ফেব্রুয়ারি মাসের তিন তারিখ মামুন রশীদের জীবনের শুভ দিন। অন্তত এই উনিশ শ তিরাশি সালের ফেব্রুয়ারির তিন তারিখের আগে পর্যন্ত তাই ছিল । তিরাশির তিনের সকালেও এই ধারণা পাল্টানোর কোনো কারণ ঘটে নি। মামুন হিসেব করে দেখেছিল ঐ দিনে তার চাকরির বিশ বছর পূর্ণ হয়েছে, তার বিয়ের আঠারো বছর এবং তার একমাত্র পুত্রসন্তান ষোলো বছরে পা দিয়েছে।
দুঃখের কথা, মামুন তার নিজের জন্মতারিখ জানে না, তবে তার দৃঢ়বিশ্বাস এবং এই বিশ্বাস সঙ্গত বলেই মনে হয় যে তার জন্মও কোনো এক ফেব্রুয়ারির তিন তারিখে। এতগুলো ফেব্রুয়ারির তিন যখন তার জীবনে এত শুভ হয়ে দেখা দিয়েছে, তখন সে নিজেও নিশ্চয় এই দিনেই এক দুর্লভ উপহার হিসেবে এই বাংলাদেশে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। কিন্তু সে কথা বলা যাবে না, কারণ তার বাবা ঐরকম একটা সময়ে হবে, হয় জানুয়ারি না হয় ফেব্রুয়ারি, হয় মাঘ, না হয় ফাল্গুন এই রকম কথা বলে এসেছেন, কখনো নির্দিষ্ট তারিখ মনে করতে পারেন নি। অথচ ভদ্রলোক তার অন্য সন্তানদের প্রত্যেকেরই জন্মের বার তারিখ তিথি নক্ষত্র সবই লিখে রেখেছিলেন, শুধু তার বেলাতেই কিছু লিখে রাখেন নি। ভাইবোনদের প্রায় সবাইকে এখন গরু গাধার শামিল ধরে নেওয়া যায়, অন্তত মামুনের সঙ্গে তাদের কোনো তুলনাই চলে না। এ থেকেই বোঝা যায় মানুষ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছুই জানে না। মামুন রশীদ তার বাবার পঞ্চাশ বছর বয়েসের সন্তান, তার জন্মের আগে ভাইবোনে মিলে তার তখন পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়ে গিয়েছে।
আজকের আকাশটা নিচু, ঠিক যেন ছাদের উপরেই নেমে এসেছে। সিসের মতো ময়লা ছাই রঙের আকাশ, রোদ নিভে গেছে সকাল থেকেই। হিম ঠাণ্ডা ঝড়ো হাওয়া বইছে, এইবার টিপি টিপি বৃষ্টি নামবে। আকাশের ভারটা ঘরের মধ্যেও টের পাওয়া যাচ্ছে। মামুন কয়েকদিন থেকে অফিস যাচ্ছে না, লম্বা একটা ছুটি নিয়েছে। পাজামার উপরে মোটা সুতি পাঞ্জাবি পরেছে সে। তার উপরে জড়িয়েছে পুরনো একটা কাশ্মীরি শাল। ড্রয়িংরুম দোকানের মতো সাজানো, মেঝেতে দেয়াল থেকে দেয়াল পুরু কার্পেট, আমাদের দিশি আমিন ভাইদের নয়, খোদ ইরানি; ফোম আঁটা ডবল সোফা সেট, নিচ টেবিল, টিপয়, ফুলদানি, ফুল, বুক কেস, ব্রোঞ্জের নগ্নিকা, ডিসকাস নিক্ষেপকারী অ্যাথলেট, দেয়ালে জয়নুল, সুলতান, আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন্নবী— মানে সংস্কৃতির একেবারে ছড়াছড়ি। বলা চলে বিশ্বসংস্কৃতির মেলা। অত বড় ঘরেও ঠিকমতো জায়গা হচ্ছে না। জায়গা সঙ্কুলান না হবার একটা কারণ হচ্ছে এতসব সংস্কৃতি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে না, তাদের মধ্যে লটঘটি খটখটি লেগেই আছে। ঘরের আবহাওয়া চব্বিশ ঘণ্টাই তেতে রয়েছে। বাঁ দিকে এক টুকরো চৈনিক সংস্কৃতি, তার পাশেই ডান হাতে খানিকটা বাঙালি সংস্কৃতি ঠিক যেন নেড়ি কুকুরের মতো দাঁত খিচিয়ে আছে। ওদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার পুতুলের ভিতর পুতুল, বড় মানিব্যাগের মধ্যে ছোট মানিব্যাগ, এদিকে তার কাছেই সংস্কৃতি সুড়ঙ্গ খুঁড়তে খুঁড়তে চলে গেছে হাতি। তার পিঠে চড়া যায়। সত্যি বলতে কি মামুনের ছেলে এই ষোলো বছর বয়েসেও ওটার উপরে চড়ে বসে থাকে।
এই ড্রয়িংরুম বন্ধ। প্রথমে সূক্ষ্ম তারের পাল্লা বন্ধ, তারপর মোটা কাচের পাল্লা বন্ধ, তার পেছনে কাঁচা সোনা রঙের ভারী পর্দা থকথকে করে টানা । এইভাবে সব বন্ধ করে দিয়ে ঘরের মধ্যে কাশ্মীরি শাল গায়ে মামুন বড় সোফার ফোমের মধ্যে শরীরের আদেকটাই ডুবিয়ে দিয়ে বসে আছে। ঠাণ্ডা লাগার প্রশ্নই নেই। ঘরের ভিতরটি কবরের মতো স্তব্ধ, বাতাস ঢোকা তো দূরের কথা বাইরের ঝড়ো বাতাসের গর্জন পর্যন্ত এতটুকু শোনা যাচ্ছে না এ ঘর থেকে। মাঠঘাট ঝেটিয়ে হাওয়া যে কেঁদে চলেছে অকূল উদ্দেশে সেটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে অবশ্য রবি ঠাকুরের গানের রেকর্ড রয়েছে। ঘরের কোণে রাখা মিউজিক সেন্টারটি চালু করে দিলে সমুদ্রের গভীর গর্জনকেও এখানে ডেকে আনা যায় ।
সোফায় বসে বসে সকাল থেকে এ পর্যন্ত তিনবার সে ডেকেছে তার বউকে । বউ আসে নি। মামুন বেশ লম্বা, কিন্তু সোফাটিকে তৈরি করিয়েছে তার চেয়েও লম্বা করে যাতে কোনোরকম অসুবিধে না হয়। এই সোফা তাদের বড় প্রিয়, এতে চড়ে তারা সাত ভুবন দেখে এসেছে। সময় সুযোগ যখন মিলেছে তখন এই সোফাতেই মামুন রকমারি খাবার খেয়েছে, মুখ ফিরিয়েছে নতুন স্বাদের মাংসে। সেইসব খাদ্যের নানা গন্ধ নানা চিহ্ন এখনও হঠাৎ হঠাৎ মামুন পেয়ে যায়। সেদিন সে পেয়ে গেল এক দীর্ঘ সোনালি চুল, ফোমের ভাঁজ থেকে যখন টেনে বের করছিল, মনে হচ্ছিল যেন দৃঢ়লগ্ন দুই স্তনবলয়ের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসছে এক স্বর্ণতন্তু। চুল থেকে মনে পড়ে গেল অতলান্তিকের নীল মেশানো একজোড়া নীল চোখ। জোয়ানা হিল। মামুন বুঝতে পারে না, মেয়েরা কি কারণে পারফিউম মাখে। তার ধারণা খুব ভালো জাতের শিকারি কুকুরের চেয়েও সমঝদার পুরুষের ঘ্রাণশক্তি প্রবল। এই নিষ্কলঙ্ক সোফায় কি বিচিত্র সব সুগন্ধের আভাস। এসবের তো সত্যি করেই কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিটি নারীর যে নিজের নিজের একা গন্ধ তা সে নির্ভুলভাবে চিনে নিতে পারে, পারফিউম ব্যবহার করার ফলে সেই চিনে ওঠার ব্যাপারটাই শুধু গুলিয়ে যায়। এর কোনো মানে হয় না।
অন্যদিকে মেয়েরা কোনো গন্ধ পায় না। শুয়োপোকার মতো অন্ধ তারা। তাদের ঈর্ষা বড় ছোট জায়গায় ঘুরপাক খায়। তারা কেবল নিজেদের দেখে। আপন আপন পুরুষ মানুষকে নাভিমূলের চারপাশে নাকে দড়ি বেঁধে ঘোরাতে চায়। মামুন সারাদিন বসে বসে আকাশের রং ফেরা দেখতে পারে। মেয়েরা তা পারে না। শুয়োপোকার দল! সেইজন্যেই বার বার সে তার বউকে এই একই সোফায় ডাকতে সাহস পায়। কিন্তু আজ কিছুতেই আসছে না সে । শোবার ঘরে উপুড় হয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে আছে। কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চুলের গোছা বিছানায় ছড়িয়ে রয়েছে। তার মধ্যে একটিমাত্র রুপোলি গুচ্ছ ঠিক সাপের মতো একে-বেঁকে উরুর নিচে চলে গেছে। সাপ নয়, সাপের খোলস। শীতের শেষে সাদা খোলস ফেলে কুচকুচে কালো রঙের সাপ চলে গেছে। কতো হবে এখন তার স্ত্রীর বয়স?
