হরগোবিন্দকে দেখে কেমন যন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল তার আসার সময় সাধারণত তিনি থাকেন না প্রাযই ইন্দুভূষণের বেরোবার মুখে তিনি ঘরে ঢোকেন তাছাড়া সুধার মুখ আ্জ বড়ই গম্ভির,  বিষন্ন কেউ কোন কথা বলছে না দেখে ইন্দুভূষণ বললে, হাবুল, ফুলগুলি তুলে রাখ
হরগোবিন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি রাখছি বাঃ, চমৎকার মোটা-মোটা ডাটাগুলি তা! এ ফুল বোধ হয় ধারে কাছে পাওয়া যায না, কি বলেন মাস্টারমশাই!
ইন্দুভূষণ লজ্জিত হযে বললে, আজ্ঞে না কলেজ স্ট্রীট মার্কেট থেকে এনেছি
হরগোবিন্দ বললেন, ভারি চমৎকার ফুল
ইন্দুভূষণ হাবুলকে পড়াতে শুরু করল আর সেই ফঁকে হরগোবিন্দ উঠে একবার বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন অন্য ভাডাটেদের সঙ্গে ফিসফিস করে কি যেন আলাপ করলেন
ইন্দুভূষণ সুধার দিকে চেযে বলল, কি ব্যাপার আজ যে এমন………।
সুধা ভাইকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে ঠোটে আঙুল ছোয়াল তার মানে আজ হাবুলও বে-দলী হয়েছে আরও সাবধান আরও সতর্ক হবার প্রযোজন রয়েছে সুধা আর ইন্দুভূষণের
খানিকক্ষণ বাদে হরগোবিন্দ ফিরে এসে নিজের জায়গায় তেমনি স্থির হয়ে বসলেন ইন্দুভূষণ অন্য দিনের তুলনায় আজ কিছুক্ষণ বেশি সময নিয়ে বেশি যত্ন করে পড়াল ছাত্রকে তারপর পরের দিনের জন্যে অঙ্ক আর ট্রান্সলেশনের টাস্ক দিয়ে বিদায় নিয়ে বেরুতে হরগোবিন্দ এলেন পিছনে পিছনে, মাস্টার, চল, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে"
সুধা এতক্ষণ চুপ করে ছিল এবার দোরের কাছে এসে দাড়িয়ে তীক্ষ ক্কন্ঠে বললে, ওঁকে যা বলবার আমার সামনে বল বাবা ওঁকে তুমি কিছুতেই অপমান করতে পারবে না
হরগোবিন্দ বললেন, অপমান করব কেন?  শুধু দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করে নেব কি মাস্টার, তোমার কি ভয় হচ্ছে "
ইন্দুভূষণ একবার সুধার দিকে তাকল, তারপর হরগোবিন্দের দিকে চেয়ে বলল, না, ভয কিসের, চলুন"
পুকুর ছাড়িযে সেই ছোট্ট মাঠ মাঠ পেরিয়ে নির্জন সরু অন্ধকার গলি সেই গলির মুখে হরগোবিন্দ হঠাৎ থেমে দাড়ালেন তারপর ইন্দুভূষণের মুখোমুখি দাড়িয়ে বললেন, মাস্টাব, তোমার পেশাটা কি সত্যি করে বল তো? ছেলে-পড়ানো না মেয়ে-বখানো ?
ভয়ে ইন্দুভূষণের বুক কঁপিছিল, কিন্তু মুখের বড়াই অত সহজে ছাড়ল না, আপনার ও ধরনের কথার জবাব দিতে আমি প্রস্তুত নই।
আচ্ছা আমরা তোমাকে প্রস্তুত করে নিচ্চি- বলে গুটিকয়েক ছায়া মাঠের ভিতর থেকে এগিয়ে এল এদের কাউকে কাউকে চিনতে পারল ইন্দুভূষণ এরা সুধার সেই প্রতিবেশী দাদার দল একই বাড়ির ভাডাটে
ইন্দুভূষণ ভয় পেয়ে বলল, কি মতলব আপনাদের -মারবেন নাকি?

