নিয়মগিরি, ধনঝরি পাহাড়, নদীর ধারে বাড়ি-- বিভূতিবাবুর কথা

অমর মিত্র

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠে শুরু হয়েছিল যেন আমারও এই জীবন। সিনেমায় পথের পাঁচালী দেখে কী যে বিস্ময়। তখন আমার বয়স আর অপুর বয়স এক। আমি একটা রাংতার মুকুট তৈরি করতে আরম্ভ করেছিলাম অপুকে দেখে। পথের পাঁচালী, আরণ্যক, ইছামতী, দৃষ্টিপ্রদীপের বিভূতিভূষণ যে চোখে এই জীবন, এই জন্ম, এই সভ্যতাকে দেখেছেন, তা আমাদের সাহিত্যে তো হয়নি। তিনি মানুষের মনের গহনে প্রবেশ করে প্রাণের সৌন্দযকে খুঁজে বের করে আনতেন। জীবন সুন্দর। অনেক অন্ধকারের ভিতরেও জীবনের ভিতরে যে অস্ফুট আলো লুকিয়ে থাকে, বিভূতিবাবু সেই আলোর রেখাটুকুকে তাঁর গল্পে খুঁজে আনতেন।
না, এ কিন্তু ইচ্ছাপূরণের গল্প নয়। তিনি তো কাহিনি লিখিয়ে ছিলেন না। তিনি জীবন লিখতেন। জীবন উদারতার, নিষ্ঠুরতারও। এমন জীবন লেখা তাঁর উপন্যাসে যেমন হয়েছে, তেমনি হয়েছে তাঁর গল্পে। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকত তাঁর ইতিহাসবোধ। তিনি সেই মানুষের কথা লিখতেন, যে মানুষের চাওয়া ছিল কম। অল্পতে খুশি। যে মানুষের কিছুই নেই প্রায়, কিন্তু যেটুকু আছে, তাই নিয়ে সে আনন্দময়, সেই মানুষের কথাই লিখতেন তিনি। মনে করা যাক “আমোদ” নামের গল্পটিকে। সেই গল্পে একেবারে ভূমিহীন চাষা যাত্রা দেখতে গেল। কত ভীড় সেখানে, সে আর বসবে কী করে, সমুখে গিয়ে দেখবে কী করে ? সেখানে বাবুদের জায়গা সামনে। পরে যারা আছে, তারা আগে এসেছে। প্যান্ডেলের বাইরে একেবারে পিছনে দাঁড়িয়ে, ডিঙি মেরে মেরে সমস্ত রাত সে দেখল যেটুকু দেখা যায়। আসলে অতদূর থেকে সে কিছুই শোনেনি, কিছুই দ্যাখেনি, কিন্তু যা দেখেছে যা শুনেছে তাইই অনেক। সকাল হয়ে গেল যাত্রা শেষ হতে। চলল সে তার কাজে। যাই হোক আমোদটা তো হয়েছে। সামান্য পেলেই খুশি সে। এই গল্পের সঙ্গে আমাদের পরিচয় তেমন কই? কত গভীর কথা কত সহজে না তিনি বলে গেছেন। কত নির্ভার তাঁর কাহিনি! ‘’তুচ্ছ “ গল্পটির কথা মনে করি। সেই গল্পে দরিদ্র কামারের তের-চোদ্দ বছরের মেয়ে বিয়ের পর বাপের বাড়ি ফিরে বাবু ঘরে গেছে। বাবুদের বাড়ির বউ, মেয়েরা তার সঙ্গে কী আর কথা বলবে? সে মেঝেতে বসে চার দেওয়াল দ্যাখে। এই বাড়ির প্রবীন মানুষটি আর তাকে নিয়েই এই গল্প। মেয়েটি দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের অকিঞ্চিৎকর ছবি দেখেই মুগ্ধ, প্রবীন মানুষটিকে জিজ্ঞেস করে কত কথা। তাকে এবাড়ির আর সকলে অবহেলা করছে, সে বিষয়ে তার কোনো বোধ নেই। প্রবীন মানুষ, গল্প কথক স্নানে যাবেন, গন্ধ তেল মাথায় দিচ্ছেন। এক ফোটা তেল নিয়ে হাতটি মেয়েটির মাথায় ঘষে দিলেন। কি রকম গন্ধ?

