ঢাকা-আরিচা সড়কে ঘনঘন দূর্ঘটনার কারণ আজ বেশ আঁচ করতে পারে মহিদুল।
বাসে উঠে অন্তত তিনবার, অই মিয়া, আস্তে চালাও বলে ড্রাইভারকে সাবধান করেও কোন ফল হয় না। কে শোনে কার কথা! রাতের রাস্তা যেন রেসিং-ট্রাক। খালি রাস্তা পেয়ে উড়ে যাচ্ছে । বাইরে যদিও হালকা কুয়াশা, ছেঁড়াছেঁড়া। আর আকাশে পলায়নরত মেঘেরা একটু পরপরই ঢেকে দিচ্ছে শুক্লপক্ষের চাঁদ। কাল ছিল বিজয়া দশমী। বিসর্জনের পর দেবীর কৈলাশে ফিরে যাবার দিন। রাস্তায় রাস্তায় ছিল মণ্ডপ শোভাযাত্রা। তবে আজ বেশ ফাঁকা।
আরমান টেক্সটাইল, মনোরমা ফার্মাসি, সুরুজ মিয়ার ভাতের হোটেলের পর গরু ছাগল মোটাতাজাকরন প্রকল্প। বাম দিকে অনতিদূরে ফসলী জমির শেষে কুয়াশার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দৃশ্যমান গ্রামটিকে মনে হচ্ছে নাভি বের করে দাঁড়িয়ে থাকা যেন রহস্যময় কোন নারী। মোটাতাজাকরন প্রকল্পের ঠিক পাশ দিয়ে অতিশয় রুগ্ন একটি খাল সাপের লেজের মতো সরু হয়ে পরিশেষে গ্রামের নাভির ভিতর ঢুকে গেছে।
ছোট্ট একটা বাঁক পিছনে ফেলে ডান দিকে টার্ন নিতে হয় এখানটায়। অদূরে এক কালের প্রমত্ত পদ্মা। তবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার মাঝখানে পদ্মা এখানে ওখানে জেগে ওঠা চরের কারণে এখন প্রায়শ দীঘির জলের মতো ধিরস্থির। ফেরী পারাপারের জন্য যেতে হয় আরো খানিকটা পথ।
ডান দিকে টার্ন নিতে না নিতেই মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায় বাস। আর এগুনো যাবে না। সামনে বাসের মিছিল যেন। আর ঠিক তখনই খবরটা কানে আসে মহিদুলের।
কাম অইছে ওস্তাদ। আইজ আর যাওন যাইবো না। কুয়াশায় ফেরী আটকাইছে নদীর মধ্যে।
হেলপারের কথায় গা করে না ড্রাইভার। যেন তার জানাই ছিল পাটুরিয়া ঘাটে এমনটাই হবে। পথে হালকা কুয়াশার ভিতরেও যেন এরকম একটা সিগনাল ছিল। সে বলে, অই মদনা, চা লইআয়। খাইয়া ঘুমদি।
এ ধরনের পরিস্থিতি মোটেই নতুন নয়, অভিজ্ঞতা আছে মহিদুলের। এখন ছ’আট ঘন্টায় পার পেলে হয়।
অনেকেই নেমে গেছে বাস থেকে। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। ডানপাশের মাঝবরাবর সারিতে এক দম্পতি, মেয়েটি খুবই রুগ্ন, কাঁচের জানালায় মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। দৃষ্টি তার যেন চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝপথে কোন অজানা জায়গায় স্থির। মহিদুল দেখে, তার চোখেমুখে আধো আলো আধো অন্ধকার। মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমন্ত লোকটি সত্যি সত্যি ঘুমাচ্ছে, না চোখ বুজে আছে বুঝা যায় না। তার ডান হাত কঠিনভাবে ধরে আছে মেয়েটির বাম হাতখানা।
বাস যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে তার দু’পাশের অধিকাংশ দোকানপাটই খাবার-দাবারের। নানা ধরনের গান বেজে চলেছে। মেরা জুতা হায় জাপানী, একবার যেতে দে মা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, শোনো একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে’র অপূর্ব মিশ্রণ। ইলিশ ফ্রাই হচ্ছে কোথাও। প্রিয় পরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগছে। চায়ের তেষ্টা পায় মহিদুলের। সে বাস থেকে নেমে আসে। নামার সময় মেয়েটির আবার চোখে চোখ পড়ে তার। সে দেখে, মেয়েটি গাঢ় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ নামিয়ে নেয় মহিদুল।
২
আকাশে শুক্লপক্ষের সেই চাঁদ এখন মধ্যগগনে। মরা জ্যোৎস্না আর জমাটবাধা কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারদিক। দূরে দৌলতদিয়া ঘাট, আরিচার ওপারে। মাঝখানে যে পদ্মা তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেন একটা কুয়াশার টানেল, এমন ভ্রম হয় মহিদুলের। হালকা শীত শীত একটা ভাব। চা শেষ করে বাসে উঠে আসে সে।
ভাইজান কি খুলনা যাচ্ছেন ?
