কাঁকন ছেলেটা বেড়াতে বেরুল। শুকনো মুখে খালি পায়ে বেরিয়ে এলো। মা বলল না, কাঁকন কোথায় যাস? ওকেও বলতে হলো না, কোথাও না, এমনি। কাঁকন জানে মা কিছুই জিগগেস করবে না, কারণ ডাক্তার এসেছিল, বলে গেছে, দাদু মারা যাবে আজ। না হয় কাল। না হয় পরশু। কিন্তু মারা যাবেই। তাই মা জানে দাদু মারা যাচ্ছে। কাঁকনও জানে। এখন ভীষণ শীত পড়ে গেছে। গরম কাপড়চোপড় বের করতে হয়েছে। লেপ রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। এই শীতে ঠাণ্ডায় দাদুর মরতে কষ্ট হবে। দাদু বোধহয় রোদে মরতে চাইবে । মাকে বলবে, আমি রোদে মরব।
শীতে গাছের পাতাগুলোকে বিশ্রী দেখাচ্ছে, পথের ওপর ছায়া ভয়ানক ঠাণ্ডা আর ঘাসের ভেতর রাস্তার রং দুধের মত শাদা । ঘাস এখনও হলদে হয় নি—হবে হবে করছে। এই সব আধ-মরা ঘাসের ওপর শিশির আধাআধি শুকিয়েছে এতটা বেলা হয়েছে। রোদ কেবল এই সময়টায় একবার চড়াৎ করে উঠেছে, খেজুর গাছে ঘুঘু ডাকছে, অমনি মন কেমন করে উঠলো কাঁকনের। সব মরে যাচ্ছে গো–কাঁকন এই কথাটা শোনাবার মত লোক খুঁজে পেল না। দ্যাখো না, পাতা মরে যাচ্ছে, ঘাস মরে যাচ্ছে, বাগানগুলো ফাঁক ফাঁক, ফ্যাকাশে হলদে হলদে ভিজে ভিজে। মরে যাচ্ছে আর কি দাদুও মরে যাচ্ছে এই সঙ্গে। এদের সকলের সঙ্গে একবার আলাপ করে নেওয়া দরকার। ঘাস, পাতা, আকাশ ইত্যাদির সঙ্গে। বাতাসের মধ্যে খালি গায়ে কাঁপতে কাঁপতে কাঁকন বেরিয়ে এলো। প্যান্টটা কষে এটে পরল। পাছায় হাত ঘষে সর্দি মুছল। পকেটের মার্বেলগুলো গুনলো একবার, আপন মনে বলল, শালারা জিতে নিয়েছে দশটা। হেরে যাওয়ার স্মৃতিটা আসতেই লোকসানের কথা ভেবে পথের মাঝখানে বিমর্ষ হয়ে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু মার্বেলের শোক ভুলল সঙ্গে সঙ্গেই, কি ছাই মার্বেল, দাদু মরে যাচ্ছে সে কথাটা ভাবা নেই—কি যে তোমার মার্বেল হয়েছে কাঁকন? মা যা বলে সেটাই নিজের করে নিয়ে কাঁকন ভাবলো আর ভারিক্কি চালে দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল, এখন বাইরে যাচ্ছি, মা কিন্তু বলছে না, তোমাকে স্কুলে যেতে হবে না? কাঁকন, স্কুলে যাবে না তুমি? মা বলবেই-বা কেন? স্কুলে যেতে তো হবেই না। আজ কাল পরশু। আজ কাল পরশুর মধ্যে দাদু মারা যাচ্ছে। মরব মরব করে দাদু যতদিন না মরছে স্কুলে যেতে হবে না। কেউ মরলে কি স্কুলে যাওয়া চলে? ছি, লোকে কি বলবে? অবশ্য মার্বেল খেলাও উচিত না। যে মরছে তার কাছে থাকা উচিত। এই কথা মনে হতেই কাঁকন আর একটুও দাঁড়ায় না। হন হন করে হাঁটতে শুরু করে। পায়ের নিচে মাটি ভিজে ঠাণ্ডা। বরফের মত শক্ত আর ঠাণ্ডা করকর। মরা লতাপাতা জঙ্গল পেছনে সরে যায়, শুকনো পাতা সামনে উড়ে এসে পড়ে, খালে জমা অবশিষ্ট একটুখানি চকচকে কালো পানি কাতর চোখে কাঁকনের পেছন দিকে চেয়ে থাকে। ফাঁকা চষা জমিটায় হোচট খেয়ে পায়ের আঙুলের মাথা ছিড়ে রক্ত পড়ে। কাঁকন হাঁপায়। দাদুর ঘর কি ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আর একদম চুপ। চেয়ার টেবিল জানলা কপাট খাট বিছানা পানির জগ দাদু, সব চুপ। আর আমাদের ঘর দেখুন না–অদৃশ্য শ্রোতাকে কাঁকন বুঝোয়—আমাদের ঘর হচ্ছে নোংরা, আমি সেখানে পড়ি, কাগজ ছিড়ি, ফেলি, নোংরা আমাদের ঘর। বাতাস ঢোকে আর জানলা খট খট করে ওঠে। যাচ্ছেতাই নোংরা আমাদের ঘর। মা আর আমি ঘুমোই সেই ঘরে । আমি চেঁচাই। মা বকে, কাঁকন চেঁচিও না। মায়ের মুখভঙ্গি নকল করে কাঁকন বলে, চেঁচিও না। আমাদের ঘরে খালি মা-টাই চুপ আর সব ঠিক আছে।
দাদুর ঘরটা অবিশ্যি সবচাইতে ভালো। বাড়ির মাঝখানে ঘরটা। দরজা জানলায় পরদা দেওয়া আছে। অন্য কোন ঘরে নেই। খাটের ওপর ধপধপে বিছানা, টেবিলে শাদা চাদর পাতা। চেয়ারে তুলোর গদি। টেবিলের ওপর পানির জগ, গ্লাশ, ওষুধের শিশি । একটা শুকনো পাতা এসে পড়লেও মা হাতে করে তুলে বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। তিনবার করে ঘরটা ঝাড়া হয় আর কী ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ঘষা মেঝেটা আয়নার মত চকচকে করে। দাদু সেই কবে থেকে পড়ে আছে, বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারে না। কেউ ঘরে ঢুকলে দাদু খ্যাপার মত চেঁচায়। বাজারের জটাই পাগলের মত। বেশি রেগে গেলে বালিশে মাথা ঠোকে । বুড়োটা আচ্ছা চেঁচাতে পারে। খালি ঘ্যান ঘ্যান করে আর চেঁচায়—খেতে দে–খেতে দে–খিদে লেগেছে। বিরক্ত করে মারল আমার মা-টাকে। কাঁকন একটা গাছকে শুনিয়ে বলল। ওর দাদু লোকটা প্যারালিসিসে পড়ে আছে। মেজাজটা তিরিক্ষে থাকে এজেন্যেই। বুড়োর বেশি দোষ নেই। মরতে এত দেরি কারই-বা সহ্য হয়? বুড়ো ভাবে, যতদিন না মরা যাচ্ছে, দিনে চারবার খেতে হবে, মলমূত্র ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কাঁকন তাকে বিনা কারণে ভ্যাঙালো।
কাঁকন ঘরে ঢুকলে তো বুড়ো খুশি হয়। বলে, এই যে ভাই—কি খবর?
