নীহারুল ইসলাম
এই বাংলায় আমরা যারা গল্প লিখি, তাঁদের একটা ‘তীর্থ’ আছে। সেটা হল হুগলীর চন্দননগর। পর্তুগীজদের চন্দননগর কখন যেন আমাদের গল্পনগর হয়ে গেছে, আমরা টের পাইনি। আর যাঁর জন্যে এটা হয়েছে, সেই মানুষটির নাম গৌর বৈরাগী। আমাদের সবার গৌরদা। তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে মাসিক গল্পপাঠের আসর চালিয়ে আসছেন তিনি ‘গল্পমেলা’র নামে। প্রতি মাসে গল্পপাঠের আসর বসানোর সঙ্গে প্রতি ডিসেম্বর মাসে দু’দিন ধরে বার্ষিক অধিবেশন। যেখানে আমরা সবাই মিলিত হই। গল্পপাঠ, গল্প নিয়ে আলোচনা, আড্ডা। রাতে গঙ্গার বাঁধানো সুন্দর পাড়ে হাওয়া খাওয়া। এ যেন এক বার্ষিক-তীর্থ আমাদের! সারাবছর তাকিয়ে থাকি এই তীর্থের জন্যে।
এবছর কিছুদিন আগে একদিন রাত্রে আচমকা গৌরদার ফোন : নীহারুল তুমি কোথায়?
বললাম : দাদা- লেখার ঘরে।
বললেন : একটা খবর দিই তোমাকে।
আমি বললাম : বলুন।
গৌরদা বললেন : এবছর ‘গল্পমেলা’ নীহারুল ইসলামের।
আমি চমকে উঠলাম। কেননা, সেই ১৯৯৫ সাল থেকে প্রায় নিয়মিত গল্পমেলায় যাই। হইচই করে আসি। গৌরদা (বৈরাগী), অরুণদা (সিংহ) , সৌম্যদা (বোস), সুকান্তদা (গঙ্গোপাধ্যায়), বিশ্বজিৎ (পান্ডা), অরিন্দম (বসু), অজিতদা (কুমার মুখোপাধ্যায়), অমল দাস, শতুদ্র মজুমদার এবং আরও অনেকের আন্তরিকতা ভরা উষ্ণতা বয়ে নিয়ে আসি সারাবছরের জন্যে। নিজেকে গল্পমেলার একজন মনে করি। কিন্তু আমার কাছে এবার গল্পমেলা পুরস্কার প্রাপ্তির খবর অন্যরকম ভালোলাগা বয়ে আনল। ৩৬ বছরের গল্পমেলা ‘গল্পমেলা পুরস্কার’ প্রদান শুরু করেছিল ১৯৯১ সালে। এই পুরস্কার প্রথম বার পেয়েছিলেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তারপর থেকে যথাক্রমে পেয়ে এসেছেন : ভগীরথ মিশ্র, কিন্নর রায়, নলিনী বেরা, অসীম ত্রিবেদী, মুর্শিদ এ. এম, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, রবিশংকর বল, শতুদ্র মজুমদার, অভিজিৎ সেন, আনসারউদ্দীন, হেমেন্দুশেখর জানা, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম বসু, অনিতা অগ্নিহোত্রী, দেবর্ষি সারগী, জয়ন্ত দে, কুনাল কিশোর ঘোষ, গৌর কারক, বিপুল দাস, শৈলেন ঘোষ এবং অহনা বিশ্বাস। আর এবছরের প্রাপক ছিলাম আমি। মধ্যে ২০০০ এবং ২০০৫ সালে অনিবার্য কারণ বশত এই পুরস্কার প্রদান বাদ ছিল। পাশাপাশি ‘অনাদি স্মারক সম্মান’ প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৯৩ সাল থেকে। এযাবৎ এই পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা হলেন : অমলকুমার মিত্র (১৯৯৩), প্রদীপ মিত্র (১৯৯৪), অরুণ সরকার (১৯৯৫), বিমল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৯৬), গৌতম দাস (১৯৯৭), প্রশান্ত মাল (১৯৯৮), নিয়তি রায়চৌধুরী (১৯৯৯), অমৃত বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০১), অমলেন্দু চক্রবর্তী (২০০২), তাপস ভৌমিক- সম্পাদক/কোরক (২০০৩), দীপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (২০০৪), সুবল সামন্ত- সম্পাদক/এবং মুশায়েরা (২০০৮), অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়- সম্পাদক/গল্পগুচ্ছ (২০০৯), অমর দে- সম্পাদক/গল্পসরণি (২০১০), অতীন্দ্রিয় পাঠক- সম্পাদক/অব্যয় লিটারেরি সোসাইটি (২০১১), দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়- সম্পাদক/পরিকথা (২০১২), অরুণ চট্টোপাধ্যায়- সম্পাদক/শিশুমেলা (২০১৩) এবং সুনন্দা ঘোষ- সম্পাদক/সাগরী (২০১৪)। আর এবছরের প্রাপক ছিলেন কল্যাণ মজুমদার- সম্পাদক/অন্য প্রমা পত্রিকা।
মূলত ছোটগল্পকে ঘিরেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। পাশাপাশি থাকে অনুগল্প চর্চারও জায়গা। সেই সঙ্গে গল্প-অনুগল্প নিয়ে আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক। নবীন-প্রবীণ গল্পকারদের উপস্থিতির পাশাপাশি গল্পরসিকদের ভিড়ে চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে জমে ওঠে দুই দিনের এই গল্পমেলা। সকালে লুচি-আলুর দম, দুপুরের খিঁচুড়ি ভোগ, আর বিকেলের তেলেভাজা-চা-য়ে ডিসেম্বরের এই ভরা শীতে গঙ্গাপাড়ের চন্দননগরে ছোটগল্পকে ঘিরে যেন চড়ুইভাতির আসর বসে। যেখানেই থাকি না কেন, আমরা এই দুই দিন চন্দননগরকে কিছুতেই এড়িয়ে থাকতে পারি না। বাঁকুড়া সোনামুখি থেকে যেমন আসেন গল্পকার গৌরকারক, তেমনি শিলিগুড়ি থেকে আসেন বিপুল দাস। মালদহ থেকে যেমন তৃপ্তি সান্ত্রা আসেন, পুরুলিয়া থেকে আসেন স্বাতী গুহ। শান্তিনিকেতন থেকে যেমন আসেন অহনা বিশ্বাস, তেমনি আসানসোল থেকে আসেন সুন্দর মুখোপাধ্যায়। নদীয়া থেকে যেমন আসনে আনসারউদ্দীন, তেমনি উত্তর পরগণা থেকে আসেন ভবানী ঘটক। বীরভূম থেকে যেমন আসেন অমর দে, তেমনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে আসেন মুর্শিদ এ. এম। এছাড়াও সাধন চট্টোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অমর মিত্র, কিন্নর রায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, আফসার আমেদ, নলিনী বেরা, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত, সাত্যকিরা তো থাকেনই। প্রতি বছরের মতো এবারও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও অনেকে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে এবছর সুব্রতদা, বিপুলদা ও আফসারদা তাদের ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
এই মেলার আর একটি বৈশিষ্ট ছোটদের মধ্যে গল্প নিয়ে আগ্রহ জন্মাতে তাঁদের গল্পপাঠের আয়োজন থাকে। যেমন এবছর গল্প পড়েছেন : অয়ন্তিকা গোস্বামী, অনিন্দিতা খামারু, শ্রীজিৎ পান্ডা, দিঘী বসু, শ্রদ্ধান্বিতা মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী পান্ডা, সম্পূর্ণা কুন্ডুর মতো ছোটরাও।
এবছরের আর একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, গল্পমেলার বার্ষিক সংকলনে বারো জন প্রতিশ্রুতিবান গল্পকারের গল্প ছাপানোর পাশাপাশি গল্পমেলার পক্ষ থেকে তাদেরঁ ‘প্রতিশ্রুতি স্মারক’ দিয়ে সম্মান জানানো হয়। সেই বারো জন গল্পকারেরা হলেন : অম্লানকুসুম চক্রবর্তী, উজ্জ্বল রায়, জয়দেব দত্ত, বিশ্বদীপ দে, সমীরণ রায়, রাজেশ কুমার, রাজীবকুমার ঘোষ, শংখদীপ ভট্টাচার্য, শমীক ঘোষ, শুদ্ধেন্দু চক্রব্রতী, সুব্রত নাগ ও সুবীর মজুমদার।
