২০১৫ সালে পড়া গল্পের সালতামামি--২

গল্পপাঠ :  ১
২০১৫ সালে কত সংখ্যক গল্প পড়েছেন?

রুবিনা খানম : ১ 
হিসেব করিনি বা গুণে দেখা হয়নি। তবে গড় হিসেব, সপ্তাহে অন্তত একটি।

গল্পপাঠ : ২.
কোন কোন মাধ্যম থেকে গল্পগুলো পড়েছেন?
রুবিনা খানম : ১
গল্পপাঠ থেকে। ফেসবুকে কেউ নিজের লেখা গল্প শেয়ার দিলে। বিভিন্ন বাংলা গল্পের সাইট থেকে পিডিএফ ডাউনলোড করে।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ওয়েব সাইট থেকে (ফোনের জন্য apps ও আছে)। এবং নিজের সংগ্রহের গল্পের বই তো আছেই।




গল্পপাঠ : ৩.
কোন কোন গল্পকারের গল্প পড়েছেন?

রুবিনা খানম : ৩
এই বছর বাংলা পুরানো ছোট গল্পগুলো আবার নতুন করে পড়ছি। তাই বাংলা গল্পকারের গল্পের সংখ্যাই বেশি। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, সমরেশ মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবু ইসহাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হাসান আজিজুল হক, সাদত হাসান মান্টো, ইসমত চুগতাই, তপন রায় চৌধুরী ,গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, অমর মিত্র, কুলদা রায়, এলিস মনরো, অরুন্ধতী রায়, অরবিন্দ আদিগা (Aravind Adiga) এবং গল্পপাঠের অধিকাংশ লেখক।


গল্পপাঠ : ৪.
এর মধ্যে ভালো লাগার গল্পগুলোর কয়েকটি নাম করুন। গল্পগুলো ভালো হয়ে উঠেছে কি কি কারণে সেগুলো উল্লেখ করুন।

রুবিনা খানম : ৪
এ বছরে আমার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার, অরুন্ধতী রায়ের গড অব স্মল থিংস, অরবিন্দ আদিগার হোয়াইট টাইগার এবং তপন রায় চৌধুরীর বাঙ্গালনামা । গড অব স্মল থিংস পড়ার পর মনে হয়েছে, এই বইটি আগে না পড়ে ভালোই করেছি। আগে পড়লে অরুন্ধতী রায়ের লেখার স্বাদ পুরোপুরি নিতে পারতাম কী-না জানিনা। লেখকের গল্প বলার ধরণ, চরিত্রগুলোকে বিকশিত করার প্রক্রিয়া এবং ভাষার গাঁথুনী অসম্ভব শক্তিশালী। হোয়াইট টাইগার এবং গড অব স্মল থিংস, প্রায় পরপর পড়েছি। মনে আছে পড়ার পর অন্তত এক সপ্তাহ ভীষণ উত্তেজনার মধ্যে ছিলাম। যার সাথেই কথা হতো, এই দুই বই এবং লেখকদের গল্প করতাম। দক্ষিণ ভারতীয় সব বন্ধুদের হঠাৎ সাথে এই বইগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। হোয়াইট টাইগার এর যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হলো অরবিন্দ আদিগার গল্প বলার স্টাইল। ভিন্ন এবং খুবই ইন্টারেস্টিং! ভাষার প্রতি যথেষ্ট দখল না থাকলে, আমি মনে করিনা গল্প বলার ঢঙ কে এরকম উপভোগ্য করা যেতে পারে। বাঙ্গালনামার কথা অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। আমি মোটামুটি ভালোই দ্রুতগতির পাঠক। কিন্তু এই বইটি আমি অত্যন্ত ধীর গতিতে পড়ছি। এক এক পৃষ্ঠার কিছু অংশ কয়েকবার করে পড়ি। তপন রায় চৌধুরীর লেখা অনেকটা সুস্বাদু খাবারের মত। ইচ্ছে করে দীর্ঘদিন সেই স্বাদ জিভে লেগে থাকুক। তপন রায় চৌধুরীর কাছ থেকে সত্যি বলতে বাংলা ভাষাটি আবার ঝালাই করে নিচ্ছি।


গল্পপাঠ : ৫. 
সেরা গল্পটি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ বলুন।

