সাহিত্যে পুরস্কার দেওয়ার সময় লেখককে একটি অলিখিত শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, তা হল এই যে : তোমার লেখা অব্যাহত রাখতে হবে, এবং লেখার মান বাড়ুক কি নাই বাড়ুক অর্জিত মান যেন পড়ে না-যায় সে দিকে লক্ষ রাখবে। এই শর্ত যে-কোন লেখককে সবসময় তটস্থ রাখার পক্ষে যথেষ্ট। একথা, আমার মনে হয়, উপন্যাস-লেখকের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।
উপন্যাসের সৃষ্টি ঔপনিবেশিক যুগে, অথচ এর অবস্থান ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিপক্ষেই। উপন্যাসে সব স্তরের মানুষের যে বিপুল সমাবেশ ঘটে, শ্রেণী গোষ্ঠী সম্প্রদায় নির্বিশেষে যে-বিচিত্র জীবন্ত মানুষ সুষ্টি হয়, মানুষের সৃজনশীল কল্পনার যে-বাঁধভাঙ্গা প্রকাশ ঘটে তা ঔপনিবেশিক আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থার প্রতি তো রীতিমত হুমকি। এজন্যই কি দন কিহোতে-র মতে শিল্পকর্মকে দুশো বছর লাতিন আমেরিকার স্পানিশ উপনিবেশগুলোয় নিষিদ্ধ করা হয়? কিন্তু উপন্যাসের খোলামাঠে বিপুল লোকসমাগম ও মানুষের স্ফূর্ত কল্পনার উড়াল ঠেকায় কে? স্পেনের ক্ষয়িষ্ণু আভিজাত্যের কাহিনি তাই মদের পিপেয় চালান হয়ে দিব্যি ঢুকে পড়ে বলিভিয়ায়, পেরুতে, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে। প্রায় চারশো বছর আগে সের্ভান্তস সাহেব তাঁর নাইটকে যে রুগ্ণ ঘোড়ায় চাপিয়েছিলেন তা এখন দাপিয়ে বেড়ায় দুনিয়া জুড়ে। ওই রুগ্ণ ঘোড়ার দাপটে সত্যিই অভিভূত না হয়ে পারা যায় না।
উপন্যাস বড় হয়েছে ব্যক্তির বিকাশ ঘটতে ঘটতে। আবার ব্যক্তির বিকাশ ঘটাতেও উপন্যাসের ভূমিকা কম নয়। ওদিকে পাশ্চাত্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার উন্মেষ না-ঘটতেই তা রুপান্তরিত হয়েছে ব্যক্তিসর্বস্বতায়। উপন্যাসে ব্যক্তি আসছে নানান রঙে নানান ঢঙে।
আমাদের এই উপমহাদেশে ব্যক্তির বিকাশ প্রথম থেকেই বাধা পেয়ে এসেছে। এখানে ব্যক্তিপ্রবরটি জন্ম থেকেই পঙ্গু ও দুর্বল। পাশ্চাত্যের সর্বত্রই যেহেতু ব্যক্তিসর্বস্বতার জয়গান, আমাদের এখানেও তাই জন্মরোগা ব্যক্তিটির দিকেই আমাদের লেখকদের অকুণ্ঠ মনোযোগ। বাংলা উপন্যাসে প্রথমে এই রুগ্ণ ব্যক্তির শরীরে একটু তেজ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নকল তেজ তাকে শক্তি যোগাতে পারেনি। কেবল তা-ই নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল উপন্যাসগুলোয় বরং দেশের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাকে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের মর্যাদাই দেওয়া হয়। অথচ অন্যান্য সাহিত্যের উপন্যাসে তখন প্রচলিত সংস্কার, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে অবিরাম আঘাত করা হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শক্তির উপহার এই খঞ্জ ব্যক্তিটিই হয়ে ওঠে লেখকদের আদরের ধন। তাকে নানাভাবে তোয়াজ করাই হল আমাদের ঔপন্যাসিকদের আসল কাজ। দেশের অসংখ্য শ্রমজীবি মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ এবং আবার স্বপ্ন দেখার অসীম শক্তি