সাদিক হোসেন : ২০১৫ সালে পড়া গল্পের সালমামামি

গল্পপাঠ : ১.
২০১৫ সালে কত সংখ্যক গল্প পড়েছেন?

সাদিক হোসেন : ১. 
আমি প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘন্টা বই পড়ি। ছুটির দিনে আরও বেশি। ফলত, বলা যায়, বেশ কিছু গল্প আমি এই বছরে পড়তে পেরেছি। তাছাড়া আগে পড়া গল্পগুলির কাছে আমি বার বার ফিরে যাই। গল্পকাররা, সেক্ষেত্রে, অনেকটা ডিটেকটিভের মত, নতুন কোন ইশারা আবার পাওয়া যাচ্ছে কিনা তার সন্ধান চালিয়েই যেতে থাকে। তাই, একস্যাক্ট কতগুলি গল্প পড়েছি সেই সংখ্যাটা বলা বেশ মুশকিল।
আমি বরঞ্চ বলব, ২০১৫ সালে বেশ কিছু নতুন গল্পকারের সন্ধান পেয়েছি।



গল্পপাঠ : ২
কোন কোন মাধ্যম থেকে গল্পগুলো পড়েছেন?

সাদিক হোসেন : ২
আমি এখনও বই নিয়ে পড়তে ভালবাসি। আগে একদমই টানা কম্পিউটারের স্ক্রীনে পড়তে পারতাম ন। এখন কিছুটা অভ্যেস হয়েছে। অডিও বুক কিছু শুনেছি। আমার তা পছন্দ হয়নি।


গল্পপাঠ : ৩
 কোন কোন গল্পকারের গল্প পড়েছেন?

সাদিক হোসেন : ৩
২০১৫ সালে, আগে পড়া হইনি, এমন বেশ কিছু গল্পকারের গল্প পড়েছি। তাদের মধ্যে মানিক চক্রবর্তী, শাহদুজ্জামান, হিন্দিতে মনোজ কুমার পান্ডে, দক্ষিণ আফ্রিকার ইভান ভ্লাদিস্কাভিচ ও আমেরিকার ডেনিস জনসনের কথা প্রথমেই মনে পড়ছে। এছাড়া কার্লোস ফুয়েন্তেস, বুকাওস্কি, অ্যালিস মুনরো, আন্তনিও স্কারমাতার কিছু গল্প এক কথায় অনবদ্য। রামকুমার মুখোপাধ্যায়, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্পগুলিতে আমাকে বারবার ফিরে যেতে হয়। এঁদের লেখা পড়ে আমি গল্পলেখা শিখছি। তবে উপন্যাসিকদের তালিকা কিছুটা অন্য রকম হবে।


গল্পপাঠ : ৪
এর মধ্যে ভালো লাগার গল্প গুলোর নাম করুন। গল্পগুলো ভালো হয়ে উঠেছে কি কি কারণে সেগুলি উল্লেখ করুন।

সাদিক হোসেন :  ৪
অনেকগুলি ভালো গল্প পড়েছি। তবে এগুলি এখনি মনে পড়ল ---

ক) শাহদুজ্জামানের 'অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প'
খ) ডেনিস জনসনের ' ডার্টি ওয়েডিং'
গ) স্বপ্নময় চক্রবর্তীর 'রক্ত' 