হয়ত কাঁকন বলল, স্কুল থেকে এলাম।
তা আয়, বোস আমার কাছে।
আমি হাত মুখ ধুই নি এখনও ।
তা হোক বোস ।
বাঃ, আমি বুঝি কিছু খাব না?
যা তাহলে, বেরো।
তখন কাঁকন হয়ত বসল।
ঘরে কেউ আছে কি না দেখে নিয়ে ফিশফিশ করে দাদু বলল, আজ কি দিয়ে ভাত খেয়ে স্কুলে গেলি বলতো?
ইলিশ মাছ ভাজা, ডাল আর আলুর তরকারি দিয়ে। কাকন উৎসাহের সঙ্গে বলে, বুঝলে দাদু—তরকারিটা এত ভালো হয়েছিল না!
ভাই, আমাকে দুটো ইলিশ মাছ এনে দিবি। চুপি চুপি রান্নাঘর থেকে এনে দে।
মা দেখলে পিটিয়ে আমার ছাল তুলবে।
তোর মা দেখতে পাবে না—যা ।
আমি পারব না দাদু।
যা না ভাই—লক্ষ্মী—ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার ।
দাদু তুমি কি? ছেলেমানুষের মত কেবল খাওয়ার বায়না! ওতো আমরা করবো। তা আমি কোনদিন করি না। মা যা দেয় তাই খাই। কেন, দুপুরে তুমি খাও নি? মা দেয় নি খেতে? অত খাই খাই কর কেন? উঠতে পারলে তুমি ঠিক হাড়ি খেতে দাদু।
দাদু কথা কানে তোলে না, দুটো ইলিশ ভাজা এনে দে দাদু—তোকে একটা দেব। কাঁকন মুখ গম্ভীর করে বলে, ও! আবার লোভ দেখানো হচ্ছে? তুমি যাচ্ছেতাই হয়ে গেছ। খেলার সাথীদের কাছ থেকে শেখা কথাটা বলে কাঁকন, এবার তুমি টেঁসে যাও দাদু।
এইবার চটে বুড়ো, তাইতো তোরা চাস—তোর মা রাক্ষসী তাই চায় বলেই তো খেতে দেয় না |
এখন যেই মা ঘরে ঢুকে বলল, কি বলছেন, দাদু ভিজে বেড়াল হয়ে গিয়ে বলল, এই কাঁকনমণির সঙ্গে একটু গল্প করছিলাম আর কি?
দাদুটা এত পারে—ন্যাকা–কাঁকন নাক সিটকোয় ।
ফাটা আঙুলটায় হাত বুলোতে বুলোতে আর একটা হাত গালে রেখে কাঁকন ভাবতে লাগল, কিন্তু দ্যাখো, সেই দাদু আজ মরে যাচ্ছে। হয় আজ, না হয় কাল, না হয় পরশু। মতি ডাক্তার এসে বলে গেল। দাদু না মরা পর্যন্ত আমাকে আর স্কুলেও যেতে হচ্ছে না। আহা রে—দাদুটা মরে যাচ্ছে—লতাপাতা, ঘাস, আকাশ সব কি রকম করে মরে যাচ্ছে দাদু আমার লোক খুব ভালো। মায়া লাগে বুড়োর জন্যে। আমি বড়ো হতে হতে দাদু বেঁচে থাকলে দাদুকে রাজা করে দিতাম। কাঁকনের হাসি পেল, দাদু সেদিন দুপুরবেলায় আমাকে ডেকে চুপি চুপি বলল কিনা—কাঁকন আজকাল বাজারে যাস না?
কেন দাদু?
বালিহাঁস বিক্রি হচ্ছে না বাজারে? আনিস তো ভাই একটা! বলেই দাদু কেমন ঝিমুতে লাগল।
দাদু মাত্তর একটা বালিহাঁস চায়। কি ওড়ে বালিহাঁসগুলো! শোঁ-শোঁ করে শব্দ হয়। কাঁকন আকাশের দিকে চাইল। ম্যাটমেটে রং আকাশটার। একটুও ভালো লাগে না। হাঁসগুলো ঐ আকাশ দিয়ে উড়ে আসে—কোথা থেকে কে জানে! কেমন হু-হু করে উড়ে আসে। আমি যদি উড়তে পারতাম ওদের মত! কি মজাই না হতো। এক একদিন আমার কি খারাপ লাগে! দাদু মুখ গুজে শুয়ে থাকে—মা কথা বলে না। আমার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। আর না হয় মরে যেতে । কবে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল কাঁকন সেই কথা মনে করার চেষ্টা করল। পনেরটা মার্বেল হেরে খেপে গিয়ে একদিন ন্যাজা বলল, ভারি তেজ দেখি যে! তোর বাপ কোথা জানিস?
মা যেমন বলেছিল তেমনি জবাব দিল কাঁকন, ঢাকায়।
এঃ ঢাকায়! ঢাকায় তো আসে না কেন শুনি?
গর্বের সঙ্গে কাঁকন বলে, আসবে।
তোর বাপকে আর আসতে হচ্ছে না।
কেন?
লোকে ধরে ঠ্যাঙাবে।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁকন, কেন?
তোর বাবা একটা মাগিকে নিয়ে ভেগেছে।
মাগি কি?
মাগি জানিস না? আরে ছ্যা ছ্যা—মাগি জানিস না? এবার আর একা ন্যাজা নয়, সবাই ওকে ঘিরে ধরে হাসল, ভ্যাংচাল, চিমটি কাটল, ছোড়া মাগি জানে না—হো হো!
ওদের সঙ্গে খুনোখুনি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মাকে খুঁজল কাঁকন। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। হাত মুখ না ধুয়েই পড়তে বসল কাঁকন। একটা অক্ষরও পড়তে পারল না, বই খুলে ঘরের ছায়ার দিকে চেয়ে রইল। তারপর ঢুলতে শুরু করল। মা খেতে ডাকলে গেল না। রাত একটু বেশি হলে সব কাজ শেষ করে মা ঘরে এসে শুয়ে পড়তে যাবে, কাঁকন জিগগেস করল, মা, আব্বা কোথায়?
