লেখকের বয়স :-বিতর্ক : লেখার জন্য বয়স কোনো বাধা নয়

চারুলতা হক

পালোয়ানী করার জন্য তরুণ বয়সটাই উপযুক্ত সময়। বয়স বাড়তে থাকলে পালোয়ানরা অবসরে চলে যায়। কিন্তু লেখালেখির জন্য এরকম বয়সের কোনো সীমা নেই। ৩০/৪০/৫০/ ৬০ বা সত্তর বছর বয়সেও লেখালেখি শুরু করা যেতে পারে। লেখালেখিতে জনপ্রিয়তা পাওয়া সম্ভব।


আবার প্রথম জীবনে লেখালেখি শুরু করেও অনেকে ব্যর্থ হন। পাঠক-সমালোচকের নজরে পড়েন না। অনেকেই হতাশ হয়ে লেখালেখি ছেড়ে দেন। কিন্তু নিয়মিত চর্চা করে গেলে, আরও ভালো লেখার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা গেলে লেখালেখির উত্তরণ ঘটে।
বিশ্বসাহিত্যে এ রকম অসংখ্য লেখকের উদাহরণ রয়েছে যারা প্রবীণ বয়সেও বেস্ট সেলার হয়েছেন। এ রকম কয়েকজন লেখককে নিয়ে লিখেছেন চারুলতা হক।


ব্রাম স্টোকার (১৮৪৭-১৯১২)

ব্রাম স্টোকার তাঁর জীবদ্দশায় লেখক হিসেবে যতটা পরিচিত ছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশী পরিচিত ছিলেন একজন অভিনেতার সহকারী ও লণ্ডনের লাইসেয়াম থিয়েটারের ম্যানেজার হিসেবে।

জীবনের শুরুতে স্টোকার গণিত বিষয়ে ডিগ্রী লাভ করেন। ডাবলিন ক্যাসেলে এক যুগ প্রায় সিভিল সার্ভিসে চাকরি করেছেন। সে সময়ে তিনি নিয়মিত নাটক দেখতেন। এই নাটক বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা লেখেন সে সময়কার পত্রিকায়। এগুলো তিনি লিখেছেন পারিশ্রমিক ছাড়াই। এই সূত্রেই তিনি অভিনেতা হেনরি ইরভিংএর কাছাকাছি আসেন। তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ইরভিংকে এক পর্যায়ে ড্রাকুলার কিছু অংশ লিখে পড়তে দেন। লেখাটি বিষয়ে তার মতামত চান। ইরভিং ড্রাকুলা লেখাটি পছন্দ করেননি। বলেন, এই ড্রাকুলা থিয়েটারে অভিনয়ের উপযুক্ত নয়।
বছরের পর বছর স্টোকার খুব মনোযোগ দিয়ে থিয়েটারের রিভিউ, বেশ কিছু ছোটো গল্প লেখেন তাঁর কুড়ি থেকে মধ্য তিরিশ বছর বয়সের মধ্যে। তবে তিনি কখনোই পুরোমাত্রায় মন দিয়ে লেখেননি। তেতাল্লিশ বছর বয়সে তিনি লেখেন স্নেকস পাস-নামে উপন্যাস। এই বইটিও পাঠকদের নজরে পড়েনি।
এর ঠিক সাত বছর পরে স্টোকার লেখেন ড্রাকুলা। এই ড্রাকুলাই তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়।


লরা ইঙ্গালস ওয়াইল্ডার (১৮৬৭-১৯৫৭)

