বিশ বছর, বলা চলে শান্তিপূর্ণ সংসার জীবন যাপন করে যখন তারা আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিলো, সেটি সহেলি খানের জন্য নির্ভাবনার হলেও দিল হাসনাত খানের জন্য তা ছিল দুর্ভাবনার। এই কসমোপলিটান শহরে মাথা গোঁজার আর কোন ঠাই নেই তার। দিল হাসনাত খান পরনের কিছু জামা কাপড় একটি সুটকেসে ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ফ্লাট থেকে। অপরিসর লিফট এর গুমোট ভাব, দশ ওয়াট বাল্ব এর জন্ডিস আলো তার বিদায়ের ক্ষণটিকে বিবর্ণ করে তুলেছিল। একবার পিছনে ফিরে তাকানোর মতো সাহস তার ছিল না।
দুজনের তিলেতিলে গড়ে তোলা সঞ্চয়ে যুগল জীবনের দশ বছরের মাথায় কিনেছিল আদাবরের এই ফ্লাটটা। লোনের টাকা পরিশোধ হওয়ায় গত বছর ব্যাংক থেকে ফ্লাটের দলিলটা হাতে পেয়েছে। মাথা গোঁজার এই ঠাঁই টুকুর জন্য এতোদিন ধরে লোনের বোঝা টানতে টানতে তারা দুজনেই ক্লান্ত।
তিন রুমের এ ফ্লাটটি আগে ছোট মনে হলেও এখন গড়ের মাঠ মনে হয়। দেয়ালে হঠাৎ ডেকে ওঠা টিকটিকির শব্দেও এখন চমকে ওঠে সহেলি খান। সংসারের যাবতীয় কাজ নিজের হাতে করার যে কী যন্ত্রণা তা এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সকালের নাস্তা, দুপুরের টিফিন রেডি করে অফিসে যাওয়ার আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফ্লাটের বয়সী কাজের মেয়ে চাঁদ সুলতানাকে বিদায় করা হয়েছে দিল হাসনাত খানের বেরিয়ে যাওয়ার আগের দিন।
এই ফ্লাটে ওঠার পর কত নির্ভাবনার জীবন ছিল তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে যখন চায়ের কাপে চুমুক দিত তখন নীচে অফিসের গাড়ীর হর্ন শোনা যেত। দু মিনিটেই নীচে চলে যেত সহেলি খান। চাঁদ সুলতানা ব্যাগে পুরে দিত দুপুরের টিফিন। দিল হাসনত খানের গাড়ী আসতো আরও পরে। কর্পোরেট অফিসের মতো সরকারি অফিসে উপস্থিতির এতো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই ধীরে সুস্থে গদাই লস্করি চালে বেরিয়ে পড়তো অফিসের পানে। চাঁদ সুলতানা একসঙ্গে বানানো সকলের নাস্তা টেবিলে দিয়ে অফিসের টিফিন ভরে দিত ব্যাগে। মাঝে মাঝে কাজ না থাকলে বা অফিসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা না থাকলে দুপুরেই চলে আসতো বাসায়। দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটা দিবা নিদ্রা দিয়ে যখন সে জেগে উঠত তখন সহেলি খান গলার ভাঁজে ভাঁজে থকথকে ঘাম নিয়ে ঘরে ঢুকত। এসির বাতাসে হিম ঠাণ্ডা ঘরের বিছানায় বসে নিস্তেজ গলায় বলতো-
"আল্লার আসলে বিচার বুদ্ধি কমে গেছে। আমার চাকুরিটা তোমার আর তোমার চাকুরিটা আমার হলে দোষের কি ছিল? আর ফ্লাটটা কেনার সময় বললাম, অফিসের আশে পাশে কিনতে কিন্তু না, টাকা বেশি লাগে আর মুক্ত আলো বাতাসের জন্য উনি কিনলেন ঝিলের ধারে। এখন তো আর মুক্ত আলো বাতাস নেই। ঝিল ভরাট করে তোলা হয়েছে অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি। আদাবর এখন পুরোটাই বস্তি।"
দিল হাসনাত খান আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে-"পরের জন্মে আমাকে হয়তো অনেক কষ্টের কাজ করতে হবে, সে কারণেই আল্লা হয়তো আমাকে এ সুখটুকু দিয়েছেন।"
এ ফ্লাটটির যখন তারা বুকিং দেয় তখন তাদের বিয়ে এবং চাকুরির দশ বছর পূর্তি হয়ে গেছে। এ দশ বছরেরে তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়েও ফ্লাটের বুকিং মানি হচ্ছিল না। নিজের বাড়ি হবে এ আশায় সহেলি খান বিয়েতে পাওয়া তার সমস্ত গহনা তুলে দিয়েছিল দিল হাসনাত খানের হাতে। ছিনতাই হওয়ার ভয়ে গহনাগুলো কখনও পড়া হয় না আর প্রতি বছর গহনাগুলো রাখার জন্য ব্যাংকে হাজার দশেক টাকা গুনতে হয়, তাই এগুলো বিক্রি করে কাজে লাগানো ভালো-কষ্টের মাঝে এমন একটা সান্ত্বনা খুঁজে ছিল সহেলি খান। দিল হাসনাত খান অবশ্য গহনাগুলো বিক্রি কতে আপত্তি করেছিল, ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত লোন নেয়ার কথা বলেছিল। সহেলি খান তা শোনেনি। নিজের বাড়ির স্বপ্নে বুদ হয়ে থাকা সহেলি খানের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল নিজের বাড়ি, সাজানো গোছানো সংসার।
ফ্লাটের যখন মালিকানা হস্তান্তর হবে তখন সহেলি খান চেয়েছিল দুজনের নামেই হোক। দলিলের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করেছে দিল হাসনাত খান। উকিলের কাছে দৌড়াদৌড়ি, ডেভেলপারের সঙ্গে যোগাযোগ সব একহাতে করেছে সে। রেজিস্ট্রি অফিসে স্বাক্ষর করতে গিয়ে সহেলি খান দেখল স্বাক্ষরের জায়গায় একজনের নাম। স্বাক্ষর করার আগে দিল হাসনাত খানের দিকে তাকালে সে চোখ টিপে স্বাক্ষর করতে বলেছিল। সে সময় আনন্দে কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে গিয়েছিল সহেলি খানের। সবার অলক্ষ্যে দু-ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়েছিল দলিলের কার্টিজ পেপারের উপর। চোখের জলের সে দাগ এখনও আছে বাসার দলিলে।
