মোহাম্মদ নূরুল হক
শিল্পে-সাহিত্যে স্বপ্ন ও বাস্তবতা কখনো-কখনো হাত ধরাধরি করেও চলে। এর কারণ হয়তো এই—শিল্পী-সাহিত্যিক চান, সমাজ যেন তাদের দেখা স্বপ্নের মতোই গড়ে ওঠে। অথবা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হোক তাদের ইচ্ছামতো। এ কারণে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা সমাজের যে চিত্র আঁকেন, তাতে হুবহু সমাজকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। আংশিক চেনা সমাজকে রসগ্রাহীরা দেখেন, বাকিটা চেনা জগতের সঙ্গে প্রায়-ই মেলে না।
এর সঙ্গত কারণ ওই একটা-ই। শিল্পী-সাহিত্যিকেরা সমাজকে নিজেদের মতো করে বদলাতে চান। তাই কিছুটা বাস্তব আর কিছুটা স্বপ্নের ছবি-ই আঁকেন তারা। এ ক্ষেত্রে পাঠক বা শিল্পরস পিপাসুদের দুই ধরনের দ্বন্দ্বে পড়তে দেখা যায়। প্রথমত, যারা কট্টর বাস্তববাদী, তাদের কাছে কল্পনার রঙটুকু বাহুল্য প্রায় ঠেকে, দ্বিতীয়ত যারা খুব স্বপ্নচারী, তাদের কাছে রূঢ়বাস্তবতাটুকু প্রায় অসহনীয় মনে হয়। শিল্পী-সাহিত্যিককে এই দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে হয়। অন্তত সামঞ্জস্যসৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কথাগুলো মনে হলো—জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের গল্পপাঠ শেষে।
ইমদাদুল হক মিলন যতটা জনপ্রিয়, ততটা সিরিয়াস ধারার লেখক নন—এই অভিযোগ সমালোচকদের পুরনো। তবে ওই অভিযোগ তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি যখন ছোটগল্প লিখেছেন, লিখতে চেয়েছেন, তখন স্বপ্ন, বাস্তবতা, শিল্পরস—এই তিনের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। সঙ্গত কারণে তাঁর জনপ্রিয়তার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, তাঁর গল্পসাহিত্যকে গুরুত্বহীন করে দেখা সমীচীন হবে না।
ইমদাদুল হক মিলনের গল্পকে মোটাদাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়।
১। সামাজিক পটভূমিতে রচিত গল্প
২। প্রেম-ভালোবাসা আশ্রিত গল্প
৩। রাজনৈতিক ধারার গল্প
৪। মনস্তাত্ত্বিক গল্প
তাঁর গল্পে সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ-তরুণীর প্রেম-ভালোবাসার বিষয় সর্বাধিক বিস্তৃত। একইঙ্গে মুক্তযুদ্ধ, দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গও তাঁর গল্পের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে। তবে সংখ্যায় অল্প হলেও মনস্তাত্ত্বিক গল্পও রয়েছে তাঁর। আর এই মনস্তাত্ত্বিক ধারা গল্পগুলো কিছুটা খেয়ালিপনা ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যও বটে।
সামাজিক পটভূমিতে রচিত গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ‘মেয়েটি কোনো অপরাধ ছিল না’, ‘গাহে অচিন পাখি’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘মানুষ কাঁদছে’, ‘খেলোয়াড়’ প্রভৃতি। এরমধ্যে ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’ গ্রামীণ পটভূমির গল্প। গল্পে প্রধান দুই চরিত্র কুসুম ও পবন। পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু তারা দুজন দুই ধর্মের। ধর্মের বাধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক বাধা। একদিকে স্থানীয় মসজিদের ইমামের রোষানলে পড়ে কুসুম, অন্যদিকে বাড়ির মানুষেরাই তাকে দেখে সন্দেহের চোখে, দেয় অপবাদ। করে বিচারের মুখোমুখি। প্রহসনের রায়ে শাস্তি হয় কুসুমের। তার পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বলে না, এমনকি মেয়েটির বাবাও না। অথচ অপরাধ কী? পবনকে ভালোবাসা? পবনের সঙ্গে একান্তে দেখা করা? যদিও ভালোবাসা কিংবা একান্তে দেখা করা কোনো বিবেচনায়-ই অপরাধের মধ্যে গণ্য হয় না, তবু প্রতিহিংসাপরায়ণ বাড়ির লোক আর প্রতিপত্তিলোভী মোল্লার রোষানলে পড়ে কুসুমকে প্রকাশ্য প্রহসনে শাস্তি পেতে হয়। বিপরীতে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও পবনের কোনো শাস্তি হয় না। শাস্তি হয় না, কারণ, সে অবস্থাসম্পন্ন বাড়ির সন্তান। তার অভিভাবক তার অপরাধের জন্য আর্থিক দণ্ড দেয়, কিন্তু কুসুমের অপরাধের জন্য তার পক্ষ থেকে তার বাপও ক্ষমা চায় না, নিজের মেয়ের পক্ষ হয়ে কোনো যুক্তিও তুলে ধরে না। পরন্তু খালেক মিস্ত্রি স্পষ্ট ঘোষণা দেন, ‘টেকা দিতে রাজি না আমি। আমার কাছে টেকা নাই। থাকলেও টেকা আমি দিতাম না। এমুন মাইয়া থাকন না থাকন এককথা। একশটা না এক হাজারটা ঝাড়–র বাড়ি মারেন ওরে।’ এরপরই কুসুমকে একশ ঝাড়ুর আঘাত, শাস্তি কার্যকর করেন ইমাম। এরপরের কাহিনী সহজে বোধগম্য। অপমান, অবহেলা, জন্মদাতার উপেক্ষার যন্ত্রণা সইতে না পেরে অভিমানে আত্মহত্যা করে মেয়েটি। এই চিত্র, আবহমান বাংলার চিরায়ত। দুর্বল, ক্ষীণচিত্তের বাবারা কখনো নিজের সন্তানের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তারা সমাজের আক্রোশের ভয়ে, আশ্রয় হারানোর শঙ্কায় সমাজের সমস্ত অবিচার মাথা পেতে মেনে নেন। তাই কোনো অপরাধ না করেও এভাবে কুসুমদের প্রহসনের বিচারে শাস্তি পেতে হয়, মেনে নিতে হয় নীরব মৃত্যুর স্বাদ।
সামাজিক বাস্তবতার আরেকটি ভয়াবহ গল্প ‘নিরন্নের কাল’। এই গল্পে দুর্ভিক্ষ পীড়িত গ্রাম্য দুই বালকবালিকার জীবন সংগ্রামের কথা বর্ণিত হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ সর্বস্বও হারানোর জন্য প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় ইচ্ছায়, অনেক সময় বাধ্য হয়ে। আবার কখনো-কখনো না বুঝেও। ‘নিরন্নের কাল’ ইমদাদুল হক মিলনের শ্রেষ্ঠদুটি গল্পের একটি। অন্যটি ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’। এ গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি। দুই ভাইবোন। কিশোর-কিশোরী দীনু-বুলবুলি। পড়ার শুরুতে পরিবেশ বর্ণনা নয়, দুই ভাইবোনের গল্পে মজে থাকার দৃশ্যে চকিতে বিভূতি ভূষণের ‘পথের পাঁচালি’র দুর্গা-অপুর কথা মনে পড়ে যেতে পারে। কারণ, দুর্গা-অপু দারিদ্রপীড়িত পরিবারের সন্তান, মিলনের বুলবুলি-দীনুও তাই। এটা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া, সামঞ্জস্যের কথা বললাম মাত্র। বাকি ঘটনাবলিতে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। দুর্গা-অপুর জীবনে বিস্ময়ের পর বিস্ময়, শেষপর্যন্ত দুর্গার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অপুকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়া হয়। কিন্তু মিলনের গল্পে দীন নিঃসঙ্গ হয় না বটে, বুলবুলি তার সবচেয়ে বড় সম্পদ হারায়। কেবল পেটের দায়ে এক কামলিপ্সুর হাতে নিজেকে সপে দেয়। সংসারে দুমুঠো অন্ন জোগানের জন্য তার এই আত্মত্যাগের কথা ছোটভাই দীনু বুঝতে পারে না। সে কেবল জানতে চাই বুলবুলি রক্তাক্ত হলো কেমন করে। বুলবুলি ভাইকে অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষের মতো বোঝায়, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয। পেটপুরে খেতে চাইলে রক্ত ঝরাতে হয়। সমাজে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের শেষসম্বল তার দেহ, তাও অর্থশালীদের ভোগের জন্য উৎসর্গ করে দিতে হয়। নাহলে দরিদ্রমানুষগুলো বেঁচে থাকার অবলম্বনও অনেক সময় হারায়। সমাজের শ্রেণীবৈষম্য প্রকট হয়ে উঠলে বেশির ভাগ মানুষকেই মানবেতর জীবন বেছে নিতে হয়। তাদের আত্মমর্যাদা-সম্ভ্রম সবই ধূলায় মিশিয়ে দিতে হয়। এ গল্পের ভেতর দিয়ে মিলন সমাজের এসব অবিচার-অনাচারকে ব্যঙ্গবিদ্রূপে চিত্রিত করেছেন। গল্পের পাঠের পর পাঠকের মনে বিত্তশালীদের প্রতি যেমন ক্ষোভ জন্মায়, তেমনি দারিদ্র্যপীড়িত পতিত শ্রেণীর জন্য কান্না উপচে ওঠে।
ইমদাদুল হক মিলনের গল্পে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বদেশ ও স্বদেশের সাধারণ মানুষ অনেক সময় প্রায় অভিন্ন হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায় তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার বর্ণনা করেন, তখন সেখানে বঙ্গবন্ধু যেমন বড় হয়ে ওঠেন, তেমনি সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগও বড় হয়ে ওঠে। এ ধরনের গল্পে মধ্যে ‘রাজার চিঠি’, ‘মানুষ কাঁদছে’ ও ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। এরমধ্যে ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পটির কাহিনির শুরু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের দিন বিকালের ঘটনা দিয়ে। শুরু ভাগচাষি রতনের রাজধানী আগমণ নিয়ে। ভাগচাষি রতন গ্রাম থেকে নগরে আসে। সে