প্রেইরি এলাকার একটি ছোটো ঘরে লরা তার চার ভাইবোনসহ বেড়ে উঠেছিলেন। সেই ছেলেবেলাতেই তার বাবা তাদেরকে ছেড়ে চলে যান। তারপর চরম দারিদ্রতার সঙ্গে শুরু হয় এই মেয়েটির নানা লড়াই সংগ্রাম। সাউথ ডাকোটায় ষোল বছর বয়সে তিনি শিক্ষতার পেশা গ্রহণ করেন। এক বেডরুমের ঘর ভাড়া করেন। এর মধ্যে তার বিয়ে হয়। স্বামী ডিপথেরিয়ার শিকার হন। তাদের একটি সন্তান মারা যায়। বাসস্থানটি আগুনে পুড় যায়। খরায় তাদের ক্ষেতের সকল ফসল নষ্ট হয়ে যায়। বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে এর মধ্যে লরা শিক্ষতা করেন, কখনো রেলরোডের খাদ্য সরবরাহকারীর কাজ করেন। আবার কখনোবা পোল্ট্রি ফার্মের দেখাশুনা করেন। জীবনের এ ঘটনাগুলো তিনি কাউকেই বলেননি। এভাবে ষাট বছর পার হয়ে যায় লরার বয়স।
লরার মেয়ে রোজ ওয়াইল্ডার মাকে এইসব ঘটনাগুলোকে লিখতে বলেন। মেয়ের উদ্দীপনায় লরা লিখতে শুরু করেন তার তরুণজীবনের গল্পগুলো। এই নাটকীয় ঘটনাগুলো মিশৌরি রুরালিস্ট পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। পরে তিনি লেখেন ‘ওয়াইল্ডারস ফেমাস লিটিল হাউস’ সিরিজের লেখাগুলো। ৬৪ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই লিটিল হাউস ইন দি বুক উডস। তিনি ততোদিনে বিখ্যাত হয়ে যান। এই বইটির আটটি খণ্ডে এ পর্যন্ত চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।


ফ্রাংক ম্যাককার্ট (১৯৩০-২০০৯)

তের বছর বয়সে ফ্রাংককে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তখন তার মায়ের সঙ্গে একটি আইরিশ বস্তিতে থাকতেন। বাবা ছিল না। অভাবের সংসারে খরচ চালানোর ছিচকে চুরি চামারি ও ছোটখাট কাজ শুরু করেন। মাঝে মাঝে তাকে রাস্তা থেকে রুটির টুকরো কুড়িয়ে আ্নতে হত। এরপর ফ্রাংক নিউ ইয়র্কে চলে আসেন। তখন তাঁর বয়েস ১৯। সেখানে একটি হোটেলে একটি চাকরি যোগাড় করেন। এরপর তাঁকে কোরিয়ার যুদ্ধে যেতে হয়।

ফ্রাংক খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারতেন। প্রথাগত পড়াশুনা না থাকলেও শব্দের প্রতি ভালোবাসার কারণে তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ পান। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন।

ফ্রাংক ম্যাককার্ট চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত কোনো প্রকার লেখালেখি করতেন না। ৬৬ বছর বয়সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী এলেন ফ্রে তাকে বললেন, তুমি এতো সুন্দর করে তোমার জীবনের গল্পগাছা করতে পারো, তুমি এগুলো লিখে ফেলো না কেনো?

তিনি লিখতে শুরু করলেন। লিখলেন এঞ্জেলা এ্যাশেস নামে একটি উপন্যাস। তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন। এরপর পেলেন ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল পুরস্কার এবং এলএ টাইমস বুক পুরস্কার। এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা নির্মিত হল। এরপর তিনি আরো দুটি স্মৃতিকথা লিখেছেন।



চার্লিস বুকোউস্কি (১৯২০-১৯৯৪)

চার্লিস জন্মেছিলেন জার্মানিতে। বড় হয়েছেন আমেরিকায়। তার বাবার হাতে তিনি বেধড়ক মার খেতেন। গ্রাম্য উচ্চারণে কথা বলতেন। জামাকাপড়ের ছিরিছাদ ছিল খুবই খারাপ। মুখভরা ছিল ব্রনের দাগ। কোনো মেয়ে তাকে পছন্দ করত না।

এরপর তিনি নিউ ইয়র্কে চলে আসেন লেখক হওয়ার বাসনায়। তাঁর বয়স যখন ২৫ তখন তাঁর দুটো গল্প পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এরপর তিনি যতগুলো লেখা পত্রিকায় পাঠিয়েছেন সেগুলো সম্পাদকরা প্রকাশ করেন নি। তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। মন খারাপ করে তিনি লেখালেখি ছেড়ে দেন। একটি চাটনি কারখানায় চাকরি নেন। মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। বিয়েও করেন। শেষে আলসার রোগে মারা যান। শেষ দশ বছর তিনি পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন।

