সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যতত্ত্ব একটি প্রাচীন শাস্ত্র; এর উৎপত্তি শিল্প সৃষ্টির প্রথম তৎপরতার সমসাময়িক । শিল্প মানবমনের আনন্দিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ এবং সেই শিল্পকে সৌন্দর্যের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় যে শাস্ত্রে, তার নাম নন্দনতত্ত্ব । আনন্দিত উপলব্ধি? বেদনা থেকে কি শিল্প জন্ম নেয় না? নেয় ।
কিন্তু সে বেদনার প্রকাশেও এক ধরনের আনন্দ থাকে, যন্ত্রণা থেকে এক ধরনের মুক্তি । নন্দনতত্ত্বের ‘তত্ত্ব’ শব্দটিতে প্রচলিত অর্থে তাত্ত্বিকতার আভাষ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে একজন নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পকে কোনো বাঁধাধরা নিয়মে যাচাই করতে পারেন না । শিল্পের প্রধান পরিচয় শিল্প একটি সৃষ্টি এবং শিল্পমাত্রই এক অর্থে স্বতঃস্ফূর্ত। নিয়মশৃঙ্খলার নিগড়ে আবদ্ধ করলে শিল্পের চরিত্র ক্ষুন্ন হয় । নন্দনতত্ত্বের সূত্রসমূহ শিল্পসৃষ্টির পথনির্দেশক নয়। এসব সূত্রের সাহায্যে শিল্পকে ও তার অন্তর্গত সৌন্দৰ্য-চেতনাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়, তলিয়ে দেখা যায় । শিল্পের সংজ্ঞা নির্ণয় যেহেতু দুরূহ ব্যাপার, সেজন্য নন্দনতত্ত্বের পরিধিও ব্যাপক ও বিস্তৃত । প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে জয়নাল আবেদীনের দুর্ভিক্ষের ছবি, আদিম বনদেবতার পূজা-উৎসবের নৃত্যার্ঘ থেকে আধুনিক কোনো নৃত্যদলের পরিবেশিত ব্যালে, অফিয়ুসের মোহন বাঁশি থেকে পাংক-রক, সবই শিল্পের পর্যায়ভুক্ত । এখানেই শেষ নয় । জীবনবাদী ও সমাজাশ্রয়ী শিল্প সমালোচনা অনুযায়ী শ্রমিকের রক্তে ঘামে তৈরি একটি রাস্তাও শিল্প, গুণটানা মাঝিরাও শিল্পী । এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে এসব শিল্প হলে এখানে আনন্দের স্থান কোথায়? উত্তর : শিল্পের আনন্দ প্রয়োজনসিদ্ধ নয়, এবং এর কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই । গুণটানা মাঝির বিষন্ন শরীরে বা ক্লান্ত শ্রমিকের পরিশ্রমী অবয়বে বাহ্যিক সৌন্দর্য নেই; চোখকে বা মনকে তা তৃপ্ত করে না । কিন্তু এদের উপস্থিতি এক ধরনের মহত্ত্বের দাবিদার, পরিপার্শ্বকে তারা সহজেই ক্ষুদ্র করে ফেলে, শ্রমের সমুন্নতিতে নিজেদের অস্তিত্বকে করে বিশাল । এই মহত্ত্বের অনুভবই সৌন্দর্য । শিল্পের অনিষ্ট হলো জীবন । তাই এ মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন যে, জীবনধারণের গৃঢ় তাগিদই শিল্প । যে তাগিদ জীবনকে পরিচালিত করে তাই সৃষ্টি করে শিল্প ।
এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত না হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে শিল্প মানবিক সৃষ্টি বলে কোনো না কোনোভাবে এতে জীবনের প্রসঙ্গ থাকবেই। এবং জীবন জটিল ও বহু বিচিত্র । এজন্য নন্দনতত্ত্বের বিষয়বস্তুর কোনো সুনির্দিষ্ট সীমাচিহ্ন নেই । নন্দনতত্ত্বের সীমানায় শিল্পকলার বিভিন্ন অনুষঙ্গ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সূত্র ও সমস্যা, নীতিশাস্ত্র, মূল্যবিচার এবং সামগ্রিকভাবে দর্শনের নানান উপাদান অন্তর্ভুক্ত। এবং যেহেতু শিল্পের একটি বড় অংশ অচেতন বা অবচেতন মনের সৃষ্টি, নন্দনতত্ত্বের প্রধান বিচার তর্ক-ভিত্তিক বা জ্ঞান-ভিত্তিক নয়, অনুভব এবং অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক । সৌন্দর্য ও রমণীয়তার নিরিখে শিল্পের বিচার হলে তার ব্যাখ্যা জগন্নাথ পণ্ডিত যেমন “রসগঙ্গাধর”-এ কাব্যের স্বরূপ নির্ণয় প্রসঙ্গে বলেছেন, লোকোত্তরাহ্লাদজনকক্তানগোচরতা। অর্থাৎ সজ্ঞান বিবেচনার বাইরে আনন্দ সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া তাই সৌন্দর্য । বলা যায় তা-ই শিল্প । নন্দনতত্ত্বের অন্যতম উপজীব্য এই লোকোত্তরাহ্লাদ ।
