দোসরা শ্রাবণের এই সকালে আজ, পরমহংস তার বিকেলটাকে হালকা করে নিতে চায়। বিনয় বেলা দুটো নাগাদ অফিসে ফটোগুলো পৌঁছে দেবে কথা ছিল, নিউজ-এডিটর ছবি বেছে নেবেন। কিন্তু বিনয় দুটোর বদলে পাঁচটা করে ফেলতে পারে। পাঁচটায় নিউজ-এডিটর ব্যস্ত থাকতে পারেন, থাকেনও। তা হলে, পাঁচটা থেকে সাতটা, সাতটা থেকে আটটা হয়ে যাবে। আটটায় গল্ফ লিঙ্কে যাওয়া যায় না, পৌঁছুতেই পৌনে নটা তার পর সল্ট লেকে ফেরা--। দেড়-দু বছর পর রাত নটায় এমন অঘোষিত পৌঁছানো যায় না—অনুর জন্মদিন হলেও না।
পরমহংস এত নিশ্চিতই বা বোধ করে কী করে যে অনু নিজে তার জন্মদিন মনে রেখেছে, বা মনে রাখতে চায়? এমনও ত হতে পারে, পরমহংস দোসরা শ্রাবণের লক্ষে পৌঁছুল কিন্তু অনুকে জানাতে পারল না যে আজ অনুর জন্মদিন।
বিনয় চার পাশে ছিটানো ফটোর মধ্যে বসে ছিল। সামনে বোর্ডে ক্লিপে এঁটে একটা ফটোতে রঙ দিচ্ছিল। পরমহংসের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল বাড়ির বাচ্চা চাকরটি। তখন বিনয় তাকে ঢুকতে দেখেছে কী না পরমহংস জানে না। কারণ, সে যতক্ষণ বিনয়ের পাশে এসে বসে আছে, ততক্ষণের মধ্যে বিনয় এক-বারও চোখ তোলে নি। খুব মন দিয়ে ফটোটার ওপর কাজ করছে বলেও মনে হয় না। তেমন মন দিতে ও হুমড়ি খায়। বরং যেন মনে হয়, ফটোটা নষ্ট করছে, আঁকিবুঁকি কেটে। পরমহংস একবার ভাবে, উঁকি দিয়ে ফটোটা দেখে। বদলে, মেঝেয় পড়ে থাকা গোটাকয়েক ফটো একসঙ্গে তুলে নেয়। দোমড়ানো-মোচড়ানো ফটো। দেখে মনে হতে পারে ফেলে দেয়া। খবরের কাগজের কাছে কোনো ফটোই ফালতু নয়, কোনদিন যে কোনটা কাজে লাগছে। বিনয়ের এই এত ফেলে দেওয়া ছড়িয়ে ফেলার মধ্যেও ওর হিসেব আছে।
কিন্তু এগুলো ত সব প্রিন্ট। নেগেটিভ সব যত্ন করে তোলা থাকে। চাইলেই প্রিন্ট হয়ে যাবে। আর, কাগজের দরকার মত প্রিন্ট দিতে না পারলে ফ্রি লান্সিং-এর বারটা বেজে যাবে।
পরমহংস বাঁ হাত দিয়ে একটা ছবি তুলেছিল। বড় প্রিন্ট। তাই তোলার পরও দোমড়ানোই থাকল। সেটাকে খুলতে দু হাত লাগাতে হয়। কে যেন কিসের ফিতে কাটছে। অনেকগুলো লোকের মুখ। মাঝখানে বেঁটে লোকটার হাতে কাঁচি, মুখে হাসি। ফটোটা উলটে দেখল—কিছু লেখা নেই। ফেলে দিতে-দিতে পরমহংস ভাবল, কাঁচিকাটা হয়ে গেলেই ত হয়ে গেল, এ-ছবি আবার কোন কাজে লাগবে। ভেবেই হাসল, ‘স্টেটসম্যান’ কিছুদিন আগে এ-রকমের বাতিল ছবি ছাপিয়ে হৈ হৈ বাধিয়ে দিয়েছিল। ক-বছর আগে মিসেস গান্ধী কী-একটা উদ্বোধন করেছেন, ফিতে কাটা হয়েছে, মার্বেল প্লাক বসানো হয়েছে—তার পর কোনো কিছুর পাত্তা নেই। এক রিপোর্টের ঠেলায় শেষে সেখানকার পি.আর.ও. বিবৃতি দিল যে মার্বেল প্লাক তাঁরাই সরিয়ে রেখেছেন, ঠিক জায়গায় লাগানো হবে বলে। খবরের কাগজ যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে—এতদিনে সত্যিকারের ফোর্থ এস্টেট? নিউজ-এডিটর তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘আর ইউ ইনটারেস্টেড ইন ডেথ? কী মশাই, করবেন নাকি, ডেথ?’ পরমহংস ভাবল, কেউ বুঝি মারা গেছে—অবিট করতে বলছেন। কিছু না বলে হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে থাকল। নিউজ-এডিটর হাসিটা বন্ধ না করে বলে গেলেন, আর ওঁর ভঙ্গিগুলো এতদিনের চেনা বলেই পরমহংস বুঝতে পারে এবার কথাটা উনি, যাকে বলে সিরিয়াসলি, বলছেন। এটা কি এক পরমহংসই বোঝে, না সবাই বোঝে কোথায় কখন ওঁর বদলটা ঘটে যায়। একই হাসি অথচ আসল কথা বলার সময় হাসিটার কোনো মানে থাকে না, হাসি থাকা সত্বেও গম্ভীর দেখায়। পরমহংসের কখনো মনে হয়, ওঁর গলার স্বরটা বদলে যায়। কখনো মনে হয়, ওঁর চোখটা বদলে যায়। বা, এত ভাবার কী আছে। একসঙ্গে এতদিন কাজ করতে-করতে পরস্পরের কাজের ধরন ত জানা হয়ে যাওয়ারই কথা। পরমহংস লম্বা, চওড়া, সমান সমান, বাঁকা, নানা সাইজের ফটো মেঝে থেকে তুলেছিল আর সেগুলো তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তুলে, তাকাচ্ছিল একবার নিশ্চয়ই কিন্তু দেখছিল না। বা, হয়ত দেখছিলও। কিন্তু সেই পক্রিয়ায়, মাত্র দু-এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও, সে বিনয়কে ভুলে গিয়েছিল। যেন এটা তার নিউজ-এডিটরের টেবিল। টেবিলের ওপর ছড়ানো ছবির পর ছবি। ছবিগুলো থেকেই যায়, পরমহংস অপরিবর্তিত আসনে ছবি তোলে ও ফেলে।, যেন, এই মাত্র সে বিনয় আর তার নিউজ-এডিটরের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছিল সেটা আর কোথাও কেউ টেরই পেল না।
তাকাতেই হাতে উঠে আসা ছবিটা এত চেনা ঠেকে যে পরমহংস না-দেখে ফেলতে পারে না। খরা তুলছিল তখন বিনয় পুরুলিয়ায়, কোথা দিয়ে যেতে যেতে দেখা পালকি নামিয়ে এরা বিশ্রাম করছে, বিয়ে করে ফিরছে, বিনয় ছবি তুলতে গেলে মেয়েটি তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে হাসি চাপা দেয়, বরটাও হাসছে, ‘মেয়েটার জামার সেফটিপিন পর্যন্ত উঠেছে’-বিনয় ছবিটা বুঝিয়েছিল, অনেকগুলো প্রাইজ পেয়েছে, উইলসের ‘মেড ফর ইচ আদার’-ও, শেষে জার্মানিতে, যে-অ্যালবামে ছবিটা ছাপা হয়েছিল তাতে অনেক নগ্ন ছবি ছিল, জার্মান ভাষায় বিনয়ও বুঝতে পারে নি, পরমহংসও বুঝতে পারে নি অত নগ্নিকার সঙ্গে এই মেয়েটির সম্পর্ক কী হতে পারে।
পরমহংসের হাত থেকে ছবিটা পড়ে গেল। সে আর-কোনো ছবি না তুলে শুধু তাকিয়ে থাকল। কত মন্ত্রীর মাথা গড়াগড়ি খাচ্ছে, দেশ-বিদেশের এমন অনেক লোকও যাঁরা মন্ত্রী নন, ভঙ্গি খুব না বদলে পরমহংস উলটো দিকের দেয়ালে তাকায়, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর একটা বিশাল ছবি, পাশে জ্যোতি বসু, ফিদেল ঘাড় ঘুরিয়ে একগাল হাসছেন। চোখ দুটো চকচক করছে, বিনয় সারা ঘরে এই একটি ছবিই, অন্তত চার ফুট লম্বা করে, টাঙ্গিয়ে রেখেছে, অনেকে কিনতে চেয়েছিল, গবর্নমেন্টও, হঠাৎ খেপে গিয়েছিল বিনয়, আমার ছবি আমি বেচব না, কার বাপের কী, জ্যোতিবাবু চেয়েছিলেন, এক কপি দিয়ে এসেছিল, পরমহংস আবার মেঝময় মানুষের হাসি, মাথা, হাত, নদী, নালা, পাহাড়-পর্বত, প্লেন, ট্রেন, মোটরগাড়ি, ক্বচিৎ কখনো নিসর্গ—যা আসলে খরা বা বন্যার দুর্বিপাকে, দেখে যায়। আর ইউ ইনটারেস্টেড ইন ডেথ? এত ছবির মধ্যে কি পরমহংসের দরকারি ক-টি মড়ার ছবি পাওয়া যাবে না? তা হলে আর বিকেলে বিনয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হত না। ক্যাপশানের গুণে ত জ্যান্তকেও ‘মড়া’ করে দেয়া যায়। ক্যাপশান না-হয় ভাবা যাবে, আপাতত ছবিটা পেলেই হয়। যেন তার ছবিটা খুঁজতেই পুরো মেঝেটা চোখ দিয়ে চষে ও বোঝে—ওখানে ছবিগুলো যেভাবে ছড়ানো তাতে বাঁচা-মরার ভিতর তফাৎ করা যাবে না, যায় না। তার ‘মড়া’র খোঁজে পরমহংস এক কোনায় কয়েকটি মেয়ের আভাস পায়। সেই ছবিগুলো দেখতে, তাকে উঠতে হয় ও কতগুলো বছর ও দেশ ও দ্রুত উন্নতি ও সরকার ও বিদ্রোহ ও দুর্বিপাক ও জন্ম ও মৃত্যু ও অপসারণ ও...মাত্র দুটি পদক্ষেপে মাড়িয়ে সেই ছবির কাছে গিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে খুঁজতে হয়—দুই হাত দুই পা ওপরে তোলা এক লাস্যময়ী লম্ফন, হাত-পা মুখচোখহীন কোনো হাসি, শুধু হাসি, এত ঘন বড় ঠোঁট বা দাঁত ক্যামেরার ওপাশে থাকে না, চোখ—দীর্ঘতম পল্লবময়, যেন পল্লবই চোখ, শুধু আঙুল—বাহুহীন আঙুল, শুধু নখ-আঙুলহীন নখ, শুধু চুল-মাথাহীন মাথার ভিতরে কম্পিউটার বসানো...। পরমহংসকে একটা ক্যাপশান ভাবতে ভাবতে ফিরে আসতে হয়—‘দি কর্পস—ডিজমেমবার্ড।’ কিন্তু বিজ্ঞাপনের এ-ছবিগুলো দিয়ে তার হবে না, সুতরাং বসতে বসতে সে ক্যাপশানটা আবার ভুলে যেতে পারে।
বিনয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সে আসলে একটা ছবি নষ্টই করেছে। ছবির চোখ দুটোর ভিতর দুটো উদ্ভট গাছ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। একটাতে পুরোপুরি ঢোকানো হয়ে গেছে, আর-একটাতে আধাআধি, এখনো পাতগুলো সব গজায় নি, বা, আধাআধি পাতা সব ঝরে গেছে।
পরমহংস এতক্ষণে বোঝে যে, বিনয় তার সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। বিনয় কাজে ব্যস্ত থাকলে এমন কিছুক্ষণ যেতে পারে। কিন্তু এতক্ষণে যেন বিনয়ের কিছু বলা উচিত ছিল। সে কোনো অসুবিধে করল না ত বিনয়ের, এমন না-বলে এসে। পরমহংস তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। এটা ভাবতে-ভাবতেই ওঠে যে এমন আচমকা ওঠা ঠিক নয়, কথাটা বলেই ওঠা যায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে কথাটি ভেবে নেয়, দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘আসছ ত আপিসে দুটোয়? চলি—’
‘আরে দাঁড়াও, চা খেলে না’
‘এখন খাব না’, এতে বিনয় ভাবতে পারে রাগ করেছি—তাই পরমহংস তাড়াতাড়ি যোগ করে, ‘তোমাকে মনে করিয়ে দেব বলে এক মিনিটের জন্যে এসে এত ফটো দেখে আটকে গেলাম—‘
‘এই, এক কাপ চা খেয়ে যাও, তোমার ছবি দেখে যাও’
পরমহংস বোঝে, বিনয় তাকে আটকাতে চায়। সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে-যেতে বলে, ‘ঠিক দুটোয় অফিসে যেও, দেখব।’ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বিনয়কে দেখতে যায়, বিনয় ওঠে নি, বসেই ছিল।
রাস্তায় নেমে পরমহংস প্রথমে ভাবে—ম্যানেজ করতে পেরেছে যা-হোক, বিনয় নিশ্চয়ই টের পায় নি যে সে রাগ করেই উঠে পড়েছিল। ঠিক রাগ করে নয়, অভিমান করে। ঠিক অভিমান করেও নয়, ভয়ে। ভয়?