সোফার কোণে বসে চুরুট টানতে টানতে দিশেহারা মামুন রশীদ হিসেব করতে গিয়ে বউয়ের বয়েসের কথা ভুলে যায়। মাঝখানে একটি সপ্তাহ চলে গেল, তবু ফেব্রুয়ারির তিন তারিখের কথাটা কেবলই প্যাচ কেটে কেটে স্কু-র মতো মগজ ছ্যাঁদা করে ভিতরে ঢুকতে থাকে। চাকরির বিশ বছর হয়ে গেল। যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকেছিল, তখন এই দেশটার অন্য নাম ছিল। দেশে তখন জঙ্গল অনেক বেশি, আবাদি জমির পরিমাণ কম, মানুষজন কম। তখন রোদ ছায়া নদী-নালা মাটি জল অন্যভাবে সাজানো ছিল। বিশ বছরে সবই প্রায় নিড়িয়ে সাদা করে আনা গেছে। কিন্তু তাতে তার কিছু আসে যায় না। সে তো একেবারে শুরুতেই নেতৃত্ব দিতে শিখে যায়। কি নিদারুণ নিখুঁত ইংরেজিতেই না সেই চমৎকার বক্তৃতাটি দেওয়া হয়েছিল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল ভাষাটি যত্ন করে শেখা, ইংরেজি যার মাতৃভাষা সে কখনই এত চমৎকার কথা বলতে শেখার প্রয়োজন বোধ করে না। মামুন দেখেছে ইংরেজি যাদের মাতৃভাষা তারা এলোমেলোভাবেই কথা বলে, ভক্তি আর আনুগত্য মূর্ধা থেকে জননেন্দ্রিয় পর্যন্ত না পৌছুলে পরের ভাষা এত সুন্দর করে বলা কঠিন। যাই হোক, সেই অমোঘ বক্তৃতার মূল কথাটি আঁকড়ে ধরেই তো সে এত উপরে উঠল। তোমাদের বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট, কিন্তু আদতে তোমরাই জনগণের শাসক। কাজেই ঘোড়ায় চড়তে শেখো এবং চাবুক চালানো আয়ত্ত করো। একই কারণে ইংরেজি শেখো, তোমার দেশের লোকের ভাষায় কথা বললে তারা তোমাকে ঘরের লোক ধরে নিয়ে গা বেয়ে মাথায় উঠে মুতবে। শাসিতদের থেকে তোমাদের সম্পূর্ণ আলাদা করার ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। কিন্তু দাঁত কেলিয়ে ঘাড় চুলকে বিনয় দেখিয়ে পাবলিক সার্ভেন্ট কথাটা সব সময়ে চালিয়ে যাবে। তা না হলেই বাঁশ যাবে, চামড়া খিঁচে নেবে জনগণ। এইভাবে তালিম দিতে শুরু করে তাকে আর তার সেই সময়ের ঝাঁকটিকে একপাল হাঁসের ছানার মতো শামুক গুগলির খোঁজে পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হলো। সকলের সঙ্গে সঙ্গে মামুনেরও বগলের রোয়ার উপর ছোট ছোট একজোড়া পাখা গজালো। তারপর সুদিন এলে পুরো ঝাঁক ডানা মেলে উড়ে দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল ।
মামুনের স্পষ্ট মনে পড়ে ঐ অসাধারণ বক্তৃতার ফলে তার জীবনের ছাঁচ চিরকালের জন্যে তৈরি হয়ে যায়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত যখন যেখানে সে গেছে, প্রথমেই সব থেকে উচু জায়গাটি দেখে নিয়েছে। চেয়ার হোক, মোড়া হোক, পিড়ি হোক, নিদেনপক্ষে একটুখানি উচু মাটির ঢিবি হোক, উচু জায়গাটি ঠিক সময়ে বেছে নিতে কখনো ভুল হয় নি তার, আর অসাধারণ অন্যমনস্কতার সঙ্গে সেই জায়গাটি দখল করে নিতেও কখনো সে দ্বিধায় পড়ে নি। নিজের জীবনের দিকে চেয়েও মামুন দেখতে পায় সিড়িভাঙা অঙ্কের মতো উচু নিচু আসনের ছক পড়ে আছে। ধাপে ধাপে সাজানো, সবার উপরে এক বিশাল সিংহাসন। ঐ সিংহাসনটি নিষিদ্ধ ফল—ওটার দিকে কখনো সে হাত বাড়ায় নি, হাত বাড়াবেও না । পুরোপুরি হংসরাজ হয়ে আকাশে উড়ার মুখে শেষ শিক্ষাটি তাদের দিয়ে দেওয়া হয়। উঠবে, উঠবে, কেবলি উচুতে উঠবে, কিন্তু কখনো কোনো অবস্থাতেই সবচেয়ে উচু আসনটিতে চড়ে বসবে না। তোমার জন্যে ঐ সর্বোচ্চ আসনটি হচ্ছে হিন্দুর গোমাংস ও মুসলমানের শুয়োরের রক্ততুল্য। ঐ আসনটি হচ্ছে চূড়ান্ত ক্ষমতার আসন । তোমাকে বলা হয়েছে পাবলিক সার্ভেন্ট, কিন্তু তুমি আসলে জনগণের শাসক। এইবার তোমাকে বলা যাক শাসক তুমি যতই হও তুমি কিন্তু সত্যি সত্যিই সেবক, ক্ষমতার সেবক । ক্ষমতা কার? সেটা প্রশ্ন পর্যন্ত করবে না। ক্ষমতার নাক মুখ চোখ নেই।
সত্যিই, প্রথম আসনটা খুব উঁচু ছিল। বুড়ো আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোভাবেই মামুন আর সেটার নাগাল পায় না—শেষে তার তলায় টুল পেতে টুলে দাঁড়িয়ে হাঁজোর পাঁজোর করে তাতে সে উঠে বসে। সে তো আজকের কথা নয়, একটা ফেব্রুয়ারির তিন থেকে তার শুরু। তারপর একটু একটু করে সে উঠেছে। এখন সে মেঘলোকেই চলে এসেছে বলা যায়। মণিমুক্তো দিয়ে সাজানো, মখমলের ঝালর দেওয়া উচু সিংহাসনটি এখন তার হাতের কাছেই, ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দেখতে পারে। মাঝে মাঝে যখন ফাঁকা পড়ে থাকে, দু-একবার বসে নিতেও পারে। কিন্তু এই ভুল সে কখনো করে না। এমন অপয়া এই জায়গাটা যে দু-দণ্ড তিষ্ঠিয়ে কেউ পাছা ঠেকাতে পারে না। কেবলই পাছা বদল হচ্ছে। যে বসে সে সিনেমার ছবির মতো, ঝক ঝক ঝক, বদলিয়েই যাচ্ছে, এই গোঁফ, এই গোঁফ চাঁছা, এই দাঁড়ি, এই কামানো, এই টাক, এই চুল। মামুন ওদিকে চোখ তুলে চেয়ে দেখে না পর্যন্ত। জীবনে সবচেয়ে ভালো করা মানেই হলো টিকে থাকা । আগে টেকসই হও, পরে কারিগরি ফলিয়ো । হাউয়ের মতো উপরে উঠে গোত্তা খেয়ে পড়ে নিতম্বের হাড়গোড় ভাঙার কোনো মানে নেই। মামুন চুরুট কামড়ে ধরে, জনগণ অস্থির, আর আমরা স্থির। ক্ষমতা? ক্ষমতা আবার কি? কাগজের বাঘের আবার গর্জন কি? ওর ল্যাজ তো সলতে, যে আসছে ফস করে দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে দিচ্ছে। কুটকুটুনির শখ হয়েছে, থাকো সিংহাসনে বসে। ক্ষমতাটা ঠিক কোথায় আছে, সে আমরাই ভালো বুঝি। চুরুটটাকে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিল সে।
