সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা তারাপদ রায়ের চিঠি

কবি তারাপদ রায় ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও রসরচনাকার। তিনি ‘নক্ষত্র রায়’ ও ‘গ্রন্থকীট’ ছদ্মনামেও লিখতেন। তিনি অধুনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় ১৭ নভেম্বর, ১০৩৬ সালে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি বাংলাদেশেই মেট্রিক পাশ করেন বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৫১ সালে তিনি কলকাতায় চলে যান । তিনি কলকাতার সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) অর্থনীতিতে লেখাপড়া করেন। কিছুকাল তিনি উত্তর ২৪ পরগণার হাবড়ার একটি স্কুলে শিক্ষকাতও করেন।


তিনি ‘পূর্বমেঘ’ (১৯৫৭), ‘কয়েকজন’ (১৯৬৮) প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন । তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার প্রতিমা’ ১৯৫৮ সালে (মতান্তরে ১৯৬০) প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ছিলাম ভালবাসার নীল পতাকাতে স্বাধীন’ (১৯৬৭), ’কোথায় যাচ্ছেন তারাপদ বাবু’ (১৯৭০), ’নীল দিগন্ত এখন ম্যাজিক’ (১৯৭৪), ‘পাতা ও পাখিদের আলোচনা’ (১৯৭৫), ’ভালবাসার কবিতা’ (১৯৭৭), ‘দারিদ্ররেখা’ (১৯৮৬), ‘দুর্ভিক্ষের কবিতা’, জলের মত কবিতা’ (১৯৯২), ‘দিন আনি দিন খাই’ (১৯৯৪), ’টিউবশিশুর বাবা’ (১৯৯৫), ‘ভাল আছো গরীব মানুষ’ (২০০১), ‘কবি ও পরশিল্পী’ (২০০২) ইত্যাদি।

তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘কান্ডজ্ঞান’, ‘জ্ঞানগম্যি’, ’ডোডো তাতাই পালাকাহিনী’, ’স্বনির্বাচিত তারাপদ রায়’, ‘ছাড়াবাড়ি পোড়াবাড়ি’, ‘বালিশ’ ইত্যাদি।

কথাভঙ্গি এবং পরিহাস বিদ্রুপ মিশ্রিত বাকধারার সমন্বয়ে বাংলা কবিতায় এক স্বাতন্ত্র অর্জন করেছেন। শিশুসাহিত্য রচনাতেও তিনি নিপূণ। ডোডো তাতাই তাঁর প্রতিভার নিদর্শন। শিরোমণি পুরষ্কার এবং কথা পুরষ্কারে (১৯৯৫) তিনি ভুষিত হয়েছিলেন।

২৫ আগস্ট, ২০০৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি লেখায় এত উৎসাহী ছিলেন যে, তিনি হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শুয়েও জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লিখে গেছেন।

তারাপদ রায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের সঙ্গে কীর্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন শক্তি, সুনীল, সন্দীপনদের সঙ্গে। সুনোল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠির মধ্যে দুটো চিঠি এখানে প্রকাশিত হল।

প্রথম চিঠিটি লিখেছেন ১৯৬৩ সালে। মার্চ মাসের ১৩ তারিখে। তখন বসন্ত কাল। কিন্তু কোথা থেকে চিঠিটি লিখেছেন সেটা উল্লেখ নেই। ছোটো চিঠি। সাধুভাষায় রচিত। কয়েকটি বিয়ে বাড়ির উল্লেখা আছে একটি বাক্যে। কিন্তু তারাপদ বোধ হয় তখন সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন।

পরের চিঠিটা লিখেছেন টাঙ্গাইল থেকে। সেটা ১৯৬৫ সাল। এটাও মার্চ মাসের চিঠি। তারিখটি ১৩ নয়—১৬। বসন্ত কাল। এবারেও তারাপদ অসুস্থ। মৌমাছির হুলের যন্ত্রণা বোধ করছেন। তখনো পাক-ভারত যুদ্ধ লাগে নি। চিঠিতে তারপদর বোনের বিয়ের কথা উল্লেখ আছে। চিঠিটি চলতি ভাষায় লেখা।



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা তারাপদ রায়ের চিঠি
১৩/৩/১৯৬৩

গাঙ্গুলি মশায়,

রক্তকষায় নেত্র, বিস্ফোরিত গণ্ডদেশ, সদ্য প্রস্ফুটিত শারদ প্রভাতকালের কমল কোরক বর্ণতুল্য অধরমহিমা—আমাকে দেখিলে আর হয়তো চিনিতে পারিবেন না যদি না ঈশ্বরের ইচ্ছায় ‘পুনর্মানবো ভব’ না হই।

শক্তি, উৎপল বা আর কাহারো সহিত কি আপনার দেখা হইয়াছে, যদি হইয়া থাকে সমস্ত শ্রুতিগোচর করিবেন।

দুরন্ত বসন্ত কাল। আশেপাশে অন্ততঃ দশটি বাটিতে বিবাহ-উৎসবে সারা দুপুর মাইক বাজিতেছে। মুখে মাফ্লার বাঁধিয়া কম্বল মুড়ি দিয়া শুইয়া শুইয়া মন উদাস হইয়া উঠিয়াছে। প্রাইভেট কবিত্বের এতবড় অবসর জীবনে আর মেলে নাই।