নন্দনতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ Aesthetics । কিন্তু মূল শব্দটি গ্রীক ভাষা থেকে উদ্ভূত। Aisthesis শব্দের অর্থ One who perceives অর্থাৎ যিনি প্রত্যক্ষ করেন । কাজেই Aesthetics মানে প্রত্যক্ষণ শাস্ত্র । প্রাচীন সংস্কৃতে যাকে বলা হয় বীক্ষাশাস্ত্র । বীক্ষণ অর্থও বিশেষ ভাবে দেখা অর্থাৎ গ্রীক প্রত্যক্ষণ আর সংস্কৃত বীক্ষণ একই কর্মকাণ্ডের পরিচায়ক । কিন্তু প্রশ্ন আসে, কি দেখা? এই প্রশ্নের সঙ্গে আরো যোগ করা যায় কিভাবে দেখা, কি জন্য দেখা? উত্তরে বলা যায়, আমাদের বস্তুজগতের যা কিছু দৃশ্যমান তাদের দেখা, তাদের চরিত্র, রূপ অনুধাবন করা, তাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও সম্পর্কসমূহ তলিয়ে দেখা । কিন্তু প্রত্যক্ষ বস্তুজগতের বাইরেও যে সৌন্দর্যের অস্তিত্ব তাকেও দেখতে হবে; অবাঙ্মনসগোচর পৃথিবীর স্বরূপ সন্ধানও করতে হবে, অর্থাৎ দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগৎ, দেহ ও আত্মার লীলাক্ষেত্র উভয়কে প্রত্যক্ষণ করা । গ্রীক শব্দ Aisthetes এর যে পরিচয়, যিনি প্রত্যক্ষণ বা perceive করেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রত্যক্ষণ ইন্দ্ৰিয়জাত হলেও অনেকটা ইন্দ্ৰিয়াতীতও বটে। কাজেই কিভাবে দেখা যাবে? এর উত্তরে বলা যায়, ইন্দ্রিয় সংযোগে, আবার বোধি এবং স্বজ্ঞার মাধ্যমেও । কি জন্য দেখা? এর কোনো সঠিক ও পরিমাপযোগ্য উত্তর নেই। শিল্পী তাঁর সৃষ্টির স্বাধীন তাগিদ থেকে সৃষ্টি করেন বলে কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের অধীনে তার সৃষ্টিকর্মকে ফেলা যায় না। শিল্পী সম্পূর্ণ স্বাধীন, নন্দনতত্ত্বের প্রত্যক্ষণ কোনো কারণ-উদ্ভূত নয় । তবুও বলা যায়, জগৎ প্রকৃতির লীলাখেলাকে প্রত্যক্ষ করে, তার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সকল প্রকাশকে অনুভব ও বোধির মাধ্যমে অধিগত করে আমরা সৃষ্টির প্রকৃত রূপকে উপলব্ধি করতে পারি। এই প্রক্রিয়াটি দর্শনেরও একটি স্বীকৃত প্রক্রিয়া; তবে নন্দনতত্ত্বের প্রত্যক্ষণ যে গৃঢ় তাগিদ থেকে উদ্ভূত, তার উদ্দিষ্ট সুন্দর, শুভ, আনন্দ ও কল্যাণ ।
শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব উপায়ে জগৎ ও প্রকৃতিকে বিশ্বস্ততার সাথে তাঁদের কর্মে প্রতিফলিত করেন, এবং নন্দনতত্ত্ব এই প্রক্রিয়া ও তার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করে । এজন্য নন্দনতত্ত্বে অনুসন্ধানের মূল্য অনেক । এই অনুসন্ধান বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়, এর দ্বারা শিল্পীর সৃষ্টি রহস্য, ভিন্নতা, শিল্পের ভিতরবাসী সত্য ও তার সার্বিক লক্ষণসমূহ ধরা পড়ে। নন্দনতাত্ত্বিক যখন প্রশ্ন করেন, একটি অভিন্ন উদ্দেশ্য সত্ত্বেও শিল্পে এত ভিন্নতা কেন, প্রকাশের এত বৈচিত্র্য কেন, তখন নানা মত হাজির করা হয়। টলস্টয় বলেন, শিল্পীর ব্যক্তিত্ব, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, বোধ, অনুভূতির তারতম্যের জন্য এমনটি ঘটে; আবার ই. এইচ. গোম্ব্রিচ-এর মতো নন্দনতাত্ত্বিক মত পোষণ করেন যে টলস্টয়ের ধারণাটি সত্য বটে, তবে তাতে শিল্পীর সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানকে অবহেলা করা হয়েছে । তাঁর মতে সকল শিল্পের উৎপত্তিস্থল মানুষের মন । শুধু দৃশ্যমান পৃথিবী নয় বরং সমগ্র বিশ্বের প্রতি আমাদের আচার আচরণের উপর নির্ভর করে এই শিল্প- দৃশ্যমান ও দৃশ্য-অগোচর উভয় জগৎই শিল্পের উদ্দিষ্ট । যেহেতু সকল শিল্পই Conceptual বা ধারণা-ভিত্তিক, সেজন্য শিল্পের পরিচয় মেলে তার শৈলীতে । এভাবে কবি, সাহিত্যিক, চিত্রী সবাই বিশেষ যুগ বা কালের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন- তাঁদের নিজস্ব যুগ বা কাল তাঁদের সৃষ্টিকর্মকেও প্রভাবিত করে তাকে চিহ্নিত করে । শেক্সপীয়ারের সৃষ্টির চিরায়ত অবদান সত্ত্বেও শৈলী ও আঙ্গিকের বিচারে তাকে এলিজাবেথীয় বলে সহজেই সনাক্ত করা যায়- পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কোনো যুগের যে তা নয়, শেক্সপীয়ারের জন্মতারিখ না জেনেও তা বলা যায় ।