খুব নিচুস্বরে কথা বলতে শিখেছে মামুন। ধীরলয়ে মৃদুকণ্ঠে সে তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে। উচ্চারণ করার আগের মুহুর্তে পর্যন্ত কখনো বোঝা যায় না কোন শব্দটি সে ব্যবহার করবে, কিন্তু কখনই কোনো শব্দের জন্য তাকে হাতড়ে বেড়াতে হয় না। উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় তার শব্দটি অমোঘ। তার আলাপের মূল সূত্রগুলো এইরকম : যে কোনো প্রস্তাব, যে কোনো কাজ সমর্থনযোগ্য। দুই, যে কোনো প্রস্তাব, যে কোনো কাজ খণ্ডনযোগ্য। তিন, পথের কোনো অন্ত নেই এবং সব পথই পিচ্ছিল অতএব যে কথাটা সত্যিই বলা হয়েছে, সে কথাটা সত্যিই বলা হয় নি আর সর্বশেষ হলো, বাস্তবের দিকে কখনো চেয়ে দেখা যাবে না, হিসেবটা সব সময়েই আমাদের দিক থেকে। অর্থাৎ বাস্তব এক ধরনের বৌদ্ধিক নির্মাণমাত্র।
সিংহাসনে যে বা যারাই বসে থাকুক, মামুন রশীদরা ক্ষমতার বাঁকে বাঁকে থাবা পেতে অপেক্ষা করছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। তাদের মোলায়েম সুকুমার ঠোঁটে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ঢেউ উঠছে। সেই ঢেউ বেয়ে গড়িয়ে নামছে শব্দের দীর্ঘ সারি। কালো কালো অক্ষরের পিঠে চড়ে সাদা কাগজ বেয়ে ঢলঢলে কাদার স্রোতের মতো এগিয়ে চলছে। কার সাধ্য এই স্রোত আটকায়?
মামুন এমন করে সামনের দিকে চেয়ে রইল যেন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তারই বয়ানে তার ফরমান স্রোতের আকার নিয়ে জনপদের দিকে এগোচ্ছে। ঠেকানোর কোনো পথ নেই। কাঠ-কুটো, মাটি-পাথর ফেলে কোনো লাভ হচ্ছে না। মানুষজন ঝটপট প্রাণপণে কানে হাত চাপা দিচ্ছে, চেঁচাচ্ছে, ভাঙাচ্ছে—কিন্তু কোনো ফল নেই, দেয়াল ভেঙে ঘরবাড়ি গুতিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে যাচ্ছে ফরমান। এক এক টানে খুলে নিচ্ছে মানুষের চামড়াসুদ্ধ জামাকাপড়। তার কপালে বিনবিনে ঘাম দেখা দিল। অনুপ্রাণিত বোধ করলে এরকম হয় তার। আর বসে থাকা অসম্ভব হলো তার পক্ষে। ঘরের কোণে নকশা তোলা কাঠের যে বাকসোটিতে সিগার রাখা আছে, সেদিকে এগোল মামুন রশীদ। ডালা তুলে দেখল ভিতরটা ফাঁকা। একটু অবাক হয় সে! কাল রাতেও ভরা ছিল বাকসো। চুরুটগুলো সে কি চিবিয়ে খেয়েছে? কয়েকটা মুহুর্ত সে থমকে দাড়িয়ে রইল। মাথার ভিতরটা ভারী সিসের পাতে ভর্তি—ঘাড় ঝুঁকে আসে তার, কিরকম একটা বাসি গন্ধ এসে নাকে ঢোকে। বাইরেটা এখন কেমন একবার দেখতে পারলে হতো। কিন্তু কি করে সেটা সম্ভব করতে পারে মামুন রশীদ? প্রথমে জানালার কাছে পৌছুতে হবে, তারপরে টানতে হবে কি সাংঘাতিক সোনালি ভারি পর্দা, তারপরে কিসব ছিটকিনি, ঘষা কাচের ভিতর দিয়ে বাদল দিন দেখা আর সেই ঝড়ো বাতাসের ভয়ঙ্কর গর্জন ।
মামুন ফিরল। নিমেষে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল যেন। রাজা আর জল্লাদের তফাত নিয়ে যে গল্পটি সেই গল্পের কথা আবার ভাবতে পারছে সে। রাজা চেয়েছিলেন শিল্পী মানুষের কাটামুণ্ডু আঁকুন। এঁকে দেখালে কাজটা পছন্দ হয় নি তার। শিল্পীকে ডাকলেন তিনি, বললেন, কাটামুণ্ডু আপনি দেখেন নি কখনো, দেখা দরকার—এই বলে সামনের ক্রীতদাসটির মাথা কেটে দিতে বললেন জল্লাদকে। জল্লাদের সঙ্গে কিছু তফাত আছে রাজার। রাজা নিষ্ঠুর একথাটা বলা যায়, জল্লাদের সম্বন্ধে মনস্থির করা সম্ভব নয়।
চুরুট রয়েছে শোবার ঘরে। অনেকটা পথ যেতে হবে। ড্রয়িংরুমের পশ্চিম কোণে দরজা, সেটা পেরুলে বাঁ হাতে টয়লেট, ডাইনে বন্ধ ঘর, তারপর বন্ধ ঘর, খানিকটা এবং শেষ পর্যন্ত শোবার ঘর। সমস্ত পথটাতে গালচে পাতা—গা শিউরোনো শব্দ করে গালচের মেঝে নিঃশ্বাস ফেলে, চপ্পলের তলা আঁকড়ে ধরে। এ ঘরে এসে যখন পৌছোয় মামুন রশীদ তখন তার হাটু দুটি দুমড়ে ভেঙে পড়ছে। চেষ্ট অব ড্রয়ারের গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়ায় সে। চুরুটগুলো কোথায়? এত তুচ্ছ কথা কি জিগ্যেস করা যায় ঐ পাথরের মূর্তির কাছে? উপুড় হয়ে আছে তার বউ শায়েলা। গোলাপের শুকনো পাপড়ির মতো দু খানি পায়ের পাতা। বিছানার চাদরের রং ঐরকম অসম্ভব সাদা না হলে অত ফিকে গোলাপি রং কিছুতেই চোখে পড়ত না। আর সেই কোমর ছাড়িয়ে নামা কুচকুচে কালো চুলের রাশের মধ্যে একগুচ্ছ বরফের মতো ঠাণ্ডা সাদা চুল যাকে কেবলই সাপের খোলসের মতো মনে হয়।
