ইলিয়াস, একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস
মুহম্মদ ইমদাদ
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের নাম ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। এই গল্প পড়ে জানা গেল- তার ভেতর বাস করে একজন কবি। এমন এক কবি, যিনি কখনো কবিতা লিখেন না। কিন্তু কবির চোখেই দেখেন তার আশপাশ, চারিপাশ।আর কবি মানেই তো ফিরতে চাইবে এমন একটি কালে যেখানে ফেরা যায়, তবু চাইবে, অর্থাৎ সে খুব নস্টালজিয়া-আক্রান্ত।
ইলিয়াস নিজে অবশ্য বলতেন তার ভেতর বাস-করা ওই লোকটা পাগল। কিন্তু আমাদের কাছে তাকে পাগল মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে কবি। একজন কবির যা-বৈশিষ্ট্য সবই ইলিয়াসের অন্তর্গত ওই লোকটার মাঝে লক্ষ্য করা যায়, আমরা তা-ই করি। গল্পটা পড়ে এসে এখন আপনি যদি বলেন, ‘কেমনে বুঝলেন লোকটা কবি?’ তাহলে আমরা উত্তর দেবো। তার গল্প থেকেই তুলে দেবো এমন কিছু পঙক্তি-প্যারাগ্রাফ, যা আসলে কবির কাজ, অর্থাৎ কবিতা।
এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো।…
আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারেরর ভিজে
গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো
লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি
কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে
আমার ঘুম আস না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস।
মনোরম মনোটোনাস শহর, রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধ, বিষাদবর্ণ দেওয়াল, ছমছম করা রাত্রি, লোনলী-লগ্ন, বৃষ্টি-বুনোট রাত, সর্বোপরি বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস- কে বলতে পারে
এই সব অভাবিত বিশেষণ, বিশেষণের মধ্যে সৃষ্টি করে অভাবিত অনুপ্রাস? লক্ষ করার বিষয় বাংলা-ইংরেজি শব্দের মধ্যে অনুপ্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং বিশেষণগুলি সাধারণ বিশেষণ নয় বরং এক-একটি ছবি যেন, যা আগে কখনো দেখিনি আমরা। দেখেছেন বিষাদবর্ণ দেওয়াল? লোনলী-লগ্ন কখনো? বৃষ্টিকে কখনো মনে হয়েছে ‘সে তো বৃষ্টি নয়, একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস?’ বৃষ্টি আর দীর্ঘশ্বাসকে যিনি ব্যক্তি ভাবতে পারেন, তিনি কবি ছাড়া আর কী? কবিই তো!
