-আপনি আমাকে ময়নাদ্বীপে নিয়ে যাবেন?
পরপর দু’বার কথাটা বলে নীপা।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী চলছে পাবলিক লাইব্রেরীর অডিটোরিয়ামে। দর্শক মোটামুটি। দুপুরের এই শোতে ভীড় কম এখন। নীপা এবং আমি হলঘরের এক কোণের একটি আসনে খুঁজে পেতে বসেছি। আশেপাশের সিট অনেকগুলোই খালি। নীপা আমার পাশে গা ঘেঁসে বসেছে। আমি বেশ মনোযোগ দিয়েই ছবিটা দেখছি। ইতিপূর্বে দেখেছি। আজ এসেছি তার সঙ্গী হয়ে।
ক’দিন ধরেই সে ফোনে আমাকে বলে আসছিল আমার সঙ্গে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিটা দেখতে চায়। কারণ, সঙ্গী পাচ্ছে না। বান্ধবীরা সবাই দেখে ফেলেছে। আমার কি একটু সময় হবে তার সাথে ছবিটা দেখতে যাবার?
ছবি দেখতে আমি ভালই বাসি। গৌতম ঘোষের ছবি দু’বার কেন, বেশীও দেখা যায়। তাছাড়া সময় এখন অফুরন্ত আমার। একজন কর্মহীন মানুষের সময়ের কোনো অভাব থাকে না। বয়স যদি কিছু কম হতো মজা করে নিজের পরিচয় দেয়া যেত টোটো কম্পানির ম্যানেজার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে এ পর্যায়ে এসে সেটা শোভা পায় না। একটা খন্ডকালীন প্রজেক্টে এনজিওর যে চাকরীটা ছিল আমার, মাস তিনেক আগে সেটার সমাপ্তি ঘটেছে। প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ তো চাকরীও শেষ। নীপার সিনেমা দেখার প্রস্তাবে তাই রাজী হতে কোনো সমস্যা হয় না।
প্রজেক্ট হলেও চাকরীটা অবশ্য ভাল ছিল। অনেক বড় ফান্ড। বিগ বসেরা লুটেপুটে খাবার পরও আমাদের চুনোপুটিদের জন্য ছিটেফোঁটা উচ্ছিষ্ট যা থাকত, সেটা নেহাৎ মন্দ ছিল না। প্রতিমাসেই ফিল্ড। পনের দিন, বিশ দিন, কোনো মাসে তিরিশ দিন পর্যন্ত। ফিল্ডের পয়সায় মাস যেয়েও হাতে যা উদ্বৃত্ত থাকে তা প্রায় বেতনের দ্বিগুন। বেতন তো ধরাই থাকে ! সেই সাথে দেশের আনাচে- কানাচে ঘোরার আনন্দে দিন ভালই কাটছিল আমার। আড্ডায় টাকা ওড়াই বন্ধুদের নিয়ে। দুর্গাপুজায় মা, দাদা, দিদিদের শাড়ি, জামা-প্যান্টের কাপড় গিফ্ট করি। মাস গেলে মায়ের জন্য অষুধপত্র, টুকটাক হাতখরচ বাবদ নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাই। মনে হয়, জীবন নেহাৎ জটিল কিছু নয়। খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুরছি, আড্ডা দিচ্ছি, ভালই তো। বড় ধরনের কোনো প্রত্যাশা নেই। যা কিছু অযাচিত তাই সুন্দর। প্রত্যাশা থাকলেই বরং জীবনে মার খেতে হয়।
সমস্যা হলো, সুখের দিনগুলো যত দ্রুত যায়, কষ্টের দিনগুলো মোটে কাটতেই চায় না। এ লাইনে দুই মাস প্রজেক্টে কাজ করি তো, তিন মাস বেকার থাকি। কখনো কখনো ছয় সাত মাসও পার হয়ে যায়। ব্যাচেলর বলে টাকা পয়সার চাপ যতটা না, তারচেয়ে সামাজিকতায় বাঁধে বেশী। এই আছে তো, এই নেই চাকরীতে মানসম্মানের বালাই থাকে না। কি করি, কোথায় করি ইত্যাকার সাতকাহন পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কাউকে বলার নয়। কাশবন দূর থেকে ঘনই দেখায়। আড্ডায় দু’এক পয়সা ওড়াই বলে, বন্ধুরা ভাবে না জানি কত টাকা বেতন পাই। ভেতরে যে কিছু নেই, সেটা কেউ দেখে না।
নীপা জানে না বর্তমানে আমি বেকার। শুধু নীপা কেন বন্ধু-বান্ধব, বাড়িতে কেউ না। এখানে সিনেমা দেখতে আসার আগে অফিসে ঢুঁ মেরে এসেছি। বসের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বস আশ্বাস দিয়েছেন, নূতন প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য তিনি খুব করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব শিঘ্রী হয়তো একটা সুখবর পাওয়া যাবে। একটু যেন দোয়া করি।
বস একটু সাংস্কৃতিক গোছের। পত্র পত্রিকার লেখালেখি করেন। বসিং ব্যাপারটা নেই। আমাদের সাথে অনেক খোলামেলা কথাবার্তা বলেন। তবে জাতে মাতাল তালে ঠিক। পয়সা দেবার বেলায় সাইত্রিল ষোলআনা। বসকে বলি, দোয়া তো অবশ্যই করি স্যার ! প্রজেক্ট না থাকলে আমরা চলব কী করে? মনে মনে বলি, প্রজেক্ট না থাকলে আপনার মতো রাঘব-বোয়ালরা খাবে কী? আপনাদের উচ্ছিষ্ট না থাকলে, আমাদের মতো চুনোপুঁটিরাইবা বাঁচবে কী খেয়ে ?