চুরুট দরকার। কোনটায়? খুব মৃদু গলায় মামুন বলে। চুরুট নিতেই এ ঘরে এসে মামুন সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায় এখানে কেন এসেছে সে। কোনো কথা খুঁজে না পেয়েই যেন সে চুরুটের কথা জিগ্যেস করে।
শায়েলার সাদা সিল্কের শাড়ির আঁচল মেঝের উপর নিঃশব্দে খসে পড়ে।
আমি তোমার সঙ্গে দু-একটি কথা বলতে চাই—আর দাড়িঁয়ে থাকা অসম্ভব দেখে মামুন বিছানার এক কোণে বসে পড়ে। সিল্ক সরে যাচ্ছে, মামুন দেখতে পায় শায়েলার পিঠের খানিকটা, পায়ের নিচের দিকের সামান্য একটু অংশ। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে মামুন।
আমরা কি এটা নিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারি না? মামুন ধীর শান্ত গলায় বলে। সে জানে শায়েলাকে একবার তার সঙ্গে কথা বলাতে পারলে সমস্ত ব্যাপারটার নিম্পত্তি করতে আর কোনো অসুবিধে হবে না। জীবনে অসংখ্যবার সে অতি জটিল গিট খুলতে পেরেছে মাত্র একটি কথা দিয়ে শুরু করে, আসুন আমরা কথা বলি। কথা, কথা, কথা— আমরা কথা বলতে চাই–কথা বলতে পারলে আমাদের সব সমস্যাই মিটিয়ে নিতে পারব। মানুষের একটা নরম ভেজা চ্যাপ্টা জিভ আছে যার সত্যিকার শক্তির পরিমাপ মানুষ কখনই করতে পারে নি। সেই জিভ দিয়ে মামুন একবার তার শুকনো ঠোঁট দুটো চেটে নিল ।
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই—আরও একবার প্রায় এই কথাগুলোই সে বলেছে, এবারে মনে হলো বাতাসের মৃদু শব্দের মতো কথাগুলো যেন ঘরের কোণ থেকে উঠে এলো। দু-এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে মামুন তার জিভটিকে মুখের ভিতরই বারকতক ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, দুর্ঘটনা ব্যাপারটা আমরা ইচ্ছে করলেই সব সময়ে এড়াতে পারি না। দুর্ঘটনা যাই ঘটুক না, শেষ পর্যন্ত সেটাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতেই হবে। যদি তুমি সেটা না করো, তাহলে তো ঘটনাটা মুছেও যাবে না, উবেও যাবে না। আমার মনে হচ্ছে, তুমি কোনো কথা না বলে বাড়াবাড়ি করছ। আমাদের তো দেখতে হবে এটা নিয়ে আমরা কি করতে পারি?
মামুন খেয়াল করল, হ্যাঁ, এইবার সত্যিই সে কথা বলছে। আর হেলে পড়ছে না কথাগুলো—একটার পেছনে আর একটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। নানারকম ফাঁস তৈরি হচ্ছে, সামান্য বিরক্তির সঙ্গে মেশাতে পেরেছে ঈষৎ শ্রেষ। আছে কি নেই।
অনেকটা সময় নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসছে শায়েলা। সরসর শব্দে চুলের গোছা কোমর থেকে নিচে নামছে, সাদা খোলসটা দুটো মোচড় খেলো, তারপর হালকা বাতাসে দুলতে শুরু করল। শায়েলা পেছন ফিরে ছিল—এবার সে মামুনের দিকে ফিরল। গোলাপি ঠোঁট দুটোয় ছোট ছোট অসংখ্য কুঞ্চন, সারা মুখ থমথমে, বাতাসে ভাসছে যেন, মুখের দুপাশে চুলের গোছা—কপালে গালে থোকায় থোকায় অল্প দুলছে, কিছু নরম চামড়ায় সেঁটে আছে। মামুনের দিকে ফিরে সে স্থির চোখে চেয়ে রইল। সেখানে রাগ-ক্ষোভ কিছুই দেখতে পায় না মামুন। কিন্তু একটা আতঙ্ক নেমে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। হাজার বছরের পুরনো পাথর কেটে গড়া এক মূর্তি তার সামনে। হিম সাঁতলা একটা বাতাসের ঝাপটা এসে যেন তার গায়ে লাগল। শায়েলার ঠোঁট নড়ল কি নড়ল না, মামুনের কানে এলো দুটি শব্দ, কি বলছিলে? মুখের ভিতরে মামুনের জিভ পাথরের মতো ভারী হয়ে এলো, আবার কানে এলো তার, কি বলছিলে বলো।
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই ।
বলো ।
তোমার সঙ্গে, মানে এই ব্যাপারটা নিয়ে।
কোন ব্যাপারটা নিয়ে? হেঁয়ালি করো না, স্পষ্ট করে বলো কোনো ব্যাপারটা নিয়ে।
আমি এটাকে একটা দুর্ঘটনা বলতে চাইছি?
কোনটাকে তুমি দুর্ঘটনা বলতে চাইছ? এটা-সেটা, ঘটনা-দুর্ঘটনা এইসব কথা বলছ কেন? তুমি জানো না ঘটনাটাকে কি বলে?
আমরা যদি কথাই বলতে চাই তাহলে বলার অবস্থাটা বজায় রাখতে হবে। তুমি যে অবস্থায় আছ তাতে কথা বলা অসম্ভব। এই মুহুর্তে তুমি দেখতেও পাচ্ছ না, শুনতেও পাচ্ছ না ।
এতগুলো কথা একসঙ্গে বলতে পেরে মামুন বুঝতে পারল কথার উপর তার নিয়ন্ত্রণ এসে গেছে। সে থামল না, শায়েলার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে মৃদু গলায় বলে গেল, দুর্ঘটনা আমরা কাকে বলি? যে ঘটনা প্রচণ্ড ক্ষতি করে—যে কোনো রকমের ক্ষতি—সেই রকম ঘটনা যা আমরা ঘটাই নি, যা আমাদের ইচ্ছাকৃত নয়, তাকেই তো বলা যায় দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় আমাদের সায় নেই, দায়দায়িত্ব নেই। দুর্ঘটনা আমরা চাই না বটে, কিন্তু ঘটে গেলে সেটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে?