একসময় এই মেলায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখকরা যেমন উপস্থিত থাকতেন, তেমনি এখন আমরা পাই রমানাথ রায়ের মতো প্রখ্যাত গল্পকারকে। এবছর তাঁর হাত থেকে ‘গল্পমেলা পুরস্কার’ গ্রহণ আমার কাছে এক বিশাল পাপ্তি। নিঃসন্দেহে যা আমাকে ধন্য করেছে।
এবছরের অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন :
গল্পমেলা-র ৩৬ বর্ষের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল গত ১২-১৩ ডিসেম্বর ২০১৫, চন্দননগর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সভাঘরে (রবীন্দ্রভবন)-এ। এবারও ছোটদের সঙ্গে গল্প পড়লেন বাংলা সাহিত্যের মান্য লেখকেরা। গল্পপাঠ ছাড়াও দুদিনের অনুষ্ঠানের ছিল বিতর্ক এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা। এবারের বিতর্কের বিষয়-‘যাপিত জীবনের সঙ্গে লেখার বৈপরীত্য অন্যায়’। সঞ্চালকের খোঁচায় জমে ওঠে এবারের বিতর্ক। অংশ নেন সাহিত্যিক নলিনী বেরা, কিন্নর রায়, সাত্যকি হালদার, সুপ্রিয় চৌধুরী, অমিত ভট্টাচার্য প্রমুখ।
‘বাস্তব চরিত্রের মুখোমুখি যখন লেখক’ শীর্ষক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, অহনা বিশ্বাস প্রমুখ। ‘গল্পের নির্বাচনে সম্পাদকের সমস্যা’ শীর্ষক আলোচনায় বক্ত্যব্য রাখেন দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত দে, সুরঞ্জন মিদ্দে, রমাপদ পাহাড়ী, কাজল সেন, অমর দে, জীবনময় দত্ত প্রমুখ।
‘গল্পের বিষয় কীভাবে ধরা দেয়’ নামক আলোচনায় তৃষ্ণা বসাক, দেবর্ষি সারগী, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, রমানাথ রায় প্রমুখ সাহিত্যিক তাঁদের গল্পের বিষয় নির্বাচন সম্পর্কে বলেন। ‘সাম্প্রতিক বাংলা ছোটগল্প কোন্ দিকে’ বিষয়ে অসামান্য বক্তব্য রাখেন সাধন চট্টোপাধ্যায় ও বরেন্দু মণ্ডল। এই আলোচনার মুখপাত করেন বিশ্বজিৎ পান্ডা।
জীবনানন্দ দাশের ‘নিরুপম যাত্রা’ গল্পটি অন্যভাবে পাঠ করলেন নাট্যব্যক্তিত্য সৌম্যদেব বসু ও শাশ্বতী ত্রিবেদী।
এছাড়াও দুদিনের অনুষ্ঠানে গল্পপাঠ-আলোচনা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেন সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়, ভবানী ঘটক, ঝিলম ত্রিবেদী, মানস সরকার, কাবেরী চক্রবর্তী, অরুণ দে, সুতপা চক্রবর্তী, নীতা রায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, অরিন্দম গোস্বামী, অভয় সামন্ত, সুন্দর মুখোপাধ্যায়, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশা পাল, অরন্দিম বসু প্রমুখ প্রায় তিনশো জন সাহিত্যিক ও সাহিত্যমনস্ক মানুষ।
এবার সাহিত্যমেলা পুরস্কার পেলেন সাহিত্যিক নীহারুল ইসলাম এবং অনাদি স্মারক সম্মান দেওয়া হল ‘অন্য প্রমা’ পত্রিকা (সম্পাদক-কল্যাণ মজুমদার)-কে। গল্পমেলার কর্ণধার সাহিত্যিক গৌর বৈরাগী জানালেন পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু সাহিত্যিক এবারের অধিবেশনেও অংশগ্রহণ করেছেন।