প্রজেক্ট পেতে বসকে প্রায়ই দাতাদের সঙ্গে নামী-দামী রেস্তোরায় খাওয়াতে হয়। সম্ভবত আজও সে রকম একটা পার্টি আছে। খেতে খেতে নানা রকম কথার ফাঁকে দাতাদের বলা; তাকে কোনো একটা কাজ দেয়া যায় কী না ? এ লাইনের ভাষায় ‘স্টাডি’ করা। দাতারাও খুব বুদ্ধিমান। অতি সহজেই বুঝে ফেলে। আকলমন্দকে লিয়ে ইশারায় কাফি! বলে, ঠিক আছে, তুমি একটা প্রপোজাল দাও, আমরা সেটা বিবেচনা করবো! এরপর বায়োনিক দ্রুততায় প্রপোজাল তৈরি হয় এবং জায়গা মতো পৌঁছে যায়। কখনো বস নিজে যান। কখনো আমাদের পাঠান। শুরু হয় দিন গোনা। এবং ভাগ্য ভাল হলে মিলেও যায় ফান্ড। তখন আমরা পড়ি টেনশনে। বস এ প্রজেক্টে আমাদের রাখবেন তো? নাকি অন্যদের নেবেন? নূতনদের নিলে তার লাভ বেশী। কম টাকায় সারতে পারবেন!
প্রথম প্রথম এসব নিয়ে দলবাজি করতে চাইতাম। পরে বুঝেছি, তাতে লাভ হয় না। বরং পরবর্তী প্রজেক্টে বাদ পড়তে হয়। তবে বসের দয়ার শরীর। দু’দিন বাদেই সব ভুলে যান। শাস্তির মেয়াদ খুব বেশী দীর্ঘায়িত হয় না। কিছুদিন অফিসে ঘুর ঘুর করলেই পুনরায় ডেকে নেন। সেক্ষেত্রে বেতন, টিএ, ডিএ-র পরিমান আগের চেয়ে কমে যায়। সুতরাং কী দরকার?
পাশে বসে নীপা, দ্বিতীয়বারের মতো ময়নাদ্বীপে যাবার কথার পুনরাবৃত্তি করে। এবার আমি নড়েচড়ে বসি। সিনেমায় নায়িকা কপিলার মুখের এ সংলাপ একেবারে শেষ দৃশ্যে, কুবেরের উদ্দেশ্যে বলা। সেটা তার জানার কথা নয়। নীচু গলায় প্রশ্ন করি, তুমি কি ছবিটা আগে দেখেছ?
দুষ্টু মুখে সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। বলে, বান্ধবীদের সাথে!
ছবি দেখা শেষ হলে পরে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে তখন বিকেলের পড়ন্ত সোনা রোদ গলে গলে পড়ছে। ছাতিম গাছের তলায় বসি। খানিক বাদে চা খাই। বিকেলে এখন বেশ ভীড় দর্শকদের। তা সত্ত্বেও পরিবেশটা ভাল লাগছে। নীপা বলে, বাসায় বড় আপাকে বলে এসেছি হলে বান্ধবীর কাছে নোট আনতে যাব, ফিরতে দেরী হবে। আজ সন্ধ্যার পরেও অনেকক্ষণ থাকতে পারব। আামকে কিন্তু বাসায় পৌঁছে দিতে হবে !
ঢাকায় নীপা তার বড় আপার বাসায় থেকে পড়াশুনা করে। দুলাভাই পুলিশের এসপি। আপা ভীষন কড়া। বাসা থেকে মোটেই বের হতে দেয় না। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা একেবারেই নিষেধ। মাঝে মাঝে সে হাপিয়ে যায়। কিছু একটা বলে তখন বাসা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। আমাকে বলে, জানেন, এত আটকা থাকতে আমরা ভাল লাগে না! ভাবছি ভার্সিটির হলে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে থাকবো !
সে সম্প্রতি একটা পাবলিক কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আমার সাথে পরিচয় আড্ডার সূত্র ধরে। এখন দেখছি আড্ডা বাদ দিয়ে সে আমার সঙ্গে মিশতে বেশী পছন্দ করছে !
তার সাথে পরিচয়ের স্বল্পমেয়াদে বেশ কয়েকটা অপরাধ করেছি আমি। দন্ড হওয়া উচিত আমার। সম্ভবত সে ক্ষমা করে দিয়েছে। দিন কয়েক আগের কথা; হঠাৎ ফোন দিয়ে সে বলে, বাসা থেকে বেরোবার একটা ফাঁক মিলেছে ! আমি যেন বিকাল তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে আসি। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সে থাকতে পারবে। বিষয়, আমার সঙ্গে আড্ডা ! যেহেতু কোনো কাজ নেই, তাই রাজী হই। ছয়টায় তাকে বিদায় দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যাব। কিন্তু দুষ্টগ্রহের ফেরে সেদিন আমার আর আসা হয় না। তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত আমার জন্য তিন ঘন্টা অপেক্ষায় থেকে সে ফিরে চলে যায়।
আগে-পরে গ্রহ কর্তৃক নাস্তানাবুদ হওয়ার অনুরূপ ঘটনা আরও ঘটে। এখানে আমি কেবল দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করবো।
প্রথম ঘটনার সময় ওইদিন আমার একটা ইন্টারভিউ ছিল। সকাল দশটায়। গিয়ে শুনি ইন্টারভিউটা বিকাল তিনটায় পরিবর্তিত হয়েছে। এ লাইনের চাকুরীর ধরনটাই এমন। হয়তো এরা ইচছা করেই করে এগুলো ! দেখে, কার কার চাকরীর গরজ আছে ?
