শিমুল মাহমুদ
প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমান সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে বিভূতিভূষণের গল্প থেকে আমরা কীভাবে পাঠ গ্রহণ করবো? প্রশ্নটি অপরিহার্য এই জন্য যে, আমরা আমাদের বর্তমান সভ্যতার ওপর দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের অকল্পনীয় প্রয়োগ ও সফলতায় বিহ্বল। এবং সঙ্গত কারণেই মানব প্রজাতি ক্রমশ মাত্রা-অতিরিক্ত অহঙ্কারি হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অথচ এহেন অহঙ্কারের পাশাপাশি আমরা এখনও একটি অসাম্প্রদায়িক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি; সমাজের বহুস্তরের ভেতর গ্রহণযোগ্য কোনো সমঝতায় এখনও আমরা পৌঁছুতে পারিনি; ফলে আমাদেরকে বাস করতে হচ্ছে বর্ণভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, পেশাভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, ধর্মভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, শিক্ষাভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, সম্পদভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর। এই যে নানাবিধ স্তর-বিভাজন, যা পক্ষান্তরে মানবিক চেতনার পরিপন্থী।
আমাদের করণীয় কী? এর পাশাপাশি আমাদেরকে এও ভাবতে হচ্ছে বিভূতিভূষণের গল্পের মানুষগুলোর দৈনন্দিন-বিশ্বাস আর আচরণের সাথে মানবিকতার বিষয়টি কতটুকু সংযুক্ত? এ কথা ঠিক যে, প্রত্যেক জাতির একটা নিজস্ব ঐতিহ্য-আশ্রিত কালচার আর পালনীয় ধর্ম বা প্রথা বা লোকবিশ্বাস অবশ্যই থাকে; এ বিষয়গুলোকে সাথে নিয়েই জাতিগতভাবে মানব সমাজ ক্রমশ মানবিক হয়ে উঠতে থাকে। এই চেতনাটিকে বিভূতি প্রযত্নের সাথে বিবেচনায় রেখেছিলেন। ফলে তাঁর গল্পে উপস্থাপিত সমাজে বা গোষ্ঠীতে সচরাচর অসঙ্গতি চোখে পড়ে না; বরং অসঙ্গতি থাকলেও তা আড়ালে থাকে; অথবা লেখক সমাজের বহুস্তরভিত্তিক অসঙ্গতিকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে মানবসমাজের ভেতর যে চিরায়ত অনিবার্য বন্ধনের জায়গাটি রয়েছে সেটিকেই বড় করে তুলেছেন তাঁর গল্পে। ফলে তাঁর গল্পের সংকটগুলোকে যদি আমরা মর্গান থেকে শুরু করে মার্কস যেভাবে সভ্যতার গতিবিধিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন সেভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি দেখবো, বিভূতিভূষণ সমাজের গোষ্ঠীগত আবেগ অথবা সমাজ গঠনের স্বার্থে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের যে অনিবার্যতা তাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে তাঁর গল্পে উপস্থাপিত সামাজিক নানাবিধ শ্রেণিবিন্যাস আমাদের চোখে প্রকট হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। বরং গল্পের অধিকাংশ ঘটনাকেই মনে হয় স্বাভাবিক, অনিবার্য আর চিরায়ত; যেখানে রয়েছে এক ধরনের মানবিক বন্ধন ও মায়া। এ কারণে বিভূতিভূষণের গল্পের মানুষগুলো সহজেই আমাদের পরিচিত আপনজন অথবা আত্মীয় হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়ে যায়।
গল্পের ভেতর এমন আত্মীয়সুলভ অবস্থা সৃষ্টির জন্য লেখক লোককথা, লোকজীবন, কিংবদন্তি, ফোক-বিলিভ, দৈনন্দিন আচার, কুসংস্কারসহ বিবিধ লোকজ উপাদানকে লেখার মালমশলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে তিনি এই লোকজ উপাদানগুলোকে যতটা না সরাসরি ব্যবহার করেছেন তার চেয়ে অধিক প্রয়োগ করেছেন মনোসামাজিক প্রেক্ষাপটে। এখানেই বিভূতিভূষণ সমকাল থেকে এগিয়ে গিয়েছেন। আর মনোসামাজিক বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়ার ফলে গল্পের ঘটনাবিন্যাস এবং চরিত্রের গতিবিধি হয়ে উঠেছে সমাজে ঘটে যাওয়া সহজাত মানসজগতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারপরও এই সময়ের পাঠকের সমাজবীক্ষণ-পদ্ধতি ও প্রাজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে আমরা বিভূতিভূষণের গল্পের সমাজ আর সমাজের মানুষকে শুধুমাত্র চিরায়ত মানবিকতার ধুয়া তুলে অথবা ভাববাদি চেতনায় আবেগতাড়িত হয়ে একচেটিয়া বাহবা দিতে প্রস্তুত নই। আমরা বরং লোকায়ত বিষয়সমূহ বস্তুগতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী।
কমরেড ননী রায় এর মতো আমরা অনেকেই মনে করি, সনাতন বা চিরস্থায়ী বলে আসলে কিছু নেই, সবকিছুই পরিবর্তনশীল, এই পরিবর্তন চলছে প্রতি মুহূর্তে; আর তাছাড়া সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে জ্ঞানের রাজ্যের নেই কোনো নির্দিষ্ট ভূগোল। আমরা বিভূতিভূষণের চিরায়ত বাঙালি জীবনের ভেতর দিয়ে এই সত্যের অবভাষ ভেসে উঠতে দেখি। ‘মৌরীফুল’ গল্পে গ্রাম্যবধূ সুশীলা এবং কলকাতার বউয়ের ভেতর যে সখীত্ব, তারা যেভাবে নদীতীরের মৌরীফুল দিয়ে চিরকালীন বন্ধনে নিজেদেরকে বেঁধে ফেলে তা আমাদের মতো শহুরে হিসেবি মানুষের বোধগম্য হবার কথা নয়; তারপরও আমাদেরকে মনে রাখতে হয়, এই গল্পের লোক-অনুষঙ্গ শেষ পর্যন্ত পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানবিকতার ভেতর দিয়ে যেভাবে সুখের দিকে ধাবিত হয়েছে তা আমাদের চেতনাকে তাড়িত করার পরিবর্তে এক ধরনের প্রশান্তি দেয়।
বিভূতিভূষণের গল্পের বিষয় প্রাত্যহিক ক্লান্তি অথবা গ্লানীবোধের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলেও শেষ পর্যন্ত আমরা এক ধরনের প্রশান্তির মুখোমুখি হই। এটা বিভূতি-র গল্পের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই সহজাত বৈশিষ্ট্য সত্য হয়ে ওঠে তখন, যখন আমরা দেখতে পাই, শহুরে শিক্ষা ও মানবিক চেতনা নির্দিষ্ট ভূগোল অথবা নির্দিষ্ট লোকসংস্কৃতি অতিক্রম করে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে; অথবা আমরা দেখতে পাই সুশীলার জীবন-অভিজ্ঞতার চিরায়ত বিশ্বাসসমূহ তার শহুরে সখিকেও আকৃষ্ট করেছে। পুঁথি পাঠ অথবা হাপু গান অবলম্বনে জীবন ধারণ, চিরন্তন অভাবের ভেতর দিয়ে কী এক অর্বাচীন সুখে বিমোহিত মানবজীবন, ‘প্রকাণ্ড বটগাছ, তাহার তলায় ভাঙা ইঁটের মন্দির। গাছতলা হইতে একটু দূরে এক বুড়ী নানা ঔষধ বিক্রয় করিতেছে।’ আমরা দেখতে পাই হাঁটের ভেতর অথবা লোক-মেলার লোকসমাগমের ভেতর বাঙালি জনজীবন মানব-জীবনের যাবতীয় সংকট সমাধানের দাওয়াই সাজিয়ে বসে আছে। সেই ঔষধের সাথে প্রাত্যহিক বিশ্বাস মিশে থাকলেও শ্বশুর-শাশুড়ী থেকে শুরু করে ‘সংসারের অলক্ষ্মীস্বরূপা আগের পক্ষের বউ-এর নাম সে সংসারে আর কোনদিন কেহ করে না।’
সুশীলার স্বামী কিশোরের আগের পক্ষ অর্থাৎ সুশীলার জীবনের দৈনিকতার নানা হিসেব সুশীলার জীবনে শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই থেকে যায়। এইভাবে অমীমাংসিত প্রাত্যহিকতা আমরা প্রতিনিয়ত মেনে নেই; এটাও জীবনের স্বাভাবিকতা। এই স্বাভাবিকতা সহনীয় হয়ে ওঠে লোকবিশ্বাস অথবা ধর্মীয় ভক্তিবাদ অথবা ভাববাদের হাত ধরে। ভাববাদের হাত ধরে আমরা বেঁচে থাকি অথচ সুশীলার চোখে তাঁর শহুরে সখীর জন্য জল; সুশীলার ওপর স্বামীর অত্যাচার অত্যন্ত স্বাভাবিক আচারের ভেতর দিয়েই নেমে আসে। স্বামী তার বিয়ে করা বউ-এর শরীরে হাত ওঠাবে এটাও আমাদের ধর্মীয় আচারের ও লোকবিশ্বাসের সাথে পালিত হয়ে আসছে সেই আবহমান সময় থেকে; যে আচারসমূহ শাস্ত্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে,
রমণীর উপনয়ন লাভ হয় বিবাহ যজ্ঞ দ্বারা
পতিসেবা কর্মে নিহিত থাকে পবিত্র বেদ অধ্যয়ন
আর পতিগৃহে বসবাস নিশ্চয় দেবগৃহে বসবাস।
এবং মহাভারত শাস্ত্রমতে,
নগরের দক্ষিণ প্রান্তে যমপুরী সন্নিকটে
হে নগরবাসী নির্মাণ করবে তোমরা গণিকালয়।
একইভাবে লোকাচার চিরায়ত বিশ্বাস দ্বারা শাস্ত্রমতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়,
লিখে রাখো বিধান
নিঃসন্তান বধূকে পরিত্যাগ সম্ভব
বিবাহের দশ বৎসর বাহিত হলে
অথবা শুধুমাত্র কন্যাসন্তানের জননীকে বার বৎসর এবং
মৃতবৎসাকে পনের আর শুনে রাখ অহঙ্কারী পুরুষ ওহে
কলহপ্রিয়া বধূ তৎক্ষণাৎ পরিত্যাজ্য।
বিভূতি-র গল্পের সুশীলা কলহপ্রিয়; তবে সেটা ছিল তার অধিকার। স্বামী-সংসার আর শ্বশুড়-শাশুড়ীর প্রতি এক অনিবার্য চিরায়
ত ভালোবাসা থেকেই সে কলহে লিপ্ত হতো। গল্পপাঠে আমরা এমনটিই দেখতে পাই। এই চিরায়ত নারী প্রাকৃতিক নিয়মে হয়ে ওঠে রজঃশীলা। অথচ উর্বরতার আধার রজঃশীলা রমণীকে অববিত্র ঘোষণা করেছে পবিত্র ধর্মপুস্তক কোরআন।
রজঃশীলা রমণীর জন্য নিষিদ্ধ
মাসিক চলাকালীন সময়ে উপাসনা উপবাস।
এ হেন চিরায়ত লোকাচারের প্রতি সুশীলার কোনো অভিযোগ নেই। সে জানে এটাই মানব-ধর্ম। লোকায়ত জীবনের মধ্যে বাস করে ধর্মের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন অবান্তর। লোকায়ত জীবনের ভেতর বেঁচে থেকে প্রশ্নমুখর চোখের জন্ম কোনো কালেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঘর-সংসার-স্বামীর ওপর অভিযোগের বিষয়টি লোকশিক্ষার অংশ নয়। নারীকে অভিযোগ করতে নেই এমন একটি পুরুষমুখি শিক্ষায় লোকবিশ্বাস বরাবরই নারীকে মরিচিকার ভেতর আটকে রেখেছে। নারী এই আটকে থাকার ভেতরই সুখবোধ করেছে। এমনটাই আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্পে এবং পাশাপাশি আমাদের বাঙালি লোকজীবনের ভেতর। সুতরাং সারারাত ঘরের বাইরে সুশীলাকে রাত কাটাতে হলেও তার কোনো অভিযোগ নেই; বরং সে স্বামীকে নিয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখে; একান্তই নিজেস্ব গৃহকোণ। এই হলো সুশীলার মতো চিরায়ত নারীসমাজের পৃথিবী; যদিও সেই পৃথিবীতে তার নেই কোনো একক সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার। সুশীলা স্বপ্ন দেখে, তার শহুরে সখী তার স্বামীর জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। আর এ রকম সরল বিশ্বাস আমাদেরকে সুশীলার প্রতি তার মনোচেতনার প্রতি আরও কিছুটা যত্নশীল করে তোলে। শহুরে সখীর কাছে তার আকুলতা, ‘এই আংটিটা আমার মায়ের দেওয়া, তোমায় দিলাম, তবু এটা দেখে তুমি গরীব মৌরীফুলকে ভুলে যাবে না।’
এ পর্যায়ে দরিদ্রতার বিষয়টি আর প্রাত্যহিক অভাব-অনটনের ভেতর আটকে থাকে না বরং তা মুহূর্তেই হয়ে ওঠে চিরায়ত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ; যে অনুষঙ্গ মানুষকে সুখের স্বপ্ন দেখায়, সুখী হতে শেখায়। এভাবে আমাদের চিরায়ত জীবন প্রাত্যহিক গ্লানী অথবা দুঃখ-কষ্টের সংজ্ঞা পালটে দিয়ে জীবনকে টেনে তোলে এক ধরনের অপার্থিব মহার্ঘতায়। এভাবেই বিভূতিভূষণের গল্পের মানুষগুলোর জীবন দৈনিকতার সুখে টইটম্বুর হয়ে ওঠে; এমনকি মৃত্যুও সেখানে স্বাভাবিকতা নিয়েই উপস্থিত হয়,
‘‘তাহার মৃত্যুতে গাঙ্গুলী-পাড়ার হাড় জুড়াইয়া গেল, পাড়ার কাক-চিলগুলাও একটু সুস্থির হইল। কিছুদিন পরেই কিশোরীর দ্বিতীয় পক্ষের বউ মেঘলতা ঘরে আসিল। দেখিলে চোখ জুড়ায় এমন সুন্দর মেয়ে, কর্মপটু, হুঁশিয়ার, গোছালো দ্বিতীয়বার বিবাহের অল্পদিন পরেই যখন কিশোর পালেদের স্টেটে ভাল চাকরিটা পাইল, তখন নূতন বউ-এর লক্ষ্মীভাগ্য দেখিয়া সকলেই খুব খুশি হইল।’’
মৃত্যুর আগে জ্বরের বিকারে সুশীলা স্বপ্ন দেখে, ‘জানালার বাহিরে জ্যোৎস্নায় ও-গুলো কি ভাসিতেছে? সেই যে তাহার স্বামী গল্প করিত জ্যোৎস্না-রাত্রে পরীরা সব খেলা করিয়া বেড়ায়, তাহারা নয় তো?’ এই হলো বিভূতিভূষণের গল্পের লোকজ-অনুষঙ্গ, যে অনুষঙ্গসমূহ জড়িয়ে লেপটে রয়েছে চিরায়ত বাঙালি জনজীবনের চিরায়ত বিশ্বাস আর দৈনিকতার আধারে। লক্ষ্মী পয়মন্ত গৃহবধূ অথবা অলক্ষ্মী গৃহবধূ কীভাবে গোটা অঞ্চলের ওপর অশুভ ছায়ায় সকলের হাড়-মাংস একাকার করে দেয় অথবা আকাশে নৃত্যরত পরীর দল কীভাবে মানবজীবনকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়, এই সব কিছু নিয়ে বিভূতি-র মানবজীবন সাবলীল এবং সংকটবিহীন। দৈনিকতার কুসংস্কারে আচ্ছাদিত অথবা দরিদ্রতার আক্রমণে আক্রান্ত প্রাত্যহিক সংকট আর সংকট হিসেবে আমাদেরকে আক্রান্ত করে না; বরং আমরা এক ধরনের প্রশান্তিতে ডুব দেই; এই তো জীবন, আমরা সবাই মিলে ভালো আছি। বিভূতিভূষণের এই ভালো থাকা আর না থাকার বিষয়টি এই সময়ের পাঠককে নতুন করে ভাবতে শেখায়। প্রশ্ন জাগে পক্ষান্তরে এভাবে আমরা কি সামাজিক শোষণ আর কুসংস্কারের আক্রমণে ডুবে থেকে শেষাবধি শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে আরও খানিকটা উস্কে দিচ্ছি?
