চৌধুরী আজাদুর রহমান মোটেই জানতেন না তার গল্পের কাহিনি এবং জাপানের প্রখ্যাত লেখক কেন্যাবুরো ওয়ের পুত্রের জীবনকাহিনি হুবহু এক। ফলে গল্পটি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার বিশাল কলেবরের ঈদ সংখ্যায় ছাপা হওয়ার পর বোদ্ধামহলে হৈচৈ পড়ে গেল?এটা তো কোনো মৌলিক কাহিনি নয়, কেন্যাবুরোর কাছ থেকে স্রেফ মেরে দেওয়া একটা কাহিনি। আজাদুর রহমান নিঃসন্দেহে একজন মৌলিক গল্পকার। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে ক’জন গল্পকারের নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে তাদের মধ্যে অনিবার্যভাবেই থাকবে তার নামটি। তার কাছ থেকে এমন নকলবাজি আশা করা যায় না। তিনি তার পাঠকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একজন প্রতিশ্রুত লেখক হিসেবে তিনি কাজটা ঠিক করেননি।
এ নিয়ে ঢাকার আজিজ মার্কেট, কনকর্ড, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, উত্তরা এমনকি সারাদেশের সবক’টি সাহিত্যপাড়ায় সমালোচনার ঝড় উঠল। বামপন্থি উঠতি কবি-সাহিত্যিকরা মন্তব্য করতে লাগল, এ দেশে সাহিত্য বলতে কিছু হয় না। সাম্রাজ্যবাদের দালালি করতে করতে সাহিত্যিকদের মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে, সাহিত্যিকরা পচে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর এ দেশে সেই অর্থে দ্বিতীয় কোনো কথাসাহিত্যিকের জন্ম হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রগতিশীলতার তকমাধারী কিছু উঠতি কবি-সাহিত্যিক, পাঠক কাম ফেসবুকার আজাদুর রহমানের চৌদ্দগোষ্ঠী ধুয়ে দিতে লাগল। বিখ্যাত এক ব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত একটি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত জনৈক তরুণ কবি তার স্ট্যাটাসে লিখল, প্রত্যেক লেখকের একটা সময় বন্ধ্যাত্ব আসে, যাকে বলে রাইটার ব্লক। চৌধুরী আজাদুর রহমান রাইটার ব্লকে ভুগছেন। জোর করে লেখার দরকার কি, লেখালেখি ছেড়ে দিলেই তো পারেন।
তার স্ট্যাটাসটি শেয়ার হলো প্রায় সাড়ে সাত শ। ঘটনা এতদূর গড়াল, ধর্মীয় মৌলবাদীদের একটি দৈনিক পত্রিকায় আজাদুর রহমানের একটি ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন এঁকে তার নিচে ‘মারিং কাটিং রাইটার’ লিখে প্রথম পাতায় ছেপে দিলো। পরদিন সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন পত্রিকাটির অফিসে গিয়ে সম্পাদককে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি চৌধুরী আজাদুর রহমানের গল্পটি পড়েছেন?
জি না, পড়িনি।
তাহলে কোন যুক্তিতে তার মতো সম্মানিত একজন লেখকের এমন ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ছাপলেন?