এই বাংলায় আমরা যারা গল্প লিখি, তাঁদের একটা ‘তীর্থ’ আছে। সেটা হল হুগলীর চন্দননগর। পর্তুগীজদের চন্দননগর কখন যেন আমাদের গল্পনগর হয়ে গেছে, আমরা টের পাইনি। আর যাঁর জন্যে এটা হয়েছে, সেই মানুষটির নাম গৌর বৈরাগী। আমাদের সবার গৌরদা। তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে মাসিক গল্পপাঠের আসর চালিয়ে আসছেন তিনি ‘গল্পমেলা’র নামে। প্রতি মাসে গল্পপাঠের আসর বসানোর সঙ্গে প্রতি ডিসেম্বর মাসে দু’দিন ধরে বার্ষিক অধিবেশন। যেখানে আমরা সবাই মিলিত হই। গল্পপাঠ, গল্প নিয়ে আলোচনা, আড্ডা। রাতে গঙ্গার বাঁধানো সুন্দর পাড়ে হাওয়া খাওয়া। এ যেন এক বার্ষিক-তীর্থ আমাদের! সারাবছর তাকিয়ে থাকি এই তীর্থের জন্যে।
এবছর কিছুদিন আগে একদিন রাত্রে আচমকা গৌরদার ফোন : নীহারুল তুমি কোথায়?
বললাম : দাদা- লেখার ঘরে।
বললেন : একটা খবর দিই তোমাকে।
আমি বললাম : বলুন।
গৌরদা বললেন : এবছর ‘গল্পমেলা’ নীহারুল ইসলামের।
আমি চমকে উঠলাম। কেননা, সেই ১৯৯৫ সাল থেকে প্রায় নিয়মিত গল্পমেলায় যাই। হইচই করে আসি। গৌরদা (বৈরাগী), অরুণদা (সিংহ) , সৌম্যদা (বোস), সুকান্তদা (গঙ্গোপাধ্যায়), বিশ্বজিৎ (পান্ডা), অরিন্দম (বসু), অজিতদা (কুমার মুখোপাধ্যায়), অমল দাস, শতুদ্র মজুমদার এবং আরও অনেকের আন্তরিকতা ভরা উষ্ণতা বয়ে নিয়ে আসি সারাবছরের জন্যে। নিজেকে গল্পমেলার একজন মনে করি। কিন্তু আমার কাছে এবার গল্পমেলা পুরস্কার প্রাপ্তির খবর অন্যরকম ভালোলাগা বয়ে আনল। ৩৬ বছরের গল্পমেলা ‘গল্পমেলা পুরস্কার’ প্রদান শুরু করেছিল ১৯৯১ সালে। এই পুরস্কার প্রথম বার পেয়েছিলেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তারপর থেকে যথাক্রমে পেয়ে এসেছেন : ভগীরথ মিশ্র, কিন্নর রায়, নলিনী বেরা, অসীম ত্রিবেদী, মুর্শিদ এ. এম, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, রবিশংকর বল, শতুদ্র মজুমদার, অভিজিৎ সেন, আনসারউদ্দীন, হেমেন্দুশেখর জানা, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম বসু, অনিতা অগ্নিহোত্রী, দেবর্ষি সারগী, জয়ন্ত দে, কুনাল কিশোর ঘোষ, গৌর কারক, বিপুল দাস, শৈলেন ঘোষ এবং অহনা বিশ্বাস। আর এবছরের প্রাপক ছিলাম আমি। মধ্যে ২০০০ এবং ২০০৫ সালে অনিবার্য কারণ বশত এই পুরস্কার প্রদান বাদ ছিল। পাশাপাশি ‘অনাদি স্মারক সম্মান’ প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৯৩ সাল থেকে। এযাবৎ এই পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা হলেন : অমলকুমার মিত্র (১৯৯৩), প্রদীপ মিত্র (১৯৯৪), অরুণ সরকার (১৯৯৫), বিমল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৯৬), গৌতম দাস (১৯৯৭), প্রশান্ত মাল (১৯৯৮), নিয়তি রায়চৌধুরী (১৯৯৯), অমৃত বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০১), অমলেন্দু চক্রবর্তী (২০০২), তাপস ভৌমিক- সম্পাদক/কোরক (২০০৩), দীপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (২০০৪), সুবল সামন্ত- সম্পাদক/এবং মুশায়েরা (২০০৮), অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়- সম্পাদক/গল্পগুচ্ছ (২০০৯), অমর দে- সম্পাদক/গল্পসরণি (২০১০), অতীন্দ্রিয় পাঠক- সম্পাদক/অব্যয় লিটারেরি সোসাইটি (২০১১), দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়- সম্পাদক/পরিকথা (২০১২), অরুণ চট্টোপাধ্যায়- সম্পাদক/শিশুমেলা (২০১৩) এবং সুনন্দা ঘোষ- সম্পাদক/সাগরী (২০১৪)। আর এবছরের প্রাপক ছিলেন কল্যাণ মজুমদার- সম্পাদক/অন্য প্রমা পত্রিকা।