বিভূতিভূষণ ‘জলছত্র’ গল্পে ‘কচু-চুষির মাঠে’র গল্প বলেছেন। তারাচাঁদের ছোটবোন জলপিপাসায় কচু চুষতে চুষতে মাঠের এক প্রান্তে নির্জন বটতলায় মারা যায়। লেখক লোকশ্রুতি থেকে পাওয়া লোককথার আলোকে গল্পনির্মাণ করতে গিয়ে পক্ষান্তরে লোকসংস্কৃতিকে আশ্রয় করে একদিকে যেমন লোকবিশ্বাসের প্রতি আস্থা রেখেছেন অপরদিকে তিনি সামাজিক কুসংস্কারকে অতিক্রম করে ধর্মীয় প্রথার ঊর্ধ্বে মানুষের যে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা সেই প্রচেষ্টাকে প্রধান বিবেচনার বিষয় করে তুলেছেন এই গল্পে। তারাচাঁদ এক সময় সম্পদের মালিক হলে তার সেই মরে যাওয়া বোন তাকে স্বপ্ন দেখায়, ‘দাদা, ঐ মাঠের মধ্যে সকলের জন্য তুই একটা জলছত্র করে দে।’ তারাচাঁদ বিশ্বেস জলসূত্র নির্মাণ করে; এবং সেখানে জলখাবারের ব্যবস্থাও রাখে। পিপাসার্ত পথিক মাঠ পাড়ি দেবার সময় বটতলায় জলছত্রের নিচে এসে শরীর জুড়িয়ে নেয়। পিপাসা পায়, যে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের। একদিকে মুসলমানের অপরদিকে হিন্দু-প্রথার ভেতর ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য অথবা শূদ্রের সকলেরই পিপাসা পায়। একদিন এক ব্রাহ্মণের পিপাসা পেলে তিনি জলছত্রের ব্যবস্থা দেখে বিতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন, ‘সর্বনাশ! নতুন মাটির জালা ভর্তি জল ও কচি ডাবের রাশি দেখে পিপাসার্ত শিরোমণি-মশায় যে আনন্দ অনুভব করেছিলেন, তা তাঁর এক মুহূর্তে কর্পূরের মত উবে গেল। কলুর দেওয়া জলসত্রে তিনি কি করে জল খাবেন? তিনি নিজে এবং তাঁর বংশ চিরদিন অশুদ্রে প্রতিগ্রাহী; আজ কি তিনি --- ওঃ!’
ধর্মহীনতার ভয়ে শিরোমণি-মশায় চুপসে যেতে থাকলে দেখতে পান, ‘একজন চাষা পাশের মাঠ থেকে লাঙ্গল ছেড়ে বটতলায় উঠলো। ঘেমে সে নেয়ে উঠেছে। একটু বিশ্রাম করে সে তৃপ্তির সঙ্গে ছোলা, গুড় আর জল খেয়ে বসে গল্প করতে লাগলো। এক বুড়ী অন্য এক গ্রাম থেকে ভিক্ষা করে ফিরছিল। গাছতলায় এসে সে ঝুলি নামিয়ে একটু জল চেয়ে নিয়ে হাত-পা ধুলে। একজন বললে --- আবদুলের মা, একটা ডাব খাবা?’
বর্ণপ্রথাকে অতিক্রম করে এই সর্বজনীন ব্যবস্থা কি শেষ পর্যন্ত শিরোমণি-মশায়ের ভেতর সংক্রমিত হয়? এইভাবে সংক্রমণ-কৌশল নির্মাণের ভেতর দিয়ে বিভূতিভূষণ কি অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠলেন? আমরা গল্পের এই পর্যায়ে দেখতে পাই, যে লোকটি জল দিচ্ছিল সেই সদগোপ জাতের চিনিবাসকে শিরোমণি-মশায় বলছেন, ‘ওহে বাপু, তোমার ঐ বড় ঘটিটা বেশ করে মেজে এক ঘটি জল আমায় দাও, আর ইয়ে--- ব্রাহ্মণের জন্য আনা সন্দেশ আছে বললে না?’
শিরোমণি মশায়ের এই উক্তির মধ্য দিয়ে গল্প শেষ হয়; আর সেইসাথে পাঠকের মধ্যে জেন্ম নেয় এক ধরনের উদাস করা মানবিকতা। পাঠক সহসা আবিষ্কার করে, তাই তো জীবন আগে, জাতবিচার পরে। লোকায়ত চেতনার এই যে বিবর্তন, সেই সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে বলা চলে, এক ধরনের বিপ্লব। বিপ্লবই বলা সম্ভব; কেননা বিভূতি-র সময়ের প্রেক্ষাপটে জাত খোয়ানোর এহেন কাজ যে তিনি করতে পেরেছিলেন, তা কিন্তু লেখকের লোকজীবন চেতনার কারণেই সম্ভব হয়ে উঠেছিল। লোকসংস্কৃতি বিভূতিকে কুসংস্কারের ভেতরে আটকে না রেখে অথবা বলা সম্ভব পিছন দিকে টেনে না ধরে বরং তাকে সেই অন্ধকারে টইটম্বুর জীবনাচার থেকে উদ্ধারের পথ দেখিয়ে দিয়েছে; এবং অবশ্যই এই দেখিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে চিরায়ত বাঙালি মানস। এ অবস্থায় আমাদেরকে লোকসংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হলে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পপাঠের পর নতুন করে চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সেই ভাবনাটা হতে পারে, বাঙালি লোকসংস্কৃতি শুধুমাত্র সনাতন প্রথার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং পাশাপাশি পরিবর্তনের পথও সেই সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। এ অর্থে আমরা যারা চিরায়ত লোকাচার অথবা লোক-ঐহিত্য নিয়ে ভাবছি তাদেরকে লোকজীবনের এপিঠ-ওপিঠ দুটোই দেখার আহ্বান জানায় বিভূতি-র ছোটগল্পসমূহ।
বিভূতিভূষণ অপার্থিব চরিত্র সৃজনের মধ্য দিয়ে চিরায়ত জীবনের মানবিক চেতনার পরিবেশ নির্মাণ করেছেন ‘জলছত্র’ গল্পে। যেখানে বলা হচ্ছে, ‘চারি ধারে যখন সন্ধ্যা নামে... তপ্ত মাঠ যখন ছায়া-শীতল হয়ে আসে... তখনই কেবল সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সে মেয়েটি অস্ফুট জ্যোৎস্নায় শুভ্র-আঁচল উড়িয়ে কোন অজ্ঞাত ঊর্ধ্বলোকে তার নিজের স্থানটিতে ফিরে চলে যায়। ... তার পৃথিবীর বালিকা-জীবনের ইতিহাস সে ভোলে নি।’
এই না ভোলা ইতিহাসই পক্ষান্তরে চিরায়তের ভেতর লুকিয়ে থাকা মানবিক চেতনার ইতিহাস; অসাম্প্রদায়িক চেতনার ইতিহাস। তারপরও কথা থেকে যায়, এই না বলা ইতিহাসের ইশারায় লেখক হয়তো বা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, যেন বা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন; হয়তো বা মানব পরিবারের বর্ণপ্রথা তিনি ভেঙে ফেললেন; আমরাও পরিতৃপ্তবোধ করি। অথচ আমরা লেখকের গল্পপাঠে দেখতে পাই বিভূতিভূষণ শেষাবধি লোকবিশ্বাস অথবা কুসংস্কারের কাছেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য বাধ্য হওয়ার কারণও আছে; বাধ্য হওয়ার কারণ বোধ হয় গল্প লেখার কাঁচামশলা হিসেবে চিরায়ত লোকসংস্কৃতি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। শিল্প নির্মাণের সেই তাৎপর্যবহ শক্তির খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন লোকজ অনুষঙ্গের নানাবিধ অনিবার্য রূপকের ভেতর। ফলে সঙ্গত কারণেই লেখক লোকজ অনুষঙ্গকে অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি সহজাত কারণেই কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি অথবা লোকজীবনবোধকে আশ্রয় করে গল্প রচনায় সফলতা অর্জন করেছেন।
এক্ষেত্রেও আমাদের প্রশ্ন জাগে, লেখকের কাছে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ? ধর্ম, নাকি জীবন? নাকি বেঁচে থাকার জন্য বাঙালি মানব পরিবারের চিরায়ত অভ্যস্থতা? আমরা গল্পপাঠে বুঝতে পারি, লেখক এক্ষেত্রে আপোষ করেন অভ্যস্থতার সাথে। যেমন ‘রাক্ষস-গণ’ গল্পে দেখতে পাই, প্রেম অথবা মানবিক চেতনা অপেক্ষা মূখ্য হয়ে উঠেছে ‘ঠিকুজী কোষ্ঠী’; অর্থাৎ সুরেশ আর রেণুর বিয়ে সম্ভব নয়; কারণ, ‘উভয়ের ঠিকুজী কোষ্ঠী মেলাতে গিয়ে দেখা গেল মেয়ের রাক্ষস-গণ! মিলনের বহু বাধা, নক্ষত্রেরা সব তির্যক-গতিতে অবস্থান করছেন--- বিবাহ অসম্ভব।’
অথচ সবাই রেণুকে পছন্দ করেছে। সকলের ভেতর রেণুর প্রতি মমত্ব জেগে উঠেছে। সুরেশের ভেতর রেণুর অনুপস্থিতি এক ধরনের অভাব অথবা বলা চলে শূন্যতা তৈরি করে যা অনুরাগের নামান্তর। অথচ সবকিছু সহসা মিথ্যে হয়ে ওঠে একমাত্র ‘ঠিকুজী কোষ্ঠী’ বিশ্বাসের কাছে। সুরেশের বিভাবতি নামের অন্য এক সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো; আর এদিকে রেণুরও আরেক জায়গায় বিয়ে হবার পর শোনা গেলো বিয়ের পর রেণুর মা কলেরায় মারা গিয়েছে; অর্থাৎ রাক্ষস-গণ-এর মেয়ে রেণুর দোষ; তার দোষেই এ অনিষ্ট। ‘শেষ পর্যন্ত সুরেশের মনে হোল--- ভালই হয়েছে বিয়েটা না হয়ে, গণকের কথা একেবারে উড়িয়ে দেবার জিনিস তো আর নয়? ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।’
আমরা এভাবেই দেখতে পাই, লোকবিশ্বাসের কাছে প্রেম অথবা মানবিক চেতনা পরাজিত হতে থাকে। এমনকি গল্পের শেষে গিয়ে দেখি, চাকুরিতে উন্নতি হবার পর সুরেশ রসুলপুর বদলি হয়। তাদের বিশ্বাস দ্রুত ব্যবসায় টাকা আসতে থাকা আর চাকরিতে উন্নতি সবই তার বৌয়ের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। লোকবিশ্বাসে আক্রান্ত সুরেশ তার ভাগ্যবতী পয়মন্ত বৌকে নিয়ে রসুলপুর গমনের উদ্দেশ্যে ট্রেনে ওঠে। এ অবস্থায় সুরেশ দেখতে পায় ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে একজন বিধবা। সেই বিধবা আর কেউ নয়, রেণু। এই সেই রেণু, যে রেণুর অনুপস্থিতিতে এক সময় সুরেশের জীবন অর্থহীন হয়ে উঠেছিল। এই সেই রেণু, যে রেণুর সেবা এক সময় সুরেশ গ্রহণ করেছে। অথচ লেখক আমাদেরকে আজ সুরেশের ভেতরের সহজ বিশ্বাসের কথা শুনিয়ে দিলেন; যা ছিল মানবীয় চেতনার বিপরীত। চূড়ান্ত অর্থে লোকাচারের কাছে এখানে মানবতা পরাজিত হয়েছে। লেখকের বর্ণনায়,
‘‘সরুপাড় ধূতি পরা, হাত খালি, মাথায় আধরুক্ষ চুল, বিধবা বেশে রেণু। সুরেশ সেখানে আর দাঁড়াতে পারলো না, দিশাহারা ভাবে এসে নিজের গাড়িতে উঠলো। রেণু সম্ভবতঃ তাকে দেখেনি, তার চোখ অন্যদিকে ফেরানো ছিল। ... সুরেশের সারা শরীর দিয়ে কি যেন একটা ঝাঁজ বেরুচ্ছিল। নিজের কতকটা অজ্ঞাতসারে তার মনে হোল--- উঃ, কি বেঁচেই গিয়েছি! মার কথা যদি তখন না শুনতাম? রাক্ষুসীর ফাঁদই তো বটে!’’
এরপর গল্পের পরিণতিতে এসে লেখকের বিবেকবোধ লেখককে গল্পের শিল্পকৌশলের স্বার্থেই তাড়িত করে। ফলে লেখক সুরেশের মনোজগতে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপরতার পাশাপাশি রেণুর জন্য জাগিয়ে তুলেছেন সহমর্মিতাবোধ; যে বোধের কারণে সহসা আমাদের কাছে বিভূতিভূষণের গল্প হয়ে ওঠে বিষণ্নতার আধারে এক ধরনের প্রশান্তি প্রদায়ক অনুঘটক। প্রশান্তি প্রদায়ক এ কারণে যে, লেখক সুরেশের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে রেণুর জন্য সহানুভূতি প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে আমরা প্রশান্তি লাভের সুযোগ পেয়ে যাই। আমরা সহসা মানবিক হয়ে ওঠার সুযোগ লাভ করি। গল্প হয়ে ওঠে প্রশান্তি প্রদায়ক। অথচ হাস্যকর হলেও সত্য আমরা কখনোই কেউ রেণুর কোনো দায়িত্ব নেই না এবং অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের অথবা সুরেশের এই বিষণ্নতা অথবা সহমর্মিতাবোধ রেণুর জন্য কোনোই ফল বয়ে আনে না। এও মানব মনের এক ধরনের উপর-চালাকি এবং পলায়নবাদি চেতনা; যে চেতনার প্রকাশ ঘটে ‘আহা উহু’ ধ্বনি প্রকাশের মধ্য দিয়ে; আর এই হা-হুতাশও পক্ষান্তরে লোকাচারেরই অংশ। এই লোকাচার গোষ্ঠীগত অর্থে মনোসামাজিক লোকাচার। আর সুরেশের লোকাচার মূলত মনোদৈহিক লোকাচার। মনোদৈহিক লোকাচারের উদাহরণ পাওয়া যায় সুরেশের মানসকথনের ভেতর, ‘হঠাৎ সুরেশের মনে দূর-সম্পর্কিত সহানুভূতিশূন্য এক আত্মীয়ের দ্বারস্থ এই পিতৃমাতৃহীনা নিরপরাধা অভাগিনী বালিকার ছবিটি সম্পূর্ণ অন্যভাবে ফিরে এল। কার অপরাধে এই প্রস্ফুট-মুকুল-প্রথম-বসন্তের দিনে তার জীবনের আনন্দ-দীপটি নির্বাপিত হয়ে গেল চিরদিনের মত?’
