রুমা মোদক'এর গল্প : বেণীমাধবের বাড়ি

দিনগুলো পেরিয়ে যায়, রাতগুলো ভোর হয় কেমন ইউফোরিয়ার মধ্যে। ঘুম ভেঙে প্রাত্যহিকতা, রুমের কোণ ঘেঁষে রিডিং টেবিলের উপরে গ্লুু দিয়ে লাগানো উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা বাবুটার মুচকি হাসিটুকু খুব আহ্লাদে গায়ে মেখে, চেয়ারে স্তুপিকৃত গোটা সপ্তাহে জমে যাওয়া কাপড় থেকে নীল জামাটা হাতে নিয়ে দেখে নেই লুকিং গ্লাসে, পুরো রাতের অযত্ন কতটা দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে এটিকে, ইস্ত্রি লাগবে? ঘড়ির দিকে চোখ রেখে ফু মেরে উড়িয়ে দেই ফিটফাট মসৃণ হওয়ার ইচ্ছেটা, এখন আর কিছুতে কিছু যায় আসে না আমার।
এই জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশের মাঝখানের এই করিডোরটুকুতে কেমন খুব অমূল্য বোধ হয় নিজেকে, আমার ক্রাস হয়ে যাওয়া কাপড় জামা, ঠিকমত চিরুনী ক্লিপ না লাগানো চুল, লিপস্টিক না লাগানো ঠোঁট, কারো চোখে ভাল না লাগলে আমার কি আসে যায়? কি আসে যায় উসকু খুসকু আমাকে নিয়ে কেউ আড়ালে আবডালে মুখ লুকিয়ে হাসলে? এ জীবনটাতো অপেক্ষায় অন্য একটা জীবনের, কাঙ্খিত জীবনের। কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে, দুমড়ানো জামাখানা গায়ে গলিয়ে, ডাইনিংয়ে শুকনো রুটি আর রাতে রান্না করা বাসি গন্ধ ছড়ানো সবজিতে নাস্তা সেরে প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে নাক ডুবিয়ে দেই নগরের কার্বন মনো অক্সাইডে। পেটের ভিতরে বাসি খাবারগুলোর ফুলে ফেপে উঠা অস্বস্তি নিয়ে টাউন সার্ভিসের বাসের চাপাচাপিতে কোনরকমে লেডিস সিটে পাছা লাগানোর সুযোগটা পেয়েই হারিয়ে যাই ভবিষ্যতে। সেখানে এই সকালে টেবিলে সাজানো চাপাতি রুটি, ডিমের পোচ, উপরে টাটকা কাঁচামরিচ পেয়াজ ভেসে থাকা সবজি, নকশা করা ডাইনিং ক্লথে শাইন পুকুরের ঝকঝকে ক্রোকারিজ, নাটকে সিনেমায় কত্তো দেখেছি.............।

অফিস থেকে হোস্টেল, হোস্টেল থেকে অফিস, মনোটনাস জীবনের রুটিনটা দুলছে বদলে যাওয়ার হাওয়ায়। আমার জন্য রাজ্যের রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা করছে আগামীর দিন। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো থেকে একেবারে অন্যরকম দিন। ........