এ বছরই (২০১৫) তারাপদ রায়ের গল্প ‘বিশেষজ্ঞ’ পড়েছি। রুগির ঠাণ্ডা লেগে ডান নাক বন্ধ। ডাক্তারবাবু বাঁ নাকের বিশেষজ্ঞ। অতএব বিনি চিকিৎসায় রুগিকে পথ দেখতে হলো। হাসি কিন্তু ডান দিকের ঠোঁট আর দাঁতকে লিয়ে বরাদ্দ হয়নি। হাসতে হাসতে শরীরের গোটা ব্যবস্থা কেঁপে কেঁপে উঠলো। অব্যবহিত পরেই গল্পটির কনটেন্টে দুনিয়া জুড়ে বিচ্ছিন্নকরণের সুলুনিতে বুক জ্বলে গেলো।
উপরিলিখিত প্রশ্নেরা গায়ে গায়ে মেশামিশি হয়ে পাঠকের বোধে একাকার হয়ে আছে, ছাড়াছাড়ি করতে গেলে, উত্তরগুলি এ ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে, এ রকম একটা আজেবাজে যুক্তি খাড়া করে, সাত চোঙার প্রশ্নগুলিকে এক চোঙায় ভরে, আসলে জ্ঞানের ছেঁড়া পাতাকে চালাকির ধামা চাপা দিয়ে রেহাই পেতে চাইছি। পাঠক মাপ করবেন।
গল্পের বাঁ নাক, ডান কড়ে আঙুল, হৃদপিণ্ডের তলদেশে ধড়ফড়ানি ইত্যাদি নিয়ে পণ্ডিতি না করে বলি গল্প আসলে অনন্ত বেঁচে থাকার জীবন্ত টুকরো। সর্দিতে বাঁ নাকে হেঁচে, বাঁ নাকে সর্দি ঝেড়ে, বাঁ নাকে কাহিল না হয়ে গোটা শরীরে ঝাঁকুনি খেলে স্বস্তিতে স্বজ্ঞানে সুস্থ হওয়ার উপায় দেখতে পাই। রিখটারে মাপা গেলে ঝাঁকুনির মাত্রা অবশ্য বাঁ নাকে বেশি হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কাজ না থাকলে বেঁচে থাকাটা নিরর্থক মনে হয়। রিটায়ার করার পর কাজের দায় দায়িত্ব তেমন ঝাঁপিয়ে পড়ছে না দেখে পুরোনো স্যাঙাৎ গল্পের ঘাড়ে আমিই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বাঁচতেতো হবে।
অফিসতো নয়, খোঁয়াড়। চেয়ার টেবিলে মুখ গুঁজে বেঁচে থেকেছি বহুদিন। লোক-লোকুতো, স্যাঙাৎ সঙ্গ ছেড়ে পেট সেবা করে গেছি। পেটে পেটে যে গল্পের এতো খিদে চাপা ছিলো টের পাইনি। ভাগ্যিস পেট বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। নয় নয় করে এ বছরে শ’পাঁচেকতো বটেই, কম গল্প পাঠাধঃকরন করিনি। মগজে কতখানি হজম, কিংবা বদহজম হয়েছে, হিসেব মেলাতে গিয়ে ‘ঠাঁই’ পাচ্ছিনে। মনে হচ্ছে, বছরের যতো শেষের দিকে এগিয়েছি, গব্য( গর্ভ) এষণায় পাঠ সারাংশে ষাঁড়ের গোবর তৈরি হয়েছে। যখন পড়েছি, কতো গল্পইতো চাকুমচুকুম লেগেছে। এখন হাতড়াতে গিয়ে আর খুঁজে পাচ্ছিনে। গল্পকারেরা মাপ করবেন। আপনাগো গল্পের কোনো দোষ নাই। বয়স হলে এমন হয়গো দাদারা।
গল্পের সাথে পিরীত ছিলো শরীরে জল-জঙ্গল ঘন হওয়ার বয়স থেকে। কিশোর বয়সের প্রেম যতো বাসি হয়, রস মরে
তত ঝোলা, শক্ত, ক্ষীরেল, নানান স্বোয়াদের হয়।
ট্রান্সফারের চাকুরি খতম হলো। আহা! বহুকাল পর খোঁয়াড় মুক্ত প্রাণি। বাঁধা গোরু ছাড়া পেলে কী হয়? বললাম না, ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বই, পত্র পত্রিকা, নেট সাইট, মায় ছেঁড়া ঠোঙা, আড্ডা, পাহাড়-জঙ্গল, লোকালয়, গল্প পেলে হাঁ, ছাড়ছিনে কাউকে। হাড়ে হাড়ে গল্পে মজে আছি।
ট্রান্সফার হয়ে হয়ে যতো স্থানে গিয়েছি, পিরীতে মজে গল্পের বই কিনে কিনে সাঙা করেছি , খোঁয়াড়ে পরকীয়ার ( পড়া ক্রিয়ার) ফুরসুত মেলেনি। এখন হাড়ে হাড়ে আশনাইয়ে মজেছি। বই কেনার পয়সাগুলো জলে না গিয়ে পোকা মাকড়ের পেটে যাচ্ছে দেখে যতোখানি পারা যায় ঘাস পাতার মতো পাঠাঃধকরনে উসুল করছি। জাবর কাটার একটা চান্স করে দিয়েছেন, কুলদা দাদা। কৃতজ্ঞ।
বছরের প্রথমেই বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (সাহিত্যম প্রকাশিত ) দু’ দুখানা থানইট (২২১ খানা গল্প) সাইজের ‘গল্পসমগ্র’ গিলেছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেরা মানিক’, সেও গল্পগ্রন্থ, নেহাত আধলার কম হবে না। পুরোনো বই স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘অষ্ট চরণ ষোল হাঁটু’, টাটকা বই সঞ্জীব নিয়োগীর ‘অগল্পনীয়’ পাঠে ঋদ্ধ হয়েছি। বছর ত্রিশেক আগে পেয়েছিলাম, কান্তি চট্টোপাধ্যায় ভাষান্তরিত ‘ও হেনরি/ নির্বাচিত গল্প’ (প্রকাশক-পত্রপুট ১৩৮৯)। ১৮টি গল্পের একখানি চটি বই, এবছরের অন্যতম শ্রেষ্ট পাঠ। অনুবাদক বাংলাভাষায় ও হেনরিকে মুক্তি দিয়েছেন। বিচিত্র কনটেন্ট, বহুরূপি ফর্ম,