একজন বলল, না না না, আমরা শুধু জবাবটুকু বের করে নেব

আর একজন উপমা দিয়ে বুঝিয়ে বলল, টিউব টিপে শুধু পেস্টটুকু বের করে নেব দাদা হরগোবিন্দ তাদের সঙ্গে আসছিলেন একজন বলল, ‘মেসোমশাই, আপনাকে আর আসতে হবে না আমরা আপনাকে ঠিক সময়ে খবর দিয়ে আসব'

খবর পাওয়া গেল সপ্তাহখানেকবাদে। হাসপাতালে জ্বর বিকারে মৃত্যু হযেছে ইন্দুভূষণের প্রথমে দিন কয়েক মেসেই পড়ে ছিল। আহত অবস্থায় কারা যেন মেসবাড়ির দরজায় পৌছে দিয়ে গিয়েছিল তাকে। প্রথমে মেসের লোকেরা তেমন গ্রাহ্য করেনি। তারপরে অবস্থা খারাপ হওয়ায় কয়েকজনে তাকে হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে ভরতি ক’রে দিয়ে আসে।

সুধা সাত দিন ধরেই ছটফট করছিল। কিন্তু হরগোবিন্দ কড়া পাহারা বসিয়েছিলেন দোরগোড়ায়। কেউ তাকে ঘর থেকে বেরোতে দেয় নি। খবরটা সকলেই চাপতে চেষ্টা করেছিল। তবু চাপা রইল না। বাড়ির ছেলেদের ফিসফিসানির ভিতর দিয়ে সে খবর সুধার কাছে ভেসে এল।

সুধা কাদল না, চেঁচামেচি করল না, শুধু দিন দুই বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে রইল। শুকনো কালো একরাশ চুল পিঠের ওপরে ছড়ানো। তার ফাকে সুন্দর তনুদেহ থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
হরগোবিন্দ পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, সুধা!

সুধা কোন জবাব দিল না।

হরগোবিন্দ মেয়ের পিঠে আস্তে আস্তে হাতখানা রাখলেন। সুধা কোন সাড়া দিল না।
হরগোবিন্দ বললেন, সুধা, তুই আমাকে বিশ্বাস কর, এতটা যে হবে আমি ভাবতেই পারি নি। আমরা ওকে শাস্তি দিতেই চেয়েছিলাম, সরিযে দিতে চাইনি।'
সুধা কোন মন্তব্য করল না।

তৃতীয় দিনে সুধা ফের উঠে দাঁড়াল। আবার সংসারের কাজে হাত দিল, ভাইযের স্কুল আর বাপের অফিসের রান্না রাধতে বসল। ওপর থেকে সবই ঠিক আগের মতই চলতে লাগল, কিন্তু ভিতর থেকে কোন কিছুই অার আগের মত রইল না। একটি মে বাধে বাড়ে, ঘর গুছোয়, বিছানা পাতে – সবই করে। হরগোবিন্দ চেয়ে চেয়ে দেখেন। এ যেন তার চির-আদরের সুধা নয, তারই একখানা অবিকল পাথরের প্রতিমূর্তি। সেই মূর্তির চোখ আছে, তাতে পলক নেই , সে মূর্তির অপরূপ দুটি সুন্দর রক্তাভ ঠোট আছে, কিন্তু তাতে স্নেহ-মমতা-প্রীতি-শ্রদ্ধার চিহ্নমাত্র নেই।

এই পাথর আর বরফের দেশে হাবুল বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। তার যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। শুধু খাওয়া আর শোওয়ার সময় ছাড়া সারাটা দিন বাইরে বাইরে থাকে। কিন্তু হরগোবিন্দকে তার চেয়ে বেশিক্ষণ থাকতে হয়। মেয়ের ভাবভঙ্গি দেখে এখনও তার গায়ে জলা ধরে, মনে রাগ হয় ; কিন্তু রাগ প্রকাশ করতে কোথায় যেন বাধে। আস্তে আস্তে সব দাহ প্রদাহ, সব উত্তেজনা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এক সীমাহীন শীতল সমুদ্রের মধ্যে তারা দুজনে যেন জনপ্রাণীহীন তৃণশস্যহীন দুই দ্বীপ। শুধু দূর থেকে একজনকে আর একজনের চোখে পড়ে। পারাপার হবার মত মাঝখানে কোন সেতু নেই, খেয়া নেই। -