মনে পড়ে স্বাক্ষর করে আসার পর সে রাত তারা কাটিয়ে দিয়েছিল না ঘুমিয়ে। বাসর রাতের পর এই প্রথম আর একটা রাত তারা কাটিয়ে দিলো উত্তেজনা আর নির্ভাবনাকে সঙ্গী করে। সে রাতে মাখো মাখো আবেগ যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার স্বচ্ছ রূপরেখা। পরিকল্পনার রূপরেখা করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে হয়ে গেছে তা কেউ জানতেই পারেনি। দোতলা ভাড়া বাসার জানালার পাশে অপরিসর জায়গায় আলোর জন্যে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বেড়ে ওঠা আম গাছটার ডালে চড়ুই পাখিগুলো যখন কিচির মিচির শব্দ করতে লাগলো তখন আবেগের অতিশয্যে ক্লান্ত হয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
একমাত্র মেয়েটা এতোদিন তাদের সাথেই ঘুমাতো। ফ্লাটে ওঠার পর মাষ্টার বেডের লাগোয়া রুমটার সে দখল নিয়ে নিলো। নতুন বাসার জন্যে কেনাকাটা করার আগেই চাহিদা মোতাবেক তার রুমের জন্য সবকিছু কিনতে হলো। তিনজনের থাকা খাওয়া, আলো বাতাস, ওয়াস রুমের ব্যবহার সবকিছুতেই সুবিধা। আগে দুরুমের ছোট ভাড়া বাসায় ছিলো একটা ওয়াসরুম, সকালে উঠে মা-মেয়ের মাঝে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। কেউ একজন বেশিক্ষণ তা দখল করে থাকলে রঙচটা কাঠের দরজায় তখন অবিরাম কিলঘুষি পড়তো। ঝকঝকে তকতকে নতুন বাসায় সবদিক দিয়ে সুবিধা হলেও অসুবিধা একটা থেকেই গেল। আগে মেয়ের স্কুল ছিলো ভাড়া বাসার কাছেই। দিল হাসনাত খানের দুর সম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা পড়তো একই স্কুলে, স্কুল শেষে মেয়েটা তাদের সাথে চলে যেত সে বাসায়। অফিস শেষে দিল হাসনাত খান বা সহেলি খান যে আগে ফিরতো, সেই মেয়েকে নিয়ে আসতো। এমনও দিন গেছে বিকেল বেলা ঘুমিয়ে পড়া মেয়েকে কোলে করে বাসায় ফিরতো।
নতুন ফ্লাটে ওঠার পর প্রতি সপ্তাহে গ্রামের বাড়ী যায় দিল হাসনাত খান। একটা স্থায়ী কাজের লোক সে হণ্যে হয়ে খুঁজছে। কিন্তু গ্রাম থেকে এখন কাজের লোক জোটানো আর বাঘের দুধ মেলান প্রায় সমর্থক হয়ে গেছে। গ্রামের মেয়েরা কৈশোর কালেই এখন চলে আসে শহরে। কাজের মেয়ে নয়, চাকুরিজীবী হিসেবে তার জীবন শুরু করে গার্মেন্টস ইন্ডাট্রিতে। তারপরেও এক শনিবার চাদ সুলতানাকে নিয়ে বাসায় ফেরে দিল হাসনাত খান। মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে চাদ সুলতানার বাবা রাজী হয়েছে তার কিশোরী মেয়েকে রাখতে।
চাদ সুলতানাকে পাওয়ার পর তারা আকাশের চাঁদ হাতে পেল। তাকে শিখিয়ে পরিয়ে নিতে সহেলি খান অফিস থেকে পনের দিন ছুটি নিলো। কিন্তু চটপটে এই কিশোরী মেয়েটি সবকিছু এমন করে বুঝে নিলো যে সহেলি খান তার ছুটি বাতিল করে কাজে যোগ দিল। মেয়েটি এখন স্কুলে যায় বাসে করে, ছুটির পর আসেও স্কুল বাসে করে। বাস যখন আসে চাঁদ সুলতানা তখন গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। সাত বছরের মেয়েটির সাথে দশ বছরের চাদ সুলতানার সখি সখি ভাব হয়ে যায়।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর ভীষণ নি:সঙ্গতায় ভোগে সহেলি খান। এ লেভেল, ও লেভেলে এতো ভালো রেজাল্ট করে যে ওকে আটকে রাখাও যাচ্ছে না। সহেলি খান চেয়েছিলো অনার্সটা পাশ করে ও পড়তে যাক বাইরে কিন্তু জাপান সরকারের বৃত্তিটা যখন সে পেয়ে গেল তখন আর না করতে পারেনি। এরমাঝে মফস্বলের পাট চুকিয়ে দিল হাসনাত খান থিতু হয়েছে ঢাকায়। এ দশ বছরের প্রায় অর্ধেকটা কাটিয়েছে মফস্বলে। সপ্তাহান্তে বা পনের দিনে দু'তিন দিনের জন্য এসে আবার চলে গিয়েছে কর্মস্থলে। পুরো সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে চাদ সুলতানা। মাঝে মাঝে তার বাবা ভাই আসে, বিয়ের কথা বলে। বেতন বাড়ানোর আশ্বাস পেয়ে আবার চলে যায়। বাড়তে বাড়তে চাদ সুলতানার বেতন এখন গার্মেন্টস কর্মীদের কাছাকাছি। এখন অবশ্য সহেলি খান খুব একটা চিন্তিত নন তার সংসার দেখাশোনা নিয়ে। মেয়েটার দেখভালের জন্যই বাসায় একজনের সার্বক্ষনিক উপস্থিতি দরকার ছিলো। সে বাইরে পড়তে যাওয়ায় তার চিন্তা অনেকটাই কমে গেছে। তাছাড়া দিল হাসনাত খান এখন থিতু হয়েছে ঢাকায়। দুজনের সংসার মিলেমিশে চালিয়ে নেয়া খুব একটা কষ্টকর নয়।
মেয়ের শোক আর নিজের একাকিত্ব ভুলতে সহেলি খান বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে অফিসের কাজে। চাকুরীর বয়সের সাথে তার পদমর্যাদা বেড়েছে, বেড়েছে দায়িত্ব। এখন অফিসের অনেক প্রকল্প তাকে একাই বাস্তবায়ন করতে হয়। কিন্তু দিল হাসনাত খান তার ব্যতিক্রম। তার পদমর্যাদা বেড়েছে, দায়িত্ব বেডেছে, সাথে সাথে অফিস ফাঁকি দেয়ার প্রবনতাও বেড়েছে। সময় অসময়ে সে বাসায় ফেরে, শুয়ে বসে সময় কাটায়। কারন হিসেবে সে যা বলে তা বিশ্বাসযাগ্য মনে হয় না। অফিসের নিয়োগ নিয়ে তদ্বির হবে, ঝামেলা হবে তা ঠেকানোর জন্য বাসায় এসে পালিয়ে থাকা কোন সমাধান নয়। সহেলি খান বিষয়টি নিয়ে ভাবে। বিশ্বাসের যায়গাটুকু এতোই অটুট যে অবিশ্বাসের সেখানে কোন ঠাঁই হয় না।
দিন যায়, মাস যায়, দিল হাসনাত খানের কোন পরিবর্তন হয় না। অফিসের নিয়োগ সম্পর্কিত ঝামেলা শেষ হয়ে যায় কিন্তু অফিস ফাঁকি দেয়ার প্রবনতা কমে না বরং বাড়তে থাকে। চাদ সুলতানার মাঝেও কিছু বেপরোয়া ভাব সে লক্ষ্য করে। আগে বকা দিলে মাথা নীচু করে থাকতো, এখন সে মাথা তুলে তাকায়, কথার প্রতিত্তুরে কথা বলে। দিল হাসনাত খানও মাঝে মাঝে চাদ সুলতানার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। তার গ্রামের মেয়ে, আত্নীয়ের কাছাকাছি, তাকে এভাবে বকাঝকা করা ঠিক না। সহেলি খান অসহায় বোধ করে।