অপঘাতে মৃত্যু, হত্যা, আত্মহত্যা বিবিধ বিষয় নিয়ে প্রত্যন্ত পাড়াগাঁ থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্টেশন, পুরোনো বাড়ি, রাজবাড়ি অথবা জমিদার বাড়িকে আশ্রয় করে লোকসমাজে আধিভৌতিক গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিভূতিভূষণ এই জাতীয় বিষয়াদি তাঁর ‘হাসি’ গল্পের ভেতর সংযুক্ত করেছেন। আমরা আধুনিক শিক্ষার আলোকে এ ধরনের বিষয়াদির যৌক্তিকতা অস্বীকার করলেও আমাদের মানসজগতে ভৌতিক বিষয়াদিকে কেন্দ্র করে যে ফ্যান্টাসি ও শিহরণের সৃষ্টি হয় তাকেই লেখক গল্পের জাদুশক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃত বাস্তবতায় এ জাতীয় লোকজ-অনুষঙ্গ সমাজ-মনস্তত্ত্ব উপস্থাপনের সহায়ক। বিভূতিভূষণ জেনে শুনেই লোকসমাজের প্রবাহমান বাস্তবতাকে উপস্থাপনের স্বার্থে বিষয়গুলো তাঁর গল্পে কাজে লাগিয়েছেন। এই একই গল্পে হারিয়ে যাওয়া মানব পরিবারের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় অতিপ্রাকৃত ঘটনা সংস্থাপনের মধ্য দিয়ে। যেমন, ‘বনভূমি তখন নিস্তব্ধ--- চাঁদ ডুবে গিয়ে নদী আকাশ বন সব অন্ধকারে একাকার! আমার চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছে, এমন সময় অন্ধকারভরা গভীর বনভূমির দিক থেকে আর একবার সেই বিকট হাসির রোল উঠলো। শেষরাত্রের চাঁদ-ডোবা অন্ধকারে সেটা এত অমানুষিক, এত পৈশাচিক ঠেকলো যে তখন আমার বালক-বয়স হলেও হাসিটার প্রকৃত রূপ বুঝে বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল।’
লেখকের গল্প অনুসারে লোকশ্রুতিতে পাওয়া যায়, সুন্দরবনের যে গভীর বনাঞ্চল থেকে অভিশপ্ত অশরীরী আত্মার এই পৈশাচিক উল্লাস-ভরা অট্টহাসি ভেসে আসে সেখানে কখনো বা কোনো জনপদ ছিল। আজ ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মৃতনগরীর অতৃপ্ত মানব আত্মারা প্রতি রাতে চিৎকার অথবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। একই পরিবেশ লেখক তৈরি করেছেন ‘প্রত্নতত্ত্ব’ গল্পে। হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতা জীবন্ত হয়ে উঠেছে গল্পের ভেতর। লেখকের কৌতূহল শুধু বর্তমান নিয়ে নয় অথবা শুধু ইতিহাস নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন; তিনি ইতিহাসের পথ ধরে সরাসরি পৌঁছে যেতে চান অতীত সভ্যতা অতীত চরিত্র অতীত পরিবেশ ও প্রতিবেশে। ফলে লেখককে লোকজ বিশ্বাসের আশ্রয়ে লোকশ্রুতির আশ্রয়ে আধিভৌতিক পরিবেশ নির্মাণের মাধ্যমে গল্পের আঙ্গিক নির্মাণ করতে হয়েছে। এই আঙ্গিককৌশলে বিভূতিভূষণ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো অতীত চরিত্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। আমরা দ্বিধান্বিত হই; শিহরিত হই অথবা সহসা সময়ের সমস্ত যৌক্তিকতা অতিক্রম করে অতীতচারী হয়ে উঠি। আমাদেরকে এ পর্যায়ে এসে বুঝতে হবে লোকবিশ্বাসের আশ্রয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে বিভূতিভূষণ তাঁর গল্পে সময়ের সীমানাকে ভেঙেছেন অথবা অস্বীকার করেছেন। লেখকের দৃষ্টিতে অতীত কখনো বিলুপ্ত হয় না; কেননা অতীতের ওপর দাঁড়িয়েই বর্তমান মূর্ত হয়ে ওঠে। সুতরাং অতীত অভিজ্ঞতা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় লেখকের কাছে এবং লেখক তাড়না বোধ করেন মানব প্রজাতির যাবতীয় জ্ঞানকে যাবতীয় অর্জনকে যাঁচাই করে দেখতে। লেখক লোকবিশ্বাসের হাত ধরে স্বপ্ন-বাস্তবতার কৌশলে কখনো বা জাদুবাস্তবতার টেকনিকে আমাদেরকে পৌঁছে দেন মানব পরিবারের লব্ধ অভিজ্ঞতার নিকট। আমরা গল্পের ভেতর দেখি বৌদ্ধ-ভিক্ষু বলছেন,
‘‘তুমি যে মূর্তিটি মাটি খুঁড়ে বার করেছ, তারই টানে অনেক দিন পরে আজ আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। নয় শ’ বৎসর আগে আমি তোমার মতই পৃথিবীর মানুষ ছিলাম। যে স্থান তোমরা খুঁড়েছ, ওই আমার বাস্তুভিটা ছিল। তুমি জ্ঞানচর্চায় সমস্ত জীবন যাপন করেছ, এই জন্যেই তোমার কাছে আসা আমার সম্ভব হয়েছে; এবং এই জন্যেই আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমার জীবনের কতকগুলি প্রধান প্রধান ঘটনা তোমাকে দেখালাম। আমি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান,--- নরপালদেবের সময়ে আমি নালন্দা মহাবিহারের সঙ্ঘস্থবির ছিলাম। ভগবান তথাগতের অমৃতময়ী বাণীতে আমার মন মুগ্ধ হয়েছিল; সে জন্য দেশের হিন্দু-সমাজে আমার জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়।...
অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযান জয়যুক্ত হোক।’’
লোকাচারকে আশ্রয় করে বিভূতি-র ছোটগল্প নান্দনিকতা লাভ করলেও প্রশ্ন ওঠা প্রাসঙ্গিক, বিভূতিভূষণের প্রতিপালিত ধর্ম কোনটি অথবা সেই ধর্মের বৈশিষ্ট্য কেমন? তিনি বাঙালি সমাজের সনাতন ধর্মে জন্ম নিয়েছিলেন সন্দেহ নেই; কিন্ত সন্দেহ আছে সেই ধর্মের কতটুকু তিনি কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর ছোটগল্পে লোকসংস্কৃতির ব্যবহার, তাৎপর্য ও পাঠ-গ্রহণ বিষয়ে সতর্ক হলে আমাদেরকে একটি বিষয়ে একমত হতে হবে তা হলো, নিঃসন্দেহে ‘জ্ঞান’ই চূড়ান্ত অর্থে বিভূতিভূষণের ধর্ম; অজ্ঞানতা তাঁর কাছে ধর্মহীনতার নামান্তর। ফলে তিনি প্রথাগত ধর্মের ভেতর বাস করেও সংশয়বাদী। পক্ষান্তরে প্রতিনিয়ত জ্ঞান অনুসন্ধানের পথ ধরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতিবাদি। প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মানবতাবাদই চূড়ান্ত অর্থে মানবজীবনের মুক্তির পথ। ফলে তিনি প্রথাগত ধর্মের ভেতর বাস করেও প্রথাগত ধর্মের শেকড় ধরে টান দিয়েছেন। চিরায়ত লোকবিশ্বাসের ভেতর বাস করেও লোকসংস্কৃতিকে তিনি যাঁচাই করে নিয়েছেন মানবতাবাদের আলোকে। আচারমুখর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম শেষ পর্যন্ত লোকসংস্কৃতির কাছে নিস্তেজ হয়ে উঠেছে। তাঁর গল্পে আচারবাদিদের জায়গা দখলে নিয়েছে সাধারণ মানুষ এবং চূড়ান্ত ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ।
ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে ম্যাজিক-রিয়ালিজমের কথা বলা হলেও আমাদের বাঙালি মানস ও লোকাচারের ভেতর সহজাতভাবে মিশে আছে ম্যাজিক-রিয়ালিজমের জাদুশক্তি; যা বিভূতি-র লেখার আঙ্গিক বিশ্লেষণ শুধু নয় বিশেষ করে লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লোকজীবন নিয়ে আলোচনা করতে হলে অনিবার্যভাবে চলে আসবে। যদিও তিনি ম্যাজিক-রিয়ালিজম বিষয়ে কিছুই জানতেন না; কেননা তখনও তাত্ত্বিকগণ এ বিষয়ে তেমন একটা মুখ খোলেননি। যাই হোক আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্পের পরিবেশ আর সেই পরিবেশে জড়িয়ে থাকা মানুষেরা প্রকৃতির অংশ হিসেবে চিরকালের চিরায়ত মিথে রূপান্তরিত হয়ে মিথের ভেতরই বেঁচে থাকে; চিরায়ত মিথের ভেতর জীবন যাপন করে; লোকবিশ্বাসের ওপর আস্থা রেখে লোকাচারকে জীবন যাপনের ধর্ম হিসেবে দৈনিকতার সাথে মিলিয়ে নিয়ে টিকে থাকে প্রকৃতিলালিত বাস্তবতার আধারে। এই প্রকৃতিলালিত বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ‘দাতার স্বর্গ’ গল্পে পাই,
ক. স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা নেমে এসেছেন নবরূপ ধরে প্রজার দুঃখ দূর করতে।
খ. ভগবান শুধু আমার মধ্যে দিয়েই তাঁরই ধন তাঁর জীবদের দিচ্ছেন বই তো নয়।
গ. দূর আকাশের নীল-সাগরের পারে একটি নক্ষত্র যেন তাঁর দিকেই চেয়ে জ্বলছে, প্রলয়কালের বিশ্বের
অনন্ত-জলময়ী প্রসারতার মাঝখানে অনাদিকারণ প্রজাপতির চিরজাগ্রত নেত্র-জ্যোতির মত!
ঘ. তিনি তাঁর কৃতকার্যের ফলাফল শুনতে যমরাজের খাস-দরবারে নীত হলেন। সামনে প্রকাণ্ড খাতা
খুলে বসে চিত্রগুপ্ত।
আমরা এই গল্পে দেখতে পাই, দাতা কর্ণসেনের আভিজাত্যের অহঙ্কার মিথ্যে হয়ে যায়। শেষাবধি তিনি দেখেন চিত্রগুপ্তের দরবারে চূড়ান্ত বিচারের খাতায় তার জন্য কোনো পুরস্কার লেখা নেই; নেই কোনো পূণ্য; বরং দেশে প্রচণ্ড মহামারির সময় কর্ণসেন প্রজাদের জন্য নিজের বাড়ির মায়া ত্যাগ না করায় তাকে নিয়ে সারা রাজ্যে ধিক্কার উচ্চারিত হয়; সেই ধিক্কারের ভেতর যখন কর্ণসেন খ্যাতি অর্জনের লোভ পরিত্যাগ করে প্রজাদের আশ্রয়ের জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে দিলেন তখন তার জন্য চিত্রগুপ্তের খাতায় পুণ্য লেখা হলো। অর্থাৎ আচারনির্ভর ধর্মীয় রীতিকে লেখক এই গল্পে আক্রমণ করেছেন; সেইসাথে আক্রমণ করেছেন মানবজীবনের প্রদর্শনযোগ্য আভিজাত্যের মোহকে। এই গল্পে চূড়ান্ত অর্থে মানবিক মূল্যবোধের বিষয়টি লোকাচারের আলোকে তথা ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে মূখ্য হয়ে উঠেছে।
‘খুঁটি-দেবতা’ গল্পে ঘরের একটি সাধারণ বাঁশের খুঁটি কীভাবে ব্যক্তিমানসের কাছে নালিশ জানানোর অবলম্বন হয়ে ওঠে; আর সেই খুঁটি কীভাবে শেষ পর্যন্ত দেবতার চরিত্র লাভ করে তারই খুটিনাটি বর্ণনা, চরিত্রের বিকাশ, চরিত্রসমূহের মনোলোক উন্মোচন এবং পারিপার্শ্বিকতাকে গল্পে জীবন্ত করে তুলবার জন্য যে ভাষারীতি, --- এই সার্বিক বিষয়াদি যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমাদেরকে বিভূতিভূষণের গল্প নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একই অর্থে ‘গ্রহের ফের’ এবং ‘মরীচিকা’ গল্প দুটোও লোকজীবন অর্থাৎ লোকসংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে রচিত চিরায়ত দীর্ঘশ্বাসের গল্প। একই অর্থে বলা সম্ভব আলোচ্য গল্পগ্রন্থের দশটি গল্পই চূড়ান্ত বিচারে বিভূতিভূষণের চিরায়ত-লোকমানস প্রকাশজ্ঞাপক গল্প। ‘মৌরীফুল’ তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। এই গ্রন্থের সবগুলো গল্প লৌকিক-বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও প্রতিটি গল্পের গভীরে এবং অর্থবিস্তারে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক চেতনাজাত আবহ। ফলে প্রতিটি গল্প সহজেই চিরায়ত জীবনস্রোতের সাথে একাত্ম হয়ে ওঠে।
আমাদেরকে আজ স্বীকার করতেই হবে, বিভূতিভূষণ শুরু করেছিলেন শুরু থেকে। শুরুর পটভূমি, লোকজীবন। প্রকৃত প্রস্তাবে লোকজীবনের হাত ধরেই মানব-পরিবার এতদূর হাটতে শিখেছে। হাটতে গিয়ে মানুষের পা কতটুকু স্বনির্ভর হয়ে উঠলো আর কতটুকুই বা দুর্বল থেকে গেলো, এ বিষয়টিও খুঁজে বের করা সম্ভব লোকজীবন অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। বিভূতিভূষণের ‘অনুসন্ধানকৌশলী-চোখ’ সমকাল অপেক্ষা প্রখর; বলা সম্ভব তাঁর চোখ ইতিহাস অপেক্ষাও কিছুটা এগিয়ে ছিল।
বিভূতিভূষণের ভেতর ব্যক্তিমানুষকে দেখার যে বৈশিষ্ট্য ছিল, সে বৈশিষ্ট্য শেষাবধি শুধুমাত্র ব্যক্তিকে উপস্থাপন করে না; বরং এই একক ব্যক্তি হয়ে ওঠে গোষ্ঠীমানব। এবং এই গোষ্ঠীমানব শেষাবধি হয়ে ওঠে চিরায়ত সত্যভাষণ। সেই চিরায়ত সত্যভাষণের গভীর থেকে প্রকাশ পেয়েছে এক ধরনের প্রাচীন দীর্ঘশ্বাস; আর সেই প্রাচীন দীর্ঘশ্বাসের ভেতর থেকে ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে চিরায়ত ও চিরকালীন বাঙালি জীবন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গল্প পরিচিত পথে সাবলীল এগিয়ে গিয়েছে; এই এগিয়ে চলার ভেতর তিনি নিজেও উপস্থিত থেকেছেন। নিজের উপস্থিতির সাথে যখন তিনি তাঁর পারিপার্শিকতাকে মিলিয়ে নিয়েছেন তখন তাঁর গল্প আর নিছক গল্পের ভেতর আটকে না থেকে হয়ে ওঠে বিস্তর জীবনের পটভূমি।
বিভূতিভূষণের গল্প শেষ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর আটকে থাকে না। তাঁর গল্প নির্দিষ্ট প্লটের ভেতর আটকে থেকে দম বদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় না; বরং বিভূতিভূষণের গল্প মানব-জীবনকে ছড়িয়ে দিয়েছে এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষের সীমানায়। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্প একটি একক ঘটনার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি হয়তো রবীন্দ্রনাথের গল্পের মতো একক চরিত্র অথবা একক ঘটনার চূড়ান্ত মুহূর্ত নির্মাণে অতটা বিশ্বাসী ছিলেন না; ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গল্পপাঠে আমরা পেয়ে যাই বহুর মিশ্রণ, বহু স্তরের মিশ্রণ, সামাজ বিকাশের নানা অনুষঙ্গ। এ সব কিছুই সম্ভব হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ কারণে, তা হলো তিনি তাঁর গল্পের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কখনো বা পরোক্ষভাবে কখনো বা প্রত্যক্ষভাবে রেখেছেন বাঙালি চিরায়ত লোকজীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গসমূহ। ফলে তাঁর গল্প মানবজীবনের শেকড় থেকে যাত্রা শুরু করে ক্রমশ অগ্রসর হয় কাণ্ডে, অতঃপর সবুজ শাখা ও উপশাখায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকতে তাঁর ষোলটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পায়, মেঘমল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৭), কিন্নর দল (১৯৩৮), বেনীগীর ফুলবাড়ী (১৯৪১), নবাগত (১৯৪৪), তালনবমী (১৯৪৪), উপলখ- (১৯৪৫), বিধু মাস্টার (১৯৪৫), ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫), অসাধারণ (১৯৪৬), মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭), আচার্য্য কৃপালনী কলোনী (১৯৪৮), জ্যোতিরিঙ্গণ (১৯৪৯), কুশল পাহাড়ী (১৯৫০)--- এই ষোলটি গল্পগ্রন্থ অনুসন্ধানে আমরা প্রায় ক্ষেত্রেই লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির গন্ধ খুঁজে পাই। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত রূপহলুদ (১৯৫৭), অনুসন্ধান (১৯৬০), ছায়াছবি (১৯৬০)--- এই তিনটি গল্পগ্রন্থ বিষয়েও একই মন্তব্য করা সম্ভব। প্রশ্ন উঠতে পারে এর কারণ কী?