এই প্রশ্নে মহিদুল দেখে সহসা একটি লোক, যাকে সে একটু আগে বাসের ভিতর জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখেছে। ভাইজান কি খুলনা যাচ্ছেন, বলে লোকটা তার ডান পাশের খালি আসনটিতে বসে পড়ে।
আবারও সেই একই প্রশ্ন লোকটার। অচেনা লোকের এমত প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত বোধ করে মহিদুল। এই প্রথম লোকটাকে খুব কাছ থেকে পরিপূর্ণভাবে দেখার সুযোগ হয় তার। গলায় মাফলার, পরনে পাঞ্জাবি, তার উপর মেরুন রঙের সোয়েটার, কাঁধে কাফনের কাপড়ের মতো ধবধবে শাল। সারা মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় মাংকি ক্যাপ, চুল আছে কি নেই বোঝা যায় না।
আমিও অই খুলনার পথেরই যাত্রী, তবে পথে দিন দু’এক দৌলতদিয়া ঘাটে থাকতে হবে।
লোকটার মুখ থেকে ভুরভুর করে জর্দার গন্ধ বেরুচ্ছে। জর্দার এই গন্ধটা একদম সহ্য করতে পারে না মহিদুল। সে অসহায়ের মতো লোকটির কাঁধের উপর দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি তখনো তাকিয়ে আছে জালানার বাইরে।
ও ভালো কথা, আপনারে তো আমার পরিচয় দেওয়া হয় নাই। আমার নাম হারু, হারু খালাশি। সাপ্লাইর ব্যবসা করি। এক সময় সারা বাংলাদেশের চৌদ্দ জায়গায় আমার এই ব্যবসা ছিল। এখন দৌলতদিয়া ঘাটে সাপ্লাই দিতে দিতেই নান্দিবিনাশ অবস্থা। আম্বিয়া খালার লগে আমার কনটাক্ট দশ বছরের। আমরা যদিও সমবয়সি, সবাই তারে খালা ডাকে দেইখা আমিও ডাকি। তা একদিন...
বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলেই যাচ্ছে লোকটা, আর একটু পরপর নজর রাখছে মেয়েটির দিকে।
ঠিক এসময় মহিদুলের মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, কি সাপ্লাই দেন আপনি? রড সিমেন্ট, না বালু পাথর? যা দাম বেড়েছে আজকাল। লাভ হয়?
