বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় উৎপন্ন ‘ব্যক্তি’র বিশেষ কোনো সমস্যা কী সংকটকে কেন্দ্রবিন্দু করে তাকে তীক্ষ্ণভাবে দেখার জন্য ছোটগল্পের চর্চা হয়ে আসছে আজ দেড়শো বছর ধরে। ‘ছোটগল্প মরে যাচ্ছে...’ এই চরম জবাবটি শুনে মনে হতে পারে, ঐ সমাজ-ব্যবস্থা ও তার হাল মুমূর্ষু অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
যেমন সামন্তব্যবস্থার অবসানের সঙ্গে মহাকাব্যকে বিদায় নিতে হয়েছে। অথচ মানুষের বীরত্ব ও মহত্ব, দয়া ও নিষ্ঠুরতা, করুণা ও হিংস্রতা, ক্ষমা ও ঈর্ষা, ক্রোধ ও ভালবাসা এবং ভোগ ও ত্যাগের সর্বোচ্চ রূপের প্রকাশের মধ্যে সেই সময়ের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে পরম গৌরব দেওয়া হয়েছে মহাকাব্যেই। দিন যায়, অন্য যুগের পাঠকের কাছে মানুষের এই দেবত্ব লোপ পেলেও সে মহত্তর গৌরব নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। মহাকাব্যের গৌরব বাড়ে। কিন্তু অন্যদিনে এসে মানুষকে প্রকাশ করার জন্য এই প্রকরণটিকে শিল্পী আর ব্যবহার করতে পারেন না, নতুন সমাজে মানুষ আর অতিমানব নয়, সে নিছক ব্যক্তিমাত্র। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির উত্থানের সঙ্গে তার প্রকাশের স্বার্থে, বিকাশের তাগিদেও বটে, জন্ম হয় উপন্যাসের। প্রথম দিকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোতে সমাজের নতুন মানুষ ‘ব্যক্তি’কে গৌরব দেওয়ার উদ্যোগ স্পষ্ট, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর কারণেই ব্যক্তিস্বাধীনতা যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পিচ্ছিল পথ ধরে বন্দি হল ব্যক্তিসর্বস্বতার স্যাঁতস্যাঁতে কোটরে তখন এই মাধ্যমটিই তার ক্ষয় ও রোগ শনাক্ত করার দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের ঘাড়ে। আজ রোগ ও ক্ষয়ের শনাক্তকরনের সঙ্গে আরও খানাতল্লাশি চালিয়ে ব্যক্তির মানুষে উন্নীত হওয়ার সুপ্ত শক্তির অন্বেষণে নিয়োজিত হয়েছে উপন্যাসই। আর ছোটগল্প তো তার জন্মলগ্ন থেকেই বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির রোগ ও ক্ষয়কে তীক্ষ্ণভাবে নির্ণয় করে আসছে। এই সমাজব্যবস্থার একটি ফসল হয়েও ছোটগল্প এই ব্যবস্থার শ্রীচরণে তাঁর সিদুরচর্চিত মুণ্ডুখানি কোনোদিনই ঠেকিয়ে রাখেনি যে এর মহাপ্রয়াণ ঘটলে তাকেও সহমরণে যেতে হবে। তা ছাড়া, এই বুর্জোয়া শোষণ ও ছলাকলার আশু-অবসানের কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।
তবে হ্যাঁ, ছোটগল্পের একটা সংকট চলছে বটে। বাংলা ভাষায় বেশকিছু ছোটগল্প লেখা হয়েছে বলেই এই সংকটটি চোখে পড়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, তারপরেও আন্তর্জাতিক মানের গল্প লিখেছেন বেশ কয়েকজন কথাসাহিত্যিক। তাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন। জীবিতদের বেশীরভাগই হয় কলম গুটিয়ে রেখেছেন নয়তো মনোযোগ দিয়েছেন অন্য মাধ্যমে। প্রকাশকের নজরও উপন্যাসের দিকে। গল্পের বই ছাপলে তাদের নাকি লোকসান। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোর বিশেষ সংখ্যা মানে হাফ-ডজন হাফ-ডজন উপন্যাস, ছোটগল্পের পাত্তা সেখানেও নেই। এখন লোকে নাকি গল্প পড়তে চায় না, ঘরে বসে ভিসিআরে গল্প দেখে। কিন্তু তাহলে উপন্যাস বিক্রি হয় কি করে? গড়পড়তা উপন্যাস আর গড়পড়তা ভিসিআরের মধ্যে তফাতটা কোথায়? জনপ্রিয় উপন্যাস হলেই সেটাকে তরল বলে উড়িয়ে দেওয়ার মানে হয়না, লেখকের উদ্দেশ্য বা মতলব যা-ই থাক, নিজের সমস্যাকে কোনো-না-কোনোভাবে শনাক্ত হতে না-দেখলে পাঠক একটি বইয়ের অনুরাগী হবে কেন? আর শিল্পমানে উন্নত উপন্যাস পৃথিবী জুড়ে যত লেখা হচ্ছে ঐ মাপের ছোটগল্পের পরিমান সে-তুলনায় নগণ্য। ছোটগল্পের প্রকাশ কিন্তু আগেও খুব একটা ছিলনা, উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের পাঠক বরাবরই কম। তবু আগে ছোটগল্প লেখা হয়েছে এখন অনেক কম হচ্ছে। মনে হয় এই সংকটের কারণটা খুজতে হবে ছোটগল্পের ভেতরেই।
কোনো একটি সমস্যাকে কেন্দ্রবিন্দু করে একরৈখিক আলোর মধ্যে তাকে যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করার শর্তটি পালন করা সৃজনশীল লেখকের দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। একটি মানুষকে একটিমাত্র অনুভূতি বা সমস্যা দিয়ে চিহ্নিত করা এখন অসম্ভব। লেখকের কলম থেকে বেরুতে-না-বেরুতে এখনকার চরিত্র বেয়াড়া হয়ে যায়, একটি সমস্যার গয়না তাকে পরিয়ে দেওয়ার জন্য লেখক হাত তুললে সে তা ছুঁড়ে দিয়ে গায়ে তুলে নেয় হাজার সংকটের কাঁটা। লেখকের গলা শুকিয়ে আসে, একটি সমস্যার কথা তুলে ধরার জন্য। এত সংকটের ব্যাখ্যা করার সুযোগ এখানে কোথায়? অর্জুনের মত নজরে পরা চাই পাখির মাথাটুকু, লক্ষ ভেদ করতে হবে সরাসরি, আশপাশে তাকালে তীর ঐ বিন্দুটিতে পৌঁছবে কী করে? লেখক তখন থেমে পড়েন, গলার সঙ্গে শুকোয় তার কলম। কারণ, ছোটগল্পের শাসন তিনি যতই মানুন, এটাওতো তিনি জানেন যে তার চরিত্রটির উৎস যে-সমাজ তা একটি সচল ব্যবস্থা, সেখানে ভাংচুর চলছে এবং তার রদবদল ঘটছে অবিশ্বাস্য রকম তীব্রগতিতে। পরিবর্তনের লক্ষ হল শোষণপ্রক্রিয়াকে আরো শক্ত ও স্থায়ী করা। এর প্রধান হাতিয়ার হল রাষ্ট্র, রাষ্ট্র ক্রমেই স্ফীতকায় হচ্ছে। মানুষের ন্যুনতম কল্যানের পক্ষে পদক্ষেপ না-নিলেও রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে চলেছে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সুস্পষ্ট কোনো কৃষিনীতি সে নেবে না, কিন্তু সারের দাম বাড়িয়ে চাষির মাথায় বাড়ি মারবে নির্দ্বিধায়; পাটের দামের ওপর নিয়ন্ত্রন শিথিল করে চাষিকে সে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। বন্যার পর, দুর্ভিক্ষের সময় জমি থেকে উৎখাত হয়ে নিরন্ন গ্রামবাসী বিচ্যুত হয় নিজের পেশা থেকে, কিন্তু নতুন পেশা খুঁজে নিতে রাষ্ট্র তাকে সাহায্য করবেনা। ব্যক্তিস্বাধীনতার ডংকা বাজিয়ে যে ব্যবস্থার উদ্ভব, সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলেও কি কিছু অবশিষ্ট আছে? দম্পতির শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে রাষ্ট্র হুকুম ছাড়ে, ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানের বেশি যেনো পয়দা কোরো না। কিন্তু ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্যের দায়িত্ব নিতে তার প্রবল অনীহা। গনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনের মচ্ছব চলে, সেখানে ব্যবস্থা এমনই মজবুত যে কোটিপতি ছাড়া কারও ক্ষমতা নেই যে নির্বাচিত হয়। দফায়-দফায় গণআন্দোলনে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী প্রাণ দেয়, রাষ্ট্রের মালিক পালটায়, ফায়দা লোটে কোটিপতিরা। রাষ্ট্রের মাহাত্ম্যপ্রচারের জন্য গ্রামে পর্যন্ত টেলিভিশন পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে চাষাভুষারা বসে বসে টেলিভিশনের পর্দায় আমেরিকানদের সাম্প্রতিক জীবনযাপন দেখে, সেখানে মেয়েপুরুষ সব তীব্রগতিতে গাড়ি চালায়, রকেট ছোড়ে, তাদের একটি প্রধান চরিত্রের নাম কম্পিউটার, তার কীর্তিকলাপও বিস্তারিত দেখা যায়। বাড়ি ফিরে ঐ চাষি পায়খানা করে ডোবার ধারে, ঐ ডোবার পানি সে খায় অঞ্জলি ভরে, টেলিভিশনে মস্ত করিডোরওয়ালা হাসপাতাল দেখে মুগ্ধ চাষি বৌছেলেমেয়ের অসুখ হলে হাঁস-মুরগি বেচে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স পর্যন্ত পৌঁছে শোনে যে ডাক্তার সাহেব কাল ঢাকা গেছে, ডাক্তার সাহেব থাকলে শোনে যে এখানে ওষুধ নেই। তখন তার গতি পানি-পরা-দেওয়া ইমাম সাহেব। রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার গ্রাম এই-ই ছিল, তার আগে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশের কৃষকের যে-বিবরণ লিখে গেছেন, তাতে এই একই পরিচয় পাই। পরে শরৎচন্দ্র কৃষকের ছবি আঁকেন, তাতেও তেমন হেরফের কই? তারাশংকর, মানিক বন্দোপাধয়, এমনকি সেদিনের সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যে-চাষিকে দেখেছিলেন সেও এদেরই আত্মীয়। কিন্তু একটা বড় তফাত রয়েছে। যন্ত্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল রেলগাড়ি আর টেলিগ্রাফের তার দেখা পর্যন্ত, বড়জোর রেলগাড়িতে চড়ার ভাগ্য কারও কারও হয়ে থাকবে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটেছে আরও পরে। বাংলাদেশের নিভৃত গ্রামের বিত্তহীন চাষি বিবিসি শোনে, টেলিভিশন দেখে, জমিতে শ্যালো মেশিনের প্রয়োগ সম্বন্ধেও সব জানে। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার তার জীবনে আর সম্ভব হয়না। টেলিভিশনের ছবি তার কাছে রূপকথার বেশি কিছু নয়। রূপকথা এবং অল্পক্ষণের জন্য হলেও তার কল্পনাকে রঙিন করতে পারত, একটা গল্প দেখার সুখ সে পেত। গান আর গাথার মত রূপকথা শোনাও তার সংস্কৃতিচর্চার অংশ। পক্ষিরাজ তো কল্পনার ঘোড়া, এর ওপর সেও যেমন চড়তে পারেনা, গ্রামের জোতদার মাহাজনও তাকে নাগালের ভেতর পাবে না। কিন্তু টেলিভিশনে-দেখা-জীবন তো কেউ কেউ ঠিকই ভোগ করে। ঢাকা শহরের কেউ-কেউ এর ভাগ পায় বইকী। তাদের মধ্যে তার চেনাজানা মানুষও আছে। এই দুই দশকে শ্রেণীর মেরুকরণ এত হয়েছে যে গ্রামের জোতদারের কী সচ্ছল কৃষকের বেপরোয়া ছেলেটি ঢাকায় গিয়ে কী করে কী করে অনেক টাকার মালিক হয়ে বসেছে, সে নাকি এবেলা ওবেলা সিঙ্গাপুর-হংকং করে। চাষিরা নিজেদের কাছে তাই আরও ছোট হয়ে গেছে। তবে কি ঐ জীবনযাপন করতে তার আগ্রহ হয়না? না, হয় না। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্পৃহাকে সংকল্পে রূপ দিতে পারে যে-রাজনীতি তার অভাব আজ বড় প্রকট। রাজনীতি আজ ছিনতাই করে নিয়েছে কোটিপতির দল। এদের পিছে পিছে ঘোরাই এখন নিম্নবিত্ত মানুষের প্রধান রাজনৈতিক তৎপরতা। এখনকার প্রধান দাবি হল রিলিফ চাই।। এনজিওতে দেশ ছেয়ে গেল, নিরন্ন মানুষের প্রতি তাদের উপদেশঃ তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াও। কী করে?-না, মুরগি পোষো, ঝুড়ি বানাও, কাঁথা সেলাই করো। ভাইসব, তোমাদের সম্পদ নেই, সম্বল নেই, মুরগি পুষে, ডিম বেচে, ঝুড়ি বেচে তোমরা স্বাবলম্বী হও। কারন, সম্পদ যারা হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে তা তাদের দখলেই থাকবে, ওদিকে চোখ দিও না। রাষ্ট্রক্ষমতা লুটেরা কোটিপতিদের হাতে, তাদের হাতেই ওটা নিরাপদ থাকবে, ওদিকে হাত দিতে চেষ্টা কোরো না। তাদের মানুষ হয়ে বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা, অধিকার আদায়ের স্পৃহা এবং অন্যায় সমাজব্যবস্থা উৎখাত করার সংকল্প চিরকালের জন্য বিনাশ করার আয়োজন চলছে। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী তাই ছোট থেকে আরও ছোট হয়, এই মানুষটির সংস্কৃতির বিকাশ তো দূরের কথা, তার আগের অনেক অভ্যাস পর্যন্ত লুপ্ত হয়। কিন্তু নতুন সংস্কৃতির স্পন্দন সে কোথাও অনুভব করে না।
এখন এই লোকটিকে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কি ‘ছোট প্রান ছোট কথা’র আদর্শ দিয়ে কাজ হবে? তার একটা সমস্যা ধরতে গেলেই তো হাজারটা বিষয় এসে পড়ে, কোনোটা থেকে আরগুলো আলাদা নয়। একজন চাষির প্রেম করা কী বউকে তালাক দেওয়া, তার জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কী ভুমিহীনে পরিণত হওয়া তার ছেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের দিকে রওয়ানা হওয়া এবং সেখান থেকে সৌদি আরব যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় টাউটের পাল্লায় পড়া, তরুন চাষির প্রেমিকার মুখে এসিড ছুড়ে মারা- এসবের সঙ্গে সারের ওপর ভরতুকি তুলে নেওয়া কিংবা জাতীয় পরিষদের ইলেকশনে তিন কোটিপতির ইলেকশন ক্যাম্পেনে টাকার খেল দেখানো কিংবা এনজিওর কার্যক্রমের সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকা এমনকিছু বিচিত্র নয়। ছোটগল্প লিখতে গিয়ে কোন ব্যাপারটা আনব আর কোনটা আনব না, সমস্যাকে তুলে ধরতে গেলে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি, ছোটগল্পের সীমারেখা কোথায়-এসব প্রশ্ন কি ছোটগল্প লেখাকে জটিল করে তুলছে না?
মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কী উচ্চমধ্যবিত্তের চরিত্র অনুসরন করা কঠিন। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত আর বাপ-দাদার শ্রেনীতে পড়ে থাকতে চায় না, সবারই টার্গেট বড়লোক হওয়া। যে যে-পেশায় থাকুক-না, ওর মধ্যেই পয়সা বানাবার ফন্দিফিকির বার করার তালে থাকে। এখন মধ্যবিত্তের সংস্কার বলি, মূল্যবোধ বলি কিংবা মূল্যবোধ বলে চালানো সংস্কার, অথবা অভ্যাস, রেওয়াজ, আদবকায়দা, বেয়াদবি বেতমিজি- এগুলো মোটামুটি সবারই কমবেশি জানা। খারাপ লেখকও জানেন ভালো লেখকও জানেন। কিন্তু যে-লোকটি মানুষ হয়েছে নিম্নবিত্তের ঘরে, কী মধ্যবিত্তের সংস্কার যার রক্তে, সে যখন শয়নে স্বপনে পশ লিভিংয়ের ধান্দায় থাকে তখন সে বড় দুর্বোধ্য মানুষে পরিণত হয়। আবার চুরিচামারি করে, ঘুষ খেয়ে অজস্র মানুষের গলায় লালফিতার ফাঁস পরিয়ে, স্টেনগান, মেশিনগান বা বাখোয়াজির দাপটে, এমনকি বিদ্যা বেচেও কয়েক বছরে যারা উচ্চবিত্তের প্রাসাদে প্রবেশ করেছে এবং তারপর সারাজীবনের অভ্যাস, সংস্কার, রেওয়াজ, প্রথা সব পালটে ‘উইথ রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্ট’ বুর্জোয়া হওয়ার সাধনায় ব্যস্ত বরং বলি ব্যতিব্যস্ত, ছোটগল্পে তাদের যথাযথ শনাক্ত করা কি কম কঠিন কাজ! ভণ্ডামি মধ্যবিত্তের স্বভাবের অংশ বহু আগে থেকেই। কিন্তু ভণ্ডামির ভেতরেও যে সামঞ্জস্য থাকে, এখন তাও খুঁজে পাওয়া ভার। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহাচ্যাম্পিয়ন, বাংলার ‘ব’ বলতে প্রাণ আনচান করে ওঠে, চোখের জলে বুক ভাসায় এমন অনেকের ছেলেমেয়ে জন্ম থেকে থাকে বাইরে, বাংলা ভাষা বলতেও পারে না। রাজনীতি থেকে সর্বক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ্র বুলি হাঁকায় এমন অনেক সাচ্চা মুসলমানের মক্কা হল আমেরিকা, ছেলেমেয়েদের আমেরিকা পাঠিয়ে তাদের গ্রীন কার্ড, ব্লু কার্ড না রেড কার্ড করার রঙিন খোয়াবে তারা বিভোর। আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা যে-জীবনযাপন করে তা কি কোনোদিক থেকে ইসলামি? পিরসাহেবের হুজরায় গিয়ে আল্লাহর করুণা পাবার জন্য কেঁদে জারজার হয়ে হুজুরপাকের তবারক নিয়ে সেই বিরিয়ানি খায় হুইস্কি সহযোগে এবং নগদ টাকার সঙ্গে সেই পবিত্র হুইস্কি নিবেদন করে আমলাদের সেবায় টেন্ডার পাবার উদ্দেশ্যে- এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত কোন আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত?
শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত প্রযুক্তির সুযোগ যা পাচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর তুলনায় তা অনেক ক্ষেত্রেই কম নয়। প্রযুক্তি আসছে, কিন্তু বিজ্ঞান চর্চার বালাই নেই। জীবনে বিজ্ঞান পড়েনি এমন সব বিদ্যাদিগগজরা টেলিভিশনে ডারউইনের তত্ব নিয়ে বিরূপ ঠাট্রা করার স্পর্ধা দেখায়। এমন কি বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়া পন্ডিতেরা সরকারি মাধ্যমগুলোতে প্রচার করে যে, বিজ্ঞানীদের যাবতীয় কথা পবিত্র ধর্মগ্রন্থেই নিহিত রয়েছে, বিজ্ঞানীদের কর্ম সব ঐসব বই থেকে চুরি করে সম্পন্ন করা হয়। পাকিস্তানের নরখাদক সেনাবাহিনীর গোলামরা গাড়ি হাঁকিয়ে দেশের এ-রাত ও-রাত ঘোরে, ফ্রিজের কোকাকোলায় চুমুক দিতে দিতে মাইকে ঘেউ ঘেউ করে, সাম্যবাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল শয়তানের কারসাজি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান্মনস্কতার প্রসার ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। টেলিভিশন আর ভিসিআরের কল্যাণে এখন ঘরে ঘরে আমেরিকা। কিন্তু কাজের প্রতি ওদের মনোযোগ ও দায়িত্ববোধ কি আমাদের ভদ্রলোকদের কিছুমাত্র প্রভাবিত করেছে? রাস্তায় কেউ কি ট্রাফিক আইন মানে? বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহ বাড়ে? স্বাস্থসম্মত জীবনযাপনে উৎসাহী হয়? যা এসেছে তা হল আগ্নেয় অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করা। বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফল ভয়াবহ, এর ফল হল নিদারূন সাংস্কৃতিক শূন্যতা এবং অপসংস্কৃতির প্রসার। কোন সাংস্কৃতিক পরিবেশে তরুণদের এই ধারনা বদ্ধমুল হয় যে, এই দেশ বসবাসের অযোগ্য? কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাষ্ট্র দখলের যুদ্ধে যারা নামে তারা কি এইসব তরুণদের হতাশা মোচন করার কোনো কর্মসূচি নেয়? গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যে কোটি কোটি টাকা অপচয় করা যায়, কিন্তু টাকার অভাবে বিপুল সংখ্যক সরকারি পদ বছরের পর বছর শূন্য পড়ে থাকে। রাষ্ট্রেরই-বা ক্ষমতা কতটা? রাষ্ট্রেরও বাপ আছে, রাষ্ট্র কি ইচ্ছা করলেই মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারে? তার বাপ কি তাকে সুবিধামতো কলকারখানা তৈরি করতে দেবে? সারের ওপর ভরতুকি কি সে ইচ্ছা করলেই অব্যাহত রাখতে পারে? কর্মীদের বেতন নির্ধারন করতে পারে? রাষ্ট্রের কোমরে বাঁধা দড়ির প্রান্তটি যে-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে তাকে লক্ষ করাওতো ছোটগল্প লেখকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশি যুদ্ধে প্রাণ দেয় ইউনিভার্সিটির ছেলে, ইউনিভা্সিটিতে তালা ঝোলে আর গ্রামে পাটের দাম না পেয়ে পাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বৃদ্ধ চাষি। সেই রিক্ত চাষির গালে কার হাতের থাপ্পড়ের দাগ? কার হাত? মায়ের গয়না বেচে যে তরুণ পাড়ি দিয়েছে জার্মানি কি আমেরিকায় সে তো আর ফেরে না তার মায়ের নিঃসঙ্গতাকে কি শুধু মায়ের ভালবাসা বলে গৌরব দেওয়ার জন্য গদগদচিত্তে লেখক ছোটগল্প লিখবে? কর্মসংস্থান করতে না-পেরে যে-যুবক দিনদিন অস্থির হয়ে উঠছে, নিজের গ্লানিবোধকে চাপা দিতে হয়ে উঠছে বেপরোয়া, অসহিষ্ণু এবং বেয়াদব, আর ছিনতাইকারী হয়ে ওঠা, কিছুদিনের মধ্যে এই পেশায় তার সহকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া, একটির পর একটি গোষ্ঠী পালটানো এবং এ থেকে সবাইকে অবিশ্বাস করার প্রবণতার ভয়াবহ শিকারে পরিণত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে অনুভূতিহীন, স্পৃহাবঞ্চিত নিম্নস্তরের প্রাণী হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা- এই লোকটিকে পরিচিত করানো তো বটেই, এমনকি শুধু উপস্থাপন করতেও কত বিচিত্র বিষয়কেই-না মনে রাখতে হয়। বলা যায় যে, এসবের উৎস হল অভাব, অভাব