ভারতের বাঙালি গ্রামীণ সমাজের সামন্ততান্ত্রিক জীবনভিত্তিক বিশ্বাস, যে বিশ্বাস লোকসংস্কৃতির ভূমিতে লালিত হলেও পক্ষান্তরে তা শোষণের ভূমিকায় কার্যকর। এ বিষয়েও লেখকের চেতনা বোধকরি চলমান ছিল, অন্তত তাঁর গল্পপাঠে তেমন ইশারাই পাওয়া সম্ভব। এই চিরায়ত চেতনার হাত ধরেই তাঁর গল্পে অবলীলায় স্থান পেয়েছে কৃষিপ্রধান জীবন, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ভূমিব্যবস্থা, ফসল, ভোগপিপাসা ও ব্যক্তি-আকাক্সক্ষা। বিভূতি-র কাছে বাঙালিজীবন, বাঙালিসংস্কৃতি আর বাঙালি-গ্রাম ছিল আত্মীয়তুল্য; এই আত্মীয়তার সূত্র ধরে তিনি লোকায়ত সংস্কৃতির বিশাল ক্যানভাসের শরীরে গল্প অঙ্কনের স্বার্থে বিবিধ রঙের ব্যবহার করেছেন। এই বিবিধ রঙ একান্তই ভারতবর্ষীয়; ইউরোপ থেকে ধার করা নয়। বলা সম্ভব সে সময়ে বিভূতিভূষণই একমাত্র লেখক যিনি ইউরোপীয় ধারা থেকে নিজেকে সচেতনভাবে সরিয়ে রাখতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সত্যিকারের লোকায়ত জীবনের নানা উপাচার ও অনুষঙ্গের। অবশ্য তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলী বাকের উপকথা’সহ বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাসে লোকায়ত জীবনের চিরায়ত সত্য মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে; তা সত্ত্বেও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে তারাশঙ্কর উপন্যাস অথবা ছোটগল্পের আখ্যান নির্মাণের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় রীতিকে অস্বীকার করতে পারেননি। যাই হোক, সঙ্গত কারণেই ভারতীয় দর্শনের আলোকে বাংলা কথাসাহিত্য হয়ে উঠতে পারতো বিভূতিভূষণের ধারাবাহিকতায় একান্তই ভারতীয়। অথচ আমরা দেখেছি ইউরোপ থেকে আমদানি করা কৃৎকৌশল ও দর্শনের এক পতনমুখর ধারাক্রম। অনেক পরে দেবেশ রায় যে বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদেরকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন। তিনি ভগীরথ মিশ্র সৈয়দ মুস্তফা সিরাজকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইউরোপ ও ভারতের পার্থক্য বোঝাতে বলেছিলেন, ‘ফারাক দুটি ভূখণ্ডের মাটিতে, আবহাওয়ায়, জলবায়ুতে, খাদ্যে, পোশাকে, রীতিনীতিতে, শিক্ষাদীক্ষায়, যাপনে, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে, মননে, দর্শনে, সংস্কারে, বিশ্বাসে সব কিছুতেই। ফলে, এই দুটি ভূখণ্ডের সাহিত্যেও ফারাকগুলো খুবই প্রত্যাশিত ছিল। এই যে সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ, তার হাজার-হাজার বছরের ইতিহাস, তার মন্দির-মসজিদ-দেউল, লোকায়ত ঐতিহ্য, সর্বোপরি তার নিজস্ব মানসপট, জীবনদর্শন--- সব কিছু সাপটে খুব শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারত এদেশের সাহিত্যে।’
বিভূতিভূষণের গল্পের শহর আদতে আমাদের ভারতীয় বাঙালি-সংস্কৃতি আশ্রিত গ্রামেরই বর্ধিত সংস্করণ। ফলে কী শহুরে প্রেক্ষাপটে লিখিত গল্প কী পাড়াগেঁয়ে গল্প সব জায়গাতেই আমরা পেয়ে যাই লোকায়ত জীবনের সোঁদামাটির গন্ধ, মায়া, আবেগ ও সরলতার ভেতর এক ধরনের গভীরতা ও জীবনমুখিনতা এবং আত্মকথন। বিভূতিভূষণের পর যারা গল্প লিখতে এসেছেন, অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের গল্পকারদেরকে কিন্তু এসব ভাবতে হয়েছে। দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধের পর দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যা, নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থান অথবা চারু মজুমদার, সিরাজ সিকদার, এর মাঝে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়া অথবা ইউরোপের সাথে গণচীনের আপোষকামিকা সবকিছু মিলিয়ে কিন্তু একটা হতচকিত অবস্থায় ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ এমন একটি লোকদেখানো ডাকসাইটে স্লোগানের ওপর অনাস্থা ক্রমশ দানা বেঁধে উঠলে এনজিও-গুলো যখন বন্ধুর ভেক ধরে দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার জন্য ডলার বিলাতে শুরু করেছে তখন আমাদেরকে কিন্তু বিভূতিকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে বেশ কিছু অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কালচার, লোকপ্রথা অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধের বিবর্তনরেখা এখন কোন পথে? কোন পথে এই বিবর্তরেখার গথিপথ থাকা উচিত ছিল? প্রসঙ্গত বলতে হবে, লোকায়ত জীবনের ছায়াপাতের মধ্য দিয়ে লোকায়ত দর্শনের আলোকে গণচেতনার পথ কি সত্যিকার অর্থেই বিভূতিভূষণ তাঁর ছোটগল্পে অনুসন্ধান করেছিলেন?
টি এস এলিয়ট তাঁর ‘ট্রাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’ প্রবন্ধে প্রকৃতির ভেতর এক ধরনের ‘নেগেটিভ কেপেবিলিটি’-র বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছিলেন। সেখানে যে চিরায়ত নির্লিপ্ততার কথা বলা হয়েছে সেই নির্লিপ্ততার প্রতিভাষ পাওয়া যায় বিভূতি-র গল্পে। তাঁর গল্পে যখন আমরা লোকায়ত জীবনের সন্ধান করি তখনই এই নির্লিপ্ততার প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে সবই যেন চিরকালীন অনিবার্যতার ভেতর দিয়ে ঘটে চলেছে; সেখানে মানুষ প্রকৃতির সহসত্তা মাত্র; মানুষের কিছুই করার নেই; মানুষ নির্লিপ্ত বাস্তবতা মাত্র। সুতরাং ‘খুঁটি-দেবতা’ গল্পের নন্দলাল অথবা তার স্ত্রী অথবা নন্দলালের মামা রাঘব চক্রবর্তীর কিছুই করার থাকে না অথবা অপরাপর গল্পের পাত্রপাত্রিদেরও আমরা দেখি চিরায়ত বিশ্বাসের কাছে নতজানু হয়ে ঘটে যাওয়া বাস্তবতাকে মেনে নিতে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো এখানেই কি সব শেষ? না, শেষ নয়। এর পরেও আমরা এমন এক দর্শনের ইশারা পেয়ে থাকি বিভূতি-র গল্পপাঠে, যে ইশারার ভেতর আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্পের পাত্র পাত্রিরা মহাকালের ইশারায় থমকে থাকে না; তারা অগ্রসর হয় সময়ের সাথে, বিবর্তনের পথে। ফলে অরণ্য, গাছপালা, প্রকৃতি অথবা মানুষ শুধুমাত্র প্রকৃতির ভেতর আটকে থাকে না, সকলেই জেগে ওঠে; তারা উপলব্ধি করে জীবনকে এবং জীবনের পরিবর্তনকে খুঁজে নেবার জন্য তারা ব্যাকুল হয়। এই ব্যাকুলতা আমরা দেখতে পাই ‘গ্রহের ফের’ গল্পে রাজচন্দ্রবাবুর চরিত্রে এবং আমরা দেখতে পাই লোকবিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে গণিতের হিসেব সেখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা দেখতে পাই, বিজ্ঞানের সাথে সাথে দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে মানুষের পরিবার আর পরিবারের চিরায়ত বিশ্বাসসমূহ।
লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোজের কাছে ছোটগল্প লেখা এক ধরনের ধর্মযাত্রার নামান্তর। এই ধরনের ধর্মযাত্রায় তিনি যে রোমাঞ্চ বোধ করতেন সেই রোমাঞ্চ থেকে তিনি মানবজীবনকে দেখতেন সূচনাবিহীন তাৎপর্যের আতশবাজি হিসেবে। তিনি তাঁর ‘ট্রেঞ্জ পিলগ্রাম’ গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন, তাঁর নিজের গল্পের শুরুও নেই শেষও নেই। আমরা জানি, জীবনের এই শুরু বা শেষ না থাকার বিষয়টি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মানবজীবনের বৈশিষ্ট্যনির্ভর অভিযাত্রা। কেননা এ সময়ের লেখকগণ জেনে গেছেন কোনো মৃত্যুই শেষ পর্যন্ত জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারে না। বরং জীবনের শুরুও নেই, শেষও নেই। আমরা বিভূতিভূষণের গল্পে লোকায়ত জীবনের দিকে তাকালে এ ধরনের অনুভূতির মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা লাভ করি। আধুনিক নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট মানবজীবনের বিস্ময়কর স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছেন তাঁর প্রতীকপ্রধান নাটকে; ব্যাকেটের এই বিস্ময়কর স্বাধীনতার বিপরীতে বিভূতিভূষণ এক ধরনের চিরায়ত বন্ধনের প্রতিচ্ছবি আবিষ্কার করেছেন তাঁর লোকায়ত জীবন অনুসন্ধানের ভেতর; অর্থাৎ ব্যাকেটের বহু আগেই বিভূতি-র লেখকসত্তায় চিরায়ত বন্ধনের আলোকে এক ধরনের অনিবার্য বিস্ময়কর স্বাধীনতার আকুতি লক্ষ করা গিয়েছিল। অথবা বেকেটের এই যে অপার স্বাধীনতাবোধ, যে বোধ বহু আগেই বিভূতি পেয়েছিলেন, সেই বোধের ভেতর পাওয়া যায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের নির্জনতা, শৈশবের প্রিয় খেলার মাঠ অধবা আত্মজৈবনিক চেতনার স্ফূরণ। এই আত্মজৈবনিকতা বিভূতি-র গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি আত্মজৈবনিকতার সাথে প্রকৃতিকে সংযুক্ত করে পক্ষান্তরে জীবন ও প্রকৃতির ভেতর অনন্ত স্বাধীনতার স্বাদ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। বিভূতিভূষণ তাঁর গল্পের মধ্যে সেই অপার স্বাধীনতার আলোকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন অনন্ত জীবনের অনিবার্য সম্ভবনা। তিনি তাঁর অধিকাংশ গল্পের পটভূমি নির্মাণ করেছেন গল্পের ভেতর তাঁর নিজের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। ফলে গল্পগুলো সহজেই হয়ে উঠেছে বিশ্বাসযোগ্য। আর যখন সেই বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে সংযুক্ত হয়েছে হাজার মানুষের হাজার বছরের বিশ্বাস অথবা লোকধর্ম, তখন সেই বিশ্বাযোগ্যতা মুহূর্তেই মিথে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় তাঁর গল্পসমূহ হয়ে উঠেছে চিরকালিন বাঙালি জনজীবনের চিরায়ত প্রতিচ্ছবি।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’গ্রন্থের ভূমিকাতে বলেছেন, ‘আমাদের দর্শন অতীতকে বর্জন করে অগ্রসর হতে পারেনি, অতএব তার মধ্যে টিকে থেকেছে প্রাচীন-- এমনকি আদিম পর্যায়ের বহু ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস। ফলে, ভারতীয় দর্শনের একটি চিত্তাকর্ষক বৈশিষ্ট্য বলতে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস ও পৌরাণিক কল্পনা--- এমনকি সাধনপদ্ধতি ও অনুষ্ঠানাদি থেকে অসম্পূর্ণ মুক্তি, এবং অন্তত আপাতদৃষ্টিতে বা অত্যাশ্চর্য প্রতীত হয় জটিল, গভীর ও অত্যন্ত সুউন্নত দার্শনিকতার সঙ্গে এগুলির সহাবস্থান।’ আমরা যখন বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে লোকায়ত জীবনের বিবিধ লোকাচার অনুসন্ধান করি তখন আমাদেরকে অবশ্যই সঙ্গতকারণেই বিবেচনায় রাখতে হয় ভারতীয় বৈদিক এবং অবৈদিক উভয়বিধ দর্শন। কেননা ভারতীয় দর্শনের সাহায্যেই বাঙালি লোকাচারের যথার্থ ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞজনের কাছে আমার প্রস্তাব থাকবে বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে লোকসংস্কৃতি অনুসন্ধান করতে হলে ভারতীয় দর্শনের আলোকে আমাদের ঐতিহ্যগত উৎসের যথার্থতা যাচাই করে নেওয়া; এবং পাশাপাশি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে লোকায়ত জীবনের গ্রহণীয় বর্জনীয় বিষয়াদিকে চিহ্নিত করার যৌক্তিক রূপরেখা নির্মাণ করা। আমরা অবশ্যই স্বীকার করবো, বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে অঙ্কিত যে সমাজ আমরা পাচ্ছি, সেখান থেকে চিরায়ত বাঙালি জীবন সরে আসতে শুরু করেছে। এই সরে আসা প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে উপস্থাপিত লোকসংস্কৃতির ভিন্নতর পাঠগ্রহণ আজ যৌক্তিকতা দাবি করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমান সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে বিভূতিভূষণের গল্প থেকে আমরা কীভাবে পাঠ গ্রহণ করবো? প্রশ্নটি অপরিহার্য এই জন্য যে, আমরা আমাদের বর্তমান সভ্যতার ওপর দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের অকল্পনীয় প্রয়োগ ও সফলতায় বিহ্বল। এবং সঙ্গত কারণেই মানব প্রজাতি ক্রমশ মাত্রা-অতিরিক্ত অহঙ্কারি হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অথচ এহেন অহঙ্কারের পাশাপাশি আমরা এখনও একটি অসাম্প্রদায়িক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি; সমাজের বহুস্তরের ভেতর গ্রহণযোগ্য কোনো সমঝতায় এখনও আমরা পৌঁছুতে পারিনি; ফলে আমাদেরকে বাস করতে হচ্ছে বর্ণভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, পেশাভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, ধর্মভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, শিক্ষাভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর, সম্পদভিত্তিক স্তর-বিভাজনের ভেতর। এই যে নানাবিধ স্তর-বিভাজন, যা পক্ষান্তরে মানবিক চেতনার পরিপন্থী।