দেখুন, আমি তো এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানি না। কার্টুনটা তো এঁকেছে আমাদের শিল্পী, আপনারা বরং তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করুন।
তাকে তো আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করবই। তিনি শিল্পী মানুষ, শিল্পীর কাজ আঁকা, তিনি আঁকতেই পারেন। কিন্তু আপনার তো একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। গল্পটা না পড়ে, কোথাকার কোন কেন্যাবুরোর পুত্রের জীবনকাহিনির সঙ্গে তার গল্পের কাহিনির মিল আদৌ আছে কিনা আপনি একটিবার যাচাই না করে এমন একটা কার্টুন ছাপা সম্পাদক হিসেবে আপনার উচিত হয়নি। ভবিষ্যতে এসব ব্যাপারে আশা করি সতর্ক থাকবেন।
একটি গল্পকে কেন্দ্র করে ঘটনা এতটা জটিল আকার ধারণ করল, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন না করে পারলেন না। কমিটি তদন্ত করে দেখুক গল্পটির কাহিনি আসলেই নকল, নাকি কুচক্রী মহল চৌধুরী আজাদুর রহমানের মতো একজন প্রবীণ লেখকের সম্মানহানির জন্য এসব ষড়যন্ত্র করছে।
কমিটির প্রধান সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জনৈক অধ্যাপক, যিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাংলা বাজারের বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্য নোট-গাইড লেখেন। সৈয়দ আজাদুর রহমানের গল্পটি তার পড়া ছিল না, তদন্ত কমিটির দায়িত্ব পেয়েই ঈদসংখ্যাটি সংগ্রহ করে তিনি পড়া শুরু করলেন। ইলাস্ট্রেশনসহ সর্বমোট তিন পৃষ্ঠার গল্প। প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে হাওরের আকাশে উড়ন্ত বালিহাঁসের ইলাস্ট্রেশন, পৃষ্ঠার ডান কোনায় ৪৫ সাইজ ফন্টে লাল রঙের কালিতে গল্পের শিরোনাম ‘বালিহাঁসের ডাক’ লেখা, তার নিচে লেখকের নাম, তারপর যথারীতি গল্প শুরু।
বা লি হাঁ সে র ডা ক
পানাই নদীর জলকুণ্ডের ভেতর স্রোতে ভেসে আসা খড়কুটোরা যেভাবে সাঁই করে ঢুকে পড়ে, ঠিক সেভাবে জ্যৈষ্ঠের দিনগুলো ফুরাতে ফুরাতে মাসটা যখন মহাকালের মহাকুণ্ডে ঢুকে পড়ার জন্য ধেয়ে চলে, ঠিক সেই সময়টায় উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে জল আসতে আসতে মধ্যশ্রাবণে হাওরটা টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। তখন তো হাওরের কূলকিনারা থাকে না। যেদিকে তাকাও জল আর জল, ঢেউ আর ঢেউ। তবু ভকশিমইলের উত্তরে দাঁড়িয়ে বাঁ-হাতের তালুটা তেরচা করে কপালে ঠেকিয়ে দক্ষিণে তাকালে দিগন্তজোড়া হাওরের পাড়ে ঝাঁচকচকে টিনের যে ঘরটি দেখা যাবে সেটি সুজনচন্দ্র দাশের।
মায়ের সঙ্গে বউয়ের বনিবনা না হওয়ায় বাড়ির পুবের ভিটায় সুজন মাত্র পনের দিনে ঘরটি তুলে বউ-বাচ্চা নিয়ে উঠে পড়ে। বাইরে থেকে ঘরটি সুন্দর দেখালেও ভেতরে সুন্দর লাগার মতো তেমন কিছু নেই। সামনের কামরায় একটা খাট, কাঠের একটা আলমিরা আর কয়েকটা চেয়ার। কোণায় একটা টেবিলে একটা কম্পিউটার, আর ভেতরের ঘরে একটা দোলনা আট বছর ধরে ঝুলছে। সারা ঘরে আসবাব বলতে এই। সুস্মিতার সঙ্গে সংসার পেতেছে প্রায় দশ বছর হতে চলল, তবু সংসারটা এখনো ঠিক সাজিয়ে তুলতে পারেনি। পারবে কীভাবে, কলেজের একজন প্রভাষকের ক’টাকা