তো আমাদের পুরোনো সঙ্গী। কিন্তু তা কি আগে কখনোই এরকম ব্যাপক, গভীর এবং সর্বোপরি জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর আবর্তিত হয়েছে? আমাদের অভাব এখন পুঁজিবাদী ব্যক্তির সম্পদ। আমাদের অভাবমোচনের মহান দায়িত্বপালনের এরকম সুযোগ আগে কোনোদিন তারা পায়নি। এই উদ্দেশ্যে তারা এখন অবাধে যেখানে সেখানে ঢোকে, তারাই আমাদের প্রভু, তাদের নিপুণ কার্যক্রমে তাদের প্রভুত্ব মেনে নিতে সব দ্বিধাদ্বন্দ্বই আমরা ঝেড়ে ফেলেছি। তাদের দরাজ হাতে আমাদের দায়ভার তুলে দিতে আমরা উদগ্রীব। ফলে অভাবমোচনের জন্য মানুষের সমবেত স্পৃহাকে বিনাশ করার আয়োজনে তারা অনেকটাই সফল। অভাব হয়ে ওঠে মানুষের কাছে নিয়তি। সমাধানের স্পৃহা না-থাকলে সমস্যাকে সমস্যা বলে বিবেচনা করা যায় না। নিরাময় করতে চাই বলেই রোগকে রোগ বলি, নইলে সর্দি থেকে শুরু করে ক্যান্সার এইডস পর্যন্ত যাবতীয় ব্যাধিকে দাড়িগোঁফ গজানো আর চুল পাকা আর দাঁত পরার মতো শারীরিক নিয়ম বলে মেনে নিতাম। সমস্যা-উত্তরনের সঙ্কল্পের জায়গায় এখন সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতাই প্রধান। এর ওপর চলছে সমাজতন্ত্রকে হেয়প্রতিপন্ন করার সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, যা কিনা অভাব থেকে মুক্তির স্পৃহাকে দমন করা এবং মানুষ হয়ে বাঁচবার সংকল্পকে মুচড়ে দেওয়ার চক্রান্তের একটি অংশ। মানুষের শাসিত স্পৃহা ও দমিত সংকল্পকে আবর্জনার ভেতর থেকে খুঁজে বার করে আনার দায়িত্বও বর্তায় কথাসাহিত্যিকের ঘাড়ে।
সমাজের প্রবল ভাংচুর, সমাজব্যবস্থায় নতুন নতুন শক্তি ও উপাদানের সংযোগ প্রভৃতির ফলে মানুষের গভীর ভেতরের রদবদল ও অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত ছোটগল্পের শরীরেও পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। উপন্যাসে এই পরিবর্তনটি আসছে লেখকের প্রয়োজোনেই। কাহিনী ফাঁদা আর চরিত্র উপস্থাপন এখন উপন্যাসের জন্য যথেষ্ট নয়, কেবল ধারাবাহিকতা রক্ষা করলেই গল্পের সমস্ত দায়িত্ব পালন করা হয় বলে এখন আর কেউ মনে করে না। গল্প ভেঙ্গে উপন্যাসের মধ্যে আরেকটি গল্প তৈরী হচ্ছে, আবার একই গল্প লেখকের কয়েকটি ছোটগল্পে আসছে নানামাত্রায়, নানা ভঙ্গিতে। একই চরিত্র একই নামে বা ভিন্ন নামে লেখকের কয়েকটি ছোটগল্পে আসতে পারে, তাতেও না-কুলালে এ-চরিত্র আসন করে নিচ্ছে লেখকের উপন্যাসে। ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’ বলে এখন কিছু আছে কি? ‘ছোট দুঃখ’ কোনটি? প্রতিটি ছোট দুঃখের ভেতর চোখ দিলে দেখা যায় তার মস্ত প্রেক্ষাপট, তার জটিল চেহারা এবং তার কুটিল উৎস। ছোটগল্পের হৃৎপিণ্ডে যে-প্রবল ধাক্কা আসছে তা থেকে তার শরীর কি রেহাই পাবে?
ব্যক্তির একটি আপাত-সামান্য ও আপাত-ছোট সংকটকে পাঠকের সামনে পেশ করতে হাজির করতে হচ্ছে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক একটি সাহায্যসংস্থার রিপোর্টের অংশ। খবরের কাগজের ভাষা এমনকি একটি কাটিং নিহত সন্তানের মায়ের উদ্বিগ্ন শোকের প্রেক্ষাপট বোঝাতে সাহায্য করতে পারে। গার্মেন্টসে নিয়োজিত তরুণীর গ্লানিবোধ নিয়ে আসার লক্ষে লেখক বিজ্ঞাপনের একটি লাইন তুলে দিতে পারেন। খরায় ধুকতে থাকা একটি চাষের জমিকে প্রধান চরিত্র করে প্রকাশিত হতে পারে শুধু সেখানকার সমাজ নয়, শহরের একটি বেয়াদব মাস্তানের অসহায় অবস্থা। সরকারি প্রজ্ঞাপনের আকারে উপস্থাপন করা যায় মুষ্টিমেয় বিত্তবানের সম্পদ কুক্ষিগত করার লালসাকে। কোথাও খুব পরিচিত কবিতার একটি পঙক্তি এমন বেঁকেচুরে এসে পড়ে যে মূল কবিতাকে আর চেনা যায় না, এই বিকৃত কবিতার লাইন হাতকাটা কোনো শ্রমিকের পায়ে ঝিঝি ধরাকে যথাযথ প্রেক্ষিতে তুলে ধরার জন্য হয়তো বিশেষভাবে দরকারি। একটা শ্যালোমেশিনের কলকব্জার মিস্ত্রি সুলভ বর্ণনায় উন্মোচিত হয় একটা গোটা এলাকার মানুষের হতাশ হৃদয়। একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ কী বুদ্ধিজীবীর কোনো পরিচিত কর্মকাণ্ডের বিশ্বস্ত বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে তার স্বভাবের গভীর ভেতরকার কোনো বৈশিষ্ট্য বোঝাতে লেখক তাঁকে করতে পারেন ফ্যান্টাসির চরিত্র, এতেও একই সঙ্গে প্রকাশিত হতে পারে নামহীন গোত্রহীন হাজার মানুষের বিশেষ কোনো সংকট।
ছোটগল্পের এই পরিবর্তন যে ঘটছে না তা নয়; কিন্তু তা তেমন চোখে পড়ে না। তার প্রধান কারণ এই যে, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ভূমিকা এই ব্যাপারে গৌণ। তাদের মধ্যে সৎ ও ক্ষমতাবানেরা কিছুদিন আগে সামাজিক ধসের ভেতর থেকে হাড্ডিমাংস জোড়া দিয়ে মানুষকে উপস্থিত করেছিলেন পাঠকের সামনে, সাম্প্রতিক সময়কে উন্মোচন করার স্বার্থেই যে এই মাধ্যমটিকে গড়েপিটে নেওয়া দরকার তা নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে বোঝেন তাঁরা। তাহলে তাঁরা গল্প লেখেন না কেন? খ্যাতি লেখককে প্রেরনা হয়তো খানিকটা দেয়, তবে খ্যাতি তাঁকে আরও বেশি সতর্ক করে রাখে খ্যাতি নিরাপদ রাখার কাজে । নিজের ব্যবহৃত, পরিচিত ও পরীক্ষিত রীতিটি তার বড় পোষমানা, এর বাইরে যেতে তার বাধো বাধো ঠেকে। কিংবা নিজের রেওয়াজ ভাঙতে তাঁর মায়া হয়। তাই ছোটগল্পের জন্য ভরসা করতে হয় লিটল ম্যাগাজিনের ওপর। প্রচলিত রীতির বাইরে লেখেন বলেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের দরকার হয় নিজেদের পত্রিকা বার করার। বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় ছোটগল্পের ছিমছাম তনুখানি অনুপস্থিত, সাম্প্রতিক মানুষকে তুলে ধরার তাগিদে নিটোল গপ্পো ঝেড়ে তাঁরা তৈরী করছেন নানা সংকটের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত ছোটগল্পের খরখরে নতুন শরীর। এইসব লেখকদের অনেকেই অল্পদিনে ঝরে পড়বেন, সমালোচকদের প্রশংসা পাবার লোভ অনেকেই সামলাতে না-পেরে চলতে শুরু করবেন ছোটগল্পের সনাতন পথে। হাতে গোনা যায় এমন কয়েকজনও যদি মানুষের এখনকার প্রবল ধাক্কা খাওয়াকে উপযুক্ত শরীরে উপস্থাপনের দায়িত্বপালন অব্যাহত রাখেন তো তাতেও ছোটগল্পের মুমূর্ষু শরীরে প্রাণসঞ্চার সম্ভব। এঁরা তো বটেই, এমনকী যারা ঝরে পড়বেন বা সমালোচকদের পিঠ-চাপড়ানোর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, তাদের অল্পদিনের তৎপরতাও ভবিষ্যৎ লেখকদের যেমন অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি বিরল সততাসম্পন্ন মুষ্টিমেয় অগ্রজ লেখকও এঁদের কাজ দেখে পা ঝেড়ে উঠতে পারেন।
..............................