সহেলি খানের অফিসে এখন নি:শ্বাস ফেলার সময় নেই। কর্পোরেট অফিসে প্রশাসন চালানো খুব একটা ঝক্কি ঝামেলার না হলেও নিরাপত্তার বিষয়টি সকলকে চিন্তিত করে তুলেছে। বিশেষ করে দেশব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা ও নাশকতা বিষয়টি চিন্তা করে গত মাসের বোর্ড সভায় পুরো অফিসকে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সহেলি খানকে।
বিষয়টি সহেলি খানের কাছে নতুন, নতুন বলে দায়িত্ব এডিয়ে যাওয়ার মতো নয়। ছোটবেলা থেকেই চ্যালেন্জকে মোকাবেলা করার অদম্য স্পৃহা আছে তার মধ্যে। মনে পড়ে সেই কলেজ জীবনের কথা। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে কলেজ বার্ষিকী বের করা তার কর্তব্য । কিন্তু কাজটা এতো সহজ নয়, লেখা হয়তো সংগ্রহ করা যাবে কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা, প্রেসে বসে প্রুফ দেখা, কাজের তদারকি করতে দিন পার হয়ে সন্ধ্যা এমনকি মধ্যরাত হয়ে যায়। তাই সিদ্ধান্ত হয় সংসদের অন্য কাউকে সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়ে কাজটি করানো হবে, সহেলি খান সহ-সম্পাদক থাকবেন। কিন্তু বেঁকে বসে সহেলি খান। অনেকটা জোড করেই দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়ে কাজে। তখন ইসলামের ইতিহাসের সরকারি অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, তিনি আবার ছাত্র সংসদের কোষাধ্যক্ষ , বলেই বসেন-' দুনিয়াতে নারীর পর্দাপ্রথা বলে আর কিছু থাকলো না।'
কাজটা যতো সহজ মনে করেছিলো ততো সহজ না। মফস্বল শহরে বড় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো না, বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজ করতে হতো ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। সেসব প্রতিষ্ঠানে সহেলি খান যখন যেত তখন দোকানের মধ্যবয়সি মালিক একশত টাকা বিজ্ঞাপন দেয়ার কথা বলে অষ্টাদশি কলেজ পডুয়া একটি মেয়েকে বসিয়ে রাখতো ঘন্টার পর ঘন্টা। আলাপ জমানোর চেষ্টা করতো। মালিকের অনুপস্হিতিতে দোকানের কর্মচারীরা কথা বলতে চাইতে তার সাথে। মুদ্রণ শিল্প এতো আধুনিক ছিলো না। লেটার প্রেসে একটার পর একটা অক্ষর সাজিয়ে প্রুফ তৈরি করা হতো। তা সংশোধন করতে করতে দিন গড়িয়ে রাত। তারপরও দমে যায়নি সহেলি খান। তিন মাসের পরিশ্রমে যা বের হয়েছিলো তা দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা তো অবশ্যই, শিক্ষকরাও অবাক। ইদ্রিস আলী স্যার তখন বলেছিলেন-"সহেলি তো ডা: মাহফুজুর রহমানের মাইয়্যা না, ব্যাটা!"
কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, বিষয়টি সম্পর্কে ধারণাও নেই, তারপরও অফিসকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলার প্রকল্পটি হাতে নেয়। পডাশুনা করে, অভিজ্ঞ দু একজন এবং ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারী দু একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ করে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে দিল হাসনাত খানের সাথেও আলাপ করেছিলো সে। দিল হাসনাত খান তাচ্ছিল্য করে বলেছিলো- "তুমি তো আর কাজ পাও না, দুনিয়ার যতো ঝামেলা মাথায় করে ঘোরাফেরা করো।"
বানিজ্যের গন্ধ পেয়ে ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আনাগোনা বেড়ে যায়। প্রকল্পের কাজ ছোট হলেও টাকার অঙ্কটা ছোট নয়। পরিচিত জনের মাধ্যমে দুএকটি প্রতিষ্ঠান অনৈতিক প্রস্তাবও পাঠায়। ছোটবেলা থেকেই সততার জায়গাটি তার শক্ত। নিরবে নিভৃতে সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
এতোদিনে সহেলি খান জানতে পেরেছে সিসি ক্যামেরার নিরাপত্তার বিষয়টি নির্ভর করে এর নিরবিচ্ছিন্ন রেকর্ড ধারণের সক্ষমতার উপর । বিষয়টি পরীক্ষার জন্য ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠান দুটি প্রোটেবল ডিভাইস দিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। এ দুটি ডিভাইসে আগামী ২৪ ঘন্টার ধারণকৃত রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখবে সে। ডিভাইস দুটি একই সময়ে চালু করে একটি রেখে দেয় অফিসে, অন্যটি নিয়ে আসে বাসায়।
অফিস থেকে বাসার কাছাকাছি আসতেই সেলফোনে খবর পায়, তার বাবাকে নেয়া হয়েছে হাসপাতালে। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করায় নিজেই উদ্যোগী হয়ে গিয়েছে সে। হাসপাতালে পৌঁছার পর তাকে নেয়া হয়েছে নিবিড পরিচর্যা কেন্দ্রে। বাসায় এসে সবকিছু টেবিলের উপর রেখে অফিসের গাড়িতেই রওনা দিয়েছে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। দিল হাসনাত খান তখনও আসেনি। হাসপাতালে এসে ডাক্তারের কাছে সবকিছু শুনে আশ্বস্ত হয় সহেলি খান। দ্রুত হাসপাতালে আসায় কোন ক্ষতি হয়নি তার। দিল হাসনাত খান হাসপাতালে আসতে চেয়েছিলো, টেলিফোন করে তাকে সরাসরি বাসায় চলে যেতে বলে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। নিজের কাছে রাখা চাবি দিয়ে বাসায় ঢোকে সে। ততক্ষণে দিল হাসনাত খান খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পডেছে। রান্না ঘরের লাগোয়া ছোট ঘরটি থেকে চাদ সুলতানার নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
