রুমা মোদক
সেই কবে কৈশোরের শেষে অপু- দুর্গার যৌথ শৈশবে একাত্ম হয়ে একজন বিভূতি ভূষণ কে চিনে উঠেছিলাম,সেই যে কিশোরী দুর্গার মৃত্যুতে একদলা কান্না এসে গলায় আটকে ছিলো,তারপর অনেক অনেকদিন শত সহস্র পাঠেও সেই কান্নার দলা সহজে নামতে চায়নি। কেমন অনড় হয়ে গ্রাস করেছিলো পাঠ অভিজ্ঞতার দিনমান। তারপর একাডেমিক প্রয়োজনে, পাঠের মহৎ অপ্রয়োজনে বিভূতিভূষণ পাঠ। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি কে পাঠ,সমাজ বাস্তবতাকে পাঠ--------।
বিভূতিভূষণ পাঠের কোন পর্যায়ে মেঘ-মল্লার পড়েছিলাম মনে নেই,তবে গল্পপাঠে আলোচনার জন্য পুনপাঠে বাস্তবিক অর্থে আবিষ্কার করি সত্যিকার অর্থে গল্পটির পুণ-পাঠ হয়েছে। বর্তমান পাঠে গল্পটির যে নবতর ব্যাখ্যা আমার কাছে প্রতিভাত হয়,বোধ হয় এটিই লেখকের অন্তর্জাত কাংক্ষা। একটি প্রতীকী আবরণ যার আখ্যান। আপন আকাংক্ষা জাত উদ্দেশ্যেই চরিত্রগুলো তৈরি করেন তিনি। তৈরি করেন এর পরাবাস্তব আখ্যান। লেখকের সেই অন্তর্জাত কাংক্ষা খুঁজে বের করা পাঠকের দায় এবং দায়িত্ব ও বটে।
মেঘ- মল্লার নামক রাগটি আখ্যানে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করলেও মেঘ- মল্লার গল্পের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি অন্যকিছু। আপাত ভাবে কাহিনীটি এমন- বৌদ্ধ বিহারের শিক্ষার্থী প্রদ্যুম্ন মন্দিরের জমায়েতে খুঁজে ফেরে একজন বিখ্যাত বীনবাদককে,নিজ শিক্ষার উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে। উল্টো সে পড়ে যায় এক তান্ত্রিকের ফাঁদে, মিথ্যে পরিচয়ে যে কিনা প্রদ্যুম্নর বাঁশিতে মেঘ মল্লার রাগ সুনিপুণ বাজানোর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বন্দী করে বিদ্যা আর কলার দেবী সরস্বতীকে। বৌদ্ধদর্শন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষায় প্রদ্যুম্ন পৌরাণিক দেবদেবীদের কাল্পনিক জানার সাথে চোখের সামনে দৃশ্যমান অপরূপা দেবীকে আবিষ্কার করে জ্ঞান আর পরিস্থিতির দ্বন্দ্বে অভিভূত হয়ে পড়ে। পরবর্তিতে আচার্য্য পূর্নবর্দ্ধনের কাছে গিয়ে বিস্তারিত জানানোর পর যখন তার কাছে প্রকৃত তথ্য জ্ঞাত হন,তখন আত্মদগ্ধ প্রদ্যুম্ন বেরিয়ে পড়েন প্রায়শ্চিত্তের উদ্দেশ্যে। অনেক কাল অনেক স্থান পরিভ্রমণ শেষে অবশেষে তান্ত্রিক গুণাঢ্য ও বন্দীকৃত সেই অপরূপা নারীর সন্ধান পান। নিজের জীবন বিসর্জনের বিনিময়ে মুক্ত করেন দেবীকে। যাকে একদা অজ্ঞাতসারে বন্দী করতে সাহায্য করেছিলেন প্রদ্যুম্ন নিজেই। কাহিনতে খুব সামান্য কিন্তু উচ্ছল প্রেম আর বেদনার মিথস্ক্রিয়া নিয়ে উপস্থিতি রয়েছে ' সুনন্দা' নামের এক নারীর।
আপাত গল্পটি পাঠে বিভূতিভূষণের কাব্যময় ভাষা বর্ণনায়, প্রকৃতি- পরিবেশের চিত্রকল্পময়তায় কেমন মোহাবিষ্টতা তৈরি হয় পাঠক হৃদয়ে। সেই মোহাবিষ্টতা অতিক্রম করে আলোচনার স্বার্থে কারণ অনুসন্ধান করতে চাই,লেখক কেন এ গল্পটি বলছেন? এই গল্পের মাধ্যমে তিনি কী বলতে চান? এই বাংলা যার পটভূমি নয়,লেখকের সমকালীন আর্থ- সামাজিক বাস্তবতা যার প্রেক্ষিত নয়!!
