নুসরতের সংগে দেখা- আমরা তখন নতুন স্মার্ট হয়েছি। সেই সময় এবং বয়োসটাই স্মার্ট হওয়ার বা কথিত স্মার্ট ভাব করবার! নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে, ঝুঁকে পরে হ্যান্ড শেক, ভণিতা, ভূমিকা ও বাচালতা ভরা চোখ ঝলমলানো কায়দায় নিজের নাম বলা, এবং এমন ভাব করা যেন জীবন এবং সবকিছুই এক স্থায়ী কৈশোরিক দশা। তেমন সময়ে নুসরতের সাথে পরিচয়। সে ছিল টিন বয়োসের শেষ প্রান্তে। আমিও তাই। আমরা একই বছরে দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করেছি, একথা পরে জেনেছি। নুসরত বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। বন্ধু ফারুক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ফারুক মুগ্ধ হওয়ার যাবতীয় সব কবিতা লিখত, চলা-ফেরার শৈলী, ভঙ্গিমা এসব ছিল চেগেভারা’র চাক্ষুষ প্রতিদ্বন্দ্বী।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর সকল বন্ধুরা যখন বিভিন্ন বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজ গুলোতে পড়তে চলে গেল আমি তখন প্রায় কোথাও আবেদন করবারই সুযোগ পেলাম না। কারণ পরীক্ষার ফলাফল ছিল তৃতীয় ধরনের দ্বিতীয় বিভাগ। ওই ফলাফলে আবেদনই করা যেত না। ফলে ব্যর্থ তরুণ-যুবার দোটানা লয়ে, কখনো এক্সটেসি, হিস্টামিন, চরশ-গাজা, ফেন্সিডাইল সেবন করার চেষ্টা, ‘কিছুই হলো না হবে না’ ভাব ধরা, ‘লুজার’ ইমেজের বাজারজাতের চূড়ান্ত মহড়া, এই সব আরকী। হতাশা কাটাতে বন্ধুদের পরামর্শ ছিল ‘প্রেমে’ জড়ানো; সে সবের কোনও দাওয়াই-ই কাজ করেনি। অবশেষে কাউনিয়া এলাকা থেকে শহরের বিপরীত মাথায় আলেকান্দা সংলগ্ন বরিশাল মেডিকেলে যাতায়াত শুরু। পুরনো বন্ধুরা যারা ওই চিকিৎসা বিদ্যালয়ে ভর্তী হয়েছে তাদের অবসরের আড্ডায় যোগ দেয়া। সেই নিয়মেরই ফল ছিল নুসরত।
তার চোখের রঙ আমার জন্য খুব দ্বিধার ছিল। গভীর ভ্রম হতো গাঢ় বাদামী, হালকা নীল অথবা সবুজের মিশ্রণ ভেবে। অত আলাদা রঙ না খুঁজে ধরে নিতাম ‘রংধনু চোখ’। তুলনায় পাপড়িগুলো বড়, মনে হতো অকারণে তাতে শিশির জমেছে। দীর্ঘ বিরতির পর পলক পরতো। ভাবতাম আহা চোখের পাতা পড়াটা যদি আরো ক’মুহুর্ত বিলম্বিত হতো। সরাসরি তাকিয়ে কখনো আমাদের সাধারণ কথা হয়েছে কিনা মনে পরে না। যদিবা দু’একবার তা সাধারণ নয় আগেই ইঙ্গিত করেছি। চোখে-চোখে রেখে কথা বলবার মুহুর্তগুলো বুকের কোথাও খামচিটা ধরে আছে এখনও; এই যুগ-যুগ পরও সেটা টের পাওয়া যায়। সেকী কেবল আমারই অসহায় বুক নাকী তারও অবদান ছিল?