শিল্পে প্রতিফলিত জগতের দৃশ্য বা অদৃশ্যরূপের যে সন্ধান নন্দনতত্ত্বে চলে তার একটি পরিচয় এর সাংকেতিক চরিত্র । যে শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি যত প্রখর হবে, এই রূপ তাঁর কাছে তত সহজেই ধরা পড়বে- এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য প্রত্যক্ষণের দুরূহতাও । সকলের কাছে জীবন ও জগতের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে না, এজন্য চর্চার প্রয়োজন, অথবা প্রয়োজন এক তীব্র দিব্যদর্শনের, যা বালীকিকে যেমন, মুহুর্তের মধ্যে মহাকবিতে রূপান্তরিত করেছিলো । নন্দলাল বসু মনে করতেন যে, “আমাদের মনের সামনে একটা চিক টাঙ্গানো থাকে; সেইটি সরাতে না পারলে বস্তুকে যথার্থ দেখা যায় না... । দীর্ঘকালীন অনুরাগ ও অভ্যাসে কোন বিশেষ প্রতিভাবান শিল্পী হয়তো এমন অবস্থা লাভ করেন যে যখন যে-বস্তুর পানেই তাকান চোখের সামনে থেকে ঐ আবরণ সরে যায়, রূপরচনা কাজেই তাঁর পক্ষে সহজ হয় ।” এর সাথে আরেকটু যোগ করে বলা যায়, কোনো কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে জীবন ও জগতের মধ্যে বস্তু ও মনের মাঝখানে যে মায়াবী পর্দা টাঙ্গানো তা মুহুর্তের ভগ্নাংশে প্রাপ্ত দিব্যদর্শনেও অপসারিত হয়; প্রকাশ হয়ে পড়ে জগতের প্রকৃত রূপ । কিন্তু পস্থা যাই হোক এই রূপটি একবার অনুধাবন করতে পারলে পরবর্তী যে পর্যায়, তাকে প্রকাশ করা, সে হয়ে দাঁড়ায় সমান দুরূহ। মহৎ শিল্পী মাত্রই যথাসাধ্য চেষ্টা করেন এই রূপের সার্বিক পরিচয় তুলে ধরতে । কিন্তু সমস্যা হয় সার্বিক পরিচয়টি কি তা নিয়ে । বস্তু বা জগৎ নির্বস্তু বা অতিজগতের অভ্রান্ত রূপটি কি, এ বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা কোনো শিল্পীর পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয় । তাই শরণ নিতে হয় সংকেতের, প্রতীকের; আসে বিমূর্তন । হাৰ্বার্ট রীডের মতে “শিল্পের প্রকৃত পরিচয় নির্ভর করে প্রতীকতার চরিত্র এবং প্রয়োগের যথাযথ বিবেচনার উপর ।” রীড আরো বলেছেন, “প্রতীকতা হচ্ছে মানবমনের ক্রিয়াকাণ্ডের একটি পরিচয়, অন্যটি হচ্ছে বাহ্য পৃথিবীর সরাসরি অভিজ্ঞান” অর্থাৎ সরাসরি বর্ণনাকে অপ্রতুল ভেবে কবি সংকেত-প্রতীকের প্রয়োগ করেছেন। অবশ্য গৃঢ় অর্থে ভাষাও প্রতীক, ভাষার ধর্ম প্রতীকেরই ধর্ম। এজন্য নন্দনতত্ত্বের একটি প্রধান প্রচেষ্টা শিল্পের সংকেত ও প্রতীকের অর্থ উদ্ধার করা, কারণ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সৃষ্টিশীলতার সূত্রাবলী ।
নন্দনতত্ত্বের একটি সমস্যা হলো এই যে, এতে কোনো সুনির্দিষ্ট বিচার বিবেচনা চলে না বলে শিল্পের পরিচয় ব্যক্তিতে না ব্যক্তির পরিচয় শিল্পে, এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মেলে না । আমরা দেখেছি টলস্টয়-এর দেয়া শিল্পের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা পরবর্তীদের দেয়া ব্যাখ্যা থেকে আলাদা । তাছাড়া শিল্পীর ব্যবহৃত উপায় উপকরণের ভিন্নতার জন্য শিল্পের প্রকাশ ভিন্ন হয় । এজন্য সংকেতধর্মী শিল্প, বর্ণনা বা প্রকাশধর্মী শিল্প, মূর্ত ও বিমূর্ত শিল্পের চরিত্র আলাদা তাছাড়া Aesthetic Emotion বা নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতির প্রসঙ্গটিও এখানে প্রণিধানযোগ্য । জনৈক নন্দনতত্ত্বসমালোচকের