আমাদের চোখে পড়ে না। এজন্য শ্রমজীবি, নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে যখন লিখি তখনও পাকেপ্রকারে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেই মধ্যবিত্তকে এবং শক্তসামর্থ্য, জীবন্ত মানুষগুলোকে পানসে ও রক্তশুন্য করে তৈরি করি। বাংলাদেশে এখন চলছে শ্রমজীবি মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া। ফলে আমাদের সংস্কৃতির বনিয়াদ চলে যাচ্ছে আমাদের চোখের আড়ালে। আমাদের গান, আমাদের ছবি, আমাদের কবিতার উৎস যে-জীবন ও সংস্কৃতি তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটায়, সংখ্যার দিক দিয়ে বিস্ফোরণ হলেও, আমাদের উপন্যাস দিন দিন রক্তহীন হয়ে পড়ছে। একই কাহিনি নানান বয়ানে শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। তবে ক্লান্তিও লেখকরা লুফে নেন এবং জীবনে একেই একমাত্র সত্য বলে জাহির করার সুযোগ খোঁজেন।
বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে আরও দেরিতে। বাঙালি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমাজে উপন্যাসের চর্চা শুরু হয়েছে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনার অনেক পরে। বাংলাদেশের প্রধান ঔপন্যাসিক প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কুসংস্কারকে গৌরব দেওয়ার কাজে লিপ্ত হননি। বরং এই সমাজের ধর্মান্ধতাকেই তিনি প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছেন। নিজ সম্প্রদায়ের শেকড়সন্ধানের প্রয়াস এবং পশ্চাৎপদ সংস্কারকে আঘাত করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন একই সঙ্গে। তাঁর শেষ উপন্যাসে তাই তাঁকে একটি স্বকীয় ভাষারীতিও তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ না-করে আমরা বরং পাঠকের মনোরঞ্জনের কাজেই নিয়োজিত হয়েছি। আমরা কৃশকায় মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তরল ও পানসে দুঃখবেদনার পাঁচালি গাই, কিন্তু এতে উপন্যাসে কি ব্যক্তির যথাযথ সামাজিক অবস্থানটি কোনভাবেই প্রকাশিত হয়? এতে শেষে যে-ব্যক্তিটিকে উদ্ধার করি সে কিন্তু রেনেসাঁসের সেই শক্তসমর্থ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ নয় বরং দায়িত্ববোধহীন ফাঁপা এক প্রাণীমাত্র।
আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি অনুসন্ধান করলে সেখানে বাঙালি জাতির একটি অভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেই পরিচয় খোঁজা তো দুরের কথা, আমরা শিক্ষিত মানুষেরা, আমাদের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলো, আমাদের স্ফীতোদর রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ দীর্ঘদিন থেকে সম্প্রদায়গুলোকে নানাভাবে উসকানি দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেই। সমগ্র জাতির বিকাশে এমন আচরণ কখনই সহায়ক হতে পারে না। নিঃসন্দেহে, সমগ্র জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি অনুসন্ধান করা একটি কঠিন কাজ। কিন্তু 'কঠিনেরে ভালবাসিলাম'-এটুকু জেদ না-থাকলে কারও শিল্পচর্চায় হাত দেওয়ার দরকার কী?