ঢেউ তোলানো চুল আধা উলটা আঁচড়ানো, আছরে পরে থাকে লম্বা গলার উপর, অদ্ভুত কৃষ্ণকায়-সোনালী রঙ। ছোটবেলায় বড় মামার সনে ঝাউতলার সোনালী সিনেমা হলে দেখা আলফ্রেড হিচককের ‘রিয়ার উইন্ডো’ ছবির গ্রেস কেলির মতন। ভ্রু, কপাল, গাল, নাক, চিবুক, ঠোট এর সবই গ্রেস কেলির সঙ্গে বিনিময় যোগ্য। আগে ক্যান্টিনে অথবা ক্যাম্পাসের অন্য কোথাও দেখে থাকতে পারি। প্রায় ছয় ফুট লম্বা, জিন্স অথবা ড্রেস প্যান্ট, সামনে বোতাম লাগানো (বাটন ডাউন) জামা। দ্বিতীয় বোতাম খোলা, বোতাম স্পট বরাবর খুব চিকন সিলভার চেইনে ঝুলে দোলে বনঘাসে সদ্য গজানো কচি পাতার হালকা সবুজাভ পেন্ড্যান্ট। একগোছা চুল বাম কপাল দিয়ে মাঝ নাক ছুঁয়ে গাল ধরে ডান কানের পাশে দুলে যেতে থাকে। তখন ফারুক চেগেভারার ইমেজে নেরুদার বিপ্লবী কবিতার মতন আমাকে পরিচয় করায়। নুসরত, আমীর আলী, আমীর আলী, নুসরত। এমন করে হাসি, মাথা নাড়ানো, চোখের পাপড়ি শিশিরের ভারে পলক পরা, যেন আমি তার চেনা। আর তাকে রিইনকারনেশন প্রাক্ কালে আমি চিনি। ভেতরে লজ্জিত হই, এত অস্থির হওয়ার মানে নাই। বিচলিত অথচ তাকে পরিতুষ্ট করবার (ইমপ্রেস!) সেকি চেষ্টা আমার। গলা শুকায়, দৃষ্টিতে ঝাপসা অনুভূত হয়, কানে উত্তাপ টের পাই, নিশ্চয় এতক্ষণে তা লাল আভায় পরিণত হয়েছে। হেসে নাম বলে “নুসরত”। নিজের ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কেন জানি না, বাম হাত দিয়ে ধরলাম, কেন জানিনা বলা কি ঠিক হবে? জানতাম তো, সেটা স্নায়ুবিকতা। এ-ই কী ‘প্রথম দর্শন ভালোলাগা’? ফার্স্ট শাইট ক্র্যাশ? হোক, ফারুকের সেখানে অস্তিত্ব থাকে না, বললাম, “আহ্, নুসরত”, স্বাভাবিক থাকবার এক মরন চেষ্টা! বললাম, “আমি আরও দুজনকে জানি যাদের নাম নুসরত”। ফারুক এই ফাঁকে চলে গিয়েছিল? স্মরণে নেই, এত দিন পরে। ওকথা শুনে একটু হাসল হয়তো, যত সামান্য পরিমাণের হাসি তাকে বলা যায়। আমার দিকে নয়, আবার ভিন্ন কোথাও-ও না তাকিয়ে- “আচ্ছা”! ভাবলাম এরপর বলবে ‘তাই বুঝি’। ওরকম কিছুই নয় বরং “হুম… ইন্টারেস্টিং, দু’জন কারা?”। ভয়ও হলো ভেবে যে সেকী ভাবল অন্য কোন মেয়েদের নাম? কিংবা সেরকম কিছু? অবশ্য চাউনি, কণ্ঠে, এসবের তেমন ইঙ্গিত ছিলনা। বললাম “একজন কাওয়ালী সঙ্গীত শিল্পী, পাকিস্তানের, ফতে আলী”, ইচ্ছে করে ফতে আলীর প্রথম নাম উচ্চারণ করলাম না। “একজন জুলফিকার আলী ভুট্টর স্ত্রী, কুর্দি, ইরানীয়ান বংশোদ্ভূত”। পরীক্ষার ফলাফল তৃতীয় মানের দ্বিতীয় শ্রেণী হলেও নিষ্ঠাবান সংবাদ পত্র পাঠক হিসাবে ওইসব নাম আমি জেনেছিলাম। মনে হলও চব্বিশ সেকেন্ডের একভাগ সময়ের জন্য তাকাল, সেইই জীবনের প্রথম চোখে চোখ রেখে কথা বলা। তারপর মাটিতে তাকিয়ে, যেখানে ক্যান্টিনের জানলায় আসা রোদে একটি গাছের ছোট ডালের পাতার ছায়া মেঝেতে দুলছিল, সেখানে চেয়ে থাকল, অসীম