এমত প্রশ্নে আরো ঘনিষ্ট হয়ে বসে হারু খালাসী। বলে, কী যে বলেন ভাইজান। যে জিনিষের মধ্যে পরান নাই অই জিনিশের ব্যবসা হারু খালাসী করে না। আমি যে জিনিশ সাপ্লাই দেই তার মধ্যে পরান আছে, আছে আনন্দ ফূর্তি। খুবই সনাতন ব্যবসা।
হারু খালাসীর কথাবার্তা ধ্বন্ধের মধ্যে ফেলে দেয় মহিদুলকে। সে অতিশয় বিপন্নবোধ করে। ধূরন্ধর হারু যেন টের পায়, তার কথাবার্তা দিশেহারা করে ফেলেছে মহিদুলকে। সে বলে, ভাইজান, আর একটু খোলশা করে বলি,
অই যে ওপারে দৌলতদিয়া ঘাট, আমি ওখানে মাল সাপ্লাই দি। রক্ত-মাংসের মাল। এ আমাদের চার পুরুষের সনাতন খানদানী ব্যবসা। তবে আমি পিম্প না। প্রাইভেট কাম করি না, প্রাইভেট কামে গ্যাঞ্জাম অনেক। জনগনের জন্য কাম করি।
কি রকম- মহিদুলের এ প্রশ্নে যেন কিছুটা বিস্মিত হয় হারু খালাসী। লোকটা ছাগল নাকি! কিছুই কি বোঝে না ! সে বলে, অই যে দৌলতদিয়ার কথা বললাম আপনারে, একটু খুইল্লাই বলি, তামাম দুনিয়ার সবচে’ বড় পল্লী।
৩
আপনারা বলেন যৌনপল্লী, আমরা বলি হারেমখানা। গরীবের হারেমখানা। বাংলাদেশের নানা জায়গায় এরকম চৌদ্দটি গরীবের হারেমখানা আছে। সব হারেমখানার লাইসেন্স আছে। মানুষ ফুর্তি করতে আসে, ফুর্তি কইরা চইল্লা যায়। কারো তো কোন ক্ষতি হয় না। এই দৌলতদিয়ায় কতো মানুষ আসে রোজ আপনার ধারনা আছে ? সাড়ে তিন হাজার। তাগো ফুর্তির জোগান দেয় আড়াই হাজার সেবাদাসী। ভদ্রভাবে আপনারা যাদের দেহজীবী, যৌনকর্মী বলে থাকেন। মানুষেরা এখন কিছু ভদ্র সভ্য হয়েছে, আজকাল কেউ আর ওদের বেশ্যা, খান্কী, রান্ডি, পতিতা বলে না।
তা তুমি অই রোগাশোকা পাটকিলে মেয়েটাকে দৌলতদিয়া নিয়ে যাচ্ছো যৌনপল্লীতে বিক্রীর জন্যে ? ওই তাহলে তোমার সাপ্লাইয়ের মাল?
জী স্যার।
তোমার মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কি কিছু নেই ? সাহস করে বলে ফেলে মহিদুল।
খুব সস্তা একখানা বচন দিলেন ভাইজান। অইসব থাকলে তো আর এ লাইনে কাম করা যায় না। আর তাছাড়া আমি যা জানি আপনি তো তা জানেন না।
যেমন?
মেয়েটির অবস্থা আপনি তো কিছুই জানেন না। জানেন?
না।
তাহলে শোনেন, জগৎসংসারে ওর আপন বলে কেউ নেই আর। ও বাপ-মা ভেসে গেছে সিডরে। আর ও, মানে অই ফতি কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে একদিন এই শহরে এসে উঠল। কিন্তু কোথাও ঠাই হ’ল না। প্রথমদিকে কিছুদিন এ বাড়ি ও বাড়ি করে শেষে আবার ভাসমান কচুরিপানা। আমি ওরে প্রথম দেখি সদরঘাটে।
না খেয়ে খেয়ে একেবারে হাড্ডিসার। তবে সেদিন ওর চোখ দুটি দেখে মনে হয়েছিল, ভিতরে আগুন আছে। শুধু নিভু নিভু সলতেটা একটু উস্কে দিতে হবে। ওকে বাসায় এনে নিজের কাছে রাখলাম, যত্ন আত্তি হল মাসকয়েক। চেহারার কিছু অন্তত ফিরে পেল ফতি। তারপর একদিন সময় সুযোগ বুঝে প্রস্তাবটা দিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার কথায় কেঁদেকেটে বুক ভাসাবে। কিছুই করল না, বরং একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। তারপর থেকেই কবে নিয়া যাবেন, কবে নিয়া যাবেন করতে থাকে।
তাই বলে এই রকম একটা রোগাশোকা মেয়েকে...