ঢাকায় ।
আসে না কেন?
আসবে। শুয়ে পড়ো কাঁকন। কিছু খেলে না কেন?
আব্বা একটা মাগির সঙ্গে চলে গেছে?
মা একটু থমকালো, কে বলল?
ঐ ছেলেরা।
নিরুত্তাপ কণ্ঠে মা জবাব দেয়, হ্যাঁ।
মাগি কি?
প্রচণ্ড একটা চড় কষে ওর মা ফেটে পড়ে, রাত দুপুরে শয়তানি। পাজি কোথাকার। হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি তোমার। মাগি কাকে বলে জানিস না—আমি একটা মাগি ।
পাশের ঘর থেকে দাদু বলে, কি হলো?
কাঁকনের মা রাগে ফুলতে ফুলতে ছুটে যায় ও ঘরে। দড়াম করে দরজা খুলে বলে, খবরদার, একটা কথা নয়, একদম চুপ। কুচুটে বুড়ো, কিছু জানে না!
অ, আচ্ছা—দাদু আর কথা বলে না। ঘুমোয়, না জেগে থাকে কে জানে? মা ফিরে আসে, দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে দেয়। তারপর শুয়ে পড়ে। অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে কাঁকনের ইচ্ছে হয় মরে যেতে। মাগি খুব খারাপ কথা, ছিছি করার মত কথা? নাকি খারাপ জিনিশ? কেমন জিনিশ? জিনিশটা ঠিক কি রকম জানবার ইচ্ছা নিয়ে কাঁকনের মরে যেতে মন করে।
সেই একবার। আরও একেবার মরতে ইচ্ছে হয়েছিল। এইতো কদিন আগে । কাঁকন মনে করল ঘটনাটা। স্কুল থেকে দুপুরে হঠাৎ বাড়ি চলে এলো। খুব রোদ ছিল। গাছপালা পুড়ছিল। মাটি পুড়ছিল। এই সব পোড়ার পটপট শব্দ হচ্ছিল। কাঁকন গন্ধ পাচ্ছিল। এই সব পুড়ছিলো আর ঝিমুচ্ছিল । ওদের বাড়িটাও রোদে থিরথির করে কাঁপছিল। দাদুর ঘরে কেবল ঠাণ্ডা ছায়া, ওষুধের মিষ্টি একটা গন্ধ, টেবিলে পানির জগ, গ্লাশ। দাদু ছায়ায় শুয়ে। কাঁকনের ইচ্ছে হল একবার দাদুর ঘরে যেতে। দাদু হা করে ঘুমোচ্ছে। কলতলায় একটা কাক খানিকটা রোদ আর খানিকটা ছায়ায় থেকে একটা হাড় আছড়াচ্ছে। হঠাৎ হাড় ছেড়ে লাফিয়ে একটা মরা ইদুর তুলে নিয়ে এলো, উড়ে গেল, সজনে গাছে বসল। একটা শাদা লম্বা ঠ্যাং ফড়িং ঘাসে তিরিং করে লাফ দিল । কাঁকন নিজেদের ঘরে এলো, ঘরের ছায়ায় বিছানায় ফরশা একটা মানুষ শুয়ে, মায়ের কোলে তার মাথা, মা ওর চুলের ভেতর আঙুল চালাচ্ছে, তারপর মা তার মাথা নামিয়ে আনে, কাকটা চিৎকার করে ওঠে কা কা করে, কাঁকন ফিরে দেখে, ইদুরটা রেখেছে কার্নিশে, আবার তুলে নিল ঠোঁটে ।
মা বিষণ্ন চোখে কাঁকনকে দেখল, বলল, আয়।
লোকটা উঠে দাড়াল, চুল ঠিক করল, একটা হাইও তুলল, মা বলল, আমার ছেলে কাঁকন ।
আচ্ছা—কাঁকনের থুতনিতে একটা টোকা দিয়ে মায়ের দিকে ফিরে লোকটা বলল, চলি । তারপর চটপট রোদের রাস্তায় বেরিয়ে গেল। রোদে-পোড়া ঘাসের গন্ধ ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল আর পটপট শব্দ হলো। কাকটার পাত্তা নেই, তার বদলে সজনে গাছে সবুজ রঙের একটা পাখি লেজ নাচাচ্ছে, কলতলায় এঁটো বাসনকোশনের ডাই পড়ে আছে। সে দিকে চেয়ে মা বলল, কাঁকন কাউকে কিছু বলবে না।
লোকটা কে?
কাউকে কিছু বলবে না তুমি।
রাগে কাঁকন চোখে কিছু দেখতে পেল না। মায়ের মুখটা কলতলার দিকে ফেরানো ।
সে বলল, বলব।
না, বলবে না।
হ্যা, বলব, সবাইকে বলব।
কাঁকন ।
হ্যা বলব, সবাইকে বলব—রাগ নয়, চোখের পানিতে এখন কাঁকন কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, বলব, যাকে খুশি তাকে বলব—জবাই করা মুরগির মত সে আছাড় খেল, লাফাল, ধেই ধেই করে নাচল, বলব, বলব, সবাইকে বলব।
মা চুপ করে চেয়ে চেয়ে দেখল ওকে, দেখতে দেখতে রোদ ঝিমিয়ে এলো, কাঁকন ঘুমিয়ে পড়ল । পড়ন্ত রোদে অনেকগুলো কাক কলতলায় জমে চেঁচাতে শুরু করল। কাঁকন সেদিন ঘুম থেকে উঠেছিল সন্ধ্যাবেলায়। চোখ কচলে তার মনে হলো সকাল হয়েছে আর মনে হলো মরে গেলে বেশ হয়। নিজেকে শুনিয়ে সে বলল, কাঁকন তুমি মরে যাও । মায়ের সঙ্গে লোকটাকে দেখে তার কেন যে মরে যেতে ইচ্ছে করল কে জানে? লোকটা কি খুব খারাপ? কয়েকবার দেখেছে তাকে, পাকা রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে মোটর সাইকেলে যায় ঝকঝক করে। একবার এসেছিল দাদুকে দেখতে। খুব খারাপ নাকি লোকটা? কিন্তু মায়ের সঙ্গে লোকটা ঐভাবে থাকলে কাঁকনের মনে হয়, তার, না হয় তার মা-র মরে যাওয়া উচিত।
এই নিয়ে কাঁকন যখন গালে হাত দিয়ে ভাবছিল, ওর পকেট থেকে একটা মার্বেল গড়িয়ে পড়ল। চমকে উঠে দাড়ায় কাঁকন। মনটা তখন ওর ভারি খারাপ। বোকার মত সে গড়িয়ে চলা মার্বেলটার দিকে চেয়ে দেখল। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে মায়ের সকালবেলার কথা মনে পড়ল, কাঁকন আজ বিকেলে বাড়িতে থাকবে।
কেন?