বিষন্নতায়, ক্যান্টিন ভর্তি অত ছাত্র ছাত্রী থাকা সত্যেও অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল, জগতে দাঁড়াবার মাটি নামে অবশিষ্ট থাকল না। একটা সময় পার হওয়ার পর নীরবতা ভাঙ্গল “আপনার চেনা নামের দুজনকে কেন পাকিস্তানেরই হতে হবে”? আমাদের কথা থাকেনি এরপর। নির্বোদ্ধিতা, হতবাক, এছাড়া ভাবা যায়নি- কেবল, কী হতে পারে ওদেশের নামটিতে? এই বিষণ্ণতার পেছনে? তার বাবাকে পাকিস্তানীরা হত্যা করেছে? মা অথবা বোন ধর্ষিত? নাকি নিজেই তখন বালিকা-কালে ধর্ষনের শিকার? ভাই যুদ্ধে শহীদ? এইসব সম্ভাবনার কথা মনে হয়েছিল।
সেটাই মেডিকেল ক্যান্টিনে যাওয়ার শেষ দিন। সেখানে কখনো এরপর যাওয়া হয়নি, যাইনি। এর কিছুদিন বাদে দাদু অসুস্থ হয়ে সেখানে ভর্তি হলে একদিন প্রফেসরদের সাথে এসেছিল। দাদুর সংগে যেই সাচ্ছন্দে কথা বলছিল, হাতের নড় দেখছিল, স্টেথোস্কোপ দিয়ে চেক করছিল যেনবা কমরেডের কোনও মেয়ের ঘরের নাতনী। যাওয়ার আগে সামনে এসে দাঁড়াল, “যদি বলতে পারতাম সেদিনের বিষয়টা ভাঙ্গিয়ে”। উত্তর না দিয়ে ডান হাতের পাতাটা তুলি যার অর্থ করি - ও কিছু নয়, ঠিক আছে। নীরবতা ভেঙ্গে বলল, “আমি খুবই দুঃখিত, তোমাকে মোটেই কষ্ট দেয়া উদ্দেশ্য ছিল না”। আগের মতন, অনুত্তরিত থাকি, এমনভাবে হাত এ্যানিমেট করি যার অর্থ দাঁড়ায়- ধ্যাত, ও কোনও ব্যাপার নয়। এরপর নিরবতা আসে, সেই ফাঁকে অনুভব করলাম, আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করছে। ভাবলাম, হতে পারে অজ্ঞাত কারণে মায়া জন্মেছে। মাটিতে, জানলায় নাহয় কোনদিক ফিরে এবং তৃতীয় বারের মত প্রশ্ন করলো- “তুমি মেডিকেলের ক্যান্টিনে আসছো না আমাকে অপরাধী অনুভূতিটা দেয়ার জন্য”? সরাসরি তাকাল, “পারলে সেদিনের সময়টা ফিরিয়ে নিতাম”। আমি কোনও কথারই উত্তর করিনা। আগের মতনই ভাব করছি, ওসব কিছুনয়, কোনকিছুই যে কোনকিছু না।
যাওয়ার জন্য হাটা শুরু করলে সাথে হাঁটলাম। একটু আগে ওয়ার্ডের ফ্লোর ডেটল জল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। ফ্যানগুলো জোরে চালানো মেঝে দ্রুত যাতে শুকায়। ওরকম হাটতে গিয়ে চোখে পড়ল ওড়না পরেছে। এর আগে যতবার দূর থেকে দেখেছি পরিচয় হওয়ার আগেও কখনো ওড়না পরতে দেখিনি। সিল্কের, হালকা সাদার সঙ্গে সবুজ ম্যাপেল পাতার ছাপ, ফ্যানের বাতাসে ওড়নার প্রান্ত আমার মুখের উপর এসে পড়ল। ওড়না সরাবার কালে দেখি হাসছে, এক নিদারুন বিনোদনে। ওড়নার কোনাটা আলতোয় এক মুঠিতে আরো এক মুঠ যোগ দিল; মনে হয় নিশ্চিত করলো আবার না উড়ে এসে আমার মুখে পরে। ওয়ার্ডের শেষ মাথায় এসে একটু দাঁড়াল। সেই বিভ্রান্তিকর রঙের রংধনু-চোখ সহ, সরাসরি তাকাল। তাকানোর সেইটুকু সময়ের মধ্যে একবার চোখের পাতা পড়ল, হায়! চোখের পাতা পরল, পাপড়ি দুলে গেল, নিভৃতে ভাবি, তার চোখ!
পরে দাদুর কাছে শুনলাম। আরও একদিন এসেছিল এবং তারা অনেক গল্প করেছে। বুজলাম, নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছে। বললাম দাদু তুমি নিশ্চয় বলেছো আমি তোমার ‘এতিম নাতি’। জানালো, “সে যে বলতেই চেয়েছি তা তো নয়ই, মেয়েটি যেমন ভাবে জানালো ওর বাবাকে ডিসেম্বরে পাকিস্তানীরা তুলে নিয়ে গেছে আরে ফেরেনি, এমনকি লাশও পায় নি। যা বলেছি তখন, এবং প্রাসাঙ্গিক”। দাদু জানে আমার এর পরের অংশও পছন্দ নয় যা বলে থাকতে পারে। যোগদিল, সেই প্রসংগে বলেছি আমার একমাত্র ছেলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে! দাদু বাবার মৃত্যু বিষয়ে কখনও শহীদ নয়তো মুক্তিযুদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেনা একধরনের বিনয় থেকে, কিন্তু এই প্রথম করেছে মেয়েটির কাছে। দাদু ও আমি এইসব বিষয়গুলো ব্যক্তিগত রেখে থাকি। কেন নুসরতের সঙ্গে ‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহার করেছে তা জানা হয়না।
দাদুর লাশ যখন বরিশাল মেডিকেল হাসপাতালে রিলিজ প্রক্রিয়া চলছিল, আগেই দেখেছি নুসরত সেখানে। কথা বলিনি, যাবতীয় কাজে ব্যস্ত ছিলাম, তাকে এড়াতে ব্যাস্ত থাকতে চেয়েওছিলাম। এ সময়ে কাছে এলো, “এক মিনিট সময় দেবে?” আগের মতই বিনীত, “নিশ্চয়ই” বললাম, একটু পাশে হাঁটল আমাকে সহ, সামান্য আড়ালের দিকে, যদিও মোটেই তা নয়। “তোমার দাদু কয়েকটা কথা বলেছে”। মাথা নাড়ি। মুহুর্ত ভাবলাম, মেয়েটি সম্ভবত কাঁদবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখালাম তেমনটি না। বেশ শান্ত কণ্ঠে, “কমরেড বলেছে তার মৃত্যুর পর তোমার রক্ত-জগতে কেউ থাকবে না”। মাথা নাড়লাম এমনভাবে যেন, ঠিক আছে, সেসব ঠিকই। সে বলে যেতে থাকে- “আরও একটা কথা, ওটা এখন বলব না। কিন্তু অন্য কথা হলো, তুমি যেন তোমার বাবার উপর আক্ষেপ না রাখ, তোমাকে ছেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল বলে”। জানি দাদুর এই পাগলামিটা আছে। তিনি একটি জায়গায় মনে করেন, বাবা আমাকে এত ছোট রেখে যুদ্ধে না গেলেও পারত। ওটা একান্ত তারই মত। আমার নয়। দাদু একথা আমাকে একাধিকবার বলেছে, ভাবি নুসরতকে কেন বলতে গেল? এবারে সকল সামাজিকতা অবহেলা করে হাত ধরল। এমন স্মৃতি নেই, মা ছাড়া এই পৃথিবীতে নারী আদরে (হয়তো দাদিও) আমাকে ছুঁয়েছে। মাও মরেছে ওসময়ে দশ বছরের বেশী। “তোমার দাদু আশা করে তুমি তোমার মায়ের আত্মহত্যা নোট পড়”। হাত নিজে আমি ছাড়াতাম কিনা জানিনা। হয়তো হাত ছাড়াবার ইচ্ছাটাই কোনদিন হতোনা।
এটা প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। কোনদিন নুসরতের সঙ্গে দেখা হয়নি এরপর, যোগাযোগও নয়। জানিও না কোথায় কেমন আছে। জানবও না। হতে পারে এক অসম্পূর্ণতায় থাকবে যেহেতু দাদুর বলা কথাটি শেষদিন বলতে গিয়েও বলেনি, ভেবেছে হয়তো কোনও এক সময়ে বলবে। অথচ আমি সেকথা জানি, কেনোনা দাদু আমাকে তথ্যটা জানিয়ে দিয়েছিল। আমার জগতে কমরেডের পর রক্তের কেউ না থাকলে, একটা নতুন রক্ত সম্পর্ক শুরু হবে আশায় নুসরতেক বলেছিল, সে যেন তার একা হয়ে থাকা নাতির খোঁজ নেয়।
নুসরত সম্পর্কে এখন এতদিন পর প্রায় স্মৃতিশুন্য, যদিও গ্রেস ক্যালির চেহারাটা ভুলিনি। যেদিন নুসরতের ওড়না এসে মুখে পরেছিল, সরিয়ে দেয়ার পর যখন ওড়নার আঁচল হাতের মূঠোয় নিয়েছিল, মনে হতে পারে তা আদর করে, বলেছিলঃ “শোনো, রুমমেট ইয়াস্না জোর করে মাসে একদিন চুলে ওর মায়ের দেয়া ভেষজ তেল মেখে দেবে”। ঘার ঘুরিয়ে চুলে তাকাই। দেখলাম আরক্তিম-লাজুকতা, ব্লাশ শব্দটার সাক্ষাৎ দর্শন! এর পর গালভরা রক্তগোলাপের লাজুকতা লয়ে- “কাল রাতেই সেই তেলটা দিয়েছে। চুলের তেল গন্ধটা ওড়নায় যেতে পারে, ভেবেই খারাপ লাগছে, ওড়নাটা তোমার মুখেই পড়তে হবে”।
সেই ওড়নায় পাওয়া ভেষজ তেল এবং চুলের রাসায়নিক সৌরভটা এখনও কখনো মুক্ত বাতাসে থাকে, তা টের পাই ঢের বেদনায়।
(গল্পটি গত বিজয় দিবস সমকাল'এর শাহিত্যসাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে)
উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর সকল বন্ধুরা যখন বিভিন্ন বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজ গুলোতে পড়তে চলে গেল আমি তখন প্রায় কোথাও আবেদন করবারই সুযোগ পেলাম না। কারণ পরীক্ষার ফলাফল ছিল তৃতীয় ধরনের দ্বিতীয় বিভাগ। ওই ফলাফলে আবেদনই করা যেত না। ফলে ব্যর্থ তরুণ-যুবার দোটানা লয়ে, কখনো এক্সটেসি, হিস্টামিন, চরশ-গাজা, ফেন্সিডাইল সেবন করার চেষ্টা, ‘কিছুই হলো না হবে না’ ভাব ধরা, ‘লুজার’ ইমেজের বাজারজাতের চূড়ান্ত মহড়া, এই সব আরকী। হতাশা কাটাতে বন্ধুদের পরামর্শ ছিল ‘প্রেমে’ জড়ানো; সে সবের কোনও দাওয়াই-ই কাজ করেনি। অবশেষে কাউনিয়া এলাকা থেকে শহরের বিপরীত মাথায় আলেকান্দা সংলগ্ন বরিশাল মেডিকেলে যাতায়াত শুরু। পুরনো বন্ধুরা যারা ওই চিকিৎসা বিদ্যালয়ে ভর্তী হয়েছে তাদের অবসরের আড্ডায় যোগ দেয়া। সেই নিয়মেরই ফল ছিল নুসরত।
তার চোখের রঙ আমার জন্য খুব দ্বিধার ছিল। গভীর ভ্রম হতো গাঢ় বাদামী, হালকা নীল অথবা সবুজের মিশ্রণ ভেবে। অত আলাদা রঙ না খুঁজে ধরে নিতাম ‘রংধনু চোখ’। তুলনায় পাপড়িগুলো বড়, মনে হতো অকারণে তাতে শিশির জমেছে। দীর্ঘ বিরতির পর পলক পরতো। ভাবতাম আহা চোখের পাতা পড়াটা যদি আরো ক’মুহুর্ত বিলম্বিত হতো। সরাসরি তাকিয়ে কখনো আমাদের সাধারণ কথা হয়েছে কিনা মনে পরে না। যদিবা দু’একবার তা সাধারণ নয় আগেই ইঙ্গিত করেছি। চোখে-চোখে রেখে কথা বলবার মুহুর্তগুলো বুকের কোথাও খামচিটা ধরে আছে এখনও; এই যুগ-যুগ পরও সেটা টের পাওয়া যায়। সেকী কেবল আমারই অসহায় বুক নাকী তারও অবদান ছিল?
ঢেউ তোলানো চুল আধা উলটা আঁচড়ানো, আছরে পরে থাকে লম্বা গলার উপর, অদ্ভুত কৃষ্ণকায়-সোনালী রঙ। ছোটবেলায় বড় মামার সনে ঝাউতলার সোনালী সিনেমা হলে দেখা আলফ্রেড হিচককের ‘রিয়ার উইন্ডো’ ছবির গ্রেস কেলির মতন। ভ্রু, কপাল, গাল, নাক, চিবুক, ঠোট এর সবই গ্রেস কেলির সঙ্গে বিনিময় যোগ্য। আগে ক্যান্টিনে অথবা ক্যাম্পাসের অন্য কোথাও দেখে থাকতে পারি। প্রায় ছয় ফুট লম্বা, জিন্স অথবা ড্রেস প্যান্ট, সামনে বোতাম লাগানো (বাটন ডাউন) জামা। দ্বিতীয় বোতাম খোলা, বোতাম স্পট বরাবর খুব চিকন সিলভার চেইনে ঝুলে দোলে বনঘাসে সদ্য গজানো কচি পাতার হালকা সবুজাভ পেন্ড্যান্ট। একগোছা চুল বাম কপাল দিয়ে মাঝ নাক ছুঁয়ে গাল ধরে ডান কানের পাশে দুলে যেতে থাকে। তখন ফারুক চেগেভারার ইমেজে নেরুদার বিপ্লবী কবিতার মতন আমাকে পরিচয় করায়। নুসরত, আমীর আলী, আমীর আলী, নুসরত। এমন করে হাসি, মাথা নাড়ানো, চোখের পাপড়ি শিশিরের ভারে পলক পরা, যেন আমি তার চেনা। আর তাকে রিইনকারনেশন প্রাক্ কালে আমি চিনি। ভেতরে লজ্জিত হই, এত অস্থির হওয়ার মানে নাই। বিচলিত অথচ তাকে পরিতুষ্ট করবার (ইমপ্রেস!) সেকি চেষ্টা আমার। গলা শুকায়, দৃষ্টিতে ঝাপসা অনুভূত হয়, কানে উত্তাপ টের পাই, নিশ্চয় এতক্ষণে তা লাল আভায় পরিণত হয়েছে। হেসে নাম বলে “নুসরত”। নিজের ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কেন জানি না, বাম হাত দিয়ে ধরলাম, কেন জানিনা বলা কি ঠিক হবে? জানতাম তো, সেটা স্নায়ুবিকতা। এ-ই কী ‘প্রথম দর্শন ভালোলাগা’? ফার্স্ট শাইট ক্র্যাশ? হোক, ফারুকের সেখানে অস্তিত্ব থাকে না, বললাম, “আহ্, নুসরত”, স্বাভাবিক থাকবার এক মরন চেষ্টা! বললাম, “আমি আরও দুজনকে জানি যাদের নাম নুসরত”। ফারুক এই ফাঁকে চলে গিয়েছিল? স্মরণে নেই, এত দিন পরে। ওকথা শুনে একটু হাসল হয়তো, যত সামান্য পরিমাণের হাসি তাকে বলা যায়। আমার দিকে নয়, আবার ভিন্ন কোথাও-ও না তাকিয়ে- “আচ্ছা”! ভাবলাম এরপর বলবে ‘তাই বুঝি’। ওরকম কিছুই নয় বরং “হুম… ইন্টারেস্টিং, দু’জন কারা?”। ভয়ও হলো ভেবে যে সেকী ভাবল অন্য কোন মেয়েদের নাম? কিংবা সেরকম কিছু? অবশ্য চাউনি, কণ্ঠে, এসবের তেমন ইঙ্গিত ছিলনা। বললাম “একজন কাওয়ালী সঙ্গীত শিল্পী, পাকিস্তানের, ফতে আলী”, ইচ্ছে করে ফতে আলীর প্রথম নাম উচ্চারণ করলাম না। “একজন জুলফিকার আলী ভুট্টর স্ত্রী, কুর্দি, ইরানীয়ান বংশোদ্ভূত”। পরীক্ষার ফলাফল তৃতীয় মানের দ্বিতীয় শ্রেণী হলেও নিষ্ঠাবান সংবাদ পত্র পাঠক হিসাবে ওইসব নাম আমি জেনেছিলাম। মনে হলও চব্বিশ সেকেন্ডের একভাগ সময়ের জন্য তাকাল, সেইই জীবনের প্রথম চোখে চোখ রেখে কথা বলা। তারপর মাটিতে তাকিয়ে, যেখানে ক্যান্টিনের জানলায় আসা রোদে একটি গাছের ছোট ডালের পাতার ছায়া মেঝেতে দুলছিল, সেখানে চেয়ে থাকল, অসীম বিষন্নতায়, ক্যান্টিন ভর্তি অত ছাত্র ছাত্রী থাকা সত্যেও অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল, জগতে দাঁড়াবার মাটি নামে অবশিষ্ট থাকল না। একটা সময় পার হওয়ার পর নীরবতা ভাঙ্গল “আপনার চেনা নামের দুজনকে কেন পাকিস্তানেরই হতে হবে”? আমাদের কথা থাকেনি এরপর। নির্বোদ্ধিতা, হতবাক, এছাড়া ভাবা যায়নি- কেবল, কী হতে পারে ওদেশের নামটিতে? এই বিষণ্ণতার পেছনে? তার বাবাকে পাকিস্তানীরা হত্যা করেছে? মা অথবা বোন ধর্ষিত? নাকি নিজেই তখন বালিকা-কালে ধর্ষনের শিকার? ভাই যুদ্ধে শহীদ? এইসব সম্ভাবনার কথা মনে হয়েছিল।
সেটাই মেডিকেল ক্যান্টিনে যাওয়ার শেষ দিন। সেখানে কখনো এরপর যাওয়া হয়নি, যাইনি। এর কিছুদিন বাদে দাদু অসুস্থ হয়ে সেখানে ভর্তি হলে একদিন প্রফেসরদের সাথে এসেছিল। দাদুর সংগে যেই সাচ্ছন্দে কথা বলছিল, হাতের নড় দেখছিল, স্টেথোস্কোপ দিয়ে চেক করছিল যেনবা কমরেডের কোনও মেয়ের ঘরের নাতনী। যাওয়ার আগে সামনে এসে দাঁড়াল, “যদি বলতে পারতাম সেদিনের বিষয়টা ভাঙ্গিয়ে”। উত্তর না দিয়ে ডান হাতের পাতাটা তুলি যার অর্থ করি - ও কিছু নয়, ঠিক আছে। নীরবতা ভেঙ্গে বলল, “আমি খুবই দুঃখিত, তোমাকে মোটেই কষ্ট দেয়া উদ্দেশ্য ছিল না”। আগের মতন, অনুত্তরিত থাকি, এমনভাবে হাত এ্যানিমেট করি যার অর্থ দাঁড়ায়- ধ্যাত, ও কোনও ব্যাপার নয়। এরপর নিরবতা আসে, সেই ফাঁকে অনুভব করলাম, আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করছে। ভাবলাম, হতে পারে অজ্ঞাত কারণে মায়া জন্মেছে। মাটিতে, জানলায় নাহয় কোনদিক ফিরে এবং তৃতীয় বারের মত প্রশ্ন করলো- “তুমি মেডিকেলের ক্যান্টিনে আসছো না আমাকে অপরাধী অনুভূতিটা দেয়ার জন্য”? সরাসরি তাকাল, “পারলে সেদিনের সময়টা ফিরিয়ে নিতাম”। আমি কোনও কথারই উত্তর করিনা। আগের মতনই ভাব করছি, ওসব কিছুনয়, কোনকিছুই যে কোনকিছু না।
যাওয়ার জন্য হাটা শুরু করলে সাথে হাঁটলাম। একটু আগে ওয়ার্ডের ফ্লোর ডেটল জল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। ফ্যানগুলো জোরে চালানো মেঝে দ্রুত যাতে শুকায়। ওরকম হাটতে গিয়ে চোখে পড়ল ওড়না পরেছে। এর আগে যতবার দূর থেকে দেখেছি পরিচয় হওয়ার আগেও কখনো ওড়না পরতে দেখিনি। সিল্কের, হালকা সাদার সঙ্গে সবুজ ম্যাপেল পাতার ছাপ, ফ্যানের বাতাসে ওড়নার প্রান্ত আমার মুখের উপর এসে পড়ল। ওড়না সরাবার কালে দেখি হাসছে, এক নিদারুন বিনোদনে। ওড়নার কোনাটা আলতোয় এক মুঠিতে আরো এক মুঠ যোগ দিল; মনে হয় নিশ্চিত করলো আবার না উড়ে এসে আমার মুখে পরে। ওয়ার্ডের শেষ মাথায় এসে একটু দাঁড়াল। সেই বিভ্রান্তিকর রঙের রংধনু-চোখ সহ, সরাসরি তাকাল। তাকানোর সেইটুকু সময়ের মধ্যে একবার চোখের পাতা পড়ল, হায়! চোখের পাতা পরল, পাপড়ি দুলে গেল, নিভৃতে ভাবি, তার চোখ!
পরে দাদুর কাছে শুনলাম। আরও একদিন এসেছিল এবং তারা অনেক গল্প করেছে। বুজলাম, নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছে। বললাম দাদু তুমি নিশ্চয় বলেছো আমি তোমার ‘এতিম নাতি’। জানালো, “সে যে বলতেই চেয়েছি তা তো নয়ই, মেয়েটি যেমন ভাবে জানালো ওর বাবাকে ডিসেম্বরে পাকিস্তানীরা তুলে নিয়ে গেছে আরে ফেরেনি, এমনকি লাশও পায় নি। যা বলেছি তখন, এবং প্রাসাঙ্গিক”। দাদু জানে আমার এর পরের অংশও পছন্দ নয় যা বলে থাকতে পারে। যোগদিল, সেই প্রসংগে বলেছি আমার একমাত্র ছেলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে! দাদু বাবার মৃত্যু বিষয়ে কখনও শহীদ নয়তো মুক্তিযুদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেনা একধরনের বিনয় থেকে, কিন্তু এই প্রথম করেছে মেয়েটির কাছে। দাদু ও আমি এইসব বিষয়গুলো ব্যক্তিগত রেখে থাকি। কেন নুসরতের সঙ্গে ‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহার করেছে তা জানা হয়না।
দাদুর লাশ যখন বরিশাল মেডিকেল হাসপাতালে রিলিজ প্রক্রিয়া চলছিল, আগেই দেখেছি নুসরত সেখানে। কথা বলিনি, যাবতীয় কাজে ব্যস্ত ছিলাম, তাকে এড়াতে ব্যাস্ত থাকতে চেয়েওছিলাম। এ সময়ে কাছে এলো, “এক মিনিট সময় দেবে?” আগের মতই বিনীত, “নিশ্চয়ই” বললাম, একটু পাশে হাঁটল আমাকে সহ, সামান্য আড়ালের দিকে, যদিও মোটেই তা নয়। “তোমার দাদু কয়েকটা কথা বলেছে”। মাথা নাড়ি। মুহুর্ত ভাবলাম, মেয়েটি সম্ভবত কাঁদবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখালাম তেমনটি না। বেশ শান্ত কণ্ঠে, “কমরেড বলেছে তার মৃত্যুর পর তোমার রক্ত-জগতে কেউ থাকবে না”। মাথা নাড়লাম এমনভাবে যেন, ঠিক আছে, সেসব ঠিকই। সে বলে যেতে থাকে- “আরও একটা কথা, ওটা এখন বলব না। কিন্তু অন্য কথা হলো, তুমি যেন তোমার বাবার উপর আক্ষেপ না রাখ, তোমাকে ছেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল বলে”। জানি দাদুর এই পাগলামিটা আছে। তিনি একটি জায়গায় মনে করেন, বাবা আমাকে এত ছোট রেখে যুদ্ধে না গেলেও পারত। ওটা একান্ত তারই মত। আমার নয়। দাদু একথা আমাকে একাধিকবার বলেছে, ভাবি নুসরতকে কেন বলতে গেল? এবারে সকল সামাজিকতা অবহেলা করে হাত ধরল। এমন স্মৃতি নেই, মা ছাড়া এই পৃথিবীতে নারী আদরে (হয়তো দাদিও) আমাকে ছুঁয়েছে। মাও মরেছে ওসময়ে দশ বছরের বেশী। “তোমার দাদু আশা করে তুমি তোমার মায়ের আত্মহত্যা নোট পড়”। হাত নিজে আমি ছাড়াতাম কিনা জানিনা। হয়তো হাত ছাড়াবার ইচ্ছাটাই কোনদিন হতোনা।
এটা প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। কোনদিন নুসরতের সঙ্গে দেখা হয়নি এরপর, যোগাযোগও নয়। জানিও না কোথায় কেমন আছে। জানবও না। হতে পারে এক অসম্পূর্ণতায় থাকবে যেহেতু দাদুর বলা কথাটি শেষদিন বলতে গিয়েও বলেনি, ভেবেছে হয়তো কোনও এক সময়ে বলবে। অথচ আমি সেকথা জানি, কেনোনা দাদু আমাকে তথ্যটা জানিয়ে দিয়েছিল। আমার জগতে কমরেডের পর রক্তের কেউ না থাকলে, একটা নতুন রক্ত সম্পর্ক শুরু হবে আশায় নুসরতেক বলেছিল, সে যেন তার একা হয়ে থাকা নাতির খোঁজ নেয়।
নুসরত সম্পর্কে এখন এতদিন পর প্রায় স্মৃতিশুন্য, যদিও গ্রেস ক্যালির চেহারাটা ভুলিনি। যেদিন নুসরতের ওড়না এসে মুখে পরেছিল, সরিয়ে দেয়ার পর যখন ওড়নার আঁচল হাতের মূঠোয় নিয়েছিল, মনে হতে পারে তা আদর করে, বলেছিলঃ “শোনো, রুমমেট ইয়াস্না জোর করে মাসে একদিন চুলে ওর মায়ের দেয়া ভেষজ তেল মেখে দেবে”। ঘার ঘুরিয়ে চুলে তাকাই। দেখলাম আরক্তিম-লাজুকতা, ব্লাশ শব্দটার সাক্ষাৎ দর্শন! এর পর গালভরা রক্তগোলাপের লাজুকতা লয়ে- “কাল রাতেই সেই তেলটা দিয়েছে। চুলের তেল গন্ধটা ওড়নায় যেতে পারে, ভেবেই খারাপ লাগছে, ওড়নাটা তোমার মুখেই পড়তে হবে”।
সেই ওড়নায় পাওয়া ভেষজ তেল এবং চুলের রাসায়নিক সৌরভটা এখনও কখনো মুক্ত বাতাসে থাকে, তা টের পাই ঢের বেদনায়।
(গল্পটি গত বিজয় দিবস সমকাল'এর শাহিত্যসাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে)
0 মন্তব্যসমূহ