এসেছে নেতাকে দেখার জন্য। কিন্তু নেতার সঙ্গে দেখা করতে হলে বাসায় যেতে হবে, বিষয়টা সে ভাবতে পারে না। সাহস পায় না মনে। তাই সে নেতার বাসভবনের আশেপাশে ঘুর-ঘুর করে। তার গতিবিধি পুলিশের চোখে সন্দেহের ঠেকে, তাই তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের কর্মকর্তা ও দুই কনস্টবল তার সঙ্গে নানা কথাবার্তা বলে। রতনকে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটক করলেও ভোরবেলা তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। শুধু ছেড়েই দেয় না, তার কাছে ক্ষমাও চায় তারা। সঙ্গে পুলিশ অফিসারটি এ খবরও তাকে দেয়—‘আমরা খবর পেয়েছি তাঁর খুব ঘনিষ্ট লোকজন, নেতার আদর্শে বিশ্বাসী, একই রাজনীতি দীর্ঘদিন করেছে, তারা ষড়যন্ত্র করে নেতাকে হত্যা করেছে। তোমার ওপর আমি অবিচার করেছি। যাও বাড়ি যাও তুমি।’ নিজের এই মুক্তির খবরে খুশি হয় না রতন। উল্টো ফুঁসে ওঠে। বলে—‘আমাকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না সাহেব। আমাকে হাজতেই রাখুন। ছেড়ে দিলে নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেব আমি।’ রতনের এই উক্তির ভেতর দিয়ে লেখক অগণিত মুজিবভক্তের ক্ষোভ-প্রতিশোধ স্পৃহাকে প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখেছেন, জনকহত্যার প্রতিশোধে সমগ্র জাতিই যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আর ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। গল্পটির শুরু, সামান্য ভবঘুরেকে আটকের ভেতর দিয়ে। শেষ একটি করুণ, হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনায়। এ গল্পে লেখক, বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষে অসীম মমত্ব ও ভালোবাসার রূপ চিত্রিত করেছেন। যা কাহিনি বর্ণনা ও সংলাপের ভেতর দিয়েই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
‘রাজার চিঠি’ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। তবে রূপকথার আদলে। এই গল্পে ছদ্মবেশী রাজা তাঁর মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা চিত্র সচক্ষে দেখেন। এ সময় তাঁকে চোখে ধরা পড়ে আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র। তিনি কেবল আমলাতন্ত্রের অনিয়মের চিত্র দেখেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ত মন্ত্রিপরিষদের মুখোশ পড়তে পারেন না। তাই বুঝতে পারেন না, রাজ্যব্যাপী এই যে, অবিচার, এই নাশকতা এসবের মূলে কেবল আমলারা-রাজকর্মচারীরা জড়িত নয়। এর সঙ্গে জড়িত তাঁর চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা, তাঁরই আস্থাভাজন মন্ত্রিপরিষদ। যাদের চাটুকারিতার কারণে দেশব্যাপী জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটনের খবর তাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছত না। রাজা দেশপরিদর্শন শেষে জনগণকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে প্রাসাদে ফেরেন। কিন্তু তিনি আর সাহায্য করতে পারেন না জনতাকে। তার আগেই ‘রাত্রির মধ্যযামে’ তাঁকে হত্যা করে মন্ত্রিপরিষদ। রাজা চেয়েছিলেন, ‘তাঁর রাজ্যে কোনো দুঃখী প্রজা থাকবে না, অনাহারী থাকবে না।’ কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ চেয়েছিল, রাজ্য ভরে থাকতে অনাহারে, দুঃখপীড়িত জনতায়। আর তারা ভোগ বিলাসে মত্ত থাকবে। ঘিরে থাকবে রাজার চারপাশ। রাজা যেন, তাদের বেষ্টনী ভেদ করে দেশের প্রকৃত চিত্র দেখতে না পান। আর যেদিনই রাজা দেশের প্রকৃত চিত্র দেখে এলেন, সেদিনই রাজাকে প্রাণ হারাতে হলো। এ গল্পে মিলন দেখিয়েছেন মানুষ যখন ক্ষমতার শিখরে আরোহণ করে, তখন তার চারপাশ যদি চাটুকারে বেষ্টিত থাকে, তাহলে ওই মানুষ দেশের প্রকৃত চিত্র কোনোদিনই দেখতে পান না। তিনি কেবল সেই চিত্রটুকুই দেখেন, সেই খবরটুকুই জানেন, যা তার চাটুকাররা তাকে দেখায়, বা শোনায়। এই ধরনের ক্ষমতাবানদের জীবন সবসময় ঝুঁকির ভেতর থাকে। তাঁরা আর সত্যের সন্ধান পান না। যখনই তাঁরা সত্যের সন্ধানে বের হতে চান, তখনই তাঁদের সামনে ঘাতকের খড়গকৃপাণ ঝুলতে থাকে। কারণ, তাঁরা যদি সত্যের সন্ধান জেনে যান, তাহলে ঘাতক-চাটুকারদের মুখোশ খুলে পড়বে। তাঁরা দেশব্যাপী লুটতরাজ, দুর্নীতি করে বেড়াতে পারবে না। চাটুকারবেষ্টিত ক্ষমতাবানরা সারাজীবন চাটুকারবেষ্টিত থাকতে হবে, না হয় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে।