একদিন হরগোবিন্দের চোখে পডল, সুধা বেশভূষা সব ছেড়ে দিযেছে। কালো পাড়ের শাড়ি পরে। হাতে দুগাছি চুড়ি ছাড়া আর কোথাও কোন গয়না নেই সোনার গয়নাও নয়, ফুলের গযনাও নয়। আর একদিন খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলেন, সুধা শুধু ডাল-তরকারি দিয়ে খেয়ে উঠছে। মাছ-মাংস ছুঁয়েও দেখছে না। সব বাপ আর ভাইকে দিয়ে দিচ্ছে
হরগোবিন্দ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন, মাছ খেলি নে কেন সুধা?
সুধা বললে, ‘খেতে ইচ্ছে করে না
হরগোবিন্দ বললেন, কিন্তু কেন ইচ্ছে করে না শুনি ? তুই কি বিধবা ? তোদের কি বিয়ে হয়েছিল?’
সুধা বলল, মন্ত্রপড়া বিয়েটাই কি সব ?
হরগোবিন্দ বললেন, ছিছিছি বাপের সামনে এ কথা বলতে তোর লজ্জা হল না ?
সুধা নির্বিকারভাবে বলল, তুমি শুনতে চাইলে, তাই বললাম জিজ্ঞেস করতে তোমারও তো লজ্জা হয় নি বাবা!"
হরগোবিন্দ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তোর সব কথা মিথ্যে সুধা কেবল জেদ করে এসব কথা বলছিস এমনি ক’রে আমার ওপর শোধ নিতে চাচ্ছিস কিন্তু তুই আমাকে দিন রাত পুড়িয়ে মারছিস কেন ? তোর যদি সন্দেহ হয়ে থাকে, তুই এর চেয়ে থানা-পুলিশ কর, আইন-আদালত কর, সে অনেক ভাল

একটু যেন হাসি ফুটল সুধার মুখে সুধা বলল, “সে সব যারা করতে পারত তেমন আত্মীয়স্বজন তার কেউ নেই থাকার মধ্যে আছি আমি কিন্তু আমি যে তোমার মেয়ে! তুমি খুন করে এ’লে তোমার সেই হাত আমি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেব সে হাতে শিকল পরাব কেন ? আমি যে তোমার মেয়ে

হরগোবিন্দ আর্তনাদ করে উঠলেন, “তুই আমার কেউ নস, কেউ নস্ তুই আমার শত্ৰু, চিরজন্মের শত্রু

কিছুদিন চুপচাপ থাকবার পর হবগোবিন্দই ফের এগিযে আসতে চেষ্টা করেন, মৃত সম্পর্ককে আবার যেন উজ্জীবিত করে তুলতে চান নিজের থেকেই কথা আরম্ভ করেন হবগোবিন্দ রাত্রে শুয়ে শুয়ে আগের মতই পুরনো দিনের কথা তোলেন সুধার মাযের গল্প, নানাবাড়ি্র গল্প কিন্তু বাপের স্মৃতিকথায সুধার আর কোন আগ্রহ নেই হরগোবিন্দ কথা বলে যান তক্তপোশ থেকে সূধার কোন সাড়া মেলে না

হরগোবিন্দ বলেন, ও সুধা, ঘুমলি নাকি?
সুধা অতি সংক্ষেপে জবাব দেয়, হু'
মাছধরার গল্প, নৌকাডুবির গল্প, বিদেশ বিভুঁইয়ের নানা রকম দুঃসাহসিক রোমাঞ্চকর কাহিনী শুরু করেন হরগোবিন্দ যে সব কাহিনী সুধা উৎকর্ণ হয়ে রদ্ধশ্বাসে শুনত,  আর সে সব গল্পে তার কৌতুহল নেই হাসির গল্পে সুধা আর হাসে না, ভূ৩ের গল্পে ভয় পায় না, ঘর সংসারের আলোচনায় কোন উৎসাহ আগ্রহ প্রকাশ করে না কিছুতেই সেই আগের মত আলাপ জমাতে পারেন না হরগোবিন্দ

সেদিন অফিস থেকে ৩াড়াতাডি ফিরে এলেন তিনি তিনখানা সিনেমার টিকিট একেবারে কিনে নিয়ে এসেছেন

হরগোবিন্দ বললেন, চল যাই সুধা, কতদিন ছবি দেখি নে মধুমালতীর মত এমন চমৎকার বই শিগগির আর আসে নি কথায় কথায় গান তুই তো গান ভালবাসিস

ছেলেকে ইশারা করেন হরগোবিন্দ হাবুল ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, চল না দিদি

সুধা জবাব দেয়, আমাকে বিরক্ত করিস নে হাবুল তোদের ইচ্ছে হয় তোরা যা অনুবোধ উপরোধ ছেড়ে হরগোবিন্দ ফেব রাগারগি শুরু করেন, কিন্তু কোন ফল হয় না শেষ পর্যন্ত টিকিট তিনখানা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলেন তিনি

যাদুঘর, চিড়িয়াখান, লেক কি গঙ্গর ধারে বেড়াতে যাওযার পস্তাবেও আর কান দেয় না সুধা বলে, “তোমরা যাও আর একদিন ভরি তিনেক ওজনের একগাছি হার নিযে এলেন হরগোবিন্দ ধানের ছড়ার ডিজাইন নতুন উঠেছে বললেন, পরে দেখ সুধা, তোকে ভারি চমৎকার মানাবে
সুধা বাপের দিকে একটুকাল তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, কেন মিছিমিছি টাকাগুলি নষ্ট করলে বাবা! আমি তো ওসব ছেড়ে দিয়েছি” ছেড়ে দিয়েছি!"