পোস্ট অফিসে চাকরি করার সময়ে বুকোউস্কি কয়েকটি কবিতা লেখেন। গল্পও লেখেন। সেগুলো প্রকাশিত হলে একটু সাড়া পড়ে। ১৯৬৯ সালে ব্লাক স্প্যারো প্রেস নামে এক প্রকাশনী তাকে বই লেখার অনুরোধ করে। তখন চার্লি চাকরি ছেড়ে দেন। ফুলটাইম লেখতে মনোযোগ দেন। লেখেন পোস্ট অফিস নামে একটি উপন্যাস। সেটি বেস্ট সেলার হয়। তখন তার বয়স ৪৯। তারপর কয়েক হাজার কবিতা লেখেন। লেখেন কয়েক শ গল্প। আর ছয়টি উপন্যাস।


উইলিয়াম এস বারোহস (১৯১৪-১৯৯৭)

হারভার্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বারোহস ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়া করেন। তার বাবা মা ছিলেন খুব ধনী। তারা তাঁকে অনেক টাকা-কড়ি দিতেন। ফলে তিনি উচ্ছন্নে যেতে দেরি করেননি। খুব দ্রুত মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। বেশ কয়েকবার জেলে যান। ভলমার নামে একজন ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করেন। মহিলাটি ক্রয়েশিয়ার অধিবাসী। তিনি আমেরিকায় আসার চেষ্টা করছিলেন। বারোস তার প্রতি প্রেম বশত: নয়, আমেরিকায় আসতে সাহায্য করার জন্যই তাঁকে বিয়ে করেছিলেন।

বারোহস সেনাবাহিনীতে চাকরির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেনাকর্মকর্তার বদলে সামান্য একজন সৈনিক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা তাঁর জন্য অবমাননাকর মনে করে বসেন। ফলে মন খারাপ করে কাজকারবার করতেন না। তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তারপর তিনি শিকাগো শহরে কীটনাশক ছিটানোর চাকরি নেন। কিছুদিন পরে হোটেলের ওয়েটারের কাজও করেন।

বিট জেনারেশনের সঙ্গে তিনি গভীরভাবেই যুক্ত ছিলেন। এ্যালেন গিনসার্গের সঙ্গে মরফিন ইঞ্জেকশন নিতেন। একটি খুনের ঘটনার সঙ্গেও এই তিনজনের নাম যুক্ত হয়ে আইনী ঝামেলায় পড়েন। এরপর বারোহস নেশাজাতীয় ওষুধের নকল প্রেশক্রিপশন ব্যবহার করে ধরা পড়েন। এটা নিয়ে কেসে পড়েন।

ভলমারের গর্ভে তাঁর একটি ছেলেও হয়। নিষিদ্ধ নেশা বিষয়ে এলেন গিনসবার্গকে লেখা তাঁর একটি চিঠি পুলিশের হাতে পড়ে। তখন তিনি মেক্সিকোতে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি স্প্যানিশ ভাষা বিষয়ে পড়াশুনা করেন। মেক্সিকান চিত্রভাষা শেখেন।

একদিন মদ্যপ অবস্থায় বারহোস তাঁর স্ত্রীর মাথায় গুলি করেন। স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। বারহোসের মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু নানা মিথ্যেকথা বলে ও ঘুষ দিয়ে সে-দণ্ড থেকে মাফ পেয়ে যান। এরপর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যান। সেখানেও ড্রাগ ব্যবহার করে মানুষকে টেলিপ্যাথি করার ধান্ধা করেন।

স্ত্রী ভোলমারকে গুলি করে মেরে ফেলার পরে তার মনের মধ্যে একটি পরিবর্তন ঘটে। তিনি জানান, আমি কখনো লেখক হতে চাইনি। কিন্তু ভলমারের মৃত্যুর ঘটনাটি কিভাবে ঘটল সেটা নিয়ে বিস্তারিত ভাবতে ভাবতে তার আদ্যোপান্ত ফরমূলার মতো আবিষ্কার করে ফেললাম। মনে হল, এটা নিয়ে একটা লেখা করলে মন্দ হয় না। আমি পাগলের মত লিখতে শুরু করলাম। মরক্কোতে বাস করতাম তখন। আমার বয়স ছিল ৩৯। লেখা হল জাংকি নামের উপন্যাস। আর ৪৫ বছর বয়সে দ্বিতীয় উপন্যাস ন্যাকেড লাঞ্চ

প্রকাশিত হলে সারা তুমুল বিতর্কিত হন। এবং বিবেচিত হন বিখ্যাত লেখক হিসেবে।



লেখক পরিচিতি
চারুলতা হক
কবি। গল্পকার।
নিউ ইয়র্কে থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