প্রীতি জানিবেন।



ইতি

তারাপদ রায়



টাঙ্গাইল, ১৬/৩/৬৫

গাঙ্গুলিমশায়,

এসে অবধি ভাবছি তোমাকে চিঠি লিখবো। কিন্তু চিঠি তো কবিতা নয় যে ইচ্ছে হলেই বসে লেখা যায়। চিঠি লিখতে হলে মনের বা প্রয়োজনের তাগিদ দরকার, জানানোর মতো মালমশলা দরকার, সে তো আর কবিতা লেখাত মতো ফাঁকা আরাম নয় যে বস্লাম আর পনেরো মিনিটের মধ্যে ভালোমন্দ দশবিশ লাইন হয়ে গেলো।

এই পর্যন্ত এক প্যারা বানিয়ে ভালোই লিখেছি মনে হচ্ছে। এখন দুএক্টা নীরস সংবাদ দিতে পারি। মধ্যে চৌদ্দদিন যাকে বলে মনে হচ্ছিলো সারা শরীরে যেম পঁচিশটা মৌমাছির চাঁক বসেছে। বর্তমানে ভালো হয়ে গেছি তবে একেবারে চিতাবাঘের মতো, পাকা কাঁঠালের মতো চিত্রবিচিত্র হয়ে গেছি। ইচ্ছে হলে নিজেকে এখন সচিত্র তারাপদ রায় বলে বিজ্ঞাপিত করতে পারি।

তোমাদের নাটক এতদিনে হয় মঞ্চস্থ হয়েছে না হয় বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টাই স্বাভাবিক। আমি মধ্যে মধ্যে অবাক হই কয়েকজন মধ্যবয়সী যুবক যাদের সংসার, সাহিত্য, সামাজিকতা আর আড্ডা দিয়ে আর কোনো সময়ই হাতে থাকা উচিত নয়, সম্ভবত নয়, তারা কি করে এরকম একটা নাটকের মহড়া দেয়ার সময় পাচ্ছে। যে নাটক তাদের কারোরই লেখা নয়। একশো বছরের পুরনো রদ্দি নাটকের অনুবাদ মাত্র। নাটক যাদের ক্রিয়াকর্ম, স্বপ্ন ধর্ম তারা এ নিয়ে উৎসাহ বোধ করতে পারে, কিন্তু তোমরা, তোমাদের পক্ষে এ একেবারেই অবাস্তব বলে আমার ধারণা।

মীনাক্ষী বহু উৎসাহ নিয়ে এ নাটকের অনুবাদ করেছেন, আমি দুদিন মহড়ায় গিয়েছি। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও মহোৎসাহী। সুতরাং এ অবস্থায় আমি আগের অংশে যা লিখেছি সেটা নিতান্তই ব্যক্তিগত, একমাত্র তোমাকেই জানবার জন্যে জানালাম।

কৃত্তিবাস নিশ্চয় এতদিন বেরিয়ে গেছে। আজকাল বিশেষ করে এখানে এসে নির্জন স্ববাসে মধ্যে মধ্যে ভাবি আমি তোমাদের থেকে অনেক দূর হয়ে গেছি। সেই হৈ-হট্টগোল, রাত বারোটায় বাড়ি ফেরা আমি তার কোথাও রইলাম না। আমি কি হেরে গেলাম?

কিছু কিছু কবিতা লিখেছি। কিন্তু কোথায় সেই সপ্তপদশ আশ্বারোহী, সব কিছু কেমন তাল্গোল পাকিয়ে গেলো।

কণা’র বিয়ের সময় আমি কলকাতাতেই ছিলাম, তুমি জানতে না। আগে বন্ধুদের পারিবারিক, ব্যক্তিগত বহু ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ অংশীদারিত্ব ছিলো সেটাও বোধ হয় এতদিনে গেছে।

দিন বড় তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। কেমন বেমালুম মিশে গেলাম আরেক জীবনে। কিন্তু সত্যিই কি মিশে গেলাম? হয়তো তোমাদের সঙ্গেই রয়ে গেলাম। মনে মনে। নিজের অজ্ঞাতসারে এতদিন গ্রুপফটোর মধ্যে মুখ গলিয়ে দিয়েছিলাম এতদিনেও কি বার করে নিতে পেরেছি। ইচ্ছা-অনিছায় তোমাদের উদ্দামতায় সঙ্গী হয়েছিলাম, পরে বুঝেছি এই উদ্দাম জীবনে আমার মত স্বপ্নপ্রাণ, কাপুরুষের অধিকার একেবারেই নেই। তাই মানে মানে বিদায় নিতে চেয়েছি।

বিদায় কি সত্যিই নেওয়া হয়েছ?

তোমরা নিশ্চয়ই ভালো আছ।

আমি এই মার্চ মাসের মধ্যেই কলকাতা ফিরছি।

নিশ্চয়ই তখন দেখা হবে।



ইতি



তারাপদ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