ঘোরের মধ্যে হাটছি চলছি ফিরছি কাটছে সময়। অফিস শ৮েষে কোন কোন দিন রাজীব এসে দাঁড়ায় হোস্টেলের গেটে। চম্পা সোহেলীরা টিপ্পনি কাটে- ভাতারের আর তর সয় না রে! রাগ নয় শিহরিত হই। ‘ভাতার’ এর মতো অশ্লীল শব্দটাও আপন হয়ে উঠে মুহুর্তে, কি নয় রাজীব আমার! রাজীবের সাথে স্বপ্নে স্বপ্ন ঘষে চষে বেড়াই শহরের এ প্রান্ত ও প্রান্ত। নতুন সংসার, কত কি লাগবে, হাতা-বেড়ি-খুনতি। ঝা চকচকে মলগুলোতে ঘুরে ঘুরে শেষমেষ ওকে টেনে নিয়ে আসি ফুটপাতের সাজানো পসরায়- অযথাই অসম্ভব দাম ওখানে। আমার খুতখুতে সুক্ষ্ম রুচিটাতে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় ও- এতো বাছাবাছি করলে জিনিস কিনতে পারবে না, নিয়ে নাও তো একটা। ওর বিরক্তি গায়ে মাখি না। ভাতের হাড়িটা একটু বড় দেখে কিনি, তরকারির সসপ্যানটাও। রাজীব মসকরা করে- ইউরোপিয়ানদের মতো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিয়ে করছি নাতো, এতো বড় বড় সব হাড়ি-পাতিল। মনে মনে আমার হিসেব ঠিক আছে, আর কেউ না হোক রুবি আপাতো আসবেই মাঝে মাঝে। সোহেলী চম্পারাও কি বাদ যাবে! কতদিনের সম্পর্ক, মনের হিসেবটা মনেই লুকিয়ে একটু উচকে দেই ওকে, জানিতো কিসে উচকে উঠে ছেলেরা- আজ নেই, হবেতো একদিন। ঠিক ঠিক বদলে যায় রাজীব, আগাম সুখের বর্ণচ্ছ্বটায় লাল হয় ওর কানের লতি, নাকের ডগা, নিউ মার্কেটের ওভারব্রিজে আবছা আলোয় ও জড়িয়ে ধরে আমাকে- আমার কিন্তু এক হালি চাই। আমি নিজেকে মুক্ত করি ওর উষ্ণতার আলিঙ্গন আর হালি পূরণের অন্তরালের অনুভবের শিহরণ থেকে। - করছো কী প্রকাশ্য জনারণ্যে, লোকজন সব তাকিয়ে আছে। সুখের আবেশ উপভোগের অনুভব থেকে বিচ্ছিন্ন রাজীব বিরক্ত হয়- দেখুক, দেখুক না! পর নারী নাকি দুদিন পর বিয়ে করা বউ হবে।

নতুন ফ্ল্যাটটাতে ঢুকে এদিক সেদিক পাল্টে রাখি শোপিসগুলো, ফুলের টব, কর্নার টেবিল, খুব বেশি নয় সম্পদ, দুজনের জমানো কিছু বই, আর একটা খাট আলমিরা। নতুন চাকরি রাজীবের, আমারটাও। বাসাটাও খুব বড় নয় বেডরুমের বাইরে এক টুকরো ডাইনিং আর রান্নাঘর। বেডরুম লাগোয়া বাথ আর তার পাশে একটা বিশাল ছাদ। আসলে পাঁচ তলা বাড়িটার ছাদের উপরে বাড়তি তোলা এ অংশটুকু। এডভান্স দিয়ে কনফার্ম করার পর আমার খুশি দেখে কে, একটা বাসার ভাড়া দিয়ে পুরো ছাদটাই ফ্রি!! নিজের ঘর, নিজের সাজানো একেবারে নিজের। নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারে এক ডিম ভাগ করে খেয়ে এক ঘরে খেয়ে পরে ঘুমিয়েছি পাঁচ ভাইবোন। খুব নিজের করে কখনো পাইনি কিছু। মনে পড়ে প্রথম যেদিন লেডিস হোস্টেলে এসে নিজের একটা লকার চেয়ারসহ একটা রিডিং টেবিল একটা খাট আর রুমে ডুপ্লিকিট চাবিটা পেয়েছিলাম সেদিন নিজেকে মনে হচ্ছিল সম্্রাজ্ঞী। আর আজ পুরো একটা সংসার হচ্ছে আমার, কেবলই আমার।