এই কবিটি অর্থনৈতিক ভাবে সমাজের যে-স্তরে বাস করে তার নাম আমরা দিয়েছিলাম ‘মধ্যবিত্ত’। তাই সে শিক্ষিত। শহুরে। মনে পড়ে তার মা-বাবা মিলে সিনেমা দেখতে যেতেন। কখনো-সখনো ভাইবোনসহ বাবা ‘টারজান’ দেখাতে তাকেও নিয়ে যেতেন। এ-কারেণে আমরা বুঝতে পারি সে স্মৃতিকাতরও মানে নস্টালজিয়া-অক্রান্ত। কবিত্ব আর নস্টালজিয়া তাকে তাই বৃষ্টিরাতে পড়তে দেয় না কিছু ‘সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্ত-কাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের।’ তার ‘চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়।’ ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলে ভিজে আলো। আর মনে পড়তে থাকে তার, না, এই মনে-পড়া সাধারণ মনে-পড়া নয়, তার চিনচিন করে ওঠে স্মৃতি, সাতটি রবীন্দ্রসংগীত শোনার স্মৃতি, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’র স্মৃতি। আর ‘সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে’ তার স্মৃতির সায়রে, ঘুমাতে পারে না, সে আলোর মধ্যে একলা জেগে রয়।
আলোর মধ্যে একলা জেগে-থাকা লোকটা কি পাগল? না আমাদের তা মনে হয় না। বরং তাকে মনে হয় এক স্মৃতির কৌঠা। এই পৃথিবীর আর এই পৃথিবীতে বাস-করা সব মানুষের অতীতকে নিয়ে সে যেন বসে আছে একলা। সে যেন সেই কালখণ্ড যাকে আমরা যাপন করে এসেছি কিন্তু মনে রাখতে পারিনি। পারি না। আর কালখণ্ডটি ধানের শীষে শিশিরবিন্দুর মতো আমাদের অতি কাছে বসে অবলোকন করে আমাদের। আমরা স্মার্টলি ‘পাস্ট ইজ পাস্ট’ বলে বেমালুম ভুলে থাকি তাকে, ফলে সে একলা হয়, আলোতে একলা জেগে রয়। স্মৃতির ভারে সে পিষ্ট হয়, ঘুমাতে পারে না। আর ঘুম-না-আসার সুযোগে তার মনে পড়ে আরও কত ফেলে-আসা…। সোনার শৈশব আর ভুল করে দেখা টলমল স্বপ্নটি আমাদের সকলেরই স্বপ্ন, যাকে আমরা কোনোদিন ছুঁতে পারিনি। এই ছুঁতে-না-পারার বেদনা যে-নির্জন মুহূর্তে আমাদের পোড়ায়-কাঁদায়, লোকটা সেই নির্জন মুহূর্তই।
সে বর্তমানকে দেখে কবির চোখে আর ভেতরে যাপন এক জাতিস্মরকে। তার খালি মনে পড়ে, মনে পড়ে। সে আমাদের যাপন-না-করে-আসা-জীবনের মেটাফর!! গণিতের বিপরীতে সে গান আর ব্যাংকারের বিপরীতে স্মৃতির আধার। যে-আধার জীবন্ত-চঞ্চল, এবং জীবনবিমুখ আর মৃ্ত্যুমুখি। মৃত্যুমুখি মানুষ তো বাবা-মা’র কাছে পাগলই! তাই না? তাই তো বাবা-মা’র করুণা সে পায়। ভিজে যায় বাবার চোখ। আহা ছেলেটা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক জীবন বলে হয়তো মনে হয় বাবার, মা’রও।
কিন্তু তার ভ্রূক্ষেপ নাই সচল জীবনগঙ্গার দিকে। সে বসে আছে যেন হেরাক্লিটাসের সেই নদীর জলে স্নান করবার আশায় যা চলে গেছে গভীর-বিপুল উজানে, দূর উজানে।।