একবার ভেবেছিলাম, বাদ দিই ঘোড়ার ইন্টারভিউ। কিন্তু এসব চাকরীতে অনেক সময় জেনারেল মিটিং করেও সবাইকে নিয়ে নেয়। মানে মিটিং-এ সবার উদ্দেশ্যে প্রজেক্টের শর্ত-টর্ত গুলো বলে আর কি! যদি সেরকম হয়, তো তাড়াতাড়ি ছাড়া পাব ভেবে থেকে যাই। কিন্তু বৃথাই সব! ওদের আগে থেকে লোক ঠিক করা ছিল। ইন্টারভিউ নামমাত্র। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। ইন্টারভিউ যখন শেষ হলো, তখন হাতে আর সময় নেই।
এ বিষয়ে নীপাকে আমি কী আর বলতে পারতাম?
আমার যে চাকরী নেই, ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আটকে গেছিলাম, ফালতু জব করে বেড়াই, যখন-তখন বেকার হই, এসব নীপা, বন্ধুবান্ধব এমনকী নিজের বাড়িতেও বলা যায়?
এর পরের ঘটনাটা আরো বেশী গুরুতর ছিল। বড় আকারে ধরা খেয়েছিলাম।
তখনো চাকরীতে আছি, বেকার হইনি। একদিন সকালে সে অফিসে ফোন করে আমাকে বলে, বাসায় আসবেন একটু? আসেন না একদিন !
আমি বলি, কেন, কী ব্যাপার! সমস্যা কোনো? জরুরী কিছু?
সে বলে, না, না ! জরুরী কিছু না, এমনিই। আপা-দুলাভাই ভারতে গেছেন। বাসায় একদম একা। ভাগ্নী দু’টো আছে শুধু। ওদের রেখে কোথাও তো বের হতে পারি না! কদিন ধরে খুব বোর লাগছে। আসেন না, প্লিজ! আসবেন ? এক ধরনের আকুতি ঝরে পড়ে তার কন্ঠে !
মজা করে বলি, যদি আসি, তো কী খাওয়াবে ? সে উৎসাহিত হয়ে বলে, আপনি যা খেতে চান, তাই খাওয়াব !
-আমি তো বাঙালি, বাংলা খাবার পছন্দ করি। এই ধরো, ভাত, মাছ, সব্জি, ডাল, ভর্তা এইসব !
সে বলে, বেশ, আমি আপনার জন্য বাংলাই রাঁধবো! কবে আসবেন, কাল?
আমি বলি কাল? হ্যাঁ, তা আসা যায়!
- দুপুরে, নাকি রাতে?
আমি বলি, না, রাতে না, দুপুরে, অফিস থেকে সরাসরি চলে আসবো তোমার বাসায়, তিনটা থেকে চারটার মধ্যে। তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?
- না, না ! সে আশ্বস্ত করে, কোনো সমস্যা নেই, ভাগ্নীরা খালার খুব ভক্ত! ঠিক আছে, তাহলে, ওই কথাই রইল, চারটার মধ্যে চলে আসবেন, আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো ! বলে নীপা ফোনটা ছেড়ে দেয়।
কিন্তু পরদিন নীপার বাসায় আমার যাওয়া হয় না।
দুপুরে লাঞ্চের কিছু পরে, তিনটার দিকে বস আমাকে ডেকে পাঠান। এমনিতে বৃহস্পতিবার তিনটা নাগাদ অফিস হাল্কা হয়ে যায়। আমিও বেরোবো, মনে মনে, তৈরি হচ্ছি। সে সময় ঢাকা শহরের জ্যাম এত ওয়ার্ড ক্লাস ছিল না। অফিস থেকে তিনটায় বের হলে, অটোরিক্সায় নীপার বাসায় এক ঘন্টা লাগে না। ঠিক তখুনি বসের জরুরী তলব।
আমি ঢুকতেই, বস আমাকে জরুরী গলায় বললেন, শোনো মুকুল, তুমি এক্ষুণি এই প্যাকেটটা নিয়ে মানিকগঞ্জ চলে যাও, এতে আমার সিভি এবং অন্যান্য কিছু কাগজপত্র আছে! বলে, একটা মুখ আটা বাঁশ পাতার বড় সাইজের ভারী খাম আমার হাতে তুলে দেন।
তারপর কোথায়, কার কাছে, কী বলতে হবে সব ব্রিফ করেন। সেটা যে একটা প্রজেক্ট-প্রপোজাল আমার তা বুঝতে বাকী থাকে না। বস আরও বলেন, অফিসের গাড়ী নিয়ে জরুরীভাবে চলে যাও! ড্রাইভারকে বলা আছে তোমার জন্য নীচে অপেক্ষা করছে!
কোনো কথা না বলে, বিদায় জানিয়ে আমি বসের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি। এবং সেদিন মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরি রাত দশটায়। ড্রাইভার রশিদ আমাকে বাসায় নামিয়ে দেয়।
এরপর কিছুদিন নীপার ফোন বন্ধ থাকে।
তবে স্বস্তিকর এই যে, এ নিয়ে সে আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি। ফলে, অন্ত:ত মিথ্যা অজুহাতের দায় থেকে দুষ্টগ্রহ যে আমাকে রেহাই দিয়েছে, ভেবে স্বান্তনা খুজে পাই!
পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরে ইতিমধ্যে সন্ধ্যার পার হয়ে গেছে।
ছাতিম গাছের তলায় বসে দ্বিতীয় দফা চা খেতে খেতে নীপা বলে, আপনার হাতটা একটু ধরি? বলে সে আলগোছে আমার হাতটা নিজের ভেতরে টেনে নেয় এবং দু’হাত দিয়ে ধরে থাকে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে, আপনার এ হাত আমি সারা জীবনের মতো ধরে রাখতে চাই, সেই অধিকার চাই। জানি না আপনি আমাকে কী বলবেন, বা আমার সম্পর্কে কী ভাববেন? আমি শুধু আমার যেটা কথা, সেটাই আপনাকে বললাম। আপনি এখন যা খুশি তাই আমাকে ভাবতে পারেন!
এক নি:শ্বাসে সে কথাগুলি বলে!
আমি বোবা হয়ে যাই। ভেবে পাই না কী বলবো? প্রস্তুত ছিলাম না, এটুকু শুধু বলতে পারি।
অনেকক্ষণ কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলাম। নীপা অন্য দিকে মুখ ফিরে আছে। নিরবতার এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে মুখোমুখি বসেআছি আমরা। সেখান থেকে বের হতে চাইলে, হয় সামনে এগুতে হবে, নতুবা সম্পর্কের এখানেই ইতি টানতে হবে। মাঝামাঝি থাকা আর চলবে না।
কিছু সময় পরে নিরবতা ভেঙে বলি তাকে, শোনো নীপা, এদেশে এখনো হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে অনেক দুস্তর পারাপার । তোমাকে নিয়ে ময়নাদ্বীপ বা যেখানেই যাই, তোমার দুলাভাই আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করবেন। তারপর কী হবে তুমি না জানলেও আমি জানি কী হবে!
নারী অপহরন নির্যাতনের মামলা যদি নাও হয়, তোমার আপা দুলাভাইকে বলবেন, হিন্দুর বাচ্চার এত বড় সাহস আমার বোনের দিকে হাত বাড়ায়! ওকে উচিত শিক্ষা দাও।
একটা অবৈধ অস্ত্র বা হেরোইন জাতীয় মারাত্মক কোনো মাদকের মামলায় আমাকে জড়িয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না তোমার দুলাভাইয়ের জন্য। পদ্মানদীর মাঝিতেও তো দেখেছ, কুবের কিভাবে জেলে যেতে পারতো! সুতরাং চৌদ্দ শিকের ঘানি আমার নিশ্চিত। তুমি হয়তো কেঁদেটেদে কিছুদিন মনমরা হয়ে থাকবে। বাড়াবাড়ি করলে ঘুমের বড়িতে ব্যর্থ চেষ্টা করবে হয়তোবা। তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে তুমি, সময়ের প্রলেপে সয়ে যাবে পুরনো যন্ত্রনা।
মধ্য থেকে আমি, আমার বিধবা অসহায় মা, যাকে আমি ছাড়া দেখার কেউ নেই, দাদা-দিদি সহ একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে ! শুধু শুধু জীবনে জটিলতা ডেকে আনার কোনো মানে হয় না! ভালবাসা আর করুণা এক জিনিস নয়। তুমি আমাকে যেভাবে ভেবেছ, আমি তোমাকে সেভাবে ভাবিনি। নিশ্চয়ই তুমি ভালবাসার নামে আমার কাছ থেকে করুনা আশা করো না এবং আমারও সেটা উচিত হবে না। আমরা পরস্পরের একান্ত আপন না হতে পারি, একে অপরকে যেন ছোট না করি। ভবিষ্যতে দু’দিনের পরিচয়ের বন্ধুত্বকে আমরা যেন শ্রদ্ধার চোখে স্মরণ করতে পারি!
আরো কী কী সব বলেছিলাম সেই সন্ধ্যায়, আজ তা মনে নেই। দেখেছিলাম, তার চোখ বেয়ে নেমে আসা দু’সারি কষ! শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে টোল পড়া মুখে!
এক সময় তন্ময়তা ভেঙে বলি, চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই, অনেক রাত হয়ে গেছে!
এরপর নীপার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না আমার।
কিছুকাল পরে বন্ধুদের মুখে নীপার খবর শুনি। বিয়ে করেছে সে। পরিবারের ঠিক করা ধনী ব্যবসায়ী পাত্রকে উপেক্ষা করে নিজ-পছন্দের মধ্যবিত্ত এক চাকরীজীবি ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছে। নিজেও একটা স্কুলে ঢুকেছে। একটা ফুটফুটে ছোট্ট শিশু এবং ছোট্ট সুখি গৃহকোন!
