মেহেদী উল্লাহ এর গল্প : ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে


রিজিয়া খালা হারিয়ে যেতে থাকা বিড়ালটাকে খাঁচায় ভরে সাতটা বাচ্চাসহ মুরগিটাকে মুক্ত করে দিলে আমি আর আমির ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম। ৫৭ নম্বর বাসার গেটের ভেতর ঘটনা। খালা বাসার নিচ তলায় থাকে, গেটের দেয়াল-লাগোয়া এক রুম। শুরুর দিন থেকেই এমনভাবে থাকছে, যেন ওই দিনই ছিল সেখানে তার কাটানো একচল্লিশতম দিন।

আমার নানির/আমিরের দাদির দিনকয় আগে মহল্লার গলিতে হাঁটাহাঁটির সময় এক মধ্যবয়সী মহিলার সঙ্গে দেখা। তিনি দেখেই কীভাবে যেন বুঝলেন, বৃদ্ধা এখানকারই কোনো বাড়িওয়ালার আদুরে মাতা। না হলে সক্কাল বেলা এইভাবে টেনশন ছাড়া হাঁটে! আসলে তিনি ঠিক ধরেছেন, বাড়িওয়ালাটা আমার মামা/আমিরের আব্বা, সরকারি কর্মচারী, এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, মামি একটা এনজিওতে বুদ্ধি বণ্টন করেন।

হাঁটতে থাকা নানির কাছে মহিলার আবদার, তিনি পাশের গলির একটা বাড়িতে কাজ করতেন এতদিন, আজ ঠিক ভোরে তিনি বাসায় একটা ঘটনার আবার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় রাগে গজগজ করতে করতে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সোজা এক কাপড়ে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছেন নতুন কাজের খোঁজে। নানি বুঝতে পারলেন, এই মহিলার হাঁটার উদ্দেশ্য যেহেতু ব্যায়াম না, অন্য কারণ, চাইলে তাকে একটা চাকরি দিতেই পারেন।

এই মহিলাই রিজিয়া খালা, ৫৭, মামার বাসার বর্তমান কাজের লোক কাম দারোয়ান। নানি তাকে পাকা কথা না দিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখতে চেয়ে বললেন, আচ্ছা, আগে তুমি কয়দিন করে দেখাও। আমার যদি কাজ পছন্দ হয়, তবেই তুমি পারমানেন্ট হইতে পারবা।


দুই

এই বাড়িতে নানির কথাই শেষ কথা। আমার নানি একটা ভেরিফাইড ফেসবুক আইডির মতো, একটা ঘটনাকে কেউ যদি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কানে দিতে চায় মুহূর্তের মধ্যে তবে সে যেন নানিকে শুধু একটা মিসকল দেন। নানিই তাকে কল ব্যাক করবেন। তারপর নিজে থেকে সেটা প্রচারের যাবতীয় দায়িত্ব তার। এরপর চেইন লেটারের মতো এক কান থেকে অন্য কানে কথা চালাচালি হয়। তাকে নিয়ে তাই সবার এত ভয়। দেখা গেল, তিনি একটা কাজের লোক জোগাড় করে এনেছেন, কোনো কারণে মামা/মামি সেটা রিজেক্ট করেছেন। তারপর তা দুনিয়া! সব ব্লেম মামা/মামিকেই নিতে হবে। এমনভাবে নানি স্বজনদের কানপড়া দেন, তখনই তারা ফোন দিতে শুরু করবেন মামা/মামিকে। হয়তো বলবেন, তোমরা কেন এমন করলা মুরব্বির সাথে? মামা/মামির এত সময় নাই, তাই নানিকে খুব মান্য করেন, যাতে অন্তত স্বজনদের কৈফিয়ত না দিতে হয়।

নানি চায় তো, রিজিয়া খালা তাই টিকে গেলেন। আর আজকের বিকালেই, সে আমিরের অতি আদরের বিড়ালটা পালিয়ে যাচ্ছে বলে নিজের মুরগির খাঁচায় তাকে আটকে রেখে আমার বিশেষত আমিরেরও পছন্দের হয়ে গেল। আমরাও নানি/দাদির মন জয় করার চেষ্টা করি সর্বদা। তার সিদ্ধান্তটা যে খুবই কার্যকর হয়েছে, সেটা জানাতে ভুলি না। বলি, রিজিয়া খালা ভালো, আমাদের বিড়ালের জন্য নিজের মুরগিগুলারে সে বেওয়ারিশ করতে রাজি।