তাই তো তার খালি মনে হয়, ‘পাতাবাহারের ছায়া লুফে নিয়ে পালিয়ে গেলো দুটো ফক্সওয়াগন’, এই ফক্সওয়াগন কি কোনো রূপক? যন্ত্র-সভ্যতার? আমাদের তাই মনে হয়। প্রাকৃত-পৃথিবীর ছায়া তো লুটে নিছে এই সব ফক্সওয়াগনের গতি-ধোঁয়া আর অহং!! ফক্মওয়াগন চড়েই আমরা চলে গেছি সোনার শৈবব ফেলে অন্ধ ভবিতব্যের দিকে। কিন্তু লোকটার, মেমোরি-মর্মরিত লোকটার খালি মনে হয়, ‘আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।’ আম্মার ঘরেই তো আমরা ফেলে এসেছি আমাদের সোনার জীবন! যেদিন মা-হীন একলা বিছানায় শুতে আরম্ভ করলো মানুষ সেদিনই তো সে ফেলে এসেছে তার স্বর্গের জীবন। আর প্রবেশ করেছে বর্বর পৃথিবীতে যেখানে খালি সময় চলে যায়, স্বপ্ন টুপ করে ঝরে পড়ে অতল গঙ্গার জলে। আর ‘লোকে ভুলে যায়, সহজেই ভোলে’। কিন্তু সে ভুলতে পারে না। ভুলতে-না-পারার অপরাধে তার আরো বেশিবেশি মনে পড়ে ‘আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।’ আম্মার ঘরটাকে তাই মাঝে মাঝে বিপুল এক অতীত মনে হয়, যেখানে সময় নাই, কিন্তু স্বপ্ন পড়ে আছে ডাঙার মাছের মতো।
তাই তার কাছে ‘বকুল পাতার নিঃশ্বাস বড়ো শূন্য মনে হয়।’ মনে হয়, ‘ল্যাম্পোস্টে ভিজে আলোয় ইলেক্ট্রিক তারের ওপর সার বেঁধে জ্বলতে-থাকা বৃষ্টির শিশির, … একপলক পর পর গানের টুকরোর নিচে ঝড়ে পড়ছে।’ মনে হয় ‘কাজলা দিদি এই তারের মধ্যে দিয়ে কোথায়, কার বাল্বে জ্বলে উঠছে? কোথায়?’ তার কাজলা দিদির জন্য মন খারাপ হয়। সে বাস্তবিকই যেন ফিরে যায় অতীতে। আম্মার ঘরে। গিয়ে সে কী দেখে? দ্যাখে : ‘দেওয়ালে কোনোদিন-উড়বে-না তুলোর শাদা প্রজাপতি ও সবুজ সুতোর প্রেমিক ময়ুর দম্পতি লালচে হয়ে গিয়েছে।’
জাদুঘরের স্মৃতি আর মাথার স্মৃতি কি এক? না। তাই সে কিছুই পেলো না তার আম্মার ঘরে। নিজের ঘরে ফিরে সে ভেড়া গুণে গুণে ক্লান্ত হয় না, বরং ভেড়া-চরা মাঠের স্মৃতি তাকে আরো নস্টালজিক করে তোলে, তার মনে পড়ে : ‘কোথায় যেনো আমি এমনি একটা মাঠ দেখেছি। সেই মাঠের একদিকে ধূসর রঙের পাহাড়, দীর্ঘ একজন মানুষ পাহাড়ের বিপরীত দিকে হাজার হাজার ভেড়ার পেছনে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবে দেখেছি? কবে? কোন জন্মে?’
কার এমন মনে হয়? কবি আর স্মৃতিচারি মানুষ ছাড়া কে দেখতে পারে যে, বিদ্যুতের তার থেকে গানের টুকরার মতো বৃষ্টির শিশিরের ঝরে-পড়া, আর ওই তারের ভিতর দিয়ে কারও বাল্বে জ্বলে-ওঠার জন্য কাজলা দিদির যাওয়া, কে ভাবতে পারে? একজন্মে দাঁড়িয়ে কে মনে করতে পারে আরো আরো জন্মের স্মৃতি? এ-এক আশ্চর্য আর মহাকাব্যিক মানুষ, ইলিয়াসের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে, আর ক্লান্ত করে। আমাদের মনে পড়ে জীবনানন্দের ‘বিপন্ন বিস্ময়’র কথা। ইলিয়াসের ভেতরের ওই লোকটারও রক্তে এক বিপন্ন বিস্ময়, এক মহাজাগতিক বেদনা, কসমিক স্বপ্নের আলোড়ন।