কাকে নিয়ে? নিজেকে নিয়ে? ‘আনসিওর অফ হিমসেলফ’—তাদের কাগজে একটা দারুণ এডিট বেরিয়েছিল, হরিয়ানার রাজ্যপাল তাপাসিয়া দেবীলালকে কথা দিয়ে ভজললালকে ডেকেছিল, ক্যাপশানটি পরমহংস গোপনে নিজের পেছনে লাগাল—অনুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর থেকে এটা হয়েছে—কোথাও সে তার জায়গা বা অধিকার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না। একবার ভেবেছিল, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবে। নিজেই যখন বুঝতে পারছে, নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে, ভেবে, আর দেখায় নি। তার পর, নিজেই সে টের পেয়েছে, নিজেরই ভিতর তৈরি করে তুলতে পেরেছে এক প্রতিরক্ষা। যখনই তার কোথাও অনিশ্চিত ঠেকে, সে সরে আসতে পারে প্রায় কোনো নাটক না করেই। পরমহংস একটু আত্মপ্রশংসায় করুণ হয়--কথা বলাটাই ত আমার কা-ল, এতদিন কথা দিয়েই নিজেকে জাহির করেছি, এখন কথা দিয়েই নিজেকে লুকোই। সেই একই কথা বলে যাই, অথচ কেউ বুঝতে পারে না কথার উদ্দেশ্য পালটে গেছে।
সে পালটাক । বিনয়ের কাছ থেকে চলে আসার আগে ওটুকু জেনে আসা হল না, ছবিগুলো হয়েছে কিনা। ছবির ব্যাপারে বিনয় শেষ মুহুর্তেও কিছু বলে নি । এমনকি দুটোর সময় তাদের অফিসে আসবে কি-না, সে কথাতেও ত হ্যাঁ বলল না। পরমহংসকে একটু ভাবতে হয়, আসলে ত আমি বিনয়কে সে-সময়টুকুই দিলাম না, নিজে তখন পালিয়ে আসতে পারলে বাঁচি। পালিয়ে আসারই-বা কী ছিল ? আমি ত বিনয়ের কাছে কাজেই গিয়েছি, তারই কাজে। আমারই উচিত ছিল প্রথমেই গিয়ে ছবির কথা জিগগেস করা। বিনয়ের কোনো দোষ নেই। ও আমার ভাবসাব দেখে ভেবেছে আমি কিছুক্ষণ বসব।
তা হলে কি আজও অনুর কাছে খাওয়া হবে না, আজ দোসরা শ্রাবণ ?
কোনো-এক অতীতে অনুর কাছে যাবার ইচ্ছেটা পরমহংসকে দমন করতে হয়েছিল এই ভেবে যে দোসরা শ্রাবণ যাবে। দোসরা অনুর জন্মদিন ।
কতদিন আগে এটা ঘটেছিল তার কোনো হিশেব নেই। যে-সব অনুষঙ্গ দিয়ে-দিয়ে মনের হিশেব রাখা যায়, তেমন কোনো অনুষঙ্গও নেই। দেড়-দু বছরের মধ্যে সে অনুকে দেখে নি। বাবির একটা চিঠি পেয়েছিল-পরীক্ষায় পাশের খবর দিয়ে। অনেকবার পড়ে পরমহংস বুঝে গিয়েছিল, কী ভাবে বাবার সঙ্গে কথা বলবে, তার মেয়ে সেটা ঠিক করে উঠতে পারছে না। দু-একবার ভেবেছে, বোধ হয়, চিঠি বলেই এমন । কিন্তু পরে, ভেবে-ভেবে নিজেই এই যুক্তি বের করেছে-বাৰি তাকে দেখল ক-দিন, এর পর প্রতিদিনই ত ওর বড় হয়ে ওঠা, সেই দিনগুলোর কোথাও ত পরমহংস নেই, শুধু স্মৃতি নিয়ে বাবি থাকবে কী করে, এটুকু জীবনে আর কত বড় স্মৃতিই-বা হতে পারে বাবির। সেই চিঠিটির কোনো উত্তর পরমহংস দেয় নি।
কিন্তু কোনো একদিন নিজের ভিতরেই টের পেয়ে থাকবে এক অদম্য ইচ্ছা--অনুকে শুধু একবার দেখে আসার অদম্য ইচ্ছা। সেই ইচ্ছাটা যে একবারে হঠাৎ অদম্য হয়ে উঠেছে, তা নয়। তেমন যাতে না হয়ে ওঠে, তার জন্যে পরমহংস নিজেই নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে। কখনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অঙ্কে-অঙ্কে তুচ্ছ করে দিতে চেয়েছে এই ইচ্ছেটাকে। কখনো নিজেকে ঠাট্টাবিদ্রুপ করে করে উড়িয়ে দিতেও চেয়েছে। তবু টের পেয়েছে, ভিতরে-ভিতরে অদম্য হয়ে উঠছে অনুর কাছে চলে যাবার টান। যে স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে ভেঙে গেছে, তার প্রতি এই টান বোধ করার কোনো আইনি অধিকারও নেই, সামাজিক অধিকারও নেই ; অথচ সেই আইন ও সমাজের কোনো কেয়ার না রেখেই পরমহংসের ইচ্ছেটা এমন অদম্য হয়ে উঠেছিল, বোধ হয়, অধিকার নেই বলেই অদম্য হয়ে উঠেছিল। আর যাওয়াটা যখন এতই সহজ । প্রতিদিনই গলফ লিঙ্কের মিনিবাসের সারি ডিঙিয়ে উল্টো দিকে গিয়ে তাকে সন্ট লেকের বাস ধরতে হয়। যেকোনো দিন উঠে বসলেই ত হয়। তার পর বড় জোর আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু ইচ্ছের এই অদম্যতা সত্ত্বেও, পথ থেকে গলফ লিঙ্কের মিনিবাসের ফুটবোর্ডের দূরত্ব অনতিক্রম্য থেকে গেছে। কোনো উপলক্ষ নেই পরমহংসের, অনুর দরজায় গিয়ে টোকা দেবার কোনো উপলক্ষ নেই। দরজাটা খুলে যাবে , তার পর, কী বলবে সে। হয়ত না বললেও চলবে। বাবি আছে; এটা ত জানা কথাই-বাবিকে দেখতে সে মাঝে-মাঝে যাবে । কিন্তু যায় নি ত। এখন, যখন অনুকে দেখতেই সে যেতে চায়, তখন মেয়েকে তার উপলক্ষ করে কী ভাবে ? আর, অনুর কাছে উপলক্ষহীন কোনো যাওয়া ত তার থাকতে পারে না ।
সেই উপলক্ষের সূত্রেই পরমহংসের মনে পড়েছিল, দোসরা শ্রাবণ। বাংলা তারিখ, মাস, কিছুই তার জানা ছিল না, কিন্তু অনুর জন্মদিনটা যেন তার যাওয়ার উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। দোসরা শ্রাবণ কতদিন পর সে হিশেবটাও তার কাছে স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু ঐ একটি তারিখ ভেবে যেন নিজেকে সামলাতে পেরেছিল তখনকার মত ।
তখনকার মত সামলানো হয়ত গেল, কিন্তু সেই সুযোগে ইচ্ছেটা ভিতরে ভিতরে চারিয়ে গেল অনেকখানি, বা, দিনে-দিনেই চারিয়ে গেল ভিতর থেকে আরো ভিতরে, এমনই যে দোসরা শ্রাবণ হয়ে ওঠে পরমহংসের কাছে এক লক্ষ, উপলক্ষহীন এক লক্ষ, দোসরা শ্রাবণ পর্যন্ত সেই লক্ষটিকেই সে লালন করে এসেছে, সেই লক্ষের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছে। কলকাতার রাস্তা থেকে গলফ লিঙ্কের মিনিবাসের ফুটবোর্ডের অনতিক্রম দূরত্ব পরমহংস যেন সময়ের এই দীর্ঘতা দিয়ে এই কয়েক যুগ জুড়ছিল।
এখন, তা হলে, খুব তাড়াতাড়ি, পরমহংসকে মনটা একটু গুছিয়ে ফেলতে হবে অনুর কাছে আজও যাওয়া হবে না বলে ?