আমি আমার মতো কারণটি আবিষ্কার করি এবং এই বিশ্বাসে স্থিত হই এটি লেখকের আরাধ্য অন্তর্গত কারণ। মূলত গল্পকার যখন গল্প বলেন,তা কেবলই বলার জন্য বলা নয়। বলার মধ্য দিয়ে বলার অধিক কিছু বলা, যা হয়তো ধারণ করে তার গোপণ কোনো কাংক্ষা,হয়তো তৈরি করেন প্রতীকী কোনো ব্যঞ্জনা। মূলত যে উদ্দেশ্যে তিনি গল্পটি পেতেছেন তা কতোখানি স্পর্শ করলো পাঠক হৃদয়,পাঠক উপলব্ধি করতে সমর্থ্য হলো কিনা লেখকের উদ্দেশ্য-- এখানেই লেখকের সার্থকতা কিংবা মুন্সিয়ানা। হতে পারে লেখকের উদ্দেশ্যকে অতিক্রম করে অধিক কিছু ব্যাখ্যা পাঠক তৈরি করে নিতে পারে,যা কি না লেখক হয়তো ভেবে লেখেন নি। কিন্তু এও লেখকের কৃতিত্ব যে তিনি যা লেখেন, পাঠক তার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা করতে সমর্থ্য হন।
' মেঘ- মল্লার' গল্পটি,তার চরিত্র সমুহ,ঘটনা পরম্পরা শেষ পর্যন্ত আমার কাছে এক প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। উপস্থিত হয় প্রতীকের আড়ালে এক অন্তর্নিহিত নিগূঢ় সত্য নিয়ে। এবং তা হলো এই যে চিরন্তন কোনো সৌন্দর্য কিংবা কলা কিংবা প্রতিভা কখনোই কোনো শৃংখলে আবদ্ধ থাকতে পারে না। চাতূর্য দিয়ে একে বশ করা যায় না। তাকে আপাত শৃংখলিত করা গেলেও চূড়ান্ত ভাবে তা অসম্ভব এবং অনুচিত তো বটেই।
লেখক যথার্থ এই বক্তব্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই গল্পখানিতে প্রতীকী আখ্যান সাজিয়েছেন এই প্রতীতি নিয়েই আমি পাঠক প্রবেশ করি তার বর্ণনা,ভাষাভঙ্গি ও গল্প শুরুর ভঙ্গিতে। যে বীণ বাদককে খুঁজতে দশ পারমিতার মন্দিরে প্রদ্যুম্ন এর আগমন,সেই মন্দিরেই সুরদাসের মিথ্যে পরিচয়ে প্রদ্যুম্ন কে খুঁজে নেয় তান্ত্রিক গুণাঢ্য। যে তান্ত্রিক গুণাঢ্যর আসল পরিচয় জানার আগে আমাদের যেতে হয় ভারী এক কৌতুহলোদ্দীপক মোহময়ী ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে,যেখানে গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রদ্যুম্ন নিজের অজ্ঞাতসারে তান্ত্রিক কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। তার মেঘ-মল্লার সুরের আবাহনে আবির্ভূতা হন কলার দেবী স্বরস্বতী। পৌরাণিক দেবী বন্দী হন তান্ত্রিক কর্তৃক। গল্পের শুরুতেই আমাদের সাক্ষাত ঘটে আরেক মোহময়ী নারী ' সুনন্দা ' র সাথে; প্রদ্যুম্ন‘র সাথে যার হৃদয়জ সম্পর্ক চিহ্নিত হয় পারস্পরিক বাক্য বিনিময়ে। সুনন্দা প্রদ্যুম্ন এর এই হৃদয়জ সম্পর্ক প্রচুর সম্ভাবনাময়তা নিয়ে আমাদের মনে কৌতূহলের জন্ম দেয়,এবং মূল গল্পের সমান্তরালে আরেকটি আখ্যান পাঠের আগ্রহ নিয়ে গল্পের অন্তে দেখা পাই প্রেমিকের জন্য অপেক্ষমাণ প্রবজ্যার কঠোর ব্রত ধারণ করা এক বিরহী তরুণীর। বেদনার ঘনায়মান মেঘ বৃষ্টি হয়ে না ঝরলেও টের পাই পাঠক মনে বেদনা সংক্রামিত করার লক্ষ্যেই চরিত্রটির সৃষ্টি। গল্পের শুরুতে যার জ্বাজ্বল্যমান আবির্ভাব গল্পের শরীর জুড়ে তাকে কেনো এতো অবহেলা লেখকের? বোধ করি পাঠক মনে বেদনা সৃষ্টির উদ্দ্যেশ্যে তৈরি এই চরিত্রটির প্রতি খানিক অবহেলাই করেছেন লেখক।
