সৈয়দ শামসুল হক : গল্পের শরীরে সংলাপ



উনিশ শো উনসত্তরের দিকে সাপ্তাহিক চিত্রালী-র কোনো এক সংখ্যায় একটি ছোটগল্প লিখেছিলাম, লেখাটি এখন হারিয়ে গেছে, আর খুঁজে পাই নি; গল্পটির নাম ছিলো সে এবং এতে একটিও সংলাপ ছিলো না। তখন পর্যন্ত গল্প বা উপন্যাসে সংলাপের কখন দরকার, কেন দরকার, কোথায় দরকার-এসব নিয়ে সচেতনভাবে কিছু ভাবতাম না, লেখার সময় কলমের টানের ওপরই ভরসা রাখতাম— কলমের টানে সংলাপ এলো তো এলো, না এলো তো নেই। এমনকি ওই গল্পটি লেখার সময়েও ঠিক করে লিখতে বসি নি যে এতে একটিও সংলাপ থাকবে না।

আমার গল্পটা ছিলো এক ধনবান ব্যবসায়ীকে নিয়ে; অভিজাত একটি এলাকায় সুন্দর একটি বাড়িতে সে থাকে; তার আছে চমৎকার একজন স্ত্রী আর দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে এমন একটি ছেলে। সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক কোনো একটি অসুখে সাময়িকভাবে পঙ্গু হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে; শুয়ে শুয়ে সে তার চারদিকে সংসারের স্রোত বয়ে যেতে দেখে; এবং একদিন লক্ষ করে সে নিজেই কখন একটি আসবাৰে পরিণত হয়ে গেছে; বাড়িতে সে আছে কি নেই এটা আর কারো কাছেই কোনো সংবাদ নয়। একদিন সে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে, এলাকা ছেড়ে, তার পরিচিত সমস্ত কিছু ছেড়ে যখন চলে যায়, তখনো কেউ তার অনুপস্থিতি অনুভব করতে পারে না। এই ছিলো গল্পের কথা। আমি শুরু করেছিলাম প্রধান চরিত্রটি যখন শয্যাগত তখন থেকে; গল্পটিকে দেখেছিলাম তার চোখ থেকে: আমার এমন একটা ইচ্ছে ছিলো পাঠক ও প্রধান চরিত্রের ভেতরে কোনো দূরত্ব থাকবে না; যেহেতু চরিত্রটি নীরবে সমস্ত কিছু দেখে যাচ্ছে, তাই কলমের টানে আর সংলাপ আসে নি; সমস্ত কিছু ঘটে গেছে অখণ্ড নীরবতার ভেতর দিয়ে, স্তবকের পর স্তবকে কেবলি বর্ণনায়।

গল্পটি ছাপা হয়ে যাবার কয়েক সপ্তাহ পর হঠাৎ আবিষ্কার করি যে, এই আমার প্রথম একটি গল্প যাতে কোনো সংলাপ নেই। এবং সেই মুহূর্ত থেকেই, এখনো মনে করতে পারি, আমি প্রথম সচেতন হই গল্প বা উপন্যাসে সংলাপের ব্যবহার সম্পর্কে। তখন আমি নিজের পুরনো কিছু লেখা তো বটেই, যাদের শ্রদ্ধা করি তাদেরও কিছু লেখা আবার দ্রুত পড়ে ফেলি- সংলাপ ব্যবহারের প্রয়োজন ও কৌশল বুঝে দেখবার জন্যে। হতাশার সঙ্গে আবিষ্কার করি, আমার অধিকাংশ পুরনো লেখাতেই আমি বড় অবহেলার সঙ্গে, অমনোযোগীভাবে সংলাপের মতো গল্প বলার প্রধান একটি হাতিয়ারকে ব্যবহার করেছি। বিশ্বয়ের সঙ্গে আবিষ্কার করি, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা উপন্যাসের সেই সংলাপ- পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ - সাধুভাষার দূরত্ব সত্ত্বেও কেন আমাদের কানে সদ্য শোনা জীবন্ত উচ্চারণের মতো অবিরাম ধ্বনিত হতে থাকে; আর কেনইবা রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ গল্পে মেহের পাগলার তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, সব কুট হ্যায়, সব কুট হ্যায় এই দুর্বোধ্য এবং বিশাল এবং প্রতিরোধহীন জীবনের প্রতি ছুড়ে দেয়া একটি ব্যর্থ কিন্তু রক্তাক্ত মন্তব্যের মতো আমাদের কাছে মনে হয়।
অনিবাৰ্যভাবে গল্প-উপন্যাসে সংলাপের ব্যবহার তখন আমার মনোযোগ দখল করে বসে। আমার মনে পড়ে, আবছা মনে পড়ছে, কার যেন গল্পে চরিত্রের মুখে একটি সংলাপের পাশে ব্র্যাকেটে আর একটি করে সংলাপ লেখা ছিলো। লেখকের অভিপ্রায় ছিলো, চরিত্রটির যে সংলাপ ব্র্যাকেটের বাইরে তা উচ্চারিত, আর ব্র্যাকেটের ভেতরে যে সংলাপ তা সেই মুহুর্তে তার মনের অনুচ্চারিত কথা। বানানো উদাহরণ এইরকম দেয়া যেতে পারে-ধরা যাক-আমি চাইছি সে চলে যাক কিন্তু সামাজিকতার খাতিরে তাকে বসতে বলছি- কী খবর কতদিন পরে দেখা। (কেন এসেছ ? আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না।) লোকটি হয়তো এসেছে আমাকে ধার পরিশোধের তাগাদা দিতে, তাই বলছে— সামাজিকতায় সেও কম যায় না"এই এলাম, অনেকদিন তো দেখা হয় না। (আমার টাকাটা এখনো ফেরত পাইনি)