রুবিনা খানম : ৫
আগেই বলেছি মূলত বাংলা সাহিত্যের বহু আগের পড়া ছোটগল্পগুলো আবার মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। সুতরাং একটি মাত্র সেরা গল্পের কথা বলা কঠিন। তবে দু’টো গল্পের কথা উল্লেখ করি- হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবী গাছ এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি তুলসী গাছের কাহিনী। এই দু’টো গল্পের প্রথম বাক্যটিই যথেষ্ট একটি পাঠককে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করার জন্য। শব্দ বা বাক্যগঠনের ক্ষেত্রে খুব একটা বাগাড়ম্বর বা ঘনঘটা নেই। কিন্তু প্রতিটি বাক্যে একধরণের মায়া আছে। প্রতিটি বাক্য শেষ করার পর মনে হয় শেষ হইয়াও হইলো না শেষ, এর ভেতরে, খুব গভীরে আরও কিছু আছে। গল্প শেষ করার পর হয়তো চোখে জলের ছোঁয়া নেই, কিন্তু শরীরের ভিতরে কোন একটি অংশ কেউ যেন দুমড়ে মুচড়ে দেয়। গলাটা ভীষণ ভারী ঠেকে, দীর্ঘক্ষণ পড়ার জায়গাটি ছেড়ে নড়া যায়না।


গল্পপাঠ : ৬.
আপনি কি মনে করেন—এই গল্পগুলো বাংলাদেশের চিরায়ত গল্পগুলোর সমতুল্য বা তাদেরকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে?

রুবিনা খানম : ৬
আমি যদি বর্তমানে যারা গল্প লিখছেন তাদের কথা বলি, তাহলে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হবে, আসলে এদের অধিকাংশই কোন গল্প লিখছেন না বা লিখতে পারছেন না (একান্তই ব্যক্তিগত মতামত)। মোট কথা, বর্তমান অধিকাংশ গল্প লেখকদের লেখা গল্প, আমার কাছে “গল্প” ই মনে হয়না। বাংলাদেশের চিরায়ত গল্পগুলোর সমতুল্য বা তাদেরকে অতিক্রম করতে সক্ষম হতে পেরেছে কী-না, এই প্রশ্ন এখনও অনেক দূরের। গত সপ্তাহেই একজন কবির লেখা একটি গল্প পড়লাম। পড়ার সময় আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন এটাকে “গল্প” বলা হচ্ছে। শব্দ, বাক্য, ভাষার গাঁথুনী-চমৎকার। চাইলে “ভাব” কেও সম্প্রসারণ করা যাবে। চরিত্র, প্লট, সেটিং কিছুই পরিষ্কার নয় (অন্তত আমার কাছে)। চেষ্টা করলে কোন কবির গল্প বের করা যাবে। কিন্তু তার জন্য পাঠকের চেষ্টা করতে হবে। গল্প লেখক তার চমৎকার সব শব্দের জাল বুনে “গল্প” টিই তার মধ্যে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন।


গল্পপাঠ : ৭.
বিদেশি গল্পের সঙ্গে এ গল্পগুলোর মানকে কিভাবে তুলনা করবেন?

রুবিনা খানম : ৭
বিদেশি গল্প মানেই যে ভালো গল্প, এমন নয়। তবে চিরায়ত বাংলা গল্পের সাথে চিরায়ত বিদেশি গল্পের তুলনা আসতে পারে। চিরায়ত বাংলা গল্প এবং সাহিত্য নানাদিক থেকেই অনেক সমৃদ্ধ। যেকোন ভালো গল্পই মাঝে মাঝে দেশ, কাল এবং পাত্রের সীমা অতিক্রম করতে পারে। যদি বর্তমান বাংলা গল্পগুলোর কথা বলি, তাহলে বলতে হবে – লেখক তার নিজস্ব স্বত্তাটিকেই তাঁর গল্পে অধিকাংশ সময় অতিক্রম করতে পারেননা। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে গল্পটির চরিত্র হয়ে উঠেন না। একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লেই লেখকের নিজের চেহারাটিই দেখতে পাওয়া যায়। একটু কষ্ট করলে, লেখকের জেন্ডার, বয়স সবই বের করে ফেলা যায় শুধুমাত্র তাঁর গল্পটি থেকে। একজন রফিক যখন নীরার গল্প বলতে গিয়ে, নীরার মধ্যে রফিকই রয়ে যায়, জানিনা সেটা আদৌ গল্প হয়ে উঠে কী-না!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