আমাদের করণীয় কী? এর পাশাপাশি আমাদেরকে এও ভাবতে হচ্ছে বিভূতিভূষণের গল্পের মানুষগুলোর দৈনন্দিন-বিশ্বাস আর আচরণের সাথে মানবিকতার বিষয়টি কতটুকু সংযুক্ত? এ কথা ঠিক যে, প্রত্যেক জাতির একটা নিজস্ব ঐতিহ্য-আশ্রিত কালচার আর পালনীয় ধর্ম বা প্রথা বা লোকবিশ্বাস অবশ্যই থাকে; এ বিষয়গুলোকে সাথে নিয়েই জাতিগতভাবে মানব সমাজ ক্রমশ মানবিক হয়ে উঠতে থাকে। এই চেতনাটিকে বিভূতি প্রযত্নের সাথে বিবেচনায় রেখেছিলেন। ফলে তাঁর গল্পে উপস্থাপিত সমাজে বা গোষ্ঠীতে সচরাচর অসঙ্গতি চোখে পড়ে না; বরং অসঙ্গতি থাকলেও তা আড়ালে থাকে; অথবা লেখক সমাজের বহুস্তরভিত্তিক অসঙ্গতিকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে মানবসমাজের ভেতর যে চিরায়ত অনিবার্য বন্ধনের জায়গাটি রয়েছে সেটিকেই বড় করে তুলেছেন তাঁর গল্পে। ফলে তাঁর গল্পের সংকটগুলোকে যদি আমরা মর্গান থেকে শুরু করে মার্কস যেভাবে সভ্যতার গতিবিধিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন সেভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি দেখবো, বিভূতিভূষণ সমাজের গোষ্ঠীগত আবেগ অথবা সমাজ গঠনের স্বার্থে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের যে অনিবার্যতা তাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে তাঁর গল্পে উপস্থাপিত সামাজিক নানাবিধ শ্রেণিবিন্যাস আমাদের চোখে প্রকট হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। বরং গল্পের অধিকাংশ ঘটনাকেই মনে হয় স্বাভাবিক, অনিবার্য আর চিরায়ত; যেখানে রয়েছে এক ধরনের মানবিক বন্ধন ও মায়া। এ কারণে বিভূতিভূষণের গল্পের মানুষগুলো সহজেই আমাদের পরিচিত আপনজন অথবা আত্মীয় হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়ে যায়।
গল্পের ভেতর এমন আত্মীয়সুলভ অবস্থা সৃষ্টির জন্য লেখক লোককথা, লোকজীবন, কিংবদন্তি, ফোক-বিলিভ, দৈনন্দিন আচার, কুসংস্কারসহ বিবিধ লোকজ উপাদানকে লেখার মালমশলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে তিনি এই লোকজ উপাদানগুলোকে যতটা না সরাসরি ব্যবহার করেছেন তার চেয়ে অধিক প্রয়োগ করেছেন মনোসামাজিক প্রেক্ষাপটে। এখানেই বিভূতিভূষণ সমকাল থেকে এগিয়ে গিয়েছেন। আর মনোসামাজিক বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়ার ফলে গল্পের ঘটনাবিন্যাস এবং চরিত্রের গতিবিধি হয়ে উঠেছে সমাজে ঘটে যাওয়া সহজাত মানসজগতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারপরও এই সময়ের পাঠকের সমাজবীক্ষণ-পদ্ধতি ও প্রাজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে আমরা বিভূতিভূষণের গল্পের সমাজ আর সমাজের মানুষকে শুধুমাত্র চিরায়ত মানবিকতার ধুয়া তুলে অথবা ভাববাদি চেতনায় আবেগতাড়িত হয়ে একচেটিয়া বাহবা দিতে প্রস্তুত নই। আমরা বরং লোকায়ত বিষয়সমূহ বস্তুগতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী।
কমরেড ননী রায় এর মতো আমরা অনেকেই মনে করি, সনাতন বা চিরস্থায়ী বলে আসলে কিছু নেই, সবকিছুই পরিবর্তনশীল, এই পরিবর্তন চলছে প্রতি মুহূর্তে; আর তাছাড়া সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে জ্ঞানের রাজ্যের নেই কোনো নির্দিষ্ট ভূগোল। আমরা বিভূতিভূষণের চিরায়ত বাঙালি জীবনের ভেতর দিয়ে এই সত্যের অবভাষ ভেসে উঠতে দেখি। ‘মৌরীফুল’ গল্পে গ্রাম্যবধূ সুশীলা এবং কলকাতার বউয়ের ভেতর যে সখীত্ব, তারা যেভাবে নদীতীরের মৌরীফুল দিয়ে চিরকালীন বন্ধনে নিজেদেরকে বেঁধে ফেলে তা আমাদের মতো শহুরে হিসেবি মানুষের বোধগম্য হবার কথা নয়; তারপরও আমাদেরকে মনে রাখতে হয়, এই গল্পের লোক-অনুষঙ্গ শেষ পর্যন্ত পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানবিকতার ভেতর দিয়ে যেভাবে সুখের দিকে ধাবিত হয়েছে তা আমাদের চেতনাকে তাড়িত করার পরিবর্তে এক ধরনের প্রশান্তি দেয়।
বিভূতিভূষণের গল্পের বিষয় প্রাত্যহিক ক্লান্তি অথবা গ্লানীবোধের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলেও শেষ পর্যন্ত আমরা এক ধরনের প্রশান্তির মুখোমুখি হই। এটা বিভূতি-র গল্পের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই সহজাত বৈশিষ্ট্য সত্য হয়ে ওঠে তখন, যখন আমরা দেখতে পাই, শহুরে শিক্ষা ও মানবিক চেতনা নির্দিষ্ট ভূগোল অথবা নির্দিষ্ট লোকসংস্কৃতি অতিক্রম করে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে; অথবা আমরা দেখতে পাই সুশীলার জীবন-অভিজ্ঞতার চিরায়ত বিশ্বাসসমূহ তার শহুরে সখিকেও আকৃষ্ট করেছে। পুঁথি পাঠ অথবা হাপু গান অবলম্বনে জীবন ধারণ, চিরন্তন অভাবের ভেতর দিয়ে কী এক অর্বাচীন সুখে বিমোহিত মানবজীবন, ‘প্রকাণ্ড বটগাছ, তাহার তলায় ভাঙা ইঁটের মন্দির। গাছতলা হইতে একটু দূরে এক বুড়ী নানা ঔষধ বিক্রয় করিতেছে।’ আমরা দেখতে পাই হাঁটের ভেতর অথবা লোক-মেলার লোকসমাগমের ভেতর বাঙালি জনজীবন মানব-জীবনের যাবতীয় সংকট সমাধানের দাওয়াই সাজিয়ে বসে আছে। সেই ঔষধের সাথে প্রাত্যহিক বিশ্বাস মিশে থাকলেও শ্বশুর-শাশুড়ী থেকে শুরু করে ‘সংসারের অলক্ষ্মীস্বরূপা আগের পক্ষের বউ-এর নাম সে সংসারে আর কোনদিন কেহ করে না।’
সুশীলার স্বামী কিশোরের আগের পক্ষ অর্থাৎ সুশীলার জীবনের দৈনিকতার নানা হিসেব সুশীলার জীবনে শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই থেকে যায়। এইভাবে অমীমাংসিত প্রাত্যহিকতা আমরা প্রতিনিয়ত মেনে নেই; এটাও জীবনের স্বাভাবিকতা। এই স্বাভাবিকতা সহনীয় হয়ে ওঠে লোকবিশ্বাস অথবা ধর্মীয় ভক্তিবাদ অথবা ভাববাদের হাত ধরে। ভাববাদের হাত ধরে আমরা বেঁচে থাকি অথচ সুশীলার চোখে তাঁর শহুরে সখীর জন্য জল; সুশীলার ওপর স্বামীর অত্যাচার অত্যন্ত স্বাভাবিক আচারের ভেতর দিয়েই নেমে আসে। স্বামী তার বিয়ে করা বউ-এর শরীরে হাত ওঠাবে এটাও আমাদের ধর্মীয় আচারের ও লোকবিশ্বাসের সাথে পালিত হয়ে আসছে সেই আবহমান সময় থেকে; যে আচারসমূহ শাস্ত্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে,
রমণীর উপনয়ন লাভ হয় বিবাহ যজ্ঞ দ্বারা
পতিসেবা কর্মে নিহিত থাকে পবিত্র বেদ অধ্যয়ন
আর পতিগৃহে বসবাস নিশ্চয় দেবগৃহে বসবাস।
এবং মহাভারত শাস্ত্রমতে,
নগরের দক্ষিণ প্রান্তে যমপুরী সন্নিকটে
হে নগরবাসী নির্মাণ করবে তোমরা গণিকালয়।
একইভাবে লোকাচার চিরায়ত বিশ্বাস দ্বারা শাস্ত্রমতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়,
লিখে রাখো বিধান
নিঃসন্তান বধূকে পরিত্যাগ সম্ভব
বিবাহের দশ বৎসর বাহিত হলে
অথবা শুধুমাত্র কন্যাসন্তানের জননীকে বার বৎসর এবং
মৃতবৎসাকে পনের আর শুনে রাখ অহঙ্কারী পুরুষ ওহে
কলহপ্রিয়া বধূ তৎক্ষণাৎ পরিত্যাজ্য।
বিভূতি-র গল্পের সুশীলা কলহপ্রিয়; তবে সেটা ছিল তার অধিকার। স্বামী-সংসার আর শ্বশুড়-শাশুড়ীর প্রতি এক অনিবার্য চিরায়
ত ভালোবাসা থেকেই সে কলহে লিপ্ত হতো। গল্পপাঠে আমরা এমনটিই দেখতে পাই। এই চিরায়ত নারী প্রাকৃতিক নিয়মে হয়ে ওঠে রজঃশীলা। অথচ উর্বরতার আধার রজঃশীলা রমণীকে অববিত্র ঘোষণা করেছে পবিত্র ধর্মপুস্তক কোরআন।
রজঃশীলা রমণীর জন্য নিষিদ্ধ
মাসিক চলাকালীন সময়ে উপাসনা উপবাস।
এ হেন চিরায়ত লোকাচারের প্রতি সুশীলার কোনো অভিযোগ নেই। সে জানে এটাই মানব-ধর্ম। লোকায়ত জীবনের মধ্যে বাস করে ধর্মের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন অবান্তর। লোকায়ত জীবনের ভেতর বেঁচে থেকে প্রশ্নমুখর চোখের জন্ম কোনো কালেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঘর-সংসার-স্বামীর ওপর অভিযোগের বিষয়টি লোকশিক্ষার অংশ নয়। নারীকে অভিযোগ করতে নেই এমন একটি পুরুষমুখি শিক্ষায় লোকবিশ্বাস বরাবরই নারীকে মরিচিকার ভেতর আটকে রেখেছে। নারী এই আটকে থাকার ভেতরই সুখবোধ করেছে। এমনটাই আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্পে এবং পাশাপাশি আমাদের বাঙালি লোকজীবনের ভেতর। সুতরাং সারারাত ঘরের বাইরে সুশীলাকে রাত কাটাতে হলেও তার কোনো অভিযোগ নেই; বরং সে স্বামীকে নিয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখে; একান্তই নিজেস্ব গৃহকোণ। এই হলো সুশীলার মতো চিরায়ত নারীসমাজের পৃথিবী; যদিও সেই পৃথিবীতে তার নেই কোনো একক সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার। সুশীলা স্বপ্ন দেখে, তার শহুরে সখী তার স্বামীর জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। আর এ রকম সরল বিশ্বাস আমাদেরকে সুশীলার প্রতি তার মনোচেতনার প্রতি আরও কিছুটা যত্নশীল করে তোলে। শহুরে সখীর কাছে তার আকুলতা, ‘এই আংটিটা আমার মায়ের দেওয়া, তোমায় দিলাম, তবু এটা দেখে তুমি গরীব মৌরীফুলকে ভুলে যাবে না।’
এ পর্যায়ে দরিদ্রতার বিষয়টি আর প্রাত্যহিক অভাব-অনটনের ভেতর আটকে থাকে না বরং তা মুহূর্তেই হয়ে ওঠে চিরায়ত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ; যে অনুষঙ্গ মানুষকে সুখের স্বপ্ন দেখায়, সুখী হতে শেখায়। এভাবে আমাদের চিরায়ত জীবন প্রাত্যহিক গ্লানী অথবা দুঃখ-কষ্টের সংজ্ঞা পালটে দিয়ে জীবনকে টেনে তোলে এক ধরনের অপার্থিব মহার্ঘতায়। এভাবেই বিভূতিভূষণের গল্পের মানুষগুলোর জীবন দৈনিকতার সুখে টইটম্বুর হয়ে ওঠে; এমনকি মৃত্যুও সেখানে স্বাভাবিকতা নিয়েই উপস্থিত হয়,
‘‘তাহার মৃত্যুতে গাঙ্গুলী-পাড়ার হাড় জুড়াইয়া গেল, পাড়ার কাক-চিলগুলাও একটু সুস্থির হইল। কিছুদিন পরেই কিশোরীর দ্বিতীয় পক্ষের বউ মেঘলতা ঘরে আসিল। দেখিলে চোখ জুড়ায় এমন সুন্দর মেয়ে, কর্মপটু, হুঁশিয়ার, গোছালো দ্বিতীয়বার বিবাহের অল্পদিন পরেই যখন কিশোর পালেদের স্টেটে ভাল চাকরিটা পাইল, তখন নূতন বউ-এর লক্ষ্মীভাগ্য দেখিয়া সকলেই খুব খুশি হইল।’’
মৃত্যুর আগে জ্বরের বিকারে সুশীলা স্বপ্ন দেখে, ‘জানালার বাহিরে জ্যোৎস্নায় ও-গুলো কি ভাসিতেছে? সেই যে তাহার স্বামী গল্প করিত জ্যোৎস্না-রাত্রে পরীরা সব খেলা করিয়া বেড়ায়, তাহারা নয় তো?’ এই হলো বিভূতিভূষণের গল্পের লোকজ-অনুষঙ্গ, যে অনুষঙ্গসমূহ জড়িয়ে লেপটে রয়েছে চিরায়ত বাঙালি জনজীবনের চিরায়ত বিশ্বাস আর দৈনিকতার আধারে। লক্ষ্মী পয়মন্ত গৃহবধূ অথবা অলক্ষ্মী গৃহবধূ কীভাবে গোটা অঞ্চলের ওপর অশুভ ছায়ায় সকলের হাড়-মাংস একাকার করে দেয় অথবা আকাশে নৃত্যরত পরীর দল কীভাবে মানবজীবনকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়, এই সব কিছু নিয়ে বিভূতি-র মানবজীবন সাবলীল এবং সংকটবিহীন। দৈনিকতার কুসংস্কারে আচ্ছাদিত অথবা দরিদ্রতার আক্রমণে আক্রান্ত প্রাত্যহিক সংকট আর সংকট হিসেবে আমাদেরকে আক্রান্ত করে না; বরং আমরা এক ধরনের প্রশান্তিতে ডুব দেই; এই তো জীবন, আমরা সবাই মিলে ভালো আছি। বিভূতিভূষণের এই ভালো থাকা আর না থাকার বিষয়টি এই সময়ের পাঠককে নতুন করে ভাবতে শেখায়। প্রশ্ন জাগে পক্ষান্তরে এভাবে আমরা কি সামাজিক শোষণ আর কুসংস্কারের আক্রমণে ডুবে থেকে শেষাবধি শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে আরও খানিকটা উস্কে দিচ্ছি?