সে ঘুমাতে পারে না। বরং ‘ফায়ার ব্রিগেডের লাল রঙের দ্রুতশ্বাস গাড়ি’ তাকে বাইরে নিয়ে আসে। তার ভয় করে তবু সে যায়। চলে আসে রাস্তায়। তার মনে পড়ে নিশ্চিন্তপুরের মাঠ, মনে পড়ে দিদি দুর্গাকে।সে অপু হয়ে যায়। কতকাল আগে দুর্গা মরে গেছে? সে জানে না। তার মনে পড়ে না। রাস্তার পুলিশ এগিয়ে এলে মনে হয় পুলিশ নয়, দুর্গা। পুলিশরূপী দুর্গা তাকে মনে করিয়ে দেয় তার পিতার জীবন। আর সঙ্গে সঙ্গে পিতার জীবনকেও যাপন করাবর ইচ্ছে তার মনে জাগে। সে বলে ওঠে: এইসব দিন আমার জন্মের কতো আগে মিশে গিয়েছে। এদের জন্যে আমার এমন করে কেন? আব্বার রক্তের সঙ্গে এই দিনগুলো কি আমার শরীরে উজান বয়ে এলো? আমার ভারি ইচ্ছে করে একবার এদের ছুঁয়ে দেখি।
একজীবনে সে যাপন করতে চায় কত কত জীবন, জীয়ন! পৃথিবীর সকল বয়সকে সে করে নিতে চায় তার নিজের বয়স। সকল জীবনকে সে করে নিতে চায় তার আত্মজীবন। তার ‘… একটুও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। মাথা নিচু করে সামনে তাকিয়ে রঞ্জু অন্ধকারের পানে পা বাড়ালো।’ যেতে যেতে শহরের শেষে, এসে দাঁড়ায় এমন এক মাঠের সামনে, যে-মাঠে, তার মনে হয় : ‘এক হাজার নয়শো তেতাল্লিশ বছর আগে আমার বন্ধুরা এখানে ক্রিকেট খেলতো। আমি নদীর তীরে বসে, মাঝে মাঝে ওদের দিকে, কখনো নদীর পানে চেয়ে সময় ও বিষাদ কাটিয়েছি।’
বন্ধুদের হারিয়ে না-পাওয়া ক্রিকেট বলের মতো সেও যেন কোথায় কি হারিয়ে এসেছে, তার মনে হয় আর এলোমেলো শুয়ে পড়ে সে নদীর ধারের মাঠের কাছের বড় শিমুলগাছের তলায়, ‘নদীর জলে উন্মুখ কান পেতে।’
মেমোরি-মর্মরিত ছেলেটি শুয়ে শুয়ে খুঁজতে থাকে সে কি যেনো হারিয়ে এসেছে। কী হারিয়ে এসেছে সে? আমরা জানতে পারি না কারণ, ‘প্রবলরকম ঝড় হইতে শুরু করেছিলো। … ‘এমন সময় শিমুল গাছের মস্ত একটা ডাল’, তার মনে হলো, ‘আমার ওপর, আমার বুকের মধ্যে, কালো, অন্ধকার ও ভারী কোনো নিরাকার নিশ্বাস স্থায়ী আশ্রয় নিয়েছে।’
গত জনমের জন্য কাঙাল বিরল বিপুল স্মৃতিকাতর কবির স্বভাবী এক মধ্যবিত্ত যুবক বর্তমান জীবন-গড্ডালিকা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে যাওয়ার অপরাধে শিমুলডালের ভেঙে-পড়ার নিচে লীন হয়ে যায়। হয়ে-যাওয়া ঠিক? ঠিকই তো। কারণ সে কবির চোখে পৃথিবীরে দেখে আর খোঁজে গত জনম, গত গত জনম। মরবেই তো। কেন সে গড্ডলপ্রবাহে ভাসেনি। এই তার অপরূপ অপরাধ।
তার হারানো আর খুঁজে-ফেরা বস্তুটির নাম কী মহাজীবন?
সে কী রামপ্রসাদকে চিনতো? গাইতো, মানবজমিন রইলো পতিত আবাদ কররে ফলতো সোনা/মনরে কৃষিকাজ জানো না?
........................