শাহদুজ্জামানের 'অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প'
গল্পটি শুরু হচ্ছে গল্পকার এবং তার বন্ধু মিলনের কথাবার্তা দিয়ে। গল্পকার জানাচ্ছেন তিনি ইদ সংখ্যার জন্য একটি গল্প লিখছেন। তার বন্ধু এতে বেশ বিরক্ত হয়। সে জানায়, "লেখা কি প্যান্ডেল নাকি যে পর্দা উইঠা গেছে, পাবলিক বইসা আছে তোরে এখন পারফর্মেন্স দেখাতেই হবে?" খুব স্বাভাবিক ভাবেই এইরকম কথাবার্তার সম্মুখীন হলে যে কোন গল্পকারই দমে যাবে। গল্পকারের বিব্রত আরও বেড়ে যাবে যদি তার বন্ধু জানায়, " এই যে সব সময় নতুন নতুন লেখা প্রকাশ করা, এর ভিত্রে একরকম ইগো স্যাটিসফ্যাকশনের ব্যাপার আছে, ঔদ্ধত্য আছে। এইটা ইন আ ওয়ে ভালগারও"। এবং এই গল্পটির ক্ষেত্রে, কী আশ্চর্য, এইসবই ঘটে।

অর্থাৎ, এখানে, গল্পকার নিজের অবস্থান নিয়েই কনফিউসড। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি প্রায় মৃতপ্রায়। ফলত, এমন অবস্থায় সবাই যা করে, গল্পকারও তাই করলেন। তিনি নতুন গল্পটির লেখা মুলতুবি রেখে পাঠককে নোটিস ধরিয়ে দিলেন। গল্পটিতে নোটিস নেই। থাকলে হয়ত তার বয়ান এইরকমই হতো -- "এতদ্বারা জানানো যাইতেছে যে অনির্দিষ্ট কালের জন্য নতুন গল্পটিকে বন্ধ করা হইল। "

এইবার, মিলন আর গল্পকার জীবনানন্দ দাশের একটি শিরোনামহীন গল্পকে নিয়ে কাটাছেড়া শুরু করে দিলেন। তারা গল্পটির বিষয়, আঙ্গিক ও ভাষাপ্রয়োগ নিয়ে বিবিধ আলোচনা করলেন। কখনও কখনও পরস্পর সহমতও পোষন করতে পারলেন না। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এখানে, গল্পকার ও মিলনের গন্তব্য একটিই। এবং তারা প্রায় একই পন্থায় সেই দিকে এগোচ্ছে। ফলে এই দুই ক্যারেক্টারের ভেতরে একধরনের ফিকশনলেস কনফ্লিক্ট দেখা দিচ্ছে। এই টুকুই। কিন্তু শুধুই কি তাই?

শাহাদুজ্জামান অত্যন্ত চালাক লেখক। তিনি সমালোচনার ভঙ্গিতে জীবনানন্দের গল্পটিকে এমন ভাবে বলতে শুরু করেন যে পাঠকও গল্পটিতে (জীবনানন্দ দাশের গল্প) কি কি হয়েছিল তা জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এবং প্রায় থ্রিলারের মতই তিনি জীবনানন্দের গল্পটির ক্লাইমেক্সে এসে পড়েন। আমরা জানতে উৎসুক হয়ে থাকি গল্পটিতে শেষ পর্যন্ত কী ঘটল এবং মিলন ও গল্পকার কী কী ভাবছেন।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, এতো গেল জীবনানন্দ দাশের গল্পটির শিল্প উৎকর্ষতা নিয়ে এক ধরনের যুক্তিকাঠামো। এটাকে কি অদৌ গল্প বলা যায়?

শাহাদুজ্জামান আসলে এখানেই গল্পটির কনফ্লিক্টকে স্থাপন করছেন।

মৌলিক গল্প বলতে আমরা কি বুঝি বা একটি গল্প কতটুকু মৌলিক হতে পারে -- এই প্রশ্নগুলিই গল্পটির আসল ক্যারেক্টার যা বেড়ালের যৌনক্রিয়ার মতই বেশির ভাগ সময় গোপনে থেকে যায়। কখনও সখনও প্রকাশ্যে এলে আমরা " গল্পের ভেতর একাধারে চেপে বসা কালো আর অকুলীনা আলো খুঁজতে থাকি"।



স্বপ্নময় চক্রবর্তীর 'রক্ত

-- নাম?

-- লেখেন - অমিতাভ।

-- বয়স?