বেতন? খেতে-পরতেই তো সব খরচ হয়ে যায়। ঘরের পেছনেও তো কম টাকা যায়নি, সেই ঋণ এখনো পুরোপুরি শোধ দিতে পারেনি। তা ছাড়া যতই মান-অভিমান থাকুক, মাকে তো আর মা বলে অস্বীকার করতে পারে না সুজন। মা তার একটু জটিল চরিত্রের বটে, অন্যের ভালো মোটেই সইতে পারে না। ছেলেবউ তো বটেই, পাড়াপড়শিদের সঙ্গেও সবসময় ঝগড়া-ফ্যাসাদ বাঁধিয়ে রাখে। বিশ শতকের নারী, চরিত্র তার এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীটা যে আর হাকালুকি হাওরের মতো অপরিবর্তিত হালে নেই সেকথা তো তার অজানা। জানতে হয়তো পারত, ঘরে যদি একটা টেলিভিশন থাকত। মানুষের আদিম জটিল সংস্কৃতিকেও বদলে দেয় টেলিভিশন।
আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও মা এখনো সময়-অসময়ে ছেলেবউকে গালাগালি করে, সুজন শুনতে পায়। কিন্তু কিছু বলে না, উল্টো বউকে মুখে তালা লাগিয়ে রাখতে বলে। সে শিক্ষিত ছেলে, তার বউটাও ইন্টারমিডিয়েট পাস, মায়ের যত দোষই থাকুক, ছেলে হয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করলে লোকে তাকে ভালো বলবে না। বাপটা চিতায় চড়ার সময় মায়ের জন্য বাড়িটা আর তিন ছেলে আর দুই মেয়ে ছাড়া স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ কিছু রেখে যায়নি। আলাদা হয়ে গেলেও মা-ভাইয়ের ভরণ-পোষণের ভার নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখতে পারেনি সুজন। সৌভাগ্য যে, বোন দুটির বিয়ে হয়ে যায় বাপ বেঁচে থাকতেই এবং বছরখানেক আগে তার ছোট এক ভাই সিলেটের কোন লন্ডন প্রবাসীকে ধরে কীভাবে যেন লন্ডন চলে গেছে। গত কয়েক মাস ধরে সে অল্প অল্প টাকা পাঠাচ্ছে। এবার যদি সুজনের কাঁধ থেকে বাপের সংসারের জোয়ালটা নামে!
এত কিছুর পরও হয়তো নিজের সংসারটা সুজন সাজিয়ে তুলতে পারত, যদি না বালক কৃষ্ণের মতো সুন্দর তার ফুটফুটে ছেলেটা আজন্মের বোবা হতো। শরীরের কোথাও কোনো খুঁত নেই, একেবারে ঠিক মায়ের মতো, অথচ ভগবানের কী লীলা, আট বছর বয়স হয়ে গেল নিশানের, এখনো পর্যন্ত একটিবার বাবাকে বাবা আর মাকে মা বলে ডাকল না!
সুস্মিতাকে পাওয়ার জন্য জীবনের সবকিছু এমনকি জীবনটাকেও তুচ্ছজ্ঞান করেছিল সুজন। স্বপ্ন দেখেছিল বিয়ের পর দুজনের সংসার হবে অনাবিল হাসি-আনন্দে ভরপুর একটা সুখী সংসার। অথচ ভগবান কিনা তার ভাগ্য নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলতে শুরু করলেন! বিয়ের পর থেকে মা তাকে একটা দিনও শান্তিতে থাকতে দিলো না। সইতে না পেরে ঘরের কাজ শেষ হওয়ার আগেই সাত মাসের নিশানকে নিয়ে নতুন ঘরে চলে এল। যাক, এবার বুঝি শান্তি ফিরবে! নিশান আর সুস্মিতাকে নিয়ে এবার বুঝি গড়ে তুলতে পারবে নিজের একটা জগত্।
এক বছর গেল, দু-বছর গেল, তৃতীয় বছরটাও কেটে গেল, অথচ নিশানের মুখে ভাষা ফুটল না। সুজন চোখে অন্ধকার দেখে। হায়! এ তার কেমন ভাগ্য! জুড়ি থেকে কুলাউড়া, সিলেট থেকে ঢাকা?কোথায় কোন ডাক্তারের কাছে নেয়নি ছেলেকে? সব ডাক্তারেরই একই কথা, না, জীবনে কোনোদিন নিশানের মুখে কথা ফুটবে না।
তবু সুজন হাল ছাড়ে না, পাঁচ-ছ মাস পর পরই সে নতুন নতুন ডাক্তারের কাছে ছেলেকে নিয়ে হাজির হয়। ডাক্তারের পিছে টাকা ঢালতে ঢালতে সংসারের দৈন্যদশা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। পা ঢাকলে মাথা উদোম, মাথা ঢাকলে পা উদোমের মতো অবস্থা।