‘মানুষ কাঁদছে’ গল্পের সূচনা রহিম ও কালুর তাস খেলার বর্ণনা দিয়ে। এ গল্পে ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়েছে। একইসঙ্গে সামাজিক বাস্তবতাও। এ গল্পের আরেকটি বিশেষ দিক হলো—গল্পটি শুরু হয় তৃতীয় পুরুষে, কিন্তু হঠাৎ করে উত্তমপুরুষ এসে হাজির হয়। কিছুটা যাওয়ার পর আবারও সেই তৃতীয় পুরুষ। অর্থাৎ গল্পের ভেতর কথকও একবার ঢুকে পড়েন। গল্পের ভেতর কথক ঢুকে পড়েন ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর জন্য। এগল্পের চরিত্রগুলো নিতান্ত দরিদ্র। কারও সামান্য লেখাপড়া আছে, কারও বা তাও নেই। তবে চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলেও অন্যকে ফাঁকি দিয়ে সামান্য পরিমাণে হলেও ফায়দা লোটার বাসনা আছে। তাই সামান্য কয়টা টাকার লোকে উদ্ভ্রান্তের মতো সাইকেল চালিয়ে যায় রহিম। ঘটনাচক্রে দুর্ঘটনা। এবং মৃত্যু।
রহিমের এক্সিডেন্টের কথা শুনেও আশরাফ দাঁড়ায় না। পরন্তু সে ভয় পায়। সে ভাবে যদি পুলিশ তাকে ধরে, যদি জেনে যায় সে-ই রহিমকে সাইকেল নিয়ে পাঠিয়েছিল। তাই সে পালায়। এদিকে একে একে রহিম-আশরাফ দুজনেই ফিরে না আসায় ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে ওঠে আরিফ। সে জানতে পারে না রহিমের কী হয়েছে, আশরাফই বা কোথায় চলে গেল। হাতে যা কিছু ছিল, সব কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলে। উড়িয়ে দেয় বাতাসে। আর ওই কুচিকুটি কাগজের টুকরোগুলোর ওপর লুটিয়ে পড়ে গুমরে গুমরে কাঁদে।
ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন গল্প। কিন্তু সমাজকে দেখেছেন অনেকটা দার্শনিক ও কবির চোখে। ফলে কথাশিল্পীর যে দৃষ্টি রূঢ়বাস্তবতাকে খুটিয়ে খুটিয়ে চিত্রিত করে নির্মোহতার প্রমাণ দেয়, মিলনের গল্পের সে চিত্র কম। বরং দার্শনিক ও কবির স্বপ্ন চিত্রায়িত হয়েছে বেশি। ‘পাগল সাহেব’ কিংবা ‘গোপন দুয়ার’-এর মতো গল্প কেবল সামাজিক বাস্তবতার চেতনা দিয়ে লেখা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হয় কবির স্বপ্ন, দার্শনিকের প্রত্যয়। তবেই একইরুচির দুজন মানুষের দেখা মেলা সম্ভব। তবেই সমাজের দুই শ্রেণীর মানুষের ভেদাভেদ ভুলে পাগল সাহেব নিজেই রিকশা চালাতে পারেন রাতের বেলা, আর রিকশাঅলাকে বসিয়ে দিতে পারেন, যাত্রীর আসনে। এমন অমিতসম্ভাব্য স্বপ্ন দেখা সম্ভব হলেই দুই তৃষ্ণার্ত-ভাগ্যবিড়ম্বিত নরনারী প্রথম সাক্ষাতে নিজেদের গোপন দুয়ার খুলে বসতে পারেন। আর দিতে পারেন জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত নিষ্ঠুর ঘটনার বর্ণনা। আশ্চর্য রকমভাবে দুজনের জীবনের সমস্ত ঘটনা-ই একই বিন্দুতে এসে মিলিত হতে পারে।
ইমদাদুল হক মিলন গল্প লিখতে গিয়ে কোনো তত্ত্ব বা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচার করেননি। কিন্তু সমাজ-রাজনীতির নোংরা-নিষ্ঠুর দিকগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্লট বর্ণনার সঙ্গে সংলাপ, পরিবেশের সঙ্গে চরিত্রের সামঞ্জস্য পাঠকের আশ্বস্ত করে। মনে হয় না, বানিয়ে বানিয়ে কোনো ঘটনা বর্ণনা করছেন লেখক। বরং কখনো কখনো মনে হয়, একেবারে সাক্ষাৎ চিত্র তুলে এনেছেন। এছাড়া গল্পের ভাষা নিয়ে তেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তিনি তেমন করেন না। যখন যেমন ভাষার প্রয়োজন, চরিত্রগুলোর মুখে সে ভাষা-ই তিনি দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি গল্পকে শেষপর্যন্তই একরৈখিক রাখেন। কখনো নিরীক্ষার দোহায় দিয়ে গল্পকে বহুরৈখিক করে তোলার নামে, বর্ণনাসর্বস্ব করে তোলেন না। একজন শক্তিমান কথাকারের সার্থকতা এখানেই। মিলনের গল্পে স্বপ্ন ও যাপিত জীবন অনেক সময়-ই হাত ধরাধরি করে চলে না। কিন্তু যাপিত জীবনে পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখানোও অনেক বড় কাজ। যা একজন কথাশিল্পীর কলমকে রূপকথার ‘সোনার কাঠি, রূপার কাঠির’ মতোই বিস্ময়কর করে তোলে। ইমদাদুল হক মিলনের ছোটগল্পে কলমকে সেই রূপকথার ‘সোনার কাঠি, রূপার কাঠি’ বললে অত্যুক্তি হয় না।