যাওয়া হবে না--এটা এতটাই ধরে নেয় কী করে পরমহংস, নাকি ধরে নিতে চায় বলেই ধরে নিতে পারছে? এই সুয়োগে আজ দোসরা শ্রাবণ যদি পার হয়ে যায়, তা হলে তাকে আর-কোনো আশ্বিন, বা অগ্রহায়ণ, মাঘ, বা চৈত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে? অনুর সাথে দেখা করতে চায় না পরমহংস? সে শুধু দেখা করার ইচ্ছেটাকে লালন করতে চায় ? পরমহংস কি নিজেকে শুধু এইটুকু এক বিশ্বাসে বাঁধতে চায় যে এই কলকাতা শহরেরই এক জায়গায় অনু থাকে, একটা বাসে আধঘণ্টা-পয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়ালে বা বসলেই সে পৌঁছে যেতে পারে অনুর সেই বাড়িতে, তারপর দুটি-একটি টোকার পরই দরজার কপাট উপে যায়, কপাটের ফ্রেম জুড়ে জেগে ওঠে অনু, সে কপাটে আলো এসে পড়ে কোন পথে।
পরমহংস তার লায়েক অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারে--এক নিষ্পত্তিহীন যৌন তাকে প্রবল টানছে। তার কোনো তৃপ্তি অন্যত্র নেই, এমন-কি অনুতেও নেই। এখন, এই সকাল দশটা, সাড়ে দশটায় তার জানালা দিয়ে দেখা পাশের বাড়ীর দেয়ালে-জানলায় নিমগাছের ছায়ার দোলার সঙ্গে সে-যৌন মিশে যায়, খাচ্ছে, এমন-কি, সবুজ জানলায় ঐ নিমগাছের পাতার ছায়াটাকেও সবুজ মনে হওয়ার বিভ্রমসহই মিশে যাচ্ছে, মানিক তলার মোড়ে হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি আসায় সার্কুলার রোডের আকস্মিক জনহীনতায় এমনই মিশে গিয়েছিল, শেয়ালদা ফ্লাইওভারের রাজা বাজারের দিকে নেমে যাওয়ার অস্পষ্ট বাঁকের স্পষ্ট ঢালে দোতলা বাসের জানলা থেকে অনুকে মনে পড়ে গেল, এয়ারপোটের ভি. আই. পি. লাউঞ্জে মন্ত্রীর জন্যে অপেক্ষমাণ রাত এগারটায় রানওয়ের প্রান্তর থেকে জেটের স্থাপত্যময় আশরীর প্রবল বীর উত্থান জুড়ে জেগে উঠছিল অনুর শরীর, দুর্গাপুর ব্রিজের মাঝখান থেকে দেখা পশ্চিমমুখো রেললাইনগুলোর ধাবমান প্রান্তরে বয়ে যায় অনুর শরীরের শানিত ইস্পাত। এই শহর কলকাতার, অনুপ্রাসহীন সীমান্তহীন কলকাতার নাগরিক বিস্তার জুড়ে অনুর শরীর নিয়ত অম্বিত হয়ে থাকে পরমহংসের কাছে যৌনের আসঙ্গে। আকাশ-বাতাসের রোদজলের প্রকৃতিতে নয়, অনুর অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে পরমহংসের কাজকর্মের চলাফেরার প্রতিদিনের কলকাতায় । সব চেয়ে বেশি মনে পড়ে বাসের সব চেয়ে বেশি ভিড়ে। নিস্পিষ্ট, সেই প্রায় জলে ডুবে যাওয়ায় আর্তিতে যেন অনু হাতের সীমার মধ্যে এসে যায়, যখন, তার হাত ওঠানোর সামান্য অবকাশও আর নেই। অথচ অনুর এত চেনা শরীর, প্রায় প্রতিটি রোমকৃপে চেনা শরীর, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্মৃতি নিয়ে আসে না, আসে এক সমগ্রতায় – যেখানে কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, যেখানে কোনো কিছুই খণ্ডিত নয়, যেখানে সব কিছুই সব কিছুর উপমা।
পরমহংস যেন মনে মনে এতক্ষণে নিজেকে গুছিয়ে ফেলতে পারে, আজ দোসরা শ্রাবণেও তাকে অনুর কাছে যেতে হবে না, তা হলে সে আর-এক দোসরা শ্রাবণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে। অথচ, পরমহংস জানে, সমস্ত ঘটনাটিই ত উলটে যেতে পারে--অফিসে গিয়ে হয়ত দেখবে বিনয় ছবি দিয়ে গেছে , নিউজএডিটর হয়ত বলবেন--ছবি আমি বেছে নেব, আপনি যান ; হয়ত আজ তার হাতে কোনো কাজই আর থাকবে না। তবু অনুর কাছে যাতে না যেতে হয় তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিচ্ছে পরমহংস।
বেলা বারটা নাগাদ বিনয় আসে।
‘তখন, এমন হঠাৎ চলে এলে, তোমাদের ছবির কথা জিজ্ঞেস করব, ভুলেই গেলাম।’
'বোলো। ছবি ত দিয়েই আসবে, আবার কী’
‘কী ছবি দেব'
'বাঃ, তোমার ত আজ বেলা দুটোর সময় দেয়ার কথা, কাল থেকে ত স্টোরি বেরুবে '
‘কী কী ছবি, তা-ও ত ভুলে গেছি, হাওড়া ব্রিজের ফুটোর অনেকগুলো ছবি ত তোমাদের দিয়ে এলাম’
'বোসো-না। শুধু হাওড়া ব্রিজের ফুটো দিয়ে কী হবে?’
‘তোমাদের নিউজ-এডিটর ত তাই বললেন’
‘কবে’
‘ঐ-যে, দিল্লি থেকে টিপ করল আর এখানে হাওড়া ব্রিজে এসে গুলি পিল হল--নো ঠকঠকাস', বিনয়ের কথায় পরমহংস হেসে ফেলল, পরমহংসের হাসিতে বিনয় সিগারেটের প্যাকেট বের করে বসে পড়ল, ‘তোমাদের থিমটা কী বলো ত, হাওড়া ব্রিজের ফুটো দিয়ে কালকের দিনটা ম্যানেজ দিয়ে দাও’
'সে কী করে হবে, কাল ত যাচ্ছে অন্য স্টোরি, তবে কালীদাকে বলে গিয়ে, তোমার জন্যে যদি ঘেসকে ব্রিজ করে দেন'
‘মানে আজ ঘেসের ছবি তুলতে হবে ?’
‘তাই ত কথা'
"তোমাদের ত হাইড্রান্টের ঢাকনা, হাওড়া ব্রিজের ফুটো এই-সব দরকার ছিল বলেছিলেন – “ডেথট্রাপস-"। পরমহংস হেসে ফেলে, ‘তুমি ভুলে গেছ, “ইজি ডেথস”।
‘বাবা তোমাদের নামের কথা ছাড় ত, আমি অশিক্ষিত মানুষ, শাটার টিপে পেট চালাই, এ-কাগজে যেটা বেচি কংগ্রেস-ই র্যালি বলে, অন্য কাগজে সেটাই বেচি সি-পি-এম র্যালি বলে’
‘নিশান?’
"একটা ফ্রন্ট শট, আর-একটা পেছন থেকে – যে রেট বেশি দেবে তাকে ঝাণ্ডা দেব, পয়সা কম হলে আর্ট দেব-পেছন থেকে মানুষের মাথা, হাত ঝাণ্ডার আর ফেস্টুনের ডাণ্ডায় ব্যস, তবে বেশিদিন করে খেতে হবে না'
‘কেন’
‘এরপর ত রঙিন ছবি ছাপতে শুরু করবে, তখন ত মাল ক্যাচ’
'আমাদের কাগজ বুঝি তোমাকে পয়সা কম দেয় তাই হাওড়া ব্রিজের ফুটোর ছবি চালাচ্ছ ঘেসের ছবি বলে—’
বিনয় হো হো করে হেসে ফেলে, ‘শোনো, পরমহংস, আমার ভাই ছবি তোলা হয় নি। এক অ্যাড-এজেন্সি ধরেছিল একটা ক্যাম্পেনের জন্যে । তিন-চারদিনের মধ্যেই প্রেজেন্টেশন, মালিকরাই দেখবে। ক-দিন পাগলের মত কাজ করলাম। কাল সন্ধ্যাবেলায় পার্ক হোটেলে মালিকদের কাছে প্রেজেন্ট করা হল ব্লো-আপ করে, লিখে-ফিখে, এঁকে-টেকে, তা-ও আবার তিন-তিনটে মডেল নিয়ে তিনটে ডিফারেন্ট সেট, শালাদের কখন কোন মেয়েছেলের মুখ পছন্দ হবে কে জানে, বলবে, ই লেড়কি বহুৎ হাসতা হ্যায়, ত দিলে গম্ভীর মেয়েছেলের মুখ ত বলবে ই ত রোতা হ্যায়, আমি বাবা কোথা থেকে এমন মুখ জোগাড় করব যা হাসবেও না, কাঁদবেও না, সেই ত এক মেয়েছেলে তার দুটো চোখ, দুটো কান, --তা আর কত কাটাছেড়া করব বলো—’
'কেটে-কেটে দিলেই পারতে, এর ঠ্যাং, ওর গলা, একজনকেই মনে হত কত রকম’
‘'সে কি আর তোমার বুদ্ধির জন্যে বসেছিলাম ? একেবারে কাটা পোনার মত করে সাজিয়ে দিয়েছিলাম তিন-তিনটে মেয়েছেলে, দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা করে মুড়ো, কোন মুড়োর কোন পেট, কোন পেটির কোন গাদা, কোন ল্যাজা'
‘এত করেও হল না’
ছবি নিয়েছে দুটো, ক্যাম্পেনটা হল না, লাভের মধ্যে বিয়ারে ঢোল হয়ে বাড়ি ফিরলাম, এখনো ঢেকুর উঠছে, আর এ-সব করতে গিয়ে তোমাদেরটা করাই হয় নি। তোমাদের ঘেসই চাই, ফুটো হলে হবে না?’
‘সে কালীদাকে গিয়ে বলো, ঘেসকে ফুটো করে দেবেন'
‘কালীদাকে কি এ-সব বলা যায় ভাই, গুডউইল চলে যাবে, ওখানে বলতে হবে একেবারে ফুটোর মধ্যে ঢুকে গিয়ে ফুটোর ছবি তুলে এনেছি, তবে ত দাম দেবে’
‘সে ত হল। এখন হবেটা কী?’
‘একটা কাজ করো, তুমি আমাকে থিমটা মনে করিয়ে দাও ত। মানে, মরাটরার ব্যাপার ত। তুমি চট করে রেডি হয়ে যাও। আমি কিছু ছবি এনেছি, নেগেটিভও এনেছি। দেখি কিছু স্টক পাই কিনা। না-হলে এখান থেকে স্পটে গিয়ে তুলে তোমাদের স্টুডিয়োতে প্রিন্ট করে নেব।’
‘এর মধ্যে হবে?’
'আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি রেডি হয়ে নাও-না, ছবি দেখিয়ে স্পেসটা রেখে দিতে বলব, তার পর পেষ্টিং ত হবে রাত বারটায়, হয়ে যাবে, আরে ডেথ ত, দেখো, আমার স্টকেই পেয়ে যাবে, তুমি রেডি হয়ে নাও, আমাকে থিমটা বলে যাও,’ বিনয় আর-একটা সিগারেট ধরায়।
পরমহংস দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবে থিমটা কী বলবে। বিনয় তার বিরাট ব্যাগের ভিতর থেকে তিন-চারটি ফটোর খাম বের করে। এক ঝাঁকিতে একটা খাম উপুড় করে চৌকির ওপর ছড়িয়ে দেয়, তার পর হাত দিয়ে আরো ছড়িয়ে দেয়-যাতে সবগুলো দেখা যায়। ঘরের মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পরমহংস দেখে তার চৌকিময় ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু মৃতদেহ--কখনো ক্লোজ-আপে, যেমন কাগজে পুলিস বিজ্ঞাপনে ছাপে ফুলে-পচে-গলে যাওয়া মুখ, চোখ দেখাই যায় না, অনেকগুলো ছবির ওপর দিয়ে একটু ঝঁকে সেই ছবিগুলোই একসঙ্গে টেনে হাতে তুলে বিনয় বলে, 'আনআইডেন্টিফায়েড ডেডবডি।হবে?’