না, বাড়ির বাইরে যাবে না বিকেলে ।
তখুনি বুঝতে পারল কাঁকন, দাদুর কথা বলছে মা ।
ডাক্তার যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিল আমি শুনেছি জানো?
বেশ করেছ। বাইরে যেও না, আর—মায়ের গলা একটু কাপল—কাঁকন মায়ের দিকে চেয়ে, আর—বিকেলে তোমার আব্বা আসবেন।
সত্যি? কখন?
বললাম তো বিকেলে ।
ভারি মজা হবে।
বাড়িতে থেকো আজ। মা আর কথা বাড়াল না।
সকালবেলার কথা মনে পড়ে এখন কাঁকনের মন কিন্তু আরও মুষড়ে পড়ল। মজা হবে না ছাই। সেই লোকটা আর আসে না। কিন্তু পড়তে পড়তে হঠাৎ হয়ত কাঁকনের মনে হলো লোকটা এসে পেছনে দাড়িয়েছে। ওর মনে হয়, লোকটা সব সময় ঘরে রয়েছে, আর মায়ের কোলে তার মাথা । মায়ের কোলে কতদিন যাই না—ছি, বড় হলে আবার কেউ মায়ের কোলে যায় নাকি। কিন্তু মা তো ইচ্ছে করলে কোলে টানতে পারে—আমি নাইবা গেলাম! মা টানে না। আব্বা কোন ঘরে থাকবে? আর সেই মাগি কথাটা পরে জেনেছে একটা যাচ্ছেতাই। মা বলল কথাটা সত্যি। তাহলে মায়ের ছেলে কাঁকন তোমার আব্বার মুখ দেখা উচিত কি? পাকা ঝুনো ছেলে কাঁকন ঝাকি দিয়ে চুল সরালো কপাল থেকে ।
একটা শব্দ হলো শোঁ-শোঁ করে মাথার ওপর । কাঁকন রোদ থেকে চোখ আড়াল করে আকাশের দিকে চেয়ে দেখল। বালিহাঁসের বিরাট একটা দল উড়ে যাচ্ছে। ওদের পা পেছনে ফেরানো, গলা এগিয়ে দেওয়া সামনের দিকে। রোদে ঝলকাচ্ছে ওদের কালচে ডানা, গলার কাছে ফিকে নস্যি রং যেন সোনালি। হঠাৎ সা করে ঘুরে একটা বড় ত্রিভুজের আকার নিয়ে দলটা বিলের দিকে ফিরল।
সব কষ্ট দুঃখ ভুলে কাঁকন হাততালি দিয়ে বলল, এতদিন কোথা ছিলি তোরা। একটা নেমে আয় না! ভয় নেই। দাদু একটা খেতে চেয়েছিল—তা দাদু আজ না হয় কাল, না হয় পরশু মরে যাচ্ছে, খেতে পারবে না। পুষব আয় ।
হাঁসগুলো আমন্ত্রণে কান দেয় না। রেলগাড়ির মত হু-হু করে বাতাস কেটে বিলের দিকে এগোয়। মার্বেলটা কুড়িয়ে পকেটে পুরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করল কাঁকন। তারপর পাছায় সর্দি মুছে দৌড়ুল চষা জমির ছোট মাঠ, আগাছার পড়ো জমি, বুক পর্যন্ত উচু আধমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। ভাঙা দালানবাড়ির ভিটে থেকে একটা ঘুঘু আড়চোখে কাঁকনের মারমূর্তি দেখে নিয়ে পিরিং করে ডানার শব্দ তুলে উড়ে গেল। ঝোপের পাশে একটা শেয়াল বিশ্রাম নিচ্ছিল চোখ বন্ধ করে। কাঁকন হুড়মুড় করে প্রায় তার ওপরে পড়ল। ভীষণ বিরক্ত হয়ে শেয়ালটা সরে গেল। কাঁকন অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে থাকল একটুক্ষণ। তারপরেই আবার ছুটতে শুরু করল।
এখন হাঁসগুলোকে আর দেখা যায় না। রোদটাও মিইয়ে লালচে হয়ে এসেছে। কাঁকন সামনে রেল লাইন দেখতে পেল। পেছনে ঝাপসা মাঠ আর রেল লাইনের ওপারে বিরাট বিলটা । এত বড় বিল যে ভয় পেল কাঁকন । এর মধ্যে কোথায় হাঁসগুলো বসেছে দেখতে পেল না সে! এতদূর দৌড়ে এসে ক্লান্ত অবসন্ন কাঁকন রেল লাইনের নিচে জমির আলে বসে পড়ে। কোন দিকে ওদের বাড়ি বুঝতে পারে না। আর হাঁসগুলোকে দেখতে না পেয়ে দুঃখে কষ্টে ও আবার ভেঙে পড়ে। ভারি দুঃখী হয়ে যায় কাঁকন। সেই মরে যাওয়ার ইচ্ছাটা ফিরে আসে । আহা রে যদি মরে যেতাম—কত ভালো হতো—হয়ত হাঁসগুলোর মত উড়তে পারতাম। তার বদলে দাদুটা মরে যাচ্ছে। হয়ত এখুনি দাদু মরছে। একটা বালিহাঁস খেতে চেয়েছিল দাদু। দাদু মরে গেলে চেয়েচিন্তে একটা বালিহাঁস খেলেও খেতে পারবে । এই সঙ্গে মায়ের কথা মনে পড়ল কাঁকনের আর ওর বুকটা যেন ফেটে যেতে চাইল! মা-টাও মরে গেছে। মা-টাও মরে গেছে বলে মনে হয় যে আমার! আব্বার সঙ্গে বিকেলে কি আজ দেখা হবে? সেই মেয়েলোকটা কি আসবে?
কাঁকন ছেলেটার মনে কি রকম মরে যাবার ইচ্ছা প্রবল হয়। দারুণ শীতের জন্য সেই সময় ঘাস, পাতা, আকাশ, রোদ সব কিছু মরছিল বা মরণাপন্ন ছিল।
হাঁসগুলো ঠিক এই সময়েই বিল ছেড়ে আকাশে উঠল আর কাঁকন দেখল ওদের। আস্তে আস্তে উঠে এলো সে রেললাইনের ওপর। চারদিকে চেয়ে দেখল। আকাশের রোদ কমে এসেছে, কিন্তু রেললাইনটা ঝকঝক করছে।
বেলা তিনটের ট্রেন ক্রুর আনন্দে ঝকঝক গুম গুম শব্দ তুলে দৈত্যের মত চলে গেল। তারপর কি নিদারুণ স্তব্ধ প্রশান্তি!