চমৎকার, কাকাবাবু!

গন্ধ তেল মেখেই সে ভারি খুশি, বলে, বেলা হয়েচে, আসি তাহলে কাকাবাবু!

কতটুকু আর তেল দিয়েছেন তিনি ওর মাথায়। তাতে সে কত খুশি! আর সেই আনন্দ মানুষটির ভিতরে সঞ্চারিত হলো। এই সৌন্দযর্ময় অনুভূতির গল্পই তুচ্ছ। আপাতত যা তুচ্ছ, তাই-ই কত বিপুল, নীল আকাশের মতো তার বিস্তার।

“নদীর ধারে বাড়ি” গল্পটির কথা বলি। এই গল্প এক গৃহবধূ শ্যামলীকে নিয়ে। কলকাতার এক কানা গলির ভিতরে সাত ভাড়াটের বাড়িতে ন’টি বছর সে রয়েছে। তার দুই মেয়ে দুই ছেলে। বয়স তিরিশের উপর। স্বামী এক সওদাগরী অফিসের কেরানি। সামান্য বেতন তার। মনের গহনে সে লুকিয়ে রেখেছে অসামান্য এক সৌন্দয। প্রতিবেশি ভাড়াটেদের নোংরামি, ঈর্ষা, কলহ ইত্যাদির ভিতরে বাস করতে করতেও শ্যামলী সকলের থেকে আলাদা। এখানে সমস্তদিন কেউ না কেউ কারোর না কারোর সঙ্গে কলহ বাঁধিয়েই রেখেছে। সে চুপ করে ভাবে কবে এই ঘৃণ্য পরিবেশ ছেড়ে উঠে যাবে। যেমন মানুষ সব, তেমন এই বাসা। রান্নাঘরের সামনে খোলা ড্রেনে তরকারির খোসা, ফেন, শাকের ডাঁটা, চিংড়ি মাছের খোসা জমে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এরই ভিতর এক প্রতিবেশি ধার চেয়ে না পেয়ে শ্যামলীর রান্না ঘরের সামনে সকালবেলায় তার দুই বাচ্চাকে ড্রেনের ধারে বসিয়ে দেয় প্রাতঃকৃত্যে। যদুনাথ তার স্বামী। সেও জানে কোন পরিবেশে আছে। সে বের হতে চায় এখান থেকে, কিন্তু উপায় নেই। সামান্য বেতনের কেরানি। তাই শ্যামলীকে অভয়া, শশীবাবুর বউ, বিশ্বেস গিন্নি, মতির মায়েদের ভিতরে থেকেও কোনোক্রমে নিজেকে আলাদা করে রাখতে হয়, এই ঘৃণ্য পরিবেশ থেকে কবে যে উঠে যেতে পারবে ? একদিন তার স্বামী যদুনাথ এক খবর আনে, রাণাঘাট থেকে যেতে হয়, এগার মাইল উত্তরে বল্লভপুর নামে একটি গ্রামে কলকাতার এক বড়লোকের কাছারি বিক্রি হচ্ছে। ওপরে নিচে পাঁচখানা ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, নাইবার ঘর। দশ বিঘে জমির উপর সেই বাড়ি, তাতে আম কাঁঠালের গাছ আছে, বাড়ির গা দিয়ে একটা ছোট নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই নদীতে একটি ঘাটলা করে দিয়েছে জমিদার তার বাড়ির মেয়েদের স্নানের সুবিধার জন্য। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তুলে নিয়ে আরো কিছু সংগ্রহ করে যদুনাথ সেই বাড়ি কিনবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কলকাতার এই খিন্ন জীবনে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। যে করে হোক ওই পাড়াগাঁয়ে বাড়ি কিনেও কলকাতার এই কানাগলি ছেড়ে যাবে। এই বিষাক্ত পরিবেশ ছেড়ে যাবে। দিনরাত জল নিয়ে, স্নানঘর নিয়ে কলহ লেগে আছে। সবাই গায়ের জোর আর মুখের জোর দিয়ে সব কিছু করায়ত্ব করতে চায়। শ্যামলী যখন বলে, যদুনাথের চাকরি ? যদুনাথ বলে, চাকরি সে ছেড়ে দেবে। একঘেয়ে হয়ে গেছে এই জীবন। স্বাস্থ্য যেতে বসেছে। একটু সাহস করে সে গ্রামে চলে যাবে ওই বাড়ি কিনে। বিভূতিভূষণ এই গল্পে যদুনাথের মুখ দিয়ে বলছেন, বিলেত থেকে লোক গিয়ে আমেরিকায় বাস করে আমেরিকা যুক্তরাজ্য স্থাপন করেছিল। অজানায় পাড়ি না দিলে মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে না। যদুনাথ ওই গ্রামে গিয়ে চাষবাস করবে, নাইট ইস্কুল করবে, কত তার স্বপ্ন। আর তারা সত্যিই গেল। রাণাঘাট লাইনে গাংনাপুর স্টেশনে নেমে গরুর গাড়িতে রওনা হলো। সে কতদূর! মাঠ আর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে গরুর গাড়ি চলল। সে যেন এক অভিযাত্রা। শ্যামলীর বুক দুরুদুরু করে ওঠে, এত আশা করে কেনা বাড়িটা কেমন হবে কে জানে? না দেখেই বাড়িটা কিনেছে যদুনাথ তার সবর্স্ব দিয়ে। অপরাহ্নবেলায় তারা পৌঁছল বল্লভপুর। দেখল আশাহত হওয়ার মতো নয়। এ যেন প্রাসাদ। বাড়ি দেখে আনন্দ ও বিস্ময়ে শ্যামলী বাক্যহারা। তেতলা এই বাড়ি তাদের নিজস্ব। গল্প এই। যেন সমুদ্র যাত্রা করে তারা এক সবুজ দ্বীপের সন্ধান পেয়েছে। বারান্দা, রান্নাঘর, কুয়োতলা, নাইবার ঘর, ছাদ, সমস্ত নিয়ে যে বাড়ি তাদের অপেক্ষায় ছিল, তা শ্যামলীকে বিহ্বল করল। মুক্তোর মা নামে এক কাজের লোক বাড়ি ঝাটপাট দিয়ে ধুয়ে রেখে দিয়েছিল। শ্যামলী কতদিন বাদে বুক ভরে শ্বাস নিল। বেলা শেষে ছোট নদীটির ঘাটে গেল গা ধুতে। নদীর পাড়ে একটি নাম না জানা গাছে শাদা ফুল ফুটেছে। কী সুবাস। শ্যামলী জলে নামল। আজ সে যেন রূপকথার রাজকন্যা। অন্ধকার নেমে গেছে। মাথার উপর তারাভরা আকাশ। এই বাঁধাঘাট, প্রাচীন বনস্পতি, বনফুলের গন্ধ, সবই তাদের। তারা পয়সা দিয়ে কিনেছে। কলকাতার সেই পচা ড্রেন, কানাগলি, কলঘর, অভয়া, বিশ্বেস গিন্নি, সব অবাস্তব স্বপ্ন হয়ে গেছে একদিনেই। তাদের জন্য কষ্ট হলো শ্যামলীর। সত্যি কষ্ট! বেচারী শশীবাবুর বউ, মতির মা, ওদের একবার আনতে হবে এখানে। গল্প আর কিছু নেই। বাড়ির জানালা থেকে মেয়ে ডাকে, মা, তাড়াতাড়ি এস, বাবা চা চাইছে...

শ্যামলী সেই মুক্তোর মাকে বলল, সাবান আনিনি, যাও তো, ছোট তোরঙ্গের ভিতর আছে, নিয়ে এস তো।

গল্প এইটুকু। সুখের যে চিহ্ন এঁকেছেন বিভূতিবাবু, তা বিরল। আর শ্যামলীর সেই দুঃখ কলকাতার প্রতিবেশিদের ক্ষুদ্র জীবনের জন্য..., এও বিরল। বিভুতিবাবু আমাদের সাহিত্যে এক বিরলতম লেখক, যিনি নিজের পথে নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী। তাঁর পথ, তাঁরই। এই পথে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই বিশ্ব সাহিত্যে। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক থেকে দৃষ্টি প্রদীপ সমস্ত লেখার ভিতরেই মহাপৃথিবী তাঁর সঙ্গে হেঁটেছে। পরিশ্রমী আর প্রকৃতি সংলগ্ন মানুষের প্রতি তাঁর সহমরমীতা আমাকে শিখিয়েছে অনেক। মনে পড়ে কুশল পাহাড়ি গল্পে সেই দেবস্থানে সাধুর কাছে যাত্রা পথটির কথা। প্রায় ভবঘুরে গল্প কথক ( বিভূতিবাবু নিজেই হয়তো সেই সতীশ ) অরণ্যময় সুন্দরগড় স্টেটে বেড়াতে এসে মনোহরপুরের স্থানীয় এক বাঙালির বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। সেই সদাশয় মানুষটি তাঁকে নিয়ে চললেন। সতীশের তেমন সাধুসন্তে ভক্তি নেই, কিন্তু বনপথে যাত্রাটি তো তাকে টেনে নিয়ে চলল। বনের অপূর্ব রূপ, দিকচক্রবালে মেঘের মতো শৈলমালা, বনমধ্যে বীরহোড় উপজাতির একটি কুটির। উপজাতি রমনী একা ছেলেমেয়ে নিয়ে ওই বনের ভিতরেই থাকে। নিঃশঙ্কচিত্ত। এই সভ্যতা প্রবেশ করেনি অরণ্য মধ্যে, তাই এইভাবে বাঁচতে তার ভয় করে না। সভ্যতা মানুষের ভিতরে উদ্বেগ আর ভয় ঢুকিয়েছে। কত অল্পে বাঁচা এদের। দেবস্থানে পৌঁছে সেই সবর্ত্যাগী সাধুর জীবন দর্শন সতীশকে স্পর্শ করে।