-- লেখেন না যা খুশি।

এমনি আকস্মিক ভাবে স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর 'রক্ত' গল্পের ভেতর আমাদের ঢুকিয়ে নেন। আমরা জানতে পারি, পাঁচু এখন ব্লাডব্যাঙ্কের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে রক্ত দেবে। রক্ত দিলে পেট পুরে খাবার পাওয়া যায়। তাই সে সপ্তাহে দুবার রক্ত দেয়।

এই রক্ত দিতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে জবার পরিচয়। জবাও কোলকেতার নীচের লোক। তবে পাঁচুর সঙ্গে তার শ্রেনীগত কিছু পার্থক্য আছে। জবা গেরস্থ বাড়ির মেয়ে। অন্যদিকে পাঁচুর একটি আবছা বংশ পরিচয় আমরা জানতে পারি। কিন্তু তার কোন আত্মীয়স্বজন নেই। সে একা। পার্কসার্কাস বাজারে আইনুলের মাংসের দোকান। দোকানের পেছনে পাঠা-খাসি থাকে। পাঁচুর কাজ ছাগল-নাদি পরিস্কার করা।

রক্ত দিতে গিয়ে পাঁচুর সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হয় জবার। জবা কখনও বাড়ির তৈরি খাবার এনে পাঁচুকে খাওয়ায়। তাদের মধ্যে একধরনের নৈকট্য তৈরি হয়। এই নৈকট্য কি প্রেম?

এখানে গল্পকার মূলধারার 'প্রেমে'র সঙ্গে পাঁচু ও জবার সম্পর্ককে একটি ডিবেটে নিয়ে যান।

আমরা প্রথমেই দেখেছি, ব্লাডব্যাঙ্কের কাউন্টার থেকে যখন নাম জিজ্ঞেস করা হল পাঁচু জানিয়েছিল -- অমিতাভ। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে তবেই আবার রক্ত দেওয়া যায়। যাদের পেশাই হল রক্ত দেওয়া তারা তো আর অতদিন ওয়েট করতে পারে না। ফলে তাদের ভূয়ো নাম নিতে হয়। এখানে লক্ষ্য রাখা দরকার পাঁচু কিন্ত 'গোপাল' বা 'বিনয়' টাইপের কোন নাম বলছে না । সে বলছে একজন মেইনস্ট্রিম সিনেমার নায়কের নাম। শুধু তাই নয়, হাতের মধ্যে সূচ ঢুকে গেলে সে মনে মনে যা আওড়াল তা হল --- লাইলন শাড়ি আর পাইলট পেন, উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন।

এই যে, একজন প্রান্তিক মানুষের চোখ দিয়ে মেইনস্ট্রিমকে দেখা, এই 'দেখা'টা কিন্তু সারা গল্প জুড়েই রয়েছে। মূলধারার রাজনীতিও এখানে একটা পপুলার কালচারের শাখা হিসেবেই হাজির হয়।

একজন দালালের সঙ্গে একটি বেসরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে গেছে পাঁচু। নাম রেজিস্টারের সময় প্রশ্ন-উত্তর গুলো লক্ষনীয়--

-- বয়স?

-- লিখেন না যা খুশি।

-- যা খুশি হয় না কি! বয়সটা ঠিক করে বল।

-- সেটা জানি না।

-- স্বাধীনতার সময় কতটুকু ছিলে?-

-- সব বছরই তো হয়। বোঁদে খেতে দেয়?

-- চীন যুদ্ধের সময় কতবড় হয়ে ছিলে?

-- এ্যঁ

-- কোলকাতার কোন ঘটনা মনে আছে তোমার?

