আজও যেভাবে বেঁচে আছেন শেকসপিয়র

বিপাশা চক্রবর্তী

২৩ এপ্রিল ১৬১৬তে বায়ান্ন বছর বয়সে যখন শেক্সপিয়রের মৃত্যু ঘটল তখন আসেনি কোন শোকবার্তা বা শ্রদ্ধাঞ্জলি। অনুষ্ঠিত হয়নি কোন সাড়ম্বরপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। হয়তো তাৎক্ষনিকভাবে সমসাময়িক কয়েকজন গিয়েছিলেন সমবেদনা জানাতে। এমনিক তাঁর দেহাবশেষ যখন স্ট্রাটফোর্ড ট্রিনিটি চার্চে সমাহিত করা হলো তখন তেমন কেউ প্রস্তাবও রাখেন নি, যেন তা ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে করা হয়।
ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে  ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ ও অভিজাত ব্যক্তিদের সমাহিত করা হয়। অথচ শেক্সপিয়রের মৃত্যুর বছরেই তাঁর সহকর্মী ও নাট্যকার ফ্রান্সিস বিয়েমোন্ট এবং কয়েকবছর পর বেন জনসনকে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়। আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করা যায়, শেকসপিয়রের মৃত্যুতে তাঁর সমসাময়িক ব্রিটিশ ও অন্যান্য প্রতিভাধরেরা সম্পূর্ণরূপে নিরব। শুধুতাই নয়, তাঁর মৃত্যুর সংবাদে নেই কোন রাজকীয়, কূটনৈতিক ও বণিকমহলের কোন শোকবার্তা। বৃটিশ ঐতিহ্য অনুসারে আসেনি কোন নোটিশ, নিউজলেটার বা অন্যকোন চিঠিপত্র। এভাবেই একজন মহান কবি ও পৃথিবীর সর্বকালের সেরা নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়রের মৃত্যু হলো স্থানীয় কোন সাধারণ বৃটিশ নাগরিকের মৃত্যুর মতো। সবার অলক্ষ্যে অগোচরে অতি নিভৃতে। তাঁর মৃত্যুর বেশকিছুকাল পরে, ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবের পোয়েট’স কর্নারে শেকসপিয়রের একটি মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।

শেকসপিয়র মারা যাবার তিনবছর পরেই ১৬১৯ সালে আমরা দেখতে পাই বিখ্যাত অভিনেতা রিচারড বারবাগেজ’এর মৃত্যু তাৎক্ষনিকভাবে প্রবল উত্তেজনা তৈরি করেছিল জনমানসে। শুধু তাই নয় অভিনেতা বারবাগেজের  এই মৃত্যুতে অভিজাত শ্রেণী থেকে শুরু করে তাঁর সমসাময়িকরা এবং সাধারণ জনগণ দীর্ঘদিন শোকগ্রস্ত ছিল । 'ইংল্যান্ড স্পষ্টতঃ একজন মহান মানব’কে হারিয়েছে',  ‘সে চলে গেছে’-- এমন সব শোকবার্তা এসেছিল চারিদিক থেকে। অখ্যাত কবিরাও তাঁকে নিয়ে শোকের কবিতা লিখেছেন।
বারবাগেজ শেকসপিয়রের মতো কোনো তিনি কালত্তীর্ণ বা সাধারণ মানেরও কোনো নাটক লেখেননি, শুধু অভিনয় করেছিলেন শেকসপিয়রের হ্যামলেট, ওথেলো, কিং লেয়ারসহ বহু নাটকের মুখ্য চরিত্রে। নাট্যকারের বদলে অনেক বেশী গুরুত্ব পেয়েছিলেন অভিনেতা বারবাগেজ।

শেকসপিয়রের কাজ এমনকি তাঁর অস্তিত্ব নিয়েও নানা জলঘোলা ,বিস্তর গবেষণা অনুসন্ধান,কথা ও কাহিনীর পরেও শেষপর্যন্ত কিন্তু তিনিই বিজয়ী ।