ঘন্টাধ্বনী শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় সহেলি খানের। চোখে ঘুম নিয়েই উঠে পড়ে সে। গতরাতের ক্লান্তি এখনও সারা শরীর জুড়ে। অফিসের গাড়ী আসার আগেই তাকে তৈরি হতে হবে। চাদ সুলতানা বরাবরের মতো অনেক আগে উঠে সবকিছু তৈরি করে রেখেছে। বলার প্রয়োজন নেই তবুও নাস্তা খেতে খেতে দুপুরে কী রান্না হবে তা বুঝিয়ে বলে। নীচে গাড়ীর হর্ণ শোনা গেলে বেডরুমে ঢুকে মশারির কোনাটা তুলে সদ্য ওঠা সাদা কালো দাঁড়ি সম্বলিত দিল হাসনাত খানের গালে একটা শব্দ করে চুমু দেয়, অনেকদিন পরে এ কাজটা করলো সে। মশারির কোনা ফেলতে ফেলতে দেখলো, গাল ভর্তি লিপিষ্টিকের দাগ। ঘুমের ঘোরেই আ-হা শব্দ করে হাত দিয়ে তা মুছে ফেলে দিল হাসনাত খান।
অফিসে এসে নিত্যদিনের প্রশাসনিক কাজ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে যায় সহেলি খানের তা খেয়াল থাকে না। আজ সকালেই চিন্তা করে রেখেছিলো, লাঞ্চের পর সিসি ক্যামেরার কাজগুলো নিয়ে বসবে। বারোটার পর থেকে দুই প্রতিষ্ঠানের দুইজন গেষ্টরুমে বসে আছে সে খবর পেয়েছে। লাঞ্চের পর তাদেরকে ডেকে কাজটি বুঝে নেয়। ২৪ ঘন্টার রেকর্ডিং দেখার সময় তারা অবশ্য থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু সহেলি খান রাজি হননি। মেমোরি কার্ড ডিভাইস থেকে খুলে নিয়ে তাদেরকে বিদায় করেছিলো। মেমোরি কার্ড থেকে রেকর্ড কিভাবে সাথে সাথে সেন্ট্রাল সার্ভারে ট্রান্সফার হবে সেটিও বলে দিয়েছিলো তারা।
চাদ সুলতানার তৈরি করে দেয়া নাস্তা খেতে খেতেই কম্পিউটারে ফরোয়ার্ড করে দেখতে থাকে রেকর্ডিং। প্রথম ক্যামেরার রেকর্ড দেখে সহেলি খান সন্তুষ্ট । মাঝে মাঝে টিভিতে সিসি ক্যামেরার যে ফুটেজ সে দেখে তার চেয়ে এর রেকর্ডিং কোয়ালিটি বেশ উন্নতমানের । দ্বিতীয় ক্যামেরার মেমোরি কার্ডটি কম্পিউটারে সে লাগিয়ে নেয়। লাঞ্চ শেষ করে এককাপ কফি নিয়ে অনেকটা আয়েসি ভঙ্গিতে সে ফরোয়ার্ড করে দেখতে থাকে। চল্লিশোর্ধ বয়সে কাজের চাপে এমনিতেই কপালে দুতিনটি ভাঁজ সবসময়ই থাকে, সে ভাঁজ দুতিনগুণ হয়ে সহেলি খান অফিসে বসেই অসুস্থ্য বোধ করেন। দিত্বীয় ক্যামেরার মেমোরিকার্ডটি ব্যাগে পুরে বস্ কে অসুস্থতার কথা বলে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে সহেলি খান। ড্রাইভারকে বলে গাড়ীর এসির তাপমাত্রা কয়েকদফা কমিয়ে নেয়ার পরও ঘামতে থাকে।
গাড়ীতে বসে অনেক কথাই মনে হচ্ছে তার। সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । মফস্বল শহরে সদ্য পোষ্টিং নিয়ে আসা দিল হাসনাত খানের খবর আসে বাবার কাছে। কাজের ছলে বাবা তার অফিসে গিয়ে দেখে। ঝকঝকে এক তরুণ কর্মকর্তাকে দেখে বাবার মন ভরে যায়। সেদিনই টেলিগ্রাম করে বাবা। পরের সপ্তাহে এসে সে নিজেও দেখে আড়াল থেকে। পছন্দের কথা বলতেই বাবা উঠে পড়ে লেগে যায়। তার দুমাস পড়েই বিয়ে হয়ে যায় সহেলি খানের।
বিয়ের পরেও দুবছর পডাশুনা করেছিলো সহেলি খান। এ দুবছরে এক সপ্তাহে বাড়ী গিয়েছে সহেলি খান, আরেক সপ্তাহে ঢাকা এসেছে দিল হাসনাত খান। বান্ধবীরা এ নিয়ে কত হাসাহাসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মাসে তো দুরের কথা তিনচার মাসেও বাড়ী যায়নি সে আর এখন প্রতি দুসপ্তাহে একবার দেখা পায় তার। আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে তো কথাই নেই, তখন তার ঠিকানা হয়ে যায় এ শহর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই এ চাকুরিটা হয়ে যায় তার। তখন আর ঢাকায় স্থায়ী হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দিল হাসনাত খান বদলি হয়ে আসে ঢাকায়। তখন তারা এর আশেপাশেই ভাড়া বাড়িতে সংসার শুরু করে। এ ফ্লাটে ওঠার আগে পর্যন্ত তারা সে বাডীতেই কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের অনেকটা বছর।
চাদ সুলতানা এ অসময়ে সহেলি খানকে দেখে বেশ অবাকই হয়। দিল হাসনাত খানের মতো অফিস ফাঁকি দিয়ে সে সাধারণত বাসায় আসে না। "ভাবীর কী শরীর খারাপ"- বলে সে সহেলি খানের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে টেবিলে রাখে। সহেলি খান কোন কথা না বলে ঢুকে যায় বাথরুমে। ঠান্ডা পানিতে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে। তারপর কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পডে। ঘুমানোর আগে কেউ যেন তাকে না ডাকে সে বিষয়ে বলে দেয় চাদ সুলতানাকে। ড্রইংরুমে চাদ সুলতানার ভাই আর দিল হাসনাত খানের আলাপে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। সে শুনতে পায় - "তিনটার দিকে ভাবী ফোন করে খবর দিয়েছে জরুরী ভিত্তিতে আসার জন্য। খবর পেয়েই রওনা দিয়েছি।"
সন্ধ্যার দিকে চাঁদ সুলতানার সমস্ত পাওনা পরিশোধ করে যখন তাকে একেবারে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন এর কারন জানতে চেয়েছিলো দিল হাসনাত খান। কিন্তু সহেলি খানের ক্রুর দৃষ্টি আর গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয়বার তা আর উচ্চারণ করার সাহস হয়নি। সন্ধ্যার অনেক পরে চোখের জল মুছতে মুছতে বিদায় হলো চাদ সুলতানা ।
গভীর রাত পর্যন্ত ল্যাপটপ সামনে রেখে নির্বাক বসে থাকলো সহেলি খান আর দিল হাসনাত খান। কারো মুখেই কোন কথা নেই। সহেলি খানের মুখ জুডে আছে ঘৃনা, সে ঘৃণার ভার বহন করে বাকীটা পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব নয় আর দিল হাসনাত খানের মুখ জুড়ে ক্ষমা পাওয়ার আকুতি। ঘুমানোর আগে সহেলি খান নিস্পৃহ গলায় বলেছিলো- "এই ফ্লাট থেকে তোমার যা যা পছন্দ তা নিয়ে যেতে পারো"।