মতে “নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতির স্বরূপ কি এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর মেলে না; মেলাবার নয় । কেননা শৈল্পিক আনন্দ-বিষাদ নিয়ে শিল্পানন্দ আস্বাদনের কোন সার্থক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করা চলে না । করলে সে ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যা হবে । এই ধরনের ব্যাখ্যা-প্রয়াসে এক ধরনের অনুপপত্তি ঘটবে । একে বলা হয়েছে Naturalistic Fallacy বা প্রাকৃত আভাস।” নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতি আর সৌন্দর্যানুভূতি সমার্থক শিল্পের সার্থকতা-ব্যর্থতা তর্ক বিচারে যতটা না পরিমাপ করা যায়, অনুভূতির বিচারে তার থেকে বেশি করা সম্ভব । প্লেটো সৌন্দর্যানুভূতিকে নির্মল আনন্দানুভূতির তুল্য বলেছেন । আর ওয়াল্টার পেটার জানিয়েছেন যে আর্ট ও কবিতার রসাস্বাদন আলোচনার মাধ্যমে করা সম্ভব নয় ।
সৌন্দর্যানুভূতি মানুষের সহজাত অনুভূতি- প্রবৃত্তিও বলা যায়, এর প্রকাশ অকপট ও স্বত:স্ফূর্ত; কিন্তু নন্দনতত্ত্বের সমস্যা হলো এই অনুভূতিকে সঠিকভাবে কি করে চিহ্নিত করা যায় । কলাকৈবল্যবাদীরা নিছক সুন্দরের মাপকাঠিতে তাকে পরীক্ষা করতে চান, জীবনবাদীরা চান জীবনের মাপকাঠিতে । ব্যক্তিতে যারা বিশ্বাসী তারা ব্যক্তির বিশিষ্টতার উপর একে নির্ভরশীল দেখতে চান, আবার যারা সংশয়বাদী, তারা বলেন- সৌন্দর্যানুভূতি অবশ্যই বস্তু নিরপেক্ষ: বস্তুতে যেমন সৌন্দর্য নাই, মনেরও তেমনি কোনো সুনির্দিষ্ট সৌন্দর্যচিন্তা নেই । বস্তু ও মন উভয়ের যোগফলে যদি সৌন্দর্যানুভূতির সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই অনুভূতি অপ্রকৃত । কারণ তা একটি ভিত্তিহীন মানসিক প্রক্রিয়া । এসব চরম ও বিপরীত মতামতের কেন্দ্রে যে সত্যটি প্রতিষ্ঠিত তা হলো, সৌন্দর্যের সন্ধান, বিভিন্ন মতাবলম্বীরা বিভিন্নভাবে তা করে গেছেন । এই সৌন্দর্যের সন্ধান ও চর্চাই নন্দনতত্ত্বের সর্বপ্রথম উপজীব্য । ইউরোপীয় দার্শনিক ব্যমগার্টেন নন্দনতত্ত্বকে সর্বপ্রথম ‘সৌন্দর্যের দর্শন’ বলে অভিহিত করেছেন । কিন্তু সুন্দর কি, এর একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা না পেলে সৌন্দর্যের দর্শন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট রয়ে যাবে ।
আচাৰ্য সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত তাঁর “সৌন্দর্যতত্ত্ব” বইটি শুরু করেছেন সুন্দরের ব্যাখ্যা ও কিছু সংজ্ঞা দিয়ে। তিনি বলেছেন, “সৌন্দর্য একটি বিশেষ সামঞ্জস্য বা পরিচয়ের বোধ । বিশেষাত্মক এবং বিশিষ্ট বোধ বলিয়া ইহার স্বরূপ লক্ষণ সম্ভব নহে ।” এই বোধটি Subjective বা ব্যক্তিনির্ভর এবং এর চরিত্র সব সময় আপেক্ষিক চূড়ান্ত নয় । তবে কোনো একটি পর্যায়ে সুন্দরের একটি রূপ আছে যা একান্তভাবেই সর্বজনগ্রাহ্য । শিল্পীরা তাঁদের সুন্দরের অনুসন্ধানে বর্ণনাকে বাদ দিয়ে প্রতীককে বেছে নিয়েছেন, কারণ চূড়ান্তকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করবে তেমন ভাষা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতীকের মাধ্যমে সর্বজনগ্রাহ্য ঐ রূপটিকে সাজাতে গিয়ে একজন কবি বা একটি যুগ আরেকজন কবি বা আরেকটি যুগের কাছে যা রেখে যায়, তা প্রতীকের বৃহত্তর রূপমিথ্ । কোন্ আদিকালে হোমার হেলেনকে তেমনি একটি প্রতীকে রূপান্তরিত করেছিলেন, এখন হেলেন রূপের প্রতীক শুধু নন, তিনি চলে গেছেন মিথের পর্যায়ে । রক্তমাংসের হেলেন থেকে থাকলে নিশ্চয়ই কোথাও খুঁত ছিলো তাঁর, কিন্তু এখন এহ বাহ্য। এই প্রতীকীকরণের প্রচেষ্টা সৌন্দর্যসৃষ্টির একটি দুরূহ প্রক্রিয়ার নামান্তর । “সুন্দরের স্বরূপলক্ষণ সম্ভব নহে” এই কথাটি মেনে নিয়ে অবশ্য শিল্পীরাও বসে