লেখক পরিচিতি
মুহম্মদ ইমদাদ।কবি ও কথাসাহিত্যিক।
জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৭৮। মৌলভীবাজার।
‘অন্ধ পৃথিবীর জানলাগুলি’ তাঁর প্রথম কবিতার বই।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৬।
লেখালেখিকেই জীবনের অভিপ্রায় বলে মনে করেন।
মুহম্মদ ইমদাদ
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের নাম ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। এই গল্প পড়ে জানা গেল- তার ভেতর বাস করে একজন কবি। এমন এক কবি, যিনি কখনো কবিতা লিখেন না। কিন্তু কবির চোখেই দেখেন তার আশপাশ, চারিপাশ।আর কবি মানেই তো ফিরতে চাইবে এমন একটি কালে যেখানে ফেরা যায়, তবু চাইবে, অর্থাৎ সে খুব নস্টালজিয়া-আক্রান্ত।
ইলিয়াস নিজে অবশ্য বলতেন তার ভেতর বাস-করা ওই লোকটা পাগল। কিন্তু আমাদের কাছে তাকে পাগল মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে কবি। একজন কবির যা-বৈশিষ্ট্য সবই ইলিয়াসের অন্তর্গত ওই লোকটার মাঝে লক্ষ্য করা যায়, আমরা তা-ই করি। গল্পটা পড়ে এসে এখন আপনি যদি বলেন, ‘কেমনে বুঝলেন লোকটা কবি?’ তাহলে আমরা উত্তর দেবো। তার গল্প থেকেই তুলে দেবো এমন কিছু পঙক্তি-প্যারাগ্রাফ, যা আসলে কবির কাজ, অর্থাৎ কবিতা।
এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো।…
আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারেরর ভিজে
গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো
লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি
কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে
আমার ঘুম আস না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস।
মনোরম মনোটোনাস শহর, রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধ, বিষাদবর্ণ দেওয়াল, ছমছম করা রাত্রি, লোনলী-লগ্ন, বৃষ্টি-বুনোট রাত, সর্বোপরি বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস- কে বলতে পারে
এই সব অভাবিত বিশেষণ, বিশেষণের মধ্যে সৃষ্টি করে অভাবিত অনুপ্রাস? লক্ষ করার বিষয় বাংলা-ইংরেজি শব্দের মধ্যে অনুপ্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং বিশেষণগুলি সাধারণ বিশেষণ নয় বরং এক-একটি ছবি যেন, যা আগে কখনো দেখিনি আমরা। দেখেছেন বিষাদবর্ণ দেওয়াল? লোনলী-লগ্ন কখনো? বৃষ্টিকে কখনো মনে হয়েছে ‘সে তো বৃষ্টি নয়, একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস?’ বৃষ্টি আর দীর্ঘশ্বাসকে যিনি ব্যক্তি ভাবতে পারেন, তিনি কবি ছাড়া আর কী? কবিই তো!
