হাসান আজিজুল হকের প্রিয় শিক্ষক : সম্বুদ্ধ

পাঠশালা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়- সব জায়গায়ই তো অনেক শিক্ষককে পেয়েছি। যেহেতু প্রিয়তার কোনো মানদণ্ড নেই, সেহেতু সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক নির্ধারণ করা কঠিন। আর আমি যে সাহিত্যিক হয়েছি, সেটাতেও কে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, বলতে গেলে মাত্র একজনের নাম বলাটা খুব কঠিন এবং সেটা পুরো সত্য বলা হবে না। লেখক হওয়ার ব্যাপারটা স্বভাবের মধ্যে থাকতে হয় এবং সেটা আমার মধ্যে ছিল। একটা সময় আমার মনে এ বিষয়টা এতটাই স্থির হয়ে গেল যে আমি অন্য কোনো পেশার দিকে আগ্রহী হলাম না। দেখলাম, একমাত্র শিক্ষকতাই আমাকে স্বাধীনতা দিতে পারে এবং আমার লেখক হওয়ার পথে কোনো বাধা তৈরি করবে না। ফলে পেশা হিসেবে ইচ্ছা করেই শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছি। সেটাও ১৯৬০ সালের ঘটনা। এমএ পাস শেষে শুরু করলাম শিক্ষকতা।


বাল্যকালের একজন শিক্ষকের কথা বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। তাঁর নাম শিবরাম চৌধুরী। তিনি আমার স্কুলের শিক্ষক। স্কুলে নানা বিষয়ে তিনি আমাকে উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়েছেন। তিনি আমাদের ক্লাস নিতেন ফাইভ, সিক্স আর সেভেনে। তাঁর সান্নিধ্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।

১৯৫৪ সালে ভর্তি হই খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজে তৎকালীন আইএ ক্লাসে। কলেজজীবনে যদি সাহিত্যের জায়গা থেকে কোনো শিক্ষকের কথা বলতে চাই, তাহলে প্রথমেই বলতে হবে- সম্বুদ্ধর নাম। এটা তাঁর লেখক নাম। আসল নাম অমূল্য কুমার দাশগুপ্ত। 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায় সমাজ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করতেন। ছিলেন সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠিত লেখক। অদ্ভুত সব রম্য রচনা লিখতেন। সম্বুদ্ধ স্যার আমাদের পড়াতেন অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকের সঙ্গে কথা বলতেন; সময়জ্ঞানও থাকত না। যতক্ষণ কথা বলতেন- সামনে দাঁড়ানো শ্রোতারা হাসতে হাসতে মরে যেত। নানা রকমের অদ্ভুত গল্প সুন্দর করে বলতেন। চুপচাপ থাকতে পছন্ধ করেন এমন অনেক শিক্ষকই তাঁকে অ্যাভয়েড করতেন; কারণ তাঁর সঙ্গে দেখা হলে এক-দেড় ঘণ্টার আগে ছাড়া পেতেন না। আর ছাত্র যদি কোনো একটা সমস্যা নিয়ে তাঁর বাড়িতে যায়; দেখা গেল দুপুরে গেছে, ওর আর সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাড়া নেই। অনর্গল বলে যেতেন যেকোনো বিষয় নিয়ে। একবার দুটো ছেলে খেতে বসে তর্ক জুড়ে দিল- হাঁসের ডিম বেশি পুষ্টিকর না মুরগির ডিম? এ বলে 'হাঁসের ডিম', ও বলে 'মুরগির ডিম'। তখন বেলা ১টা বাজে। সমস্যা সমাধানে ছেলে দুটো গেল অমূল্য স্যারের কাছে। সমস্যা শুনে স্যার বললেন, 'ও আচ্ছা, এই সমস্যা; তোরা বস।'

এরপর ২টা, ৩টা, ৪টা, ৫টা বেজে যায়, স্যার অনর্গল ওই প্রসঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছেন। ছেলে দুটি একদম মরে গেছে আর কি! 'ও তোরা তো জিজ্ঞেস করেছিস, হাঁসের ডিম বেশি পুষ্টিকর না মুরগির ডিম? দুটোই সমান, যা। আর সবচেয়ে ভালো ঘোড়ার ডিম'- সন্ধ্যার দিকে ছেলে দুটোকে উত্তর দিলেন অমূল্য স্যার। এ রকম অনেক মজার সব কাণ্ড করতেন তিনি। এই মানুষটি কলেজবার্ষিকীর সম্পাদক ছিলেন। সাহিত্যে ওই কলেজে আরো অনেক প্রিয়, খুব বড়, জ্ঞানী, খুব বড় গুণী শিক্ষক ছিলেন। নানাভাবে তাঁরা প্রভাবিত করেছেন; কিন্তু তিনি এ কথাটা একটু স্পষ্ট করে বললেন, 'সাহিত্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে।' এই প্রথম একজন সাহিত্যিককে দেখি, তাঁর কথা শুনি, তাঁর ছাত্র হয়েছি, তাঁর লেখা পড়েছি এবং আমাকে তিনি লিখতে প্ররোচিত করেছেন। কলেজবার্ষিকীতে অনেকের একটা লেখাও ছাপা হলো না। আমার একসঙ্গে তিনটি লেখা ছাপা হওয়ায় স্যার ছাত্রদের বলে দিলেন, 'যা করেছি, বেশ করেছি; তিনটে কেন ও যদি ছয়টা লেখা দিত, ছয়টাই ছাপতাম। তোর লেখা ছাপা হয় নাই তো তোর কী হয়েছে?'

খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। কলেজ কোয়ার্টারে থাকতেন। অসম্ভব পড়াশোনা ছিল, বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ কিছুই মানতেন না। পরবর্তীকালে কলকাতায় চলে যান এবং মারা গেছেন ওখানেই। 'ডায়ালেক্টিক', 'শিকার কাহিনী'সহ তাঁর অনেক রচনা রয়েছে। কলকাতায় তাঁর রচনাসমগ্রও পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও অনেক শিক্ষক পেয়েছি। তবে যাঁরা আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের চেয়েও অনেকেই প্রিয় ছিলেন যাঁরা আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে সান্নিধ্য পেয়েছি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মোশারফ হোসেনসহ অনেক গুণী শিক্ষকের। তবে সম্বুদ্ধর কথা কোনো দিন যাবে না ভোলা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