প্রতিটি চিরায়ত সাহিত্যকর্মই এক একটি বীজতলা। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে শেকসপিয়র এমনই বীজতলা রোপণ করে গেছেন যা থেকে আজও কেবল ফসল ফলেই যাচ্ছে। কোথায় নেই শেকসপিয়র! আর এখনতো রীতিমতো বলাই বাহুল্য যে পৃথিবীর সকল দেশের প্রায় সব ধরনের সাহিত্য ও সাহিত্যিক কোন না ভাবে কম বেশী শেকসপিয়র দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত। উপন্যাস কি কবিতায় নাটক কি চলচ্চিত্রে শেকসপিয়র উপস্থাপিত হচ্ছেন নিত্য নতুনরূপে। এমনকি বাদ যায়নি বিজ্ঞাপন জগতও। শুধু কি তাই, চিকিৎসাশাস্ত্রেও শেকসপিয়র এসেছেন ভিন্নভাবে। সঙ্গীকে নিয়ে নারী বা পুরুষের সন্দেহ প্রবণতার রোগ ‘ওথেলো সিনড্রোম’ এর কথা আমরা জানি। ‘ওথেলো’সহ অন্যান্য সৃষ্টিকর্মগুলোতে শেকসপিয়র যেভাবে নারী-পুরুষের মনোজগতকে বিকশিত করেছেন তা এককথায় অনবদ্য।
২০১৪ সালে শেকসপিয়রের ৪৫০তম জন্মবার্ষিকীতে কানাডিয়ান লেখক ও সাংবাদিক ডেন ফাল্ক প্রকাশ করেছেন ‘দ্য সায়েন্স অফ শেকসপিয়রঃ আ নিউ লুক অফ প্লেরাইট’স ইউনিভার্স ’। লেখক ডেন  ফাল্ক তার বইয়ে দেখিয়েছেন-- শেকসপিয়র মানব প্রকৃতিকে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ঠিক যেমনভাবে রাতের আকাশকে পর্যবেক্ষণ করেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। পাশাপাশি সুক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন-- বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থ, মনোবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শেকসপিয়রের আকর্ষণ ছিল, সেই সঙ্গে ছিল যথেষ্ট জ্ঞান।

এ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে মহান এই ব্রিটিশ সাহিত্যিক শেকসপিয়রের চারশতম মৃত্যুবার্ষিকী।

আর এই আয়োজনকে কেন্দ্র করে একুশ শতকের পাঠকের কাছে শেক্সপিয়রকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে সব আয়োজনই সম্পন্ন করেছে ব্রিটিশ প্রকাশনী সংস্থা হোগার্থ প্রেস। তারা ২০১২ সালে 'হোগার্থ শেকসপিয়র' নামে একটি প্রকাশনা প্রকল্প বাস্তয়ন করছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য সেকালের শেকসপিয়রকে এ-কালের কথাসাহিত্যিকের মধ্যে পূনর্জন্ম দেওয়া।  আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের কাছে শেক্সপিয়র সম্ভবত তাঁর লেখা নাটকের জন্যই বেশী প্রিয়। সেই চারশ বছর আগেকার লেখা নাটকগুলির  আবেদন আজকের দিনেও হারায়নি মোটেও। তাঁর সেইসব নাটক অবলম্বনে সিরিজ আকারে কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশ করতে যাচ্ছে হোগার্থ-শেকসপিয়র প্রকল্প। বর্তমান আধুনিক পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই কাজটি করাছে হোগার্। সমকালীন লেখকদের মধ্যে এনি টেলর, জেনেট উইন্টারসন, মার্গারেট অ্যাটউড, হাওয়ার্ড জ্যকবসন, জো নিসবো , ফ্লিন, ট্রেসি চেয়াভিলায়ার– এদের সাথে কথা পাকাপাকি করেছে প্রকাশন সংস্থাটি । 

এই সিরিজের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসটি লিখেছেন সাহিত্যিক জেনেট উইন্টারসন। বছর দেড়েক আগে শেক্সপিয়রের নাটকগুলো থেকে যে কোনো একটিকে সাহিত্যরূপ দেবার জন্য বেছে নিতে তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল প্রকাশক হোগার্থ। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ‘দ্য উইন্টারস টেল’-এর মতো মিলনান্তক কমেডি বেছে নিলেন। তা দেখে প্রকাশক খানিকটা চিন্তিত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন তিনি আসলেই এটি করতে চান কি--না? উত্তরে উইন্টারসন মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকিয়েছিলেন।