শিল্পে-সাহিত্যে স্বপ্ন ও বাস্তবতা কখনো-কখনো হাত ধরাধরি করেও চলে। এর কারণ হয়তো এই—শিল্পী-সাহিত্যিক চান, সমাজ যেন তাদের দেখা স্বপ্নের মতোই গড়ে ওঠে। অথবা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হোক তাদের ইচ্ছামতো। এ কারণে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা সমাজের যে চিত্র আঁকেন, তাতে হুবহু সমাজকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। আংশিক চেনা সমাজকে রসগ্রাহীরা দেখেন, বাকিটা চেনা জগতের সঙ্গে প্রায়-ই মেলে না।
এর সঙ্গত কারণ ওই একটা-ই। শিল্পী-সাহিত্যিকেরা সমাজকে নিজেদের মতো করে বদলাতে চান। তাই কিছুটা বাস্তব আর কিছুটা স্বপ্নের ছবি-ই আঁকেন তারা। এ ক্ষেত্রে পাঠক বা শিল্পরস পিপাসুদের দুই ধরনের দ্বন্দ্বে পড়তে দেখা যায়। প্রথমত, যারা কট্টর বাস্তববাদী, তাদের কাছে কল্পনার রঙটুকু বাহুল্য প্রায় ঠেকে, দ্বিতীয়ত যারা খুব স্বপ্নচারী, তাদের কাছে রূঢ়বাস্তবতাটুকু প্রায় অসহনীয় মনে হয়। শিল্পী-সাহিত্যিককে এই দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে হয়। অন্তত সামঞ্জস্যসৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কথাগুলো মনে হলো—জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের গল্পপাঠ শেষে।
ইমদাদুল হক মিলন যতটা জনপ্রিয়, ততটা সিরিয়াস ধারার লেখক নন—এই অভিযোগ সমালোচকদের পুরনো। তবে ওই অভিযোগ তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি যখন ছোটগল্প লিখেছেন, লিখতে চেয়েছেন, তখন স্বপ্ন, বাস্তবতা, শিল্পরস—এই তিনের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। সঙ্গত কারণে তাঁর জনপ্রিয়তার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, তাঁর গল্পসাহিত্যকে গুরুত্বহীন করে দেখা সমীচীন হবে না।
ইমদাদুল হক মিলনের গল্পকে মোটাদাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়।
১। সামাজিক পটভূমিতে রচিত গল্প
২। প্রেম-ভালোবাসা আশ্রিত গল্প
৩। রাজনৈতিক ধারার গল্প
৪। মনস্তাত্ত্বিক গল্প
তাঁর গল্পে সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ-তরুণীর প্রেম-ভালোবাসার বিষয় সর্বাধিক বিস্তৃত। একইঙ্গে মুক্তযুদ্ধ, দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গও তাঁর গল্পের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে। তবে সংখ্যায় অল্প হলেও মনস্তাত্ত্বিক গল্পও রয়েছে তাঁর। আর এই মনস্তাত্ত্বিক ধারা গল্পগুলো কিছুটা খেয়ালিপনা ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যও বটে।
সামাজিক পটভূমিতে রচিত গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ‘মেয়েটি কোনো অপরাধ ছিল না’, ‘গাহে অচিন পাখি’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘মানুষ কাঁদছে’, ‘খেলোয়াড়’ প্রভৃতি। এরমধ্যে ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’ গ্রামীণ পটভূমির গল্প। গল্পে প্রধান দুই চরিত্র কুসুম ও পবন। পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু তারা দুজন দুই ধর্মের। ধর্মের বাধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক বাধা। একদিকে স্থানীয় মসজিদের ইমামের রোষানলে পড়ে কুসুম, অন্যদিকে বাড়ির মানুষেরাই তাকে দেখে সন্দেহের চোখে, দেয় অপবাদ। করে বিচারের মুখোমুখি। প্রহসনের রায়ে শাস্তি হয় কুসুমের। তার পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বলে না, এমনকি মেয়েটির বাবাও না। অথচ অপরাধ কী? পবনকে ভালোবাসা? পবনের সঙ্গে একান্তে দেখা করা? যদিও ভালোবাসা কিংবা একান্তে দেখা করা কোনো বিবেচনায়-ই অপরাধের মধ্যে গণ্য হয় না, তবু প্রতিহিংসাপরায়ণ বাড়ির লোক আর প্রতিপত্তিলোভী মোল্লার রোষানলে পড়ে কুসুমকে প্রকাশ্য প্রহসনে শাস্তি পেতে হয়। বিপরীতে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও পবনের কোনো শাস্তি হয় না। শাস্তি হয় না, কারণ, সে অবস্থাসম্পন্ন বাড়ির সন্তান। তার অভিভাবক তার অপরাধের জন্য আর্থিক দণ্ড দেয়, কিন্তু কুসুমের অপরাধের জন্য তার পক্ষ থেকে তার বাপও ক্ষমা চায় না, নিজের মেয়ের পক্ষ হয়ে কোনো যুক্তিও তুলে ধরে না। পরন্তু খালেক মিস্ত্রি স্পষ্ট ঘোষণা দেন, ‘টেকা দিতে রাজি না আমি। আমার কাছে টেকা নাই। থাকলেও টেকা আমি দিতাম না। এমুন মাইয়া থাকন না থাকন এককথা। একশটা না এক হাজারটা ঝাড়–র বাড়ি মারেন ওরে।’ এরপরই কুসুমকে একশ ঝাড়ুর আঘাত, শাস্তি কার্যকর করেন ইমাম। এরপরের কাহিনী সহজে বোধগম্য। অপমান, অবহেলা, জন্মদাতার উপেক্ষার যন্ত্রণা সইতে না পেরে অভিমানে আত্মহত্যা করে মেয়েটি। এই চিত্র, আবহমান বাংলার চিরায়ত। দুর্বল, ক্ষীণচিত্তের বাবারা কখনো নিজের সন্তানের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তারা সমাজের আক্রোশের ভয়ে, আশ্রয় হারানোর শঙ্কায় সমাজের সমস্ত অবিচার মাথা পেতে মেনে নেন। তাই কোনো অপরাধ না করেও এভাবে কুসুমদের প্রহসনের বিচারে শাস্তি পেতে হয়, মেনে নিতে হয় নীরব মৃত্যুর স্বাদ।
সামাজিক বাস্তবতার আরেকটি ভয়াবহ গল্প ‘নিরন্নের কাল’। এই গল্পে দুর্ভিক্ষ পীড়িত গ্রাম্য দুই বালকবালিকার জীবন সংগ্রামের কথা বর্ণিত হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ সর্বস্বও হারানোর জন্য প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় ইচ্ছায়, অনেক সময় বাধ্য হয়ে। আবার কখনো-কখনো না বুঝেও। ‘নিরন্নের কাল’ ইমদাদুল হক মিলনের শ্রেষ্ঠদুটি গল্পের একটি। অন্যটি ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’। এ গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি। দুই ভাইবোন। কিশোর-কিশোরী দীনু-বুলবুলি। পড়ার শুরুতে পরিবেশ বর্ণনা নয়, দুই ভাইবোনের গল্পে মজে থাকার দৃশ্যে চকিতে বিভূতি ভূষণের ‘পথের পাঁচালি’র দুর্গা-অপুর কথা মনে পড়ে যেতে পারে। কারণ, দুর্গা-অপু দারিদ্রপীড়িত পরিবারের সন্তান, মিলনের বুলবুলি-দীনুও তাই। এটা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া, সামঞ্জস্যের কথা বললাম মাত্র। বাকি ঘটনাবলিতে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। দুর্গা-অপুর জীবনে বিস্ময়ের পর বিস্ময়, শেষপর্যন্ত দুর্গার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অপুকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়া হয়। কিন্তু মিলনের গল্পে দীন নিঃসঙ্গ হয় না বটে, বুলবুলি তার সবচেয়ে বড় সম্পদ হারায়। কেবল পেটের দায়ে এক কামলিপ্সুর হাতে নিজেকে সপে দেয়। সংসারে দুমুঠো অন্ন জোগানের জন্য তার এই আত্মত্যাগের কথা ছোটভাই দীনু বুঝতে পারে না। সে কেবল জানতে চাই বুলবুলি রক্তাক্ত হলো কেমন করে। বুলবুলি ভাইকে অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষের মতো বোঝায়, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয। পেটপুরে খেতে চাইলে রক্ত ঝরাতে হয়। সমাজে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের শেষসম্বল তার দেহ, তাও অর্থশালীদের ভোগের জন্য উৎসর্গ করে দিতে হয়। নাহলে দরিদ্রমানুষগুলো বেঁচে থাকার অবলম্বনও অনেক সময় হারায়। সমাজের শ্রেণীবৈষম্য প্রকট হয়ে উঠলে বেশির ভাগ মানুষকেই মানবেতর জীবন বেছে নিতে হয়। তাদের আত্মমর্যাদা-সম্ভ্রম সবই ধূলায় মিশিয়ে দিতে হয়। এ গল্পের ভেতর দিয়ে মিলন সমাজের এসব অবিচার-অনাচারকে ব্যঙ্গবিদ্রূপে চিত্রিত করেছেন। গল্পের পাঠের পর পাঠকের মনে বিত্তশালীদের প্রতি যেমন ক্ষোভ জন্মায়, তেমনি দারিদ্র্যপীড়িত পতিত শ্রেণীর জন্য কান্না উপচে ওঠে।
ইমদাদুল হক মিলনের গল্পে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বদেশ ও স্বদেশের সাধারণ মানুষ অনেক সময় প্রায় অভিন্ন হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায় তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার বর্ণনা করেন, তখন সেখানে বঙ্গবন্ধু যেমন বড় হয়ে ওঠেন, তেমনি সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগও বড় হয়ে ওঠে। এ ধরনের গল্পে মধ্যে ‘রাজার চিঠি’, ‘মানুষ কাঁদছে’ ও ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। এরমধ্যে ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পটির কাহিনির শুরু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের দিন বিকালের ঘটনা দিয়ে। শুরু ভাগচাষি রতনের রাজধানী আগমণ নিয়ে। ভাগচাষি রতন গ্রাম থেকে নগরে আসে। সে এসেছে নেতাকে