সাবলীল বাংলাভাষা। ওহঃ! হেনরি, আহা, মানবিক শক্তির আন্তর্জাতিক রস স্রষ্টা! হাড়ে পর্যন্ত রস গজিয়ে ছেড়েছেন। বারবার স্বাদ নিয়েছি। তাই বলে ১৮ গুনিতক কোনো সংখ্যার গল্প পাঠ দাবি করছিনে। যদিও করা উচিত। যতোবার পড়েছি, কোনো না কোনো সুড়ঙ্গ পথে নতুন ভাবে, নতুন বিষয়ে আলোকিত হয়েছি। তাঁর গল্পে বাস্তবের মানুষগুলোকে বারবার জড়িয়ে ধরতে চেয়েছি। ও হেনরি আশ্চর্য কৌশলে তাঁদের স্বপ্নের জগতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ‘ধরি ধরি ধরতে নারি.. আহা ছুটে মরি..’ সে ছোটায় কী মজা, উফ!
ও হেনরির পাশেই ছিলেন স্যর আলফ্রেড হিচকক। কবে যেনো কে বলেছিলো, হিচকক দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখক। অধমের আবার অ-ক্লাসিক লেখকে রুচি কম। অতএব হিচকককে পাশে রেখে এতদিন ঘুমিয়েছি..ছিঃ ছিঃ, কেনো পড়িনি! হেউ ঢেউ সময়ের খানিক বাজে খরচের খাতে রেখে রাত বিরেতে হিচকক পড়তে শুরু করলাম। ‘দ্য বার্ডস’ পড়ে আর ঘুম আসে না। ঘরে ঘুলঘুলির পিছনে বুনো পায়রার বাসা। দিনের বেলা বকম বকমে কান মাথা খারাপ করে দেয়। সেই রাতে কাকতালীয় ঘটনায় একটা পায়রা ঘরে আটকে গেছিলো। না জেনে ফ্যান চালিয়েছিলাম। ব্যস, পাখা ভেঙে পাখিটা আর্তনাদ করে পড়েছিলো মেঝেতে। বাইরে পায়রার বকম বকম সেদিন ক্রুদ্ধ মনে হয়েছে। ‘দ্য বার্ডস’ পড়ার রাতে আর দরোজা জানালা খুলতে পারিনে ভয়ে। বুঝি লক্ষ লক্ষ পায়রা এসে আমাকে আক্রমন করবে। ভয়ের আন্তর্জাতিক ব্যপ্তি
কাকে বলে বুঝেছিলাম। দেশীয় পঙ্গপাল, শকুন ইত্যাদির হিংস্রতা বিষয়ক পূর্ব ধারনা, পৃথিবী জুড়ে মানুষের সাথে একাত্মতা বোধ, এবং পরিস্থিতির দেশ কাল ব্যেপে সাধারন বর্ণনার দাপটে হিচকককে প্রথম শ্রেণিতে তুলে দিলাম।
১৯৮৯- ৯০ সালে ‘রৌরব’ পত্রিকার সৌজন্যে আলবেনিয়ান লেখক ড্রিতিরো এগোল্লির ‘সর্ট স্টোরিস’ একখানা বই পেয়েছিলাম। বইখানি সমাজতান্ত্রিক চেতনার ১৬খানা গল্পে ভরপুর। যুদ্ধকালীন এবং পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক উন্নত মূল্যবোধ ( যা কিনা সমাজতান্ত্রিক তাত্বিক মূল্যবোধের কাছাকাছি) এবং মূল্যবোধের চ্যুতি, গল্পের কাহিনি, চরিত্রগুলিকে
এমন জীবন্ত করে তুলেছে, এ বঙ্গভূমিতেও তাদের সুখ দুঃখগুলি পড়ুয়াকে ছুঁয়ে দেয়। ইংরেজিতে অনূদিত বইখানিকে আষ্টেপিষ্টে জাপটে পড়ার চেষ্টা করেছি, ফেল মারলে ডিকসনারির ওস্তাদি নিয়ে পাঠাধঃকরণ করেছি। আরো কিছু বইয়ের পাঠ ভুলে মেরেছি।
এর বাইরে ছুট ছাট গল্পের কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রবোধ কুমার স্যান্যাল, বনফুলের মিনি গল্প (অনেকগুলো), রমাপদ চৌধুরী, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ুন আহমেদ, অমর মিত্র, কতো নাম বলবো! নেই কাজতো.. ..গল্প চেখেছি, গিলেছি.., ছুট গল্পের বেশিরভাগই বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, নেট সাইট বিশেষ করে ‘গল্প পাঠ’এ পড়েছি। ১৯১৪ সালে গল্পকার নীহারুল (ইসলাম) নেটপত্রিকাটির সন্ধান দেওয়ায় বুড়োবয়সটা বেশ জমে উঠেছে। এটি একটি গল্পের খনি।
বেশ ক’টি সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ক গল্প পড়েছি। যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতবর্ষ’ স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ধর্ম’ লেঃ ইউ এস মেননের ‘পাঠান’ (ইংরাজিতে অনূদিত মালায়লম গল্প), অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের.., দূর! শুধু মুধু নাম জমা করছি।
সন্দীপনের ‘ভারতবর্ষ’এর কথায় ধরা যাক। ৬ডিসেম্বরের গল্প। বাবরি মসজিদ ভাঙার দিন। অফিসের কাজে কোলকাতা যাচ্ছি ট্রেনে। বারাসাত স্টেশনে ট্রেন গেলো বন্ধ হয়ে। যাবে না। জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। দেশজুড়ে জটিল পরিস্থিতি। না সামনে না পিছনে। কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। অরাজক অবস্থা, বন্দী। অনিশ্চিত সময়। অসহায়, আতঙ্কিত লাগছে। প্রতি মুহূর্তে খবরের বাহারে, মনে হচ্ছে, এখুনি লুট হয়ে যেতে পারি। কিংবা কেউ গায়ে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। গোটা স্টেশন চত্বরে ভয়ের রহস্য। শরীর হাল্কা, ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। হঠাৎ সাজেদার রহমানের সঙ্গে দেখা। কলেজের জিগরি দোস্ত। অনেকদিন পর ওকে পেয়ে মন খুশিতে নেচে উঠলো। ত্রিশঙ্কু অবস্থা দেখে বললো –চল, আমার সঙ্গে।
নেহাতই গেরস্থ মানুষ। ঘর সংসারের বাইরে বুঝতে চাইনা। সাজেদারকে নিয়ে স্বপ্নেও যা কোনোদিন ভাবিনি, মুহূর্তে মাথায় চিড়িক খেলে গেলো। সন্দেহের জন্ম হলো। জীবনে প্রথম সন্ত্রস্থ হলাম এই ভেবে, আমি হিন্দু, সাজেদার মুসলমান। ও কিছু না করলেও, ওর মহল্লা ছেড়ে দেবে নাকি? লুট, নাকি খুন! কী অপেক্ষা করে আছে! বাবরি মসজিদ ভাঙা হচ্ছে, গোটা ভারতবর্ষের অস্থিরতা বুকের ভিতর দাপিয়ে উঠলো। সেদিন মনে হলো আমি একজন ভারতীয়। পণ্ডিতি করার জন্য শখ করে জেনেছিলাম, এ দেশের সাম্প্রদায়িক চরিত্র, এবং তার অস্থিরতা।
এই দুই অস্থিরতার বীজ থেকে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতবর্ষ’ মহীরুহ হয়ে দেখা দিলো। গভীর এবং ব্যপ্ত হয়ে
কাঁপিয়ে দিলো পড়ুয়াকে। একটা গল্পের কাহিনি বিন্যাস কতখানি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, প্রিয় মানুষের অন্তর্দহনের তীব্রতায় ধর্মীয়-ধর্ষণের গল্পটি পাঠে বোঝা যায়, একটি দেশের নির্বিকার ধর্ষণ সহনের অসহ্য কাহিনি নিজেই লাভার আগুন উদ্গীরণ করে। সাম্প্রদায়িকতা অধ্যুষিত দেশের পাঠকেরা এই গল্প পড়ে বুঝে নেবেন সাম্প্রদায়িক কম্পনের তীব্রতা। গল্পটি এ সনের অন্যতম স্মরণীয় পাঠ।
আর একটি গল্প হাসান আজিজুল হকের ‘জননী’। যৌবনে ফুটে ওঠার আগেই বাঁচার তাগিদে এক ফুটফুটে সুন্দরী কিশোরী ক্রমাগত ধর্ষণ-করুণায় এবং পরের বাড়ি শ্রমের এবং ঋণের দয়ায় জীবন ধারন করে। গল্প শেষে পড়ুয়ার বুকে যখন কান্না হাহাকার করে ওঠে তখনই অনুভব হয় মেয়েটি মেয়ে নয় একটি দেশ। এখানে একটি চরিত্রই দেশ কাল পেরিয়ে যেতে কাফি। )
গণহিষ্টিরিয়া বিষয়টি জেনেছিলাম মনোবিদ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনায়। যখন টিঁকে থাকার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা সমাজ অভ্যন্তরে স্বাভাবিক বিকাশ নষ্ট করে, এবং কৌশলে নষ্টামির চূড়ান্তে মেতে ওঠে, সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে সৃষ্টি
হয় অস্থিরতা। অস্থিরতার তীব্রতায় সম্মিলিত মানুষ সমবেত ভাবে অযৌক্তিক অবস্থার শিকার হয়। বোধ হয় গণহিস্টিরিয়ার সেটাই লক্ষণ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণু দুনিয়ায় গণহিস্টিরিয়া এক নতুন অধ্যায়।
এই নতুন ফেনোমেনার গল্প গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের ‘মঙ্গলবারের দিবানিদ্রা’ (টুয়েসডে সিয়েসটা)। গরীব মা মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘপথ ট্রেনে এসেছেন, সন্তানের কবরে ফুল দিতে। ছেলেটি প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতে আশ্রয় নিয়েছিলো অচেনা বাড়ির দরোজায়। চোর আতঙ্কে গৃহকর্ত্রী গুলি করে শাস্তি দেয় ছেলেটিকে। কোমরে দড়ি বাঁধা, শরীরে আঘাত পাওয়া অচেনা মৃত মানুষটিকে চোর সাজিয়ে কবর দেওয়া হয়। তাঁর মা বোন কোনো ভাবেই প্রমান করতে পারেনি, ‘ও খুব ভালো মানুষ ছিলো।’ মহল্লায় চোরের প্রতি ঘৃণা, প্রতিহিংসার লক্ষ্য এখন তার মা এবং বোন। দিবানিদ্রা নষ্ট করে এক এক করে মানুষ জমতে থাকে কবরের ভারপ্রাপ্ত ফাদারের বাড়ির চারপাশে। ব্যক্তি হিষ্টিরিয়ায় ছেলেকে খুন করা হয়েছে, বেঁচে থাকতে হলে, গণহিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া স্নেহময়ী মায়ের কাছে তুচ্ছ। পুত্রহীন মা, মেয়েকে নিয়ে গণউন্মাদনার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন।
দরিদ্র, অশিক্ষিত, অত্যাচারিত দেশগুলি এখন এই রোগে আক্রান্ত। রোগ যন্ত্রণার আর্তনাদে গল্পটি আন্তর্জাতিকতার মাত্রা পেয়েছে।
এক একটি গল্প এক বা একাধিক মাত্রার দীর্ঘকালীন আবেদন নিয়ে পাঠকের বোধে, অনুভবে বেঁচে থাকে। চিরায়ত বিষয়টি মেনে নিতে কেমন অস্বস্তি হয়। গল্প বেঁচে থাকে আবেদনের জীবদ্দশা জুড়ে। প্রেম শব্দটি আপাত দৃষ্টিতে চিরায়ত। কিন্তু ভাববার বিষয়, চণ্ডীদাস রামিকে যে প্রেম নিবেদন করতেন সাদিক হোসেনের ‘রিফিউজি ক্যাম্প’ (শিলাদিত্য * নভেম্বর সংখ্যা। গল্পটিকে কোনো এক মুহূর্তের ভুল ভাবনায় সেরার ভূমিকায় রেখে আলোচনা করবো ভেবেছিলাম। গল্পটি স্মার্ট ফর্মে, শক্তিশালী ভাষায় লেখা হলেও, অনন্ত বেঁচে থাকার কথা বলে না। লোকালয়ে অনন্ত বেঁচে থাকার আয়োজনে কিছু
মানুষ যাপন করে চলেছে। সেই গল্পকে জীবন্ত পাওয়ায় বুঝি আমার মতো পড়ুয়ার কাঙ্খিত। ) গল্পে আজকের ‘আমি’ কি এলাকে সেই প্রেম দিই! অসম্ভব।
ভিজে কাঠে ধোঁয়া হয়। শুকনো জ্বালানি কাঠ জঙ্গল ভেঙে এনে যদি চণ্ডিদাস প্রেম নিবেদন করে থাকেন, এ সময়ে ‘আমি’ আর এলা, প্রেমিক প্রেমিকা, আমি একটা সিগ্রেট ধরালে, কেড়ে নিয়ে এলা টানতে শুরু করে। নিজেরটা শেষ করে আমার ব্যাকার্ডির পেগ দখল করে। ‘আমি’ ফ্রী সেক্সের পরাকাষ্ঠা। প্রেমিকার নলচে আড়ালে অন্য নারীতে উপগত হই। তবু প্রেম বেঁচে থাকে। প্রেমের হাড় মজ্জা কেবল বদলে যায়, যুগে যুগে বদলে চলছে। ‘প্রেম’ খোল নলচের ঐতিহ্যে বেঁচে আছে। চরিত্র বদল হয়ে চলেছে উৎপাদন সম্পর্ক (production relation)এর ভিত্তিতে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সম্পর্ক। সম্পর্ক বদলায়, ভাবগত উৎপাদনের বিবর্তন মূলক গতিতে। অত্যন্ত ধীরে। কিন্তু বদলায়। চাবুকের হিশ হিশ যন্ত্রণা যে গল্পের প্রাণ ছিলো, বদলে গিয়েছে উৎপল দত্তীয় মিষ্টি ব্যবহারে। চাবুকের যন্ত্রণা রাজা রাজরা,জমিদারদের অত্যাচারের প্রকাশ । সময়টা পিছনে সরে গেছে। পড়ুয়ার অনুভব থেকে বিবর্তন মূলক গতিতে সে যন্ত্রণাও হারিয়ে যাচ্ছে। সেই যন্ত্রনা কেন্দ্রিক গল্পও হারিয়ে যাচ্ছে। যাবে। সেই সব প্রেমের ডাকসাইটে পুরোনো গল্পেরা, গল্প হিসেবে প্রয়োজনহীন হয়ে, যেহেতু এককালে দাপটে পাঠকের বুকে দাপটে রাজত্ব করেছে, ঐতিহাসিক গল্পের মৃত সম্মান নিয়ে ইতিহাসে বেঁচে থাকবে। যুগের, জগতের প্রয়োজনে নতুন সম্পর্কের গল্প নির্মান করেন গল্পকারেরা।
গল্পের জন্ম হলে মৃত্যুও অবসম্ভাবী। হ্যাঁ, শারীরিক অনুভবের অব্যাখ্যাত সুক্ষ প্রকাশ-ভিন্নতা সাধারনীকৃত হয়ে চিরায়ত মনে হয়।।।
উপরিলিখিত প্রশ্নেরা গায়ে গায়ে মেশামিশি হয়ে পাঠকের বোধে একাকার হয়ে আছে, ছাড়াছাড়ি করতে গেলে, উত্তরগুলি এ ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে, এ রকম একটা আজেবাজে যুক্তি খাড়া করে, সাত চোঙার প্রশ্নগুলিকে এক চোঙায় ভরে, আসলে জ্ঞানের ছেঁড়া পাতাকে চালাকির ধামা চাপা দিয়ে রেহাই পেতে চাইছি। পাঠক মাপ করবেন।
গল্পের বাঁ নাক, ডান কড়ে আঙুল, হৃদপিণ্ডের তলদেশে ধড়ফড়ানি ইত্যাদি নিয়ে পণ্ডিতি না করে বলি গল্প আসলে অনন্ত বেঁচে থাকার জীবন্ত টুকরো। সর্দিতে বাঁ নাকে হেঁচে, বাঁ নাকে সর্দি ঝেড়ে, বাঁ নাকে কাহিল না হয়ে গোটা শরীরে ঝাঁকুনি খেলে স্বস্তিতে স্বজ্ঞানে সুস্থ হওয়ার উপায় দেখতে পাই। রিখটারে মাপা গেলে ঝাঁকুনির মাত্রা অবশ্য বাঁ নাকে বেশি হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কাজ না থাকলে বেঁচে থাকাটা নিরর্থক মনে হয়। রিটায়ার করার পর কাজের দায় দায়িত্ব তেমন ঝাঁপিয়ে পড়ছে না দেখে পুরোনো স্যাঙাৎ গল্পের ঘাড়ে আমিই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বাঁচতেতো হবে।
অফিসতো নয়, খোঁয়াড়। চেয়ার টেবিলে মুখ গুঁজে বেঁচে থেকেছি বহুদিন। লোক-লোকুতো, স্যাঙাৎ সঙ্গ ছেড়ে পেট সেবা করে গেছি। পেটে পেটে যে গল্পের এতো খিদে চাপা ছিলো টের পাইনি। ভাগ্যিস পেট বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। নয় নয় করে এ বছরে শ’পাঁচেকতো বটেই, কম গল্প পাঠাধঃকরন করিনি। মগজে কতখানি হজম, কিংবা বদহজম হয়েছে, হিসেব মেলাতে গিয়ে ‘ঠাঁই’ পাচ্ছিনে। মনে হচ্ছে, বছরের যতো শেষের দিকে এগিয়েছি, গব্য( গর্ভ) এষণায় পাঠ সারাংশে ষাঁড়ের গোবর তৈরি হয়েছে। যখন পড়েছি, কতো গল্পইতো চাকুমচুকুম লেগেছে। এখন হাতড়াতে গিয়ে আর খুঁজে পাচ্ছিনে। গল্পকারেরা মাপ করবেন। আপনাগো গল্পের কোনো দোষ নাই। বয়স হলে এমন হয়গো দাদারা।
গল্পের সাথে পিরীত ছিলো শরীরে জল-জঙ্গল ঘন হওয়ার বয়স থেকে। কিশোর বয়সের প্রেম যতো বাসি হয়, রস মরে
তত ঝোলা, শক্ত, ক্ষীরেল, নানান স্বোয়াদের হয়।
ট্রান্সফারের চাকুরি খতম হলো। আহা! বহুকাল পর খোঁয়াড় মুক্ত প্রাণি। বাঁধা গোরু ছাড়া পেলে কী হয়? বললাম না, ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বই, পত্র পত্রিকা, নেট সাইট, মায় ছেঁড়া ঠোঙা, আড্ডা, পাহাড়-জঙ্গল, লোকালয়, গল্প পেলে হাঁ, ছাড়ছিনে কাউকে। হাড়ে হাড়ে গল্পে মজে আছি।
ট্রান্সফার হয়ে হয়ে যতো স্থানে গিয়েছি, পিরীতে মজে গল্পের বই কিনে কিনে সাঙা করেছি , খোঁয়াড়ে পরকীয়ার ( পড়া ক্রিয়ার) ফুরসুত মেলেনি। এখন হাড়ে হাড়ে আশনাইয়ে মজেছি। বই কেনার পয়সাগুলো জলে না গিয়ে পোকা মাকড়ের পেটে যাচ্ছে দেখে যতোখানি পারা যায় ঘাস পাতার মতো পাঠাঃধকরনে উসুল করছি। জাবর কাটার একটা চান্স করে দিয়েছেন, কুলদা দাদা। কৃতজ্ঞ।
বছরের প্রথমেই বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (সাহিত্যম প্রকাশিত ) দু’ দুখানা থানইট (২২১ খানা গল্প) সাইজের ‘গল্পসমগ্র’ গিলেছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেরা মানিক’, সেও গল্পগ্রন্থ, নেহাত আধলার কম হবে না। পুরোনো বই স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘অষ্ট চরণ ষোল হাঁটু’, টাটকা বই সঞ্জীব নিয়োগীর ‘অগল্পনীয়’ পাঠে ঋদ্ধ হয়েছি। বছর ত্রিশেক আগে পেয়েছিলাম, কান্তি চট্টোপাধ্যায় ভাষান্তরিত ‘ও হেনরি/ নির্বাচিত গল্প’ (প্রকাশক-পত্রপুট ১৩৮৯)। ১৮টি গল্পের একখানি চটি বই, এবছরের অন্যতম শ্রেষ্ট পাঠ। অনুবাদক বাংলাভাষায় ও হেনরিকে মুক্তি দিয়েছেন। বিচিত্র কনটেন্ট, বহুরূপি ফর্ম,
সাবলীল বাংলাভাষা। ওহঃ! হেনরি, আহা, মানবিক শক্তির আন্তর্জাতিক রস স্রষ্টা! হাড়ে পর্যন্ত রস গজিয়ে ছেড়েছেন। বারবার স্বাদ নিয়েছি। তাই বলে ১৮ গুনিতক কোনো সংখ্যার গল্প পাঠ দাবি করছিনে। যদিও করা উচিত। যতোবার পড়েছি, কোনো না কোনো সুড়ঙ্গ পথে নতুন ভাবে, নতুন বিষয়ে আলোকিত হয়েছি। তাঁর গল্পে বাস্তবের মানুষগুলোকে বারবার জড়িয়ে ধরতে চেয়েছি। ও হেনরি আশ্চর্য কৌশলে তাঁদের স্বপ্নের জগতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ‘ধরি ধরি ধরতে নারি.. আহা ছুটে মরি..’ সে ছোটায় কী মজা, উফ!
ও হেনরির পাশেই ছিলেন স্যর আলফ্রেড হিচকক। কবে যেনো কে বলেছিলো, হিচকক দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখক। অধমের আবার অ-ক্লাসিক লেখকে রুচি কম। অতএব হিচকককে পাশে রেখে এতদিন ঘুমিয়েছি..ছিঃ ছিঃ, কেনো পড়িনি! হেউ ঢেউ সময়ের খানিক বাজে খরচের খাতে রেখে রাত বিরেতে হিচকক পড়তে শুরু করলাম। ‘দ্য বার্ডস’ পড়ে আর ঘুম আসে না। ঘরে ঘুলঘুলির পিছনে বুনো পায়রার বাসা। দিনের বেলা বকম বকমে কান মাথা খারাপ করে দেয়। সেই রাতে কাকতালীয় ঘটনায় একটা পায়রা ঘরে আটকে গেছিলো। না জেনে ফ্যান চালিয়েছিলাম। ব্যস, পাখা ভেঙে পাখিটা আর্তনাদ করে পড়েছিলো মেঝেতে। বাইরে পায়রার বকম বকম সেদিন ক্রুদ্ধ মনে হয়েছে। ‘দ্য বার্ডস’ পড়ার রাতে আর দরোজা জানালা খুলতে পারিনে ভয়ে। বুঝি লক্ষ লক্ষ পায়রা এসে আমাকে আক্রমন করবে। ভয়ের আন্তর্জাতিক ব্যপ্তি
কাকে বলে বুঝেছিলাম। দেশীয় পঙ্গপাল, শকুন ইত্যাদির হিংস্রতা বিষয়ক পূর্ব ধারনা, পৃথিবী জুড়ে মানুষের সাথে একাত্মতা বোধ, এবং পরিস্থিতির দেশ কাল ব্যেপে সাধারন বর্ণনার দাপটে হিচকককে প্রথম শ্রেণিতে তুলে দিলাম।
১৯৮৯- ৯০ সালে ‘রৌরব’ পত্রিকার সৌজন্যে আলবেনিয়ান লেখক ড্রিতিরো এগোল্লির ‘সর্ট স্টোরিস’ একখানা বই পেয়েছিলাম। বইখানি সমাজতান্ত্রিক চেতনার ১৬খানা গল্পে ভরপুর। যুদ্ধকালীন এবং পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক উন্নত মূল্যবোধ ( যা কিনা সমাজতান্ত্রিক তাত্বিক মূল্যবোধের কাছাকাছি) এবং মূল্যবোধের চ্যুতি, গল্পের কাহিনি, চরিত্রগুলিকে
এমন জীবন্ত করে তুলেছে, এ বঙ্গভূমিতেও তাদের সুখ দুঃখগুলি পড়ুয়াকে ছুঁয়ে দেয়। ইংরেজিতে অনূদিত বইখানিকে আষ্টেপিষ্টে জাপটে পড়ার চেষ্টা করেছি, ফেল মারলে ডিকসনারির ওস্তাদি নিয়ে পাঠাধঃকরণ করেছি। আরো কিছু বইয়ের পাঠ ভুলে মেরেছি।
এর বাইরে ছুট ছাট গল্পের কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রবোধ কুমার স্যান্যাল, বনফুলের মিনি গল্প (অনেকগুলো), রমাপদ চৌধুরী, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ুন আহমেদ, অমর মিত্র, কতো নাম বলবো! নেই কাজতো.. ..গল্প চেখেছি, গিলেছি.., ছুট গল্পের বেশিরভাগই বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, নেট সাইট বিশেষ করে ‘গল্প পাঠ’এ পড়েছি। ১৯১৪ সালে গল্পকার নীহারুল (ইসলাম) নেটপত্রিকাটির সন্ধান দেওয়ায় বুড়োবয়সটা বেশ জমে উঠেছে। এটি একটি গল্পের খনি।
বেশ ক’টি সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ক গল্প পড়েছি। যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতবর্ষ’ স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ধর্ম’ লেঃ ইউ এস মেননের ‘পাঠান’ (ইংরাজিতে অনূদিত মালায়লম গল্প), অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের.., দূর! শুধু মুধু নাম জমা করছি।
সন্দীপনের ‘ভারতবর্ষ’এর কথায় ধরা যাক। ৬ডিসেম্বরের গল্প। বাবরি মসজিদ ভাঙার দিন। অফিসের কাজে কোলকাতা যাচ্ছি ট্রেনে। বারাসাত স্টেশনে ট্রেন গেলো বন্ধ হয়ে। যাবে না। জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। দেশজুড়ে জটিল পরিস্থিতি। না সামনে না পিছনে। কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। অরাজক অবস্থা, বন্দী। অনিশ্চিত সময়। অসহায়, আতঙ্কিত লাগছে। প্রতি মুহূর্তে খবরের বাহারে, মনে হচ্ছে, এখুনি লুট হয়ে যেতে পারি। কিংবা কেউ গায়ে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। গোটা স্টেশন চত্বরে ভয়ের রহস্য। শরীর হাল্কা, ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। হঠাৎ সাজেদার রহমানের সঙ্গে দেখা। কলেজের জিগরি দোস্ত। অনেকদিন পর ওকে পেয়ে মন খুশিতে নেচে উঠলো। ত্রিশঙ্কু অবস্থা দেখে বললো –চল, আমার সঙ্গে।
নেহাতই গেরস্থ মানুষ। ঘর সংসারের বাইরে বুঝতে চাইনা। সাজেদারকে নিয়ে স্বপ্নেও যা কোনোদিন ভাবিনি, মুহূর্তে মাথায় চিড়িক খেলে গেলো। সন্দেহের জন্ম হলো। জীবনে প্রথম সন্ত্রস্থ হলাম এই ভেবে, আমি হিন্দু, সাজেদার মুসলমান। ও কিছু না করলেও, ওর মহল্লা ছেড়ে দেবে নাকি? লুট, নাকি খুন! কী অপেক্ষা করে আছে! বাবরি মসজিদ ভাঙা হচ্ছে, গোটা ভারতবর্ষের অস্থিরতা বুকের ভিতর দাপিয়ে উঠলো। সেদিন মনে হলো আমি একজন ভারতীয়। পণ্ডিতি করার জন্য শখ করে জেনেছিলাম, এ দেশের সাম্প্রদায়িক চরিত্র, এবং তার অস্থিরতা।
এই দুই অস্থিরতার বীজ থেকে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতবর্ষ’ মহীরুহ হয়ে দেখা দিলো। গভীর এবং ব্যপ্ত হয়ে
কাঁপিয়ে দিলো পড়ুয়াকে। একটা গল্পের কাহিনি বিন্যাস কতখানি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, প্রিয় মানুষের অন্তর্দহনের তীব্রতায় ধর্মীয়-ধর্ষণের গল্পটি পাঠে বোঝা যায়, একটি দেশের নির্বিকার ধর্ষণ সহনের অসহ্য কাহিনি নিজেই লাভার আগুন উদ্গীরণ করে। সাম্প্রদায়িকতা অধ্যুষিত দেশের পাঠকেরা এই গল্প পড়ে বুঝে নেবেন সাম্প্রদায়িক কম্পনের তীব্রতা। গল্পটি এ সনের অন্যতম স্মরণীয় পাঠ।
আর একটি গল্প হাসান আজিজুল হকের ‘জননী’। যৌবনে ফুটে ওঠার আগেই বাঁচার তাগিদে এক ফুটফুটে সুন্দরী কিশোরী ক্রমাগত ধর্ষণ-করুণায় এবং পরের বাড়ি শ্রমের এবং ঋণের দয়ায় জীবন ধারন করে। গল্প শেষে পড়ুয়ার বুকে যখন কান্না হাহাকার করে ওঠে তখনই অনুভব হয় মেয়েটি মেয়ে নয় একটি দেশ। এখানে একটি চরিত্রই দেশ কাল পেরিয়ে যেতে কাফি। )
গণহিষ্টিরিয়া বিষয়টি জেনেছিলাম মনোবিদ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনায়। যখন টিঁকে থাকার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা সমাজ অভ্যন্তরে স্বাভাবিক বিকাশ নষ্ট করে, এবং কৌশলে নষ্টামির চূড়ান্তে মেতে ওঠে, সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে সৃষ্টি
হয় অস্থিরতা। অস্থিরতার তীব্রতায় সম্মিলিত মানুষ সমবেত ভাবে অযৌক্তিক অবস্থার শিকার হয়। বোধ হয় গণহিস্টিরিয়ার সেটাই লক্ষণ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণু দুনিয়ায় গণহিস্টিরিয়া এক নতুন অধ্যায়।
এই নতুন ফেনোমেনার গল্প গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের ‘মঙ্গলবারের দিবানিদ্রা’ (টুয়েসডে সিয়েসটা)। গরীব মা মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘপথ ট্রেনে এসেছেন, সন্তানের কবরে ফুল দিতে। ছেলেটি প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতে আশ্রয় নিয়েছিলো অচেনা বাড়ির দরোজায়। চোর আতঙ্কে গৃহকর্ত্রী গুলি করে শাস্তি দেয় ছেলেটিকে। কোমরে দড়ি বাঁধা, শরীরে আঘাত পাওয়া অচেনা মৃত মানুষটিকে চোর সাজিয়ে কবর দেওয়া হয়। তাঁর মা বোন কোনো ভাবেই প্রমান করতে পারেনি, ‘ও খুব ভালো মানুষ ছিলো।’ মহল্লায় চোরের প্রতি ঘৃণা, প্রতিহিংসার লক্ষ্য এখন তার মা এবং বোন। দিবানিদ্রা নষ্ট করে এক এক করে মানুষ জমতে থাকে কবরের ভারপ্রাপ্ত ফাদারের বাড়ির চারপাশে। ব্যক্তি হিষ্টিরিয়ায় ছেলেকে খুন করা হয়েছে, বেঁচে থাকতে হলে, গণহিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া স্নেহময়ী মায়ের কাছে তুচ্ছ। পুত্রহীন মা, মেয়েকে নিয়ে গণউন্মাদনার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন।
দরিদ্র, অশিক্ষিত, অত্যাচারিত দেশগুলি এখন এই রোগে আক্রান্ত। রোগ যন্ত্রণার আর্তনাদে গল্পটি আন্তর্জাতিকতার মাত্রা পেয়েছে।
এক একটি গল্প এক বা একাধিক মাত্রার দীর্ঘকালীন আবেদন নিয়ে পাঠকের বোধে, অনুভবে বেঁচে থাকে। চিরায়ত বিষয়টি মেনে নিতে কেমন অস্বস্তি হয়। গল্প বেঁচে থাকে আবেদনের জীবদ্দশা জুড়ে। প্রেম শব্দটি আপাত দৃষ্টিতে চিরায়ত। কিন্তু ভাববার বিষয়, চণ্ডীদাস রামিকে যে প্রেম নিবেদন করতেন সাদিক হোসেনের ‘রিফিউজি ক্যাম্প’ (শিলাদিত্য * নভেম্বর সংখ্যা। গল্পটিকে কোনো এক মুহূর্তের ভুল ভাবনায় সেরার ভূমিকায় রেখে আলোচনা করবো ভেবেছিলাম। গল্পটি স্মার্ট ফর্মে, শক্তিশালী ভাষায় লেখা হলেও, অনন্ত বেঁচে থাকার কথা বলে না। লোকালয়ে অনন্ত বেঁচে থাকার আয়োজনে কিছু
মানুষ যাপন করে চলেছে। সেই গল্পকে জীবন্ত পাওয়ায় বুঝি আমার মতো পড়ুয়ার কাঙ্খিত। ) গল্পে আজকের ‘আমি’ কি এলাকে সেই প্রেম দিই! অসম্ভব।
ভিজে কাঠে ধোঁয়া হয়। শুকনো জ্বালানি কাঠ জঙ্গল ভেঙে এনে যদি চণ্ডিদাস প্রেম নিবেদন করে থাকেন, এ সময়ে ‘আমি’ আর এলা, প্রেমিক প্রেমিকা, আমি একটা সিগ্রেট ধরালে, কেড়ে নিয়ে এলা টানতে শুরু করে। নিজেরটা শেষ করে আমার ব্যাকার্ডির পেগ দখল করে। ‘আমি’ ফ্রী সেক্সের পরাকাষ্ঠা। প্রেমিকার নলচে আড়ালে অন্য নারীতে উপগত হই। তবু প্রেম বেঁচে থাকে। প্রেমের হাড় মজ্জা কেবল বদলে যায়, যুগে যুগে বদলে চলছে। ‘প্রেম’ খোল নলচের ঐতিহ্যে বেঁচে আছে। চরিত্র বদল হয়ে চলেছে উৎপাদন সম্পর্ক (production relation)এর ভিত্তিতে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সম্পর্ক। সম্পর্ক বদলায়, ভাবগত উৎপাদনের বিবর্তন মূলক গতিতে। অত্যন্ত ধীরে। কিন্তু বদলায়। চাবুকের হিশ হিশ যন্ত্রণা যে গল্পের প্রাণ ছিলো, বদলে গিয়েছে উৎপল দত্তীয় মিষ্টি ব্যবহারে। চাবুকের যন্ত্রণা রাজা রাজরা,জমিদারদের অত্যাচারের প্রকাশ । সময়টা পিছনে সরে গেছে। পড়ুয়ার অনুভব থেকে বিবর্তন মূলক গতিতে সে যন্ত্রণাও হারিয়ে যাচ্ছে। সেই যন্ত্রনা কেন্দ্রিক গল্পও হারিয়ে যাচ্ছে। যাবে। সেই সব প্রেমের ডাকসাইটে পুরোনো গল্পেরা, গল্প হিসেবে প্রয়োজনহীন হয়ে, যেহেতু এককালে দাপটে পাঠকের বুকে দাপটে রাজত্ব করেছে, ঐতিহাসিক গল্পের মৃত সম্মান নিয়ে ইতিহাসে বেঁচে থাকবে। যুগের, জগতের প্রয়োজনে নতুন সম্পর্কের গল্প নির্মান করেন গল্পকারেরা।
গল্পের জন্ম হলে মৃত্যুও অবসম্ভাবী। হ্যাঁ, শারীরিক অনুভবের অব্যাখ্যাত সুক্ষ প্রকাশ-ভিন্নতা সাধারনীকৃত হয়ে চিরায়ত মনে হয়।।।
0 মন্তব্যসমূহ