বড় আপার বাসা সে ছেড়ে দিয়েছিল। হলের বান্ধবীদের সঙ্গে থাকতো। তারপর বিয়ে করে। তাকে আমি বুদ্ধিমান এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে করতাম। আমার সে ধারনা নির্ভূল ছিল।
বেশীরভাগ মানুষ সুখ চিনতে ভুল করে। কোথায় নিজের সুখ সেটা না জেনেই অন্ধের মত মরীচিকার পেছনে ছোটে। নীপা তাদের মধ্যে পড়ে না। সে নিজের সুখ নির্ণয় করতে পেরেছিল এবং সে দিকেই ধাবিত হয়েছিল।
পরপর দু’বার কথাটা বলে নীপা।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী চলছে পাবলিক লাইব্রেরীর অডিটোরিয়ামে। দর্শক মোটামুটি। দুপুরের এই শোতে ভীড় কম এখন। নীপা এবং আমি হলঘরের এক কোণের একটি আসনে খুঁজে পেতে বসেছি। আশেপাশের সিট অনেকগুলোই খালি। নীপা আমার পাশে গা ঘেঁসে বসেছে। আমি বেশ মনোযোগ দিয়েই ছবিটা দেখছি। ইতিপূর্বে দেখেছি। আজ এসেছি তার সঙ্গী হয়ে।
ক’দিন ধরেই সে ফোনে আমাকে বলে আসছিল আমার সঙ্গে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিটা দেখতে চায়। কারণ, সঙ্গী পাচ্ছে না। বান্ধবীরা সবাই দেখে ফেলেছে। আমার কি একটু সময় হবে তার সাথে ছবিটা দেখতে যাবার?
ছবি দেখতে আমি ভালই বাসি। গৌতম ঘোষের ছবি দু’বার কেন, বেশীও দেখা যায়। তাছাড়া সময় এখন অফুরন্ত আমার। একজন কর্মহীন মানুষের সময়ের কোনো অভাব থাকে না। বয়স যদি কিছু কম হতো মজা করে নিজের পরিচয় দেয়া যেত টোটো কম্পানির ম্যানেজার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে এ পর্যায়ে এসে সেটা শোভা পায় না। একটা খন্ডকালীন প্রজেক্টে এনজিওর যে চাকরীটা ছিল আমার, মাস তিনেক আগে সেটার সমাপ্তি ঘটেছে। প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ তো চাকরীও শেষ। নীপার সিনেমা দেখার প্রস্তাবে তাই রাজী হতে কোনো সমস্যা হয় না।
প্রজেক্ট হলেও চাকরীটা অবশ্য ভাল ছিল। অনেক বড় ফান্ড। বিগ বসেরা লুটেপুটে খাবার পরও আমাদের চুনোপুটিদের জন্য ছিটেফোঁটা উচ্ছিষ্ট যা থাকত, সেটা নেহাৎ মন্দ ছিল না। প্রতিমাসেই ফিল্ড। পনের দিন, বিশ দিন, কোনো মাসে তিরিশ দিন পর্যন্ত। ফিল্ডের পয়সায় মাস যেয়েও হাতে যা উদ্বৃত্ত থাকে তা প্রায় বেতনের দ্বিগুন। বেতন তো ধরাই থাকে ! সেই সাথে দেশের আনাচে- কানাচে ঘোরার আনন্দে দিন ভালই কাটছিল আমার। আড্ডায় টাকা ওড়াই বন্ধুদের নিয়ে। দুর্গাপুজায় মা, দাদা, দিদিদের শাড়ি, জামা-প্যান্টের কাপড় গিফ্ট করি। মাস গেলে মায়ের জন্য অষুধপত্র, টুকটাক হাতখরচ বাবদ নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাই। মনে হয়, জীবন নেহাৎ জটিল কিছু নয়। খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুরছি, আড্ডা দিচ্ছি, ভালই তো। বড় ধরনের কোনো প্রত্যাশা নেই। যা কিছু অযাচিত তাই সুন্দর। প্রত্যাশা থাকলেই বরং জীবনে মার খেতে হয়।
সমস্যা হলো, সুখের দিনগুলো যত দ্রুত যায়, কষ্টের দিনগুলো মোটে কাটতেই চায় না। এ লাইনে দুই মাস প্রজেক্টে কাজ করি তো, তিন মাস বেকার থাকি। কখনো কখনো ছয় সাত মাসও পার হয়ে যায়। ব্যাচেলর বলে টাকা পয়সার চাপ যতটা না, তারচেয়ে সামাজিকতায় বাঁধে বেশী। এই আছে তো, এই নেই চাকরীতে মানসম্মানের বালাই থাকে না। কি করি, কোথায় করি ইত্যাকার সাতকাহন পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কাউকে বলার নয়। কাশবন দূর থেকে ঘনই দেখায়। আড্ডায় দু’এক পয়সা ওড়াই বলে, বন্ধুরা ভাবে না জানি কত টাকা বেতন পাই। ভেতরে যে কিছু নেই, সেটা কেউ দেখে না।
নীপা জানে না বর্তমানে আমি বেকার। শুধু নীপা কেন বন্ধু-বান্ধব, বাড়িতে কেউ না। এখানে সিনেমা দেখতে আসার আগে অফিসে ঢুঁ মেরে এসেছি। বসের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বস আশ্বাস দিয়েছেন, নূতন প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য তিনি খুব করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব শিঘ্রী হয়তো একটা সুখবর পাওয়া যাবে। একটু যেন দোয়া করি।
বস একটু সাংস্কৃতিক গোছের। পত্র পত্রিকার লেখালেখি করেন। বসিং ব্যাপারটা নেই। আমাদের সাথে অনেক খোলামেলা কথাবার্তা বলেন। তবে জাতে মাতাল তালে ঠিক। পয়সা দেবার বেলায় সাইত্রিল ষোলআনা। বসকে বলি, দোয়া তো অবশ্যই করি স্যার ! প্রজেক্ট না থাকলে আমরা চলব কী করে? মনে মনে বলি, প্রজেক্ট না থাকলে আপনার মতো রাঘব-বোয়ালরা খাবে কী? আপনাদের উচ্ছিষ্ট না থাকলে, আমাদের মতো চুনোপুঁটিরাইবা বাঁচবে কী খেয়ে ?
