কী করে একটি প্রেমের গল্প লিখবেন

ঝরা সৈয়দ

১. যে গল্পটি লিখবেন বলে ভাবছেন সে গল্পটির একটি আউটলাইন করুন।
সবচেয়ে ভালো হয় একটি নোট বইয়ে যদি গল্পটির ধাপগুলো ছক করে করে নিন। লিখুন--

ক) গল্পটি কোথায় এবং কখন ঘটেছে। সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করুন।

যেমন-- বরিশালে ১৯৫০ সালে এই ঘটনাটি ঘটেছিল।

আরো সুনির্দিষ্ট করুন--

বরিশালের কোনো গ্রাম, মহল্লা, পার্টি, স্কুল, কোনো পুকুর পাড়, বটতলা ইত্যাদি।


সময়কালটা বিষয়ে মনে করুন-- কোন ঋতু, মাস, সপ্তাহ, দিন, সকাল বা বিকেল অথবা রাত। ঘটনাটি যদি শীতকালে ঘটে তাহলে বকুল ফুল ফোটার কথা আসবে না, আসতে পারে শিউলি ফুলের কথা। আসতে পারে রসের পায়েসের কথা। সেখানে নিশ্চয়ই কুয়াশা থাকবে, চাদর, সোয়েটার এগুলো চরিত্রের পরনে থাকবে চরিত্রের। এমনভাবে ঘটনার স্থান কালকে আপনি আপনার গল্পের জন্য বেছে নেবেন যার সঙ্গে আপনি ঘনিষ্টভাবে পরিচয় আছে। এমনভাবে সেটার উল্লেখ করবেন বিস্তার ঘটাবেন গল্পের প্রয়োজনে যা পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এবং পড়া মাত্র পাঠকের মাথায় ছবির মতো আঁকা হয়ে যাবে।

দেখুন--বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়ে হলুদ গল্পটিকে। গল্পটির কাল ১৯৪১ সাল। তখন দূর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। কোন মাস--শ্রাবণ মাস। দিনটাও বিভূতিবাবু ঠিক করে নিয়েছেন--মঙ্গলবার। গল্পের শুরুটা হচ্ছে সকাল বেলা। বিভূতিবাবুর এই মৌসুমীবিদ্যা জানা আছে বলেই নিঁখুতভাবে সেদিনের বর্ণনা দিচ্ছেন। শ্রাবণ মাস বলেই বৃষ্টির ধরনটা একটানা। অঝোর ধারায় নেমেছে।

--শ্রাবণ মাসে দিন, বর্ষার বিরাম নেই, এই বৃষ্টি আসছে এই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাছে। ক্ষেতে আউশ ধানের গোছা কালো হয়ে উঠছে, ধানের শিষ দেয়েছে অধিকাংশ ক্ষেতে।

(গায়ে হলুদ/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)।

এ গল্পটি কোথায় ঘটছে? সেটাই বলে দিচ্ছেন সুনির্দিষ্ট করে। একটি অজো পাড়াগাঁয়ে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে--পুঁটিদের বাড়িতে।

পুঁটিদের প্রতিবেশী মুখোজ্জে বাড়িতে দ্বিতীয় ঘটনাস্থল। এ ছাড়া পুঁটির যার সঙ্গে বিয়ে হবে সেই সুবোধদের বাড়ি এবং কোলকাতাও সহ-ঘটনাস্থল হিসেবে এসেছে।

একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় গল্পকার ছকের মত এই ঘটনাস্থলগুলো সাজিয়ে নিয়েছেন।

শ্রাবণের মাসে মাঠে দুধরনের ধান থাকে। একটি আউশ। আরেকটি আমন। আউশ ধান পাকে ভাদ্রে। শ্রাবণ মাসে আউশ ধানের শীষ বের হওয়ার সময়। কোনোভাবে ধানের কথা বলতে চাইলে আমন ধানের কথা বলাটা হবে ভুল। শ্রাবণ মাসে আমন কেবল বাড়তে থাকে। শীষ আসতে শুরু করে কার্তিক মাসে।

খ) শুরুতেই ঠিক করে নিন আপনার গল্পের চরিত্রগুলো কে বা কারা। এদের মধ্যে কোন দুজন প্রেমিক- প্রেমিকা। কে তাদের প্রেমে বাধ সাধতে চেয়েছে? কিভাবে বাধা দিতে চায়? কে তাদের প্রেমে সহযোগিতা করছে? তাদের নাম কি? দেখতে কেমন? এগুলো টুকে নেওয়া জরুরী। গল্পের শুরুতে নায়িকার নীল চোখের কথা বলেছেন নায়ক, গল্পের শেষে নায়িকার মা স্মরণ করছেন তার মেয়েটির বাদামি চোখ ছিল, তাহলে সেটা খুব হাস্যকর হয়ে উঠবে।

গ) গল্পে একটি সমস্যা তৈরি করুন। প্রেমের গল্প হোক বা সাধারণ কোনো গল্প হোক না কেন, তাতে একটি প্রধান সমস্যা থাকবে। এ থেকে উৎপত্তি হবে প্রধান দ্বন্দ্ব সংঘাত। খুঁজে বের করুন কাদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব সংঘাত ঘটছে। তারা কি দুজন, বা, তিনজন? অথবা দ্বন্দ্বটি মানসিক বা কারো মনের মধ্যে ঘটছে। প্রধান দ্বন্দ্বের পাশাপাশি কিছু ছোট খাট দ্বন্দ্ব সংঘাতের ঘটনাও নিয়ে আসুন। চিন্তা করুন, দুটি চরিত্র যখন প্রেমে পড়েছে তখন কী ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। যেমন--

--ছেলেটি প্রেমে পড়েছে, কিন্তু মেয়েটি পড়েনি।

--প্রেমে পড়ে ছেলেটির সব কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু মেয়েটির মধ্যে বদলে যাওয়ার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটি সব কিছু ত্যাগ করে মেয়েটিকে পেতে চায়, কিন্তু মেয়েটি তার পরিবার, সমাজ, ধর্মের কথা ভেবে নিজেকে দূরে রাখতে চায়। প্রেমিকের হাত ধরে যাওয়র আগে একটি মেয়েকে অনেক দায়-দ্বায়িত্বের কথা ভাবতে হয়।

--কোনো পুরনো প্রেম ভেঙ্গে গেছে। অথবা নতুন কোনো সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

--প্রেমিক বা প্রেমিকার কারো আগের সম্পর্কের সন্তান আছে।

--অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেম।

--হৃদয় বিদারক।

--সুখকর।

-- যে প্রেম অধরা।

-- ধ্রুপদী ত্রিভুজ প্রেম।


গ) ভেবে দেখুন, আপনি কি রোমিও জুলিয়েটের মতো ট্রাজিক পরিণতি চান আপনার গল্পে? না, সিন্ডারেলার মতো মিলনাত্মক করে শেষ করতে চান?

গল্পের শেষটা কী রকম হবে, গল্প লেখার আগেই ঠিক করুন। তবে লিখতে লিখতেও পরিণতি নিয়ে ভাবতে পারেন। আগেই ঠিক করে নিয়ে লিখতে হবে সে রকম কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু আগে ঠিক করে নিলে লেখাটা সহজ হয়।


২) ঠিক করুন গল্পটির বর্ণনাকারী কেন এবং কে বলবে এই গল্পটি?

প্রধান কোনো চরিত্র গল্পটি বলতে পারেন। অথবা অন্য কোনো চরিত্র কথক হতে পারে। অথবা গল্পকার নিজেও বলতে পারেন।

গল্পটি যদি একটু বড় হয়ে যায়, তবে প্রতি অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন কথক বর্ণনাকারী হতে পারে।

আপনি আগে যে বর্ণনাকারী ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন, সেটা হতে পারে আমি/তুমি/ সে বা রহিম করিম আফরোজা নীলু।


৩) গল্পটির ভাষাভঙ্গি বেছে নেওয়া দরকার। 
ঘটনার ধরন, চরিত্র স্থান কাল ইত্যাদির উপর নির্ভর করবে গল্পটিতে আপনি কী ধরনের শব্দ, বাক্য ব্যবহার করবেন। এটা গল্পের একটি কঠিন অংশ।

শুরুটা নানাভাবে করতে পারেন।

ধরা যাক কোনো প্রেমিক জোটেনি বলে যেদিন কোনো মেয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে, ঠিক তার পরদিনই তার জীবনে প্রেম এসে গেছে।

সংলাপ দিয়েও শুরু হতে পারে গল্পটি।

‘দানিয়েল, তুমি জানো, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি’। ক্রিস্টিনা বলল।

কিন্তু যে মেয়েটি তার হৃদয়কে বহুবার ভেঙ্গে দিয়েছে, তাকে দানিয়েল কীভাবে বিশ্বাস করবে?

প্রথম বাক্যটি সংলাপ। দ্বিতীয় বাক্যটি সংলাপ নয়। চরিত্রের একটি প্রশ্ন।


একটি প্রধান চরিত্রের বর্ণনা দিয়েও গল্পটি শুরু হতে পারে। উদাহরণ--

‘দয়াময়ের দুহাতে অনেক মাদুলী, হাঁটুর চারপাশে খোসপাঁচড়া। পাঁচড়া চুলকোলে মাদুলী বাজে ঝনঝন।

--(দুলালচাঁদ/ স্বপ্নময় চক্রবর্তী)


৪) এবারে লিখতে বসুন গল্পটি। 
যখন গল্পটির আউট লাইন পূর্ণভাবে করে ফেলেছেন, কোনো অস্পষ্টতা নেই, সব প্রশ্নের উত্তরই আপনার কাছে আছে, তখন লিখতে বসুন। লিখুন খোলা মনে। আরাম করে। লিখুন এই গল্পটি নিয়ে আপনি যা ভেবেছিলেন, তা লিখুন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