শীতে গাছের পাতাগুলোকে বিশ্রী দেখাচ্ছে, পথের ওপর ছায়া ভয়ানক ঠাণ্ডা আর ঘাসের ভেতর রাস্তার রং দুধের মত শাদা । ঘাস এখনও হলদে হয় নি—হবে হবে করছে। এই সব আধ-মরা ঘাসের ওপর শিশির আধাআধি শুকিয়েছে এতটা বেলা হয়েছে। রোদ কেবল এই সময়টায় একবার চড়াৎ করে উঠেছে, খেজুর গাছে ঘুঘু ডাকছে, অমনি মন কেমন করে উঠলো কাঁকনের। সব মরে যাচ্ছে গো–কাঁকন এই কথাটা শোনাবার মত লোক খুঁজে পেল না। দ্যাখো না, পাতা মরে যাচ্ছে, ঘাস মরে যাচ্ছে, বাগানগুলো ফাঁক ফাঁক, ফ্যাকাশে হলদে হলদে ভিজে ভিজে। মরে যাচ্ছে আর কি দাদুও মরে যাচ্ছে এই সঙ্গে। এদের সকলের সঙ্গে একবার আলাপ করে নেওয়া দরকার। ঘাস, পাতা, আকাশ ইত্যাদির সঙ্গে। বাতাসের মধ্যে খালি গায়ে কাঁপতে কাঁপতে কাঁকন বেরিয়ে এলো। প্যান্টটা কষে এটে পরল। পাছায় হাত ঘষে সর্দি মুছল। পকেটের মার্বেলগুলো গুনলো একবার, আপন মনে বলল, শালারা জিতে নিয়েছে দশটা। হেরে যাওয়ার স্মৃতিটা আসতেই লোকসানের কথা ভেবে পথের মাঝখানে বিমর্ষ হয়ে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু মার্বেলের শোক ভুলল সঙ্গে সঙ্গেই, কি ছাই মার্বেল, দাদু মরে যাচ্ছে সে কথাটা ভাবা নেই—কি যে তোমার মার্বেল হয়েছে কাঁকন? মা যা বলে সেটাই নিজের করে নিয়ে কাঁকন ভাবলো আর ভারিক্কি চালে দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল, এখন বাইরে যাচ্ছি, মা কিন্তু বলছে না, তোমাকে স্কুলে যেতে হবে না? কাঁকন, স্কুলে যাবে না তুমি? মা বলবেই-বা কেন? স্কুলে যেতে তো হবেই না। আজ কাল পরশু। আজ কাল পরশুর মধ্যে দাদু মারা যাচ্ছে। মরব মরব করে দাদু যতদিন না মরছে স্কুলে যেতে হবে না। কেউ মরলে কি স্কুলে যাওয়া চলে? ছি, লোকে কি বলবে? অবশ্য মার্বেল খেলাও উচিত না। যে মরছে তার কাছে থাকা উচিত। এই কথা মনে হতেই কাঁকন আর একটুও দাঁড়ায় না। হন হন করে হাঁটতে শুরু করে। পায়ের নিচে মাটি ভিজে ঠাণ্ডা। বরফের মত শক্ত আর ঠাণ্ডা করকর। মরা লতাপাতা জঙ্গল পেছনে সরে যায়, শুকনো পাতা সামনে উড়ে এসে পড়ে, খালে জমা অবশিষ্ট একটুখানি চকচকে কালো পানি কাতর চোখে কাঁকনের পেছন দিকে চেয়ে থাকে। ফাঁকা চষা জমিটায় হোচট খেয়ে পায়ের আঙুলের মাথা ছিড়ে রক্ত পড়ে। কাঁকন হাঁপায়। দাদুর ঘর কি ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আর একদম চুপ। চেয়ার টেবিল জানলা কপাট খাট বিছানা পানির জগ দাদু, সব চুপ। আর আমাদের ঘর দেখুন না–অদৃশ্য শ্রোতাকে কাঁকন বুঝোয়—আমাদের ঘর হচ্ছে নোংরা, আমি সেখানে পড়ি, কাগজ ছিড়ি, ফেলি, নোংরা আমাদের ঘর। বাতাস ঢোকে আর জানলা খট খট করে ওঠে। যাচ্ছেতাই নোংরা আমাদের ঘর। মা আর আমি ঘুমোই সেই ঘরে । আমি চেঁচাই। মা বকে, কাঁকন চেঁচিও না। মায়ের মুখভঙ্গি নকল করে কাঁকন বলে, চেঁচিও না। আমাদের ঘরে খালি মা-টাই চুপ আর সব ঠিক আছে।
দাদুর ঘরটা অবিশ্যি সবচাইতে ভালো। বাড়ির মাঝখানে ঘরটা। দরজা জানলায় পরদা দেওয়া আছে। অন্য কোন ঘরে নেই। খাটের ওপর ধপধপে বিছানা, টেবিলে শাদা চাদর পাতা। চেয়ারে তুলোর গদি। টেবিলের ওপর পানির জগ, গ্লাশ, ওষুধের শিশি । একটা শুকনো পাতা এসে পড়লেও মা হাতে করে তুলে বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। তিনবার করে ঘরটা ঝাড়া হয় আর কী ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ঘষা মেঝেটা আয়নার মত চকচকে করে। দাদু সেই কবে থেকে পড়ে আছে, বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারে না। কেউ ঘরে ঢুকলে দাদু খ্যাপার মত চেঁচায়। বাজারের জটাই পাগলের মত। বেশি রেগে গেলে বালিশে মাথা ঠোকে । বুড়োটা আচ্ছা চেঁচাতে পারে। খালি ঘ্যান ঘ্যান করে আর চেঁচায়—খেতে দে–খেতে দে–খিদে লেগেছে। বিরক্ত করে মারল আমার মা-টাকে। কাঁকন একটা গাছকে শুনিয়ে বলল। ওর দাদু লোকটা প্যারালিসিসে পড়ে আছে। মেজাজটা তিরিক্ষে থাকে এজেন্যেই। বুড়োর বেশি দোষ নেই। মরতে এত দেরি কারই-বা সহ্য হয়? বুড়ো ভাবে, যতদিন না মরা যাচ্ছে, দিনে চারবার খেতে হবে, মলমূত্র ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কাঁকন তাকে বিনা কারণে ভ্যাঙালো।
কাঁকন ঘরে ঢুকলে তো বুড়ো খুশি হয়। বলে, এই যে ভাই—কি খবর?
হয়ত কাঁকন বলল, স্কুল থেকে এলাম।
তা আয়, বোস আমার কাছে।
আমি হাত মুখ ধুই নি এখনও ।
তা হোক বোস ।
বাঃ, আমি বুঝি কিছু খাব না?
যা তাহলে, বেরো।
তখন কাঁকন হয়ত বসল।
ঘরে কেউ আছে কি না দেখে নিয়ে ফিশফিশ করে দাদু বলল, আজ কি দিয়ে ভাত খেয়ে স্কুলে গেলি বলতো?
ইলিশ মাছ ভাজা, ডাল আর আলুর তরকারি দিয়ে। কাকন উৎসাহের সঙ্গে বলে, বুঝলে দাদু—তরকারিটা এত ভালো হয়েছিল না!
ভাই, আমাকে দুটো ইলিশ মাছ এনে দিবি। চুপি চুপি রান্নাঘর থেকে এনে দে।
মা দেখলে পিটিয়ে আমার ছাল তুলবে।
তোর মা দেখতে পাবে না—যা ।
আমি পারব না দাদু।
যা না ভাই—লক্ষ্মী—ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার ।
দাদু তুমি কি? ছেলেমানুষের মত কেবল খাওয়ার বায়না! ওতো আমরা করবো। তা আমি কোনদিন করি না। মা যা দেয় তাই খাই। কেন, দুপুরে তুমি খাও নি? মা দেয় নি খেতে? অত খাই খাই কর কেন? উঠতে পারলে তুমি ঠিক হাড়ি খেতে দাদু।
দাদু কথা কানে তোলে না, দুটো ইলিশ ভাজা এনে দে দাদু—তোকে একটা দেব। কাঁকন মুখ গম্ভীর করে বলে, ও! আবার লোভ দেখানো হচ্ছে? তুমি যাচ্ছেতাই হয়ে গেছ। খেলার সাথীদের কাছ থেকে শেখা কথাটা বলে কাঁকন, এবার তুমি টেঁসে যাও দাদু।
এইবার চটে বুড়ো, তাইতো তোরা চাস—তোর মা রাক্ষসী তাই চায় বলেই তো খেতে দেয় না |
এখন যেই মা ঘরে ঢুকে বলল, কি বলছেন, দাদু ভিজে বেড়াল হয়ে গিয়ে বলল, এই কাঁকনমণির সঙ্গে একটু গল্প করছিলাম আর কি?
দাদুটা এত পারে—ন্যাকা–কাঁকন নাক সিটকোয় ।
ফাটা আঙুলটায় হাত বুলোতে বুলোতে আর একটা হাত গালে রেখে কাঁকন ভাবতে লাগল, কিন্তু দ্যাখো, সেই দাদু আজ মরে যাচ্ছে। হয় আজ, না হয় কাল, না হয় পরশু। মতি ডাক্তার এসে বলে গেল। দাদু না মরা পর্যন্ত আমাকে আর স্কুলেও যেতে হচ্ছে না। আহা রে—দাদুটা মরে যাচ্ছে—লতাপাতা, ঘাস, আকাশ সব কি রকম করে মরে যাচ্ছে দাদু আমার লোক খুব ভালো। মায়া লাগে বুড়োর জন্যে। আমি বড়ো হতে হতে দাদু বেঁচে থাকলে দাদুকে রাজা করে দিতাম। কাঁকনের হাসি পেল, দাদু সেদিন দুপুরবেলায় আমাকে ডেকে চুপি চুপি বলল কিনা—কাঁকন আজকাল বাজারে যাস না?
কেন দাদু?
বালিহাঁস বিক্রি হচ্ছে না বাজারে? আনিস তো ভাই একটা! বলেই দাদু কেমন ঝিমুতে লাগল।
দাদু মাত্তর একটা বালিহাঁস চায়। কি ওড়ে বালিহাঁসগুলো! শোঁ-শোঁ করে শব্দ হয়। কাঁকন আকাশের দিকে চাইল। ম্যাটমেটে রং আকাশটার। একটুও ভালো লাগে না। হাঁসগুলো ঐ আকাশ দিয়ে উড়ে আসে—কোথা থেকে কে জানে! কেমন হু-হু করে উড়ে আসে। আমি যদি উড়তে পারতাম ওদের মত! কি মজাই না হতো। এক একদিন আমার কি খারাপ লাগে! দাদু মুখ গুজে শুয়ে থাকে—মা কথা বলে না। আমার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। আর না হয় মরে যেতে । কবে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল কাঁকন সেই কথা মনে করার চেষ্টা করল। পনেরটা মার্বেল হেরে খেপে গিয়ে একদিন ন্যাজা বলল, ভারি তেজ দেখি যে! তোর বাপ কোথা জানিস?
মা যেমন বলেছিল তেমনি জবাব দিল কাঁকন, ঢাকায়।
এঃ ঢাকায়! ঢাকায় তো আসে না কেন শুনি?
গর্বের সঙ্গে কাঁকন বলে, আসবে।
তোর বাপকে আর আসতে হচ্ছে না।
কেন?
লোকে ধরে ঠ্যাঙাবে।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁকন, কেন?
তোর বাবা একটা মাগিকে নিয়ে ভেগেছে।
মাগি কি?
মাগি জানিস না? আরে ছ্যা ছ্যা—মাগি জানিস না? এবার আর একা ন্যাজা নয়, সবাই ওকে ঘিরে ধরে হাসল, ভ্যাংচাল, চিমটি কাটল, ছোড়া মাগি জানে না—হো হো!
ওদের সঙ্গে খুনোখুনি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মাকে খুঁজল কাঁকন। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। হাত মুখ না ধুয়েই পড়তে বসল কাঁকন। একটা অক্ষরও পড়তে পারল না, বই খুলে ঘরের ছায়ার দিকে চেয়ে রইল। তারপর ঢুলতে শুরু করল। মা খেতে ডাকলে গেল না। রাত একটু বেশি হলে সব কাজ শেষ করে মা ঘরে এসে শুয়ে পড়তে যাবে, কাঁকন জিগগেস করল, মা, আব্বা কোথায়?
ঢাকায় ।
আসে না কেন?
আসবে। শুয়ে পড়ো কাঁকন। কিছু খেলে না কেন?
আব্বা একটা মাগির সঙ্গে চলে গেছে?
মা একটু থমকালো, কে বলল?
ঐ ছেলেরা।
নিরুত্তাপ কণ্ঠে মা জবাব দেয়, হ্যাঁ।
মাগি কি?