তুমি এটাকে দুর্ঘটনা বলছ? শায়েলা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইল মামুনের দিকে।
আর কি বলতে পারি?
তোমার স্ত্রীর সম্মান—
সে কথাটা এখানে আসছে না।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, সে কথাটা এখানে আসছেই না। তার একমাত্র কারণ স্ত্রীর সম্মান বলে তোমার কাছে কিছু নেই। আমি সেটা ভালোই জানি। তোমার নিজের সম্মানও তোমার কাছে এতটুকু নেই। একটা কেন্নো বা একটা গিরগিটির সঙ্গেও তোমার তুলনা চলে না সেটা সারা দেশের কেউ না জানলেও আমি জানি। ছ্যাকড়া গাড়ির গাড়োয়ান হয়ে চাবুক হাঁকড়াচ্ছ, ভাবছ— -
আমি তোমাকে আগেই বলেছি কথা বলতে গেলে বলার আর শোনার জন্যে ধৈর্য দরকার। তুমি শুধু তোমার সেন্টিমেন্ট উগরে দিচ্ছ। আচ্ছা, বলো তো দেখি দুপুরবেলায় ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে ডাকাত টাকাপয়সার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মহিলার ইজ্জতটুকুও লুট করে নিয়ে চলে গেল। কি করবেন মহিলা—যাই করুন, যতই করুন ঘটনাটাকে ফেরানোর মতো কোনো রাস্তা নেই—
কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল শায়েলার মুখ। দুটি চোখ বিস্ফারিত—মণির উপরের নিচের সাদা অংশটা বেরিয়ে এসেছে—চোখের সামনে যেন কোনো বিকট দানব দেখছে সে। কেন কথা বলতে এসেছ তুমি, আমাকে তুমি কি বোঝাবে? আমি কি পোশাকের নিচে তোমাকে কোনোদিন দেখি নি? তোমরা নোংরা জঘন্য চেহারাটা? এখনও আমি তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাই। জামাকাপড়ে যতই নিজেকে ঢেকে রাখো ।
আমি কিছুই ঢেকে রাখি না, অন্তত তোমার কাছ থেকে। আমাদের বিবাহিত জীবন তো খুব কম দিনের নয়। নিজেদের কাছে আমাদের কোনো কিছুই গোপন নেই শায়েলা ।
শাঁখের মতো সাদা লম্বা ঘাড়ের উপর সাপের খোলস চাপানো একটা অসম্ভব সুন্দর মাথা দুলছে—দেখা যায় কি যায় না। দুটি কালো তারার উপর দু ফোটা আলো। ঠোঁটের ফাকে বেরিয়ে এসেছে ঝকঝকে সাদা দাঁতের উখোঘষা একটুখানি ধার, দেখা যায় কি যায় না। শায়েলা অদ্ভুত একটা হাসির সঙ্গে বলল, ঠিক বলেছ, আমাদের কারও কাছে কোনো কিছুই গোপন নেই। আমরা পরস্পরের কাছে হঠাৎ নগ্ন হয়ে গেছি। এই মুহুর্তটা আমার জীবনে আসবেই আমি জানতাম ।
তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ আমি জানি না। আমাদের জীবনে একটিই দুর্ঘটনা ঘটেছে। জীবনের এতটা পথ চলে আসার পরে। মাত্রই একটি ঘটনা, যা একবার ঘটেছে, যা আর কখনো ঘটবে না—
কথার মাঝখানে শায়েলা হঠাৎ এমন তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল যে সেটা তার চেহারার সঙ্গে একটুও মানানসই হলো না, অনেক ঘটনা আছে যা মানুষের জীবনে একবারই ঘটে, দু’বার ঘটার কোনো উপায়ই নেই। যেমন মানুষের জন্ম, মানুষের মৃত্যু। কবার মরতে পারো তুমি? অবশ্য তোমার মতো চামচিকে বেঁচে থাকে কবে যে মরবে?
বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছে মামুনের পক্ষে যে এইসব কথা তার অতি লক্ষ্মী দেবী দেবী চেহারার বউ তাকে শোনাচ্ছে । বাইশ বছরের বিবাহিত জীবনে যে শায়েলাকে সে চিনেছে আজ যেন তাকে খুবই নতুন মনে হচ্ছে। একটি অশিষ্ট শব্দ সে তার মুখে কখনো শোনে নি, এতই সঙ্গোপনে সে জীবনযাপন করেছে যে মামুন নিজের ভোগলালসাভরা দিনরাত্রি নিয়ে কখনো বিব্রত পর্যন্ত হয় নি শুধুমাত্র এই কারণে যে শায়েলা যখন হাটে তার পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না, যখন জানালার পাশে কোমরের নিচে নামা এক ঢাল চুল আঁচড়াতে বসে তখন হঠাৎ-ই ধারণা হয় যে তার শরীরটা যেন বা সোনালি রঙের আলো দিয়ে তৈরি, সাদা দেয়ালের গায়ে বিকেলের এক টুকরো ঝিকিমিকি রোদের মতো। শায়েলার পেটে যখন বাচ্চা এলো মামুনের মনে হতো যেন কুমারীর গর্ভধারণ—বিছানায় শায়েলার নগ্নদেহ সে কখনই স্মৃতিতে আনতে পারত না। সেই শায়েলা এখন কি কদৰ্য কুৎসিত কথাগুলোই না বলে চলেছে। ওর মোমের মতো সাদা মুখের উপর শঙ্কর মাছের লেজের তৈরি চাবুক দিয়ে একটি তীব্র আঘাত করার জন্যে মামুনের হাত নিশপিশ করে ওঠে। আমাদের কোনো সুন্দরীর প্রয়োজন নেই। আর সতীর প্রয়োজন তো নেই-ই। কিংবা সতী উচ্ছন্নে যাক—সতী অসতী আলাদা করার জন্যে কোথাও কোনো দাগ নেই—তা নিয়ে মামুন মাথা ঘামাচ্ছে না—তবে সতীপনা দেখানোর জন্যে একজন রাজপুরুষের বাড়ি উপযুক্ত জায়গা নয়। এই ব্যাপার নিয়ে দেবার মতো সময় সত্যিই তার নেই।
মামুন মনে করে দেখল ঘটনার দিন সকালেই ন’টার দিকে তিনি ডেকেছিলেন। তিনি, বেঁটেখাটো মানুষটি, চুল ছোট করে ছাটা, সাদাসিধে মোটা খসখসে পোশাক পরনে, ছোট কিন্তু চিলের মতো তীক্ষ কপিশ একজোড়া চোখ। না হেসে তিনি কখনো কথা বলেন না—অথচ তার সামনে দাড়ালেই মুহুর্তের জন্যে একটা ঠাণ্ডা স্রোত মামুনের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাবে। কিছুতেই এর ব্যতিক্রম হবে না। এখন কতো সহজ হয়ে এসেছে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা—মামুন এতদূর পর্যন্ত প্রশ্রয় পেয়েছে তার কাছ থেকে যে আজকাল কথাবার্তায় কখনো কখনো বেশ উদ্ধত হয়ে ওঠে সে। অথচ সামনে দাড়ালেই একবার সেই হিমঠাণ্ডা স্রোতটা সে টের পাবেই। তিনি হাসেন, কিন্তু সত্যিই হাসলে সেই হাসির সঙ্গে না মিশিয়ে কোনো কিছু কি ভাবা সম্ভব মানুষের পক্ষে? কিন্তু এই অতিমানুষটি তা করতে পারেন—হাসি একদিকে, মৃদু, চোখ-কোচকানো, ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি একদিকে আর ভাবনা চিন্তাগুলো আর একদিকে।
তিনি বললেন, আশা করি বিকেলের সব ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ। তবু তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি একবার তোমার মুখ থেকে এই বিষয়ে একদম আলাদা করে কিছু শুনব বলে। অন্যদের সামনে বিচার-বিবেচনার ভান করে যা বলো তা নয়, সত্যিই যা বলার আছে তাই বলো এখন ।
স্যার, এখন আর বলার কি আছে! সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। বিকেলের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়েছে—আমি নিজে দেখছি এটা। পাঁচ হাজার মানুষের প্যান্ডেল, নিখুঁত বন্দোবস্ত । মঞ্চ, আলো, মাইক্রোফোন। কোনো ব্যবস্থাই নিতে আমরা বাকি রাখি নি। জাতি জেনে গেছে আজ আপনি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেবেন। এখন আপনি কি শুনতে চাইছেন স্যার?