থাকেননি, তেমনি বসে থাকেননি নন্দনতাত্ত্বিকেরা। দর্শনের একটি পাঠ হলো এই যে, সমগ্রকে জানা যখন সম্ভব হয় না, তখন তার খণ্ডাংশকে জানতে চেষ্টা করা উচিত । বিভিন্ন খণ্ডাংশের সম্মিলিত জ্ঞান দিয়ে সমগ্রের নিকটে পৌঁছা সম্ভব । এজন্য সৌন্দর্যকে জানার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় এর বিভিন্ন অনুষঙ্গ উপকরণের সনাক্তকরণের প্রয়াসের মধ্য দিয়ে । সৌন্দর্যের সমার্থক বা সমতুল্য প্রকাশকে চেনার মাধ্যমেও এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে । রবীন্দ্রনাথ যেমন সৌন্দর্যকে রুচির সাথে এক করে দেখেছেন তেমনি কীটস দেখেছেন সত্যের সাথে অভিন্নভাবে । বলেছেন, Truth is beauty, beauty is truth. সৌন্দর্যের অন্যতম লক্ষণ আনন্দ এটা ধরে নিয়ে আনন্দবাদীরা শিল্পের একটি পরিচয় খুঁজেছেন আনন্দের মধ্যে। আবার হেগেল Absolute বা চূড়ান্তের মধ্যে সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ পেয়ে বলেছেন শিল্প হচ্ছে এই চূড়ান্তের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রকাশ । কিন্তু সুন্দর সম্বন্ধে অবনীন্দ্রনাথ যে কথাটি বলেছেন বোধ করি তা এ ব্যাপারে সকল আলোচনার একটি সার সংক্ষেপ নির্ণয় করে । “সৌন্দর্যের সন্ধান” নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন :
পণ্ডিতের সামনে এসে সুন্দর দায়গ্রস্থ হল- প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠলো সুন্দরকে নিয়ে- তুমি কেন সুন্দর, কিসে সুন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি । সুন্দর যে সুন্দর বলেই সুন্দর, মনে ধরল বলেই সুন্দর, এ সহজ কথা সেখানে খাটলো না; পণ্ডিত সেই সুন্দরকে বিশ্লেষণ করে দেখাবার চেষ্টা করেছেন- কী নিয়ে সুন্দরের সৌন্দর্য । সেই বিশ্লেষণের একটা মোটামুটি হিসেব করলে এই দাঁড়ায় ।
১. সুখদ বলেই ইনি সুন্দর,
২. কাজের বলেই সুন্দর,
৩. উদ্দেশ্যে এবং উপায় দুয়ের সঙ্গতি দেন বলেই সুন্দর,
৪. অপরিমিত বলেই সুন্দর,
৫. সুশৃঙ্খল বলেই সুন্দর,
৬. সুসংহত বলেই সুন্দর,
৭. বিচিত্র-অবিচিত্র সম-বিষম দুই নিয়ে ইনি সুন্দর।
— এই সব প্রাচীন এবং আধুনিক পণ্ডিতগণের মতামত নিয়ে সৌন্দর্যের সার ধরবার জন্যে সুন্দর একটি জাল বুনে নেওয়া যে চলে না তা নয়, কিন্তু তাতে করে সুন্দরকে ঠিক যে ধরা যায় তার আশা আমি দিতে সাহস করি না ।
অবনীন্দ্রনাথ আর্ট বা শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করার অসারতা সম্বন্ধে ইঙ্গিত দিয়ে আরো বলেছেন “আর্টের মধ্যে রীতিনীতি, চক্ষু-জড়ানো, মন-ওড়ানো, প্রাণ-ভোলানো ও কাঁদানো গুণ, কিংবা এর যে কোন একটা যেমন আর্ট নয়, আর্ট বলেই যেমন সে আর্ট, সুন্দরও তেমনি সুন্দর বলেই সুন্দর ।”
অবনীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর চিত্রকর্মে নিছক সুন্দরের জন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন এমনটি বলা যায় না । তাতে জীবনের নানা গৃঢ়ার্থও প্রতিফলিত হয়েছে। সত্যিকার অর্থে কলাকৈবল্যবাদী যাঁরা তাঁদের শিল্পকর্মেও তো জীবন কোনো না কোনোভাবে বিধৃত । উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপে প্রি-রাফ্যালাইট ব্রাদারহুড নামে একটি শিল্প আন্দোলন উৎকর্ষ লাভ করে, তাদের চিত্রে নক্সা ও অলঙ্কারের প্রাধান্য দেখা যায় এবং কলাকৈবল্যবাদী বলে তাঁদের সহজেই আখ্যায়িত করা চলে । কিন্তু তাঁদের চিত্রকর্মেও সমকালীন জীবনযাত্রার প্রচুর ছাপ আছে । যে অর্থে শিল্পে সামাজিক জিজ্ঞাসাসমূহ রূপায়িত হয়, প্রি-রাফ্যালাইটদের চিত্রকর্মে তার কোনো প্রচেষ্টা ছিলো না সত্য, কিন্তু রঙের ব্যবহারে নক্সা ও কারুকাজের আড়ালে কিছু কিছু জীবনোপলব্ধি অবশ্যই বাঙময় হয়েছে ।