প্রজেক্ট পেতে বসকে প্রায়ই দাতাদের সঙ্গে নামী-দামী রেস্তোরায় খাওয়াতে হয়। সম্ভবত আজও সে রকম একটা পার্টি আছে। খেতে খেতে নানা রকম কথার ফাঁকে দাতাদের বলা; তাকে কোনো একটা কাজ দেয়া যায় কী না ? এ লাইনের ভাষায় ‘স্টাডি’ করা। দাতারাও খুব বুদ্ধিমান। অতি সহজেই বুঝে ফেলে। আকলমন্দকে লিয়ে ইশারায় কাফি! বলে, ঠিক আছে, তুমি একটা প্রপোজাল দাও, আমরা সেটা বিবেচনা করবো! এরপর বায়োনিক দ্রুততায় প্রপোজাল তৈরি হয় এবং জায়গা মতো পৌঁছে যায়। কখনো বস নিজে যান। কখনো আমাদের পাঠান। শুরু হয় দিন গোনা। এবং ভাগ্য ভাল হলে মিলেও যায় ফান্ড। তখন আমরা পড়ি টেনশনে। বস এ প্রজেক্টে আমাদের রাখবেন তো? নাকি অন্যদের নেবেন? নূতনদের নিলে তার লাভ বেশী। কম টাকায় সারতে পারবেন!
প্রথম প্রথম এসব নিয়ে দলবাজি করতে চাইতাম। পরে বুঝেছি, তাতে লাভ হয় না। বরং পরবর্তী প্রজেক্টে বাদ পড়তে হয়। তবে বসের দয়ার শরীর। দু’দিন বাদেই সব ভুলে যান। শাস্তির মেয়াদ খুব বেশী দীর্ঘায়িত হয় না। কিছুদিন অফিসে ঘুর ঘুর করলেই পুনরায় ডেকে নেন। সেক্ষেত্রে বেতন, টিএ, ডিএ-র পরিমান আগের চেয়ে কমে যায়। সুতরাং কী দরকার?
পাশে বসে নীপা, দ্বিতীয়বারের মতো ময়নাদ্বীপে যাবার কথার পুনরাবৃত্তি করে। এবার আমি নড়েচড়ে বসি। সিনেমায় নায়িকা কপিলার মুখের এ সংলাপ একেবারে শেষ দৃশ্যে, কুবেরের উদ্দেশ্যে বলা। সেটা তার জানার কথা নয়। নীচু গলায় প্রশ্ন করি, তুমি কি ছবিটা আগে দেখেছ?
দুষ্টু মুখে সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। বলে, বান্ধবীদের সাথে!
ছবি দেখা শেষ হলে পরে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে তখন বিকেলের পড়ন্ত সোনা রোদ গলে গলে পড়ছে। ছাতিম গাছের তলায় বসি। খানিক বাদে চা খাই। বিকেলে এখন বেশ ভীড় দর্শকদের। তা সত্ত্বেও পরিবেশটা ভাল লাগছে। নীপা বলে, বাসায় বড় আপাকে বলে এসেছি হলে বান্ধবীর কাছে নোট আনতে যাব, ফিরতে দেরী হবে। আজ সন্ধ্যার পরেও অনেকক্ষণ থাকতে পারব। আামকে কিন্তু বাসায় পৌঁছে দিতে হবে !
ঢাকায় নীপা তার বড় আপার বাসায় থেকে পড়াশুনা করে। দুলাভাই পুলিশের এসপি। আপা ভীষন কড়া। বাসা থেকে মোটেই বের হতে দেয় না। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা একেবারেই নিষেধ। মাঝে মাঝে সে হাপিয়ে যায়। কিছু একটা বলে তখন বাসা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। আমাকে বলে, জানেন, এত আটকা থাকতে আমরা ভাল লাগে না! ভাবছি ভার্সিটির হলে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে থাকবো !
সে সম্প্রতি একটা পাবলিক কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আমার সাথে পরিচয় আড্ডার সূত্র ধরে। এখন দেখছি আড্ডা বাদ দিয়ে সে আমার সঙ্গে মিশতে বেশী পছন্দ করছে !
তার সাথে পরিচয়ের স্বল্পমেয়াদে বেশ কয়েকটা অপরাধ করেছি আমি। দন্ড হওয়া উচিত আমার। সম্ভবত সে ক্ষমা করে দিয়েছে। দিন কয়েক আগের কথা; হঠাৎ ফোন দিয়ে সে বলে, বাসা থেকে বেরোবার একটা ফাঁক মিলেছে ! আমি যেন বিকাল তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে আসি। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সে থাকতে পারবে। বিষয়, আমার সঙ্গে আড্ডা ! যেহেতু কোনো কাজ নেই, তাই রাজী হই। ছয়টায় তাকে বিদায় দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যাব। কিন্তু দুষ্টগ্রহের ফেরে সেদিন আমার আর আসা হয় না। তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত আমার জন্য তিন ঘন্টা অপেক্ষায় থেকে সে ফিরে চলে যায়।
আগে-পরে গ্রহ কর্তৃক নাস্তানাবুদ হওয়ার অনুরূপ ঘটনা আরও ঘটে। এখানে আমি কেবল দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করবো।
প্রথম ঘটনার সময় ওইদিন আমার একটা ইন্টারভিউ ছিল। সকাল দশটায়। গিয়ে শুনি ইন্টারভিউটা বিকাল তিনটায় পরিবর্তিত হয়েছে। এ লাইনের চাকুরীর ধরনটাই এমন। হয়তো এরা ইচছা করেই করে এগুলো ! দেখে, কার কার চাকরীর গরজ আছে ?