অপূর্ব কাব্যময় ছান্দিক গদ্যভঙ্গিমা বিভূতি ভূষণের। গল্প বলার ভাষাটি কবিতা নয়, কাব্যময়। ছন্দ নয়,ছান্দিক গদ্য। যেমন অনেক দেশকাল পেরিয়ে দেবীকে খুঁজে পাবার পর, প্রদ্যুম্ন যখন তাকে অনুসরণ করেন,তখন
" এক একদিন প্রদ্যুম্ন শুনতো দেবী অনেক রাতে একা একা গান গাইছেন-- সে গান পৃথিবীর মানুষের গান নয়,সে গান প্রাণধারার আদিম ঝর্ণার গান,সৃষ্টিমুখী আদিম নীহারিকাদের গান,অনন্ত আকাশে দিকহারা কোনো পথিক তারার গান।"
যেনো কবিতার অধিক কোনো কাব্যময় ভাষা বিরহিণী দেবীর অন্তরাত্মার বেদনা নিয়ে ছড়িয়ে যায় আমাদের হৃদয়ে। প্রকাশের ব্যঞ্জনায় অভিভূত করে আমাদের।
কিংবা লেখক যখন বলেন "তখন আকাশ বাতাস নীরব। অন্ধকারে সামনের মাঠটায় কিচ্ছু দেখবার উপায় নেই,শালবনের ডালপালায় বাতাস লেগে একরকম অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। বড় মাঠের পারে শালবনের কাছে দিকচক্রবালের ধারে নৈশ প্রকৃতি পৃথিবীর বুকের অন্ধকার শরশয্যায় তার অঞ্চল বিছিয়েছে। শুধু বিশ্রাম ছিলো না ভদ্রাবতীর। সে কোন অন্তরের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেবার আকুল আগ্রহে একটানা বয়ে চলেছে,মৃদুগুঞ্জনে আনন্দ সংগীত গাইতে গাইতে কূলে তাল দিতে দিতে"।
তখন তার বর্ণনার চিত্রকল্পময়তায় নিমগ্ন পাঠক কেমন যেন একাত্ম হয়ে মিশে যয় এক বর্ষণমুখর রাতের সাথে। সেই শালবন সেই ভদ্রাবতী নদী সব কেমন তাদের সমুদয় নীরব সৌন্দর্য নিয়ে মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে চোখের সম্মুখে। পুরো গল্প জুড়ে এমনি অসংখ্য ছোট ছোট বাক্য বিন্যাস
" সন্ধ্যার ঈষৎ অন্ধকার কখন মিলিয়ে গিয়েছে,অন্ধকারটাই তরল থেকে তরলতর হতে হতে হঠাৎ কখন জ্যোতস্নায় পরিণত হয়েছে" অথবা
" চূড়ার মাথার উপরকার ছায়াচ্ছন্ন আকাশ বেয়ে ঝাপসা ঝাপসা পাখীর দল ডানা মেলে বাসায় ফিরছিল ও দূরে একখানা সাদা মেঘের প্রান্ত পশ্চিমদিকের পড়ন্ত রোদে সিঁদুরের মতো রাংগা হয়ে আসছিলো,চারিধারে তার শীতোজ্জ্বল মেঘের কাঁচুলি হালকা করে টানা" তখন সমগ্র প্রকৃতিই যেনো ছবি হয়ে উঠে,ছবির চেয়েও অধিকতর মূর্ত হয়ে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে লেখকের বর্ণনার দক্ষতায়।