এই কবিটি অর্থনৈতিক ভাবে সমাজের যে-স্তরে বাস করে তার নাম আমরা দিয়েছিলাম ‘মধ্যবিত্ত’। তাই সে শিক্ষিত। শহুরে। মনে পড়ে তার মা-বাবা মিলে সিনেমা দেখতে যেতেন। কখনো-সখনো ভাইবোনসহ বাবা ‘টারজান’ দেখাতে তাকেও নিয়ে যেতেন। এ-কারেণে আমরা বুঝতে পারি সে স্মৃতিকাতরও মানে নস্টালজিয়া-অক্রান্ত। কবিত্ব আর নস্টালজিয়া তাকে তাই বৃষ্টিরাতে পড়তে দেয় না কিছু ‘সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্ত-কাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের।’ তার ‘চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়।’ ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলে ভিজে আলো। আর মনে পড়তে থাকে তার, না, এই মনে-পড়া সাধারণ মনে-পড়া নয়, তার চিনচিন করে ওঠে স্মৃতি, সাতটি রবীন্দ্রসংগীত শোনার স্মৃতি, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’র স্মৃতি। আর ‘সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে’ তার স্মৃতির সায়রে, ঘুমাতে পারে না, সে আলোর মধ্যে একলা জেগে রয়।
আলোর মধ্যে একলা জেগে-থাকা লোকটা কি পাগল? না আমাদের তা মনে হয় না। বরং তাকে মনে হয় এক স্মৃতির কৌঠা। এই পৃথিবীর আর এই পৃথিবীতে বাস-করা সব মানুষের অতীতকে নিয়ে সে যেন বসে আছে একলা। সে যেন সেই কালখণ্ড যাকে আমরা যাপন করে এসেছি কিন্তু মনে রাখতে পারিনি। পারি না। আর কালখণ্ডটি ধানের শীষে শিশিরবিন্দুর মতো আমাদের অতি কাছে বসে অবলোকন করে আমাদের। আমরা স্মার্টলি ‘পাস্ট ইজ পাস্ট’ বলে বেমালুম ভুলে থাকি তাকে, ফলে সে একলা হয়, আলোতে একলা জেগে রয়। স্মৃতির ভারে সে পিষ্ট হয়, ঘুমাতে পারে না। আর ঘুম-না-আসার সুযোগে তার মনে পড়ে আরও কত ফেলে-আসা…। সোনার শৈশব আর ভুল করে দেখা টলমল স্বপ্নটি আমাদের সকলেরই স্বপ্ন, যাকে আমরা কোনোদিন ছুঁতে পারিনি। এই ছুঁতে-না-পারার বেদনা যে-নির্জন মুহূর্তে আমাদের পোড়ায়-কাঁদায়, লোকটা সেই নির্জন মুহূর্তই।
সে বর্তমানকে দেখে কবির চোখে আর ভেতরে যাপন এক জাতিস্মরকে। তার খালি মনে পড়ে, মনে পড়ে। সে আমাদের যাপন-না-করে-আসা-জীবনের মেটাফর!! গণিতের বিপরীতে সে গান আর ব্যাংকারের বিপরীতে স্মৃতির আধার। যে-আধার জীবন্ত-চঞ্চল, এবং জীবনবিমুখ আর মৃ্ত্যুমুখি। মৃত্যুমুখি মানুষ তো বাবা-মা’র কাছে পাগলই! তাই না? তাই তো বাবা-মা’র করুণা সে পায়। ভিজে যায় বাবার চোখ। আহা ছেলেটা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক জীবন বলে হয়তো মনে হয় বাবার, মা’রও।
কিন্তু তার ভ্রূক্ষেপ নাই সচল জীবনগঙ্গার দিকে। সে বসে আছে যেন হেরাক্লিটাসের সেই নদীর জলে স্নান করবার আশায় যা চলে গেছে গভীর-বিপুল উজানে, দূর উজানে।।