একবার ভেবেছিলাম, বাদ দিই ঘোড়ার ইন্টারভিউ। কিন্তু এসব চাকরীতে অনেক সময় জেনারেল মিটিং করেও সবাইকে নিয়ে নেয়। মানে মিটিং-এ সবার উদ্দেশ্যে প্রজেক্টের শর্ত-টর্ত গুলো বলে আর কি! যদি সেরকম হয়, তো তাড়াতাড়ি ছাড়া পাব ভেবে থেকে যাই। কিন্তু বৃথাই সব! ওদের আগে থেকে লোক ঠিক করা ছিল। ইন্টারভিউ নামমাত্র। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। ইন্টারভিউ যখন শেষ হলো, তখন হাতে আর সময় নেই।
এ বিষয়ে নীপাকে আমি কী আর বলতে পারতাম?
আমার যে চাকরী নেই, ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আটকে গেছিলাম, ফালতু জব করে বেড়াই, যখন-তখন বেকার হই, এসব নীপা, বন্ধুবান্ধব এমনকী নিজের বাড়িতেও বলা যায়?
এর পরের ঘটনাটা আরো বেশী গুরুতর ছিল। বড় আকারে ধরা খেয়েছিলাম।
তখনো চাকরীতে আছি, বেকার হইনি। একদিন সকালে সে অফিসে ফোন করে আমাকে বলে, বাসায় আসবেন একটু? আসেন না একদিন !
আমি বলি, কেন, কী ব্যাপার! সমস্যা কোনো? জরুরী কিছু?
সে বলে, না, না ! জরুরী কিছু না, এমনিই। আপা-দুলাভাই ভারতে গেছেন। বাসায় একদম একা। ভাগ্নী দু’টো আছে শুধু। ওদের রেখে কোথাও তো বের হতে পারি না! কদিন ধরে খুব বোর লাগছে। আসেন না, প্লিজ! আসবেন ? এক ধরনের আকুতি ঝরে পড়ে তার কন্ঠে !
মজা করে বলি, যদি আসি, তো কী খাওয়াবে ? সে উৎসাহিত হয়ে বলে, আপনি যা খেতে চান, তাই খাওয়াব !
-আমি তো বাঙালি, বাংলা খাবার পছন্দ করি। এই ধরো, ভাত, মাছ, সব্জি, ডাল, ভর্তা এইসব !
সে বলে, বেশ, আমি আপনার জন্য বাংলাই রাঁধবো! কবে আসবেন, কাল?
আমি বলি কাল? হ্যাঁ, তা আসা যায়!
- দুপুরে, নাকি রাতে?
আমি বলি, না, রাতে না, দুপুরে, অফিস থেকে সরাসরি চলে আসবো তোমার বাসায়, তিনটা থেকে চারটার মধ্যে। তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?
- না, না ! সে আশ্বস্ত করে, কোনো সমস্যা নেই, ভাগ্নীরা খালার খুব ভক্ত! ঠিক আছে, তাহলে, ওই কথাই রইল, চারটার মধ্যে চলে আসবেন, আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো ! বলে নীপা ফোনটা ছেড়ে দেয়।
কিন্তু পরদিন নীপার বাসায় আমার যাওয়া হয় না।
দুপুরে লাঞ্চের কিছু পরে, তিনটার দিকে বস আমাকে ডেকে পাঠান। এমনিতে বৃহস্পতিবার তিনটা নাগাদ অফিস হাল্কা হয়ে যায়। আমিও বেরোবো, মনে মনে, তৈরি হচ্ছি। সে সময় ঢাকা শহরের জ্যাম এত ওয়ার্ড ক্লাস ছিল না। অফিস থেকে তিনটায় বের হলে, অটোরিক্সায় নীপার বাসায় এক ঘন্টা লাগে না। ঠিক তখুনি বসের জরুরী তলব।
আমি ঢুকতেই, বস আমাকে জরুরী গলায় বললেন, শোনো মুকুল, তুমি এক্ষুণি এই প্যাকেটটা নিয়ে মানিকগঞ্জ চলে যাও, এতে আমার সিভি এবং অন্যান্য কিছু কাগজপত্র আছে! বলে, একটা মুখ আটা বাঁশ পাতার বড় সাইজের ভারী খাম আমার হাতে তুলে দেন।
তারপর কোথায়, কার কাছে, কী বলতে হবে সব ব্রিফ করেন। সেটা যে একটা প্রজেক্ট-প্রপোজাল আমার তা বুঝতে বাকী থাকে না। বস আরও বলেন, অফিসের গাড়ী নিয়ে জরুরীভাবে চলে যাও! ড্রাইভারকে বলা আছে তোমার জন্য নীচে অপেক্ষা করছে!
কোনো কথা না বলে, বিদায় জানিয়ে আমি বসের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি। এবং সেদিন মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরি রাত দশটায়। ড্রাইভার রশিদ আমাকে বাসায় নামিয়ে দেয়।
এরপর কিছুদিন নীপার ফোন বন্ধ থাকে।
তবে স্বস্তিকর এই যে, এ নিয়ে সে আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি। ফলে, অন্ত:ত মিথ্যা অজুহাতের দায় থেকে দুষ্টগ্রহ যে আমাকে রেহাই দিয়েছে, ভেবে স্বান্তনা খুজে পাই!
পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরে ইতিমধ্যে সন্ধ্যার পার হয়ে গেছে।
ছাতিম গাছের তলায় বসে দ্বিতীয় দফা চা খেতে খেতে নীপা বলে, আপনার হাতটা একটু ধরি? বলে সে আলগোছে আমার হাতটা নিজের ভেতরে টেনে নেয় এবং দু’হাত দিয়ে ধরে থাকে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে, আপনার এ হাত আমি সারা জীবনের মতো ধরে রাখতে চাই, সেই অধিকার চাই। জানি না আপনি আমাকে কী বলবেন, বা আমার সম্পর্কে কী ভাববেন? আমি শুধু আমার যেটা কথা, সেটাই আপনাকে বললাম। আপনি এখন যা খুশি তাই আমাকে ভাবতে পারেন!
এক নি:শ্বাসে সে কথাগুলি বলে!
আমি বোবা হয়ে যাই। ভেবে পাই না কী বলবো? প্রস্তুত ছিলাম না, এটুকু শুধু বলতে পারি।
অনেকক্ষণ কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলাম। নীপা অন্য দিকে মুখ ফিরে আছে। নিরবতার এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে মুখোমুখি বসেআছি আমরা। সেখান থেকে বের হতে চাইলে, হয় সামনে এগুতে হবে, নতুবা সম্পর্কের এখানেই ইতি টানতে হবে। মাঝামাঝি থাকা আর চলবে না।
কিছু সময় পরে নিরবতা ভেঙে বলি তাকে, শোনো নীপা, এদেশে এখনো হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে অনেক দুস্তর পারাপার । তোমাকে নিয়ে ময়নাদ্বীপ বা যেখানেই যাই, তোমার দুলাভাই আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করবেন। তারপর কী হবে তুমি না জানলেও আমি জানি কী হবে!
নারী অপহরন নির্যাতনের মামলা যদি নাও হয়, তোমার আপা দুলাভাইকে বলবেন, হিন্দুর বাচ্চার এত বড় সাহস আমার বোনের দিকে হাত বাড়ায়! ওকে উচিত শিক্ষা দাও।
একটা অবৈধ অস্ত্র বা হেরোইন জাতীয় মারাত্মক কোনো মাদকের মামলায় আমাকে জড়িয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না তোমার দুলাভাইয়ের জন্য। পদ্মানদীর মাঝিতেও তো দেখেছ, কুবের কিভাবে জেলে যেতে পারতো! সুতরাং চৌদ্দ শিকের ঘানি আমার নিশ্চিত। তুমি হয়তো কেঁদেটেদে কিছুদিন মনমরা হয়ে থাকবে। বাড়াবাড়ি করলে ঘুমের বড়িতে ব্যর্থ চেষ্টা করবে হয়তোবা। তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে তুমি, সময়ের প্রলেপে সয়ে যাবে পুরনো যন্ত্রনা।
মধ্য থেকে আমি, আমার বিধবা অসহায় মা, যাকে আমি ছাড়া দেখার কেউ নেই, দাদা-দিদি সহ একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে ! শুধু শুধু জীবনে জটিলতা ডেকে আনার কোনো মানে হয় না! ভালবাসা আর করুণা এক জিনিস নয়। তুমি আমাকে যেভাবে ভেবেছ, আমি তোমাকে সেভাবে ভাবিনি। নিশ্চয়ই তুমি ভালবাসার নামে আমার কাছ থেকে করুনা আশা করো না এবং আমারও সেটা উচিত হবে না। আমরা পরস্পরের একান্ত আপন না হতে পারি, একে অপরকে যেন ছোট না করি। ভবিষ্যতে দু’দিনের পরিচয়ের বন্ধুত্বকে আমরা যেন শ্রদ্ধার চোখে স্মরণ করতে পারি!
আরো কী কী সব বলেছিলাম সেই সন্ধ্যায়, আজ তা মনে নেই। দেখেছিলাম, তার চোখ বেয়ে নেমে আসা দু’সারি কষ! শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে টোল পড়া মুখে!
এক সময় তন্ময়তা ভেঙে বলি, চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই, অনেক রাত হয়ে গেছে!
এরপর নীপার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না আমার।
কিছুকাল পরে বন্ধুদের মুখে নীপার খবর শুনি। বিয়ে করেছে সে। পরিবারের ঠিক করা ধনী ব্যবসায়ী পাত্রকে উপেক্ষা করে নিজ-পছন্দের মধ্যবিত্ত এক চাকরীজীবি ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছে। নিজেও একটা স্কুলে ঢুকেছে। একটা ফুটফুটে ছোট্ট শিশু এবং ছোট্ট সুখি গৃহকোন!
বড় আপার বাসা সে ছেড়ে দিয়েছিল। হলের বান্ধবীদের সঙ্গে থাকতো। তারপর বিয়ে করে। তাকে আমি বুদ্ধিমান এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে করতাম। আমার সে ধারনা নির্ভূল ছিল।
বেশীরভাগ মানুষ সুখ চিনতে ভুল করে। কোথায় নিজের সুখ সেটা না জেনেই অন্ধের মত মরীচিকার পেছনে ছোটে। নীপা তাদের মধ্যে পড়ে না। সে নিজের সুখ নির্ণয় করতে পেরেছিল এবং সে দিকেই ধাবিত হয়েছিল।
0 মন্তব্যসমূহ