গল্পের ছোট বড় নানা চরিত্র গুলি কেউই পূর্ণাংগ হয়ে উঠেনি একমাত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রদ্যুম্ন ছাড়া। কিন্তু সেও এক অতি জীবন্ত হলেও অসহায় চরিত্র। " বেশি চঞ্চলতা ও কৌতুকপ্রিয়তা" যার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য,যে বৈশিষ্ট্যই তাকে টেনে নিয়ে যায় তান্ত্রিকের ফাঁদে- প্রদ্যুম্ন এর শিক্ষাগুরুর এমনতর ধারণার সাথে আমরাও একমত হই শুরু থেকেই তার কর্মকাণ্ডে। একাত্মতা বোধ করি প্রদ্যুম্নএর আত্মোপলব্ধির সাথেও।
" এরকম রাত্রে যে যুগেযুগের বিরহদের মনোবেদনা তার প্রা্ণের মধ্যে জমে উঠে,তার অবাধ্য মন যে এইসব পরিপূর্ণ জ্যোতস্না রাত্রে মহাকোটঠি বিহারের পাষাণ অলিন্দে মানস সুন্দরীদের পিছন পিছন ঘুরে বেড়ায়,এর জন্য কী সেই দায়ী?" মানব মনের বিচিত্র গতি প্রকৃতি তাকে যুগে যুগে সৃষ্টিশীল করেছে, পৃথিবীর যাবতীয় রহস্য আবিষ্কারে প্রবৃত্ত করেছে কিন্তু সেই আপন মানসজগৎই যেনো হয়ে গেছে মানবের অবাধ্য অপরিচিত নিয়ন্ত্রণহীন।
অহেতুক কৌতুহল,প্রাকৃতিক পালাবদলের সাথে মানসিক গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের এই স্বাভাবিক রীতি গল্পের শুরুতে যে প্রদ্যুম্ন’র সাথে আমাদের পরিচয় ঘটায়,শেষ পর্যন্ত কারো অনিষ্ট সাধনের আশংকায় অনুশোচনা ও প্রায়শ্চিত্তের আকাংক্ষায় বছরব্যাপী পরিভ্রমণ এসবই প্রদ্যুম্নকে একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। যে জীবন্ত মানুষটির সবশেষে পাথরে পরিণত হওয়া পর্যন্ত যে মানসিক ভৌগলিক বন্ধুর জার্নি তাতে সে আগাগোড়াই এক অসহায় ভিক্টিম। যাবতীয় মানবিক গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তার এই পরিণতি পাঠকমনকে বেদনায় আচ্ছন্ন করে। লেখক তা করেছেন সচেতন ভাবে নিজ মনোস্কামনা পূরণের লক্ষ্যে।
তবু যে লেখক যা বলতে চান তা শেষ পর্যন্ত তা বলে উঠতে পারেন,প্রদ্যুম্ন’র প্রতি গভীর বেদনায় তা আবিষ্কার করে আমরা চমৎকৃত হই। চমৎকৃত হই তার অন্তর্গত উপলব্ধির প্রতীকি উপস্থাপনের সার্থকতা বিবেচনা করে। অবশেষে পুণরায় মুগ্ধ বিস্ময়ে পুনর্বার উপলব্ধি করি প্রকৃতি প্রদত্ত সৌন্দর্য, সুনিপুণ কলা কিংবা লব্ধ প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক প্রতিভা কোনকিছুই কোনোকালেই কোনোক্রমেই শৃংখলিত হবার নয়। প্রদ্যুম্ন’র মতো নিরপরাধ প্রাণের বিনিময়ে হোক কিংবা তান্ত্রিকের আত্মগ্লানির বিনিময়েই হোক শেষ পর্যন্ত গুণ আর প্রতিভা,সৌন্দর্য আর সাধনা সার্বজনীন এবং উদার। মুক্ত এবং স্বাধীন।
সেই কবে কৈশোরের শেষে অপু- দুর্গার যৌথ শৈশবে একাত্ম হয়ে একজন বিভূতি ভূষণ কে চিনে উঠেছিলাম,সেই যে কিশোরী দুর্গার মৃত্যুতে একদলা কান্না এসে গলায় আটকে ছিলো,তারপর অনেক অনেকদিন শত সহস্র পাঠেও সেই কান্নার দলা সহজে নামতে চায়নি। কেমন অনড় হয়ে গ্রাস করেছিলো পাঠ অভিজ্ঞতার দিনমান। তারপর একাডেমিক প্রয়োজনে, পাঠের মহৎ অপ্রয়োজনে বিভূতিভূষণ পাঠ। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি কে পাঠ,সমাজ বাস্তবতাকে পাঠ--------।
