পাঠকের লেখা-- মুহম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী : জোছনা ও জননীর গল্প

এক
দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ায় আমার সবচেয়ে বড় যে-ক্ষতিটা হয়েছে তা হল বাংলা বই পড়া থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি।
কেউ দূরে সরিয়ে দেয়নি | এমনি থেকেই সরে যেতে হয়েছে | বহু কারণের মাঝে পর্যাপ্ত বাংলা বই না পাওয়া একটা কারণ | বাংলাদেশে যেটা ঘর থেকে বের হয়েই পাওয়া যায় এখানে সেটাকে উড়োজাহাজে উড়িয়ে আনতে হয়!
এই কয় বছরে কত বই যে বেরিয়ে গেছে, তার টেরই পাইনি!

প্রতিবছর বইমেলা আসে | অনলাইনে প্রিয় লেখকদের বইয়ের নামগুলো পড়া, মলাট দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না!

গত বারো বছরে কিছুই পড়া হয়নি !
'জোছনা ও জননীর গল্প' - এই বইটি না পড়লে কত বড় ক্ষতি হয়ে যেত!
ক'দিন থেকে পড়ছি! কতদিন পরে সবকিছু ভুলে কিছু একটা করা হচ্ছে (বারো বছর পরে মুগ্ধ হয়ে কিছু একটা পড়ছি- সেটা আবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প)। স্বাধীনতার এতোগুলো বছরের পরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভেতরে হাঁটছি- মার্চের উত্তাল দিলগুলো, ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ডাক, দেশব্যাপী গেরিলা যুদ্ধের খণ্ডচিত্র, রাজাকারদের তাণ্ডব, হানাদার বাহিনীর পাশবিক ধ্বংসলীলা- চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছিলো |
হুমায়ূন আহমেদ- তোমার কাছে বাঙালি জাতি অনেক কারণে ঋণী- এই বইটি সে ঋণ আরোও কয়েক হাজার গুণ ভারি করে দিল।

দুই
আমি খুব ভীতু এবং আবেগপ্রবণ মানুষ |
এই দূর্বল চিত্ত আর আবেগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কোন লেখা, ছবি, বা নাটক কোনটাই আমার পড়া বা দেখা উচিত নয় |
একেকটা লেখা পড়ি, একেকটা ছবি দেখি রাগে অপমানে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে স্থির করি-আর না | এটাই শেষ | মুক্তিযুদ্ধের আর কিছু পড়ব না, দেখবও না |
'আগুণের পরশমণি' দেখে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে মনে হয়েছিল চোখের সামনে যদি একটা রাজাকার পেতাম তাহলে হাতের কাছে যা পাব তা দিয়েই পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ছাড়তাম |
'জোছনা ও জননীর গল্প' পড়তে পড়তে কতবার যে মন অস্থির হয়ে উঠেছিলো !
কত ঘটনা !
একটা ঘটনা মনে ভীষণভাবে গেঁথে গেছে। অনেক জায়গায় এটা শুনেছি, আজ 'জোছনা ও জননীর গল্প'তেও পড়লাম- '১৬ই ডিসেম্বরের সকাল | কাদের সিদ্দিকীকে সাথে নিয়ে (ইন্ডিয়ান) জেনারেল নাগরা পাকিস্তান ইস্টার্ণ কমান্ডের হেড কোয়ার্টারে গেলেন | তাঁরা দু'জন ঘরে ঢুকলেন | নিয়াজী জেনারেল নাগরার পূর্ব পরিচিত | কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে জেনারেল নাগরা ঘরে ঢুকামাত্র নিয়াজী নাগরার সাথে করমর্দন করলেন | অপমানে দুঃখে নিয়াজী জেনারেল নাগরার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন | নিয়াজীর ফোঁপানো একটু থামতেই জেনারেল নাগরা তাঁর পাশে দাঁড়ানো মানুষটির সঙ্গে নিয়াজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন | শান্ত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, এই হচ্ছে সেই টাইগার সিদ্দিকী |
জেনারেল নিয়াজী অবাক হয়ে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে | তাদের স্তম্ভিতভাব কাটতে সময় লাগল | এক সময় নিয়াজী তার হাত বাড়িয়ে দিলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে |
কাদের সিদ্দিকী হাত বাড়ালেন না | তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজীতে বললেন, নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করি না |"

আরেকটি বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমি একমত | বিষয়টি নিয়ে আমি অনেকবার ভেবেছি | একসময় অনেক ডাটাও সংগ্রহ করেছিলাম |
মাওলানা ইরতাজুদ্দীন কাশেমপুরী চরিত্রটি | আমি এই চরিত্রটির মত অনেকের কথা শুনেছি | তাঁরা মনে প্রাণে পাকিস্তান সাপোর্ট করত। কারণ তাঁদের ধারণা ছিল পাকিস্তানীরা খাঁটি মুসলমান | ওরা মানুষ মারে না, ওরা নবীজীর আদর্শ মেনে চলে, ওরা মা বোনদের ইজ্জত দিয়ে কথা বলে, ওরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। মোটকথা, খাঁটি মুসলমানের সব গুণাগুণ এদের মাঝে আছে | কিন্তু যেই মুহূর্তে ইরতাজুদ্দীনরা চাক্ষুস দেখল পাকিস্তানী মিলিটারীরা সাক্ষাৎ যম, রক্তপিপাসু পশু, নারীলোভী উন্মাদ- সেই মুহূর্তে মৃত্যকে নিশ্চিত জেনেও তাঁরা এই জানোয়ারদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন | ঘৃণার থু থু ছিটিয়েছেন | মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করেছেন |

..........................................
লেখক পরিচিতি
তরুণ বিজ্ঞানী এবং গবেষক  মুহম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী, জন্ম ১৯৭৮ সালে, সুনামগঞ্জ জেলার জয়শ্রী গ্রামে | ২০০১ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এম এস সি শেষে দক্ষিন কোরিয়ার পুসান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে পিএইচডি। অস্ট্রেলিয়ার মনাশ এবং কুইনসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ্য আট বছর গবেষণা শেষে ২০১৫ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার হিসাবে যোগ দিয়েছেন। গবেষণা করেন হিউম্যান ক্যানসার এবং অন্যান্য রোগ নির্ণয়ের সহজলভ্য পদ্ধতি উদ্ভাবনের উপর| 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