দাঁত কিড়মিড় করতে থাকেন হরগোবিন্দ কিন্তু কোন ফল হয় না বাপের মেহের যেমন প্রত্যাশ করে না সুধা তেমনি শাসনকেও ভয় করে না আর নিষ্ফল আক্রোশে হরগোবিন্দ মাঝে মাঝে আগুনের মত জুলে ওঠেন, আবার গভীর নৈরাশ্যে বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যান

একদিন বউবাজার থেকে সুধার মাসী কমলা এল খোজ নিতে সুধাকে নিয়ে যাবার জন্যে অনেক সাধাসাধি করল কিন্তু সে কিছুতেই যাবে না বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে কমলা হরগোবিন্দকে তিরস্কার করে বলল, জামাইবাবু, আপনিই বা কি ধারার মানুষ এমন হাত-পা কোলে করে বসে আছেন কেন ? জোর করে বিয়ে দিন মেয়েটার যেমন করে হোক, যার সঙ্গে হোক, বিয়ে দিন'

হরগোবিন্দ বললেন, সেই বরানগরের মুখুয্যেরা তো পিছিয়ে গেল

কমলা বলল, যাবে না? ভাংচি দেওয়ার লোকের অভাব আছে এখানে ? ভাল চান তো এই বাড়ি ছাডুন, পাড়া ছাডুন কলকাতা শহরে কি আর জায়গা নেই?

কমলা শুধু রূপবতীই নয়, বুদ্ধিমতীও ভেবে চিন্তে তার পরামর্শ নেওয়াই ঠিক করলেন হরগোবিন্দ উত্তর ছেড়ে চলে গেলেন দক্ষিণে কালীঘাটের সদানন্দ রোডে পচাত্তর টাকা দিয়ে ফ্র্যাট ভাড়া করলেন দুখানা শোবার ঘর রান্নাঘর, বাথরুম সব আলাদা মেয়ে জামাই এসে মাঝে মাঝে যদি বাস করে, কোন অসুবিধে হবে না

বাড়ি বদলানোর ব্যাপারে সুধা কোন আপত্তি করল না, কিন্তু বিয়ের কথায় ফের বেকে বসল সুধা বলল, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিতে পার, সরিয়ে দিতে পার, কিন্তু জোর করে বিয়ে তুমি আমার কিছুতেই দিতে পারবে না তা হলে চরম কেলেঙ্কারি হবে

মেযের মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেলেন হরগোবিন্দ ওকে বিশ্বাস নেই, ও এখন সব করতে পারে

আবার কিছুদিন চুপ করে রইলেন হরগোবিন্দ চুপ করে রইল সুধা দুজনের মাঝখানে শব্দহীন দুঃসহ শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে লাগল সুধাকে এখন আর বাপ-ভাইয়ের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে হয় না সে আলাদা ঘর পেয়েছে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে মেয়ের সেই ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেন হরগোবিন্দ দেখবার মত কিছু নেই দামী কোন আসবাবপত্র সে ঘরে রাখতে দেয় নি সুধা এমন কি, একখানা তক্তপোশ পর্যন্ত না ঘরের এক কোণে দেওয়ালের ধারে বিছানা ওটানো ডান দিকে ছোট একটি বইয়ের শেলফ বইগুলি না খুলেও হরগোবিন্দ বুঝতে পা্রেন এণ্ডলি তার দেওয়া, যে শক্ৰ মরেও মরে নি তাকের ওপরে একটি শূন্য ফুলদানি সেদিন ফিরে এসে হরগোবিন্দ রক্তনীগন্ধাণ্ডলি বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলেন তারপর ফুলদানিতে আর কোন ফুল রাখে নি সুধা