দেখার জন্য। কিন্তু নেতার সঙ্গে দেখা করতে হলে বাসায় যেতে হবে, বিষয়টা সে ভাবতে পারে না। সাহস পায় না মনে। তাই সে নেতার বাসভবনের আশেপাশে ঘুর-ঘুর করে। তার গতিবিধি পুলিশের চোখে সন্দেহের ঠেকে, তাই তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের কর্মকর্তা ও দুই কনস্টবল তার সঙ্গে নানা কথাবার্তা বলে। রতনকে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটক করলেও ভোরবেলা তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। শুধু ছেড়েই দেয় না, তার কাছে ক্ষমাও চায় তারা। সঙ্গে পুলিশ অফিসারটি এ খবরও তাকে দেয়—‘আমরা খবর পেয়েছি তাঁর খুব ঘনিষ্ট লোকজন, নেতার আদর্শে বিশ্বাসী, একই রাজনীতি দীর্ঘদিন করেছে, তারা ষড়যন্ত্র করে নেতাকে হত্যা করেছে। তোমার ওপর আমি অবিচার করেছি। যাও বাড়ি যাও তুমি।’ নিজের এই মুক্তির খবরে খুশি হয় না রতন। উল্টো ফুঁসে ওঠে। বলে—‘আমাকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না সাহেব। আমাকে হাজতেই রাখুন। ছেড়ে দিলে নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেব আমি।’ রতনের এই উক্তির ভেতর দিয়ে লেখক অগণিত মুজিবভক্তের ক্ষোভ-প্রতিশোধ স্পৃহাকে প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখেছেন, জনকহত্যার প্রতিশোধে সমগ্র জাতিই যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আর ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। গল্পটির শুরু, সামান্য ভবঘুরেকে আটকের ভেতর দিয়ে। শেষ একটি করুণ, হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনায়। এ গল্পে লেখক, বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষে অসীম মমত্ব ও ভালোবাসার রূপ চিত্রিত করেছেন। যা কাহিনি বর্ণনা ও সংলাপের ভেতর দিয়েই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
‘রাজার চিঠি’ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। তবে রূপকথার আদলে। এই গল্পে ছদ্মবেশী রাজা তাঁর মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা চিত্র সচক্ষে দেখেন। এ সময় তাঁকে চোখে ধরা পড়ে আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র। তিনি কেবল আমলাতন্ত্রের অনিয়মের চিত্র দেখেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ত মন্ত্রিপরিষদের মুখোশ পড়তে পারেন না। তাই বুঝতে পারেন না, রাজ্যব্যাপী এই যে, অবিচার, এই নাশকতা এসবের মূলে কেবল আমলারা-রাজকর্মচারীরা জড়িত নয়। এর সঙ্গে জড়িত তাঁর চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা, তাঁরই আস্থাভাজন মন্ত্রিপরিষদ। যাদের চাটুকারিতার কারণে দেশব্যাপী জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটনের খবর তাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছত না। রাজা দেশপরিদর্শন শেষে জনগণকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে প্রাসাদে ফেরেন। কিন্তু তিনি আর সাহায্য করতে পারেন না জনতাকে। তার আগেই ‘রাত্রির মধ্যযামে’ তাঁকে হত্যা করে মন্ত্রিপরিষদ। রাজা চেয়েছিলেন, ‘তাঁর রাজ্যে কোনো দুঃখী প্রজা থাকবে না, অনাহারী থাকবে না।’ কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ চেয়েছিল, রাজ্য ভরে থাকতে অনাহারে, দুঃখপীড়িত জনতায়। আর তারা ভোগ বিলাসে মত্ত থাকবে। ঘিরে থাকবে রাজার চারপাশ। রাজা যেন, তাদের বেষ্টনী ভেদ করে দেশের প্রকৃত চিত্র দেখতে না পান। আর যেদিনই রাজা দেশের প্রকৃত চিত্র দেখে এলেন, সেদিনই রাজাকে প্রাণ হারাতে হলো। এ গল্পে মিলন দেখিয়েছেন মানুষ যখন ক্ষমতার শিখরে আরোহণ করে, তখন তার চারপাশ যদি চাটুকারে বেষ্টিত থাকে, তাহলে ওই মানুষ দেশের প্রকৃত চিত্র কোনোদিনই দেখতে পান না। তিনি কেবল সেই চিত্রটুকুই দেখেন, সেই খবরটুকুই জানেন, যা তার চাটুকাররা তাকে দেখায়, বা শোনায়। এই ধরনের ক্ষমতাবানদের জীবন সবসময় ঝুঁকির ভেতর থাকে। তাঁরা আর সত্যের সন্ধান পান না। যখনই তাঁরা সত্যের সন্ধানে বের হতে চান, তখনই তাঁদের সামনে ঘাতকের খড়গকৃপাণ ঝুলতে থাকে। কারণ, তাঁরা যদি সত্যের সন্ধান জেনে যান, তাহলে ঘাতক-চাটুকারদের মুখোশ খুলে পড়বে। তাঁরা দেশব্যাপী লুটতরাজ, দুর্নীতি করে বেড়াতে পারবে না। চাটুকারবেষ্টিত ক্ষমতাবানরা সারাজীবন চাটুকারবেষ্টিত থাকতে হবে, না হয় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে।