সংসারের এই দৈন্যদশার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখবোধ নেই সুজনের, বেঁচে থাকলে একদিন সংসার সে ঠিকঠাকমতো গুছিয়ে তুলতে পারবে, দুঃখ তার ছেলেকে নিয়ে। ছেলের দুঃখে সে হাসতে পর্যন্ত ভুলে গেছে। তবু সে পুরুষ, মনের দুঃখ কষ্ট করে হলেও চাপা দিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু সুস্মিতা তো মা। মায়ের মন চিরকালই হাকালুকির পাঁক-কাদার মতো নরম। মায়েরা ইচ্ছে করলেই বাবাদের মতো মনের মণ মণ ওজনের বেদনাকে চাপা দিয়ে রাখতে পারে না। রাখতে গেলে বুকটা ফেটে যেতে চায়।
এত দুঃখের মধ্যেও সুখের ব্যাপার, কথা নিশান বলতে না পারলেও শুনতে কোনো অসুবিধা হয় না তার। গভীর রাতে বাবা-মায়ে ফিসফিসিয়ে কথা বললেও সে জেগে থাকলে মাথাটা ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাড়ার ছেলেছোকড়াদের সঙ্গে বাড়ির বাইরে খেলতে গেলে মা যখন ‘নিশান নিশান’ বলে ডাক দেয়, নিশান কোনোদিন ছুটে আসতে ভুল করেনি। ছুটির দিনে বাবা বাড়িতে থাকলে কম্পিউটারে রবীন্দ্রনাথের গান বাজানোর সময় সে যেখানেই থাকুক, ছুটে এসে টেবিলটার নিচে পা দুটো মুড়ে বসে যাবে। গানের তালে তালে হেলবে, দুলবে, মাথাটা এদিক-ওদিক নাড়াবে, মাঝেমধ্যে দু-হাতে তালিও বাজাবে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সমধুর কণ্ঠে ‘পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ/ তুমি ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও বসন্ত’?রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই চরণগুলো যখন বাজতে থাকে তখন তার আর নড়ন-চড়ন থাকে না, গভীর এক নিস্তব্ধতা তাকে গ্রাস করে ফেলে। কে জানে তখন কী হয় তার, গানটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাথাটা ঝুঁকিয়ে একঠাঁয় বসেই থাকে। গানটা শেষ হলে দু-হাত বাড়িয়ে মুখটা হাঁ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে চায়, কিন্তু পারে না।
সন্তানের মতো মায়ের বাকও তখন রুদ্ধ হয়ে পড়ে। দু-হাতে ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকে। না পারে কাঁদতে, না পারে হাসতে, না পারে কোনো কথা বলতে।
দীর্ঘক্ষণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রাখার পর একটা সময় নিশান বালিহাঁসের ডাক শুনে মায়ের কোল ছেড়ে হাওরের কূলে ছুটে গেলে সুস্মিতার বুকটা তখন ফেটে যেতে চায়। সে আর কান্না রুখতে পারে না, সদ্যজন্মা শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দ পাছে শাশুড়ি শুনতে পেলে তো বলবে, ‘হাতে ধরে শাশুড়ির অভিশাপ নিছ, এখন ইচ্ছেমতো কান্দো’, তাই সে মুখটা এক হাতে চেপে ধরে শুধু ফোঁপায়। এই ফোঁপানি আর থামে না। ফোঁপানি থামলেও অশ্রু থামতে চায় না। চোখ দুটি যেন কুশিয়ারার দুটি শাখা। নিরবধিকাল জল বয়েই যাচ্ছে, বয়েই যাচ্ছে।