একটু যেন ভাবতে হয় পরমহংসকে ।
নিউজ-এডিটর বলেছিলেন, হাওড়া ব্রিজের ফুট্টো দিয়ে সেই ছেলেটি গঙ্গায় পডে যাওয়ার দিন, রাতে, ‘আর ইউ ইনটারেসটেড ইন ডেথ?’ বলেছিলেন, ‘সবাই ত এখন হাওড়া ব্রিজের ফুটোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আমরা একটু অন্য রকম স্টোরি করি।’ ক্যাপশনটা ভেবে ফেলেছিলেন, ‘কালক্যাটাস ইজি ডেথ।’ পরমহংস যেন বুঝে উঠতে পারছে না ভেবে আর-একটু ব্যাখ্যা করেছিলেন, কলকাতায় কত সহজে মারা যাওয়া যায়, ফাইলটা দেখে নিতে বলেছিলেন, সেভেনটি এইটে স্টেটসম্যানে ছবি বেরিয়েছিল, একটা বাচ্চা হাইড্রান্টে পড়ে মরে ভেসে গঙ্গার পারে চলে এসেছে, ভাট ছিল বলে ছবিটা তোলার চান্স পেয়েছিল, কিন্তু হাইড্রান্ট ত খুব কমন থিম, দমদমে একবার ঘেস তুলতে-তুলতে ঘেস চাপা পড়ে পনেরটা না বিশটা বাচ্চা মারা গিয়েছিল, ঘেস নীচ দিয়ে তুলতে থাকে খুঁড়তে থাকে, তলাটা ফাঁকা হয়ে যায়, চুরি করে তোলা গর্তের ভিতর ঢুকে গেলে আর কেউ দেখতে পায় না, বলেছিলেন, ঘেস দিয়েই শুরু করতে, তাতে নাকি একটা ‘বিল্ড-আপ’-এর সুযোগ আছে, ঘেস নিয়ে কী কী হয়, চুরি-ঘুষের ব্যাপার আছে, ফিল-ইন করার সময় সিকিউরিটি চেক নিয়েই বহু কেলেংকারি, অনেক টাকার লেনদেন, ফলে ডেথ ইজ ইজি, গঙ্গাপারে কোনো পুরনো বাড়ি ধসে গিয়েছিলো, বৃষ্টি নেই, বাদলা নেই, এমনিই ধসে গিয়েছিলো, গঙ্গাপাড জুড়ে এরকম পোড়োবাড়ির বরান্দায় শয়ে শয়ে লোক ঘুমোয়, ঐ ঘটনাতে সেদিন রাতে জনা পঞ্চাশ মারা গিয়েছিল, বলেছিলেন, "ফটোগুলো গঙ্গার ওপর থেকে নিতে বলবেন নৌকা থেকে’, বলেছিলেন, ‘ডোন্ট রাব দ্যা অবভিয়াস’, বলেছিলেন, ‘স্টোরিতে মৃত্যুটা কত সহজ এই ভাবটা আনবেন’, বলেছিলেন, ‘দেয়ার কামস দি ল্যাংগুয়েজ’, কিন্তু বলেছিলেন, কিন্তু, ‘বাট অলওয়েজ গিভ দ্য সেন্স অব দ্য কুইয়ার’, বলেছিলেন, ‘সব চেয়ে সহজ মৃত্যুই সব চেয়ে রহস্যময়’। বলেছিলেন, ‘ঘেস দিয়েই শুরু করুন’। বলেছিলেন, ‘আয়রনি আছে একটা। কলকাতার প্রায় সব হাউসিং প্রজেক্টের জমি ঘেস দিয়ে ভরাট করা, অথচ সেই ঘেস হচ্ছে আসলে কবরখানা’, বলেছিলেন, 'ক্যালকাটা ইজ গোয়িং হাই অন গ্রেভস--'
সেদিন কেউ টেরই পায় নি ঘেস-এর প্রান্তরে কোথায় কিছুটা ধসে গেছে। যতটুকু বসেছিল, কয়েকজন মিলে হাত দিয়ে সরালেও কিছু বাচ্চাকে বাঁচানো যেত। কিন্তু তল থেকে বাচ্চার অতটুকু-টুকু হাত দিয়ে তাদের ওপর থেকে ঘেস সরাতে পারে নি। যত ছটফট করেছে, ওপর থেকে তত ঘেস এসে ওদের চাপা দিয়েছে। বাচ্চারা নাকি ঝুড়িগুলো আঁকড়ে ছিল, ভেবেছিল নাকি পাহারাঅলা বুড়িগুলো কাড়তে এসেছে। সেই খাদটাতে সেই একই ভাবে এখনো বাচ্চারা ঘেস চুরি করে সারা দিন ধরে । ওপর থেকে করলে আইন বাঁচে না, তাই প্রথমে গুহা বানিয়ে তার ভিতর ঢুকে যায়। অতটুকু-টুকু শরীর আড়াল করতে আর কতটুকু গুহার দরকার হয়। কুকিং গ্যাসের সাপ্লাই কম, কোল বল কলকাতা শহরের বেশ ভাল ইনডাস্ট্রি।
বিনয় জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমাদের কি আইডেনটিফায়েড ডেথ,নাকি, আনআইডেনটিফায়েড’।
জিজ্ঞাসা করে বিনয় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বলেই পরমহংসকে বিড়বিড় করে একটা উত্তর দিতে হয় । বিনয় সেটা শুনতে পায় না, ‘অ্যা?’
'না, আইডেনটিফায়েড আর কোথায়?’
‘মানে আনট্রেসড ডেডবডি, সে ত এই এত, আরে আমার স্টার্টই ত মর্গে, তাহলে ত এখান থেকে বেছে নিতে পারো’।
‘না ঠিক এরকম নয়'
‘তা হলে ? তোমার থিমটা বলো', আর-একটা বড় খাম ব্যাগ থেকে বের করে পরমহংসের দিকে ঘুরে বসে বিনয়, ‘তুমি বলো, আমি একটু খোঁজাখুঁজি করি, এর ভিতর তুমি তৈরি হয়ে নাও, তার পর চলো, দু ভাই বেরিয়ে পড়ি, ইন সার্চ অব ডেথ, না কি কী যেন ক্যাপশান, কী ডেথ?’ বিনয় আর একটা সিগারেট ধরায়।
এই প্রশ্নটিতে পরমহংস যেন শুরু করার সুযোগ পায়। সে ধপ করে মেঝের ওপর বসে পড়ে, ‘ইজি ডেথ। মানে ঐ হাওড়ার ঘটনাটার পরই—’
'মানে, ফুটো কেস?"
‘হ্যাঁ, ঐ ঘটনাটার পরই আমাদের নিউজ এডিটরের মাথায় আসে কলকাতায় এ রকম আকছার মরে যাওয়ার মত ব্যাপার কী কী ঘটছে তার একটা ধারাবাহিক কাহিনী করবেন। মানে সব কাগজই ত হাওড়া ব্রিজের ঐ-সব ছবি ছাপতে লাগল কয়েক দিন ধরে –’
‘ও ভাই ঐ কদিন যে ফুটোর ডিম্যান্ড ছিল ভাবতে পারবে না, এত ফুটে৷ কোথায় পাই বলো ত, হ্যাঁ, এবার বলো, ফাইন, মানে সিরিয়াল হবে, অনেকগুলি ছবি যাবে, এই ত, ডেইলি না গ্যাপ দিয়ে?’
পরমহংসের মনে হয়, বিনয় তাকে কথাতে নিয়ে আসতে চায়। পরমহংসের মনে হয়, বিনয় তার বিষয়টা এতক্ষণেও বুঝে উঠতে পারে নি, এ হতেই পারে না কিন্তু বিনয় তার কাছে মৃত্যুর একটা ধারাবিবরণ শুনতে চায়। কিন্তু পরমহংস ত আপত্তি করে নি। সে ত নির্দিষ্ট দিনে লেখা জমা দিয়ে দিয়েছে। প্রমাণ রেখেছে, সে ‘ডেথে ইনটারেসটেড’। কাজ এগিয়ে রাখতেই সে বিনয়ের কাছে গিয়েছিল। সল্টলেকের ভিতরে না হলে যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না। তা হলে ?
কথা বলতে-বলতে পরমহংস বোঝে সে অনুর কাছ থেকে সরে আসছে।
‘না, রোজই বেরবে, ক-দিনের আর ব্যাপার, দিন সাতেক, তবে আর কাউকেও যদি বলে থাকেন, সেটা আমি জানি না, তা হলে হয়ত আরো বেশি দিন চলবে’
‘তা বলো, চলবেটা কী’
‘মানে কলকাতায় কত রকম করে লোকে মারা যায়’,
‘ফটো তুলতে হবে ত, পরিষ্কার করে বলো সাইট কোথায়, ডেডবডি চাই কি না, ডেভবডির মুখ চাই, না বডি চাই'
চৌকির ওপর ছড়ানো ছবিগুলি থেকে নির্ভুল একটি তুলে এনে পরমহংসের কোলের ওপর ফেলে দেয়। তিন-চারজন কলকাতার রাস্তায় পড়ে আছে, পুলিসের ধাবমান ক্লোজ-আপের ওপারে। ছবিটির দিকে তাকিয়ে পরমহংস ভাবতে পারে ‘ক্যালকাটাস ইজি ডেথ...’
‘হ্যা, এটাও হতে পারত, কিন্তু আমার লেখার ছবি ত এক-একটা নির্দিষ্ট জায়গার—‘’
‘জায়গা বলো'
'ঘেস জমায় যেখানে, বা, জায়গা ভরাট চলছে’
‘তিনজলায় এখন বিরাট কাজ হচ্ছে। সেখানে—‘
বাচ্চারা নীচে সুড়ঙ্গ কেটে..."
এখন দুজনে মিলে এই শহরের মৃত্যুর মানচিত্র এঁকে ফেলবে, মুখে-মুখে । পরমহংস বোঝে, যত স্পষ্ট, নির্দিষ্ট হবে সে মানচিত্র, গল্ফ লিঙ্কের কোনো ফ্ল্যাটের সেই দরজার ফ্রেম তত দূর থেকে দূরে সরে-সরে শেষে মানচিত্রের বাইরে চলে যাবে। পরমহংস স্মৃতিতে আনার চেষ্টা করে-তার নিউজ-এডিটরের ভাষা, যাতে বিনয়কে অবিকল বলতে পারে,
'নট টু রাব দি অবভিয়াস, ক্যালকাটাস ইজি ডেথ'...
‘তুমি এইটা নিতে পার, সকালে ট্রাক ফুটপাথে উঠে গেল, সারি দিয়ে সব ঘুমাচ্ছিল, চষে দিয়ে নেমে গেল, কী, হবে না?’