আমিরের বিড়ালটা হঠাৎ কেন পালিয়ে যাবার উপক্রম করল বুঝতে পারলাম না। এমনিতে সে খুব ভালো, পালায় না। সাধারণত হয় যে, যে যা করে না, সে হঠাৎ সে রকম কিছু করে বসলে তার বিরাট অর্থ থাকে। বিড়ালটার পলায়নপর মানসিকতার বিষয়ে আমরা তাই চিন্তিত। কিসের ইশারা?

ছোট থেকেই বিড়ালটা এই বাসায়। এই বাসায় আমার চেয়ে এই বিড়ালটার বয়স বেশি। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি এক বছর দেড়মাস হয়। সে সময় থেকেই দেখছি বিড়ালটা মিনিমাম কত? থাক। বয়স জিজ্ঞেস করিনি কখনও আমিরকে। আমির এখন কলেজে পড়ে, দ্বিতীয় বর্ষে। হয়তো কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়ই বিড়ালটা কিনেছিল। নতুন নতুন কলেজে উঠলে এমন হয়, কী ছেলের, কী মেয়ের, অনেক কিছুই পুষতে ইচ্ছা করে। ভাগ্যিস, আমির একটা বিড়ালই পুষছে, অন্য কিছু না।


ক.


রিজিয়া খালা তার মুরগিগুলারে সাথে আনে নাই। নানি যেদিন সকালে তাকে নিয়ে এলেন, সেদিন দুপুরে এনেছে। নানি ঝেড়েছিলেন তাকে, মানুষরে বইতে দিলে শুইতে চায়। ভোরবেলা যেভাবে রাস্তায় হাঁটতে ছিলা তাতে মনে হইলো, জগতে তোমার কেউ নাই, এখন তো দেখতেছি মুরগিও আছে, কাল না আবার গ্রাম থেকে নিজের পোলাইন নিয়া উঠাও।

খালা জানাল, আর কেউ নাই বইলাই তো তিন মাস আগে গ্রাম ছাড়ার কালে শুধু মুরগিই আনছেন, তার স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে, ডালে লবণ কেন বেশি দেয় শুধু এই কারণে।

অবশ্য, এটা নাকি শুধু উসিলা। গরুর মাংস ভুনা পারে না এমন একজনের সঙ্গেও তার কঠিন ভাব আছিল। চলে আসার দিন বিকালেই নাকি তাকে নিয়া আসছে সে। ভাবা যায়! অথচ মাংস ভুনা পারে না! ডালের গুনাহ যে মাফ করে নাই তার বিবেক মাংসের গুনাহ মাফে সায় দিল কী করে!

যাই হোক, সেটা খালার একান্ত সাংসারিক ব্যাপার।


খ.

দিন যায়, রিজিয়া খালা থাকে। মামা-মামি অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকায় ৫৭ নম্বর বাসায় তাদের কোনো কথা-কার্যকলাপ জানানো সম্ভব না। এই বাড়িটা তাদের হলেও অদ্ভুতভাবে এখানে তাদের সম্পর্কে বলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে না।

যা ঘটে-আমির আর খালার।

সেটা কী?

সেটা হলো, আমির একদিন আমার কাছে বিচার দেয়, সে তার গার্লফ্রেন্ড নিয়া ভর দুপুরে বাসার গেটে আসতে না আসতেই খালা লুকিয়ে গেছে তার ছোট খোপে। খালার ভদ্রতা জ্ঞান নাই। একজন বড় গেস্ট আছে সঙ্গে, গেট খুলে দিবে তা না, উল্টা পালায়া গেল। ভাবা যায়! বেক্কল!