এই গল্প শেষ হয় কলকাতায়। ধনীব্যক্তিদের একটি পার্টিতে। তারা যখন বিষয় আশয় নিয়ে মগ্ন, বিষয় আশয়ের কথা বলেই যায়, সতীশের তখন মনে পড়ে সেই বনপথে যাত্রা আর সাধুর কথা। কুশল পাহাড়ি গল্পের দর্শন বিভূতিবাবুর জীবন দর্শন। আসলে তিনি মানুষকে অমনই দেখতে চান, যেমন দেখেছেন অরণ্যে, প্রকৃতিতে। আরণ্যক উপন্যাসের নায়েব জমি বন্দোবস্ত দিয়ে ফেরার সময় টের পেয়েছিল, সে আসলে অরণ্যকে ধ্বংসের বন্দোবস্ত করে যাচ্ছে। কিন্তু সে-ই তো যুগলপ্রসাদকে দেখেছিল সরস্বতীকুন্ডের ধারে, যে বৃক্ষ রোপন করে যাচ্ছে। বিভূতিবাবু স্বপ্নদ্রষ্টা তাই যুগলপ্রসাদকে দেখতে পান অরণ্য ধ্বংসের ভিতরেও। তিনি যে স্বপ্নদ্রষ্টা যে তার চিহ্ন আছে ভরহেচ নগর প্রতিষ্ঠার গল্প ‘ জাল’-এ। রামলাল ব্রাহ্মণ বিকানীরের মানুষ। কলকাতায় ব্যবসা করত। ধনী। বুড়ো কলকাতা ছেড়ে হাজারিবাগের জঙ্গলের ভিতর দেড়শো বিঘে জঙ্গুলে জমি কিনে নগর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দ্যাখে। ভরহেচ নগর তার পৈতৃক নিবাস, সেই নগরই এই বনের ভিতরে প্রতিষ্ঠা করতে চায় রামলাল ব্রাহ্মণ। ভবঘুরে হিতেন্দ্র কুশারী ঘুরতে ঘুরতে সেখানে হাজির। সে ব্যবসা করতে চায়, কাজ চায়, তার খোঁজেই না তার এতদূর আসা। কী অপূর্ব এই গল্প। বুড়ো রামলাল কী স্বপ্নই না লালন করে ওই বয়সে। মানুষ স্বপ্ন দেখেই বাঁচে। স্বপ্নহীন মানুষের ভিতরে কি প্রাণ থাকে? এই সব গল্প মানুষের সরলতা, পবিত্রতার কথা বলে। হিতেন্দ্র সেই ভরহেচ নগরের জালে জড়িয়ে গিয়ে রয়ে গিয়েছিল সেখানে। রামলাল তাকে যেন আঁকড়ে ধরেছিল। দু বছর সে রামলালের স্বপ্নের কথা শুনেছে শুধু। রামলাল চাইছিল মানুষ আসুক, সে তিনবিঘা করে জমি দেবে। জলের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু হিতেন্দ্র ব্যতীত আর একজনও আসেনি সেখানে। কে আর পরিবার নিয়ে বনবাসী হবে। জমিতে কী চাষ করবে সে? পেটের ভাত হবে? রামলালের এক ছেলের বউ আর নাতিনাতনি নিয়ে সেখানে থাকে। সেই পরিবারের একজন হয়ে যায় যেন ভবঘুরে মানুষটি। এই জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না সে। ভরহেচ নগরের বাস উঠল রামলালের মৃত্যুতে। তার ছেলেরা সব বেচে দিল। রামলালের স্বপ্নের নগরকে অরণ্য অধিকার করে নিতে লাগল আবার। বিভূতিবাবুর গল্পে জীবনকে চেনা যায়। মানুষের যে কত মুখ! ‘ঝগড়া’ গল্পে রেলের রিটায়ার্ড বাবু কেশব গাঙুলী বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয় মেয়ে আর বউয়ের গালাগালিতে। তার নিজের এক পয়সাও নেই। সব মেয়ে বউয়ের নামে করে দিয়ে তাদের গঞ্জনায় বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। কী ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় না আরম্ভ হয় এই গল্প। কিন্তু এরপর মানুষের সহৃদয়তা তাকে কদিন বাঁচায়। নৈহাটিতে তার কলিগ তাকে আশ্রয় দেয় দুদিনের জন্য। সেখান থেকে কেশব যায় ব্যান্ডেলে। কেশবের যৌবনকালের কথা মনের ভিতরে মেঘ হয়ে ঘোরে। গল্পটি এক জীবনের নানা রূপের। তিনপাহাড় স্টেশনে কেশব একা একা মরে যায়। তিনপাহাড়েই তো সে সংসার পেতেছিল নতুন বউ ষোড়শী উমাশশীকে নিয়ে। জীবন এমনও হয়। সেই ষোড়শী উমাশশীর ভালবাসা জীবনকে ভরিয়ে দিয়েছিল। আবার শেষ বয়সে উমাশশীই তাকে দূর করে দিয়েছে ভিটে থেকে। মানুষের ভালবাসা, নিষ্ঠুরতার এমন গল্প পড়িইনি আমি।

বিভূতিবাবুর যে সব গল্প নিয়ে আমি বললাম, তা আমাদের কাছে খুব পরিচিত নয়। কিন্তু এই সমস্ত গল্প জীবন রসে পরিপূর্ণ। জীবন রসই বিভুতিভূষণের গল্প উপন্যাস। সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষের ভিতর থেকে তিনি বড়মানুষের আলো খুঁজে বের করেছেন। এ আমাদের বড় পাওয়া।

পুনশ্চঃ আরণ্যকে জমি বন্দোবস্ত দিতে গিয়ে বনভূমির সবর্নাশ হয়ে গেল যে তা অনুভব করেছিল গল্প কথক, সেই জমিদারি নায়েব। বিভূতিবাবুর সেই দেশ নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম, ‘ বিভূতিবাবুর দেশ’। ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড় আর কন্দ উপজাতি এবং সেই বিভূতিবাবুর দেশের ধনঝরি পাহাড় ও আদিবাসী রাজা দোবরু পান্না, রাজকন্যা ভানুমতী মিলেছে একসঙ্গে। গল্পটি আমি লিখেছিলাম ২০১১-র জুলাই মাস নাগাদ। আমি সেই সময় বিভূতিভূষণের কয়েকটি উপন্যাস পরপর পড়ি। ইছামতী, দৃষ্টি প্রদীপ, আদর্শ হিন্দু হোটেল, আরণ্যক। তা ব্যতীত বিভূতিবাবুর গল্প। বিভূতিবাবুকে আমি ঘুরে ঘুরে পড়ি। পড়তে ভাল লাগে। তিনি আমাকে আবিষ্ট করেন। আরণ্যক পড়তে পড়তে দেখতে পাই, লেখক বা গল্প কথক যিনি এই উপন্যাসের, তাঁর ও আক্ষেপ আছে ওই বিস্তারিত অরণ্যভূমি বন্দ্যোবস্ত দেওয়ার মধ্যে। গরিব মানুষ আসে কিছু জমির আশায়, চাষবাস করে খাবে, আর বড় মহাজন বিঘার পর বিঘা জমি নিয়ে জমিদারি ফাঁদে। বনভূমি নষ্ট হতে থাকে। আর আদিবাসী রাজা দোবরু পান্না তাঁর অলীক রাজত্বের বনভূমিকে নিয়ে বাঁচেন। একদিন সমস্ত পাহাড় জঙ্গল ছিল তাঁদের, এখন নেই। আলো বাতাস অরণ্য পাহাড় সব কেড়ে নিয়েছে এই সভ্যতা আর উন্নয়ন। জাতি সঙ্ঘের কাছে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান দলপতির পাঠানো দাবী পত্রের কথা স্মরণ করুন।

বিভূতিবাবুর আরণ্যক উপন্যাসে আদিবাসী রাজা, রাজকন্যা ভানুমতী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি নতুন করে আরণ্যক পড়ে বিচলিত হই অন্য কথা ভেবে। আজ সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে আদিবাসী অন্ত্যজ মানুষ রাষ্ট্রের চোখে সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছে। আর আদিবাসী অন্ত্যজ মানুষের যে অধিকার এতদিন কাড়ত স্থানীয় মহাজন, জমিদার, সামন্ত প্রভু, তা কাড়তে এসেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। তার দোসর হয়েছে রাষ্ট্র আর গ্রামের ফড়ে মহাজন যারা থাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। ওড়িশা থেকে ছত্তিশগড়, আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গও বাদ যাবে না হয় তো। ওড়িশায় তো নিঃশব্দে উন্নয়নের জাঁতাকলে পড়ে আদিবাসী অন্ত্যজ মানুষ তার সমস্ত অধিকার হারাচ্ছে। ছত্তিশগড়েও তাই। ছত্তিশগড়ে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটছে। সোনি সোরি নামের আদিবাসী কন্যাটি যে ভাবে অত্যাচারিত হইয়েছে তা সভ্য দেশে হতে পারে না। ওড়িশায় যে পাহাড়গুলি লিজ নিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি মৃত্তিকা গর্ভ থেকে খনিজ উত্তোলনের জন্য, সেই পাহাড় নিয়মগিরি শৈলমালা আদিবাসীদের কাছে দেবতা স্বরূপ। রাষ্ট্র সব তুলে দিচ্ছে বহুজাতিকের হাতে অধিগ্রহণ করে। নানা ঘটনার কথা শুনে নিজেকে এক অক্ষম মানুষ মনে হয়। আরণ্যক পড়তে পড়তে মনে হয় এই আদিবাসী মানুষজন, নিরীহ আদিবাসী মেয়েরা যারা জেলখানায় আছে এই আমাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওড়িশা, ছত্তিশগড়ে, সারা দেশে তারা তো রাজকন্যা ভানুমতির উত্তরসূরি। ভানুমতির মেয়ে, নাতনি। আদিবাসী রাজা দোবরু পান্নার বংশধর। তাদের পবিত্র সেই ধনঝরি পাহাড়ই তো লিজে নিয়ে ভাঙতে শুরু করেছে মহাজন আর বহুজাতিক কোম্পানি। বিভূতিবাবুর কুশল পাহাড়ির অরণ্য, ভাগলপুর, হাজারিবাগের অরণ্য আর ছত্তিশগড় কিংবা ওড়িশার অরণ্যের তফাত কোথায়? তাঁর দেশ লুন্ঠিত হচ্ছে। তাঁর ভানুমতী কিংবা সেই স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বীরহোড় রমনীর সব গেছে। জেলে ঢুকে বসে আছে প্রতিরোধে নেমে। কিংবা খাদানের ঝুপড়িতে লুকিয়ে আছে মোটর সাইকেলের শব্দ শুনে। রাসবিহারী সিঙের নাতি আসছে। আরণ্যক পড়লে আমাদের দেশের বনভূমিকে চেনা যায়। চেনা যায় গ্রাম সমাজকে। রাসবিহারী সিং মহাজনকে। নন্দলাল ওঝাকে। আমাদের সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ আছে পুরোপুরি। তা বহন করেন আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা। চোখ রাঙিয়ে আর জেলখানায় শারীরিক অত্যাচার করে তাঁরা হাড় হিম করা আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে থাকেন মানুষের ভিতর। তারপর লোভের হাত বাড়ান বনভূমি, পাহাড় প্রকৃতির উপর। এ যেন আরণ্যকের রাসবিহারী সিং-এর বংশধর সবাই। মানুষ দেশ পরিচালকদের ভালবাসা কেন পায় না, রাষ্ট্রের ভালবাসা ? এই সব নানা বিষয় গল্পটির জন্ম দিয়েছে। বিভূতিবাবু যে ভাবে দরিদ্র আর অন্ত্যজ মানুষের কথা বলেছেন আরণ্যক উপন্যাসে তা আমাদের সাহিত্যে বিরল। আমি কল্পনা করি, রাজকন্যা ভানুমতীর দৌহিত্রি জিজ্ঞেস করে মাতামহীকে সেই মানুষটার কথা। সেই নায়েব। যে এসেছিল ভানুমতীর বাবা, আদিবাসী রাজা দোবরু পান্নার কাছে। সেই কতকাল আগে। তারপর কত চাঁদ ডুবেছে, কত চাঁদ মুখ দেখিয়েছে শৈলমালার শীর্ষে। এখনো রাত্রিকালে বনভূমি নির্মূল হওয়া তৃণগুল্মহীন প্রান্তরে সেই মানুষটার পায়ের শব্দ শোনা যায় যে। এই দেশকে চিনতে হলে বিভূতিবাবুকে চিনতে হবে। এই লেখা সেই বিরল প্রকৃতির লেখকের প্রতি আমার প্রণাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভাল লাগল পড়ে। দেশকে জানতে হলে বিভূতিভূষণ পড়তে হবে- কথাটা খুবই খাঁটি।

    উত্তরমুছুন
  2. ভালো লেখা। ভালো লেখকের। ভালো লেখকের প্রতি। মুগ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন