হাসান আজিজুল হকের গল্প পালিক সারভেন্ট নিয়ে আলোচনা

অমর মিত্র

হাসান আজিজুল হক এপারের মানুষ। জন্মেছেন বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার নিকটবর্তী এক গ্রাম যব গ্রামে। স্কুল ফাইনালের পর তিনি চলে যান তাঁর দিদির কাছে খুলনা জেলা শহরে। দৌলতপুর কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। সেই থেকে হাসান ওপারের মানুষ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, রাজশাহীতেই থাকেন। কলকাতায় এলে দেখা হয় এই অগ্রজের সঙ্গে। তাঁর স্নেহ পাই। সাহিত্যের কথা শুনি তাঁর কাছে। সে সব অনেক কথা। তিনি ওপারের কথা যেমন লেখেন এপারের কথাও।

আমি তাঁকে প্রথম স্পর্শ করি ১৯৭১-৭২ নাগাদ এক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত “ জীবন ঘষে আগুন” দীর্ঘ গল্পে। সেই গল্প ছিল রাঢ়ের মাটির, হাসানের ছেড়ে যাওয়া এই দেশ তার পটভূমি। তীক্ষ্ণ, টান টান এক গদ্যে দীর্ঘ এক গ্রীষ্মের কথা বলেছিলেন তিনি। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল এমন গল্প আমি পড়ি না তো। সেই সময়টা ছিল আমার গল্প শিখে নেওয়ার। হাসান আমাকে শিখিয়েছিলেন। গত পঞ্চাশ বছরে দুটি উপন্যাস( আগুন পাখি ও সাবিত্রী উপাখ্যান ) ও অসামান্য সমস্ত ছোট গল্প লিখে হাসান আমার কাছে খুব জরুরি এক লেখক। তাঁর অসামান্য সব গল্প আমার কাছে নিয়মিত পাঠ্য। 

চালচিত্রের খুটিনাটি নামের একটি গ্রন্থ অনেকবছর আগে আমি পাই। তার ভিতরে যে পূব বাঙলার কথা পেয়েছিলাম তা আমাদের ফেলে আসা মাতৃভূমি। হাসানকে আমি নিয়মিত পড়েছি সেই মাতৃভূমির কথা শুনতে। তাঁর ভিতর দিয়ে আমি আমার জন্মভূমিকে দেখতে পাই। জীবন ঘষে আগুন পড়েছিলাম এক্ষণে। তারপর বছর কয় বাদে মহাশ্বেতাদি আমাকে হাসানের দুটি গল্পের বই উপহার দেন, একটি “পাতালে হাসপাতালে”, অন্যটি খুব সম্ভবত “নামহীন গোত্রহীন”। তারপর থেকে হাসান আজিজুল হক আমার অবশ্য পাঠ্য লেখক। শকুন, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, শোনিত সেতু, পাতালে হাসপাতালে, জননী, বিধবাদের কথা......কোন গল্পের কথা বলব আমি ? তাঁর দেখার চোখ আলাদা। বাংলা গল্পকে কাহিনির বলয় থেকে মুক্ত করেও তিনি যে কাহিনি বলেন, তা স্থানিক হয়ে থাকে না। বাংলাদেশের বাস্তবতা এদেশের বাস্তবতায় কোথায় যেন মিলে যায়। 

আমি তাঁর একটি স্বল্প পঠিত গল্প “ পাবলিক সারভেন্ট’’ এর কথা বলি। এই গল্প ক্ষমতার। ক্ষমতা কোথা থেকে নেমে আসে তার এক অদ্ভুত আন্দাজ দিয়েছেন হাসান। মামুন রশিদ সরকারী আমলা। উচ্চপদস্থ তো নিশ্চয়। ফেব্রুয়ারি মাসের তিন তারিখ তার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। শুভ দিনই। এই ১৯৮৩-র তেসরা ফেব্রুয়ারির আগে অবধি তাইই ছিল। ওইদিন, ৩/২।৮৩-র সকাল অবধি তাইই ছিল। ঐদিন সে তার চাকরির বিশ বছর পূর্ণ হয়েছিল। ঐদিন তার বিয়ের আঠের বছর পূর্ণ হয়েছিল। তার মনে হয় তার জন্মও ওই তারিখেই, কোনো এক তেসরা ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল। 

মামুন কদিন ছুটি নিয়ে আছে বাড়িতে। তার বাড়ি নিখুতভাবে সাজানো। খুবই সুখী সংসার। কিন্তু সমস্ত বাড়িতে কবরের নিস্তব্ধতা। বাইরে ফেব্রুয়ারির আকাশ মেঘলা। একটা ঝোড়ো বাতাস বইছে। কিন্তু এই ঘরে তার চিহ্ন নেই। মামুন সাজানো ড্রয়িং রুমে বসে তার বউকে ডেকেছে কয়েকবার। সে আসেনি। সোফায় বসে চুরুট টানতে টানতে মামুন দিশেহারা হয়ে যায়। সে যখন সারভিসে ঢুকেছিল এই দেশের নাম অন্য ছিল। দেশে তখন জঙ্গল বেশি, আবাদি জমি কম, মানুষজন কম। 
হাসান লিখছেন,’’ তখন রোদ ছায়া নদী নালা মাটি জল অন্যভাবে সাজানো ছিল। বিশবছরে সবই প্রায় নিড়িয়ে সাদা করে আনা গেছে।‘’ পাবলিক সারভেন্ট মামুনের তাতে কিছু যায় আসে না। সে জানে পাবলিক সারভেন্ট, জনগনের সেবক আসলে জনগনের শাসক। তার অভ্যাস উঁচু জায়গাটিকে দখল করা। সারভিসে সে তাই করে এসেছে। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গাটি বেছে নিয়ে নিয়ে সে প্রায় ক্ষমতার চূড়ায়। কিন্তু সেই চূড়ার উপরেও এক চূড়া আছে। ক্ষমতার সিংহাসন, ওই নিষিদ্ধ ফলের দিকে সে কখনও চেয়ে দ্যাখেনি। ওই আসন হলো চূড়ান্ত ক্ষমতার আসন। কিন্তু চূড়ান্ত সেই ক্ষমতা কার? সেই প্রশ্ন গর্হিত। ক্ষমতার নাক মুখ চোখ নেই। 

মামুন চুরুট নিতে ঘরে ঢুকে দ্যাখে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে তার বউ শায়েলা। মামুন শায়েলার সঙ্গে কথা বলতে চায়, শায়েলা পাথর। পাবলিক সারভেন্ট হিসেবে সে জানে, কথা বলতে পারলে সব সমস্যা মিটে যায়।। শায়েলা তার কথায় সাড়া দেয় না। মামুন বলতে চায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা ঘটতেই পারে, আমরা সব সময় তা এড়াতে পারি না। শায়েলা স্তম্ভিত হয়ে মামুনের দিকে তাকায়, যা ঘটেছে তা দুর্ঘটনা! মামুনের স্ত্রীর সম্মান গেছে, আর তা দুর্ঘটনা! এই গল্প পড়তে পড়তে শিরদাঁড়ায় হিম স্রোত বয়ে যায়। 

ঘটনা একটা ঘটেছিল। উচ্চপদস্থ আমলা মামুনের সঙ্গে সেদিন সকাল নটায় দেখা হয়েছিল তাঁর। তিনি বেঁটেখাটো, চুল ছোট করে ছাঁটা, চিলের মতো কপিশ একজোড়া চোখ। না হেসে কথা বলেন না। আগে তাঁর সামনে দাঁড়ালে মামুনের গা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। এখন কথা বলতে বলতে তিনি মামুনের কাছে সহজ হয়ে গেছেন অনেক। 

সেদিন বিকেলে একটা পাবলিক মিটিং ছিল। জাতি জেনে গেছে তিনি একটা রাজনৈতিক দল গঠন করছেন। তিনি সেই বিষয়ে মামুনের অভিমত জানতে চাইছিলেন। বোঝা যায় তিনি মিলিটারি শাসক। এখন জনগণের কাছে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেছিলেন, আর কতদিন ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকবেন জনগণের কাছে না গিয়ে? মামুন বলেছিল, জনগণের কাছে যেতে হবে কেন ক্ষমতা যখন জনগণের কাছ থেকে আসেনি ? তিনি বিপরীত মত প্রকাশ করেছিলেন, বলেছিলেন, জনগণই ক্ষমতার উৎস, সমস্ত ক্ষমতা সেখান থেকেই আসে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। মামুনের সঙ্গে সকালে তাঁর তর্ক হয়েছিল ক্ষমতার উৎস নিয়ে। সেনা শাসক বলতে চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনী জনগণের অংশ। মামুন বলেছিল, জনগণের অংশ বটে, কিন্তু তা বিচ্ছিন্ন অংশ। মামুন বলেছিল, স্যার আদেশ দিলেই সে তার স্বাধীন মত বলতে পারে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন সেনাবাহিনী জনগণেরই অংশ। তারা বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। সেনাবাহিনী আসে কোথা থেকে? তাদের আত্মীয়-স্বজন তো জনগণের ভিতরই থাকে। মামুন যে কথা বলেছিল তা সেই সেনা প্রধানের বিপরীত। 

সেনাবাহিনী সম্পর্কে মামুনের মূল্যায়নে তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। আসলে মামুনের কাছে তিনি তাঁর মতের সমর্থন চেয়েছিলেন। মামুন স্বাধীন মতামত দেবে, কিন্তু তা যেন তাঁর মতের বিরুদ্ধে না যায়। সেইদিন বিকেলে তিনি রাজনৈতিক দল গঠন ঘোষণা করেন। মামুন সেই সভায় সস্ত্রীক উপস্থিত। মামুনের সৌভাগ্য সে ক্ষমতার এই শীর্ষকে চেনে। তার সঙ্গে কথা বলে। এদেশের কোনো আমলার সেই ক্ষমতা নেই। সে বসে ছিল শায়েলাকে নিয়ে। সুন্দরী বউ। তিনি মঞ্চ থেকে দল ঘোষণার পর আচমকা আলো নিভে যায়, তখন শ্লোগান চলছিল অন্ধকারেই। আর সেই অন্ধকারেই শায়েলাকে তুলে নিয়ে যায় যুবশক্তি। বলে, মামুনকে বলে, আমলার বাচ্চা, বাড়ি যা, খানিক বাদে আইস্যা নিয়া যাস......। 

হ্যাঁ, পুলিশ পাহারায় ধর্ষণ সম্পন্ন হয়েছিল। অন্তত শায়েলা তাই জানে। তারা যুবশক্তি, নতুন পার্টির সুখে আমলার বউকে ধর্ষণ করতে লেগেছে। সেই সময় এক মুহূর্তের জন্য সব আলো জ্বলে উঠেছিল। সেই মুহূর্তের আলোর ভিতরে সে কি মামুনকে দেখেছিল দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কী ভয়ানক এই গল্প। মামুনও জানে পনের সেকেন্ডের জন্য আলো জ্বলেছিল। তখন কি সে হামাগুড়ি দিয়ে বসা কুকুরের মাংস খাওয়া দেখছিল? ক্ষমতা আর তার অলীকতা এই ভাবে মামুনের কাছে এসে পৌঁছেছিল। এই গল্প ভোলা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