বিভূতিভূষণ ‘জলছত্র’ গল্পে ‘কচু-চুষির মাঠে’র গল্প বলেছেন। তারাচাঁদের ছোটবোন জলপিপাসায় কচু চুষতে চুষতে মাঠের এক প্রান্তে নির্জন বটতলায় মারা যায়। লেখক লোকশ্রুতি থেকে পাওয়া লোককথার আলোকে গল্পনির্মাণ করতে গিয়ে পক্ষান্তরে লোকসংস্কৃতিকে আশ্রয় করে একদিকে যেমন লোকবিশ্বাসের প্রতি আস্থা রেখেছেন অপরদিকে তিনি সামাজিক কুসংস্কারকে অতিক্রম করে ধর্মীয় প্রথার ঊর্ধ্বে মানুষের যে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা সেই প্রচেষ্টাকে প্রধান বিবেচনার বিষয় করে তুলেছেন এই গল্পে। তারাচাঁদ এক সময় সম্পদের মালিক হলে তার সেই মরে যাওয়া বোন তাকে স্বপ্ন দেখায়, ‘দাদা, ঐ মাঠের মধ্যে সকলের জন্য তুই একটা জলছত্র করে দে।’ তারাচাঁদ বিশ্বেস জলসূত্র নির্মাণ করে; এবং সেখানে জলখাবারের ব্যবস্থাও রাখে। পিপাসার্ত পথিক মাঠ পাড়ি দেবার সময় বটতলায় জলছত্রের নিচে এসে শরীর জুড়িয়ে নেয়। পিপাসা পায়, যে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের। একদিকে মুসলমানের অপরদিকে হিন্দু-প্রথার ভেতর ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য অথবা শূদ্রের সকলেরই পিপাসা পায়। একদিন এক ব্রাহ্মণের পিপাসা পেলে তিনি জলছত্রের ব্যবস্থা দেখে বিতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন, ‘সর্বনাশ! নতুন মাটির জালা ভর্তি জল ও কচি ডাবের রাশি দেখে পিপাসার্ত শিরোমণি-মশায় যে আনন্দ অনুভব করেছিলেন, তা তাঁর এক মুহূর্তে কর্পূরের মত উবে গেল। কলুর দেওয়া জলসত্রে তিনি কি করে জল খাবেন? তিনি নিজে এবং তাঁর বংশ চিরদিন অশুদ্রে প্রতিগ্রাহী; আজ কি তিনি --- ওঃ!’
ধর্মহীনতার ভয়ে শিরোমণি-মশায় চুপসে যেতে থাকলে দেখতে পান, ‘একজন চাষা পাশের মাঠ থেকে লাঙ্গল ছেড়ে বটতলায় উঠলো। ঘেমে সে নেয়ে উঠেছে। একটু বিশ্রাম করে সে তৃপ্তির সঙ্গে ছোলা, গুড় আর জল খেয়ে বসে গল্প করতে লাগলো। এক বুড়ী অন্য এক গ্রাম থেকে ভিক্ষা করে ফিরছিল। গাছতলায় এসে সে ঝুলি নামিয়ে একটু জল চেয়ে নিয়ে হাত-পা ধুলে। একজন বললে --- আবদুলের মা, একটা ডাব খাবা?’
বর্ণপ্রথাকে অতিক্রম করে এই সর্বজনীন ব্যবস্থা কি শেষ পর্যন্ত শিরোমণি-মশায়ের ভেতর সংক্রমিত হয়? এইভাবে সংক্রমণ-কৌশল নির্মাণের ভেতর দিয়ে বিভূতিভূষণ কি অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠলেন? আমরা গল্পের এই পর্যায়ে দেখতে পাই, যে লোকটি জল দিচ্ছিল সেই সদগোপ জাতের চিনিবাসকে শিরোমণি-মশায় বলছেন, ‘ওহে বাপু, তোমার ঐ বড় ঘটিটা বেশ করে মেজে এক ঘটি জল আমায় দাও, আর ইয়ে--- ব্রাহ্মণের জন্য আনা সন্দেশ আছে বললে না?’
শিরোমণি মশায়ের এই উক্তির মধ্য দিয়ে গল্প শেষ হয়; আর সেইসাথে পাঠকের মধ্যে জেন্ম নেয় এক ধরনের উদাস করা মানবিকতা। পাঠক সহসা আবিষ্কার করে, তাই তো জীবন আগে, জাতবিচার পরে। লোকায়ত চেতনার এই যে বিবর্তন, সেই সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে বলা চলে, এক ধরনের বিপ্লব। বিপ্লবই বলা সম্ভব; কেননা বিভূতি-র সময়ের প্রেক্ষাপটে জাত খোয়ানোর এহেন কাজ যে তিনি করতে পেরেছিলেন, তা কিন্তু লেখকের লোকজীবন চেতনার কারণেই সম্ভব হয়ে উঠেছিল। লোকসংস্কৃতি বিভূতিকে কুসংস্কারের ভেতরে আটকে না রেখে অথবা বলা সম্ভব পিছন দিকে টেনে না ধরে বরং তাকে সেই অন্ধকারে টইটম্বুর জীবনাচার থেকে উদ্ধারের পথ দেখিয়ে দিয়েছে; এবং অবশ্যই এই দেখিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে চিরায়ত বাঙালি মানস। এ অবস্থায় আমাদেরকে লোকসংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হলে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পপাঠের পর নতুন করে চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সেই ভাবনাটা হতে পারে, বাঙালি লোকসংস্কৃতি শুধুমাত্র সনাতন প্রথার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং পাশাপাশি পরিবর্তনের পথও সেই সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। এ অর্থে আমরা যারা চিরায়ত লোকাচার অথবা লোক-ঐহিত্য নিয়ে ভাবছি তাদেরকে লোকজীবনের এপিঠ-ওপিঠ দুটোই দেখার আহ্বান জানায় বিভূতি-র ছোটগল্পসমূহ।
বিভূতিভূষণ অপার্থিব চরিত্র সৃজনের মধ্য দিয়ে চিরায়ত জীবনের মানবিক চেতনার পরিবেশ নির্মাণ করেছেন ‘জলছত্র’ গল্পে। যেখানে বলা হচ্ছে, ‘চারি ধারে যখন সন্ধ্যা নামে... তপ্ত মাঠ যখন ছায়া-শীতল হয়ে আসে... তখনই কেবল সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সে মেয়েটি অস্ফুট জ্যোৎস্নায় শুভ্র-আঁচল উড়িয়ে কোন অজ্ঞাত ঊর্ধ্বলোকে তার নিজের স্থানটিতে ফিরে চলে যায়। ... তার পৃথিবীর বালিকা-জীবনের ইতিহাস সে ভোলে নি।’
এই না ভোলা ইতিহাসই পক্ষান্তরে চিরায়তের ভেতর লুকিয়ে থাকা মানবিক চেতনার ইতিহাস; অসাম্প্রদায়িক চেতনার ইতিহাস। তারপরও কথা থেকে যায়, এই না বলা ইতিহাসের ইশারায় লেখক হয়তো বা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, যেন বা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন; হয়তো বা মানব পরিবারের বর্ণপ্রথা তিনি ভেঙে ফেললেন; আমরাও পরিতৃপ্তবোধ করি। অথচ আমরা লেখকের গল্পপাঠে দেখতে পাই বিভূতিভূষণ শেষাবধি লোকবিশ্বাস অথবা কুসংস্কারের কাছেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য বাধ্য হওয়ার কারণও আছে; বাধ্য হওয়ার কারণ বোধ হয় গল্প লেখার কাঁচামশলা হিসেবে চিরায়ত লোকসংস্কৃতি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। শিল্প নির্মাণের সেই তাৎপর্যবহ শক্তির খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন লোকজ অনুষঙ্গের নানাবিধ অনিবার্য রূপকের ভেতর। ফলে সঙ্গত কারণেই লেখক লোকজ অনুষঙ্গকে অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি সহজাত কারণেই কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি অথবা লোকজীবনবোধকে আশ্রয় করে গল্প রচনায় সফলতা অর্জন করেছেন।
এক্ষেত্রেও আমাদের প্রশ্ন জাগে, লেখকের কাছে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ? ধর্ম, নাকি জীবন? নাকি বেঁচে থাকার জন্য বাঙালি মানব পরিবারের চিরায়ত অভ্যস্থতা? আমরা গল্পপাঠে বুঝতে পারি, লেখক এক্ষেত্রে আপোষ করেন অভ্যস্থতার সাথে। যেমন ‘রাক্ষস-গণ’ গল্পে দেখতে পাই, প্রেম অথবা মানবিক চেতনা অপেক্ষা মূখ্য হয়ে উঠেছে ‘ঠিকুজী কোষ্ঠী’; অর্থাৎ সুরেশ আর রেণুর বিয়ে সম্ভব নয়; কারণ, ‘উভয়ের ঠিকুজী কোষ্ঠী মেলাতে গিয়ে দেখা গেল মেয়ের রাক্ষস-গণ! মিলনের বহু বাধা, নক্ষত্রেরা সব তির্যক-গতিতে অবস্থান করছেন--- বিবাহ অসম্ভব।’
অথচ সবাই রেণুকে পছন্দ করেছে। সকলের ভেতর রেণুর প্রতি মমত্ব জেগে উঠেছে। সুরেশের ভেতর রেণুর অনুপস্থিতি এক ধরনের অভাব অথবা বলা চলে শূন্যতা তৈরি করে যা অনুরাগের নামান্তর। অথচ সবকিছু সহসা মিথ্যে হয়ে ওঠে একমাত্র ‘ঠিকুজী কোষ্ঠী’ বিশ্বাসের কাছে। সুরেশের বিভাবতি নামের অন্য এক সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো; আর এদিকে রেণুরও আরেক জায়গায় বিয়ে হবার পর শোনা গেলো বিয়ের পর রেণুর মা কলেরায় মারা গিয়েছে; অর্থাৎ রাক্ষস-গণ-এর মেয়ে রেণুর দোষ; তার দোষেই এ অনিষ্ট। ‘শেষ পর্যন্ত সুরেশের মনে হোল--- ভালই হয়েছে বিয়েটা না হয়ে, গণকের কথা একেবারে উড়িয়ে দেবার জিনিস তো আর নয়? ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।’
আমরা এভাবেই দেখতে পাই, লোকবিশ্বাসের কাছে প্রেম অথবা মানবিক চেতনা পরাজিত হতে থাকে। এমনকি গল্পের শেষে গিয়ে দেখি, চাকুরিতে উন্নতি হবার পর সুরেশ রসুলপুর বদলি হয়। তাদের বিশ্বাস দ্রুত ব্যবসায় টাকা আসতে থাকা আর চাকরিতে উন্নতি সবই তার বৌয়ের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। লোকবিশ্বাসে আক্রান্ত সুরেশ তার ভাগ্যবতী পয়মন্ত বৌকে নিয়ে রসুলপুর গমনের উদ্দেশ্যে ট্রেনে ওঠে। এ অবস্থায় সুরেশ দেখতে পায় ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে একজন বিধবা। সেই বিধবা আর কেউ নয়, রেণু। এই সেই রেণু, যে রেণুর অনুপস্থিতিতে এক সময় সুরেশের জীবন অর্থহীন হয়ে উঠেছিল। এই সেই রেণু, যে রেণুর সেবা এক সময় সুরেশ গ্রহণ করেছে। অথচ লেখক আমাদেরকে আজ সুরেশের ভেতরের সহজ বিশ্বাসের কথা শুনিয়ে দিলেন; যা ছিল মানবীয় চেতনার বিপরীত। চূড়ান্ত অর্থে লোকাচারের কাছে এখানে মানবতা পরাজিত হয়েছে। লেখকের বর্ণনায়,
‘‘সরুপাড় ধূতি পরা, হাত খালি, মাথায় আধরুক্ষ চুল, বিধবা বেশে রেণু। সুরেশ সেখানে আর দাঁড়াতে পারলো না, দিশাহারা ভাবে এসে নিজের গাড়িতে উঠলো। রেণু সম্ভবতঃ তাকে দেখেনি, তার চোখ অন্যদিকে ফেরানো ছিল। ... সুরেশের সারা শরীর দিয়ে কি যেন একটা ঝাঁজ বেরুচ্ছিল। নিজের কতকটা অজ্ঞাতসারে তার মনে হোল--- উঃ, কি বেঁচেই গিয়েছি! মার কথা যদি তখন না শুনতাম? রাক্ষুসীর ফাঁদই তো বটে!’’
এরপর গল্পের পরিণতিতে এসে লেখকের বিবেকবোধ লেখককে গল্পের শিল্পকৌশলের স্বার্থেই তাড়িত করে। ফলে লেখক সুরেশের মনোজগতে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপরতার পাশাপাশি রেণুর জন্য জাগিয়ে তুলেছেন সহমর্মিতাবোধ; যে বোধের কারণে সহসা আমাদের কাছে বিভূতিভূষণের গল্প হয়ে ওঠে বিষণ্নতার আধারে এক ধরনের প্রশান্তি প্রদায়ক অনুঘটক। প্রশান্তি প্রদায়ক এ কারণে যে, লেখক সুরেশের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে রেণুর জন্য সহানুভূতি প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে আমরা প্রশান্তি লাভের সুযোগ পেয়ে যাই। আমরা সহসা মানবিক হয়ে ওঠার সুযোগ লাভ করি। গল্প হয়ে ওঠে প্রশান্তি প্রদায়ক। অথচ হাস্যকর হলেও সত্য আমরা কখনোই কেউ রেণুর কোনো দায়িত্ব নেই না এবং অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের অথবা সুরেশের এই বিষণ্নতা অথবা সহমর্মিতাবোধ রেণুর জন্য কোনোই ফল বয়ে আনে না। এও মানব মনের এক ধরনের উপর-চালাকি এবং পলায়নবাদি চেতনা; যে চেতনার প্রকাশ ঘটে ‘আহা উহু’ ধ্বনি প্রকাশের মধ্য দিয়ে; আর এই হা-হুতাশও পক্ষান্তরে লোকাচারেরই অংশ। এই লোকাচার গোষ্ঠীগত অর্থে মনোসামাজিক লোকাচার। আর সুরেশের লোকাচার মূলত মনোদৈহিক লোকাচার। মনোদৈহিক লোকাচারের উদাহরণ পাওয়া যায় সুরেশের মানসকথনের ভেতর, ‘হঠাৎ সুরেশের মনে দূর-সম্পর্কিত সহানুভূতিশূন্য এক আত্মীয়ের দ্বারস্থ এই পিতৃমাতৃহীনা নিরপরাধা অভাগিনী বালিকার ছবিটি সম্পূর্ণ অন্যভাবে ফিরে এল। কার অপরাধে এই প্রস্ফুট-মুকুল-প্রথম-বসন্তের দিনে তার জীবনের আনন্দ-দীপটি নির্বাপিত হয়ে গেল চিরদিনের মত?’