লেখক পরিচিতি
মোমিনুল আজম
গল্পকার, প্রবন্ধকার। কানাডা প্রবাসী
দুজনের তিলেতিলে গড়ে তোলা সঞ্চয়ে যুগল জীবনের দশ বছরের মাথায় কিনেছিল আদাবরের এই ফ্লাটটা। লোনের টাকা পরিশোধ হওয়ায় গত বছর ব্যাংক থেকে ফ্লাটের দলিলটা হাতে পেয়েছে। মাথা গোঁজার এই ঠাঁই টুকুর জন্য এতোদিন ধরে লোনের বোঝা টানতে টানতে তারা দুজনেই ক্লান্ত।
তিন রুমের এ ফ্লাটটি আগে ছোট মনে হলেও এখন গড়ের মাঠ মনে হয়। দেয়ালে হঠাৎ ডেকে ওঠা টিকটিকির শব্দেও এখন চমকে ওঠে সহেলি খান। সংসারের যাবতীয় কাজ নিজের হাতে করার যে কী যন্ত্রণা তা এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সকালের নাস্তা, দুপুরের টিফিন রেডি করে অফিসে যাওয়ার আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফ্লাটের বয়সী কাজের মেয়ে চাঁদ সুলতানাকে বিদায় করা হয়েছে দিল হাসনাত খানের বেরিয়ে যাওয়ার আগের দিন।
এই ফ্লাটে ওঠার পর কত নির্ভাবনার জীবন ছিল তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে যখন চায়ের কাপে চুমুক দিত তখন নীচে অফিসের গাড়ীর হর্ন শোনা যেত। দু মিনিটেই নীচে চলে যেত সহেলি খান। চাঁদ সুলতানা ব্যাগে পুরে দিত দুপুরের টিফিন। দিল হাসনত খানের গাড়ী আসতো আরও পরে। কর্পোরেট অফিসের মতো সরকারি অফিসে উপস্থিতির এতো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই ধীরে সুস্থে গদাই লস্করি চালে বেরিয়ে পড়তো অফিসের পানে। চাঁদ সুলতানা একসঙ্গে বানানো সকলের নাস্তা টেবিলে দিয়ে অফিসের টিফিন ভরে দিত ব্যাগে। মাঝে মাঝে কাজ না থাকলে বা অফিসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা না থাকলে দুপুরেই চলে আসতো বাসায়। দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটা দিবা নিদ্রা দিয়ে যখন সে জেগে উঠত তখন সহেলি খান গলার ভাঁজে ভাঁজে থকথকে ঘাম নিয়ে ঘরে ঢুকত। এসির বাতাসে হিম ঠাণ্ডা ঘরের বিছানায় বসে নিস্তেজ গলায় বলতো-
"আল্লার আসলে বিচার বুদ্ধি কমে গেছে। আমার চাকুরিটা তোমার আর তোমার চাকুরিটা আমার হলে দোষের কি ছিল? আর ফ্লাটটা কেনার সময় বললাম, অফিসের আশে পাশে কিনতে কিন্তু না, টাকা বেশি লাগে আর মুক্ত আলো বাতাসের জন্য উনি কিনলেন ঝিলের ধারে। এখন তো আর মুক্ত আলো বাতাস নেই। ঝিল ভরাট করে তোলা হয়েছে অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি। আদাবর এখন পুরোটাই বস্তি।"
দিল হাসনাত খান আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে-"পরের জন্মে আমাকে হয়তো অনেক কষ্টের কাজ করতে হবে, সে কারণেই আল্লা হয়তো আমাকে এ সুখটুকু দিয়েছেন।"
এ ফ্লাটটির যখন তারা বুকিং দেয় তখন তাদের বিয়ে এবং চাকুরির দশ বছর পূর্তি হয়ে গেছে। এ দশ বছরেরে তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়েও ফ্লাটের বুকিং মানি হচ্ছিল না। নিজের বাড়ি হবে এ আশায় সহেলি খান বিয়েতে পাওয়া তার সমস্ত গহনা তুলে দিয়েছিল দিল হাসনাত খানের হাতে। ছিনতাই হওয়ার ভয়ে গহনাগুলো কখনও পড়া হয় না আর প্রতি বছর গহনাগুলো রাখার জন্য ব্যাংকে হাজার দশেক টাকা গুনতে হয়, তাই এগুলো বিক্রি করে কাজে লাগানো ভালো-কষ্টের মাঝে এমন একটা সান্ত্বনা খুঁজে ছিল সহেলি খান। দিল হাসনাত খান অবশ্য গহনাগুলো বিক্রি কতে আপত্তি করেছিল, ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত লোন নেয়ার কথা বলেছিল। সহেলি খান তা শোনেনি। নিজের বাড়ির স্বপ্নে বুদ হয়ে থাকা সহেলি খানের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল নিজের বাড়ি, সাজানো গোছানো সংসার।
ফ্লাটের যখন মালিকানা হস্তান্তর হবে তখন সহেলি খান চেয়েছিল দুজনের নামেই হোক। দলিলের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করেছে দিল হাসনাত খান। উকিলের কাছে দৌড়াদৌড়ি, ডেভেলপারের সঙ্গে যোগাযোগ সব একহাতে করেছে সে। রেজিস্ট্রি অফিসে স্বাক্ষর করতে গিয়ে সহেলি খান দেখল স্বাক্ষরের জায়গায় একজনের নাম। স্বাক্ষর করার আগে দিল হাসনাত খানের দিকে তাকালে সে চোখ টিপে স্বাক্ষর করতে বলেছিল। সে সময় আনন্দে কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে গিয়েছিল সহেলি খানের। সবার অলক্ষ্যে দু-ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়েছিল দলিলের কার্টিজ পেপারের উপর। চোখের জলের সে দাগ এখনও আছে বাসার দলিলে।
মনে পড়ে স্বাক্ষর করে আসার পর সে রাত তারা কাটিয়ে দিয়েছিল না ঘুমিয়ে। বাসর রাতের পর এই প্রথম আর একটা রাত তারা কাটিয়ে দিলো উত্তেজনা আর নির্ভাবনাকে সঙ্গী করে। সে রাতে মাখো মাখো আবেগ যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার স্বচ্ছ রূপরেখা। পরিকল্পনার রূপরেখা করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে হয়ে গেছে তা কেউ জানতেই পারেনি। দোতলা ভাড়া বাসার জানালার পাশে অপরিসর জায়গায় আলোর জন্যে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বেড়ে ওঠা আম গাছটার ডালে চড়ুই পাখিগুলো যখন কিচির মিচির শব্দ করতে লাগলো তখন আবেগের অতিশয্যে ক্লান্ত হয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