ওর শরীর স্বাস্থ্য নিয়া ভাবছে? ওর ভবিষ্যৎ নিয়া ভাববেন না? ভাইজান দেখি এ লাইনের কিছুই জানেন না। ওর শরীর স্বাস্থ্য মাস কয়েকএর মধ্যেই ভাল হয়ে যাবে। আপনি মাস চারেক পরে ওকে দেখলে আর চিনতেই পারবেন না যে, এই সেই ফতি যাকে আপনি বাসে দেখেছিলেন। শোনেন, ফতির বয়স এখন চৌদ্দ কি পনেরো। এই বয়সের সবাইকে এখানে আসা মাত্র দাওয়াই দেয়া হয়। দাওয়াই, ওরাডেক্সন। আসার পথে অই যে গরু ছাগল
মোটাতাজাকরন প্রকল্প বলে যে প্রকল্পটি দেখলেন ওখানকার প্রাণীদের খাবারের সঙ্গে এই দাওয়াই দেয়া হয় যাতে ওরা খুব কম সময়ের মধ্যে মোটাতাজা হয়ে ওঠে। এজন্যই ওরাডেক্সন’কে বলা হয় গরুর ট্যাবলেট। আম্বিয়া খালার হাতে পড়লে কয়েক মাসের মধ্যেই এই যাদুকরী ট্যাবলেটের জোরে ওরাও গরু-ছাগলের মতো মোটাতাজা হয়ে এক্কেবারে আঠারো বিশ বছরের যুবতী।
আতংকে লাফিয়ে ওঠে মহিদুল। বলে কি লোকটা।
আর তখনই তাকিয়ে দেখে সে, ফতি সিটে নেই। পদ্মাপাড়ের মরা জ্যোৎস্না আর জমাটবাধা কুয়াশা ওকে গিলে ফেলেছে।
আর স্বপ্নের ভিতর হারু খালাসীর শেষ পর্যন্ত কী হ’ল-- পরদিন শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না মহিদুল।
লেখক পরিচিতি
বাসে উঠে অন্তত তিনবার, অই মিয়া, আস্তে চালাও বলে ড্রাইভারকে সাবধান করেও কোন ফল হয় না। কে শোনে কার কথা! রাতের রাস্তা যেন রেসিং-ট্রাক। খালি রাস্তা পেয়ে উড়ে যাচ্ছে । বাইরে যদিও হালকা কুয়াশা, ছেঁড়াছেঁড়া। আর আকাশে পলায়নরত মেঘেরা একটু পরপরই ঢেকে দিচ্ছে শুক্লপক্ষের চাঁদ। কাল ছিল বিজয়া দশমী। বিসর্জনের পর দেবীর কৈলাশে ফিরে যাবার দিন। রাস্তায় রাস্তায় ছিল মণ্ডপ শোভাযাত্রা। তবে আজ বেশ ফাঁকা।
আরমান টেক্সটাইল, মনোরমা ফার্মাসি, সুরুজ মিয়ার ভাতের হোটেলের পর গরু ছাগল মোটাতাজাকরন প্রকল্প। বাম দিকে অনতিদূরে ফসলী জমির শেষে কুয়াশার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দৃশ্যমান গ্রামটিকে মনে হচ্ছে নাভি বের করে দাঁড়িয়ে থাকা যেন রহস্যময় কোন নারী। মোটাতাজাকরন প্রকল্পের ঠিক পাশ দিয়ে অতিশয় রুগ্ন একটি খাল সাপের লেজের মতো সরু হয়ে পরিশেষে গ্রামের নাভির ভিতর ঢুকে গেছে।
ছোট্ট একটা বাঁক পিছনে ফেলে ডান দিকে টার্ন নিতে হয় এখানটায়। অদূরে এক কালের প্রমত্ত পদ্মা। তবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার মাঝখানে পদ্মা এখানে ওখানে জেগে ওঠা চরের কারণে এখন প্রায়শ দীঘির জলের মতো ধিরস্থির। ফেরী পারাপারের জন্য যেতে হয় আরো খানিকটা পথ।
ডান দিকে টার্ন নিতে না নিতেই মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায় বাস। আর এগুনো যাবে না। সামনে বাসের মিছিল যেন। আর ঠিক তখনই খবরটা কানে আসে মহিদুলের।
কাম অইছে ওস্তাদ। আইজ আর যাওন যাইবো না। কুয়াশায় ফেরী আটকাইছে নদীর মধ্যে।
হেলপারের কথায় গা করে না ড্রাইভার। যেন তার জানাই ছিল পাটুরিয়া ঘাটে এমনটাই হবে। পথে হালকা কুয়াশার ভিতরেও যেন এরকম একটা সিগনাল ছিল। সে বলে, অই মদনা, চা লইআয়। খাইয়া ঘুমদি।
এ ধরনের পরিস্থিতি মোটেই নতুন নয়, অভিজ্ঞতা আছে মহিদুলের। এখন ছ’আট ঘন্টায় পার পেলে হয়।