মূলত ছোটগল্পকে ঘিরেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। পাশাপাশি থাকে অনুগল্প চর্চারও জায়গা। সেই সঙ্গে গল্প-অনুগল্প নিয়ে আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক। নবীন-প্রবীণ গল্পকারদের উপস্থিতির পাশাপাশি গল্পরসিকদের ভিড়ে চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে জমে ওঠে দুই দিনের এই গল্পমেলা। সকালে লুচি-আলুর দম, দুপুরের খিঁচুড়ি ভোগ, আর বিকেলের তেলেভাজা-চা-য়ে ডিসেম্বরের এই ভরা শীতে গঙ্গাপাড়ের চন্দননগরে ছোটগল্পকে ঘিরে যেন চড়ুইভাতির আসর বসে। যেখানেই থাকি না কেন, আমরা এই দুই দিন চন্দননগরকে কিছুতেই এড়িয়ে থাকতে পারি না। বাঁকুড়া সোনামুখি থেকে যেমন আসেন গল্পকার গৌরকারক, তেমনি শিলিগুড়ি থেকে আসেন বিপুল দাস। মালদহ থেকে যেমন তৃপ্তি সান্ত্রা আসেন, পুরুলিয়া থেকে আসেন স্বাতী গুহ। শান্তিনিকেতন থেকে যেমন আসেন অহনা বিশ্বাস, তেমনি আসানসোল থেকে আসেন সুন্দর মুখোপাধ্যায়। নদীয়া থেকে যেমন আসনে আনসারউদ্দীন, তেমনি উত্তর পরগণা থেকে আসেন ভবানী ঘটক। বীরভূম থেকে যেমন আসেন অমর দে, তেমনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে আসেন মুর্শিদ এ. এম। এছাড়াও সাধন চট্টোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অমর মিত্র, কিন্নর রায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, আফসার আমেদ, নলিনী বেরা, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত, সাত্যকিরা তো থাকেনই। প্রতি বছরের মতো এবারও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও অনেকে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে এবছর সুব্রতদা, বিপুলদা ও আফসারদা তাদের ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
এই মেলার আর একটি বৈশিষ্ট ছোটদের মধ্যে গল্প নিয়ে আগ্রহ জন্মাতে তাঁদের গল্পপাঠের আয়োজন থাকে। যেমন এবছর গল্প পড়েছেন : অয়ন্তিকা গোস্বামী, অনিন্দিতা খামারু, শ্রীজিৎ পান্ডা, দিঘী বসু, শ্রদ্ধান্বিতা মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী পান্ডা, সম্পূর্ণা কুন্ডুর মতো ছোটরাও।
এবছরের আর একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, গল্পমেলার বার্ষিক সংকলনে বারো জন প্রতিশ্রুতিবান গল্পকারের গল্প ছাপানোর পাশাপাশি গল্পমেলার পক্ষ থেকে তাদেরঁ ‘প্রতিশ্রুতি স্মারক’ দিয়ে সম্মান জানানো হয়। সেই বারো জন গল্পকারেরা হলেন : অম্লানকুসুম চক্রবর্তী, উজ্জ্বল রায়, জয়দেব দত্ত, বিশ্বদীপ দে, সমীরণ রায়, রাজেশ কুমার, রাজীবকুমার ঘোষ, শংখদীপ ভট্টাচার্য, শমীক ঘোষ, শুদ্ধেন্দু চক্রব্রতী, সুব্রত নাগ ও সুবীর মজুমদার।
একসময় এই মেলায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখকরা যেমন উপস্থিত থাকতেন, তেমনি এখন আমরা পাই রমানাথ রায়ের মতো প্রখ্যাত গল্পকারকে। এবছর তাঁর হাত থেকে ‘গল্পমেলা পুরস্কার’ গ্রহণ আমার কাছে এক বিশাল পাপ্তি। নিঃসন্দেহে যা আমাকে ধন্য করেছে।
এবছরের অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন :
গল্পমেলা-র ৩৬ বর্ষের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল গত ১২-১৩ ডিসেম্বর ২০১৫, চন্দননগর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সভাঘরে (রবীন্দ্রভবন)-এ। এবারও ছোটদের সঙ্গে গল্প পড়লেন বাংলা সাহিত্যের মান্য লেখকেরা। গল্পপাঠ ছাড়াও দুদিনের অনুষ্ঠানের ছিল বিতর্ক এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা। এবারের বিতর্কের বিষয়-‘যাপিত জীবনের সঙ্গে লেখার বৈপরীত্য অন্যায়’। সঞ্চালকের খোঁচায় জমে ওঠে এবারের বিতর্ক। অংশ নেন সাহিত্যিক নলিনী বেরা, কিন্নর রায়, সাত্যকি হালদার, সুপ্রিয় চৌধুরী, অমিত ভট্টাচার্য প্রমুখ।
‘বাস্তব চরিত্রের মুখোমুখি যখন লেখক’ শীর্ষক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, অহনা বিশ্বাস প্রমুখ। ‘গল্পের নির্বাচনে সম্পাদকের সমস্যা’ শীর্ষক আলোচনায় বক্ত্যব্য রাখেন দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত দে, সুরঞ্জন মিদ্দে, রমাপদ পাহাড়ী, কাজল সেন, অমর দে, জীবনময় দত্ত প্রমুখ।
‘গল্পের বিষয় কীভাবে ধরা দেয়’ নামক আলোচনায় তৃষ্ণা বসাক, দেবর্ষি সারগী, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, রমানাথ রায় প্রমুখ সাহিত্যিক তাঁদের গল্পের বিষয় নির্বাচন সম্পর্কে বলেন। ‘সাম্প্রতিক বাংলা ছোটগল্প কোন্ দিকে’ বিষয়ে অসামান্য বক্তব্য রাখেন সাধন চট্টোপাধ্যায় ও বরেন্দু মণ্ডল। এই আলোচনার মুখপাত করেন বিশ্বজিৎ পান্ডা।
জীবনানন্দ দাশের ‘নিরুপম যাত্রা’ গল্পটি অন্যভাবে পাঠ করলেন নাট্যব্যক্তিত্য সৌম্যদেব বসু ও শাশ্বতী ত্রিবেদী।
এছাড়াও দুদিনের অনুষ্ঠানে গল্পপাঠ-আলোচনা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেন সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়, ভবানী ঘটক, ঝিলম ত্রিবেদী, মানস সরকার, কাবেরী চক্রবর্তী, অরুণ দে, সুতপা চক্রবর্তী, নীতা রায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, অরিন্দম গোস্বামী, অভয় সামন্ত, সুন্দর মুখোপাধ্যায়, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশা পাল, অরন্দিম বসু প্রমুখ প্রায় তিনশো জন সাহিত্যিক ও সাহিত্যমনস্ক মানুষ।
এবার সাহিত্যমেলা পুরস্কার পেলেন সাহিত্যিক নীহারুল ইসলাম এবং অনাদি স্মারক সম্মান দেওয়া হল ‘অন্য প্রমা’ পত্রিকা (সম্পাদক-কল্যাণ মজুমদার)-কে। গল্পমেলার কর্ণধার সাহিত্যিক গৌর বৈরাগী জানালেন পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু সাহিত্যিক এবারের অধিবেশনেও অংশগ্রহণ করেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