বিভূতিভূষণ পাঠের কোন পর্যায়ে মেঘ-মল্লার পড়েছিলাম মনে নেই,তবে গল্পপাঠে আলোচনার জন্য পুনপাঠে বাস্তবিক অর্থে আবিষ্কার করি সত্যিকার অর্থে গল্পটির পুণ-পাঠ হয়েছে। বর্তমান পাঠে গল্পটির যে নবতর ব্যাখ্যা আমার কাছে প্রতিভাত হয়,বোধ হয় এটিই লেখকের অন্তর্জাত কাংক্ষা। একটি প্রতীকী আবরণ যার আখ্যান। আপন আকাংক্ষা জাত উদ্দেশ্যেই চরিত্রগুলো তৈরি করেন তিনি। তৈরি করেন এর পরাবাস্তব আখ্যান। লেখকের সেই অন্তর্জাত কাংক্ষা খুঁজে বের করা পাঠকের দায় এবং দায়িত্ব ও বটে।
মেঘ- মল্লার নামক রাগটি আখ্যানে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করলেও মেঘ- মল্লার গল্পের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি অন্যকিছু। আপাত ভাবে কাহিনীটি এমন- বৌদ্ধ বিহারের শিক্ষার্থী প্রদ্যুম্ন মন্দিরের জমায়েতে খুঁজে ফেরে একজন বিখ্যাত বীনবাদককে,নিজ শিক্ষার উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে। উল্টো সে পড়ে যায় এক তান্ত্রিকের ফাঁদে, মিথ্যে পরিচয়ে যে কিনা প্রদ্যুম্নর বাঁশিতে মেঘ মল্লার রাগ সুনিপুণ বাজানোর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বন্দী করে বিদ্যা আর কলার দেবী সরস্বতীকে। বৌদ্ধদর্শন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষায় প্রদ্যুম্ন পৌরাণিক দেবদেবীদের কাল্পনিক জানার সাথে চোখের সামনে দৃশ্যমান অপরূপা দেবীকে আবিষ্কার করে জ্ঞান আর পরিস্থিতির দ্বন্দ্বে অভিভূত হয়ে পড়ে। পরবর্তিতে আচার্য্য পূর্নবর্দ্ধনের কাছে গিয়ে বিস্তারিত জানানোর পর যখন তার কাছে প্রকৃত তথ্য জ্ঞাত হন,তখন আত্মদগ্ধ প্রদ্যুম্ন বেরিয়ে পড়েন প্রায়শ্চিত্তের উদ্দেশ্যে। অনেক কাল অনেক স্থান পরিভ্রমণ শেষে অবশেষে তান্ত্রিক গুণাঢ্য ও বন্দীকৃত সেই অপরূপা নারীর সন্ধান পান। নিজের জীবন বিসর্জনের বিনিময়ে মুক্ত করেন দেবীকে। যাকে একদা অজ্ঞাতসারে বন্দী করতে সাহায্য করেছিলেন প্রদ্যুম্ন নিজেই। কাহিনতে খুব সামান্য কিন্তু উচ্ছল প্রেম আর বেদনার মিথস্ক্রিয়া নিয়ে উপস্থিতি রয়েছে ' সুনন্দা' নামের এক নারীর।
আপাত গল্পটি পাঠে বিভূতিভূষণের কাব্যময় ভাষা বর্ণনায়, প্রকৃতি- পরিবেশের চিত্রকল্পময়তায় কেমন মোহাবিষ্টতা তৈরি হয় পাঠক হৃদয়ে। সেই মোহাবিষ্টতা অতিক্রম করে আলোচনার স্বার্থে কারণ অনুসন্ধান করতে চাই,লেখক কেন এ গল্পটি বলছেন? এই গল্পের মাধ্যমে তিনি কী বলতে চান? এই বাংলা যার পটভূমি নয়,লেখকের সমকালীন আর্থ- সামাজিক বাস্তবতা যার প্রেক্ষিত নয়!!
আমি আমার মতো কারণটি আবিষ্কার করি এবং এই বিশ্বাসে স্থিত হই এটি লেখকের আরাধ্য অন্তর্গত কারণ। মূলত গল্পকার যখন গল্প বলেন,তা কেবলই বলার জন্য বলা নয়। বলার মধ্য দিয়ে বলার অধিক কিছু বলা, যা হয়তো ধারণ করে তার গোপণ কোনো কাংক্ষা,হয়তো তৈরি করেন প্রতীকী কোনো ব্যঞ্জনা। মূলত যে উদ্দেশ্যে তিনি গল্পটি পেতেছেন তা কতোখানি স্পর্শ করলো পাঠক হৃদয়,পাঠক উপলব্ধি করতে সমর্থ্য হলো কিনা লেখকের উদ্দেশ্য-- এখানেই লেখকের সার্থকতা কিংবা মুন্সিয়ানা। হতে পারে লেখকের উদ্দেশ্যকে অতিক্রম করে অধিক কিছু ব্যাখ্যা পাঠক তৈরি করে নিতে পারে,যা কি না লেখক হয়তো ভেবে লেখেন নি। কিন্তু এও লেখকের কৃতিত্ব যে তিনি যা লেখেন, পাঠক তার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা করতে সমর্থ্য হন।
' মেঘ- মল্লার' গল্পটি,তার চরিত্র সমুহ,ঘটনা পরম্পরা শেষ পর্যন্ত আমার কাছে এক প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। উপস্থিত হয় প্রতীকের আড়ালে এক অন্তর্নিহিত নিগূঢ় সত্য নিয়ে। এবং তা হলো এই যে চিরন্তন কোনো সৌন্দর্য কিংবা কলা কিংবা প্রতিভা কখনোই কোনো শৃংখলে আবদ্ধ থাকতে পারে না। চাতূর্য দিয়ে একে বশ করা যায় না। তাকে আপাত শৃংখলিত করা গেলেও চূড়ান্ত ভাবে তা অসম্ভব এবং অনুচিত তো বটেই।
লেখক যথার্থ এই বক্তব্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই গল্পখানিতে প্রতীকী আখ্যান সাজিয়েছেন এই প্রতীতি নিয়েই আমি পাঠক প্রবেশ করি তার বর্ণনা,ভাষাভঙ্গি ও গল্প শুরুর ভঙ্গিতে। যে বীণ বাদককে খুঁজতে দশ পারমিতার মন্দিরে প্রদ্যুম্ন এর আগমন,সেই মন্দিরেই সুরদাসের মিথ্যে পরিচয়ে প্রদ্যুম্ন কে খুঁজে নেয় তান্ত্রিক গুণাঢ্য। যে তান্ত্রিক গুণাঢ্যর আসল পরিচয় জানার আগে আমাদের যেতে হয় ভারী এক কৌতুহলোদ্দীপক মোহময়ী ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে,যেখানে গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রদ্যুম্ন নিজের অজ্ঞাতসারে তান্ত্রিক কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। তার মেঘ-মল্লার সুরের আবাহনে আবির্ভূতা হন কলার দেবী স্বরস্বতী। পৌরাণিক দেবী বন্দী হন তান্ত্রিক কর্তৃক। গল্পের শুরুতেই আমাদের সাক্ষাত ঘটে আরেক মোহময়ী নারী ' সুনন্দা ' র সাথে; প্রদ্যুম্ন‘র সাথে যার হৃদয়জ সম্পর্ক চিহ্নিত হয় পারস্পরিক বাক্য বিনিময়ে। সুনন্দা প্রদ্যুম্ন এর এই হৃদয়জ সম্পর্ক প্রচুর সম্ভাবনাময়তা নিয়ে আমাদের মনে কৌতূহলের জন্ম দেয়,এবং মূল গল্পের সমান্তরালে আরেকটি আখ্যান পাঠের আগ্রহ নিয়ে গল্পের অন্তে দেখা পাই প্রেমিকের জন্য অপেক্ষমাণ প্রবজ্যার কঠোর ব্রত ধারণ করা এক বিরহী তরুণীর। বেদনার ঘনায়মান মেঘ বৃষ্টি হয়ে না ঝরলেও টের পাই পাঠক মনে বেদনা সংক্রামিত করার লক্ষ্যেই চরিত্রটির সৃষ্টি। গল্পের শুরুতে যার জ্বাজ্বল্যমান আবির্ভাব গল্পের শরীর জুড়ে তাকে কেনো এতো অবহেলা লেখকের? বোধ করি পাঠক মনে বেদনা সৃষ্টির উদ্দ্যেশ্যে তৈরি এই চরিত্রটির প্রতি খানিক অবহেলাই করেছেন লেখক।