মুহুর্তের জন্যে মুখের হাসিটি নিভল তাঁর। কালো কালো ক্রিমির মতো অন্ধকার উঠে এলো মুখের উপর। ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। সত্যিই এখন আর এটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। কিন্তু বলো সিদ্ধান্ত কি ভুল হয়েছে? জনগণের কাছে না গিয়ে, জনগণকে না জড়িয়ে কতোদিন আর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা যাবে?
মামুন দেখেছিল এ ঘরে যে কাপেট পাতা আছে, তার নিজের ড্রয়িংরুমে পাতা কার্পেটটি যে তার চেয়ে খুব কম দামি তা নয়। মৃদু পা ঘষতে ঘষতে সে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, স্যার, আপনি আমার মত জানতে চেয়েছেন, আমার অনেস্ট অপিনিয়ন, তা জানাতে আমি বাধ্য। আমার উপর রুষ্ট হবেন না। জনগণের কাছে যেতে হবে কেন ক্ষমতা যখন জনগণের কাছ থেকে আসে নি?
কথা শুনে তার কপিশ চোখের তারা জুলে উঠল, জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস। সমস্ত ক্ষমতা সেখান থেকেই আসে বলে আমি বিশ্বাস করি ।
স্যার, এই মর্মে আপনার আজকের বক্তৃতা তৈরি করা হয়েছে। আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই। মুসাবিদা করার দায়িত্ব আপনি আমাকেই দিয়েছিলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে ক্ষমতা তো জনগণের কাছ থেকে আসে নি। জনগণ সেটা ভালো করেই জানে। ক্ষমতা এই মুহুর্তে কোথায় রয়েছে সে বিষয়ে জনগণের কোনো ভুল ধারণা আছে বলে আমার মনে হয় না।
সেনাবাহিনী কি জনগণের অংশ নয়?
স্যার, নিশ্চয়ই সেনাবাহিনী জনগণের অংশ, বিচ্ছিন্ন অংশ। মামুন জোরের সঙ্গে বলল, স্যার, আমি আবার বলছি আপনি আদেশ দিলেই তবে আমি আমার স্বাধীন মত বলব। আমার স্বাধীন মতও আপনার আদেশের অধীন।
তিনি বললেন, আমি ক্লান্ত, এই সব নিয়ে আমি সত্যিই ক্লান্ত। তবু তোমার কথা শুনতে চাই আমি। বাট আই অ্যাম নট প্রিপ্রেয়ার্ড টু লিসন টু এনি ননসেন্স নাউ। সেনাবাহিনী জনগণের বিচ্ছিন্ন অংশ কেন বলছ? তারা কি এদেশের লোক নয়, তাদের আত্মীয়স্বজন কি জনগণের ভিতর বসবাস করছে না? সেনাবাহিনীটা আসছে কোথা থেকে?
স্যার, এইসব কুট প্রশ্ন তোলার কোনো দরকারই নেই। আসল কথা হচ্ছে ক্ষমতাটা যিনি দখলে রেখেছেন তার শাসন জনগণ মেনে নেবে। বর্তমানে জনগণের অবস্থার হিসেব করে আমি এটা বলতে পারি। সেনাবাহিনী একটা সংঘবদ্ধ শক্তি—জনগণের সঙ্গে সেটা কখনো মিশ খায় না। আপনার সামনে আমি এই কথাটা বলেই ফেলতে চাই যে ফায়ার আর্মস এমনিতে ঠাণ্ডা হিম কিন্তু ইস্পাতে হাত পড়লে—
আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কি বলতে চাইছ। ঠোঁটের সঙ্গে লেগে থাকা তার মৃদু হাসিটা এতক্ষণ প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না, এখন যেন একটু উস্কে উঠল। মামুন থামল না, বদলাবদলির সময়টায় জনগণ স্পষ্ট করে বুঝে যায় যে তাদের কখনো কিছু করার নেই।
ক্রোধে কালো হয়ে উঠল তার মুখ, আমি বলেছি, তুমি কি বলতে চাইছ তা আমি বুঝতে পেরেছি। বলি নি? তবে এইবার বলো এভাবে ক্ষমতা কতোদিন আঁকড়ে থাকা যায়? আমি হুমদোমুখো লোভী পেট-মোটাদের সবাইকে চিনি—তাদের মগজের উপরেও চর্বি জমেছে। আমি জানি তুমিও একটি পাকা শয়তান, কিন্তু মগজটা এখনও তাজা আছে। ক্ষমতা এইভাবে চিরকাল আটকে রাখা যাবে? গণতন্ত্রের বন্যায় পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে দেখছ না! ইউ নো বেটার দ্যান মি, বাইরের সাহায্য না পেলে একটি দিন দেশ চালানো যায় না। মামুন জানে, তিনি এখন স্বগতোক্তি করছেন, সোচ্চার চিন্তা যাকে বলে, এইসব সময়ে সে একেবারে চুপ করে থাকবে, সে যে এখানে আছে এই সত্যিটাকে পর্যন্ত মুছে দেবার চেষ্টা করবে। হঠাৎ চোখ কুঁচকে তিনি তাকে দেখলেন, কোনো বিকল্প নেই, জনগণের কোনো বিকল্প নেই, জনগণের কাছে আমাকে যেতেই হবে। দেশের সমস্ত বড় বড় নেতাদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে সে তো তুমি জানোই । মামুন অত্যন্ত নিরীহভাবে মৃদু গলায় বলল, হ্যাঁ স্যার, তারা সবাই আপনার পক্ষে আছেন। তাদের ভাষায়, আপনার নেতৃত্বের সঙ্গে, আপনার নীতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।
আর আমি চেষ্টা করছি দেশের যুবশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে, যুবশক্তির উপর নির্ভর করতে ।
যুবশক্তিও বলছে আপনি যেখানে তারাও আছে সেখানে। সমস্ত দেশে এখন অন্য কোনো আওয়াজ নেই। স্যার, চান বা না চান আপনি এখন আর একা নন।
কথাটা শুনে তিনি মামুনের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন, আমি তোমাকে পছন্দ করি। হ্যাঁ, আমি পছন্দ করি তোমাকে । কিন্তু আমি বলছি তোমাকে, যেখান থেকে ক্ষমতায় উঠে এসেছি, সেখান থেকেই আমি জনগণের দিকে এগোবো। সমস্ত জাতি আমার পেছনে এসে দাঁড়াবে। আজ বিকেলেই তুমি দেখতে পাবে মোট তিয়াত্তরটা রাজনৈতিক দলের নেতা নিজের দল ভেঙে দিয়ে আমার নতুন দলে এসে যোগ দিচ্ছে।
স্যার, আমি জানি না আপনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন কি না আপনাকে এই কথাটা মনে করিয়ে দিতে যে, যে তিয়াত্তরটা দলের কথা আপনি এইমাত্র বললেন তার অর্ধেকগুলোরই সভাপতি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো লোক নেই—বাকিগুলোর কোনো নেতা আপনার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন জেল থেকে বেরিয়ে এসে, কেউবা—
আমি তোমাকে বলেছি আজ আমি তোমার কোনো বাজে কথা শুনব না।
অবশ্যই স্যার, কিন্তু এঁদের কাউকে কাউকে আপনি ক্ষমতায় এসেই অতিশয় দুনীতিপরায়ণ বদমাশ বলে জেলে পাঠিয়েছিলেন। -
মানুষ বদলায়, বদলে যায়—
আমার বক্তব্য তা নয় স্যার। এঁদের দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটা কিভাবে হিসেব করা যাবে তা নিয়ে মৃদু অস্বস্তি থেকে যাচ্ছে আমার মনে।
দাঁত-নখ খোয়া গেলেও বুড়ো বাঘকে তো তোমার বাঘই বলতে হবে।
এইরকম বুড়ো বাঘই নরখাদক হয়।
আহা, ওদের নিয়ে আমি কি করছিটা কি? কিছুই করছি না। খাঁচায় থাকবে। আমি ডিপেন্ড করছি যুবশক্তির ওপর। দশ বছর পরে দেশ তো ওদের হাতেই যাবে।
জনগণ যুবশক্তি প্রৌঢ়শক্তি যা-ই বলা যাক না স্যার, ক্ষমতা ভাগ হয় না, ক্ষমতা এক, অবিভাজ্য, ইংরেজ দার্শনিক হবস যা শিখিয়ে গেছেন।
হ্যা, হ্যা, আই. এ. পড়বার সময় পড়েছিলাম বটে, হবেস্।
হবস্।
হ্যা হ্যা, হবেস।
হবস্।
মামুন ভাবতে গিয়ে দেখল এ তো প্রায় তাঁর সঙ্গে এক কলকেয় দম মারার মতো ব্যাপার। এদেশের দ্বিতীয় কোনো আমলা কি এই দুর্লভ সৌভাগ্যের কথা কল্পনাতেও আনতে পারবে? বিকেলে যখন তিনি হেঁটে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছিলেন—সেই বেঁটেখাটো মানুষটি, পরনে সাদাসিধে পোশাক, দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছেন, তখন তাঁর দিকে চেয়ে মামুন সকালের ইয়ার্কি আর রসালাপের পাকা একটি ঘণ্টা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না। সুদূর ঐ ব্যক্তিটি, ক্ষমতার শীর্ষে অতিলৌকিক এক মহিমায় আপাদমস্তক ঢাকা । তাঁর দিকে চেয়ে দেখতে পর্যন্ত সাহস হয় না। অথচ মোহগ্রস্তের মতো তাঁর দিকেই চেয়ে রইল সে। কিছুমাত্র অসাধারণত্ব নেই তাঁর। গায়ের রং বেশ কালো, একটা কাধ একটু উচু, পা দুটি মাটিতে পড়ছে একটু তেরছাভাবে, হাঁটাতে কি রকম একটা খিচাং খিচাং ভাব । মাঝে মাঝে হাস্যকরভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে যেন জামাটা ঠিকমতো ঘাড়ে বসিয়ে নিচ্ছেন। হাসিমুখে এগিয়ে এসেছেন মামুন রশীদের দিকে। সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে অগণিত যুবশক্তি; গায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে লোম-উঠা শেয়ালের মতো কয়েকজন নেতা। যুবশক্তি বেশ ছড়িয়ে পড়ল। মামুন দেখল গলায় চেন, হাতে ব্যান্ড-বাধা অসংখ্য তরুণদের একজনকেও সে চেনে না। পুলিশ দেহরক্ষী সবই রয়েছে কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটার দায়িত্ব যেন ওরাই নিয়েছে। প্রচণ্ড চিৎকার চলছে তিনি সম্বন্ধে, তুমি আছ যেখানে আমরা আছি সেখানে।
হাসিমুখেই তিনি এগিয়ে এলেন মামুন রশীদের দিকে কিন্তু তাকে চিনতে পারলেন না। সোজা এগিয়ে গিয়ে উঠলেন মঞ্চে । তারপর পাচ মিনিট ধরে একটানা গগনবিদারী চিৎকার, পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা, – তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে, দালালেরা হুশিয়ার, সাবধান।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেবদূতের মতো দু হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে নির্দেশ দিলেন। পাঁচ হাজার মানুষের প্যান্ডেলে এতটুকু জায়গা নেই। একটা আশ্চর্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো। মামুন শায়েলার পাশেই বসেছিল। সাদা রাজহাঁসের মতো গলা তুলে শায়েলা মঞ্চের দিকে চেয়ে আছে। কি অসম্ভব স্নিগ্ধ তার চোখের দৃষ্টি বেশ মনে পড়ে, মামুনের মুহুর্তের জন্যে মনে হয়েছিল তার এই সৌন্দর্য অপার্থিব—মুহুর্তের জন্যে সে নত হয়েছিল স্ত্রীর কাছে। তারপরেই তার বক্তৃতা শুরু হলো, নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল, বক্তৃতার টুকরো-টাকরা নিয়ে বাতাস গাঁ-গাঁ শব্দে ছোটাছুটি শুরু কাপতে থাকল। বক্তৃতা এগিয়ে চলল—তাই আমি এসেছি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, মানুষকে ভালোবাসতে, মানুষের ভালোবাসা নিতে। আজ মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের কাজে নেমে পড়তে হবে। আর বসে থাকার সময় নেই, আর রাজনীতির সময় নেই। এবারের রাজনীতি উৎপাদনের রাজনীতি, এবারের রাজনীতি রপ্তানির রাজনীতি, এবারের রাজনীতি দুখী মানুষের রাজনীতি ...