তাই তো তার খালি মনে হয়, ‘পাতাবাহারের ছায়া লুফে নিয়ে পালিয়ে গেলো দুটো ফক্সওয়াগন’, এই ফক্সওয়াগন কি কোনো রূপক? যন্ত্র-সভ্যতার? আমাদের তাই মনে হয়। প্রাকৃত-পৃথিবীর ছায়া তো লুটে নিছে এই সব ফক্সওয়াগনের গতি-ধোঁয়া আর অহং!! ফক্মওয়াগন চড়েই আমরা চলে গেছি সোনার শৈবব ফেলে অন্ধ ভবিতব্যের দিকে। কিন্তু লোকটার, মেমোরি-মর্মরিত লোকটার খালি মনে হয়, ‘আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।’ আম্মার ঘরেই তো আমরা ফেলে এসেছি আমাদের সোনার জীবন! যেদিন মা-হীন একলা বিছানায় শুতে আরম্ভ করলো মানুষ সেদিনই তো সে ফেলে এসেছে তার স্বর্গের জীবন। আর প্রবেশ করেছে বর্বর পৃথিবীতে যেখানে খালি সময় চলে যায়, স্বপ্ন টুপ করে ঝরে পড়ে অতল গঙ্গার জলে। আর ‘লোকে ভুলে যায়, সহজেই ভোলে’। কিন্তু সে ভুলতে পারে না। ভুলতে-না-পারার অপরাধে তার আরো বেশিবেশি মনে পড়ে ‘আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।’ আম্মার ঘরটাকে তাই মাঝে মাঝে বিপুল এক অতীত মনে হয়, যেখানে সময় নাই, কিন্তু স্বপ্ন পড়ে আছে ডাঙার মাছের মতো।
তাই তার কাছে ‘বকুল পাতার নিঃশ্বাস বড়ো শূন্য মনে হয়।’ মনে হয়, ‘ল্যাম্পোস্টে ভিজে আলোয় ইলেক্ট্রিক তারের ওপর সার বেঁধে জ্বলতে-থাকা বৃষ্টির শিশির, … একপলক পর পর গানের টুকরোর নিচে ঝড়ে পড়ছে।’ মনে হয় ‘কাজলা দিদি এই তারের মধ্যে দিয়ে কোথায়, কার বাল্বে জ্বলে উঠছে? কোথায়?’ তার কাজলা দিদির জন্য মন খারাপ হয়। সে বাস্তবিকই যেন ফিরে যায় অতীতে। আম্মার ঘরে। গিয়ে সে কী দেখে? দ্যাখে : ‘দেওয়ালে কোনোদিন-উড়বে-না তুলোর শাদা প্রজাপতি ও সবুজ সুতোর প্রেমিক ময়ুর দম্পতি লালচে হয়ে গিয়েছে।’
জাদুঘরের স্মৃতি আর মাথার স্মৃতি কি এক? না। তাই সে কিছুই পেলো না তার আম্মার ঘরে। নিজের ঘরে ফিরে সে ভেড়া গুণে গুণে ক্লান্ত হয় না, বরং ভেড়া-চরা মাঠের স্মৃতি তাকে আরো নস্টালজিক করে তোলে, তার মনে পড়ে : ‘কোথায় যেনো আমি এমনি একটা মাঠ দেখেছি। সেই মাঠের একদিকে ধূসর রঙের পাহাড়, দীর্ঘ একজন মানুষ পাহাড়ের বিপরীত দিকে হাজার হাজার ভেড়ার পেছনে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবে দেখেছি? কবে? কোন জন্মে?’
কার এমন মনে হয়? কবি আর স্মৃতিচারি মানুষ ছাড়া কে দেখতে পারে যে, বিদ্যুতের তার থেকে গানের টুকরার মতো বৃষ্টির শিশিরের ঝরে-পড়া, আর ওই তারের ভিতর দিয়ে কারও বাল্বে জ্বলে-ওঠার জন্য কাজলা দিদির যাওয়া, কে ভাবতে পারে? একজন্মে দাঁড়িয়ে কে মনে করতে পারে আরো আরো জন্মের স্মৃতি? এ-এক আশ্চর্য আর মহাকাব্যিক মানুষ, ইলিয়াসের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে, আর ক্লান্ত করে। আমাদের মনে পড়ে জীবনানন্দের ‘বিপন্ন বিস্ময়’র কথা। ইলিয়াসের ভেতরের ওই লোকটারও রক্তে এক বিপন্ন বিস্ময়, এক মহাজাগতিক বেদনা, কসমিক স্বপ্নের আলোড়ন।