অনেকেই নেমে গেছে বাস থেকে। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। ডানপাশের মাঝবরাবর সারিতে এক দম্পতি, মেয়েটি খুবই রুগ্ন, কাঁচের জানালায় মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। দৃষ্টি তার যেন চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝপথে কোন অজানা জায়গায় স্থির। মহিদুল দেখে, তার চোখেমুখে আধো আলো আধো অন্ধকার। মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমন্ত লোকটি সত্যি সত্যি ঘুমাচ্ছে, না চোখ বুজে আছে বুঝা যায় না। তার ডান হাত কঠিনভাবে ধরে আছে মেয়েটির বাম হাতখানা।
বাস যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে তার দু’পাশের অধিকাংশ দোকানপাটই খাবার-দাবারের। নানা ধরনের গান বেজে চলেছে। মেরা জুতা হায় জাপানী, একবার যেতে দে মা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, শোনো একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে’র অপূর্ব মিশ্রণ। ইলিশ ফ্রাই হচ্ছে কোথাও। প্রিয় পরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগছে। চায়ের তেষ্টা পায় মহিদুলের। সে বাস থেকে নেমে আসে। নামার সময় মেয়েটির আবার চোখে চোখ পড়ে তার। সে দেখে, মেয়েটি গাঢ় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ নামিয়ে নেয় মহিদুল।
২
আকাশে শুক্লপক্ষের সেই চাঁদ এখন মধ্যগগনে। মরা জ্যোৎস্না আর জমাটবাধা কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারদিক। দূরে দৌলতদিয়া ঘাট, আরিচার ওপারে। মাঝখানে যে পদ্মা তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেন একটা কুয়াশার টানেল, এমন ভ্রম হয় মহিদুলের। হালকা শীত শীত একটা ভাব। চা শেষ করে বাসে উঠে আসে সে।
ভাইজান কি খুলনা যাচ্ছেন ?
এই প্রশ্নে মহিদুল দেখে সহসা একটি লোক, যাকে সে একটু আগে বাসের ভিতর জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখেছে। ভাইজান কি খুলনা যাচ্ছেন, বলে লোকটা তার ডান পাশের খালি আসনটিতে বসে পড়ে।
আবারও সেই একই প্রশ্ন লোকটার। অচেনা লোকের এমত প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত বোধ করে মহিদুল। এই প্রথম লোকটাকে খুব কাছ থেকে পরিপূর্ণভাবে দেখার সুযোগ হয় তার। গলায় মাফলার, পরনে পাঞ্জাবি, তার উপর মেরুন রঙের সোয়েটার, কাঁধে কাফনের কাপড়ের মতো ধবধবে শাল। সারা মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় মাংকি ক্যাপ, চুল আছে কি নেই বোঝা যায় না।
আমিও অই খুলনার পথেরই যাত্রী, তবে পথে দিন দু’এক দৌলতদিয়া ঘাটে থাকতে হবে।
লোকটার মুখ থেকে ভুরভুর করে জর্দার গন্ধ বেরুচ্ছে। জর্দার এই গন্ধটা একদম সহ্য করতে পারে না মহিদুল। সে অসহায়ের মতো লোকটির কাঁধের উপর দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি তখনো তাকিয়ে আছে জালানার বাইরে।
ও ভালো কথা, আপনারে তো আমার পরিচয় দেওয়া হয় নাই। আমার নাম হারু, হারু খালাশি। সাপ্লাইর ব্যবসা করি। এক সময় সারা বাংলাদেশের চৌদ্দ জায়গায় আমার এই ব্যবসা ছিল। এখন দৌলতদিয়া ঘাটে সাপ্লাই দিতে দিতেই নান্দিবিনাশ অবস্থা। আম্বিয়া খালার লগে আমার কনটাক্ট দশ বছরের। আমরা যদিও সমবয়সি, সবাই তারে খালা ডাকে দেইখা আমিও ডাকি। তা একদিন...
বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলেই যাচ্ছে লোকটা, আর একটু পরপর নজর রাখছে মেয়েটির দিকে।
ঠিক এসময় মহিদুলের মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, কি সাপ্লাই দেন আপনি? রড সিমেন্ট, না বালু পাথর? যা দাম বেড়েছে আজকাল। লাভ হয়?
এমত প্রশ্নে আরো ঘনিষ্ট হয়ে বসে হারু খালাসী। বলে, কী যে বলেন ভাইজান। যে জিনিষের মধ্যে পরান নাই অই জিনিশের ব্যবসা হারু খালাসী করে না। আমি যে জিনিশ সাপ্লাই দেই তার মধ্যে পরান আছে, আছে আনন্দ ফূর্তি। খুবই সনাতন ব্যবসা।
হারু খালাসীর কথাবার্তা ধ্বন্ধের মধ্যে ফেলে দেয় মহিদুলকে। সে অতিশয় বিপন্নবোধ করে। ধূরন্ধর হারু যেন টের পায়, তার কথাবার্তা দিশেহারা করে ফেলেছে মহিদুলকে। সে বলে, ভাইজান, আর একটু খোলশা করে বলি,
অই যে ওপারে দৌলতদিয়া ঘাট, আমি ওখানে মাল সাপ্লাই দি। রক্ত-মাংসের মাল। এ আমাদের চার পুরুষের সনাতন খানদানী ব্যবসা। তবে আমি পিম্প না। প্রাইভেট কাম করি না, প্রাইভেট কামে গ্যাঞ্জাম অনেক। জনগনের জন্য কাম করি।
কি রকম- মহিদুলের এ প্রশ্নে যেন কিছুটা বিস্মিত হয় হারু খালাসী। লোকটা ছাগল নাকি! কিছুই কি বোঝে না ! সে বলে, অই যে দৌলতদিয়ার কথা বললাম আপনারে, একটু খুইল্লাই বলি, তামাম দুনিয়ার সবচে’ বড় পল্লী।
৩
আপনারা বলেন যৌনপল্লী, আমরা বলি হারেমখানা। গরীবের হারেমখানা। বাংলাদেশের নানা জায়গায় এরকম চৌদ্দটি গরীবের হারেমখানা আছে। সব হারেমখানার লাইসেন্স আছে। মানুষ ফুর্তি করতে আসে, ফুর্তি কইরা চইল্লা যায়। কারো তো কোন ক্ষতি হয় না। এই দৌলতদিয়ায় কতো মানুষ আসে রোজ আপনার ধারনা আছে ? সাড়ে তিন হাজার। তাগো ফুর্তির জোগান দেয় আড়াই হাজার সেবাদাসী। ভদ্রভাবে আপনারা যাদের দেহজীবী, যৌনকর্মী বলে থাকেন। মানুষেরা এখন কিছু ভদ্র সভ্য হয়েছে, আজকাল কেউ আর ওদের বেশ্যা, খান্কী, রান্ডি, পতিতা বলে না।
তা তুমি অই রোগাশোকা পাটকিলে মেয়েটাকে দৌলতদিয়া নিয়ে যাচ্ছো যৌনপল্লীতে বিক্রীর জন্যে ? ওই তাহলে তোমার সাপ্লাইয়ের মাল?