‘হ্যা, হতে পারে –’
‘দেখো’, হাতের খামটা উপুড় করে পরমহংসের কোলের ওপর ঢেলে দেয় আর মরা মানুষের ছবিগুলো ঝর ঝর করে এসে জমা হয়।
‘তাড়াতাড়ি দেখো, তার পর বেরিয়ে কয়েকটা সাইটে যাব', বিনয় তার ব্যাগ থেকে আর-একটা খাম টেনে বের করে। আর, নিজের কোলের ওপর জমে ওঠা ছবির ওপর পরমহংস ঘাড় নামায়--থালাভরা জলে যেমন গ্রহণের সুর্য দেখে--মৃতদেহ-ভাসা স্রোতে আরো কত যুগ-যুগান্তরের পারে চলে যাচ্ছে দোসরা শ্রাবণ ।
১৯৮৩
পরমহংস এত নিশ্চিতই বা বোধ করে কী করে যে অনু নিজে তার জন্মদিন মনে রেখেছে, বা মনে রাখতে চায়? এমনও ত হতে পারে, পরমহংস দোসরা শ্রাবণের লক্ষে পৌঁছুল কিন্তু অনুকে জানাতে পারল না যে আজ অনুর জন্মদিন।
বিনয় চার পাশে ছিটানো ফটোর মধ্যে বসে ছিল। সামনে বোর্ডে ক্লিপে এঁটে একটা ফটোতে রঙ দিচ্ছিল। পরমহংসের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল বাড়ির বাচ্চা চাকরটি। তখন বিনয় তাকে ঢুকতে দেখেছে কী না পরমহংস জানে না। কারণ, সে যতক্ষণ বিনয়ের পাশে এসে বসে আছে, ততক্ষণের মধ্যে বিনয় এক-বারও চোখ তোলে নি। খুব মন দিয়ে ফটোটার ওপর কাজ করছে বলেও মনে হয় না। তেমন মন দিতে ও হুমড়ি খায়। বরং যেন মনে হয়, ফটোটা নষ্ট করছে, আঁকিবুঁকি কেটে। পরমহংস একবার ভাবে, উঁকি দিয়ে ফটোটা দেখে। বদলে, মেঝেয় পড়ে থাকা গোটাকয়েক ফটো একসঙ্গে তুলে নেয়। দোমড়ানো-মোচড়ানো ফটো। দেখে মনে হতে পারে ফেলে দেয়া। খবরের কাগজের কাছে কোনো ফটোই ফালতু নয়, কোনদিন যে কোনটা কাজে লাগছে। বিনয়ের এই এত ফেলে দেওয়া ছড়িয়ে ফেলার মধ্যেও ওর হিসেব আছে।
কিন্তু এগুলো ত সব প্রিন্ট। নেগেটিভ সব যত্ন করে তোলা থাকে। চাইলেই প্রিন্ট হয়ে যাবে। আর, কাগজের দরকার মত প্রিন্ট দিতে না পারলে ফ্রি লান্সিং-এর বারটা বেজে যাবে।
পরমহংস বাঁ হাত দিয়ে একটা ছবি তুলেছিল। বড় প্রিন্ট। তাই তোলার পরও দোমড়ানোই থাকল। সেটাকে খুলতে দু হাত লাগাতে হয়। কে যেন কিসের ফিতে কাটছে। অনেকগুলো লোকের মুখ। মাঝখানে বেঁটে লোকটার হাতে কাঁচি, মুখে হাসি। ফটোটা উলটে দেখল—কিছু লেখা নেই। ফেলে দিতে-দিতে পরমহংস ভাবল, কাঁচিকাটা হয়ে গেলেই ত হয়ে গেল, এ-ছবি আবার কোন কাজে লাগবে। ভেবেই হাসল, ‘স্টেটসম্যান’ কিছুদিন আগে এ-রকমের বাতিল ছবি ছাপিয়ে হৈ হৈ বাধিয়ে দিয়েছিল। ক-বছর আগে মিসেস গান্ধী কী-একটা উদ্বোধন করেছেন, ফিতে কাটা হয়েছে, মার্বেল প্লাক বসানো হয়েছে—তার পর কোনো কিছুর পাত্তা নেই। এক রিপোর্টের ঠেলায় শেষে সেখানকার পি.আর.ও. বিবৃতি দিল যে মার্বেল প্লাক তাঁরাই সরিয়ে রেখেছেন, ঠিক জায়গায় লাগানো হবে বলে। খবরের কাগজ যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে—এতদিনে সত্যিকারের ফোর্থ এস্টেট? নিউজ-এডিটর তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘আর ইউ ইনটারেস্টেড ইন ডেথ? কী মশাই, করবেন নাকি, ডেথ?’ পরমহংস ভাবল, কেউ বুঝি মারা গেছে—অবিট করতে বলছেন। কিছু না বলে হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে থাকল। নিউজ-এডিটর হাসিটা বন্ধ না করে বলে গেলেন, আর ওঁর ভঙ্গিগুলো এতদিনের চেনা বলেই পরমহংস বুঝতে পারে এবার কথাটা উনি, যাকে বলে সিরিয়াসলি, বলছেন। এটা কি এক পরমহংসই বোঝে, না সবাই বোঝে কোথায় কখন ওঁর বদলটা ঘটে যায়। একই হাসি অথচ আসল কথা বলার সময় হাসিটার কোনো মানে থাকে না, হাসি থাকা সত্বেও গম্ভীর দেখায়। পরমহংসের কখনো মনে হয়, ওঁর গলার স্বরটা বদলে যায়। কখনো মনে হয়, ওঁর চোখটা বদলে যায়। বা, এত ভাবার কী আছে। একসঙ্গে এতদিন কাজ করতে-করতে পরস্পরের কাজের ধরন ত জানা হয়ে যাওয়ারই কথা। পরমহংস লম্বা, চওড়া, সমান সমান, বাঁকা, নানা সাইজের ফটো মেঝে থেকে তুলেছিল আর সেগুলো তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তুলে, তাকাচ্ছিল একবার নিশ্চয়ই কিন্তু দেখছিল না। বা, হয়ত দেখছিলও। কিন্তু সেই পক্রিয়ায়, মাত্র দু-এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও, সে বিনয়কে ভুলে গিয়েছিল। যেন এটা তার নিউজ-এডিটরের টেবিল। টেবিলের ওপর ছড়ানো ছবির পর ছবি। ছবিগুলো থেকেই যায়, পরমহংস অপরিবর্তিত আসনে ছবি তোলে ও ফেলে।, যেন, এই মাত্র সে বিনয় আর তার নিউজ-এডিটরের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছিল সেটা আর কোথাও কেউ টেরই পেল না।
তাকাতেই হাতে উঠে আসা ছবিটা এত চেনা ঠেকে যে পরমহংস না-দেখে ফেলতে পারে না। খরা তুলছিল তখন বিনয় পুরুলিয়ায়, কোথা দিয়ে যেতে যেতে দেখা পালকি নামিয়ে এরা বিশ্রাম করছে, বিয়ে করে ফিরছে, বিনয় ছবি তুলতে গেলে মেয়েটি তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে হাসি চাপা দেয়, বরটাও হাসছে, ‘মেয়েটার জামার সেফটিপিন পর্যন্ত উঠেছে’-বিনয় ছবিটা বুঝিয়েছিল, অনেকগুলো প্রাইজ পেয়েছে, উইলসের ‘মেড ফর ইচ আদার’-ও, শেষে জার্মানিতে, যে-অ্যালবামে ছবিটা ছাপা হয়েছিল তাতে অনেক নগ্ন ছবি ছিল, জার্মান ভাষায় বিনয়ও বুঝতে পারে নি, পরমহংসও বুঝতে পারে নি অত নগ্নিকার সঙ্গে এই মেয়েটির সম্পর্ক কী হতে পারে।
পরমহংসের হাত থেকে ছবিটা পড়ে গেল। সে আর-কোনো ছবি না তুলে শুধু তাকিয়ে থাকল। কত মন্ত্রীর মাথা গড়াগড়ি খাচ্ছে, দেশ-বিদেশের এমন অনেক লোকও যাঁরা মন্ত্রী নন, ভঙ্গি খুব না বদলে পরমহংস উলটো দিকের দেয়ালে তাকায়, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর একটা বিশাল ছবি, পাশে জ্যোতি বসু, ফিদেল ঘাড় ঘুরিয়ে একগাল হাসছেন। চোখ দুটো চকচক করছে, বিনয় সারা ঘরে এই একটি ছবিই, অন্তত চার ফুট লম্বা করে, টাঙ্গিয়ে রেখেছে, অনেকে কিনতে চেয়েছিল, গবর্নমেন্টও, হঠাৎ খেপে গিয়েছিল বিনয়, আমার ছবি আমি বেচব না, কার বাপের কী, জ্যোতিবাবু চেয়েছিলেন, এক কপি দিয়ে এসেছিল, পরমহংস আবার মেঝময় মানুষের হাসি, মাথা, হাত, নদী, নালা, পাহাড়-পর্বত, প্লেন, ট্রেন, মোটরগাড়ি, ক্বচিৎ কখনো নিসর্গ—যা আসলে খরা বা বন্যার দুর্বিপাকে, দেখে যায়। আর ইউ ইনটারেস্টেড ইন ডেথ? এত ছবির মধ্যে কি পরমহংসের দরকারি ক-টি মড়ার ছবি পাওয়া যাবে না? তা হলে আর বিকেলে বিনয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হত না। ক্যাপশানের গুণে ত জ্যান্তকেও ‘মড়া’ করে দেয়া যায়। ক্যাপশান না-হয় ভাবা যাবে, আপাতত ছবিটা পেলেই হয়। যেন তার ছবিটা খুঁজতেই পুরো মেঝেটা চোখ দিয়ে চষে ও বোঝে—ওখানে ছবিগুলো যেভাবে ছড়ানো তাতে বাঁচা-মরার ভিতর তফাৎ করা যাবে না, যায় না। তার ‘মড়া’র খোঁজে পরমহংস এক কোনায় কয়েকটি মেয়ের আভাস পায়। সেই ছবিগুলো দেখতে, তাকে উঠতে হয় ও কতগুলো বছর ও দেশ ও দ্রুত উন্নতি ও সরকার ও বিদ্রোহ ও দুর্বিপাক ও জন্ম ও মৃত্যু ও অপসারণ ও...মাত্র দুটি পদক্ষেপে মাড়িয়ে সেই ছবির কাছে গিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে খুঁজতে হয়—দুই হাত দুই পা ওপরে তোলা এক লাস্যময়ী লম্ফন, হাত-পা মুখচোখহীন কোনো হাসি, শুধু হাসি, এত ঘন বড় ঠোঁট বা দাঁত ক্যামেরার ওপাশে থাকে না, চোখ—দীর্ঘতম পল্লবময়, যেন পল্লবই চোখ, শুধু আঙুল—বাহুহীন আঙুল, শুধু নখ-আঙুলহীন নখ, শুধু চুল-মাথাহীন মাথার ভিতরে কম্পিউটার বসানো...। পরমহংসকে একটা ক্যাপশান ভাবতে ভাবতে ফিরে আসতে হয়—‘দি কর্পস—ডিজমেমবার্ড।’ কিন্তু বিজ্ঞাপনের এ-ছবিগুলো দিয়ে তার হবে না, সুতরাং বসতে বসতে সে ক্যাপশানটা আবার ভুলে যেতে পারে।
বিনয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সে আসলে একটা ছবি নষ্টই করেছে। ছবির চোখ দুটোর ভিতর দুটো উদ্ভট গাছ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। একটাতে পুরোপুরি ঢোকানো হয়ে গেছে, আর-একটাতে আধাআধি, এখনো পাতগুলো সব গজায় নি, বা, আধাআধি পাতা সব ঝরে গেছে।
পরমহংস এতক্ষণে বোঝে যে, বিনয় তার সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। বিনয় কাজে ব্যস্ত থাকলে এমন কিছুক্ষণ যেতে পারে। কিন্তু এতক্ষণে যেন বিনয়ের কিছু বলা উচিত ছিল। সে কোনো অসুবিধে করল না ত বিনয়ের, এমন না-বলে এসে। পরমহংস তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। এটা ভাবতে-ভাবতেই ওঠে যে এমন আচমকা ওঠা ঠিক নয়, কথাটা বলেই ওঠা যায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে কথাটি ভেবে নেয়, দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘আসছ ত আপিসে দুটোয়? চলি—’
‘আরে দাঁড়াও, চা খেলে না’
‘এখন খাব না’, এতে বিনয় ভাবতে পারে রাগ করেছি—তাই পরমহংস তাড়াতাড়ি যোগ করে, ‘তোমাকে মনে করিয়ে দেব বলে এক মিনিটের জন্যে এসে এত ফটো দেখে আটকে গেলাম—‘
‘এই, এক কাপ চা খেয়ে যাও, তোমার ছবি দেখে যাও’
পরমহংস বোঝে, বিনয় তাকে আটকাতে চায়। সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে-যেতে বলে, ‘ঠিক দুটোয় অফিসে যেও, দেখব।’ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বিনয়কে দেখতে যায়, বিনয় ওঠে নি, বসেই ছিল।
রাস্তায় নেমে পরমহংস প্রথমে ভাবে—ম্যানেজ করতে পেরেছে যা-হোক, বিনয় নিশ্চয়ই টের পায় নি যে সে রাগ করেই উঠে পড়েছিল। ঠিক রাগ করে নয়, অভিমান করে। ঠিক অভিমান করেও নয়, ভয়ে। ভয়?