আজ এই পুরস্কার নিতে আনন্দের সঙ্গে আমার একটু সংকোচও হয় বইকী। দেশের কী জাতির সংস্কৃতির গোড়ায় না-গিয়ে যদি নিজের আর বন্ধুদের আর আত্মীয়-স্বজনের স্যাঁতসেঁতে দুঃখবেদনাকেই লালন করি তো তাতে হয়তো মধ্যবিত্ত কী উচ্চবিত্তের সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, কিন্তু তা থেকে তারা নিজেদের জীবনযাপনে যেমন কোন অস্বস্তিও বোধ করবে না, তেমনই পাবে না কোন প্রেরণাও। তা হলে আমার যাবতীয় সাহিত্যকর্ম ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে মনে হবে নেহাতই তোতলা বাখোয়াজি।
(এই গদ্যটির প্রকাশকাল ২৮ এপ্রিল, ১৯৯৬, কলকাতা, আনন্দবাজার পত্রিকা। তাঁর 'সংস্কৃতির ভাঙা সেতু' প্রবন্ধগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।)
লেখক পরিচিতি
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। তাঁর বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ছিলেন। মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। আখতারুজ্জামান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন (১৯৬৪)। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিস, জন্ডিস-সহ নানাবিধ রোগে। ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কম্যুনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ- অন্যঘরে অন্যস্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উৎপাত, দোজখের ওম, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, গল্প সংগ্রহ। উপন্যাস- চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা।
উপন্যাসের সৃষ্টি ঔপনিবেশিক যুগে, অথচ এর অবস্থান ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিপক্ষেই। উপন্যাসে সব স্তরের মানুষের যে বিপুল সমাবেশ ঘটে, শ্রেণী গোষ্ঠী সম্প্রদায় নির্বিশেষে যে-বিচিত্র জীবন্ত মানুষ সুষ্টি হয়, মানুষের সৃজনশীল কল্পনার যে-বাঁধভাঙ্গা প্রকাশ ঘটে তা ঔপনিবেশিক আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থার প্রতি তো রীতিমত হুমকি। এজন্যই কি দন কিহোতে-র মতে শিল্পকর্মকে দুশো বছর লাতিন আমেরিকার স্পানিশ উপনিবেশগুলোয় নিষিদ্ধ করা হয়? কিন্তু উপন্যাসের খোলামাঠে বিপুল লোকসমাগম ও মানুষের স্ফূর্ত কল্পনার উড়াল ঠেকায় কে? স্পেনের ক্ষয়িষ্ণু আভিজাত্যের কাহিনি তাই মদের পিপেয় চালান হয়ে দিব্যি ঢুকে পড়ে বলিভিয়ায়, পেরুতে, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে। প্রায় চারশো বছর আগে সের্ভান্তস সাহেব তাঁর নাইটকে যে রুগ্ণ ঘোড়ায় চাপিয়েছিলেন তা এখন দাপিয়ে বেড়ায় দুনিয়া জুড়ে। ওই রুগ্ণ ঘোড়ার দাপটে সত্যিই অভিভূত না হয়ে পারা যায় না।
উপন্যাস বড় হয়েছে ব্যক্তির বিকাশ ঘটতে ঘটতে। আবার ব্যক্তির বিকাশ ঘটাতেও উপন্যাসের ভূমিকা কম নয়। ওদিকে পাশ্চাত্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার উন্মেষ না-ঘটতেই তা রুপান্তরিত হয়েছে ব্যক্তিসর্বস্বতায়। উপন্যাসে ব্যক্তি আসছে নানান রঙে নানান ঢঙে।
আমাদের এই উপমহাদেশে ব্যক্তির বিকাশ প্রথম থেকেই বাধা পেয়ে এসেছে। এখানে ব্যক্তিপ্রবরটি জন্ম থেকেই পঙ্গু ও দুর্বল। পাশ্চাত্যের সর্বত্রই যেহেতু ব্যক্তিসর্বস্বতার জয়গান, আমাদের এখানেও তাই জন্মরোগা ব্যক্তিটির দিকেই আমাদের লেখকদের অকুণ্ঠ মনোযোগ। বাংলা উপন্যাসে প্রথমে এই রুগ্ণ ব্যক্তির শরীরে একটু তেজ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নকল তেজ তাকে শক্তি যোগাতে পারেনি। কেবল তা-ই নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল উপন্যাসগুলোয় বরং দেশের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাকে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের মর্যাদাই দেওয়া হয়। অথচ অন্যান্য সাহিত্যের উপন্যাসে তখন প্রচলিত সংস্কার, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে অবিরাম আঘাত করা হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শক্তির উপহার এই খঞ্জ ব্যক্তিটিই হয়ে ওঠে লেখকদের আদরের ধন। তাকে নানাভাবে তোয়াজ করাই হল আমাদের ঔপন্যাসিকদের আসল কাজ। দেশের অসংখ্য শ্রমজীবি মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ এবং আবার স্বপ্ন দেখার অসীম শক্তি আমাদের চোখে পড়ে না। এজন্য শ্রমজীবি, নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে যখন লিখি তখনও পাকেপ্রকারে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেই মধ্যবিত্তকে এবং