একমাত্র মেয়েটা এতোদিন তাদের সাথেই ঘুমাতো। ফ্লাটে ওঠার পর মাষ্টার বেডের লাগোয়া রুমটার সে দখল নিয়ে নিলো। নতুন বাসার জন্যে কেনাকাটা করার আগেই চাহিদা মোতাবেক তার রুমের জন্য সবকিছু কিনতে হলো। তিনজনের থাকা খাওয়া, আলো বাতাস, ওয়াস রুমের ব্যবহার সবকিছুতেই সুবিধা। আগে দুরুমের ছোট ভাড়া বাসায় ছিলো একটা ওয়াসরুম, সকালে উঠে মা-মেয়ের মাঝে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। কেউ একজন বেশিক্ষণ তা দখল করে থাকলে রঙচটা কাঠের দরজায় তখন অবিরাম কিলঘুষি পড়তো। ঝকঝকে তকতকে নতুন বাসায় সবদিক দিয়ে সুবিধা হলেও অসুবিধা একটা থেকেই গেল। আগে মেয়ের স্কুল ছিলো ভাড়া বাসার কাছেই। দিল হাসনাত খানের দুর সম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা পড়তো একই স্কুলে, স্কুল শেষে মেয়েটা তাদের সাথে চলে যেত সে বাসায়। অফিস শেষে দিল হাসনাত খান বা সহেলি খান যে আগে ফিরতো, সেই মেয়েকে নিয়ে আসতো। এমনও দিন গেছে বিকেল বেলা ঘুমিয়ে পড়া মেয়েকে কোলে করে বাসায় ফিরতো।
নতুন ফ্লাটে ওঠার পর প্রতি সপ্তাহে গ্রামের বাড়ী যায় দিল হাসনাত খান। একটা স্থায়ী কাজের লোক সে হণ্যে হয়ে খুঁজছে। কিন্তু গ্রাম থেকে এখন কাজের লোক জোটানো আর বাঘের দুধ মেলান প্রায় সমর্থক হয়ে গেছে। গ্রামের মেয়েরা কৈশোর কালেই এখন চলে আসে শহরে। কাজের মেয়ে নয়, চাকুরিজীবী হিসেবে তার জীবন শুরু করে গার্মেন্টস ইন্ডাট্রিতে। তারপরেও এক শনিবার চাদ সুলতানাকে নিয়ে বাসায় ফেরে দিল হাসনাত খান। মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে চাদ সুলতানার বাবা রাজী হয়েছে তার কিশোরী মেয়েকে রাখতে।
চাদ সুলতানাকে পাওয়ার পর তারা আকাশের চাঁদ হাতে পেল। তাকে শিখিয়ে পরিয়ে নিতে সহেলি খান অফিস থেকে পনের দিন ছুটি নিলো। কিন্তু চটপটে এই কিশোরী মেয়েটি সবকিছু এমন করে বুঝে নিলো যে সহেলি খান তার ছুটি বাতিল করে কাজে যোগ দিল। মেয়েটি এখন স্কুলে যায় বাসে করে, ছুটির পর আসেও স্কুল বাসে করে। বাস যখন আসে চাঁদ সুলতানা তখন গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। সাত বছরের মেয়েটির সাথে দশ বছরের চাদ সুলতানার সখি সখি ভাব হয়ে যায়।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর ভীষণ নি:সঙ্গতায় ভোগে সহেলি খান। এ লেভেল, ও লেভেলে এতো ভালো রেজাল্ট করে যে ওকে আটকে রাখাও যাচ্ছে না। সহেলি খান চেয়েছিলো অনার্সটা পাশ করে ও পড়তে যাক বাইরে কিন্তু জাপান সরকারের বৃত্তিটা যখন সে পেয়ে গেল তখন আর না করতে পারেনি। এরমাঝে মফস্বলের পাট চুকিয়ে দিল হাসনাত খান থিতু হয়েছে ঢাকায়। এ দশ বছরের প্রায় অর্ধেকটা কাটিয়েছে মফস্বলে। সপ্তাহান্তে বা পনের দিনে দু'তিন দিনের জন্য এসে আবার চলে গিয়েছে কর্মস্থলে। পুরো সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে চাদ সুলতানা। মাঝে মাঝে তার বাবা ভাই আসে, বিয়ের কথা বলে। বেতন বাড়ানোর আশ্বাস পেয়ে আবার চলে যায়। বাড়তে বাড়তে চাদ সুলতানার বেতন এখন গার্মেন্টস কর্মীদের কাছাকাছি। এখন অবশ্য সহেলি খান খুব একটা চিন্তিত নন তার সংসার দেখাশোনা নিয়ে। মেয়েটার দেখভালের জন্যই বাসায় একজনের সার্বক্ষনিক উপস্থিতি দরকার ছিলো। সে বাইরে পড়তে যাওয়ায় তার চিন্তা অনেকটাই কমে গেছে। তাছাড়া দিল হাসনাত খান এখন থিতু হয়েছে ঢাকায়। দুজনের সংসার মিলেমিশে চালিয়ে নেয়া খুব একটা কষ্টকর নয়।
মেয়ের শোক আর নিজের একাকিত্ব ভুলতে সহেলি খান বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে অফিসের কাজে। চাকুরীর বয়সের সাথে তার পদমর্যাদা বেড়েছে, বেড়েছে দায়িত্ব। এখন অফিসের অনেক প্রকল্প তাকে একাই বাস্তবায়ন করতে হয়। কিন্তু দিল হাসনাত খান তার ব্যতিক্রম। তার পদমর্যাদা বেড়েছে, দায়িত্ব বেডেছে, সাথে সাথে অফিস ফাঁকি দেয়ার প্রবনতাও বেড়েছে। সময় অসময়ে সে বাসায় ফেরে, শুয়ে বসে সময় কাটায়। কারন হিসেবে সে যা বলে তা বিশ্বাসযাগ্য মনে হয় না। অফিসের নিয়োগ নিয়ে তদ্বির হবে, ঝামেলা হবে তা ঠেকানোর জন্য বাসায় এসে পালিয়ে থাকা কোন সমাধান নয়। সহেলি খান বিষয়টি নিয়ে ভাবে। বিশ্বাসের যায়গাটুকু এতোই অটুট যে অবিশ্বাসের সেখানে কোন ঠাঁই হয় না।
দিন যায়, মাস যায়, দিল হাসনাত খানের কোন পরিবর্তন হয় না। অফিসের নিয়োগ সম্পর্কিত ঝামেলা শেষ হয়ে যায় কিন্তু অফিস ফাঁকি দেয়ার প্রবনতা কমে না বরং বাড়তে থাকে। চাদ সুলতানার মাঝেও কিছু বেপরোয়া ভাব সে লক্ষ্য করে। আগে বকা দিলে মাথা নীচু করে থাকতো, এখন সে মাথা তুলে তাকায়, কথার প্রতিত্তুরে কথা বলে। দিল হাসনাত খানও মাঝে মাঝে চাদ সুলতানার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। তার গ্রামের মেয়ে, আত্নীয়ের কাছাকাছি, তাকে এভাবে বকাঝকা করা ঠিক না। সহেলি খান অসহায় বোধ করে।
সহেলি খানের অফিসে এখন নি:শ্বাস ফেলার সময় নেই। কর্পোরেট অফিসে প্রশাসন চালানো খুব একটা ঝক্কি ঝামেলার না হলেও নিরাপত্তার বিষয়টি সকলকে চিন্তিত করে তুলেছে। বিশেষ করে দেশব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা ও নাশকতা বিষয়টি চিন্তা করে গত মাসের বোর্ড সভায় পুরো অফিসকে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সহেলি খানকে।