উইন্টারসন হলেন বাছাইকৃত লেখকদের মধ্যে প্রথম যাকে হোগার্থ চুক্তিবদ্ধ করে এই রূপান্তরের কাজে। প্রথমে ভাবা হয়েছিল তিনি হয়তো ‘হেমলেট’, ‘ওথেলো’ বা ‘কিং লিয়ার’-এর মতো শেক্সপিয়ারের জনপ্রিয় কোনো নাটক বেছে নিবেন। কিন্ত তা না করে তিনি ‘দ্য উইন্টার’স টেল’-এর মতো নাটক পছন্দ করলেন। যা কিনা অনেকটা রহস্যময় ও দুর্বোধ্য।

উইন্টারসন মূল নাটকের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই লিখে ফেললেন তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘দ্য গ্যাপ অফ টাইম’ । এই আধুনিক উপন্যাসের মধ্য দিয়ে এ যুগের পাঠক শেক্সপিয়রের সে-যুগের নাটকের অনেক রহস্য ও প্রশ্নের উত্তর পাবেন। নাটকে বিদ্যমান অংকের মতোই উপন্যাসের গতি প্রবাহিত হয়েছে।
এদিকে কানাডার প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক,কবি ও সমালোচক মার্গারেট অ্যাটউড ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নির্বাচন করেছেন। তিনি বলেন, '''দ্য টেম্পেস্ট' সবসময়ই আমার প্রিয়। এটা নিয়ে কাজ করা আমার জন্য সত্যি একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ”। এখন দেখার বিষয়, জাদু আর বিভ্রমের এই খেলাকে অ্যাটউড কিভাবে উপন্যাসে রূপ দেন। বলা যায়, প্রকশানা সংস্থা হোগার্থের এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে একুশ শতকের পাঠকদের জন্য শেক্সপিয়রকে নতুন করে জানার ক্ষেত্র তৈরি হলো। 
এখানে এসে মনে পড়ে যাচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনূদিত শেক্সপিয়ারের ‘দ্য কমেডি অফ এরস’ অবলম্বনে ‘ভ্রান্তিবিলাস’ অথবা ‘ টেমিং অফ দ্য শ্রু’-এর বাংলা নাট্যরূপ মুনীর চৌধুরীর ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’-এর কথা। কিংবা স্মরণে আনা যেতে পারে , শেকসপিয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যনাট্য ‘রাজা ও রানী’ ও ‘বিসর্জন’এর কথা। এভাবে শেকসপিয়রে বাংলাসাহিত্যও হয়েছে সমৃদ্ধ। 

বলা হয়ে থাকে গণিতবিদরাই কেবল অমরত্বের কাছাকাছি যেতে পারে। কারণ গাণিতিক ভাষা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র এক। অন্যদিকে মানুষের মুখের ভাষা বদলে যায়--লুপ্ত হয়। তাই নির্দিষ্ট ভাষা নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাঁরা সম্ভবত কোনো এক সময়ে বিস্মৃত হবেন। কেউ হয়তো তাঁর জীবন কালে বিস্মৃত হন--কেউ হয়তো মৃত্যুর পরে বিস্মৃত হন। কিন্তু এক্ষেত্রে শেকসপিয়র ব্যতিক্রম। তিনি তাঁর নিজ কর্মগুণে যেভাবে পৃথিবীর সকল ভাষায় সকল প্রকার সাহিত্যকর্মে অবদান রেখেছেন তাতে শেকসপিয়রকে প্রায় অমর বলা যায় বৈকি।

তথ্যসুত্রঃ দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস, দ্য গার্ডিয়ান।


বিপাশা চক্রবর্তী
লেখক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. লেখাটির দীর্ঘদিন ধরে পাঠ করতাম, কিন্তু কয়েক মিনিটে ফুরিয়ে গেলো।

    উত্তরমুছুন