তিনি যখন চলে গেলেন তখন অন্ধকার নেমে গেছে। সামান্য শীত শীত করছে, পাশের পার্কের ঝোপগুলোতে সন্ধ্যের অন্ধকার গুড়ি মেরে ঢুকে পড়েছে।
সমস্ত আলো একসঙ্গে জ্বলে উঠল। মামুন রশীদ খুশি হলেন আলোর ব্যবস্থা দেখে । এইরকমই নির্দেশ ছিল তার। প্যান্ডেল আলোয় ঝকঝক করছে। কি চমৎকার সুশৃঙ্খল পরিবেশ। শুধু এই বক্তৃতাগুলো! তিনি নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেবার পর থেকেই এই বক্তৃতার তাণ্ডব শুরু হয়েছে। কারও সাহায্য না নিয়ে মামুন নিজের হাতেই মানুষ খুন করে ফেলতে পারে মাত্র একটি অপরাধে। এই বক্তৃতা। মানুষ যদি বক্তৃতা করতে না পারত। মামুন যখন এই কথাগুলো ভাবছিল ঠিক তখন, তিনি চলে যাবার আধঘণ্টা পরে, হ্যা, সে তখন ঘড়ি দেখেছিল, সমস্ত আলো এক সাথে নিভল ।
কি করে এমন হওয়া সম্ভব? ভীষণ অবাক হয়ে মামুন পেছন ফিরে দেখতে পেল অত বড় প্যান্ডেল, অত লোকজন সম্পূর্ণ গিলে নিয়েছে অন্ধকার। ঠিক তখুনি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ এলো কয়েকটা। এত আচমকা, এত প্রচণ্ড সেই শব্দ যে মামুনের বুকের ভিতরে কয়েকটা ধস নেমে গেল পরপর আর নিঃশ্বাসটা যেন আটকে গেল গলার কাছে। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো কানফাটা স্লোগান–পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা। মঞ্চের দিক থেকে ছুটে এলো কয়েকজন, পেছন থেকে ছুটে গেল একটা দঙ্গল মঞ্চের দিকে। তারপর অন্ধকার চোখে সয়ে এলো খানিকটা, পাঁচ হাজার মানুষ একসঙ্গে উঠে চারদিকে দৌডুচ্ছে, বিকট চিৎকার করছে, হারারারা শব্দে কারা বিকট হেসে উঠল একবার আর তারপরেই কি তীব্র একটা টর্চের আলো এসে পড়ল শায়েলার মুখের উপর। এই যে রে এইখানে এ্যাত্তোবড় পালান নিয়ে সিন্ধি গাইটা বসে আছে—এই কথাগুলো কানে এলো মামুনের আর সে দেখতে পেল একটা হাত শায়েলার কাধের কাছে শাড়ি আর ব্লাউজ বাঘ-থাবায় চেপে ধরে মুহুর্তের মধ্যে চেয়ার থেকে তাকে তুলে ফেলল। মিথ্যে নয় যে সে বাধা দেবার জন্য শায়েলার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কিন্তু আবছা আঁধারে কিছু দেখা যায় নি, ছায়াগুলো বাস্তব না অবাস্তব তা বিচার করার সময় পাওয়া যায় নি, কার হাতে অস্ত্র আছে তা আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না এবং ঠিক তখুনি শায়েলা আর তার মাঝখানে এক মূর্তিমান যুবশক্তি এসে মামুনের কাধে হিংস্র ধাতব একটি রদ্দা মেরে বলল, আবে আমলার বাচ্চা, বাড়িত যা, খানিক বাদে আইস্যা নিয়া যাস, এক আধটা ফ্রি সার্ভিস দিলে কি হইব—পইচা যাইব তর বউ? রদ্দা খেয়ে যেটুকু দেখতে পাচ্ছিল মামুন সেটুকুও পুরোপুরি আঁধারে লেপে গেল। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল তার। সত্যিই মামুন শায়েলাকে দেখতে পায় নি আর ।
যে স্বচ্ছ, আয়ত, ঈষৎ ক্লান্ত চোখ দুটির দৃষ্টি এতক্ষণ পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছিল এবার তা নিবদ্ধ হয়েছে মামুনের মুখের উপর। কি দেখতে চাইছে শায়েলা? আলো নিভে গেল, মামুন তার পাশেই বসেছিল, এই সময় পাচটা ইস্পাতের আঙুল তার কাধের মাংসের মধ্যে বসে গেল, বলতে গেলে হাড়ের ভিতর দিয়ে গেথে গেল। তারপর যেন উড়িয়ে নিয়ে চলল তাকে । অন্ধকারের মধ্যে মামুনকে সত্যিই আর দেখতে পাওয়া যায় নি। দু হাত বাড়িয়ে শায়েলা যতবার কিছু একটা ধরতে যায় ততবারই তার কাধে গেথে-যাওয়া হাতটাকেই আঁকড়ে ধরে। বার দুয়েক সে বলতে চেষ্টা করে, কে, কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছ, কেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছ, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তখন দুটি হাত তাকে জড়িয়ে প্রায় পিষে ফেলল। মাটি থেকে উঠে গেল তার দুটি পা—অতি কঠিন একটি হাত নির্মমভাবে নিংড়ে দিল তার একটি বুক আর তার মুখের উপরে ঝুঁকে এলো একটি খোঁচা খোঁচা দাড়িভরা দুৰ্গন্ধযুক্ত মুখ–আবছা অন্ধকারে সেই মুখের বড় বড় কয়েকটি সাদা দাত দেখা গিয়েছিল, তাদের ভিতর দিয়ে গরম বাতাসের একটি হলকা বেরিয়ে এলো, চুপ মাগি, গলা টিইপ্যা শ্যাষ কইরা দিমু, সতীপনা রাইখ্যা দে। অবশ হয়ে এলো শায়েলার শরীর। মুখে মুরগি নিয়ে শেয়াল যেমন ঝোপের আড়ালে যায় ঠিক তেমনি করেই সাততলা বাড়ীর পুবদিকের দেয়াল ঘেঁষে অন্ধকার ঝোপের তলায় তাকে নিয়ে ঢুকে গেল লোকটা। একমাত্র তখুনি শায়েলা স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছিল কি ঘটতে যাচ্ছে, তীব্র গলায় সে বলে উঠেছিল, পুলিশ তোমাকে কুকুরের মতো গুলি করে মারবে ।
পুলিশের বাপে পাহারা দিত্যাছে য্যানো ইদিগে কেউ না আসে। আমরা যুবশক্তি, আজ নতুন পার্টি হইয়া গ্যাছে—মনের সুখ কই রাখি, উম ম ম-—
পিঠের নিচে ভাঙা ক্যানেস্তারা, কাচের টুকরো, ইটের খোয়া, সিমেন্ট আর বালির বড় বড় চাঙর—উপরে অন্ধকার আকাশ আর আকাশে উজ্জ্বল কালপুরুষ—ঠিক এই সময় মুহুর্তের জন্যে আলোর তরঙ্গ এসেছিল, সব আলো একবার জ্বলে উঠেছিল। তখন সেই আলোর বন্যার মধ্যে দশ হাত দূরে যে মানুষটি দাড়িয়েছিল, যাকে একবার মাত্র দেখা গিয়েছিল, আলোর তরঙ্গ ফিরে গেলে যে তার সঙ্গে ভেসে গিয়েছিল, সে কে? সে কি মামুন রশীদ? এই একটি সত্য জানার পরেই তাকে মরে যেতে হবে বা বাচার কথা আবার ভেবে দেখতে হবে । কেউ কি শায়েলাকে বলে দেবে সে কে? কেউ কি শায়েলাকে বলে দেবে সে কে? যে তাকে বলতে পারে কে ছিল সেই মানুষ, তার হাতে তার জীবনটা বেঁটাসুদ্ধ ছিড়ে এনে এক্ষুনি দিতে পারে শায়েলা ।
ভুরু কুঁচকে, সাপের মতো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে, গলার দু’পাশের রগ ফুলিয়ে কদর্য একটা ভঙ্গিতে শায়েলা প্রাণপণে চেয়ে রইল মামুনের দুচোখের দিকে।
পনেরো সেকেন্ডের জন্যে একবার আলো জ্বলে উঠেছিল এটা মামুন অবশ্যই বলতে পারে। কিন্তু সে কি হামাগুড়ি-দিয়ে-বসা কুকুরের মাংস খাওয়ার কোনো দৃশ্য দেখেছিল? কোনো উন্মোচিত নাভি? নাঃ, সে সত্যিই বলতে পারে না। জীবনে একটি বা দুটি সত্যের সামনে দাড়ানোর সাধ্য কারও নেই। তাছাড়া একটু পরেই তো সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।
0 মন্তব্যসমূহ