লেখক পরিচিতি
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। তাঁর বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ছিলেন। মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। আখতারুজ্জামান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন (১৯৬৪)। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিস, জন্ডিস-সহ নানাবিধ রোগে। ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কম্যুনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ- অন্যঘরে অন্যস্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উৎপাত, দোজখের ওম, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, গল্প সংগ্রহ। উপন্যাস- চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা।
যেমন সামন্তব্যবস্থার অবসানের সঙ্গে মহাকাব্যকে বিদায় নিতে হয়েছে। অথচ মানুষের বীরত্ব ও মহত্ব, দয়া ও নিষ্ঠুরতা, করুণা ও হিংস্রতা, ক্ষমা ও ঈর্ষা, ক্রোধ ও ভালবাসা এবং ভোগ ও ত্যাগের সর্বোচ্চ রূপের প্রকাশের মধ্যে সেই সময়ের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে পরম গৌরব দেওয়া হয়েছে মহাকাব্যেই। দিন যায়, অন্য যুগের পাঠকের কাছে মানুষের এই দেবত্ব লোপ পেলেও সে মহত্তর গৌরব নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। মহাকাব্যের গৌরব বাড়ে। কিন্তু অন্যদিনে এসে মানুষকে প্রকাশ করার জন্য এই প্রকরণটিকে শিল্পী আর ব্যবহার করতে পারেন না, নতুন সমাজে মানুষ আর অতিমানব নয়, সে নিছক ব্যক্তিমাত্র। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির উত্থানের সঙ্গে তার প্রকাশের স্বার্থে, বিকাশের তাগিদেও বটে, জন্ম হয় উপন্যাসের। প্রথম দিকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোতে সমাজের নতুন মানুষ ‘ব্যক্তি’কে গৌরব দেওয়ার উদ্যোগ স্পষ্ট, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর কারণেই ব্যক্তিস্বাধীনতা যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পিচ্ছিল পথ ধরে বন্দি হল ব্যক্তিসর্বস্বতার স্যাঁতস্যাঁতে কোটরে তখন এই মাধ্যমটিই তার ক্ষয় ও রোগ শনাক্ত করার দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের ঘাড়ে। আজ রোগ ও ক্ষয়ের শনাক্তকরনের সঙ্গে আরও খানাতল্লাশি চালিয়ে ব্যক্তির মানুষে উন্নীত হওয়ার সুপ্ত শক্তির অন্বেষণে নিয়োজিত হয়েছে উপন্যাসই। আর ছোটগল্প তো তার জন্মলগ্ন থেকেই বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির রোগ ও ক্ষয়কে তীক্ষ্ণভাবে নির্ণয় করে আসছে। এই সমাজব্যবস্থার একটি ফসল হয়েও ছোটগল্প এই ব্যবস্থার শ্রীচরণে তাঁর সিদুরচর্চিত মুণ্ডুখানি কোনোদিনই ঠেকিয়ে রাখেনি যে এর মহাপ্রয়াণ ঘটলে তাকেও সহমরণে যেতে হবে। তা ছাড়া, এই বুর্জোয়া শোষণ ও ছলাকলার আশু-অবসানের কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।
তবে হ্যাঁ, ছোটগল্পের একটা সংকট চলছে বটে। বাংলা ভাষায় বেশকিছু ছোটগল্প লেখা হয়েছে বলেই এই সংকটটি চোখে পড়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, তারপরেও আন্তর্জাতিক মানের গল্প লিখেছেন বেশ কয়েকজন কথাসাহিত্যিক। তাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন। জীবিতদের বেশীরভাগই হয় কলম গুটিয়ে রেখেছেন নয়তো মনোযোগ দিয়েছেন অন্য মাধ্যমে। প্রকাশকের নজরও উপন্যাসের দিকে। গল্পের বই ছাপলে তাদের নাকি লোকসান। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোর বিশেষ সংখ্যা মানে হাফ-ডজন হাফ-ডজন উপন্যাস, ছোটগল্পের পাত্তা সেখানেও নেই। এখন লোকে নাকি গল্প পড়তে চায় না, ঘরে বসে ভিসিআরে গল্প দেখে। কিন্তু তাহলে উপন্যাস বিক্রি হয় কি করে? গড়পড়তা উপন্যাস আর গড়পড়তা ভিসিআরের মধ্যে তফাতটা কোথায়? জনপ্রিয় উপন্যাস হলেই সেটাকে তরল বলে উড়িয়ে দেওয়ার মানে হয়না, লেখকের উদ্দেশ্য বা মতলব যা-ই থাক, নিজের সমস্যাকে কোনো-না-কোনোভাবে শনাক্ত হতে না-দেখলে পাঠক একটি বইয়ের অনুরাগী হবে কেন? আর শিল্পমানে উন্নত উপন্যাস পৃথিবী জুড়ে যত লেখা হচ্ছে ঐ মাপের ছোটগল্পের পরিমান সে-তুলনায় নগণ্য। ছোটগল্পের প্রকাশ কিন্তু আগেও খুব একটা ছিলনা, উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের পাঠক বরাবরই কম। তবু আগে ছোটগল্প লেখা হয়েছে এখন অনেক কম হচ্ছে। মনে হয় এই সংকটের কারণটা খুজতে হবে ছোটগল্পের ভেতরেই।
কোনো একটি সমস্যাকে কেন্দ্রবিন্দু করে একরৈখিক আলোর মধ্যে তাকে যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করার শর্তটি পালন করা সৃজনশীল লেখকের দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। একটি মানুষকে একটিমাত্র অনুভূতি বা সমস্যা দিয়ে চিহ্নিত করা এখন অসম্ভব। লেখকের কলম থেকে বেরুতে-না-বেরুতে এখনকার চরিত্র বেয়াড়া হয়ে যায়, একটি সমস্যার গয়না তাকে পরিয়ে দেওয়ার জন্য লেখক হাত তুললে সে তা ছুঁড়ে দিয়ে গায়ে তুলে নেয় হাজার সংকটের কাঁটা। লেখকের গলা শুকিয়ে আসে, একটি সমস্যার কথা তুলে ধরার জন্য। এত সংকটের ব্যাখ্যা করার সুযোগ এখানে কোথায়? অর্জুনের মত নজরে পরা চাই পাখির মাথাটুকু, লক্ষ ভেদ করতে হবে সরাসরি, আশপাশে তাকালে তীর ঐ বিন্দুটিতে পৌঁছবে কী করে? লেখক তখন থেমে পড়েন, গলার সঙ্গে শুকোয় তার কলম। কারণ, ছোটগল্পের শাসন তিনি যতই মানুন, এটাওতো তিনি জানেন যে তার চরিত্রটির উৎস যে-সমাজ তা একটি সচল ব্যবস্থা, সেখানে ভাংচুর চলছে এবং তার রদবদল ঘটছে অবিশ্বাস্য রকম তীব্রগতিতে। পরিবর্তনের লক্ষ হল শোষণপ্রক্রিয়াকে আরো শক্ত ও স্থায়ী করা। এর প্রধান হাতিয়ার হল রাষ্ট্র, রাষ্ট্র ক্রমেই স্ফীতকায় হচ্ছে। মানুষের ন্যুনতম কল্যানের পক্ষে পদক্ষেপ না-নিলেও রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে চলেছে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সুস্পষ্ট কোনো কৃষিনীতি সে নেবে না, কিন্তু সারের দাম বাড়িয়ে চাষির মাথায় বাড়ি মারবে নির্দ্বিধায়; পাটের দামের ওপর নিয়ন্ত্রন শিথিল করে চাষিকে সে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। বন্যার পর, দুর্ভিক্ষের সময় জমি থেকে উৎখাত হয়ে নিরন্ন গ্রামবাসী বিচ্যুত হয় নিজের