আবার একদিন মেয়েকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন হরগোবিন্দ, বললেন সুধা, আমি তোর বাপ"
সুধা বলল, কি বলছ বল
হরগোবিন্দ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে কি তুই ক্ষমা করতে পারিস নে ?” সুধা মুখ নীচু করে বলল, ওসব কথা থাক বাবা
এরপর হরগোবিন্দ কি বলবেন ভেবে পেলেন না আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে সুধা এক সময় উঠে নিজের ঘরে চলে গেল
ছোট টেবিলটিতে বসে হাবুল নিজের মনে পড়ছিল আজকাল ও একা-একাই পড়ে নিজের মনেই থাকে বাড়ির এই নিঃসঙ্গ একক জীবনে হাবুলও এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বাবা আর দিদির মাঝখানে সে আর যোজক নয়, সেও যেন স্বতন্ত্র তৃতীয় একটি দ্বীপ

ছেলের দিকে হরগোবিন্দ অপলকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন আরো লম্বা হয়েছে কিন্তু রোগাটে ভাবটি যায় নি দেখলে কেমন যেন মায়া হয় হরগোবিন্দ বললেন, হাবুল, শোন

হাবুল বলল, কি বাবা? হরগোবিন্দ বললেন আয়, আমার কাছে আয়

হাবুল বিস্মিত হয়ে উঠে এল বাবা অনেক দিন হল এমন করে ডাকেন না ভয়ে ভযে কাছে এসে দাঁড়াল হরগোবিন্দ হঠাৎ তক্তপোশ ছেড়ে উঠে এসে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন- হাবুল, আমার হাবুল!

হাবুল কিছুক্ষণ আকৃষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারপর অতিকষ্টে দম ছাড়তে ছাড়তে বলল, বাবা, আমাকে ছেড়ে দাও বড্ড লাগছে ব্যথা পাচ্ছি

হরগোবিন্দ যেন চমকে উঠলেন, ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুইও ব্যথা পাচ্ছিস আচ্ছা যা"

হাবুল ফের গিয়ে পড়তে বসল হরগোবিন্দ পা টিপে টিপে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন কিন্তু জানালাটা আর খুললেন না খুললেই সুধাকে দেখা যাবে দেয়ালের কাছে এসে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলেন উৎকৰ্ণ হয়ে যেন কিছু একটা শুনতে চাইছেন তিনি কিন্তু কিছুই শোনা গেল না শুধু নিজের দীর্ঘশ্বাসের শব্দই কানে ভেসে এল

পরদিন সকাল সকাল অফিসে বেরুলেন হরগোবিন্দ একই টেবিলে বসে কাজ করেন সুরেন সমান্দারহরগোবিন্দর সহকর্মী। সমবয়সী, খুব সামাজিক আর সদালাপী মানুষ চারদিকের খোঁজখবর রাখেন সাধ্যমত উপকার করেন সহকর্মীদের অবিবাহিত ছেলের বিয়ের খবর আনেন, কর্মপ্রার্থী বেয়ারাদের মনিব জুটিয়ে দেন এতদিন তার কাছে মুখ খোলেন নি হরগোবিন্দ, আজ মন খুললেন

ফাইল-পত্ৰ ভাগ করে নিতে নিতে বললেন, ভাই সুরেন,আমার একটা কাজ করে দেবে?
সুরেনবাবু বললেন, কি কাজ ? '
একটি ছেলে দেখে দেবে আমাকে?
কি রকম ছেলে ?’
বামুনের ছেলে হলেই ভাল হয় অন্য জাত হ’লেও—
অন্য জাত হবে কেন ? তুমি বামুন, তোমাকে বামুনের ছেলেই দেব বামুনের অভাব আছে নাকি? তারপর ? "
ছেলেটি এম. এ পাস হলেই ভাল হয়, বি. এ. পাস হলেও ক্ষতি নেই
সুরেনবাবু বললেন, ‘কেন, এম.এ পাস ছেলের অভাব আছে নাকি? তারপর?
হরগোবিন্দ বললেন, কাজ-কর্ম যা করে করুক খেয়ে দেয়ে থাকতে পারলেই হল
সুরেনবাবু হেসে বললেন, বিলক্ষণ! তারপর? কার জন্যে হে? নিজের মেয়ের জন্যে নাকি? আরে ভাই, খুলেই বল না জামাই চাই একটি আছে আমার হাতে জামাই করতে চাও তো বল

হবগোবিন্দ বললেন, না ভাই, জামাই নয়, জামাই নয়
সুরেনবাবু বললেন, তবে ?
হরগোবিন্দ বন্ধুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘একজন প্রাইভেট টিউটর— ছেলের জন্যে একজন প্রাইভেট টিউটর '

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ একটি লেখা। আমি তার প্রায় ষাটটি গল্প পড়েছি, এটি আমার সেরা পাঁচে থাকবে হয়ত।

    উত্তরমুছুন