নন্দনতত্ত্ব শিল্প ও জীবনের সম্পর্কসমূহকে যেভাবে উন্মোচিত করে, তেমনি শিল্পের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক, রীতি-নীতি ও নির্মাণ উপকরণকে পাঠ করে । এজন্য শিল্প-অন্তর্গত ও শিল্প-বহির্ভূত অনেক প্রসঙ্গ নন্দনতত্ত্বে ঠাঁই পায় । সৃষ্টির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কথাই ধরা যায় । আমরা জানি জীবন মানেই দ্বন্দ্ব : জীবনের নানান বৈপরীত্য, দ্বৈত এবং পরস্পরবিরোধী প্রকাশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়েই জীবনের উত্তাপ । এজন্য সাহিত্যের শুরুতে নাটকের এত জনপ্রিয়তা ছিলো । গ্রীসে নাটকের চরম উৎকর্ষ ঘটে যীশুর জন্মের কয়েকশ' বছর আগেই- ঈসকাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, এরিষ্টোফিনিস-এর নাট্যচর্চায় । নাটকের এই উত্তরণ ও জনপ্রিয়তার কারণ এই যে সকল শিল্প-মাধ্যমের মধ্যে নাটকই জীবনের দ্বন্দ্বসমূহ সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে । এই দ্বন্দ্বের সুচারু প্রকাশে শিল্প হয় আকর্ষণীয়, মহিমামণ্ডিত । শিল্পদর্শনেও দ্বন্দ্বের স্বরূপ অণ্বেষা একটি প্রধান কাজ । দর্শনের ছাত্র মাত্রই জানেন, দার্শনিক হেগেলের দ্বান্দ্বিক ভাববাদের উৎস হলো তাঁর এই অনুধাবন যে বিশ্ব আত্মার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে একটি দ্বান্দ্বিক নক্সার মধ্য দিয়ে । এই নক্সার একদিকে আছে স্ব (Thesis), অন্যদিকে স্ববিরোধী (Antithesis) এবং এর আংশিক সমাধান হয় স্বপ্রতিসংহরণে (Synthesis) । হেগেলের এই মতবাদের শুদ্ধ দ্বান্দ্বিক দিকটি কার্ল মার্ক্স তার ইতিহাস দর্শনে প্রয়োগ করেন এবং তাঁর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তত্ত্ব জগৎকে উপহার দেন । নন্দনতত্ত্বের এই দ্বান্দ্বিকবাদ অনুপস্থিত নয়, তবে একটু ভিন্নভাবে । বলা হয়, শিল্প হচ্ছে পালাক্রমে জীবনভিত্তিক এবং জীবন থেকে পলাতক । শিল্প আন্দোলনসমূহ অনেকটা চক্রাকারে আবর্তিত : কলাকৈবল্যবাদের পরে আসে বিষয়সচেতনতা, জীবনঘনিষ্ঠতা, গজদন্তমিনারবাসী শিল্পের পতন হয় পর্ণ-কুটিরের শিল্পে অর্থাৎ বাস্তবতায় । এর পর আবার পরিলক্ষিত হয় পিছুটান । ইউরোপের বিভিন্ন শিল্প আন্দোলনের দিকে তাকালে আমরা এই সত্য উপলব্ধি করতে পারব । এই পালাবদল হয় শিল্পের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জন্য, জীবন- জীবনবিমুখিতার, স্বপ্নবাস্তবতার দ্বন্দ্বের জন্য । তবে শিল্প সম্পর্কে এই কথাটি বলা সম্ভব যে হেগেলীয় স্বপ্রতিসংহরণ প্রতিনিয়তই চলছে তাতে; একটি মাধ্যম আরেকটি মাধ্যমকে, একটি প্রকরণ আরেকটিকে, একটি যুগ আরেকটি যুগকে পরিপূরণ সম্পূরণ করে চলছে ক্রমাগত । এজন্য স্ব-প্রতিসংহরণ বা Synthesis-ও হচ্ছে একাধারে শিল্পের গতিময়তা বা Dynamism এই অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ ।
বিংশ শতাব্দীতে নন্দনতত্ত্বের প্রবক্তারা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লেন । শিল্পের জন্য শিল্প এই মতটি যেমন এখনও প্রতিষ্ঠিত, জীবনের জন্য শিল্প এই মতটিও প্রবলভাবে শক্তিশালী। Arts for Arts Sake বা কলাকৈবল্যবাদের প্রবক্তারা ভারতে অলংকার শাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ বিশ্বনাথ কবিরাজের “সাহিত্য দর্পণে” অনেক আগেই উন্মাদ বলে অভিহিত হয়েছেন । স্বামী বিবেকানন্দ শুদ্ধ আনন্দের জন্য শিল্পসৃষ্টির বিপক্ষে ছিলেন । ইউরোপে মার্কস ও এঙ্গেলস ছাড়াও অনেক নন্দনতাত্ত্বিক কলাকৈবল্যবাদের বিরোধিতা করেছেন । এঙ্গেলস তো বলেইছেন যে, র্যাফেল-এর চিত্রকলা, থরওয়াল্ডসনের ভাস্কর্য এবং প্যাগানিনির সঙ্গীতে যে শিল্পকুশলতা পরিলক্ষিত হয় তার পেছনে ঐতিহ্য রয়েছে শ্রমের, শ্রমিকের হাতের । হাত শুধু শ্রম-যন্ত্র নয়, শ্রমের সৃষ্টিও বটে । এই শ্রমের হাত সর্বত্র যোগায় কুশলতা, যা