পেশা থেকে, কিন্তু নতুন পেশা খুঁজে নিতে রাষ্ট্র তাকে সাহায্য করবেনা। ব্যক্তিস্বাধীনতার ডংকা বাজিয়ে যে ব্যবস্থার উদ্ভব, সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলেও কি কিছু অবশিষ্ট আছে? দম্পতির শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে রাষ্ট্র হুকুম ছাড়ে, ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানের বেশি যেনো পয়দা কোরো না। কিন্তু ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্যের দায়িত্ব নিতে তার প্রবল অনীহা। গনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনের মচ্ছব চলে, সেখানে ব্যবস্থা এমনই মজবুত যে কোটিপতি ছাড়া কারও ক্ষমতা নেই যে নির্বাচিত হয়। দফায়-দফায় গণআন্দোলনে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী প্রাণ দেয়, রাষ্ট্রের মালিক পালটায়, ফায়দা লোটে কোটিপতিরা। রাষ্ট্রের মাহাত্ম্যপ্রচারের জন্য গ্রামে পর্যন্ত টেলিভিশন পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে চাষাভুষারা বসে বসে টেলিভিশনের পর্দায় আমেরিকানদের সাম্প্রতিক জীবনযাপন দেখে, সেখানে মেয়েপুরুষ সব তীব্রগতিতে গাড়ি চালায়, রকেট ছোড়ে, তাদের একটি প্রধান চরিত্রের নাম কম্পিউটার, তার কীর্তিকলাপও বিস্তারিত দেখা যায়। বাড়ি ফিরে ঐ চাষি পায়খানা করে ডোবার ধারে, ঐ ডোবার পানি সে খায় অঞ্জলি ভরে, টেলিভিশনে মস্ত করিডোরওয়ালা হাসপাতাল দেখে মুগ্ধ চাষি বৌছেলেমেয়ের অসুখ হলে হাঁস-মুরগি বেচে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স পর্যন্ত পৌঁছে শোনে যে ডাক্তার সাহেব কাল ঢাকা গেছে, ডাক্তার সাহেব থাকলে শোনে যে এখানে ওষুধ নেই। তখন তার গতি পানি-পরা-দেওয়া ইমাম সাহেব। রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার গ্রাম এই-ই ছিল, তার আগে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশের কৃষকের যে-বিবরণ লিখে গেছেন, তাতে এই একই পরিচয় পাই। পরে শরৎচন্দ্র কৃষকের ছবি আঁকেন, তাতেও তেমন হেরফের কই? তারাশংকর, মানিক বন্দোপাধয়, এমনকি সেদিনের সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যে-চাষিকে দেখেছিলেন সেও এদেরই আত্মীয়। কিন্তু একটা বড় তফাত রয়েছে। যন্ত্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল রেলগাড়ি আর টেলিগ্রাফের তার দেখা পর্যন্ত, বড়জোর রেলগাড়িতে চড়ার ভাগ্য কারও কারও হয়ে থাকবে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটেছে আরও পরে। বাংলাদেশের নিভৃত গ্রামের বিত্তহীন চাষি বিবিসি শোনে, টেলিভিশন দেখে, জমিতে শ্যালো মেশিনের প্রয়োগ সম্বন্ধেও সব জানে। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার তার জীবনে আর সম্ভব হয়না। টেলিভিশনের ছবি তার কাছে রূপকথার বেশি কিছু নয়। রূপকথা এবং অল্পক্ষণের জন্য হলেও তার কল্পনাকে রঙিন করতে পারত, একটা গল্প দেখার সুখ সে পেত। গান আর গাথার মত রূপকথা শোনাও তার সংস্কৃতিচর্চার অংশ। পক্ষিরাজ তো কল্পনার ঘোড়া, এর ওপর সেও যেমন চড়তে পারেনা, গ্রামের জোতদার মাহাজনও তাকে নাগালের ভেতর পাবে না। কিন্তু টেলিভিশনে-দেখা-জীবন তো কেউ কেউ ঠিকই ভোগ করে। ঢাকা শহরের কেউ-কেউ এর ভাগ পায় বইকী। তাদের মধ্যে তার চেনাজানা মানুষও আছে। এই দুই দশকে শ্রেণীর মেরুকরণ এত হয়েছে যে গ্রামের জোতদারের কী সচ্ছল কৃষকের বেপরোয়া ছেলেটি ঢাকায় গিয়ে কী করে কী করে অনেক টাকার মালিক হয়ে বসেছে, সে নাকি এবেলা ওবেলা সিঙ্গাপুর-হংকং করে। চাষিরা নিজেদের কাছে তাই আরও ছোট হয়ে গেছে। তবে কি ঐ জীবনযাপন করতে তার আগ্রহ হয়না? না, হয় না। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্পৃহাকে সংকল্পে রূপ দিতে পারে যে-রাজনীতি তার অভাব আজ বড় প্রকট। রাজনীতি আজ ছিনতাই করে নিয়েছে কোটিপতির দল। এদের পিছে পিছে ঘোরাই এখন নিম্নবিত্ত মানুষের প্রধান রাজনৈতিক তৎপরতা। এখনকার প্রধান দাবি হল রিলিফ চাই।। এনজিওতে দেশ ছেয়ে গেল, নিরন্ন মানুষের প্রতি তাদের উপদেশঃ তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াও। কী করে?-না, মুরগি পোষো, ঝুড়ি বানাও, কাঁথা সেলাই করো। ভাইসব, তোমাদের সম্পদ নেই, সম্বল নেই, মুরগি পুষে, ডিম বেচে, ঝুড়ি বেচে তোমরা স্বাবলম্বী হও। কারন, সম্পদ যারা হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে তা তাদের দখলেই থাকবে, ওদিকে চোখ দিও না। রাষ্ট্রক্ষমতা লুটেরা কোটিপতিদের হাতে, তাদের হাতেই ওটা নিরাপদ থাকবে, ওদিকে হাত দিতে চেষ্টা কোরো না। তাদের মানুষ হয়ে বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা, অধিকার আদায়ের স্পৃহা এবং অন্যায় সমাজব্যবস্থা উৎখাত করার সংকল্প চিরকালের জন্য বিনাশ করার আয়োজন চলছে। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী তাই ছোট থেকে আরও ছোট হয়, এই মানুষটির সংস্কৃতির বিকাশ তো দূরের কথা, তার আগের অনেক অভ্যাস পর্যন্ত লুপ্ত হয়। কিন্তু নতুন সংস্কৃতির স্পন্দন সে কোথাও অনুভব করে না।
এখন এই লোকটিকে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কি ‘ছোট প্রান ছোট কথা’র আদর্শ দিয়ে কাজ হবে? তার একটা সমস্যা ধরতে গেলেই তো হাজারটা বিষয় এসে পড়ে, কোনোটা থেকে আরগুলো আলাদা নয়। একজন চাষির প্রেম করা কী বউকে তালাক দেওয়া, তার জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কী ভুমিহীনে পরিণত হওয়া তার ছেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের দিকে রওয়ানা হওয়া এবং সেখান থেকে সৌদি আরব যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় টাউটের পাল্লায় পড়া, তরুন চাষির প্রেমিকার মুখে এসিড ছুড়ে মারা- এসবের সঙ্গে সারের ওপর ভরতুকি তুলে নেওয়া কিংবা জাতীয় পরিষদের ইলেকশনে তিন কোটিপতির ইলেকশন ক্যাম্পেনে টাকার খেল দেখানো কিংবা এনজিওর কার্যক্রমের সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকা এমনকিছু বিচিত্র নয়। ছোটগল্প লিখতে গিয়ে কোন ব্যাপারটা আনব আর কোনটা আনব না, সমস্যাকে তুলে ধরতে গেলে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি, ছোটগল্পের সীমারেখা কোথায়-এসব প্রশ্ন কি ছোটগল্প লেখাকে জটিল করে তুলছে না?
মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কী উচ্চমধ্যবিত্তের চরিত্র অনুসরন করা কঠিন। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত আর বাপ-দাদার শ্রেনীতে পড়ে থাকতে চায় না, সবারই টার্গেট বড়লোক হওয়া। যে যে-পেশায় থাকুক-না, ওর মধ্যেই পয়সা বানাবার ফন্দিফিকির বার করার তালে থাকে। এখন মধ্যবিত্তের সংস্কার বলি, মূল্যবোধ বলি কিংবা মূল্যবোধ বলে চালানো সংস্কার, অথবা অভ্যাস, রেওয়াজ, আদবকায়দা, বেয়াদবি বেতমিজি- এগুলো মোটামুটি সবারই কমবেশি জানা। খারাপ লেখকও জানেন ভালো লেখকও জানেন। কিন্তু যে-লোকটি মানুষ হয়েছে নিম্নবিত্তের ঘরে, কী মধ্যবিত্তের সংস্কার যার রক্তে, সে যখন শয়নে স্বপনে পশ লিভিংয়ের ধান্দায় থাকে তখন সে বড় দুর্বোধ্য মানুষে পরিণত হয়। আবার চুরিচামারি করে, ঘুষ খেয়ে অজস্র মানুষের গলায় লালফিতার ফাঁস পরিয়ে, স্টেনগান, মেশিনগান বা বাখোয়াজির দাপটে, এমনকি বিদ্যা বেচেও কয়েক বছরে যারা উচ্চবিত্তের প্রাসাদে প্রবেশ করেছে এবং তারপর সারাজীবনের অভ্যাস, সংস্কার, রেওয়াজ, প্রথা সব পালটে ‘উইথ রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্ট’ বুর্জোয়া হওয়ার সাধনায় ব্যস্ত বরং বলি ব্যতিব্যস্ত, ছোটগল্পে তাদের যথাযথ শনাক্ত করা কি কম কঠিন কাজ! ভণ্ডামি মধ্যবিত্তের স্বভাবের অংশ বহু আগে থেকেই। কিন্তু ভণ্ডামির ভেতরেও যে সামঞ্জস্য থাকে, এখন তাও খুঁজে পাওয়া ভার। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহাচ্যাম্পিয়ন, বাংলার ‘ব’ বলতে প্রাণ আনচান করে ওঠে, চোখের জলে বুক ভাসায় এমন অনেকের ছেলেমেয়ে জন্ম থেকে থাকে বাইরে, বাংলা ভাষা বলতেও পারে না। রাজনীতি থেকে সর্বক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ্র বুলি হাঁকায় এমন অনেক সাচ্চা মুসলমানের মক্কা হল আমেরিকা, ছেলেমেয়েদের আমেরিকা পাঠিয়ে তাদের গ্রীন কার্ড, ব্লু কার্ড না রেড কার্ড করার রঙিন খোয়াবে তারা বিভোর। আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা যে-জীবনযাপন করে তা কি কোনোদিক থেকে ইসলামি? পিরসাহেবের হুজরায় গিয়ে আল্লাহর করুণা পাবার জন্য কেঁদে জারজার হয়ে হুজুরপাকের তবারক নিয়ে সেই বিরিয়ানি খায় হুইস্কি সহযোগে এবং নগদ টাকার সঙ্গে সেই পবিত্র হুইস্কি নিবেদন করে আমলাদের সেবায় টেন্ডার পাবার উদ্দেশ্যে- এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত কোন আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত?
শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত প্রযুক্তির সুযোগ যা পাচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর তুলনায় তা অনেক ক্ষেত্রেই কম নয়। প্রযুক্তি আসছে, কিন্তু বিজ্ঞান চর্চার বালাই নেই। জীবনে বিজ্ঞান পড়েনি এমন সব বিদ্যাদিগগজরা টেলিভিশনে ডারউইনের তত্ব নিয়ে বিরূপ ঠাট্রা করার স্পর্ধা দেখায়। এমন কি বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়া পন্ডিতেরা সরকারি মাধ্যমগুলোতে প্রচার করে যে, বিজ্ঞানীদের যাবতীয় কথা পবিত্র ধর্মগ্রন্থেই নিহিত রয়েছে, বিজ্ঞানীদের কর্ম সব ঐসব বই থেকে চুরি করে সম্পন্ন করা হয়। পাকিস্তানের নরখাদক সেনাবাহিনীর গোলামরা গাড়ি হাঁকিয়ে দেশের এ-রাত ও-রাত ঘোরে, ফ্রিজের কোকাকোলায় চুমুক দিতে দিতে মাইকে ঘেউ ঘেউ করে, সাম্যবাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল শয়তানের কারসাজি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান্মনস্কতার প্রসার ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। টেলিভিশন আর ভিসিআরের কল্যাণে এখন ঘরে ঘরে আমেরিকা। কিন্তু কাজের প্রতি ওদের মনোযোগ ও দায়িত্ববোধ কি আমাদের ভদ্রলোকদের কিছুমাত্র প্রভাবিত করেছে? রাস্তায় কেউ কি ট্রাফিক আইন মানে? বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহ বাড়ে? স্বাস্থসম্মত জীবনযাপনে উৎসাহী হয়? যা এসেছে তা হল আগ্নেয় অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করা। বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফল ভয়াবহ, এর ফল হল নিদারূন সাংস্কৃতিক শূন্যতা এবং অপসংস্কৃতির প্রসার। কোন সাংস্কৃতিক পরিবেশে তরুণদের এই ধারনা বদ্ধমুল হয় যে, এই দেশ বসবাসের অযোগ্য? কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাষ্ট্র দখলের যুদ্ধে যারা নামে তারা কি এইসব তরুণদের হতাশা মোচন করার কোনো কর্মসূচি নেয়? গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যে কোটি কোটি টাকা অপচয় করা যায়, কিন্তু টাকার অভাবে বিপুল সংখ্যক সরকারি পদ বছরের পর বছর শূন্য পড়ে থাকে। রাষ্ট্রেরই-বা ক্ষমতা কতটা? রাষ্ট্রেরও বাপ আছে, রাষ্ট্র কি ইচ্ছা করলেই মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারে? তার বাপ কি তাকে সুবিধামতো কলকারখানা তৈরি করতে দেবে? সারের ওপর ভরতুকি কি সে ইচ্ছা করলেই অব্যাহত রাখতে পারে? কর্মীদের বেতন নির্ধারন করতে পারে? রাষ্ট্রের কোমরে বাঁধা দড়ির প্রান্তটি যে-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে তাকে লক্ষ করাওতো ছোটগল্প লেখকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশি যুদ্ধে প্রাণ দেয় ইউনিভার্সিটির ছেলে, ইউনিভা্সিটিতে তালা ঝোলে আর গ্রামে পাটের দাম না পেয়ে পাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বৃদ্ধ চাষি। সেই রিক্ত চাষির গালে কার হাতের থাপ্পড়ের দাগ? কার হাত? মায়ের গয়না বেচে যে তরুণ পাড়ি দিয়েছে জার্মানি কি আমেরিকায় সে তো আর ফেরে না তার মায়ের নিঃসঙ্গতাকে কি শুধু মায়ের ভালবাসা বলে গৌরব দেওয়ার জন্য গদগদচিত্তে লেখক ছোটগল্প লিখবে? কর্মসংস্থান করতে না-পেরে যে-যুবক দিনদিন অস্থির হয়ে উঠছে, নিজের গ্লানিবোধকে চাপা দিতে হয়ে উঠছে বেপরোয়া, অসহিষ্ণু এবং বেয়াদব, আর ছিনতাইকারী হয়ে ওঠা, কিছুদিনের মধ্যে এই পেশায় তার সহকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া, একটির পর একটি গোষ্ঠী পালটানো এবং এ থেকে সবাইকে অবিশ্বাস করার প্রবণতার ভয়াবহ শিকারে পরিণত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে অনুভূতিহীন, স্পৃহাবঞ্চিত নিম্নস্তরের প্রাণী হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা- এই লোকটিকে পরিচিত করানো তো বটেই, এমনকি শুধু উপস্থাপন করতেও কত বিচিত্র বিষয়কেই-না মনে রাখতে হয়। বলা যায় যে, এসবের উৎস হল অভাব, অভাব তো আমাদের পুরোনো সঙ্গী। কিন্তু তা কি আগে কখনোই এরকম ব্যাপক, গভীর এবং সর্বোপরি জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর আবর্তিত হয়েছে? আমাদের অভাব এখন পুঁজিবাদী ব্যক্তির সম্পদ। আমাদের অভাবমোচনের মহান দায়িত্বপালনের এরকম সুযোগ আগে কোনোদিন তারা পায়নি। এই উদ্দেশ্যে তারা এখন অবাধে যেখানে সেখানে ঢোকে, তারাই আমাদের প্রভু, তাদের নিপুণ কার্যক্রমে তাদের প্রভুত্ব মেনে নিতে সব দ্বিধাদ্বন্দ্বই আমরা ঝেড়ে ফেলেছি। তাদের দরাজ হাতে আমাদের দায়ভার তুলে দিতে আমরা উদগ্রীব। ফলে অভাবমোচনের জন্য মানুষের সমবেত স্পৃহাকে বিনাশ করার আয়োজনে তারা অনেকটাই সফল। অভাব হয়ে ওঠে মানুষের কাছে নিয়তি। সমাধানের স্পৃহা না-থাকলে সমস্যাকে সমস্যা বলে বিবেচনা করা যায় না। নিরাময় করতে চাই বলেই রোগকে রোগ বলি, নইলে সর্দি থেকে শুরু করে ক্যান্সার এইডস পর্যন্ত যাবতীয় ব্যাধিকে দাড়িগোঁফ গজানো আর চুল পাকা আর দাঁত পরার মতো শারীরিক নিয়ম বলে মেনে নিতাম। সমস্যা-উত্তরনের সঙ্কল্পের জায়গায় এখন সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতাই প্রধান। এর ওপর চলছে সমাজতন্ত্রকে হেয়প্রতিপন্ন করার সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, যা কিনা অভাব থেকে মুক্তির স্পৃহাকে দমন করা এবং মানুষ হয়ে বাঁচবার সংকল্পকে মুচড়ে দেওয়ার চক্রান্তের একটি অংশ। মানুষের শাসিত স্পৃহা ও দমিত সংকল্পকে আবর্জনার ভেতর থেকে খুঁজে বার করে আনার দায়িত্বও বর্তায় কথাসাহিত্যিকের ঘাড়ে।
সমাজের প্রবল ভাংচুর, সমাজব্যবস্থায় নতুন নতুন শক্তি ও উপাদানের সংযোগ প্রভৃতির ফলে মানুষের গভীর ভেতরের রদবদল ও অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত ছোটগল্পের শরীরেও পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। উপন্যাসে এই পরিবর্তনটি আসছে লেখকের প্রয়োজোনেই। কাহিনী ফাঁদা আর চরিত্র উপস্থাপন এখন উপন্যাসের জন্য যথেষ্ট নয়, কেবল ধারাবাহিকতা রক্ষা করলেই গল্পের সমস্ত দায়িত্ব পালন করা হয় বলে এখন আর কেউ মনে করে না। গল্প ভেঙ্গে উপন্যাসের মধ্যে আরেকটি গল্প তৈরী হচ্ছে, আবার একই গল্প লেখকের কয়েকটি ছোটগল্পে আসছে নানামাত্রায়, নানা ভঙ্গিতে। একই চরিত্র একই নামে বা ভিন্ন নামে লেখকের কয়েকটি ছোটগল্পে আসতে পারে, তাতেও না-কুলালে এ-চরিত্র আসন করে নিচ্ছে লেখকের উপন্যাসে। ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’ বলে এখন কিছু আছে কি? ‘ছোট দুঃখ’ কোনটি? প্রতিটি ছোট দুঃখের ভেতর চোখ দিলে দেখা যায় তার মস্ত প্রেক্ষাপট, তার জটিল চেহারা এবং তার কুটিল উৎস। ছোটগল্পের হৃৎপিণ্ডে যে-প্রবল ধাক্কা আসছে তা থেকে তার শরীর কি রেহাই পাবে?
ব্যক্তির একটি আপাত-সামান্য ও আপাত-ছোট সংকটকে পাঠকের সামনে পেশ করতে হাজির করতে হচ্ছে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক একটি সাহায্যসংস্থার রিপোর্টের অংশ। খবরের কাগজের ভাষা এমনকি একটি কাটিং নিহত সন্তানের মায়ের উদ্বিগ্ন শোকের প্রেক্ষাপট বোঝাতে সাহায্য করতে পারে। গার্মেন্টসে নিয়োজিত তরুণীর গ্লানিবোধ নিয়ে আসার লক্ষে লেখক বিজ্ঞাপনের একটি লাইন তুলে দিতে পারেন। খরায় ধুকতে থাকা একটি চাষের জমিকে প্রধান চরিত্র করে প্রকাশিত হতে পারে শুধু সেখানকার সমাজ নয়, শহরের একটি বেয়াদব মাস্তানের অসহায় অবস্থা। সরকারি প্রজ্ঞাপনের আকারে উপস্থাপন করা যায় মুষ্টিমেয় বিত্তবানের সম্পদ কুক্ষিগত করার লালসাকে। কোথাও খুব পরিচিত কবিতার একটি পঙক্তি এমন বেঁকেচুরে এসে পড়ে যে মূল কবিতাকে আর চেনা যায় না, এই বিকৃত কবিতার লাইন হাতকাটা কোনো শ্রমিকের পায়ে ঝিঝি ধরাকে যথাযথ প্রেক্ষিতে তুলে ধরার জন্য হয়তো বিশেষভাবে দরকারি। একটা শ্যালোমেশিনের কলকব্জার মিস্ত্রি সুলভ বর্ণনায় উন্মোচিত হয় একটা গোটা এলাকার মানুষের হতাশ হৃদয়। একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ কী বুদ্ধিজীবীর কোনো পরিচিত কর্মকাণ্ডের বিশ্বস্ত বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে তার স্বভাবের গভীর ভেতরকার কোনো বৈশিষ্ট্য বোঝাতে লেখক তাঁকে করতে পারেন ফ্যান্টাসির চরিত্র, এতেও একই সঙ্গে প্রকাশিত হতে পারে নামহীন গোত্রহীন হাজার মানুষের বিশেষ কোনো সংকট।
ছোটগল্পের এই পরিবর্তন যে ঘটছে না তা নয়; কিন্তু তা তেমন চোখে পড়ে না। তার প্রধান কারণ এই যে, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ভূমিকা এই ব্যাপারে গৌণ। তাদের মধ্যে সৎ ও ক্ষমতাবানেরা কিছুদিন আগে সামাজিক ধসের ভেতর থেকে হাড্ডিমাংস জোড়া দিয়ে মানুষকে উপস্থিত করেছিলেন পাঠকের সামনে, সাম্প্রতিক সময়কে উন্মোচন করার স্বার্থেই যে এই মাধ্যমটিকে গড়েপিটে নেওয়া দরকার তা নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে বোঝেন তাঁরা। তাহলে তাঁরা গল্প লেখেন না কেন? খ্যাতি লেখককে প্রেরনা হয়তো খানিকটা দেয়, তবে খ্যাতি তাঁকে আরও বেশি সতর্ক করে রাখে খ্যাতি নিরাপদ রাখার কাজে । নিজের ব্যবহৃত, পরিচিত ও পরীক্ষিত রীতিটি তার বড় পোষমানা, এর বাইরে যেতে তার বাধো বাধো ঠেকে। কিংবা নিজের রেওয়াজ ভাঙতে তাঁর মায়া হয়। তাই ছোটগল্পের জন্য ভরসা করতে হয় লিটল ম্যাগাজিনের ওপর। প্রচলিত রীতির বাইরে লেখেন বলেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের দরকার হয় নিজেদের পত্রিকা বার করার। বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় ছোটগল্পের ছিমছাম তনুখানি অনুপস্থিত, সাম্প্রতিক মানুষকে তুলে ধরার তাগিদে নিটোল গপ্পো ঝেড়ে তাঁরা তৈরী করছেন নানা সংকটের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত ছোটগল্পের খরখরে নতুন শরীর। এইসব লেখকদের অনেকেই অল্পদিনে ঝরে পড়বেন, সমালোচকদের প্রশংসা পাবার লোভ অনেকেই সামলাতে না-পেরে চলতে শুরু করবেন ছোটগল্পের সনাতন পথে। হাতে গোনা যায় এমন কয়েকজনও যদি মানুষের এখনকার প্রবল ধাক্কা খাওয়াকে উপযুক্ত শরীরে উপস্থাপনের দায়িত্বপালন অব্যাহত রাখেন তো তাতেও ছোটগল্পের মুমূর্ষু শরীরে প্রাণসঞ্চার সম্ভব। এঁরা তো বটেই, এমনকী যারা ঝরে পড়বেন বা সমালোচকদের পিঠ-চাপড়ানোর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, তাদের অল্পদিনের তৎপরতাও ভবিষ্যৎ লেখকদের যেমন অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি বিরল সততাসম্পন্ন মুষ্টিমেয় অগ্রজ লেখকও এঁদের কাজ দেখে পা ঝেড়ে উঠতে পারেন।
..............................
লেখক পরিচিতি
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। তাঁর বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ছিলেন। মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। আখতারুজ্জামান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন (১৯৬৪)। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিস, জন্ডিস-সহ নানাবিধ রোগে। ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কম্যুনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ- অন্যঘরে অন্যস্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উৎপাত, দোজখের ওম, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, গল্প সংগ্রহ। উপন্যাস- চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা।
0 মন্তব্যসমূহ