--য্যাকোন কলকাতা আলাম, গমকলে, তখন আমি ছোট, কচি, ত্যাকোন খুব বাজি পটকা, রাস্তার লাইটের অং সব লালি-লাল। সবাই বলতেছে, নতুন মন্ত্রী এয়েচেন, আর গরীব কেউ থাকবনি, তখন আমি ছোট।

অর্থাৎ, যে বছর বামফ্রন্ট সরকার গঠন করল, সে বছরেই পাঁচু কলকাতায় এল। কিন্তু তার এই বর্তমান অবস্থার জন্য সে কাউকেই দায়ী করে না। বরঞ্চ, সে বুঝি, 'স্বাধীনতা', 'চীনযুদ্ধ', 'জ্যোতি বসু' -- এই সব কিছুকেই সিনেমার মত করে দেখছে। যে সব সিনেমায় অমিতাভ বা উত্তম-সুচিত্রারা অভিনয় করে থাকে।

শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, জবা অসুস্থ হয়েছে। সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে। তার রক্তের প্রয়োজন। রক্ত দিতে এসেছে পাঁচু। কিন্তু পাঁচুর শরীর থেকে আর রক্ত নেওয়া যাবে না। রক্ত দিতে দিতে ক্ষয়ে গিয়ে এখন সে হলুদবর্ণ পুরুষ।

পাঁচু তার পচা রক্তের শরীর নিয়ে বেডের দিকে এগিয়ে যায়। পাঁচুর কান্না পায়। সে কাঁদে না। শুধু চোখ বুজে থাকে।

এখানে গল্পকার আমাদের কানে ফিসফিসিয়ে বলে দেন -- লাইলন শাড়ি আর পাইলট পেন...। বাকি টুকু তিনি আর লেখেন না। কিন্তু আমরা নিজেরাই বলে ফেলি -- উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন।

আমাদের সুখি দৈনন্দিনতা, এই মুহুর্তে, ছুরিকাহত হল।

গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। আমি এই গল্পটির কাছে বারবার ফিরে আসি।


গল্পপাঠ ; ৫
 সেরা গল্পটি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষন বলুন।

সাদিক হোসেন :  ৫.
২০১৫ সালে পড়া আমার সেরা গল্প -- চিনেবাদাম। লেখক মানিক চক্রবর্তী।

কিষান, চিনেবাদাম বিক্রি করা দশ-বারো বছরের ছেলে, সে মারা গেছে। তার লাশ পড়ে রয়েছে লেডিস হোস্টেলের পাঁচিলের পাশে।

এই মৃত্যু ঘিরেই জল্পনা চলছে চারদিকে।

হোস্টেলের এগারো নম্বরের রুমে থাকে চারজন মেয়ে। তাদের ঘিরেই জমে উঠছে গুজব।

এই চারজন মেয়ের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা কিছু কিছু তথ্য পাচ্ছি। কিন্তু এই তথ্য গুলো কি সত্য, না নিছকই গসিপ? গসিপ কখন হয়ে ওঠে সত্য? সত্যের নির্মান প্রনালীই সারা গল্প জুড়ে চলতে থাকে।

লেখক কখনই কোন কিছুর মিমাংসা করছেন না। বরঞ্চ তিনি পাঠককে প্রভোক করছেন এইসব গসিপে অংশগ্রহণ করতে।

কিষানের সঙ্গে এই চারজন মেয়ের যৌন সম্পর্কের কতগুলি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। আবার পরক্ষণেই তা জট পাকিয়ে যাচ্ছে।

সব কিছুর স্থায়িত্বকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন লেখক। সারা গল্প জুড়েই শুধু ভঙ্গুরতা। যেন প্রথাগত নির্মাণশৈলির উপর তিনি আর আস্থা রাখতে পারছেন না। লেখক নিজেই একজন আততায়ী।

গুজব মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। এই গল্পের প্রতিটা বাক্যের মধ্যেই সে ঘূর্ণণকে অনুভব করা যায়।