বিষয়টি সহেলি খানের কাছে নতুন, নতুন বলে দায়িত্ব এডিয়ে যাওয়ার মতো নয়। ছোটবেলা থেকেই চ্যালেন্জকে মোকাবেলা করার অদম্য স্পৃহা আছে তার মধ্যে। মনে পড়ে সেই কলেজ জীবনের কথা। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে কলেজ বার্ষিকী বের করা তার কর্তব্য । কিন্তু কাজটা এতো সহজ নয়, লেখা হয়তো সংগ্রহ করা যাবে কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা, প্রেসে বসে প্রুফ দেখা, কাজের তদারকি করতে দিন পার হয়ে সন্ধ্যা এমনকি মধ্যরাত হয়ে যায়। তাই সিদ্ধান্ত হয় সংসদের অন্য কাউকে সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়ে কাজটি করানো হবে, সহেলি খান সহ-সম্পাদক থাকবেন। কিন্তু বেঁকে বসে সহেলি খান। অনেকটা জোড করেই দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়ে কাজে। তখন ইসলামের ইতিহাসের সরকারি অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, তিনি আবার ছাত্র সংসদের কোষাধ্যক্ষ , বলেই বসেন-' দুনিয়াতে নারীর পর্দাপ্রথা বলে আর কিছু থাকলো না।'
কাজটা যতো সহজ মনে করেছিলো ততো সহজ না। মফস্বল শহরে বড় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো না, বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজ করতে হতো ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। সেসব প্রতিষ্ঠানে সহেলি খান যখন যেত তখন দোকানের মধ্যবয়সি মালিক একশত টাকা বিজ্ঞাপন দেয়ার কথা বলে অষ্টাদশি কলেজ পডুয়া একটি মেয়েকে বসিয়ে রাখতো ঘন্টার পর ঘন্টা। আলাপ জমানোর চেষ্টা করতো। মালিকের অনুপস্হিতিতে দোকানের কর্মচারীরা কথা বলতে চাইতে তার সাথে। মুদ্রণ শিল্প এতো আধুনিক ছিলো না। লেটার প্রেসে একটার পর একটা অক্ষর সাজিয়ে প্রুফ তৈরি করা হতো। তা সংশোধন করতে করতে দিন গড়িয়ে রাত। তারপরও দমে যায়নি সহেলি খান। তিন মাসের পরিশ্রমে যা বের হয়েছিলো তা দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা তো অবশ্যই, শিক্ষকরাও অবাক। ইদ্রিস আলী স্যার তখন বলেছিলেন-"সহেলি তো ডা: মাহফুজুর রহমানের মাইয়্যা না, ব্যাটা!"
কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, বিষয়টি সম্পর্কে ধারণাও নেই, তারপরও অফিসকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলার প্রকল্পটি হাতে নেয়। পডাশুনা করে, অভিজ্ঞ দু একজন এবং ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারী দু একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ করে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে দিল হাসনাত খানের সাথেও আলাপ করেছিলো সে। দিল হাসনাত খান তাচ্ছিল্য করে বলেছিলো- "তুমি তো আর কাজ পাও না, দুনিয়ার যতো ঝামেলা মাথায় করে ঘোরাফেরা করো।"
বানিজ্যের গন্ধ পেয়ে ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আনাগোনা বেড়ে যায়। প্রকল্পের কাজ ছোট হলেও টাকার অঙ্কটা ছোট নয়। পরিচিত জনের মাধ্যমে দুএকটি প্রতিষ্ঠান অনৈতিক প্রস্তাবও পাঠায়। ছোটবেলা থেকেই সততার জায়গাটি তার শক্ত। নিরবে নিভৃতে সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
এতোদিনে সহেলি খান জানতে পেরেছে সিসি ক্যামেরার নিরাপত্তার বিষয়টি নির্ভর করে এর নিরবিচ্ছিন্ন রেকর্ড ধারণের সক্ষমতার উপর । বিষয়টি পরীক্ষার জন্য ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠান দুটি প্রোটেবল ডিভাইস দিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। এ দুটি ডিভাইসে আগামী ২৪ ঘন্টার ধারণকৃত রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখবে সে। ডিভাইস দুটি একই সময়ে চালু করে একটি রেখে দেয় অফিসে, অন্যটি নিয়ে আসে বাসায়।
অফিস থেকে বাসার কাছাকাছি আসতেই সেলফোনে খবর পায়, তার বাবাকে নেয়া হয়েছে হাসপাতালে। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করায় নিজেই উদ্যোগী হয়ে গিয়েছে সে। হাসপাতালে পৌঁছার পর তাকে নেয়া হয়েছে নিবিড পরিচর্যা কেন্দ্রে। বাসায় এসে সবকিছু টেবিলের উপর রেখে অফিসের গাড়িতেই রওনা দিয়েছে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। দিল হাসনাত খান তখনও আসেনি। হাসপাতালে এসে ডাক্তারের কাছে সবকিছু শুনে আশ্বস্ত হয় সহেলি খান। দ্রুত হাসপাতালে আসায় কোন ক্ষতি হয়নি তার। দিল হাসনাত খান হাসপাতালে আসতে চেয়েছিলো, টেলিফোন করে তাকে সরাসরি বাসায় চলে যেতে বলে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। নিজের কাছে রাখা চাবি দিয়ে বাসায় ঢোকে সে। ততক্ষণে দিল হাসনাত খান খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পডেছে। রান্না ঘরের লাগোয়া ছোট ঘরটি থেকে চাদ সুলতানার নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
ঘন্টাধ্বনী শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় সহেলি খানের। চোখে ঘুম নিয়েই উঠে পড়ে সে। গতরাতের ক্লান্তি এখনও সারা শরীর জুড়ে। অফিসের গাড়ী আসার আগেই তাকে তৈরি হতে হবে। চাদ সুলতানা বরাবরের মতো অনেক আগে উঠে সবকিছু তৈরি করে রেখেছে। বলার প্রয়োজন নেই তবুও নাস্তা খেতে খেতে দুপুরে কী রান্না হবে তা বুঝিয়ে বলে। নীচে গাড়ীর হর্ণ শোনা গেলে বেডরুমে ঢুকে মশারির কোনাটা তুলে সদ্য ওঠা সাদা কালো দাঁড়ি সম্বলিত দিল হাসনাত খানের গালে একটা শব্দ করে চুমু দেয়, অনেকদিন পরে এ কাজটা করলো সে। মশারির কোনা ফেলতে ফেলতে দেখলো, গাল ভর্তি লিপিষ্টিকের দাগ। ঘুমের ঘোরেই আ-হা শব্দ করে হাত দিয়ে তা মুছে ফেলে দিল হাসনাত খান।