জী স্যার।
তোমার মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কি কিছু নেই ? সাহস করে বলে ফেলে মহিদুল।
খুব সস্তা একখানা বচন দিলেন ভাইজান। অইসব থাকলে তো আর এ লাইনে কাম করা যায় না। আর তাছাড়া আমি যা জানি আপনি তো তা জানেন না।
যেমন?
মেয়েটির অবস্থা আপনি তো কিছুই জানেন না। জানেন?
না।
তাহলে শোনেন, জগৎসংসারে ওর আপন বলে কেউ নেই আর। ও বাপ-মা ভেসে গেছে সিডরে। আর ও, মানে অই ফতি কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে একদিন এই শহরে এসে উঠল। কিন্তু কোথাও ঠাই হ’ল না। প্রথমদিকে কিছুদিন এ বাড়ি ও বাড়ি করে শেষে আবার ভাসমান কচুরিপানা। আমি ওরে প্রথম দেখি সদরঘাটে।
না খেয়ে খেয়ে একেবারে হাড্ডিসার। তবে সেদিন ওর চোখ দুটি দেখে মনে হয়েছিল, ভিতরে আগুন আছে। শুধু নিভু নিভু সলতেটা একটু উস্কে দিতে হবে। ওকে বাসায় এনে নিজের কাছে রাখলাম, যত্ন আত্তি হল মাসকয়েক। চেহারার কিছু অন্তত ফিরে পেল ফতি। তারপর একদিন সময় সুযোগ বুঝে প্রস্তাবটা দিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার কথায় কেঁদেকেটে বুক ভাসাবে। কিছুই করল না, বরং একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। তারপর থেকেই কবে নিয়া যাবেন, কবে নিয়া যাবেন করতে থাকে।
তাই বলে এই রকম একটা রোগাশোকা মেয়েকে...
ওর শরীর স্বাস্থ্য নিয়া ভাবছে? ওর ভবিষ্যৎ নিয়া ভাববেন না? ভাইজান দেখি এ লাইনের কিছুই জানেন না। ওর শরীর স্বাস্থ্য মাস কয়েকএর মধ্যেই ভাল হয়ে যাবে। আপনি মাস চারেক পরে ওকে দেখলে আর চিনতেই পারবেন না যে, এই সেই ফতি যাকে আপনি বাসে দেখেছিলেন। শোনেন, ফতির বয়স এখন চৌদ্দ কি পনেরো। এই বয়সের সবাইকে এখানে আসা মাত্র দাওয়াই দেয়া হয়। দাওয়াই, ওরাডেক্সন। আসার পথে অই যে গরু ছাগল
মোটাতাজাকরন প্রকল্প বলে যে প্রকল্পটি দেখলেন ওখানকার প্রাণীদের খাবারের সঙ্গে এই দাওয়াই দেয়া হয় যাতে ওরা খুব কম সময়ের মধ্যে মোটাতাজা হয়ে ওঠে। এজন্যই ওরাডেক্সন’কে বলা হয় গরুর ট্যাবলেট। আম্বিয়া খালার হাতে পড়লে কয়েক মাসের মধ্যেই এই যাদুকরী ট্যাবলেটের জোরে ওরাও গরু-ছাগলের মতো মোটাতাজা হয়ে এক্কেবারে আঠারো বিশ বছরের যুবতী।
আতংকে লাফিয়ে ওঠে মহিদুল। বলে কি লোকটা।
আর তখনই তাকিয়ে দেখে সে, ফতি সিটে নেই। পদ্মাপাড়ের মরা জ্যোৎস্না আর জমাটবাধা কুয়াশা ওকে গিলে ফেলেছে।
আর স্বপ্নের ভিতর হারু খালাসীর শেষ পর্যন্ত কী হ’ল-- পরদিন শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না মহিদুল।
লেখক পরিচিতি
ইকবাল হাসান
বরিশালে জন্ম। কানাডা প্রবাসী।
বরিশালে জন্ম। কানাডা প্রবাসী।
গল্পকার। কবি।
বাংলা একাডেমি'র সৈয়দ ওয়ালিউললাহ সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
অক্টোবর ২৭/২০১৫
অক্টোবর ২৭/২০১৫
0 মন্তব্যসমূহ