শক্তসামর্থ্য, জীবন্ত মানুষগুলোকে পানসে ও রক্তশুন্য করে তৈরি করি। বাংলাদেশে এখন চলছে শ্রমজীবি মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া। ফলে আমাদের সংস্কৃতির বনিয়াদ চলে যাচ্ছে আমাদের চোখের আড়ালে। আমাদের গান, আমাদের ছবি, আমাদের কবিতার উৎস যে-জীবন ও সংস্কৃতি তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটায়, সংখ্যার দিক দিয়ে বিস্ফোরণ হলেও, আমাদের উপন্যাস দিন দিন রক্তহীন হয়ে পড়ছে। একই কাহিনি নানান বয়ানে শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। তবে ক্লান্তিও লেখকরা লুফে নেন এবং জীবনে একেই একমাত্র সত্য বলে জাহির করার সুযোগ খোঁজেন।
বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে আরও দেরিতে। বাঙালি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমাজে উপন্যাসের চর্চা শুরু হয়েছে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনার অনেক পরে। বাংলাদেশের প্রধান ঔপন্যাসিক প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কুসংস্কারকে গৌরব দেওয়ার কাজে লিপ্ত হননি। বরং এই সমাজের ধর্মান্ধতাকেই তিনি প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছেন। নিজ সম্প্রদায়ের শেকড়সন্ধানের প্রয়াস এবং পশ্চাৎপদ সংস্কারকে আঘাত করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন একই সঙ্গে। তাঁর শেষ উপন্যাসে তাই তাঁকে একটি স্বকীয় ভাষারীতিও তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ না-করে আমরা বরং পাঠকের মনোরঞ্জনের কাজেই নিয়োজিত হয়েছি। আমরা কৃশকায় মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তরল ও পানসে দুঃখবেদনার পাঁচালি গাই, কিন্তু এতে উপন্যাসে কি ব্যক্তির যথাযথ সামাজিক অবস্থানটি কোনভাবেই প্রকাশিত হয়? এতে শেষে যে-ব্যক্তিটিকে উদ্ধার করি সে কিন্তু রেনেসাঁসের সেই শক্তসমর্থ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ নয় বরং দায়িত্ববোধহীন ফাঁপা এক প্রাণীমাত্র।
আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি অনুসন্ধান করলে সেখানে বাঙালি জাতির একটি অভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেই পরিচয় খোঁজা তো দুরের কথা, আমরা শিক্ষিত মানুষেরা, আমাদের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলো, আমাদের স্ফীতোদর রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ দীর্ঘদিন থেকে সম্প্রদায়গুলোকে নানাভাবে উসকানি দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেই। সমগ্র জাতির বিকাশে এমন আচরণ কখনই সহায়ক হতে পারে না। নিঃসন্দেহে, সমগ্র জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি অনুসন্ধান করা একটি কঠিন কাজ। কিন্তু 'কঠিনেরে ভালবাসিলাম'-এটুকু জেদ না-থাকলে কারও শিল্পচর্চায় হাত দেওয়ার দরকার কী?
আজ এই পুরস্কার নিতে আনন্দের সঙ্গে আমার একটু সংকোচও হয় বইকী। দেশের কী জাতির সংস্কৃতির গোড়ায় না-গিয়ে যদি নিজের আর বন্ধুদের আর আত্মীয়-স্বজনের স্যাঁতসেঁতে দুঃখবেদনাকেই লালন করি তো তাতে হয়তো মধ্যবিত্ত কী উচ্চবিত্তের সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, কিন্তু তা থেকে তারা নিজেদের জীবনযাপনে যেমন কোন অস্বস্তিও বোধ করবে না, তেমনই পাবে না কোন প্রেরণাও। তা হলে আমার যাবতীয় সাহিত্যকর্ম ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে মনে হবে নেহাতই তোতলা বাখোয়াজি।
(এই গদ্যটির প্রকাশকাল ২৮ এপ্রিল, ১৯৯৬, কলকাতা, আনন্দবাজার পত্রিকা। তাঁর 'সংস্কৃতির ভাঙা সেতু' প্রবন্ধগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।)
লেখক পরিচিতি
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। তাঁর বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ছিলেন। মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। আখতারুজ্জামান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন (১৯৬৪)। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিস, জন্ডিস-সহ নানাবিধ রোগে। ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কম্যুনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ- অন্যঘরে অন্যস্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উৎপাত, দোজখের ওম, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, গল্প সংগ্রহ। উপন্যাস- চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা।
0 মন্তব্যসমূহ