শিল্প প্রক্রিয়ার একটি আরাধ্য প্রাপ্তি । ভারতের অন্যতম বিশিষ্ট নন্দনতত্ত্ববিদ আনন্দ কুমারস্বামীর শিল্প চিন্তার সঙ্গে এঙ্গেলসের এই মতের প্রচুর মিল দেখা যায় । কুমার স্বামীর মতে শিল্প কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্ব নয়, এবং সমাজের প্রায় সবাই একজন শিল্পী । যারা নিজস্ব ক্ষেত্রে শিল্পী নয়, তারা অলস, কুঁড়ে । এবং এরাই শিল্পীর বিপরীত । যে শিল্পী নয়, তার পক্ষে সামাজিক মর্যাদার কোনো দাবি থাকতে পারে না । কুমারস্বামী বিশ্বাস করতেন যে মানুষের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ কর্মে বা সৃষ্টিতে এবং কর্ম ও সৃষ্টি শাসিত হয় শিল্পের দ্বারা । কিন্তু কুমারস্বামীকে মার্ক্সবাদের প্রবক্তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উদ্ধত করুন না কেন, তাঁর নন্দনতত্ত্বের একটি পরিচয় ছিলো বিশুদ্ধ চৈতন্যের সাধনা, যা শিল্পের উপযোগিতার মতবাদকে পাশ কাটিয়ে যায়। তাঁর ‘The Mirror of Gesture’বইয়ের শুরুতে কুমারস্বামী লিখেছেন : “নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতির প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে ব্রহ্মসাধনা (আধ্যাত্মিক মিলনের) তুল্য এক ধরনের কালহীন বিমল আনন্দ।” কুমারস্বামীর সৌন্দর্যসাধনা আসলে নন্দনতত্ত্বের দ্বিবিধ ধারাকে সম্পৃক্ত করেছে; শিল্পীর সাধনা বিশুদ্ধ চৈতন্যের, তারাও শিল্পী, কামার, কুমোর, ছুতোর, উকিল, কৃষক, যাজক সবাই শিল্পী; কারণ তারা জগতের সৃষ্টিকর্মে শরিক। এভাবে শিল্প ও শিল্পীর বিশ্বজনীনতা নির্ণয়ের সাথে সাথে শিল্পের পরমার্থ এবং বিশুদ্ধ রূপের সন্ধান কুমারস্বামীর নন্দনতত্ত্বের সূত্রসমূহে বিন্যস্ত ।
সৌন্দর্যতত্ত্বের উদ্ভবের প্রথম পর্যায়ে শিল্প-সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেও বিবেচনা করা হতো। সর্বেশ্বরবাদের প্রবক্তারা প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি লক্ষ্য করতেন, নিসর্গ প্রেমিকরা নিসর্গের রূপ ও শোভায় মোহিত হয়ে প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকৃতিতে লুক্কায়িত এমন বিশ্বাস পোষণ করতেন। আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সূত্রগুলো (যথা, সুষমা, সামঞ্জস্য, সমুন্নিত ইত্যাদি) মানুষের তৈরি শিল্পে প্রতিফলিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় রোমান্টিক সাহিত্য ও চিত্রকলায় । কিন্তু মধ্যযুগের শিল্পে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশেষ স্থান নেই, তেমনি হেগেল বা আধুনিককালের নন্দনতাত্ত্বিক ক্রোচে ও তার শিষ্য জেস্তিনের ভাবাদর্শে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান অত্যন্ত গৌণ। তাঁদের মতে মানুষের তৈরি শিল্পকর্মেই প্রকৃত সৌন্দর্য বিরাজমান । বর্তমানকালে তাই নন্দনতত্ত্বে সমাজবোধ প্রবল হলেও অতিবর্তী আধ্যাত্মবাদ বা প্রকৃতি চেতনা প্রায় অনুপস্থিত । সৌন্দর্যকে ক্রোচে বস্তু-বহির্ভূত বলেও চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন সৌন্দর্য বস্তুতে নেই, আছে মানুষের কর্মকাণ্ডে । সৌন্দর্য কোনো বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণ নয় বরং তা প্রতীতির ব্যাপার । কল্পনার সহায়তা ছাড়া নিসর্গের কোনো অংশই সুন্দর নয়, এবং শিল্পীর হাতে অধিকতর সুষমা পায়নি এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোথাও নেই। নিসর্গ-সুন্দর শিল্পীর বিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই, প্রকৃতির নিজস্ব কোনো সৌন্দর্য নেই; মন কল্পনার সাহায্যে তাতে সৌন্দর্যের মাত্রা চড়ায় । এভাবে আধ্যাত্মচিন্তাও সুন্দর ও কল্যাণকর শুধুমাত্র উপলব্ধির বিশুদ্ধতা গুণে । যে শিল্পীর এই গুণ আছে তাঁর সৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক হর্ষ ও পুলক আমাদের মগ্ন চৈতন্যে আঘাত করে, এবং আমাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের ভাব জাগ্রত হয় । তবে ক্রোচের দর্শনে অধ্যাত্মবাদ যে নেই তা নয়, বরং শোপেনহাওয়ার বা কান্টের মতো তিনি সৌন্দর্যচেতনার সাথে আধ্যাত্মবাদের একটি যোগাযোগ স্থাপন করেছেন । কিন্তু অধ্যাত্মবাদ এখানে কোনো অতিবতী জীবনদর্শন নয়, বস্তুর উদ্ভাসিত রূপটি বিশেষভাবে উপলব্ধি করার একটি উপায় মাত্র ।