নিশান সেই যে যায় আর ফেরার খবর থাকে না। হাওরের তীরে তীরে, ক্ষেতের আলে আলে, রাস্তার ধারে ধারে ছেলেপিলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। শামুক কুড়ায়, ঝিনুক কুড়ায়। কখনো বা দু-একটা টেংরা, পুঁটি, গুঁজি আইড় ধরে রান্নাঘরে রান্নাবাড়ায় ব্যস্ত মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। কণ্ঠে উঁ উঁ শব্দ তুলে হাতের ঈশারায় মাকে বোঝাতে চায়, ‘মা, মাছগুলো রাঁধো, আমি খাব।’ কখনো বা একটা জ্যন্ত কাঁকড়া ধরে উঠোনে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওটার পিছে লেগে থাকে। তার হাঁটাচলা দেখে। কাঁকড়া তার ঠ্যাংটাকে বাঁকা করলে নিশানও তার ঠ্যাংটা বাঁকা করে। কাঁকড়া হাঁটতে শুরু করলে নিশানও তার পাশেপাশে হামাগুড়ি দিতে থাকে। স্থল ও জলচর ভাষাহীন দুই প্রাণীর খেলা চলতে থাকে।
নিশানের বয়স যেদিন আট বছর পূর্ণ হলো তার দু’দিন পর থেকে শ্রাবণের ঘোর বর্ষা শুরু হলো। হাকালুকি হাওর তার সীমানার বিস্তার ঘটাতে ঘটাতে ঘরের দাওয়া পর্যন্ত ঠেকল। জল আর জল, জলের সঙ্গে কচুরিপানার দঙ্গল। বন্যায় সড়ক-যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুজনের কলেজ কর্তৃপক্ষ আপতকালীন ছুটি ঘোষণা করেছে।
সেদিন দুপুরে ঘরের দরজার সামনে একটা চেয়ারে নিশানকে কোলে নিয়ে বসা সুজন, আরেকটি চেয়ারে বসে দেড় বছরের মেয়েটাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল সুস্মিতা। বন্যার জলে ভাসতে ভাসতে একটা বালিহাঁস উঠানে এসে ডাকতে শুরু করল। নিশান ডান হাতটাকে যতটা পারে লম্বা করে হাঁসটার দিকে বাড়িয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘মা মা, বালিহাঁস বালিহাঁস।’
উ প সং হা র
তদন্ত কমিটি যেদিন একাডেমির মহাপরিচালক বরাবরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে সেদিন একটি দৈনিকের সাহিত্যপাতায় সদস্য তিন জনের ছবিসহ ‘বালিহাঁসের ডাক’ গল্পটি সম্পর্কে তাদের মতামত ছাপা হলো। প্রধান সদস্যের মন্তব্য, হ্যাঁ, ঘটনা সত্য। এটি মৌলিক কোনো কাহিনি নয়। সৈয়দ আজাদুর রহমান জাপানি লেখক কেন্যাবুরো ওয়ের নোবেল ভাষণ থেকে কাহিনিটি মেরে দিয়েছেন। দ্বিতীয় সদস্যও প্রায় একই মন্তব্য করলেন। তৃতীয় সদস্যের মন্তব্য, জীবনে কোনোদিন তিনি কেন্যাবুরো ওয়ে নামের কোনো লেখকের নামই শোনেনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবার শুরু হলো কমিটির তিন নম্বর সদস্যকে নিয়ে নানা বিরূপ মন্তব্য। এমন একটা মূর্খ কীভাবে জগন্নাথ বিশ্বাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপকের চাকরি করছে! অবিলম্বে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।
একটি গল্পকে কেন্দ্র করে সাহিত্যপাড়ায় এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, অথচ গল্পকার সৈয়দ আজাদুর রহমান কিনা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব! যে পত্রিকার ঈদসংখ্যায় তার গল্পটি ছাপা হয়েছিল সেটির বিশেষ প্রতিবেদক প্রকাশিতব্য একটি প্রতিবেদনের জন্য সামগ্রিক বিষয়ে টেলিফোনে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বললেন, দেখুন, শিল্পে মৌলিকত্ব বলে কিছু নয়। শিল্পমাত্রই অনুকরণ। দেখার বিষয় হচ্ছে অনুকরণটা আমি কোন আঙ্গিকে করেছি। মনে রাখতে হবে, সাহিত্যের ইতিহাস আঙ্গিকের ইতিহাস।
0 মন্তব্যসমূহ