কাকে নিয়ে? নিজেকে নিয়ে? ‘আনসিওর অফ হিমসেলফ’—তাদের কাগজে একটা দারুণ এডিট বেরিয়েছিল, হরিয়ানার রাজ্যপাল তাপাসিয়া দেবীলালকে কথা দিয়ে ভজললালকে ডেকেছিল, ক্যাপশানটি পরমহংস গোপনে নিজের পেছনে লাগাল—অনুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর থেকে এটা হয়েছে—কোথাও সে তার জায়গা বা অধিকার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না। একবার ভেবেছিল, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবে। নিজেই যখন বুঝতে পারছে, নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে, ভেবে, আর দেখায় নি। তার পর, নিজেই সে টের পেয়েছে, নিজেরই ভিতর তৈরি করে তুলতে পেরেছে এক প্রতিরক্ষা। যখনই তার কোথাও অনিশ্চিত ঠেকে, সে সরে আসতে পারে প্রায় কোনো নাটক না করেই। পরমহংস একটু আত্মপ্রশংসায় করুণ হয়--কথা বলাটাই ত আমার কা-ল, এতদিন কথা দিয়েই নিজেকে জাহির করেছি, এখন কথা দিয়েই নিজেকে লুকোই। সেই একই কথা বলে যাই, অথচ কেউ বুঝতে পারে না কথার উদ্দেশ্য পালটে গেছে।
সে পালটাক । বিনয়ের কাছ থেকে চলে আসার আগে ওটুকু জেনে আসা হল না, ছবিগুলো হয়েছে কিনা। ছবির ব্যাপারে বিনয় শেষ মুহুর্তেও কিছু বলে নি । এমনকি দুটোর সময় তাদের অফিসে আসবে কি-না, সে কথাতেও ত হ্যাঁ বলল না। পরমহংসকে একটু ভাবতে হয়, আসলে ত আমি বিনয়কে সে-সময়টুকুই দিলাম না, নিজে তখন পালিয়ে আসতে পারলে বাঁচি। পালিয়ে আসারই-বা কী ছিল ? আমি ত বিনয়ের কাছে কাজেই গিয়েছি, তারই কাজে। আমারই উচিত ছিল প্রথমেই গিয়ে ছবির কথা জিগগেস করা। বিনয়ের কোনো দোষ নেই। ও আমার ভাবসাব দেখে ভেবেছে আমি কিছুক্ষণ বসব।
তা হলে কি আজও অনুর কাছে খাওয়া হবে না, আজ দোসরা শ্রাবণ ?
কোনো-এক অতীতে অনুর কাছে যাবার ইচ্ছেটা পরমহংসকে দমন করতে হয়েছিল এই ভেবে যে দোসরা শ্রাবণ যাবে। দোসরা অনুর জন্মদিন ।
কতদিন আগে এটা ঘটেছিল তার কোনো হিশেব নেই। যে-সব অনুষঙ্গ দিয়ে-দিয়ে মনের হিশেব রাখা যায়, তেমন কোনো অনুষঙ্গও নেই। দেড়-দু বছরের মধ্যে সে অনুকে দেখে নি। বাবির একটা চিঠি পেয়েছিল-পরীক্ষায় পাশের খবর দিয়ে। অনেকবার পড়ে পরমহংস বুঝে গিয়েছিল, কী ভাবে বাবার সঙ্গে কথা বলবে, তার মেয়ে সেটা ঠিক করে উঠতে পারছে না। দু-একবার ভেবেছে, বোধ হয়, চিঠি বলেই এমন । কিন্তু পরে, ভেবে-ভেবে নিজেই এই যুক্তি বের করেছে-বাৰি তাকে দেখল ক-দিন, এর পর প্রতিদিনই ত ওর বড় হয়ে ওঠা, সেই দিনগুলোর কোথাও ত পরমহংস নেই, শুধু স্মৃতি নিয়ে বাবি থাকবে কী করে, এটুকু জীবনে আর কত বড় স্মৃতিই-বা হতে পারে বাবির। সেই চিঠিটির কোনো উত্তর পরমহংস দেয় নি।
কিন্তু কোনো একদিন নিজের ভিতরেই টের পেয়ে থাকবে এক অদম্য ইচ্ছা--অনুকে শুধু একবার দেখে আসার অদম্য ইচ্ছা। সেই ইচ্ছাটা যে একবারে হঠাৎ অদম্য হয়ে উঠেছে, তা নয়। তেমন যাতে না হয়ে ওঠে, তার জন্যে পরমহংস নিজেই নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে। কখনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অঙ্কে-অঙ্কে তুচ্ছ করে দিতে চেয়েছে এই ইচ্ছেটাকে। কখনো নিজেকে ঠাট্টাবিদ্রুপ করে করে উড়িয়ে দিতেও চেয়েছে। তবু টের পেয়েছে, ভিতরে-ভিতরে অদম্য হয়ে উঠছে অনুর কাছে চলে যাবার টান। যে স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে ভেঙে গেছে, তার প্রতি এই টান বোধ করার কোনো আইনি অধিকারও নেই, সামাজিক অধিকারও নেই ; অথচ সেই আইন ও সমাজের কোনো কেয়ার না রেখেই পরমহংসের ইচ্ছেটা এমন অদম্য হয়ে উঠেছিল, বোধ হয়, অধিকার নেই বলেই অদম্য হয়ে উঠেছিল। আর যাওয়াটা যখন এতই সহজ । প্রতিদিনই গলফ লিঙ্কের মিনিবাসের সারি ডিঙিয়ে উল্টো দিকে গিয়ে তাকে সন্ট লেকের বাস ধরতে হয়। যেকোনো দিন উঠে বসলেই ত হয়। তার পর বড় জোর আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু ইচ্ছের এই অদম্যতা সত্ত্বেও, পথ থেকে গলফ লিঙ্কের মিনিবাসের ফুটবোর্ডের দূরত্ব অনতিক্রম্য থেকে গেছে। কোনো উপলক্ষ নেই পরমহংসের, অনুর দরজায় গিয়ে টোকা দেবার কোনো উপলক্ষ নেই। দরজাটা খুলে যাবে , তার পর, কী বলবে সে। হয়ত না বললেও চলবে। বাবি আছে; এটা ত জানা কথাই-বাবিকে দেখতে সে মাঝে-মাঝে যাবে । কিন্তু যায় নি ত। এখন, যখন অনুকে দেখতেই সে যেতে চায়, তখন মেয়েকে তার উপলক্ষ করে কী ভাবে ? আর, অনুর কাছে উপলক্ষহীন কোনো যাওয়া ত তার থাকতে পারে না ।
সেই উপলক্ষের সূত্রেই পরমহংসের মনে পড়েছিল, দোসরা শ্রাবণ। বাংলা তারিখ, মাস, কিছুই তার জানা ছিল না, কিন্তু অনুর জন্মদিনটা যেন তার যাওয়ার উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। দোসরা শ্রাবণ কতদিন পর সে হিশেবটাও তার কাছে স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু ঐ একটি তারিখ ভেবে যেন নিজেকে সামলাতে পেরেছিল তখনকার মত ।
তখনকার মত সামলানো হয়ত গেল, কিন্তু সেই সুযোগে ইচ্ছেটা ভিতরে ভিতরে চারিয়ে গেল অনেকখানি, বা, দিনে-দিনেই চারিয়ে গেল ভিতর থেকে আরো ভিতরে, এমনই যে দোসরা শ্রাবণ হয়ে ওঠে পরমহংসের কাছে এক লক্ষ, উপলক্ষহীন এক লক্ষ, দোসরা শ্রাবণ পর্যন্ত সেই লক্ষটিকেই সে লালন করে এসেছে, সেই লক্ষের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছে। কলকাতার রাস্তা থেকে গলফ লিঙ্কের মিনিবাসের ফুটবোর্ডের অনতিক্রম দূরত্ব পরমহংস যেন সময়ের এই দীর্ঘতা দিয়ে এই কয়েক যুগ জুড়ছিল।
এখন, তা হলে, খুব তাড়াতাড়ি, পরমহংসকে মনটা একটু গুছিয়ে ফেলতে হবে অনুর কাছে আজও যাওয়া হবে না বলে ?