সে ঘুমাতে পারে না। বরং ‘ফায়ার ব্রিগেডের লাল রঙের দ্রুতশ্বাস গাড়ি’ তাকে বাইরে নিয়ে আসে। তার ভয় করে তবু সে যায়। চলে আসে রাস্তায়। তার মনে পড়ে নিশ্চিন্তপুরের মাঠ, মনে পড়ে দিদি দুর্গাকে।সে অপু হয়ে যায়। কতকাল আগে দুর্গা মরে গেছে? সে জানে না। তার মনে পড়ে না। রাস্তার পুলিশ এগিয়ে এলে মনে হয় পুলিশ নয়, দুর্গা। পুলিশরূপী দুর্গা তাকে মনে করিয়ে দেয় তার পিতার জীবন। আর সঙ্গে সঙ্গে পিতার জীবনকেও যাপন করাবর ইচ্ছে তার মনে জাগে। সে বলে ওঠে: এইসব দিন আমার জন্মের কতো আগে মিশে গিয়েছে। এদের জন্যে আমার এমন করে কেন? আব্বার রক্তের সঙ্গে এই দিনগুলো কি আমার শরীরে উজান বয়ে এলো? আমার ভারি ইচ্ছে করে একবার এদের ছুঁয়ে দেখি।
একজীবনে সে যাপন করতে চায় কত কত জীবন, জীয়ন! পৃথিবীর সকল বয়সকে সে করে নিতে চায় তার নিজের বয়স। সকল জীবনকে সে করে নিতে চায় তার আত্মজীবন। তার ‘… একটুও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। মাথা নিচু করে সামনে তাকিয়ে রঞ্জু অন্ধকারের পানে পা বাড়ালো।’ যেতে যেতে শহরের শেষে, এসে দাঁড়ায় এমন এক মাঠের সামনে, যে-মাঠে, তার মনে হয় : ‘এক হাজার নয়শো তেতাল্লিশ বছর আগে আমার বন্ধুরা এখানে ক্রিকেট খেলতো। আমি নদীর তীরে বসে, মাঝে মাঝে ওদের দিকে, কখনো নদীর পানে চেয়ে সময় ও বিষাদ কাটিয়েছি।’
বন্ধুদের হারিয়ে না-পাওয়া ক্রিকেট বলের মতো সেও যেন কোথায় কি হারিয়ে এসেছে, তার মনে হয় আর এলোমেলো শুয়ে পড়ে সে নদীর ধারের মাঠের কাছের বড় শিমুলগাছের তলায়, ‘নদীর জলে উন্মুখ কান পেতে।’
মেমোরি-মর্মরিত ছেলেটি শুয়ে শুয়ে খুঁজতে থাকে সে কি যেনো হারিয়ে এসেছে। কী হারিয়ে এসেছে সে? আমরা জানতে পারি না কারণ, ‘প্রবলরকম ঝড় হইতে শুরু করেছিলো। … ‘এমন সময় শিমুল গাছের মস্ত একটা ডাল’, তার মনে হলো, ‘আমার ওপর, আমার বুকের মধ্যে, কালো, অন্ধকার ও ভারী কোনো নিরাকার নিশ্বাস স্থায়ী আশ্রয় নিয়েছে।’
গত জনমের জন্য কাঙাল বিরল বিপুল স্মৃতিকাতর কবির স্বভাবী এক মধ্যবিত্ত যুবক বর্তমান জীবন-গড্ডালিকা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে যাওয়ার অপরাধে শিমুলডালের ভেঙে-পড়ার নিচে লীন হয়ে যায়। হয়ে-যাওয়া ঠিক? ঠিকই তো। কারণ সে কবির চোখে পৃথিবীরে দেখে আর খোঁজে গত জনম, গত গত জনম। মরবেই তো। কেন সে গড্ডলপ্রবাহে ভাসেনি। এই তার অপরূপ অপরাধ।
তার হারানো আর খুঁজে-ফেরা বস্তুটির নাম কী মহাজীবন?
সে কী রামপ্রসাদকে চিনতো? গাইতো, মানবজমিন রইলো পতিত আবাদ কররে ফলতো সোনা/মনরে কৃষিকাজ জানো না?
........................
লেখক পরিচিতি
মুহম্মদ ইমদাদ।কবি ও কথাসাহিত্যিক।
জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৭৮। মৌলভীবাজার।
‘অন্ধ পৃথিবীর জানলাগুলি’ তাঁর প্রথম কবিতার বই।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৬।
লেখালেখিকেই জীবনের অভিপ্রায় বলে মনে করেন।
0 মন্তব্যসমূহ