হাসান আহমদ-এর ভিন্ন গদ্য-- এক জোড়া মেঘ-রঙের বুনোহাঁস


যতবারই আমি মরতে-মরতে বেঁচে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, ততবারই আমি প্রত্যয়ন করেছি, এবার যেহেতু আরেকটা জীবন পেলাম- ঈশ্বরের করুণায় হোক কিংবা নিতান্তই ভাগ্যের কোপে- জীবনটাকে এমনি-এমনি বৃথা যেতে দেবোনা। কল্পনায় দেখতে পেতাম একটা নীল জলাশয়- বিশাল।
দিগন্তজোড়া। দূরে- দেখতে পেতাম, জলাশয়টি ঢেউয়ের প্রাবল্যে কাঁপতে-কাঁপতে, আবেগে, যে-কোনো নতুন প্রেমিক-প্রেমিকার প্রথম আলিঙ্গনের মত করছে কোলাকুলি আকাশের সাথে। কখনো-কখনো দেখতে পেতাম, তাদের আলিঙ্গনের ভেতর থেকে ডানা ঝাপ্টিয়ে হুটহাট বেরিয়ে আসছে একজোড়া মেঘ-রঙের বুনোহাঁস। একইরকম হুটহাট করে তাঁরা হারিয়ে যেত নলখাগড়ার বনে। আমি প্রত্যয়ন করতাম, এমনই একটা নীল জলাশয়ের প্রান্ত-রেখার প্লাবন-ভূমিতে আমি নির্মাণ করবো একটা বাড়ি- ঢেউয়ের ওপর- সূর্যাস্ত-মুখো। বিকেল হলে আঙ্গিনায় পাতা রকিং চেয়ারে বসে সিগ্রেট খাবো। হংসমিথুন দেখবো। একহাতে থাকবে কফির মগ। ঢেউয়ের প্রতিক্রিয়ায় পেয়ালা থেকে ছলকে-ছলকে ওঠবে কফি। আর আমি টানতে থাকবো সিগ্রেট আর পান করতে থাকবো কফি আর রচনা করতে থাকবো জীবন।

মরে যেতে আমার আপত্তি থাকতোনা যদি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার পর কষে একটা থাপ্পড় দিতে পারতাম- মৃত্যুর গালে!

কিন্তু জীবন আমাকে অযাচিত ভাবে টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর মুখোমুখি। ঝগড়াটে প্রতিবেশিনীর মত। আর খুলে দেয় চোখের সামনে একটার পর একটা অমোঘ পর্দা। সেখানে ভেসে ওঠে নানারকমের মৃত্যুর চালচিত্র। সেখানে আমি দেখতে থাকি ইভান ইলিচের মৃত্যু। ওহ! কী ভীষণ নরক যন্ত্রণা থেকে মৃত্যু তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলো। আমি দেখতে থাকি পতঙ্গে পরিণত হওয়া গ্রেগর শামসার মৃত্যু। একটা ভীষণ অর্থহীন ও গর্দভের মত বয়ে বেড়ানো জীবনের জোয়াল থেকে মৃত্যু যাকে পরিত্রাণ করেছিলো। এমনকি আমি দেখতে থাকি, দাশ-বুট সিনেমার সেই যুবক সৈনিকটিকে; যুদ্ধে যাওয়ার অনুশীলনে ব্যর্থ হয়ে যে আত্মহত্যা করেছিল আর নিজেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল টয়লেটের কমোডের ওপর আর অনাগত যুদ্ধের গ্লানি থেকে পেয়েছিলো মুক্তি!

আহা, কখনো কখনো মৃত্যু তোমাকে মুক্তিও দিতে পারে, বটে!
.......................................
লেখক পরিচিতি
হাসান আওরঙ্গজেব মূলত কবি। তার কবিতা বাংলাদেশের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। কিছুটা বোহেমিয়ান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একাডেমিক পড়াশোনায় আপাতত ইতি টানেন, চলে যান জাহাজের নাবিক হতে। কিছুদিন সমুদ্রে কাটিয়ে মাটিতে ফিরে আসেন। মাটি তাকে আর ছাড়ে না, কবিতা তাকে টানে। বর্তমানে চাকরিসূত্রে সিলেটে বাস করছেন। জন্ম চাঁদপুর জেলার কচুয়া গ্রামে, ১৯৮৬ সালে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