আমিরের বিচার আমলে নিয়ে আমি খালারে ডাকি। অথচ সে আসতে দেরি করে ফেলল। কারণ একটাই। অন্য সময় যে কারণে দেরি করে আসত আজও সে কারণ। সুযোগ পেলেই সে ডাল রাঁধে। খাল-ইইই ডাল রাঁধে। রান্না শেষ হলে নিজে নিজে স্বাদ টেস্ট করে দেখে, লবণ ঠিক আছে কিনা। কেউ ডাক দোহাই দেয় না তাকে। যত ব্যস্ততাই থাকুক মামিই রান্না করেন। মামা হেল্প করেন। নানি টুকিটাকি কেটেকুটে দেন। খালা জানে যে, কোনো রান্নার দায়িত্বই এ বাড়িতে তার না, এমনকি ডালও না। তবুও সে কেন যেন আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ডালের লবণটা যেন ঠিকমতো হয়।


গ.

খালা এলে পরে কেন আজকের এই অতি জঘন্য ঘটনাটা ঘটালো জানতে চাইলাম। খালা জবাব দিল, আমিরের গার্লফ্রেন্ডরে সে ভয় পায়।

আমি আর আমির অবাক। বলি, তুমি তাকে চেনো?

সে জানাল, চেনে মানে, এখানে আসার আগে সে যে বাসাটা ছেড়ে আসছে ওটাই আমিরের গার্লফ্রেন্ডদের বাসা।

আচ্ছা ভালো। কিন্তু আমিরের গার্লফ্রেন্ডরে দেইখা তুমি গেট খুলে না দিয়া পালাইলা কেন? ভয় পাও কেন?

খালা জানাল, সে অনেক ভয়।

তা কেমন অনেক?

সে জানাল, আমিরের গার্লফ্রেন্ড ভয়ংকর। শুধু ভয়ংকার না, অতি অতি, রাগলে বাসা আছাড় মারে। আর একটা কাণ্ড সে করে। বার কয় করেছে।

সেটা কেমন?

খালা জানাল, আমিরের গার্লফ্রেন্ড আজরাইল! মার সঙ্গে পালাক্রমে রাগ করে তার ছয়টা মুরগির বাচ্চারে গলা টিপে মেরে ফেলছে চার কিস্তিতে।

ভবিষ্যতে আরও রাগ হবে, আরও মারা হবে। মারতে মারতে খাঁচা খালি হয়ে যাবে।

শুধু এই কারণেই রিজিয়া খালা ওই বাসায় ইস্তফা দিয়েছে।


ঘ.

আমার বিশ্বাস হয় খালার কথা, আমিরের হয় না। সে উল্টা আমাকে বুঝায়, তার গার্লফ্রেন্ড যথেষ্ট কোমলমতি, বাস্তবে তো বটেই ফেসবুকেই তেলাপোকার ছবি দেখলে আঁতকে ওঠে, বাসায় এলে তার বিড়ালটাকে আপন সন্তানের মতো আদর করে, বৃক্ষ দেখলে পাতা ছেঁড়ে না, জলে পিঁপড়া দেখলে ডাঙায় তুলে দেয়, বাসার সামনের কুকুরগুলা তার খুব ভক্ত, জুতার চাপে রাস্তার পোকা মরতে পারে এই ভয়ে সে তার বাইক ছাড়া চলেই না, একবার চিড়িয়াখানায় গিয়ে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বানররে বাদাম খাইয়েছে, পুকুরের মাছ ব্যথা পাবে বলে কোনো দিন বঁড়শি বায় নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সে কিনা?

গভীর রাতে আমির তার গার্লফ্রেন্ডকে ফোন দিয়ে বলল, আচ্ছা, আমার তো বিড়ালের বাচ্চা খুব পছন্দ আর তোমার নিশ্চই মুরগির বাচ্চা। তাই না?

আমিরের গার্লফ্রেন্ড শুনে ক্ষেপে যায়। বলে, মুরগির বাচ্চা! আই হেট মুরগির বাচ্চা। রেগে গেলে তো প্রথম সামনে পাইলে ওইটারেই মারি। এমনি এমনি মারি না, গলা টিপে টিপে মারি।

কিন্তু কেন?-নিজের প্রিয় মানুষটিকে শুধু এই প্রশ্নটাই করার সাহস পায় না আমির।

আচ্ছা ফারিয়া বলে রেখে দেয়!

আসল জায়গায় এই নিতান্ত-সাধারণ অথচ খুব জরুরি প্রশ্নটারই আকাল চলছে দেশে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