অপূর্ব কাব্যময় ছান্দিক গদ্যভঙ্গিমা বিভূতি ভূষণের। গল্প বলার ভাষাটি কবিতা নয়, কাব্যময়। ছন্দ নয়,ছান্দিক গদ্য। যেমন অনেক দেশকাল পেরিয়ে দেবীকে খুঁজে পাবার পর, প্রদ্যুম্ন যখন তাকে অনুসরণ করেন,তখন
" এক একদিন প্রদ্যুম্ন শুনতো দেবী অনেক রাতে একা একা গান গাইছেন-- সে গান পৃথিবীর মানুষের গান নয়,সে গান প্রাণধারার আদিম ঝর্ণার গান,সৃষ্টিমুখী আদিম নীহারিকাদের গান,অনন্ত আকাশে দিকহারা কোনো পথিক তারার গান।"
যেনো কবিতার অধিক কোনো কাব্যময় ভাষা বিরহিণী দেবীর অন্তরাত্মার বেদনা নিয়ে ছড়িয়ে যায় আমাদের হৃদয়ে। প্রকাশের ব্যঞ্জনায় অভিভূত করে আমাদের।
কিংবা লেখক যখন বলেন "তখন আকাশ বাতাস নীরব। অন্ধকারে সামনের মাঠটায় কিচ্ছু দেখবার উপায় নেই,শালবনের ডালপালায় বাতাস লেগে একরকম অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। বড় মাঠের পারে শালবনের কাছে দিকচক্রবালের ধারে নৈশ প্রকৃতি পৃথিবীর বুকের অন্ধকার শরশয্যায় তার অঞ্চল বিছিয়েছে। শুধু বিশ্রাম ছিলো না ভদ্রাবতীর। সে কোন অন্তরের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেবার আকুল আগ্রহে একটানা বয়ে চলেছে,মৃদুগুঞ্জনে আনন্দ সংগীত গাইতে গাইতে কূলে তাল দিতে দিতে"।
তখন তার বর্ণনার চিত্রকল্পময়তায় নিমগ্ন পাঠক কেমন যেন একাত্ম হয়ে মিশে যয় এক বর্ষণমুখর রাতের সাথে। সেই শালবন সেই ভদ্রাবতী নদী সব কেমন তাদের সমুদয় নীরব সৌন্দর্য নিয়ে মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে চোখের সম্মুখে। পুরো গল্প জুড়ে এমনি অসংখ্য ছোট ছোট বাক্য বিন্যাস
" সন্ধ্যার ঈষৎ অন্ধকার কখন মিলিয়ে গিয়েছে,অন্ধকারটাই তরল থেকে তরলতর হতে হতে হঠাৎ কখন জ্যোতস্নায় পরিণত হয়েছে" অথবা
" চূড়ার মাথার উপরকার ছায়াচ্ছন্ন আকাশ বেয়ে ঝাপসা ঝাপসা পাখীর দল ডানা মেলে বাসায় ফিরছিল ও দূরে একখানা সাদা মেঘের প্রান্ত পশ্চিমদিকের পড়ন্ত রোদে সিঁদুরের মতো রাংগা হয়ে আসছিলো,চারিধারে তার শীতোজ্জ্বল মেঘের কাঁচুলি হালকা করে টানা" তখন সমগ্র প্রকৃতিই যেনো ছবি হয়ে উঠে,ছবির চেয়েও অধিকতর মূর্ত হয়ে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে লেখকের বর্ণনার দক্ষতায়।
গল্পের ছোট বড় নানা চরিত্র গুলি কেউই পূর্ণাংগ হয়ে উঠেনি একমাত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রদ্যুম্ন ছাড়া। কিন্তু সেও এক অতি জীবন্ত হলেও অসহায় চরিত্র। " বেশি চঞ্চলতা ও কৌতুকপ্রিয়তা" যার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য,যে বৈশিষ্ট্যই তাকে টেনে নিয়ে যায় তান্ত্রিকের ফাঁদে- প্রদ্যুম্ন এর শিক্ষাগুরুর এমনতর ধারণার সাথে আমরাও একমত হই শুরু থেকেই তার কর্মকাণ্ডে। একাত্মতা বোধ করি প্রদ্যুম্নএর আত্মোপলব্ধির সাথেও।
" এরকম রাত্রে যে যুগেযুগের বিরহদের মনোবেদনা তার প্রা্ণের মধ্যে জমে উঠে,তার অবাধ্য মন যে এইসব পরিপূর্ণ জ্যোতস্না রাত্রে মহাকোটঠি বিহারের পাষাণ অলিন্দে মানস সুন্দরীদের পিছন পিছন ঘুরে বেড়ায়,এর জন্য কী সেই দায়ী?" মানব মনের বিচিত্র গতি প্রকৃতি তাকে যুগে যুগে সৃষ্টিশীল করেছে, পৃথিবীর যাবতীয় রহস্য আবিষ্কারে প্রবৃত্ত করেছে কিন্তু সেই আপন মানসজগৎই যেনো হয়ে গেছে মানবের অবাধ্য অপরিচিত নিয়ন্ত্রণহীন।
অহেতুক কৌতুহল,প্রাকৃতিক পালাবদলের সাথে মানসিক গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের এই স্বাভাবিক রীতি গল্পের শুরুতে যে প্রদ্যুম্ন’র সাথে আমাদের পরিচয় ঘটায়,শেষ পর্যন্ত কারো অনিষ্ট সাধনের আশংকায় অনুশোচনা ও প্রায়শ্চিত্তের আকাংক্ষায় বছরব্যাপী পরিভ্রমণ এসবই প্রদ্যুম্নকে একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। যে জীবন্ত মানুষটির সবশেষে পাথরে পরিণত হওয়া পর্যন্ত যে মানসিক ভৌগলিক বন্ধুর জার্নি তাতে সে আগাগোড়াই এক অসহায় ভিক্টিম। যাবতীয় মানবিক গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তার এই পরিণতি পাঠকমনকে বেদনায় আচ্ছন্ন করে। লেখক তা করেছেন সচেতন ভাবে নিজ মনোস্কামনা পূরণের লক্ষ্যে।
তবু যে লেখক যা বলতে চান তা শেষ পর্যন্ত তা বলে উঠতে পারেন,প্রদ্যুম্ন’র প্রতি গভীর বেদনায় তা আবিষ্কার করে আমরা চমৎকৃত হই। চমৎকৃত হই তার অন্তর্গত উপলব্ধির প্রতীকি উপস্থাপনের সার্থকতা বিবেচনা করে। অবশেষে পুণরায় মুগ্ধ বিস্ময়ে পুনর্বার উপলব্ধি করি প্রকৃতি প্রদত্ত সৌন্দর্য, সুনিপুণ কলা কিংবা লব্ধ প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক প্রতিভা কোনকিছুই কোনোকালেই কোনোক্রমেই শৃংখলিত হবার নয়। প্রদ্যুম্ন’র মতো নিরপরাধ প্রাণের বিনিময়ে হোক কিংবা তান্ত্রিকের আত্মগ্লানির বিনিময়েই হোক শেষ পর্যন্ত গুণ আর প্রতিভা,সৌন্দর্য আর সাধনা সার্বজনীন এবং উদার। মুক্ত এবং স্বাধীন।
---------------------------------------
লেখক পরিচিতি
রুমা মোদক
গল্পকার। নাট্যকার। প্রবন্ধকার।
রুমা মোদক
গল্পকার। নাট্যকার। প্রবন্ধকার।
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ বিশ্লেষণ।
উত্তরমুছুন