প্রচণ্ড একটা চড় কষে ওর মা ফেটে পড়ে, রাত দুপুরে শয়তানি। পাজি কোথাকার। হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি তোমার। মাগি কাকে বলে জানিস না—আমি একটা মাগি ।
পাশের ঘর থেকে দাদু বলে, কি হলো?
কাঁকনের মা রাগে ফুলতে ফুলতে ছুটে যায় ও ঘরে। দড়াম করে দরজা খুলে বলে, খবরদার, একটা কথা নয়, একদম চুপ। কুচুটে বুড়ো, কিছু জানে না!
অ, আচ্ছা—দাদু আর কথা বলে না। ঘুমোয়, না জেগে থাকে কে জানে? মা ফিরে আসে, দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে দেয়। তারপর শুয়ে পড়ে। অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে কাঁকনের ইচ্ছে হয় মরে যেতে। মাগি খুব খারাপ কথা, ছিছি করার মত কথা? নাকি খারাপ জিনিশ? কেমন জিনিশ? জিনিশটা ঠিক কি রকম জানবার ইচ্ছা নিয়ে কাঁকনের মরে যেতে মন করে।
সেই একবার। আরও একেবার মরতে ইচ্ছে হয়েছিল। এইতো কদিন আগে । কাঁকন মনে করল ঘটনাটা। স্কুল থেকে দুপুরে হঠাৎ বাড়ি চলে এলো। খুব রোদ ছিল। গাছপালা পুড়ছিল। মাটি পুড়ছিল। এই সব পোড়ার পটপট শব্দ হচ্ছিল। কাঁকন গন্ধ পাচ্ছিল। এই সব পুড়ছিলো আর ঝিমুচ্ছিল । ওদের বাড়িটাও রোদে থিরথির করে কাঁপছিল। দাদুর ঘরে কেবল ঠাণ্ডা ছায়া, ওষুধের মিষ্টি একটা গন্ধ, টেবিলে পানির জগ, গ্লাশ। দাদু ছায়ায় শুয়ে। কাঁকনের ইচ্ছে হল একবার দাদুর ঘরে যেতে। দাদু হা করে ঘুমোচ্ছে। কলতলায় একটা কাক খানিকটা রোদ আর খানিকটা ছায়ায় থেকে একটা হাড় আছড়াচ্ছে। হঠাৎ হাড় ছেড়ে লাফিয়ে একটা মরা ইদুর তুলে নিয়ে এলো, উড়ে গেল, সজনে গাছে বসল। একটা শাদা লম্বা ঠ্যাং ফড়িং ঘাসে তিরিং করে লাফ দিল । কাঁকন নিজেদের ঘরে এলো, ঘরের ছায়ায় বিছানায় ফরশা একটা মানুষ শুয়ে, মায়ের কোলে তার মাথা, মা ওর চুলের ভেতর আঙুল চালাচ্ছে, তারপর মা তার মাথা নামিয়ে আনে, কাকটা চিৎকার করে ওঠে কা কা করে, কাঁকন ফিরে দেখে, ইদুরটা রেখেছে কার্নিশে, আবার তুলে নিল ঠোঁটে ।
মা বিষণ্ন চোখে কাঁকনকে দেখল, বলল, আয়।
লোকটা উঠে দাড়াল, চুল ঠিক করল, একটা হাইও তুলল, মা বলল, আমার ছেলে কাঁকন ।
আচ্ছা—কাঁকনের থুতনিতে একটা টোকা দিয়ে মায়ের দিকে ফিরে লোকটা বলল, চলি । তারপর চটপট রোদের রাস্তায় বেরিয়ে গেল। রোদে-পোড়া ঘাসের গন্ধ ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল আর পটপট শব্দ হলো। কাকটার পাত্তা নেই, তার বদলে সজনে গাছে সবুজ রঙের একটা পাখি লেজ নাচাচ্ছে, কলতলায় এঁটো বাসনকোশনের ডাই পড়ে আছে। সে দিকে চেয়ে মা বলল, কাঁকন কাউকে কিছু বলবে না।
লোকটা কে?
কাউকে কিছু বলবে না তুমি।
রাগে কাঁকন চোখে কিছু দেখতে পেল না। মায়ের মুখটা কলতলার দিকে ফেরানো ।
সে বলল, বলব।
না, বলবে না।
হ্যা, বলব, সবাইকে বলব।
কাঁকন ।
হ্যা বলব, সবাইকে বলব—রাগ নয়, চোখের পানিতে এখন কাঁকন কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, বলব, যাকে খুশি তাকে বলব—জবাই করা মুরগির মত সে আছাড় খেল, লাফাল, ধেই ধেই করে নাচল, বলব, বলব, সবাইকে বলব।
মা চুপ করে চেয়ে চেয়ে দেখল ওকে, দেখতে দেখতে রোদ ঝিমিয়ে এলো, কাঁকন ঘুমিয়ে পড়ল । পড়ন্ত রোদে অনেকগুলো কাক কলতলায় জমে চেঁচাতে শুরু করল। কাঁকন সেদিন ঘুম থেকে উঠেছিল সন্ধ্যাবেলায়। চোখ কচলে তার মনে হলো সকাল হয়েছে আর মনে হলো মরে গেলে বেশ হয়। নিজেকে শুনিয়ে সে বলল, কাঁকন তুমি মরে যাও । মায়ের সঙ্গে লোকটাকে দেখে তার কেন যে মরে যেতে ইচ্ছে করল কে জানে? লোকটা কি খুব খারাপ? কয়েকবার দেখেছে তাকে, পাকা রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে মোটর সাইকেলে যায় ঝকঝক করে। একবার এসেছিল দাদুকে দেখতে। খুব খারাপ নাকি লোকটা? কিন্তু মায়ের সঙ্গে লোকটা ঐভাবে থাকলে কাঁকনের মনে হয়, তার, না হয় তার মা-র মরে যাওয়া উচিত।
এই নিয়ে কাঁকন যখন গালে হাত দিয়ে ভাবছিল, ওর পকেট থেকে একটা মার্বেল গড়িয়ে পড়ল। চমকে উঠে দাড়ায় কাঁকন। মনটা তখন ওর ভারি খারাপ। বোকার মত সে গড়িয়ে চলা মার্বেলটার দিকে চেয়ে দেখল। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে মায়ের সকালবেলার কথা মনে পড়ল, কাঁকন আজ বিকেলে বাড়িতে থাকবে।
কেন?
না, বাড়ির বাইরে যাবে না বিকেলে ।
তখুনি বুঝতে পারল কাঁকন, দাদুর কথা বলছে মা ।
ডাক্তার যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিল আমি শুনেছি জানো?
বেশ করেছ। বাইরে যেও না, আর—মায়ের গলা একটু কাপল—কাঁকন মায়ের দিকে চেয়ে, আর—বিকেলে তোমার আব্বা আসবেন।
সত্যি? কখন?
বললাম তো বিকেলে ।
ভারি মজা হবে।
বাড়িতে থেকো আজ। মা আর কথা বাড়াল না।
সকালবেলার কথা মনে পড়ে এখন কাঁকনের মন কিন্তু আরও মুষড়ে পড়ল। মজা হবে না ছাই। সেই লোকটা আর আসে না। কিন্তু পড়তে পড়তে হঠাৎ হয়ত কাঁকনের মনে হলো লোকটা এসে পেছনে দাড়িয়েছে। ওর মনে হয়, লোকটা সব সময় ঘরে রয়েছে, আর মায়ের কোলে তার মাথা । মায়ের কোলে কতদিন যাই না—ছি, বড় হলে আবার কেউ মায়ের কোলে যায় নাকি। কিন্তু মা তো ইচ্ছে করলে কোলে টানতে পারে—আমি নাইবা গেলাম! মা টানে না। আব্বা কোন ঘরে থাকবে? আর সেই মাগি কথাটা পরে জেনেছে একটা যাচ্ছেতাই। মা বলল কথাটা সত্যি। তাহলে মায়ের ছেলে কাঁকন তোমার আব্বার মুখ দেখা উচিত কি? পাকা ঝুনো ছেলে কাঁকন ঝাকি দিয়ে চুল সরালো কপাল থেকে ।
একটা শব্দ হলো শোঁ-শোঁ করে মাথার ওপর । কাঁকন রোদ থেকে চোখ আড়াল করে আকাশের দিকে চেয়ে দেখল। বালিহাঁসের বিরাট একটা দল উড়ে যাচ্ছে। ওদের পা পেছনে ফেরানো, গলা এগিয়ে দেওয়া সামনের দিকে। রোদে ঝলকাচ্ছে ওদের কালচে ডানা, গলার কাছে ফিকে নস্যি রং যেন সোনালি। হঠাৎ সা করে ঘুরে একটা বড় ত্রিভুজের আকার নিয়ে দলটা বিলের দিকে ফিরল।
সব কষ্ট দুঃখ ভুলে কাঁকন হাততালি দিয়ে বলল, এতদিন কোথা ছিলি তোরা। একটা নেমে আয় না! ভয় নেই। দাদু একটা খেতে চেয়েছিল—তা দাদু আজ না হয় কাল, না হয় পরশু মরে যাচ্ছে, খেতে পারবে না। পুষব আয় ।
হাঁসগুলো আমন্ত্রণে কান দেয় না। রেলগাড়ির মত হু-হু করে বাতাস কেটে বিলের দিকে এগোয়। মার্বেলটা কুড়িয়ে পকেটে পুরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করল কাঁকন। তারপর পাছায় সর্দি মুছে দৌড়ুল চষা জমির ছোট মাঠ, আগাছার পড়ো জমি, বুক পর্যন্ত উচু আধমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। ভাঙা দালানবাড়ির ভিটে থেকে একটা ঘুঘু আড়চোখে কাঁকনের মারমূর্তি দেখে নিয়ে পিরিং করে ডানার শব্দ তুলে উড়ে গেল। ঝোপের পাশে একটা শেয়াল বিশ্রাম নিচ্ছিল চোখ বন্ধ করে। কাঁকন হুড়মুড় করে প্রায় তার ওপরে পড়ল। ভীষণ বিরক্ত হয়ে শেয়ালটা সরে গেল। কাঁকন অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে থাকল একটুক্ষণ। তারপরেই আবার ছুটতে শুরু করল।
এখন হাঁসগুলোকে আর দেখা যায় না। রোদটাও মিইয়ে লালচে হয়ে এসেছে। কাঁকন সামনে রেল লাইন দেখতে পেল। পেছনে ঝাপসা মাঠ আর রেল লাইনের ওপারে বিরাট বিলটা । এত বড় বিল যে ভয় পেল কাঁকন । এর মধ্যে কোথায় হাঁসগুলো বসেছে দেখতে পেল না সে! এতদূর দৌড়ে এসে ক্লান্ত অবসন্ন কাঁকন রেল লাইনের নিচে জমির আলে বসে পড়ে। কোন দিকে ওদের বাড়ি বুঝতে পারে না। আর হাঁসগুলোকে দেখতে না পেয়ে দুঃখে কষ্টে ও আবার ভেঙে পড়ে। ভারি দুঃখী হয়ে যায় কাঁকন। সেই মরে যাওয়ার ইচ্ছাটা ফিরে আসে । আহা রে যদি মরে যেতাম—কত ভালো হতো—হয়ত হাঁসগুলোর মত উড়তে পারতাম। তার বদলে দাদুটা মরে যাচ্ছে। হয়ত এখুনি দাদু মরছে। একটা বালিহাঁস খেতে চেয়েছিল দাদু। দাদু মরে গেলে চেয়েচিন্তে একটা বালিহাঁস খেলেও খেতে পারবে । এই সঙ্গে মায়ের কথা মনে পড়ল কাঁকনের আর ওর বুকটা যেন ফেটে যেতে চাইল! মা-টাও মরে গেছে। মা-টাও মরে গেছে বলে মনে হয় যে আমার! আব্বার সঙ্গে বিকেলে কি আজ দেখা হবে? সেই মেয়েলোকটা কি আসবে?
কাঁকন ছেলেটার মনে কি রকম মরে যাবার ইচ্ছা প্রবল হয়। দারুণ শীতের জন্য সেই সময় ঘাস, পাতা, আকাশ, রোদ সব কিছু মরছিল বা মরণাপন্ন ছিল।
হাঁসগুলো ঠিক এই সময়েই বিল ছেড়ে আকাশে উঠল আর কাঁকন দেখল ওদের। আস্তে আস্তে উঠে এলো সে রেললাইনের ওপর। চারদিকে চেয়ে দেখল। আকাশের রোদ কমে এসেছে, কিন্তু রেললাইনটা ঝকঝক করছে।
বেলা তিনটের ট্রেন ক্রুর আনন্দে ঝকঝক গুম গুম শব্দ তুলে দৈত্যের মত চলে গেল। তারপর কি নিদারুণ স্তব্ধ প্রশান্তি!
3 মন্তব্যসমূহ
আহা কি অপূর্ব লেখা। মন ভরে গেল।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ!
উত্তরমুছুনকাঁকন কি তবে মরেই গেলো???
উত্তরমুছুনস্বাদে গন্ধে আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের "নিরুদ্দেশ যাত্রা " গল্পটির কথা মনে পড়ে গেলো,,,,