আমার মনে পড়ে যায়, ওই গল্পটি পড়বার পর আমি কিছুদিন একটি বীজ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছিলাম। ভেবেছিলাম এমন একটি গল্প লেখা কি সম্ভব নয় যার বেশির ভাগ জুড়ে থাকবে সংলাপ – আর সেই সংলাপও সরল হবে না; প্রতিটি সংলাপের ব্র্যাকেটে থাকবে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বক্তব্যের সংলাপ। এমনও তখন ভেবেছিলাম, একটি গল্প হয়তো এভাবে লেখা সম্ভব- ব্র্যাকেটের বাইরে অর্থাৎ উচ্চারিত সংলাপগুলো পড়ে একটি গল্প জানতে পারবো, আর শুধু ব্র্যাকেটের ভেতরে অর্থাৎ অনুচ্চারিত সংলাপগুলো পড়ে গেলে ভিন্ন একটি গল্প পাবো!— এবং এখানেই শেষ নয়; ব্র্যাকেটের ভেতর-বাইরে দুই ভিন্ন সংলাপ একই সঙ্গে পড়ে পড়ে গেলে পাবো তৃতীয় একটি গল্প। 

এ ধরনের গল্প লেখা সম্ভব কিনা জানি না, এটুকু জানি মানুষ যা কল্পনা করে তার বাস্তব রূপ অবশ্যই সম্ভব- বর্তমানে না হোক ভবিষ্যতে কখনো; এবং এরকম একটি গল্প লিখে ফেলতে পারলে আর কিছু না হোক সংলাপের মতো জরুরি একটি বিষয়ে আমার ধারণা আরো আগেই স্পষ্ট হয়ে যেতে পারতো। বলাবাহুল্য, আমার অনেক ইচ্ছার মতোই এই বিশেষ গল্পটি লিখে ফেলার ইচ্ছাও বহু কাপ কফির তলায় আশাহীনভাবে একসময় ডুবে যায়। 

আবার একবার ভেবেছিলাম, এমন একটি গল্প লিখবো যেখানে কোন সংলাপ কে বলছে সেটা জানা জরুরি নয়, সংলাপের বক্তব্যটুকুই গল্পের জন্যে আসল, অতএব সংলাপের আগে-পরে বক্তার কোনো নির্দেশ থাকবে না। এই পরীক্ষাটি বাস্তবেই করেছিলাম জেসমিন রোড নামে আমার এক উপন্যাসে। সিকান্দার আবু জাফর তখন বেঁচে ছিলেন, তার কাছে পরীক্ষাটির কথা বলবার পর তিনি সমকালএ প্রকাশের জন্যে আমন্ত্রণ জানান; এবং পরের মাস থেকেই ওই মাসিকপত্রে জেসমিন রোড প্রকাশিত হতে থাকে; কিন্তু মাত্র দুই কি তিন সংখ্যা লেখার পর অনুভব করি সংলাপ নিয়ে এভাবে এগিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। লেখা বন্ধ করে দিই; জাফরভাইয়ের বহু অনুরোধ সত্বেও যখন আর পরের কিস্তি দাখিল করি না, তখন সমকাল-এর পাতায় লেখক হিসেবে আমার মৃত্যুর যে ঘোষণা তিনি কালো বর্ডার দিয়ে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, তা পুরনো পাঠক এখনো কারো কারো হয়তো মনে আছে। 

বছর দশেক পরে সেই জেসমিন রোড আবার আমি নতুন করে লিখতে বসি দুঃসহবাসনামে। এবার সংলাপ নিয়ে ওই পরীক্ষাটি আর করি না। সংলাপ কে বলছে কে বলছে না বলছে তার পতাকা বিশ্বস্তভাবেই পুঁতে দিয়ে যাই দুঃসহবাস-এ। তবে, এখনো আমার ইচ্ছে আছে, ভবিষ্যতে অন্তত একটি গল্প লিখবো যেখানে সংলাপ কে বলছে তার কোনো নির্দেশ থাকবে না। আমার মনে হয়, এখনকার বাংলাদেশে অভিজ্ঞতার এমন একটা পর্যায়ে আমরা আছি যখন বক্তার চেয়ে বক্তব্যই একজন ঔপন্যাসিকের কাছে বেশি ব্যবহারযোগ্য মনে হতে পারে; কারণ, আমরা কি দেখি নি, আমরা কি দেখছি না- আমাদের মাথার ওপরে এবং আমাদের চোখের সমান্তরালে এমন মানুষের সংখ্যাই বাড়ছে যারা নিতান্তই সংখ্যাবাচক; নাম ভিন্ন হলেও উক্তি, পোশাক এবং কৌশল তাদের অবিকল এক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. পরীক্ষাধর্মী এই style টা ভাল লাগল। কিন্তু এরকম লেখা পড়তে গেলে পাঠকের মাথা বেশি পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে। আর তাতে করে পড়ার গতি হারাতে পারে। ব্রাকেট এর ভেতর এক বাইরে আরেক সংলাপ এর কথা বললাম।

    উত্তরমুছুন
  2. পরীক্ষাধর্মী এই style টা ভাল লাগল। কিন্তু এরকম লেখা পড়তে গেলে পাঠকের মাথা বেশি পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে। আর তাতে করে পড়ার গতি হারাতে পারে। ব্রাকেট এর ভেতর এক বাইরে আরেক সংলাপ এর কথা বললাম।

    উত্তরমুছুন