অবশেষে রাত শেষ হল। ভোর পেরিয়ে বেলা বাড়তে থাকে। হোস্টেলের অন্যান্য মেয়েরা করিডরে জমা হচ্ছে। এবার পুলিস আসবে। এগারো নম্বরের মেয়েরা তাই ধীরসস্থির ভাবে তৈরি হয়ে নিচ্ছে।

হোস্টেলের ভেতরে আর রোজদিনকার মত সোচ্চার ভাব নেই। প্রতিটা ঘরের যে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট, সেই সব মিলিয়ে গিয়ে একই রকম হয়ে গেছে।

তখনি তিন-চারজন যুবক এই দিকে তাকিয়ে, খুব গলা ফাটিয়ে, চিৎকার করে বলে গেল -- চিনেবাদাম চাই, চিনেবাদাম, চিনেবাদাম চাই...

সারা হোস্টেল ভয়ে কাঁটা হয়ে উঠল।

ভয়ের মধ্যে সবসময় আচমকা ব্যাপার থাকে। যেন, এটা হবার কথা ছিল না - কিন্তু হয়ে গেল। মানিক চক্রবর্তী একজন দক্ষ গেরিলার মতই 'ভয়'-এর কাঠামোটায় আঘাত করছেন, এখন। ভয় আর আচমকা, অস্বাভাবিক নয়। ভয় যেন ইনএভিটেবল। তাই ভয়, সত্যিই ভয়ের।

...

এলা আমার বন্ধু। ও দিল্লিতে থাকে। কদিনের জন্য কলকাতায় এসেছে। ওকে গল্পটা পড়িয়ে বললাম, চল্, বন্ডেল গেটে যাই। গল্পটাতে তো এই জায়গাটার কথাই বলা হয়েছে । দেখি যদি লেডিস হোস্টেলটার সন্ধান পাওয়া যায়।

এলা তৎক্ষনাৎ রাজি। পায়ে স্লিপার গলিয়ে বলল, বাসে যাবি, না ট্যাক্সি নেব?

বন্ডেল গেটে গিয়ে আমরা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলাম। একজায়গায় বিহারিদের ছোলা-বাদামভাজার বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। আমি তো এক্সাইটেড। বললাম, মনে হয় কাছাকাছিই কোথাও আছে হোস্টেলটা। এখুনি পেয়ে যাব।

এলা হেসে বলল, গল্পকাররা বেসিক্যালি গারবেজ কালেকটার।

কেন?

একজন গল্পকার গল্প পড়বার সময় সবসময় খেয়াল করে গল্পটিতে কি কি বাদ দেওয়া হয়েছে। তারপর সেইসব বাদ দেওয়া জিনিসপত্তর কুড়িয়ে নিজের গল্পটা লেখে। কি রে ভুল বললাম? তুই তো এই জন্যেই এখানে এলি।

দুঃখের বিষয় লেডিস হোস্টেলটা পাওয়া গেল না। এমনকি এখানে কোন কালে কোন হোস্টেলই ছিল না -- এমনই লোকজনের দাবী।

তার মানে, এই জায়গাতে হোস্টেলটা লেখক নিজেই বানিয়েছেন?

মানিক চক্রবর্তী মূলত কবি। তবে আমি তার মাত্র একটিই কবিতা পড়েছি। বহু চেষ্টা করেও তার কোন বই হাতে পাইনি। ওনার কবিতা এখন এতটাই দূর্লভ।

এলা হাসছিল। আমি ঠিক ধরতে পারছি, সেও আমার মতই, এখন এই বন্ডেল গেটে দাঁড়িয়ে সেইসব না-পড়া কবিতাগুলোর সম্ভাবনাকেই অনুমান করছে। আর আমাদের দিক দিয়ে দেখলে, সেইসব কবিতাগুলো তো এখনও লেখাই হইনি। অথচ মানিক চক্রবর্তী মারা গিয়েছেন সেই ১৯৯০ সালে। তবে? আমার কেমন ভয় করতে লাগল।

আমি আবারর এলার দিকে তাকালাম। এলাও কি এইসবই ভাবছে? নাকি এমনিই হেসেছিল? ও তো এমনিতেও হাসে।


গল্পপাঠ : ৬
আপনি কি মনে করেন -- এই গল্পগুলো বাংলাদেশের চিরায়ত গল্পগুলোর সমতুল্য বা তাদেরকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।

সাদিক হোসেন :  ৬
'চিরায়ত' শব্দটিকে আমি সন্দেহ করি। এই শব্দটি এমন এক স্পেস তৈরি করে, যেন, সেই স্পেসটি অপরিবর্তনীয়; তাই তাকে স্ট্যাটিক হতেই হবে। অন্যদিকে একজন ব্যক্তি মানুষের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি সর্বদাই রাজনৈতিক, ফলে তা পরিবর্তনশীল। এখন, এই পরিবর্তনশীলতার ভেতরে 'চিরায়ত' কিভাবে তার অস্তিত্বকে রক্ষা করে - তা নিয়ে আমার বেশ কৌতুহল আছে।

বহু চিরায়ত গল্পই আমার কাছে এখন অচল। তবু একথাও ঠিক যে তারা টিঁকে আছে। টিঁকে থাকবেও। কিন্তু কেন?

ফলে আমি প্রশ্নটিকে একটু অন্যভাবে দেখব। আমি বলব, বাংলা ভাষায় রচিত সফল গল্পগুলোর তালিকায় এই গল্পগুলিকে অনায়াসেই নথিভূক্ত করা যাবে।


গল্পপাঠ : ৭
 বিদেশি গল্পগুলোর সঙ্গে এই গল্পগুলোর মাণকে কিভাবে তুলনা করবেন?

সাদিক হোসেন :  ৭.
গল্প একটি কালচার-স্পেসিফিক শিল্প মাধ্যম। প্রতিটা ভাষা কাঠামোরই নিজস্ব সৌন্দর্যবোধ আছে। সেক্ষেত্রে গল্পের উৎকর্ষতা বিচারের জন্য কোন আন্তর্জাতিক মাণ নির্ধারণের আমি বিরোধী।

তাসত্বেও, একজন গল্পকার কিভাবে তার গল্পটির চলন নির্মাণ করছেন , চরিত্রগুলোকে কিভাবে স্থাপন করছেন - এইসব বিবিধ বিষয়ের দিকে নজর দিলে গল্পটির মাণ সম্পর্কে খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। তবে ফারাক থেকে যায় অনেকটাই। ভাষা-অভিজ্ঞতা ছাড়া একটি গল্পের সঠিক পাঠ প্রায় অসম্ভব।

আমি একটি বিদেশি গল্পকে যেভাবে পড়ি, বাংলা ভাষায় লিখিত গল্পকে সেভাবে পড়ি না। বাংলা ভাষায় লিখিত প্রতিটা শব্দ ও সেনটেন্স তার ইতিহাস সমেত আমার কাছে হাজির হয়। আমি বুঝতে পারি, গল্পকার এখানে কিভাবে এই ইতিহাসের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছেন। কিভাবে তিনি একটি বা দুটি শব্দ প্রয়োগেই তার পূর্বসুরী থেকে পৃথক হতে পারছেন।

অপরদিকে বিদেশি গল্পের ক্ষেত্রে আমি শুধুমাত্র তার আঙ্গিক ও বিষয়ের দিকেই খানিকটা দৃষ্টিপাত করতে পারি। বিদেশি ভাষার গল্পগুলি তাই আমার কাছে, প্রায়শই, একটা এক্সোটিক এক্সপেরিয়েন্স হিসেবেই দেখা দেয়।

ফলে আমার পক্ষে, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। আমি এভাবে বলতে পারি , বিদেশি গল্পগুলিতে আমি যা যা অনুমান করেছি, তা এই গল্পগুলিতে সফলভাবে সেইসবের প্রয়োগ হয়েছে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