যাওয়া হবে না--এটা এতটাই ধরে নেয় কী করে পরমহংস, নাকি ধরে নিতে চায় বলেই ধরে নিতে পারছে? এই সুয়োগে আজ দোসরা শ্রাবণ যদি পার হয়ে যায়, তা হলে তাকে আর-কোনো আশ্বিন, বা অগ্রহায়ণ, মাঘ, বা চৈত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে? অনুর সাথে দেখা করতে চায় না পরমহংস? সে শুধু দেখা করার ইচ্ছেটাকে লালন করতে চায় ? পরমহংস কি নিজেকে শুধু এইটুকু এক বিশ্বাসে বাঁধতে চায় যে এই কলকাতা শহরেরই এক জায়গায় অনু থাকে, একটা বাসে আধঘণ্টা-পয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়ালে বা বসলেই সে পৌঁছে যেতে পারে অনুর সেই বাড়িতে, তারপর দুটি-একটি টোকার পরই দরজার কপাট উপে যায়, কপাটের ফ্রেম জুড়ে জেগে ওঠে অনু, সে কপাটে আলো এসে পড়ে কোন পথে।
পরমহংস তার লায়েক অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারে--এক নিষ্পত্তিহীন যৌন তাকে প্রবল টানছে। তার কোনো তৃপ্তি অন্যত্র নেই, এমন-কি অনুতেও নেই। এখন, এই সকাল দশটা, সাড়ে দশটায় তার জানালা দিয়ে দেখা পাশের বাড়ীর দেয়ালে-জানলায় নিমগাছের ছায়ার দোলার সঙ্গে সে-যৌন মিশে যায়, খাচ্ছে, এমন-কি, সবুজ জানলায় ঐ নিমগাছের পাতার ছায়াটাকেও সবুজ মনে হওয়ার বিভ্রমসহই মিশে যাচ্ছে, মানিক তলার মোড়ে হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি আসায় সার্কুলার রোডের আকস্মিক জনহীনতায় এমনই মিশে গিয়েছিল, শেয়ালদা ফ্লাইওভারের রাজা বাজারের দিকে নেমে যাওয়ার অস্পষ্ট বাঁকের স্পষ্ট ঢালে দোতলা বাসের জানলা থেকে অনুকে মনে পড়ে গেল, এয়ারপোটের ভি. আই. পি. লাউঞ্জে মন্ত্রীর জন্যে অপেক্ষমাণ রাত এগারটায় রানওয়ের প্রান্তর থেকে জেটের স্থাপত্যময় আশরীর প্রবল বীর উত্থান জুড়ে জেগে উঠছিল অনুর শরীর, দুর্গাপুর ব্রিজের মাঝখান থেকে দেখা পশ্চিমমুখো রেললাইনগুলোর ধাবমান প্রান্তরে বয়ে যায় অনুর শরীরের শানিত ইস্পাত। এই শহর কলকাতার, অনুপ্রাসহীন সীমান্তহীন কলকাতার নাগরিক বিস্তার জুড়ে অনুর শরীর নিয়ত অম্বিত হয়ে থাকে পরমহংসের কাছে যৌনের আসঙ্গে। আকাশ-বাতাসের রোদজলের প্রকৃতিতে নয়, অনুর অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে পরমহংসের কাজকর্মের চলাফেরার প্রতিদিনের কলকাতায় । সব চেয়ে বেশি মনে পড়ে বাসের সব চেয়ে বেশি ভিড়ে। নিস্পিষ্ট, সেই প্রায় জলে ডুবে যাওয়ায় আর্তিতে যেন অনু হাতের সীমার মধ্যে এসে যায়, যখন, তার হাত ওঠানোর সামান্য অবকাশও আর নেই। অথচ অনুর এত চেনা শরীর, প্রায় প্রতিটি রোমকৃপে চেনা শরীর, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্মৃতি নিয়ে আসে না, আসে এক সমগ্রতায় – যেখানে কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, যেখানে কোনো কিছুই খণ্ডিত নয়, যেখানে সব কিছুই সব কিছুর উপমা।
পরমহংস যেন মনে মনে এতক্ষণে নিজেকে গুছিয়ে ফেলতে পারে, আজ দোসরা শ্রাবণেও তাকে অনুর কাছে যেতে হবে না, তা হলে সে আর-এক দোসরা শ্রাবণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে। অথচ, পরমহংস জানে, সমস্ত ঘটনাটিই ত উলটে যেতে পারে--অফিসে গিয়ে হয়ত দেখবে বিনয় ছবি দিয়ে গেছে , নিউজএডিটর হয়ত বলবেন--ছবি আমি বেছে নেব, আপনি যান ; হয়ত আজ তার হাতে কোনো কাজই আর থাকবে না। তবু অনুর কাছে যাতে না যেতে হয় তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিচ্ছে পরমহংস।
বেলা বারটা নাগাদ বিনয় আসে।
‘তখন, এমন হঠাৎ চলে এলে, তোমাদের ছবির কথা জিজ্ঞেস করব, ভুলেই গেলাম।’
'বোলো। ছবি ত দিয়েই আসবে, আবার কী’
‘কী ছবি দেব'
'বাঃ, তোমার ত আজ বেলা দুটোর সময় দেয়ার কথা, কাল থেকে ত স্টোরি বেরুবে '
‘কী কী ছবি, তা-ও ত ভুলে গেছি, হাওড়া ব্রিজের ফুটোর অনেকগুলো ছবি ত তোমাদের দিয়ে এলাম’
'বোসো-না। শুধু হাওড়া ব্রিজের ফুটো দিয়ে কী হবে?’
‘তোমাদের নিউজ-এডিটর ত তাই বললেন’
‘কবে’
‘ঐ-যে, দিল্লি থেকে টিপ করল আর এখানে হাওড়া ব্রিজে এসে গুলি পিল হল--নো ঠকঠকাস', বিনয়ের কথায় পরমহংস হেসে ফেলল, পরমহংসের হাসিতে বিনয় সিগারেটের প্যাকেট বের করে বসে পড়ল, ‘তোমাদের থিমটা কী বলো ত, হাওড়া ব্রিজের ফুটো দিয়ে কালকের দিনটা ম্যানেজ দিয়ে দাও’
'সে কী করে হবে, কাল ত যাচ্ছে অন্য স্টোরি, তবে কালীদাকে বলে গিয়ে, তোমার জন্যে যদি ঘেসকে ব্রিজ করে দেন'
‘মানে আজ ঘেসের ছবি তুলতে হবে ?’
‘তাই ত কথা'
"তোমাদের ত হাইড্রান্টের ঢাকনা, হাওড়া ব্রিজের ফুটো এই-সব দরকার ছিল বলেছিলেন – “ডেথট্রাপস-"। পরমহংস হেসে ফেলে, ‘তুমি ভুলে গেছ, “ইজি ডেথস”।
‘বাবা তোমাদের নামের কথা ছাড় ত, আমি অশিক্ষিত মানুষ, শাটার টিপে পেট চালাই, এ-কাগজে যেটা বেচি কংগ্রেস-ই র্যালি বলে, অন্য কাগজে সেটাই বেচি সি-পি-এম র্যালি বলে’
‘নিশান?’
"একটা ফ্রন্ট শট, আর-একটা পেছন থেকে – যে রেট বেশি দেবে তাকে ঝাণ্ডা দেব, পয়সা কম হলে আর্ট দেব-পেছন থেকে মানুষের মাথা, হাত ঝাণ্ডার আর ফেস্টুনের ডাণ্ডায় ব্যস, তবে বেশিদিন করে খেতে হবে না'
‘কেন’
‘এরপর ত রঙিন ছবি ছাপতে শুরু করবে, তখন ত মাল ক্যাচ’
'আমাদের কাগজ বুঝি তোমাকে পয়সা কম দেয় তাই হাওড়া ব্রিজের ফুটোর ছবি চালাচ্ছ ঘেসের ছবি বলে—’
বিনয় হো হো করে হেসে ফেলে, ‘শোনো, পরমহংস, আমার ভাই ছবি তোলা হয় নি। এক অ্যাড-এজেন্সি ধরেছিল একটা ক্যাম্পেনের জন্যে । তিন-চারদিনের মধ্যেই প্রেজেন্টেশন, মালিকরাই দেখবে। ক-দিন পাগলের মত কাজ করলাম। কাল সন্ধ্যাবেলায় পার্ক হোটেলে মালিকদের কাছে প্রেজেন্ট করা হল ব্লো-আপ করে, লিখে-ফিখে, এঁকে-টেকে, তা-ও আবার তিন-তিনটে মডেল নিয়ে তিনটে ডিফারেন্ট সেট, শালাদের কখন কোন মেয়েছেলের মুখ পছন্দ হবে কে জানে, বলবে, ই লেড়কি বহুৎ হাসতা হ্যায়, ত দিলে গম্ভীর মেয়েছেলের মুখ ত বলবে ই ত রোতা হ্যায়, আমি বাবা কোথা থেকে এমন মুখ জোগাড় করব যা হাসবেও না, কাঁদবেও না, সেই ত এক মেয়েছেলে তার দুটো চোখ, দুটো কান, --তা আর কত কাটাছেড়া করব বলো—’
'কেটে-কেটে দিলেই পারতে, এর ঠ্যাং, ওর গলা, একজনকেই মনে হত কত রকম’
‘'সে কি আর তোমার বুদ্ধির জন্যে বসেছিলাম ? একেবারে কাটা পোনার মত করে সাজিয়ে দিয়েছিলাম তিন-তিনটে মেয়েছেলে, দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা করে মুড়ো, কোন মুড়োর কোন পেট, কোন পেটির কোন গাদা, কোন ল্যাজা'
‘এত করেও হল না’
ছবি নিয়েছে দুটো, ক্যাম্পেনটা হল না, লাভের মধ্যে বিয়ারে ঢোল হয়ে বাড়ি ফিরলাম, এখনো ঢেকুর উঠছে, আর এ-সব করতে গিয়ে তোমাদেরটা করাই হয় নি। তোমাদের ঘেসই চাই, ফুটো হলে হবে না?’
‘সে কালীদাকে গিয়ে বলো, ঘেসকে ফুটো করে দেবেন'
‘কালীদাকে কি এ-সব বলা যায় ভাই, গুডউইল চলে যাবে, ওখানে বলতে হবে একেবারে ফুটোর মধ্যে ঢুকে গিয়ে ফুটোর ছবি তুলে এনেছি, তবে ত দাম দেবে’
‘সে ত হল। এখন হবেটা কী?’
‘একটা কাজ করো, তুমি আমাকে থিমটা মনে করিয়ে দাও ত। মানে, মরাটরার ব্যাপার ত। তুমি চট করে রেডি হয়ে যাও। আমি কিছু ছবি এনেছি, নেগেটিভও এনেছি। দেখি কিছু স্টক পাই কিনা। না-হলে এখান থেকে স্পটে গিয়ে তুলে তোমাদের স্টুডিয়োতে প্রিন্ট করে নেব।’
‘এর মধ্যে হবে?’
'আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি রেডি হয়ে নাও-না, ছবি দেখিয়ে স্পেসটা রেখে দিতে বলব, তার পর পেষ্টিং ত হবে রাত বারটায়, হয়ে যাবে, আরে ডেথ ত, দেখো, আমার স্টকেই পেয়ে যাবে, তুমি রেডি হয়ে নাও, আমাকে থিমটা বলে যাও,’ বিনয় আর-একটা সিগারেট ধরায়।
পরমহংস দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবে থিমটা কী বলবে। বিনয় তার বিরাট ব্যাগের ভিতর থেকে তিন-চারটি ফটোর খাম বের করে। এক ঝাঁকিতে একটা খাম উপুড় করে চৌকির ওপর ছড়িয়ে দেয়, তার পর হাত দিয়ে আরো ছড়িয়ে দেয়-যাতে সবগুলো দেখা যায়। ঘরের মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পরমহংস দেখে তার চৌকিময় ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু মৃতদেহ--কখনো ক্লোজ-আপে, যেমন কাগজে পুলিস বিজ্ঞাপনে ছাপে ফুলে-পচে-গলে যাওয়া মুখ, চোখ দেখাই যায় না, অনেকগুলো ছবির ওপর দিয়ে একটু ঝঁকে সেই ছবিগুলোই একসঙ্গে টেনে হাতে তুলে বিনয় বলে, 'আনআইডেন্টিফায়েড ডেডবডি।হবে?’