বাসায় খবরটা জানাইনি, জানাবো না এমনই ইচ্ছে। সেই তো মায়ের পুরানো প্যানপ্যানানি, বাবার গুম মেরে থাকা। মেয়ের জন্য জজ ব্যারিস্টার জামাই চাই যে ওদের। কত অশান্তি পেরিয়েই না হোস্টেলে আসা! তবু শাড়িটা কিনতে গেলে খয়েরি রংটা চোখে লেগে থাকে। মার ভীষন পছন্দের রং। ছোট ফুফুর বিয়ের শাড়িটা আমার গায়ে জড়িয়ে দেখেছিলেন বউ হলে কেমন দেখাবে আমাকে- ঠিক এরকম একটা শাড়ি কিনবো তোর বিয়েতে। ২৫টি বছরের শত সহস্র স্মৃতি আড়াল করে এই একটি স্মৃতি কেমন ঝলসে উঠে মাথার উপর ঝলসানো ডজনখানেক বাতির নিচে। রুবি আপা তাড়া দেয়- নে তো নিতু এটাই নে। তোকে বেশ মানাবে। মা ও ঠিক এভাবেই বলতো হয়তো। জানো রুবি আপা- রুবি আপার কাছে যখন তখন গল্পের ঝাপি খুলে বসতে কোন বাধা নেই। কষ্টের সুখের দুঃখের আনন্দের।

রাতে নিজের বেড ছেড়ে রুবি আপার বেডে যাই, একজনের অপর্যাপ্ত জায়গাটুক দুজনে ভাগ করে নেই- জানো রুবি আপা-রাজীবটা এমন যে ওকে কষ্ট দেয়ার কথা ভাবাই যায় না। রুবি আপা বিষন্নতা মাখানো স্নেহার্দ্র হাত রাখে আমার মাথায়- ভালবাসাকে কখনো অবহেলা করতে নেইরে নিতু, ভালবাসা অমূল্য। আমি রুবি আপার হাতটা ধরি। এই প্রথম খুব সাহসী হই। অনেকটা হয়েছে। আর না এবার তুচ্ছ করি রুবি আপার ব্যক্তিত্বের দৃঢ় দেয়াল, যে দেয়ালে তিনি ঢেকে রেখেছেন নিজেকে এতকাল ধরে -দিনভরতো সবাইকে উপদেশ দিয়ে বেড়াও, তোমার ঘটনাটা কি বলোতো। তোমার জীবনটা এমন কেন রুবি আপা? রুবি আপার চোখের কোলে রাত আরো ঘন অন্ধকার হয়ে নামে। জানালার গ্রিল বেয়ে বাইরে থেকে আসা ঘরময় ছিটকে পড়া রহস্যময় আলোতে সে অন্ধকারের গাঢ়তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। নিজেকে ঘিরে তৈরি করা রহস্যের ঘেরাটোপ ভাঙে না রুবি আপা। কর্মজীবী লেডিস হোস্টেলের ৩৩৩ নাম্বার রুমে পাশাপাশি আছি আজ চার বছর। দু একদিন বলছিলেন- জানিস, মোবাইলে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে প্রায়ই, কথা বলে না। প্রসঙ্গটা টেনে আনি সামনে- আচ্ছা রুবি আপা ফোনটা আরো এসেছিলো? হ্যাঁ প্রায়ইতো আসে- পাশ ফেরে শোয় রুবি আপা। টের পাই চেহারায় প্রতিফলিত কোন অভিব্যক্তি তিনি লুকাতে চান আমার কাছে। আমি আজ ছাড়বো না বলেই পণ করি- আচ্ছা জানতে ইচ্ছে করে না কে সে? কি চায়? না কি জানো ঠিকই বলছো না কোন উত্তর নেই রুবি আপার। কেমন নিস্পৃহ এড়িয়ে যান- ঘুমাতো সকালে অফিস আছে। রাগ নয় অভিমানে হাল ছেড়ে দেই, আমরা পেটের সব কথা উজাড় করে দেই তোমার কাছে আর তুমি পার না!

হোস্টেল জীবনটা কাটতে থাকে হোস্টেলের মতোই। নানাজনের নানারকম জীবনের গল্পে--- সন্ধ্যায় ফিরে ডালিয়া কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে, জুনায়েদ ওকে বিয়ে করতে পারবে না সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাসলিমা সেদিন এক বোতল ডেটল খেয়ে ফেললো রাত দুপুরে, কি ছুটাছুটি মেডিক্যালে ক্লিনিকে। সফিকের নতুন গার্ল ফ্রেন্ড জুটেছে।সারা গায়ে দাঁতের দাগ নিয়ে সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফিরে অবসন্ন ঘুমায় কুমকুম। শরীরী প্রেম দেয়নি বলে ওর আগের প্রেমিক ‘ব্যাক ডেটেড’ গালি দিয়ে পালিয়েছে। এবার আর তাই ভুল করছে কুমকুম। কত সহজ-সরল আমাদের দেনাপাওনা-হারজিতের গল্পগুলো। এই বর্তমানের গল্প। অতীতের সঙ্গে সংযুক্তিহীন ভবিষ্যতের স্বপ্নবিহীন। আমি রাজীবকে বলি, ৩৩৩ নং রুমের আমরা সবাই আমাদের গল্পগুলো দাড়ি কমাসহ জানি। কেবল রুবি আপা ছাড়া। কেন যে মহিলাটা নিজের চারপাশের দেয়ালটা ভাঙেন না। এমনিতেতো সবকিছুতে এককাঠি বাড়া সারারাত একা জেগেছিলেন মেডিক্যালে তাসলিমার পাশে আমাদের সবাইকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়ে। আমার কেনাকাটা থেকে গোছগাছ কোথায় নেই উনি! অথচ কিছুতেই নিজেকে উন্মুক্ত করেন না আমাদের কাছে। রাজীব শুধরে দেয়- বলেন না কোথায়, ওই ফোনটার কথা বললেন না। হ্যা এটুকু বলে বটে, এ নিয়ে বিরক্তও বেশ। অফিসে বসের সামনে যখন তখন কল করে লোকটা, ভীষন বিব্রত হতে হয় রুবি আপাকে। বিশেষত তার নতুন বস নাকি অফিস টাইমে মোবাইলে কথা বলা একদম পছন্দ করেন না, সবাইকে বলা আছে অফিস টাইমে ফোন না করতে। তাই আর সাইলেন্ট করার দরকার পড়ে না। কিন্তু ঐ লোকতো কোন কথাই শোনে না। আজ রুবিকে আপাকে ধরবো খুব ভাল করে। উনি নিশ্চয়ই জানেন লোকটা কে, নিশ্চয়ই তার প্রতি দূর্বলতা আছে তার। নইলে একবার কষে ধমক দিলে কেউ বারবার ডিস্টার্ব দেয় আসলে রুবি আপা তাকে প্রশ্রয় দেয়। ভাল না বাসলে প্রশ্রয় দিতো বলো। আজ তাকে ছাড়ছি না- আমার একদমে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে রাজীব আমার হাত দুটো ধরে ওর দুহাতে। আমি যেন খুজে পাই এক পৃথিবী নির্ভরতা। তুমি না আস্ত পাগল একটা -আমি ওর কন্ঠে আরও বেশি নির্ভরতার সুর শুনি। তুমি মানুষের জন্য এতো ভাবো কেন নিতু- অভিযোগ নয়, আমার ইমোশনে নুইয়ে পড়া হৃদয়ে যেন সহমর্মীতার হাত বুলায় রাজীব, আমার চোখে জল আসে। আমি জল ছলছল চোখে আরো গভীর ভালবাসা মেখে ওর দিকে তাকাই, মনে হয় আমি যতোটা না রাজীব যেন তার চেয়েও বেশি বুঝে আমাকে। হ্যা ভীষন কৃতজ্ঞ হই, না রাজীবের প্রতি নয়, নিজের প্রতি। এমন একটা ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে খুজে বের করতে পেরেছি বলে। মনে মনে বলি- ছেলে, তোমাকে কষ্ট দেয়ার দূর্ভাগ্য যেন কখনো না হয়। আসলে রাজীব এমন ছেলে বলেইতো মা বাবা শিকড় বাকড় তুচ্ছ করে ওর কাছে যেতে পারছি, যাচ্ছি চিরদিনের জন্য।

তাসলিমা কুমকুম ডালিয়া সোমা সবগুলি যেন ক্ষেপে গেছে একসাথে। গাড়ি লাগবেÑÑÑফুল দিয়ে সাজানো লাগবে। তাসলিমা বলে গাদা কুমকুম বলে সাদা, ডালিয়া বলে পারসোনা, তো সাদিয়া বলে লী। ওদের তীব্র উচ্ছ্বাসময় তর্ক উপভোগ করতে করতে আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেই, ডুবে যাই দুজন দুজনের মাঝে। মিনি চাইনিজের হালকা আলোয় টেবিলের নিচে আমার হাতের উপরে হাত রাখে রাজীব। আমিও পাল্টা আশ্রয়ে আকড়ে ধরি হাতটা। সুপের চামচ মুখে তুলতে তুলতে আমাদের যৌথ কল্পনাগুলো ফানুস উড়ায়। কেমন লাগবে আমাকে লাল টুকটুকে বউয়ের সাজে, কেমন লাগবে চিরজীবন সাদামাটা রাজীবকে মাথায় টোপর পড়ে বর সাজলে? মা বাবা স্বজন ছাড়া কেবলি বন্ধুদের পাশে নিয়ে বিয়ে করতেই বা কেমন লাগবে? ফানুসটা খুব বেশিদূর উড়ে না। অভিজ্ঞতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে, জানে না সামনের আকাশটা সাদা না কালো।

আজ বিয়ের আগে সবগুলোকে নিয়ে আমার শেষ 'অবিবাহিতা আপ্যায়ন'। সবাই এলো শুধু রুবি আপাটা ছাড়া। রুবি আপার কথা মনে পড়তেই, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলি আমি। নুতন জীবনে প্রবেশের আগে কাজটা করে যাবো, যাবোই। রিক্সায় রাজীবকে বলি কথাটা- চলো কাল রুবি আপার ঐ লোকটার সাথে দেখা করি একবার। আমার উচ্ছ্বাসে উৎসাহ দেখায় না রাজীব- ও মা ও লোক কে, কী তুমি জানো নাকি? হ্যা আমি আননোন লেখা ফোন নাম্বারটা চুরি করে দেখে ফোন দিয়েছিলাম- আমার উত্তরে রাজীব বিব্রত হয় কিছুটা ও বাবা বলো কি, তলে তলে এতদূর! মনে হয় আমার চোখে হঠাৎ অচেনা কোন ছায়া পাঠ করে রাজীব- এ্যাই নিতু তুমি এতো চালাক হলে কবে? রাজীবের কথায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই,বুঝি ধরা পড়ে যাই- দূর চালাক টালাক কিচ্ছু না কদিন ধরেই মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই ঠিকঠিক যার যার মতন চলে যাব নিজের ঠিকানা খুজে খুজে। কেবল, রুবি আপাটাই পড়ে থাকবে ৩৩৩ নং রুম আগলে। তোমার কেন মনে হচ্ছে রুবি আপা বিয়ে করবে না, ৩৩৩ নাম্বার আগলে পড়ে থাকবে- রাজীব পাল্টা প্রশ্ন করে। না আমার এমন যে কেবল মনে হচ্ছে তা নয়, তাই হবে। রুবি আপার বয়স ৩৫ ছাড়িয়ে গেছে দেখতে কুশ্রী না হলেও খুব সুশ্রী নয়। চোখের কোল, চুলের গোড়া সব পাল্টে গিয়ে বাইরের পৃথিবীটাকে বয়সটা ঠিক ঠিক প্রকট করে জানান দিচ্ছে। আমি জানি রুবি আপার ছোট ভাইবোনগুলো সবার বিয়ে হয়ে গেছে, সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ভাই আর ভাই বউয়ের সংসারে মা ই অযাচিত। নিজেকে বোঝা মনে হয় বলেইতো হোস্টেলে এসে থাকছেন। প্রায়ই মা নিতে আসেন তাকে, কিন্তু রুবি আপা যান না। বিয়ের চেষ্টাও হয় কখনো সখনো রুবি আপা রাজি হন না। যে লোকটা ফোন দেয় প্রায়ই, সে রুবি আপার প্রেমিক। কথা না বললেও রুবি আপা জানেন সেই ফোন দেয়। সেও এতোটা বছর বিয়ে না করে আছে শুধু রুবি আপার জন্যই। সময়মতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি বলে তখন বিয়ে করতে পারে নি। আর এখন একবার ফিরিয়ে দেয়ার অপরাধ বোধে বিব্রত লোকটি রুবি আপাকে বলতেই ভয় পাচ্ছে। রুবি আপারও অনেক অভিমান, তখন রাজি হলোনা যখন, না টাই থাক। এখন আর কিছুতেই হবে না। কথাগুলো শুধু আমাকেই বিশ্বাস করে বলেছে রুবি আপা। আর কাউকে যেনো না বলি,এই শর্তে। মনে মনে ভাবি এখন কেবল আমিই পারি দুজনের মাঝে দূরত্বের দেয়ালটুকু ভেংগে দেয়ার মহত দায়িত্বটা পালন করতে।ভিতরে ভিতরে আত্মতৃপ্তি উচ্ছাস আর উত্তেজনায় টগবগ ফুটতে থাকি আমি। উপর থেকে কিচ্ছু বুঝতে দেই না,রুবি আপার বিশ্বাস ভংগ না করে আসল কথাগুলো গোপণ করে রাজীবকে বলি, শোন রাজীব নুতন জীবনে প্রবেশের আগে রুবি আপার একটু উপকার করে যেতে পারলে দেখো আমাদের জীবনটা রুবি আপার শুভাশিসে ভরে উঠবে। লোকটা নিশ্চয়ই রুবি আপার কোন গোপন প্রেমিক। নিস্পৃহ রাজীবকে এবার আমার অচেনা লাগে- আচ্ছা এই মুহুর্তে নিজেদের এত কাজ ফেলে একটা আননোন নাম্বারে পেছনে ছোটার কোন মানে আছে নিতু! রাজীবের বলা ভঙ্গিটা আহত করে আমাকে। ওকে হঠাৎ আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর মনে হয় আমার। আচ্ছা ও এভাবে বলছে কেন? আমার এরকম টুকটাক পাগলামির অভ্যাস আছে বলেই না আমাকে এতো ভাললাগে ওর, বলেছিল একদিন। আমার চুপসে যাওয়া দেখে রাজি হয় রাজীব- চলো তবে কাল, ফোন দিয়ে ঠিকানাটা নিয়ে রেখো। আমার মনের কোনে জমে উঠে মেঘটা হয়তো চেহারায় এসে বাসা বাধে। পরিবেশটা হালকা করার জন্য চারপাশের সব উৎসুক চোখ তুচ্ছ করে রাজীব আমায় জড়িয়ে ধরে রিক্সায়- শোন আর যাই করো বিয়ের দিন বড় একটা লাল টিপ কিন্তু পড়বেই পড়বে। মুহুর্তেই মেঘ কেটে হাজারটা সূর্য চমকে উঠে আমার চোখে কপোলে ঠোটে আমি টের পাই। আমার টিপ, আমার শাড়ি সবকিছু নিয়ে কি ভীষন মনোযোগী রাজীব আমার প্রতি। ভাললাগায় ডুবে যেতে যেতে আমি মাথা রাখি ওর কাধে। রাতে রুমে ফিরে রুবি আপাকে বলি, কাল যে করেই হোক নুতন এক প্যাকেট লাল টিপ কিনে আনতে। বলি- জানো রুবি আপা ভালবাসা বোধহয় একেই বলে। এই অখন্ড মনোযোগকে । রুবি আপা সমর্থন করেন না- মোটেই না ছেলেরা ওসব বলে মন ভোলানোর জন্য, কদিন পরেই টের পাবি। প্রথমবার রুবি আপার কথায় একটু ধাক্কা খাই। কেমন অনাহত একটা বিষাদের ছায়া ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

টেলিফোনে এড্রেসটা নিয়ে পরদিন নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে যাই আমি ও রাজীব। কেন কি বৃত্তান্ত কিছুই বলিনি আগে থেকে। ফোনের ওপারে লোকটির বিব্রত কন্ঠস্বর টের পাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু সামনা সামনি ভদ্র সুবেশী লোকটির বিব্রত হবার পরিমান প্রায় সীমা ছাড়িয়ে গেল যখন আমি বললাম, আমি রুবি আপার রুমমেট। চলুন ক্যান্টিনে বসে কথা বলি- তড়িঘড়ি রুম থেকে বের হয়ে এলেন লোকটি। ক্যান্টিনে চা সিঙাড়ার অর্ডার দিয়ে আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি নিজেই বলা শুরু করলেন- ভালই হয়েছে আপনারা এসেছেন, আসলে আমি কারো সাহায্য চাইছিলাম। টেবিলের নিচে জুতো থেকে পা খুলে আমি আলতো চাপ দেই রাজীবের পায়ে, মানেটা এমন যে- দেখলেতো কি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আমার। রাজীবের দৃষ্টিতে স্পষ্ট বিরক্তি পড়তে পারি আমি, যার মানে- মোটেই না, এই প্রতিষ্ঠিত কর্পোরেট সুবেশী ভদ্রলোকটি রুবি আপার প্রেমিক হতেই পারে না। আমার চেয়ে জীবন ও জগতকে রাজীব বেশি চিনে, আমি স্বীকার করি। মানুষ সম্পর্কে ও যা বলে তার প্রায় সবটাই সবসময় মিলে যায়। তবে এবার ও নির্ঘাত হারবে। আমি আসলে রুবির ব্যাপারে কথা বলার জন্য কাউকে খুজছিলাম- ভদ্রলোক কথা শুরু করেন। আমি একটি বিজয়ী হাসি নিয়ে রাজীবের দিকে তাকাতেই দেখি ওর চেহারায় বিরক্তি মিলেমিশে একাকার। ভদ্রলোক বলতে থাকি দেখুন একটা বয়সে সবারই এমন দু একটা প্রেম টেম হয়, ওগুলো সিরিয়াস কিছু নয়, তরুণ বয়সে একটা সম্পর্ক র্ছিল ওর সাথে, এই কিছু চিঠিপত্র আদান প্রদান এর বেশি কিছু না, মানে ও সময়তো আর মোবাইল টোবাইল ছিল না। হয়তো ওকে না জানিয়ে বিয়েটা করা ঠিক হয় নি আমার। কিন্তু সম্পর্ক টাতো ঐ চিঠিপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো, জানানোর বাধ্য বাধুকতা ছিলো না। হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে নুয়ে পড়া সুপারি গাছের মতো আমার বিশ্বাসে আশ্বাসের হাত বুলাতে চায় রাজীব, আমার মাথায় হাত রাখে। ভদ্রলোক খেয়াল করেন কি করেন না, বলতে থাকেন- এখন প্রায়ই যখন তখন ফোন করে আমাকে ডিস্টার্ব করে। কেমন করে যেন নাম্বারটা পেয়েছে। দেখুন আমার ওতো ঘর সংসার আছে। এ নিয়ে ভীষন অশান্তিতে আছি। বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তুপের মতো মাটিতে মিশে যেতে থাকি আমি, আমার সমস্ত আয়োজন, উদ্যম, বিশ্বাস আর উৎসাহ নিয়ে। রাজীবের নির্ভরতার হাতটা মাথা থেকে পিঠে নেমে আসে আরো নির্ভরতা নিয়ে। ভদ্রলোক মিনতি করেন- প্লিজ আপনারা আমাকে উদ্ধার করুন। ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন। শুনেছি বাছ বিচার করতে করতে আর বিয়েই করা হয়নি ওর। এ বয়সেও মেয়েদের বিয়ে হয়। চাই কি বউ টউ মরে গেছে এমন কেউ-------প্রয়োজনে আমি হেল্প করবো।

ধুলিকনার মতো উড়ে যাওয়া আমার তুচ্ছাতিতুচ্ছ আবেগে মমতার হাত বোলাতে চায় রাজীব- এতো আঘাত পেয়েছ কেন? সত্যিতো বাস্তবতাটা ভাববে না, ভদ্রলোকের ওতো একটা জীবন আছে। তার দিক থেকে ভাবো। আমি উত্তর দেই না, অস্তাচলে হারিয়ে যেতে থাকা সূর্যটার দিকে তাকাই, বিয়ের জন্য কেনা খয়েরি বেনারসিটা কেমন মলিন হয়ে যেতে থাকে দৃষ্টি আড়াল করে। ভূমিকম্পের মতো দুলতে থাকে স্বপ্ন দিয়ে সাজানো ফ্ল্যাটের আসবাবগুলো--- সত্যিতো তার দিক থেকেওতো ভাবতে হবে!! কথাগুলো একসুরে মিলে যাবার রেশ ধরে রাজীব আর ভদ্রলোক দূর দিগন্তে যেন এক দেহেও মিলে যেতে থাকে----। ক্লিনিকে জ্ঞান ফিরলে মাথার পাশে রুবি আপা জানতে চান- কি রে বাসার সবার জন্য বেশি মন খারাপ লাগছে। অব্যক্ত যন্ত্রনা আমার চোখের কোনে মুক্তো দানার মতো জমে উঠে। রুবি আপা ¯ চিরাচরিত স্নেহের স্পর্শে শুষে নেন দু হাতে মুক্তো দানাগুলো- ভালোবাসার টানে যাচ্ছিস মেয়ে, কেঁদে পথটা পিচ্ছিল করছিস কেনো? আমি সামনে দাঁড়ানো আমার ভবিতব্য রাজীবের দিকে তাকিয়ে ভাবি- তুমি জানো না রুবি আপা, আমিতো ভালোবাসার জন্যই কাঁদছি।



(গল্পটির নামের জন্য জয় গোস্বামীর কবিতার কাছে কৃতজ্ঞতা।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