অপঘাতে মৃত্যু, হত্যা, আত্মহত্যা বিবিধ বিষয় নিয়ে প্রত্যন্ত পাড়াগাঁ থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্টেশন, পুরোনো বাড়ি, রাজবাড়ি অথবা জমিদার বাড়িকে আশ্রয় করে লোকসমাজে আধিভৌতিক গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিভূতিভূষণ এই জাতীয় বিষয়াদি তাঁর ‘হাসি’ গল্পের ভেতর সংযুক্ত করেছেন। আমরা আধুনিক শিক্ষার আলোকে এ ধরনের বিষয়াদির যৌক্তিকতা অস্বীকার করলেও আমাদের মানসজগতে ভৌতিক বিষয়াদিকে কেন্দ্র করে যে ফ্যান্টাসি ও শিহরণের সৃষ্টি হয় তাকেই লেখক গল্পের জাদুশক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃত বাস্তবতায় এ জাতীয় লোকজ-অনুষঙ্গ সমাজ-মনস্তত্ত্ব উপস্থাপনের সহায়ক। বিভূতিভূষণ জেনে শুনেই লোকসমাজের প্রবাহমান বাস্তবতাকে উপস্থাপনের স্বার্থে বিষয়গুলো তাঁর গল্পে কাজে লাগিয়েছেন। এই একই গল্পে হারিয়ে যাওয়া মানব পরিবারের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় অতিপ্রাকৃত ঘটনা সংস্থাপনের মধ্য দিয়ে। যেমন, ‘বনভূমি তখন নিস্তব্ধ--- চাঁদ ডুবে গিয়ে নদী আকাশ বন সব অন্ধকারে একাকার! আমার চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছে, এমন সময় অন্ধকারভরা গভীর বনভূমির দিক থেকে আর একবার সেই বিকট হাসির রোল উঠলো। শেষরাত্রের চাঁদ-ডোবা অন্ধকারে সেটা এত অমানুষিক, এত পৈশাচিক ঠেকলো যে তখন আমার বালক-বয়স হলেও হাসিটার প্রকৃত রূপ বুঝে বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল।’
লেখকের গল্প অনুসারে লোকশ্রুতিতে পাওয়া যায়, সুন্দরবনের যে গভীর বনাঞ্চল থেকে অভিশপ্ত অশরীরী আত্মার এই পৈশাচিক উল্লাস-ভরা অট্টহাসি ভেসে আসে সেখানে কখনো বা কোনো জনপদ ছিল। আজ ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মৃতনগরীর অতৃপ্ত মানব আত্মারা প্রতি রাতে চিৎকার অথবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। একই পরিবেশ লেখক তৈরি করেছেন ‘প্রত্নতত্ত্ব’ গল্পে। হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতা জীবন্ত হয়ে উঠেছে গল্পের ভেতর। লেখকের কৌতূহল শুধু বর্তমান নিয়ে নয় অথবা শুধু ইতিহাস নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন; তিনি ইতিহাসের পথ ধরে সরাসরি পৌঁছে যেতে চান অতীত সভ্যতা অতীত চরিত্র অতীত পরিবেশ ও প্রতিবেশে। ফলে লেখককে লোকজ বিশ্বাসের আশ্রয়ে লোকশ্রুতির আশ্রয়ে আধিভৌতিক পরিবেশ নির্মাণের মাধ্যমে গল্পের আঙ্গিক নির্মাণ করতে হয়েছে। এই আঙ্গিককৌশলে বিভূতিভূষণ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো অতীত চরিত্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। আমরা দ্বিধান্বিত হই; শিহরিত হই অথবা সহসা সময়ের সমস্ত যৌক্তিকতা অতিক্রম করে অতীতচারী হয়ে উঠি। আমাদেরকে এ পর্যায়ে এসে বুঝতে হবে লোকবিশ্বাসের আশ্রয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে বিভূতিভূষণ তাঁর গল্পে সময়ের সীমানাকে ভেঙেছেন অথবা অস্বীকার করেছেন। লেখকের দৃষ্টিতে অতীত কখনো বিলুপ্ত হয় না; কেননা অতীতের ওপর দাঁড়িয়েই বর্তমান মূর্ত হয়ে ওঠে। সুতরাং অতীত অভিজ্ঞতা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় লেখকের কাছে এবং লেখক তাড়না বোধ করেন মানব প্রজাতির যাবতীয় জ্ঞানকে যাবতীয় অর্জনকে যাঁচাই করে দেখতে। লেখক লোকবিশ্বাসের হাত ধরে স্বপ্ন-বাস্তবতার কৌশলে কখনো বা জাদুবাস্তবতার টেকনিকে আমাদেরকে পৌঁছে দেন মানব পরিবারের লব্ধ অভিজ্ঞতার নিকট। আমরা গল্পের ভেতর দেখি বৌদ্ধ-ভিক্ষু বলছেন,
‘‘তুমি যে মূর্তিটি মাটি খুঁড়ে বার করেছ, তারই টানে অনেক দিন পরে আজ আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। নয় শ’ বৎসর আগে আমি তোমার মতই পৃথিবীর মানুষ ছিলাম। যে স্থান তোমরা খুঁড়েছ, ওই আমার বাস্তুভিটা ছিল। তুমি জ্ঞানচর্চায় সমস্ত জীবন যাপন করেছ, এই জন্যেই তোমার কাছে আসা আমার সম্ভব হয়েছে; এবং এই জন্যেই আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমার জীবনের কতকগুলি প্রধান প্রধান ঘটনা তোমাকে দেখালাম। আমি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান,--- নরপালদেবের সময়ে আমি নালন্দা মহাবিহারের সঙ্ঘস্থবির ছিলাম। ভগবান তথাগতের অমৃতময়ী বাণীতে আমার মন মুগ্ধ হয়েছিল; সে জন্য দেশের হিন্দু-সমাজে আমার জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়।...
অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযান জয়যুক্ত হোক।’’
লোকাচারকে আশ্রয় করে বিভূতি-র ছোটগল্প নান্দনিকতা লাভ করলেও প্রশ্ন ওঠা প্রাসঙ্গিক, বিভূতিভূষণের প্রতিপালিত ধর্ম কোনটি অথবা সেই ধর্মের বৈশিষ্ট্য কেমন? তিনি বাঙালি সমাজের সনাতন ধর্মে জন্ম নিয়েছিলেন সন্দেহ নেই; কিন্ত সন্দেহ আছে সেই ধর্মের কতটুকু তিনি কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর ছোটগল্পে লোকসংস্কৃতির ব্যবহার, তাৎপর্য ও পাঠ-গ্রহণ বিষয়ে সতর্ক হলে আমাদেরকে একটি বিষয়ে একমত হতে হবে তা হলো, নিঃসন্দেহে ‘জ্ঞান’ই চূড়ান্ত অর্থে বিভূতিভূষণের ধর্ম; অজ্ঞানতা তাঁর কাছে ধর্মহীনতার নামান্তর। ফলে তিনি প্রথাগত ধর্মের ভেতর বাস করেও সংশয়বাদী। পক্ষান্তরে প্রতিনিয়ত জ্ঞান অনুসন্ধানের পথ ধরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতিবাদি। প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মানবতাবাদই চূড়ান্ত অর্থে মানবজীবনের মুক্তির পথ। ফলে তিনি প্রথাগত ধর্মের ভেতর বাস করেও প্রথাগত ধর্মের শেকড় ধরে টান দিয়েছেন। চিরায়ত লোকবিশ্বাসের ভেতর বাস করেও লোকসংস্কৃতিকে তিনি যাঁচাই করে নিয়েছেন মানবতাবাদের আলোকে। আচারমুখর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম শেষ পর্যন্ত লোকসংস্কৃতির কাছে নিস্তেজ হয়ে উঠেছে। তাঁর গল্পে আচারবাদিদের জায়গা দখলে নিয়েছে সাধারণ মানুষ এবং চূড়ান্ত ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ।
ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে ম্যাজিক-রিয়ালিজমের কথা বলা হলেও আমাদের বাঙালি মানস ও লোকাচারের ভেতর সহজাতভাবে মিশে আছে ম্যাজিক-রিয়ালিজমের জাদুশক্তি; যা বিভূতি-র লেখার আঙ্গিক বিশ্লেষণ শুধু নয় বিশেষ করে লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লোকজীবন নিয়ে আলোচনা করতে হলে অনিবার্যভাবে চলে আসবে। যদিও তিনি ম্যাজিক-রিয়ালিজম বিষয়ে কিছুই জানতেন না; কেননা তখনও তাত্ত্বিকগণ এ বিষয়ে তেমন একটা মুখ খোলেননি। যাই হোক আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্পের পরিবেশ আর সেই পরিবেশে জড়িয়ে থাকা মানুষেরা প্রকৃতির অংশ হিসেবে চিরকালের চিরায়ত মিথে রূপান্তরিত হয়ে মিথের ভেতরই বেঁচে থাকে; চিরায়ত মিথের ভেতর জীবন যাপন করে; লোকবিশ্বাসের ওপর আস্থা রেখে লোকাচারকে জীবন যাপনের ধর্ম হিসেবে দৈনিকতার সাথে মিলিয়ে নিয়ে টিকে থাকে প্রকৃতিলালিত বাস্তবতার আধারে। এই প্রকৃতিলালিত বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ‘দাতার স্বর্গ’ গল্পে পাই,
ক. স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা নেমে এসেছেন নবরূপ ধরে প্রজার দুঃখ দূর করতে।
খ. ভগবান শুধু আমার মধ্যে দিয়েই তাঁরই ধন তাঁর জীবদের দিচ্ছেন বই তো নয়।
গ. দূর আকাশের নীল-সাগরের পারে একটি নক্ষত্র যেন তাঁর দিকেই চেয়ে জ্বলছে, প্রলয়কালের বিশ্বের
অনন্ত-জলময়ী প্রসারতার মাঝখানে অনাদিকারণ প্রজাপতির চিরজাগ্রত নেত্র-জ্যোতির মত!
ঘ. তিনি তাঁর কৃতকার্যের ফলাফল শুনতে যমরাজের খাস-দরবারে নীত হলেন। সামনে প্রকাণ্ড খাতা
খুলে বসে চিত্রগুপ্ত।
আমরা এই গল্পে দেখতে পাই, দাতা কর্ণসেনের আভিজাত্যের অহঙ্কার মিথ্যে হয়ে যায়। শেষাবধি তিনি দেখেন চিত্রগুপ্তের দরবারে চূড়ান্ত বিচারের খাতায় তার জন্য কোনো পুরস্কার লেখা নেই; নেই কোনো পূণ্য; বরং দেশে প্রচণ্ড মহামারির সময় কর্ণসেন প্রজাদের জন্য নিজের বাড়ির মায়া ত্যাগ না করায় তাকে নিয়ে সারা রাজ্যে ধিক্কার উচ্চারিত হয়; সেই ধিক্কারের ভেতর যখন কর্ণসেন খ্যাতি অর্জনের লোভ পরিত্যাগ করে প্রজাদের আশ্রয়ের জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে দিলেন তখন তার জন্য চিত্রগুপ্তের খাতায় পুণ্য লেখা হলো। অর্থাৎ আচারনির্ভর ধর্মীয় রীতিকে লেখক এই গল্পে আক্রমণ করেছেন; সেইসাথে আক্রমণ করেছেন মানবজীবনের প্রদর্শনযোগ্য আভিজাত্যের মোহকে। এই গল্পে চূড়ান্ত অর্থে মানবিক মূল্যবোধের বিষয়টি লোকাচারের আলোকে তথা ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে মূখ্য হয়ে উঠেছে।
‘খুঁটি-দেবতা’ গল্পে ঘরের একটি সাধারণ বাঁশের খুঁটি কীভাবে ব্যক্তিমানসের কাছে নালিশ জানানোর অবলম্বন হয়ে ওঠে; আর সেই খুঁটি কীভাবে শেষ পর্যন্ত দেবতার চরিত্র লাভ করে তারই খুটিনাটি বর্ণনা, চরিত্রের বিকাশ, চরিত্রসমূহের মনোলোক উন্মোচন এবং পারিপার্শ্বিকতাকে গল্পে জীবন্ত করে তুলবার জন্য যে ভাষারীতি, --- এই সার্বিক বিষয়াদি যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমাদেরকে বিভূতিভূষণের গল্প নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একই অর্থে ‘গ্রহের ফের’ এবং ‘মরীচিকা’ গল্প দুটোও লোকজীবন অর্থাৎ লোকসংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে রচিত চিরায়ত দীর্ঘশ্বাসের গল্প। একই অর্থে বলা সম্ভব আলোচ্য গল্পগ্রন্থের দশটি গল্পই চূড়ান্ত বিচারে বিভূতিভূষণের চিরায়ত-লোকমানস প্রকাশজ্ঞাপক গল্প। ‘মৌরীফুল’ তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। এই গ্রন্থের সবগুলো গল্প লৌকিক-বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও প্রতিটি গল্পের গভীরে এবং অর্থবিস্তারে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক চেতনাজাত আবহ। ফলে প্রতিটি গল্প সহজেই চিরায়ত জীবনস্রোতের সাথে একাত্ম হয়ে ওঠে।
আমাদেরকে আজ স্বীকার করতেই হবে, বিভূতিভূষণ শুরু করেছিলেন শুরু থেকে। শুরুর পটভূমি, লোকজীবন। প্রকৃত প্রস্তাবে লোকজীবনের হাত ধরেই মানব-পরিবার এতদূর হাটতে শিখেছে। হাটতে গিয়ে মানুষের পা কতটুকু স্বনির্ভর হয়ে উঠলো আর কতটুকুই বা দুর্বল থেকে গেলো, এ বিষয়টিও খুঁজে বের করা সম্ভব লোকজীবন অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। বিভূতিভূষণের ‘অনুসন্ধানকৌশলী-চোখ’ সমকাল অপেক্ষা প্রখর; বলা সম্ভব তাঁর চোখ ইতিহাস অপেক্ষাও কিছুটা এগিয়ে ছিল।
বিভূতিভূষণের ভেতর ব্যক্তিমানুষকে দেখার যে বৈশিষ্ট্য ছিল, সে বৈশিষ্ট্য শেষাবধি শুধুমাত্র ব্যক্তিকে উপস্থাপন করে না; বরং এই একক ব্যক্তি হয়ে ওঠে গোষ্ঠীমানব। এবং এই গোষ্ঠীমানব শেষাবধি হয়ে ওঠে চিরায়ত সত্যভাষণ। সেই চিরায়ত সত্যভাষণের গভীর থেকে প্রকাশ পেয়েছে এক ধরনের প্রাচীন দীর্ঘশ্বাস; আর সেই প্রাচীন দীর্ঘশ্বাসের ভেতর থেকে ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে চিরায়ত ও চিরকালীন বাঙালি জীবন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গল্প পরিচিত পথে সাবলীল এগিয়ে গিয়েছে; এই এগিয়ে চলার ভেতর তিনি নিজেও উপস্থিত থেকেছেন। নিজের উপস্থিতির সাথে যখন তিনি তাঁর পারিপার্শিকতাকে মিলিয়ে নিয়েছেন তখন তাঁর গল্প আর নিছক গল্পের ভেতর আটকে না থেকে হয়ে ওঠে বিস্তর জীবনের পটভূমি।
বিভূতিভূষণের গল্প শেষ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর আটকে থাকে না। তাঁর গল্প নির্দিষ্ট প্লটের ভেতর আটকে থেকে দম বদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় না; বরং বিভূতিভূষণের গল্প মানব-জীবনকে ছড়িয়ে দিয়েছে এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষের সীমানায়। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্প একটি একক ঘটনার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি হয়তো রবীন্দ্রনাথের গল্পের মতো একক চরিত্র অথবা একক ঘটনার চূড়ান্ত মুহূর্ত নির্মাণে অতটা বিশ্বাসী ছিলেন না; ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গল্পপাঠে আমরা পেয়ে যাই বহুর মিশ্রণ, বহু স্তরের মিশ্রণ, সামাজ বিকাশের নানা অনুষঙ্গ। এ সব কিছুই সম্ভব হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ কারণে, তা হলো তিনি তাঁর গল্পের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কখনো বা পরোক্ষভাবে কখনো বা প্রত্যক্ষভাবে রেখেছেন বাঙালি চিরায়ত লোকজীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গসমূহ। ফলে তাঁর গল্প মানবজীবনের শেকড় থেকে যাত্রা শুরু করে ক্রমশ অগ্রসর হয় কাণ্ডে, অতঃপর সবুজ শাখা ও উপশাখায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকতে তাঁর ষোলটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পায়, মেঘমল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৭), কিন্নর দল (১৯৩৮), বেনীগীর ফুলবাড়ী (১৯৪১), নবাগত (১৯৪৪), তালনবমী (১৯৪৪), উপলখ- (১৯৪৫), বিধু মাস্টার (১৯৪৫), ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫), অসাধারণ (১৯৪৬), মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭), আচার্য্য কৃপালনী কলোনী (১৯৪৮), জ্যোতিরিঙ্গণ (১৯৪৯), কুশল পাহাড়ী (১৯৫০)--- এই ষোলটি গল্পগ্রন্থ অনুসন্ধানে আমরা প্রায় ক্ষেত্রেই লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির গন্ধ খুঁজে পাই। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত রূপহলুদ (১৯৫৭), অনুসন্ধান (১৯৬০), ছায়াছবি (১৯৬০)--- এই তিনটি গল্পগ্রন্থ বিষয়েও একই মন্তব্য করা সম্ভব। প্রশ্ন উঠতে পারে এর কারণ কী?
ভারতের বাঙালি গ্রামীণ সমাজের সামন্ততান্ত্রিক জীবনভিত্তিক বিশ্বাস, যে বিশ্বাস লোকসংস্কৃতির ভূমিতে লালিত হলেও পক্ষান্তরে তা শোষণের ভূমিকায় কার্যকর। এ বিষয়েও লেখকের চেতনা বোধকরি চলমান ছিল, অন্তত তাঁর গল্পপাঠে তেমন ইশারাই পাওয়া সম্ভব। এই চিরায়ত চেতনার হাত ধরেই তাঁর গল্পে অবলীলায় স্থান পেয়েছে কৃষিপ্রধান জীবন, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ভূমিব্যবস্থা, ফসল, ভোগপিপাসা ও ব্যক্তি-আকাক্সক্ষা। বিভূতি-র কাছে বাঙালিজীবন, বাঙালিসংস্কৃতি আর বাঙালি-গ্রাম ছিল আত্মীয়তুল্য; এই আত্মীয়তার সূত্র ধরে তিনি লোকায়ত সংস্কৃতির বিশাল ক্যানভাসের শরীরে গল্প অঙ্কনের স্বার্থে বিবিধ রঙের ব্যবহার করেছেন। এই বিবিধ রঙ একান্তই ভারতবর্ষীয়; ইউরোপ থেকে ধার করা নয়। বলা সম্ভব সে সময়ে বিভূতিভূষণই একমাত্র লেখক যিনি ইউরোপীয় ধারা থেকে নিজেকে সচেতনভাবে সরিয়ে রাখতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সত্যিকারের লোকায়ত জীবনের নানা উপাচার ও অনুষঙ্গের। অবশ্য তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলী বাকের উপকথা’সহ বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাসে লোকায়ত জীবনের চিরায়ত সত্য মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে; তা সত্ত্বেও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে তারাশঙ্কর উপন্যাস অথবা ছোটগল্পের আখ্যান নির্মাণের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় রীতিকে অস্বীকার করতে পারেননি। যাই হোক, সঙ্গত কারণেই ভারতীয় দর্শনের আলোকে বাংলা কথাসাহিত্য হয়ে উঠতে পারতো বিভূতিভূষণের ধারাবাহিকতায় একান্তই ভারতীয়। অথচ আমরা দেখেছি ইউরোপ থেকে আমদানি করা কৃৎকৌশল ও দর্শনের এক পতনমুখর ধারাক্রম। অনেক পরে দেবেশ রায় যে বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদেরকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন। তিনি ভগীরথ মিশ্র সৈয়দ মুস্তফা সিরাজকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইউরোপ ও ভারতের পার্থক্য বোঝাতে বলেছিলেন, ‘ফারাক দুটি ভূখণ্ডের মাটিতে, আবহাওয়ায়, জলবায়ুতে, খাদ্যে, পোশাকে, রীতিনীতিতে, শিক্ষাদীক্ষায়, যাপনে, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে, মননে, দর্শনে, সংস্কারে, বিশ্বাসে সব কিছুতেই। ফলে, এই দুটি ভূখণ্ডের সাহিত্যেও ফারাকগুলো খুবই প্রত্যাশিত ছিল। এই যে সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ, তার হাজার-হাজার বছরের ইতিহাস, তার মন্দির-মসজিদ-দেউল, লোকায়ত ঐতিহ্য, সর্বোপরি তার নিজস্ব মানসপট, জীবনদর্শন--- সব কিছু সাপটে খুব শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারত এদেশের সাহিত্যে।’
বিভূতিভূষণের গল্পের শহর আদতে আমাদের ভারতীয় বাঙালি-সংস্কৃতি আশ্রিত গ্রামেরই বর্ধিত সংস্করণ। ফলে কী শহুরে প্রেক্ষাপটে লিখিত গল্প কী পাড়াগেঁয়ে গল্প সব জায়গাতেই আমরা পেয়ে যাই লোকায়ত জীবনের সোঁদামাটির গন্ধ, মায়া, আবেগ ও সরলতার ভেতর এক ধরনের গভীরতা ও জীবনমুখিনতা এবং আত্মকথন। বিভূতিভূষণের পর যারা গল্প লিখতে এসেছেন, অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের গল্পকারদেরকে কিন্তু এসব ভাবতে হয়েছে। দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধের পর দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যা, নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থান অথবা চারু মজুমদার, সিরাজ সিকদার, এর মাঝে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়া অথবা ইউরোপের সাথে গণচীনের আপোষকামিকা সবকিছু মিলিয়ে কিন্তু একটা হতচকিত অবস্থায় ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ এমন একটি লোকদেখানো ডাকসাইটে স্লোগানের ওপর অনাস্থা ক্রমশ দানা বেঁধে উঠলে এনজিও-গুলো যখন বন্ধুর ভেক ধরে দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার জন্য ডলার বিলাতে শুরু করেছে তখন আমাদেরকে কিন্তু বিভূতিকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে বেশ কিছু অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কালচার, লোকপ্রথা অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধের বিবর্তনরেখা এখন কোন পথে? কোন পথে এই বিবর্তরেখার গথিপথ থাকা উচিত ছিল? প্রসঙ্গত বলতে হবে, লোকায়ত জীবনের ছায়াপাতের মধ্য দিয়ে লোকায়ত দর্শনের আলোকে গণচেতনার পথ কি সত্যিকার অর্থেই বিভূতিভূষণ তাঁর ছোটগল্পে অনুসন্ধান করেছিলেন?
টি এস এলিয়ট তাঁর ‘ট্রাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’ প্রবন্ধে প্রকৃতির ভেতর এক ধরনের ‘নেগেটিভ কেপেবিলিটি’-র বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছিলেন। সেখানে যে চিরায়ত নির্লিপ্ততার কথা বলা হয়েছে সেই নির্লিপ্ততার প্রতিভাষ পাওয়া যায় বিভূতি-র গল্পে। তাঁর গল্পে যখন আমরা লোকায়ত জীবনের সন্ধান করি তখনই এই নির্লিপ্ততার প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে সবই যেন চিরকালীন অনিবার্যতার ভেতর দিয়ে ঘটে চলেছে; সেখানে মানুষ প্রকৃতির সহসত্তা মাত্র; মানুষের কিছুই করার নেই; মানুষ নির্লিপ্ত বাস্তবতা মাত্র। সুতরাং ‘খুঁটি-দেবতা’ গল্পের নন্দলাল অথবা তার স্ত্রী অথবা নন্দলালের মামা রাঘব চক্রবর্তীর কিছুই করার থাকে না অথবা অপরাপর গল্পের পাত্রপাত্রিদেরও আমরা দেখি চিরায়ত বিশ্বাসের কাছে নতজানু হয়ে ঘটে যাওয়া বাস্তবতাকে মেনে নিতে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো এখানেই কি সব শেষ? না, শেষ নয়। এর পরেও আমরা এমন এক দর্শনের ইশারা পেয়ে থাকি বিভূতি-র গল্পপাঠে, যে ইশারার ভেতর আমরা দেখতে পাই বিভূতি-র গল্পের পাত্র পাত্রিরা মহাকালের ইশারায় থমকে থাকে না; তারা অগ্রসর হয় সময়ের সাথে, বিবর্তনের পথে। ফলে অরণ্য, গাছপালা, প্রকৃতি অথবা মানুষ শুধুমাত্র প্রকৃতির ভেতর আটকে থাকে না, সকলেই জেগে ওঠে; তারা উপলব্ধি করে জীবনকে এবং জীবনের পরিবর্তনকে খুঁজে নেবার জন্য তারা ব্যাকুল হয়। এই ব্যাকুলতা আমরা দেখতে পাই ‘গ্রহের ফের’ গল্পে রাজচন্দ্রবাবুর চরিত্রে এবং আমরা দেখতে পাই লোকবিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে গণিতের হিসেব সেখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা দেখতে পাই, বিজ্ঞানের সাথে সাথে দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে মানুষের পরিবার আর পরিবারের চিরায়ত বিশ্বাসসমূহ।
লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোজের কাছে ছোটগল্প লেখা এক ধরনের ধর্মযাত্রার নামান্তর। এই ধরনের ধর্মযাত্রায় তিনি যে রোমাঞ্চ বোধ করতেন সেই রোমাঞ্চ থেকে তিনি মানবজীবনকে দেখতেন সূচনাবিহীন তাৎপর্যের আতশবাজি হিসেবে। তিনি তাঁর ‘ট্রেঞ্জ পিলগ্রাম’ গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন, তাঁর নিজের গল্পের শুরুও নেই শেষও নেই। আমরা জানি, জীবনের এই শুরু বা শেষ না থাকার বিষয়টি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মানবজীবনের বৈশিষ্ট্যনির্ভর অভিযাত্রা। কেননা এ সময়ের লেখকগণ জেনে গেছেন কোনো মৃত্যুই শেষ পর্যন্ত জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারে না। বরং জীবনের শুরুও নেই, শেষও নেই। আমরা বিভূতিভূষণের গল্পে লোকায়ত জীবনের দিকে তাকালে এ ধরনের অনুভূতির মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা লাভ করি। আধুনিক নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট মানবজীবনের বিস্ময়কর স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছেন তাঁর প্রতীকপ্রধান নাটকে; ব্যাকেটের এই বিস্ময়কর স্বাধীনতার বিপরীতে বিভূতিভূষণ এক ধরনের চিরায়ত বন্ধনের প্রতিচ্ছবি আবিষ্কার করেছেন তাঁর লোকায়ত জীবন অনুসন্ধানের ভেতর; অর্থাৎ ব্যাকেটের বহু আগেই বিভূতি-র লেখকসত্তায় চিরায়ত বন্ধনের আলোকে এক ধরনের অনিবার্য বিস্ময়কর স্বাধীনতার আকুতি লক্ষ করা গিয়েছিল। অথবা বেকেটের এই যে অপার স্বাধীনতাবোধ, যে বোধ বহু আগেই বিভূতি পেয়েছিলেন, সেই বোধের ভেতর পাওয়া যায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের নির্জনতা, শৈশবের প্রিয় খেলার মাঠ অধবা আত্মজৈবনিক চেতনার স্ফূরণ। এই আত্মজৈবনিকতা বিভূতি-র গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি আত্মজৈবনিকতার সাথে প্রকৃতিকে সংযুক্ত করে পক্ষান্তরে জীবন ও প্রকৃতির ভেতর অনন্ত স্বাধীনতার স্বাদ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। বিভূতিভূষণ তাঁর গল্পের মধ্যে সেই অপার স্বাধীনতার আলোকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন অনন্ত জীবনের অনিবার্য সম্ভবনা। তিনি তাঁর অধিকাংশ গল্পের পটভূমি নির্মাণ করেছেন গল্পের ভেতর তাঁর নিজের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। ফলে গল্পগুলো সহজেই হয়ে উঠেছে বিশ্বাসযোগ্য। আর যখন সেই বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে সংযুক্ত হয়েছে হাজার মানুষের হাজার বছরের বিশ্বাস অথবা লোকধর্ম, তখন সেই বিশ্বাযোগ্যতা মুহূর্তেই মিথে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় তাঁর গল্পসমূহ হয়ে উঠেছে চিরকালিন বাঙালি জনজীবনের চিরায়ত প্রতিচ্ছবি।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’গ্রন্থের ভূমিকাতে বলেছেন, ‘আমাদের দর্শন অতীতকে বর্জন করে অগ্রসর হতে পারেনি, অতএব তার মধ্যে টিকে থেকেছে প্রাচীন-- এমনকি আদিম পর্যায়ের বহু ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস। ফলে, ভারতীয় দর্শনের একটি চিত্তাকর্ষক বৈশিষ্ট্য বলতে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস ও পৌরাণিক কল্পনা--- এমনকি সাধনপদ্ধতি ও অনুষ্ঠানাদি থেকে অসম্পূর্ণ মুক্তি, এবং অন্তত আপাতদৃষ্টিতে বা অত্যাশ্চর্য প্রতীত হয় জটিল, গভীর ও অত্যন্ত সুউন্নত দার্শনিকতার সঙ্গে এগুলির সহাবস্থান।’ আমরা যখন বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে লোকায়ত জীবনের বিবিধ লোকাচার অনুসন্ধান করি তখন আমাদেরকে অবশ্যই সঙ্গতকারণেই বিবেচনায় রাখতে হয় ভারতীয় বৈদিক এবং অবৈদিক উভয়বিধ দর্শন। কেননা ভারতীয় দর্শনের সাহায্যেই বাঙালি লোকাচারের যথার্থ ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞজনের কাছে আমার প্রস্তাব থাকবে বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে লোকসংস্কৃতি অনুসন্ধান করতে হলে ভারতীয় দর্শনের আলোকে আমাদের ঐতিহ্যগত উৎসের যথার্থতা যাচাই করে নেওয়া; এবং পাশাপাশি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে লোকায়ত জীবনের গ্রহণীয় বর্জনীয় বিষয়াদিকে চিহ্নিত করার যৌক্তিক রূপরেখা নির্মাণ করা। আমরা অবশ্যই স্বীকার করবো, বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে অঙ্কিত যে সমাজ আমরা পাচ্ছি, সেখান থেকে চিরায়ত বাঙালি জীবন সরে আসতে শুরু করেছে। এই সরে আসা প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে উপস্থাপিত লোকসংস্কৃতির ভিন্নতর পাঠগ্রহণ আজ যৌক্তিকতা দাবি করে।
2 মন্তব্যসমূহ
আপনার আলোচনা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। খুব ভালো লিখেছেন।
উত্তরমুছুনবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'মৌরীফুল' গল্প অবলম্বনে সুশীলা চরিত্রটির পরিচয় দাও
উত্তরমুছুন