নন্দনতত্ত্বের মূল প্রশ্ন ‘সুন্দর কি? ঘুরে ফিরে যে কোনো শিল্পে বা শিল্পসম্পর্কিত আলোচনায় এসে যায় । দেখা যায় এর একটি বিহিত উত্তর দাঁড় করাতে পারলে নন্দনতত্ত্বের মুখ্য সমস্যাটি দূর হয় । শিল্পের প্রক্রিয়াটি প্রধানত এক ধরনের technical বা কুশলতার প্রক্রিয়া, এবং এখানে শিল্পীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র স্বীকৃত । আগে আমরা দেখেছি যে শিল্পী তার চারপাশে যা দেখেন তাকেই সৃষ্টিমহিমায় মহিমাম্বিত করে পরিবেশন করেন । কিন্তু সত্যি কি শিল্পী যা দেখেন তা-ই পরিবেশন করেন, নাকি যা তিনি দেখতে চান, তা? এ দুয়ের মধ্যে তফাৎ অনেক । অনেক আগে থেকেই– গ্রীস ও রোমের প্রাথমিক সৃষ্টিপর্বের যুগ থেকেই আর্ট বা শিল্পকে দক্ষতা ও পদ্ধতির প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়েছে, বস্তুর উপর মানবমনের ইচ্ছাকে আরোপিত করার উপায় বলে ধরা হয়েছে । শিল্পদক্ষতা ও পদ্ধতির ব্যাপার হলে অনুকরণের তত্ত্বটি অপ্রধান হয়ে দাঁড়ায় । অনুকরণে-দক্ষতা আর সৃজনশীলতা এক জিনিস নয়, তাই অনুকরণ ছাড়াও সৃজনের ব্যাপারটি শিল্পের প্রথম বিবেচনা । সেজন্য শিল্পী যা দেখবেন, তাই বিধৃত করবেন, এটা কোনো শিল্পগুণসম্পন্ন কাণ্ড বলে ভাবা যায় না। হার্বার্ট রীড দেখিয়েছেন যে একটি গাছ সুং বংশের চীনা চিত্রকলায়, বাইজানটাইন মোজাইকে, গোথিক কাঁচ চিত্রে, গেইনসবরো বা করোর চিত্রে অথবা সেজানের চিত্রকলায় বিভিন্নভাবে উপস্থিত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে মাটিতে শিকড় ও শূন্যে ডালপালা ছাড়া আর কোনো মিল দেখা যায় না। এই অমিলের নানা সূত্র থাকতে পারে, কিন্তু শেষপর্যন্ত আপেক্ষিকবাদের সাহায্যে এর সমাধান সম্ভব । অর্থাৎ এই বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার কারণ এসব শিল্পীদের নিজস্ব জীবনদৃষ্টি ও দেখার আগ্রহের মধ্যে ভিন্নতা । শিল্পী একটি গাছকে যেভাবে দেখতে চান সেভাবে দেখান । দেখা ও দেখানোর এই নিষ্ঠা শিল্পের বৈচিত্র্য ও নির্বিশেষ ভাবকে প্রকাশ করে । একটি বিশেষ গাছ বা গাছের একটি বিশেষ প্রকাশ সুন্দর বা মনোগ্রাহ্য, অন্যটি নয়, এ ধারণা কিছুতেই এখানে টিকে না । গাছটির সৌন্দর্য নির্ভর করে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গী এবং দর্শনের মনোভাব ও রুচির উপর ।
আলেকজান্ডার ব্যমগার্টেন বলেছিলেন যে, নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে সেই শাস্ত্র যার বিবেচ্য বিষয় ইন্দ্রিয়ানুভূতিজনিত ও প্রয়োজননিরপেক্ষ সুখ দুঃখ ও তার প্রকাশ । এই সুখ দুঃখের প্রকাশে যে আনন্দ ও পুলকের সঞ্চার হয় তা আবার ইন্দ্ৰিয়নিরপেক্ষ । এই আনন্দ “কোনও চিন্তার আনন্দ নয়, কোন আকর্ষণ নয়, কোনও লিন্সা বা সঙ্গ নয়, কোনও ঐন্দ্রয়িক বা যান্ত্রিক বোধজনিতও নহে, অথচ ইহা দ্বারাই বস্তুচ্ছবিটি অন্য উদ্দেশ্যনিরপেক্ষ হইয়া জ্ঞানাকারে বিধৃত হইতে পারে ।” বিশুদ্ধ চৈতন্য, আনন্দ, সৌন্দর্যবোধ, সমাজ ও ইতিহাস সচেতনতা, ব্যক্তি ও শিল্পী স্বতন্ত্র এসব প্রেক্ষিতে বিচার করলে তাই নন্দনতত্ত্ব একটি বিশাল বিষয় বলে প্রতীয়মান হয় ।
1 মন্তব্যসমূহ
সুন্দর ও তথ্যনিষ্ঠ লেখা। পড়ে ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন