মতি নন্দীর গল্প চতুর্থ সীমানা নিয়ে আলোচনা

অমর মিত্র

মতি নন্দী একটি নাতিদীর্ঘ আত্মকথন দ্বাদশ ব্যক্তিতে লিখছেন, ‘’ যে দেশে এখনো কুড়ি কোটিরও বেশি মানুষ অর্ধাহারে ধুঁকছে, শতকরা ৭০জন লিখতে পড়তে জানে না, সে দেশের শিল্পীর পক্ষে দেশের এই অবস্থাটা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়, অবশ্য যদি যোগাযোগ থাকে। ‘’স্ট্রাইকার’’ বা ‘’কোনি’’ এই যোগাযোগেরই একটা দিক।“ মতি নন্দী খেলার মাঠ নিয়ে পাঠকপ্রিয় হয়েছিলেন, কিন্তু সেই খেলার মাঠে তাঁর প্রবেশ হেরে যাওয়া মানুষের কাহিনিকে জীবনের অদম্যতায় নিয়ে যাওয়াতে। 



 তিনি এই শহরের আদি মানুষ। পুরোন উত্তর কলকাতার পুরোন বাসিন্দা ছিল তাঁর পরিবার। এই শহরের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, বস্তিবাসী পরিবার, হেরে যাওয়া মানুষ, নিষ্ঠুর মানুষ নিয়ে মতি নন্দীর গল্প। তিনি ছেচল্লিশের দাঙ্গা দেখেছেন, ১৯৪৩-এ কলকাতা শহরের পথে অগুন্তি কঙ্কালসার শব দেহ, আর ওই শতাব্দীর সাতের দশকে দেখেছেন অবিশ্রাম খুনোখুনি, মৃত্যু। এইসব তাঁর মনোজগতে প্রবেশ করে একটা গড়ন দিয়েছিল। তার ফলে কত আশ্চয সব গল্প পেয়েছি আমরা। 

তিনি এই নগর কলকাতার প্রকৃত ভাষ্যকার। বেহুলার ভেলা, শবাগার, একটি পিকনিকের অপমৃত্যু, চোরা ঢেউ, দ্বাদশ ব্যক্তি, নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান, বুড়ো এবং ফুচা, কপিল নাচছে বা চতুর্থ সীমানা---কত গল্পে এই ভাষ্য। মতির গল্প পড়ে নিজের নিরূপায়তা, নিজের ভন্ডামিকে চেনা যায়। 

মতি নন্দী কিন্তু শুধুই কোনি বা স্টপার, স্ট্রাইকারের লেখক নন। তিনি শবাগার, দ্বাদশ ব্যক্তি, বেহুলার ভেলা বা চতুর্থ সীমানার লেখক। শবাগার গল্পে মুকুন্দর বাড়ির নিচের তলার ভাড়াটে গৌরাঙ্গকে হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে ক্যানসার বলে। গৌরাঙ্গর বউ শিপ্রার উপর মুকুন্দর নজর। মতি লিখছেন, ‘’’শীতলপাটির মতো গায়ের চামড়া, দেহটি নধর।“ মুকুন্দ সক্কালে খবরের কাগজে বাসীমুখে চারটি মৃত্যু সংবাদ দেখেছে। বউ লীলাবতীর সঙ্গে মৃত্যু নিয়ে কথা বলে সাতসকালেই আর দ্যাখে ভাড়াটের যুবতী বউ শিপ্রাকে। স্বামী শুয়ে বিছানায়, মরে যাবে শিগগির, শিপ্রা মুকুন্দর কাছ থেকে রেশনের টাকা নেয়, বিনিময়ে শিপ্রার গায়ে হাত দেয় মুকুন্দ। এই গল্পটি যেন প্রাণহীন মানুষের। গোটা শহর শবাগার হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। গভীর রাতে শিপ্রাকে তার ঘরের মেঝেতে শোয়াতে গেলে শিপ্রা বলে, ‘একি, একি ! ঘরের মধ্যে নয়। ও রয়েছে যে !’ মুকুন্দ বলে, “থাকুকগে, ও তো মরে যাচ্ছেই, তাহলে আর ভয় কিসের।“ 

 একটি পিকনিকের অপমৃত্যু গল্পে কতগুলি যুবতি দল বেঁধে ঢিলিয়ে তাদের ক্লাসের একটি ছেলেকে গাছ থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলে। 

মতি নন্দী মানুষের ভিতরের অন্ধকারকে চিনেছেন তাঁর শৈশব থেকে, সেই ১৯৪৩ থেকে। সেই অন্ধকার আর মানুষের নিরূপায়তা চতুর্থ সীমানা গল্পের ভিতরও পাই। 

চতুর্থ সীমানা এক সামান্য দম্পতি আর তাদের পরিবারের কথা। নিখিল তিন কাঠা জমি কিনেছিল কলকাতার কাছে নতুন গড়ে ওঠা এক উপনিবেশে। ছুটির দিনে নিখিল তার বউ রুবিকে নিয়ে সেই জমি দেখতে যায়। এমন উপনিবেশের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। সেই যে সেখানে ছিল শুধু জমি আর জমি। খোলা মাঠ। দেখলে মনে হয় সমুদ্র, যেন আকাশটা গড়িয়ে পড়েছে। কলোনির ভিতরে রাস্তা, আলোর খুটি, বিকেলে বেরিয়ে পড়া মানুষজন দেখতে দেখতে নিজেদের তিনকাঠার দিকে এগোতে থাকে নিখিল। যেতে যেতে নতুন গড়ে ওঠা একটি বাড়ি হাত বাড়িয়ে দেখায় রুবিকে। অধ্যাপকের বাড়ি। খুব পন্ডিত। খুব বড়লোক কি? রুবির ওই এক সঙ্কোচ। 

এখানে কত কত বড়মানুষের বাড়ি। জজের জমি, আই, এ,এসের জমি, তাদের ভিতর তারাও আছে। কলোনির রাস্তা অনেকটা গিয়ে থেমে গেছে। এদিকের গ্রাম গ্রাম ভাব যায় নি এখনো। নিখিল একটি জায়গা দেখিয়ে বলে, তাদের জমি। পঁচিশ নম্বর প্লট। পিলার আছে তো ? বুনো ঘাসে ভরে যাওয়া কাদাজলের সেই জমির পিলার খুঁজতে আরম্ভ করে নিখিল আর রুবি। বিস্তীর্ণ সেই কাদাজলের মাঠের ভিতর পিলার ছাড়া তাদের নিজস্ব জমির কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের কত স্বপ্ন সেই জমিটুকু নিয়ে। বাড়িটি কেমন হবে সেই সব কল্পনা জড়িয়ে গেছে জমিটিকে ঘিরে। সেই জলকাদার ভিতরে নেমে তারা পিলার খুঁজতে আরম্ভ করে। কাঁটা ঝোঁপ আর বুনো ঘাসের ভিতর নেমে পিলার খুঁজতে গিয়ে রুবির শাড়ি ছিঁড়ে যায়, নিখিলের আঙুল কেটে যায়। শেষ অবধি তারা খুঁজে পায়। 

প্রথমটি পেতে সময় লেগেছিল, পরের তিনটিও পায়, কিন্তু তাদের ভিতর একটি ভেঙে গেছে। তারা পরে কোনোদিন এসে সেই পিলারটি নতুন করে বসিয়ে দিয়ে সীমানাগুলি ঠিক করে দেবে। জমি তো যাওয়ার নয়। আবহমান কাল থাকবে। তারা হু হু বাতাসে সমুদ্রের গন্ধ পেল। 

বাড়ি ফিরে নিখিল ও রুবি দ্যাখে একটি অতি শীর্ণ যুবক বসে আছে ঘাড় হেট করে। ছোটকাকার ছেলে। সঙ্গে চিঠি, কাকিমার মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। ক্ষয় রোগ। সাহায্য চেয়েছে কাকা। নিখিল সামান্য আয়ের মানুষ। নিখিলের সামনে সমস্তকিছুই হয়ে ওঠে দুঃসহ। সে কাকার ছেলের জন্য কিছু খাবার আনতে বেরোয়। 

মতি নন্দী এই গল্পে এক নিরূপায় নিম্নবিত্তের জীবনকে নেড়েচেড়ে দেখেছেন। মমত্ব আছে সেই দেখায়। শবাগার বা বেহুলার ভেলা গল্পের ব্যক্তির নিষ্ঠুরতা এখানে কম, কিন্তু যা আছে তা হলো স্বপ্নটি দুঃস্বপ্নে বদলে যাওয়ার নিষ্ঠুর বাস্তবতা। বাইরে বেরিয়ে নিখিলের সঙ্গে দেখা হয় ড্রাফটসম্যান অমিয়র। সে তার জমির প্ল্যান করেছে। বলল, তিরিশ নয় চল্লিশের কমে নিখিলের বাড়ি হবে না, অবিলম্বে শুরু করতে হবে। নিখিল তার ক্ষমতা জানে। জানে সমস্তটাই অসম্ভব তার পক্ষে। অত টাকা! 

অমিয় গেল প্ল্যানটি আনতে। নিখিল দাঁড়িয়ে থাকে সেই গলির ভিতরে। তার সামনে থেকে গলি উধাও হয়। নিকষ অন্ধকারে হু হু হাওয়া বইতে থাকে সমুদ্রের। সে তার তিন কাঠার ভিতরে দাঁড়িয়ে। তিনটি পিলার উঁচু হয়ে উঠল, চতুর্থটিতে ছোটকাকি পিলার হয়ে হাসছে। নিখিল বলতে চায়, ওইটা তার জমি, বাড়ি করে সুখে থাকতে চায় সে। কথাটি শোনা মাত্র মাটির ভিতর বসে যেতে থাকে চতুর্থ পিলারটি। নিখিল আর্তনাদ করে ওঠে, ছোটকাকি চলে গেলে তার জমিটিও হারিয়ে যাবে। যেও না ছোটকাকি। 

মতি নন্দী এই গল্প লিখেছিলেন। শবাগার ও চতুর্থ সীমানা-দুই গল্পই। মুকুন্দ ও নিখিল, দুজনের কথাই। আমার কথা আপনার কথা। এই শহরের কথা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. তাকে গড়া দরকার। পরের প্রজন্মকে তাকে চেনানো দরকার।

    উত্তরমুছুন
  2. অনাবৃত ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে হলে দারস্থ হতে হবে মতি নন্দীর কাছে ।

    উত্তরমুছুন
  3. নাগরিক জীবনের নিপুণ রূপকার বাংলা সাহিত্যের 'দ্বাদশ ব্যক্তি' হতে পারেন না । উত্তর কালের কাছে তাঁর পূর্ণরূপ আরও উন্মোচিত হবে ।

    উত্তরমুছুন