একটু যেন ভাবতে হয় পরমহংসকে ।
নিউজ-এডিটর বলেছিলেন, হাওড়া ব্রিজের ফুট্টো দিয়ে সেই ছেলেটি গঙ্গায় পডে যাওয়ার দিন, রাতে, ‘আর ইউ ইনটারেসটেড ইন ডেথ?’ বলেছিলেন, ‘সবাই ত এখন হাওড়া ব্রিজের ফুটোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আমরা একটু অন্য রকম স্টোরি করি।’ ক্যাপশনটা ভেবে ফেলেছিলেন, ‘কালক্যাটাস ইজি ডেথ।’ পরমহংস যেন বুঝে উঠতে পারছে না ভেবে আর-একটু ব্যাখ্যা করেছিলেন, কলকাতায় কত সহজে মারা যাওয়া যায়, ফাইলটা দেখে নিতে বলেছিলেন, সেভেনটি এইটে স্টেটসম্যানে ছবি বেরিয়েছিল, একটা বাচ্চা হাইড্রান্টে পড়ে মরে ভেসে গঙ্গার পারে চলে এসেছে, ভাট ছিল বলে ছবিটা তোলার চান্স পেয়েছিল, কিন্তু হাইড্রান্ট ত খুব কমন থিম, দমদমে একবার ঘেস তুলতে-তুলতে ঘেস চাপা পড়ে পনেরটা না বিশটা বাচ্চা মারা গিয়েছিল, ঘেস নীচ দিয়ে তুলতে থাকে খুঁড়তে থাকে, তলাটা ফাঁকা হয়ে যায়, চুরি করে তোলা গর্তের ভিতর ঢুকে গেলে আর কেউ দেখতে পায় না, বলেছিলেন, ঘেস দিয়েই শুরু করতে, তাতে নাকি একটা ‘বিল্ড-আপ’-এর সুযোগ আছে, ঘেস নিয়ে কী কী হয়, চুরি-ঘুষের ব্যাপার আছে, ফিল-ইন করার সময় সিকিউরিটি চেক নিয়েই বহু কেলেংকারি, অনেক টাকার লেনদেন, ফলে ডেথ ইজ ইজি, গঙ্গাপারে কোনো পুরনো বাড়ি ধসে গিয়েছিলো, বৃষ্টি নেই, বাদলা নেই, এমনিই ধসে গিয়েছিলো, গঙ্গাপাড জুড়ে এরকম পোড়োবাড়ির বরান্দায় শয়ে শয়ে লোক ঘুমোয়, ঐ ঘটনাতে সেদিন রাতে জনা পঞ্চাশ মারা গিয়েছিল, বলেছিলেন, "ফটোগুলো গঙ্গার ওপর থেকে নিতে বলবেন নৌকা থেকে’, বলেছিলেন, ‘ডোন্ট রাব দ্যা অবভিয়াস’, বলেছিলেন, ‘স্টোরিতে মৃত্যুটা কত সহজ এই ভাবটা আনবেন’, বলেছিলেন, ‘দেয়ার কামস দি ল্যাংগুয়েজ’, কিন্তু বলেছিলেন, কিন্তু, ‘বাট অলওয়েজ গিভ দ্য সেন্স অব দ্য কুইয়ার’, বলেছিলেন, ‘সব চেয়ে সহজ মৃত্যুই সব চেয়ে রহস্যময়’। বলেছিলেন, ‘ঘেস দিয়েই শুরু করুন’। বলেছিলেন, ‘আয়রনি আছে একটা। কলকাতার প্রায় সব হাউসিং প্রজেক্টের জমি ঘেস দিয়ে ভরাট করা, অথচ সেই ঘেস হচ্ছে আসলে কবরখানা’, বলেছিলেন, 'ক্যালকাটা ইজ গোয়িং হাই অন গ্রেভস--'
সেদিন কেউ টেরই পায় নি ঘেস-এর প্রান্তরে কোথায় কিছুটা ধসে গেছে। যতটুকু বসেছিল, কয়েকজন মিলে হাত দিয়ে সরালেও কিছু বাচ্চাকে বাঁচানো যেত। কিন্তু তল থেকে বাচ্চার অতটুকু-টুকু হাত দিয়ে তাদের ওপর থেকে ঘেস সরাতে পারে নি। যত ছটফট করেছে, ওপর থেকে তত ঘেস এসে ওদের চাপা দিয়েছে। বাচ্চারা নাকি ঝুড়িগুলো আঁকড়ে ছিল, ভেবেছিল নাকি পাহারাঅলা বুড়িগুলো কাড়তে এসেছে। সেই খাদটাতে সেই একই ভাবে এখনো বাচ্চারা ঘেস চুরি করে সারা দিন ধরে । ওপর থেকে করলে আইন বাঁচে না, তাই প্রথমে গুহা বানিয়ে তার ভিতর ঢুকে যায়। অতটুকু-টুকু শরীর আড়াল করতে আর কতটুকু গুহার দরকার হয়। কুকিং গ্যাসের সাপ্লাই কম, কোল বল কলকাতা শহরের বেশ ভাল ইনডাস্ট্রি।
বিনয় জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমাদের কি আইডেনটিফায়েড ডেথ,নাকি, আনআইডেনটিফায়েড’।
জিজ্ঞাসা করে বিনয় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বলেই পরমহংসকে বিড়বিড় করে একটা উত্তর দিতে হয় । বিনয় সেটা শুনতে পায় না, ‘অ্যা?’
'না, আইডেনটিফায়েড আর কোথায়?’
‘মানে আনট্রেসড ডেডবডি, সে ত এই এত, আরে আমার স্টার্টই ত মর্গে, তাহলে ত এখান থেকে বেছে নিতে পারো’।
‘না ঠিক এরকম নয়'
‘তা হলে ? তোমার থিমটা বলো', আর-একটা বড় খাম ব্যাগ থেকে বের করে পরমহংসের দিকে ঘুরে বসে বিনয়, ‘তুমি বলো, আমি একটু খোঁজাখুঁজি করি, এর ভিতর তুমি তৈরি হয়ে নাও, তার পর চলো, দু ভাই বেরিয়ে পড়ি, ইন সার্চ অব ডেথ, না কি কী যেন ক্যাপশান, কী ডেথ?’ বিনয় আর একটা সিগারেট ধরায়।
এই প্রশ্নটিতে পরমহংস যেন শুরু করার সুযোগ পায়। সে ধপ করে মেঝের ওপর বসে পড়ে, ‘ইজি ডেথ। মানে ঐ হাওড়ার ঘটনাটার পরই—’
'মানে, ফুটো কেস?"
‘হ্যাঁ, ঐ ঘটনাটার পরই আমাদের নিউজ এডিটরের মাথায় আসে কলকাতায় এ রকম আকছার মরে যাওয়ার মত ব্যাপার কী কী ঘটছে তার একটা ধারাবাহিক কাহিনী করবেন। মানে সব কাগজই ত হাওড়া ব্রিজের ঐ-সব ছবি ছাপতে লাগল কয়েক দিন ধরে –’
‘ও ভাই ঐ কদিন যে ফুটোর ডিম্যান্ড ছিল ভাবতে পারবে না, এত ফুটে৷ কোথায় পাই বলো ত, হ্যাঁ, এবার বলো, ফাইন, মানে সিরিয়াল হবে, অনেকগুলি ছবি যাবে, এই ত, ডেইলি না গ্যাপ দিয়ে?’
পরমহংসের মনে হয়, বিনয় তাকে কথাতে নিয়ে আসতে চায়। পরমহংসের মনে হয়, বিনয় তার বিষয়টা এতক্ষণেও বুঝে উঠতে পারে নি, এ হতেই পারে না কিন্তু বিনয় তার কাছে মৃত্যুর একটা ধারাবিবরণ শুনতে চায়। কিন্তু পরমহংস ত আপত্তি করে নি। সে ত নির্দিষ্ট দিনে লেখা জমা দিয়ে দিয়েছে। প্রমাণ রেখেছে, সে ‘ডেথে ইনটারেসটেড’। কাজ এগিয়ে রাখতেই সে বিনয়ের কাছে গিয়েছিল। সল্টলেকের ভিতরে না হলে যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না। তা হলে ?
কথা বলতে-বলতে পরমহংস বোঝে সে অনুর কাছ থেকে সরে আসছে।
‘না, রোজই বেরবে, ক-দিনের আর ব্যাপার, দিন সাতেক, তবে আর কাউকেও যদি বলে থাকেন, সেটা আমি জানি না, তা হলে হয়ত আরো বেশি দিন চলবে’
‘তা বলো, চলবেটা কী’
‘মানে কলকাতায় কত রকম করে লোকে মারা যায়’,
‘ফটো তুলতে হবে ত, পরিষ্কার করে বলো সাইট কোথায়, ডেডবডি চাই কি না, ডেভবডির মুখ চাই, না বডি চাই'
চৌকির ওপর ছড়ানো ছবিগুলি থেকে নির্ভুল একটি তুলে এনে পরমহংসের কোলের ওপর ফেলে দেয়। তিন-চারজন কলকাতার রাস্তায় পড়ে আছে, পুলিসের ধাবমান ক্লোজ-আপের ওপারে। ছবিটির দিকে তাকিয়ে পরমহংস ভাবতে পারে ‘ক্যালকাটাস ইজি ডেথ...’
‘হ্যা, এটাও হতে পারত, কিন্তু আমার লেখার ছবি ত এক-একটা নির্দিষ্ট জায়গার—‘’
‘জায়গা বলো'
'ঘেস জমায় যেখানে, বা, জায়গা ভরাট চলছে’
‘তিনজলায় এখন বিরাট কাজ হচ্ছে। সেখানে—‘
বাচ্চারা নীচে সুড়ঙ্গ কেটে..."
এখন দুজনে মিলে এই শহরের মৃত্যুর মানচিত্র এঁকে ফেলবে, মুখে-মুখে । পরমহংস বোঝে, যত স্পষ্ট, নির্দিষ্ট হবে সে মানচিত্র, গল্ফ লিঙ্কের কোনো ফ্ল্যাটের সেই দরজার ফ্রেম তত দূর থেকে দূরে সরে-সরে শেষে মানচিত্রের বাইরে চলে যাবে। পরমহংস স্মৃতিতে আনার চেষ্টা করে-তার নিউজ-এডিটরের ভাষা, যাতে বিনয়কে অবিকল বলতে পারে,
'নট টু রাব দি অবভিয়াস, ক্যালকাটাস ইজি ডেথ'...
‘তুমি এইটা নিতে পার, সকালে ট্রাক ফুটপাথে উঠে গেল, সারি দিয়ে সব ঘুমাচ্ছিল, চষে দিয়ে নেমে গেল, কী, হবে না?’
‘হ্যা, হতে পারে –’
‘দেখো’, হাতের খামটা উপুড় করে পরমহংসের কোলের ওপর ঢেলে দেয় আর মরা মানুষের ছবিগুলো ঝর ঝর করে এসে জমা হয়।
‘তাড়াতাড়ি দেখো, তার পর বেরিয়ে কয়েকটা সাইটে যাব', বিনয় তার ব্যাগ থেকে আর-একটা খাম টেনে বের করে। আর, নিজের কোলের ওপর জমে ওঠা ছবির ওপর পরমহংস ঘাড় নামায়--থালাভরা জলে যেমন গ্রহণের সুর্য দেখে--মৃতদেহ-ভাসা স্রোতে আরো কত যুগ-যুগান্তরের পারে চলে যাচ্ছে দোসরা শ্রাবণ ।
১৯৮৩
0 মন্তব্যসমূহ