‘মানুষ কাঁদছে’ গল্পের সূচনা রহিম ও কালুর তাস খেলার বর্ণনা দিয়ে। এ গল্পে ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়েছে। একইসঙ্গে সামাজিক বাস্তবতাও। এ গল্পের আরেকটি বিশেষ দিক হলো—গল্পটি শুরু হয় তৃতীয় পুরুষে, কিন্তু হঠাৎ করে উত্তমপুরুষ এসে হাজির হয়। কিছুটা যাওয়ার পর আবারও সেই তৃতীয় পুরুষ। অর্থাৎ গল্পের ভেতর কথকও একবার ঢুকে পড়েন। গল্পের ভেতর কথক ঢুকে পড়েন ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর জন্য। এগল্পের চরিত্রগুলো নিতান্ত দরিদ্র। কারও সামান্য লেখাপড়া আছে, কারও বা তাও নেই। তবে চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলেও অন্যকে ফাঁকি দিয়ে সামান্য পরিমাণে হলেও ফায়দা লোটার বাসনা আছে। তাই সামান্য কয়টা টাকার লোকে উদ্ভ্রান্তের মতো সাইকেল চালিয়ে যায় রহিম। ঘটনাচক্রে দুর্ঘটনা। এবং মৃত্যু।
রহিমের এক্সিডেন্টের কথা শুনেও আশরাফ দাঁড়ায় না। পরন্তু সে ভয় পায়। সে ভাবে যদি পুলিশ তাকে ধরে, যদি জেনে যায় সে-ই রহিমকে সাইকেল নিয়ে পাঠিয়েছিল। তাই সে পালায়। এদিকে একে একে রহিম-আশরাফ দুজনেই ফিরে না আসায় ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে ওঠে আরিফ। সে জানতে পারে না রহিমের কী হয়েছে, আশরাফই বা কোথায় চলে গেল। হাতে যা কিছু ছিল, সব কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলে। উড়িয়ে দেয় বাতাসে। আর ওই কুচিকুটি কাগজের টুকরোগুলোর ওপর লুটিয়ে পড়ে গুমরে গুমরে কাঁদে।
ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন গল্প। কিন্তু সমাজকে দেখেছেন অনেকটা দার্শনিক ও কবির চোখে। ফলে কথাশিল্পীর যে দৃষ্টি রূঢ়বাস্তবতাকে খুটিয়ে খুটিয়ে চিত্রিত করে নির্মোহতার প্রমাণ দেয়, মিলনের গল্পের সে চিত্র কম। বরং দার্শনিক ও কবির স্বপ্ন চিত্রায়িত হয়েছে বেশি। ‘পাগল সাহেব’ কিংবা ‘গোপন দুয়ার’-এর মতো গল্প কেবল সামাজিক বাস্তবতার চেতনা দিয়ে লেখা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হয় কবির স্বপ্ন, দার্শনিকের প্রত্যয়। তবেই একইরুচির দুজন মানুষের দেখা মেলা সম্ভব। তবেই সমাজের দুই শ্রেণীর মানুষের ভেদাভেদ ভুলে পাগল সাহেব নিজেই রিকশা চালাতে পারেন রাতের বেলা, আর রিকশাঅলাকে বসিয়ে দিতে পারেন, যাত্রীর আসনে। এমন অমিতসম্ভাব্য স্বপ্ন দেখা সম্ভব হলেই দুই তৃষ্ণার্ত-ভাগ্যবিড়ম্বিত নরনারী প্রথম সাক্ষাতে নিজেদের গোপন দুয়ার খুলে বসতে পারেন। আর দিতে পারেন জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত নিষ্ঠুর ঘটনার বর্ণনা। আশ্চর্য রকমভাবে দুজনের জীবনের সমস্ত ঘটনা-ই একই বিন্দুতে এসে মিলিত হতে পারে।
ইমদাদুল হক মিলন গল্প লিখতে গিয়ে কোনো তত্ত্ব বা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচার করেননি। কিন্তু সমাজ-রাজনীতির নোংরা-নিষ্ঠুর দিকগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্লট বর্ণনার সঙ্গে সংলাপ, পরিবেশের সঙ্গে চরিত্রের সামঞ্জস্য পাঠকের আশ্বস্ত করে। মনে হয় না, বানিয়ে বানিয়ে কোনো ঘটনা বর্ণনা করছেন লেখক। বরং কখনো কখনো মনে হয়, একেবারে সাক্ষাৎ চিত্র তুলে এনেছেন। এছাড়া গল্পের ভাষা নিয়ে তেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তিনি তেমন করেন না। যখন যেমন ভাষার প্রয়োজন, চরিত্রগুলোর মুখে সে ভাষা-ই তিনি দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি গল্পকে শেষপর্যন্তই একরৈখিক রাখেন। কখনো নিরীক্ষার দোহায় দিয়ে গল্পকে বহুরৈখিক করে তোলার নামে, বর্ণনাসর্বস্ব করে তোলেন না। একজন শক্তিমান কথাকারের সার্থকতা এখানেই। মিলনের গল্পে স্বপ্ন ও যাপিত জীবন অনেক সময়-ই হাত ধরাধরি করে চলে না। কিন্তু যাপিত জীবনে পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখানোও অনেক বড় কাজ। যা একজন কথাশিল্পীর কলমকে রূপকথার ‘সোনার কাঠি, রূপার কাঠির’ মতোই বিস্ময়কর করে তোলে। ইমদাদুল হক মিলনের ছোটগল্পে কলমকে সেই রূপকথার ‘সোনার কাঠি, রূপার কাঠি’ বললে অত্যুক্তি হয় না।
0 মন্তব্যসমূহ