অফিসে এসে নিত্যদিনের প্রশাসনিক কাজ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে যায় সহেলি খানের তা খেয়াল থাকে না। আজ সকালেই চিন্তা করে রেখেছিলো, লাঞ্চের পর সিসি ক্যামেরার কাজগুলো নিয়ে বসবে। বারোটার পর থেকে দুই প্রতিষ্ঠানের দুইজন গেষ্টরুমে বসে আছে সে খবর পেয়েছে। লাঞ্চের পর তাদেরকে ডেকে কাজটি বুঝে নেয়। ২৪ ঘন্টার রেকর্ডিং দেখার সময় তারা অবশ্য থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু সহেলি খান রাজি হননি। মেমোরি কার্ড ডিভাইস থেকে খুলে নিয়ে তাদেরকে বিদায় করেছিলো। মেমোরি কার্ড থেকে রেকর্ড কিভাবে সাথে সাথে সেন্ট্রাল সার্ভারে ট্রান্সফার হবে সেটিও বলে দিয়েছিলো তারা।
চাদ সুলতানার তৈরি করে দেয়া নাস্তা খেতে খেতেই কম্পিউটারে ফরোয়ার্ড করে দেখতে থাকে রেকর্ডিং। প্রথম ক্যামেরার রেকর্ড দেখে সহেলি খান সন্তুষ্ট । মাঝে মাঝে টিভিতে সিসি ক্যামেরার যে ফুটেজ সে দেখে তার চেয়ে এর রেকর্ডিং কোয়ালিটি বেশ উন্নতমানের । দ্বিতীয় ক্যামেরার মেমোরি কার্ডটি কম্পিউটারে সে লাগিয়ে নেয়। লাঞ্চ শেষ করে এককাপ কফি নিয়ে অনেকটা আয়েসি ভঙ্গিতে সে ফরোয়ার্ড করে দেখতে থাকে। চল্লিশোর্ধ বয়সে কাজের চাপে এমনিতেই কপালে দুতিনটি ভাঁজ সবসময়ই থাকে, সে ভাঁজ দুতিনগুণ হয়ে সহেলি খান অফিসে বসেই অসুস্থ্য বোধ করেন। দিত্বীয় ক্যামেরার মেমোরিকার্ডটি ব্যাগে পুরে বস্ কে অসুস্থতার কথা বলে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে সহেলি খান। ড্রাইভারকে বলে গাড়ীর এসির তাপমাত্রা কয়েকদফা কমিয়ে নেয়ার পরও ঘামতে থাকে।
গাড়ীতে বসে অনেক কথাই মনে হচ্ছে তার। সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । মফস্বল শহরে সদ্য পোষ্টিং নিয়ে আসা দিল হাসনাত খানের খবর আসে বাবার কাছে। কাজের ছলে বাবা তার অফিসে গিয়ে দেখে। ঝকঝকে এক তরুণ কর্মকর্তাকে দেখে বাবার মন ভরে যায়। সেদিনই টেলিগ্রাম করে বাবা। পরের সপ্তাহে এসে সে নিজেও দেখে আড়াল থেকে। পছন্দের কথা বলতেই বাবা উঠে পড়ে লেগে যায়। তার দুমাস পড়েই বিয়ে হয়ে যায় সহেলি খানের।
বিয়ের পরেও দুবছর পডাশুনা করেছিলো সহেলি খান। এ দুবছরে এক সপ্তাহে বাড়ী গিয়েছে সহেলি খান, আরেক সপ্তাহে ঢাকা এসেছে দিল হাসনাত খান। বান্ধবীরা এ নিয়ে কত হাসাহাসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মাসে তো দুরের কথা তিনচার মাসেও বাড়ী যায়নি সে আর এখন প্রতি দুসপ্তাহে একবার দেখা পায় তার। আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে তো কথাই নেই, তখন তার ঠিকানা হয়ে যায় এ শহর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই এ চাকুরিটা হয়ে যায় তার। তখন আর ঢাকায় স্থায়ী হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দিল হাসনাত খান বদলি হয়ে আসে ঢাকায়। তখন তারা এর আশেপাশেই ভাড়া বাড়িতে সংসার শুরু করে। এ ফ্লাটে ওঠার আগে পর্যন্ত তারা সে বাডীতেই কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের অনেকটা বছর।
চাদ সুলতানা এ অসময়ে সহেলি খানকে দেখে বেশ অবাকই হয়। দিল হাসনাত খানের মতো অফিস ফাঁকি দিয়ে সে সাধারণত বাসায় আসে না। "ভাবীর কী শরীর খারাপ"- বলে সে সহেলি খানের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে টেবিলে রাখে। সহেলি খান কোন কথা না বলে ঢুকে যায় বাথরুমে। ঠান্ডা পানিতে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে। তারপর কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পডে। ঘুমানোর আগে কেউ যেন তাকে না ডাকে সে বিষয়ে বলে দেয় চাদ সুলতানাকে। ড্রইংরুমে চাদ সুলতানার ভাই আর দিল হাসনাত খানের আলাপে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। সে শুনতে পায় - "তিনটার দিকে ভাবী ফোন করে খবর দিয়েছে জরুরী ভিত্তিতে আসার জন্য। খবর পেয়েই রওনা দিয়েছি।"
সন্ধ্যার দিকে চাঁদ সুলতানার সমস্ত পাওনা পরিশোধ করে যখন তাকে একেবারে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন এর কারন জানতে চেয়েছিলো দিল হাসনাত খান। কিন্তু সহেলি খানের ক্রুর দৃষ্টি আর গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয়বার তা আর উচ্চারণ করার সাহস হয়নি। সন্ধ্যার অনেক পরে চোখের জল মুছতে মুছতে বিদায় হলো চাদ সুলতানা ।
গভীর রাত পর্যন্ত ল্যাপটপ সামনে রেখে নির্বাক বসে থাকলো সহেলি খান আর দিল হাসনাত খান। কারো মুখেই কোন কথা নেই। সহেলি খানের মুখ জুডে আছে ঘৃনা, সে ঘৃণার ভার বহন করে বাকীটা পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব নয় আর দিল হাসনাত খানের মুখ জুড়ে ক্ষমা পাওয়ার আকুতি। ঘুমানোর আগে সহেলি খান নিস্পৃহ গলায় বলেছিলো- "এই ফ্লাট থেকে তোমার যা যা পছন্দ তা নিয়ে যেতে পারো"।
লেখক পরিচিতি
মোমিনুল আজম
গল্পকার, প্রবন্ধকার। কানাডা প্রবাসী
0 মন্তব্যসমূহ