সেদিন আকাশে গনগনে আগুনের মত রোদ, যেন বয়লারের ঢাকনা হঠাৎ খোলা। দুপুরের রোদে যে ফেরিওয়ালা স্নিগ্ধতা হেঁকে বেডায় সে কাটা শশার ওপর ঝাঁলের গুড়ো আর নুন ছিটিয়ে আমাদের অফিসের গেটের পাশে ছায়ার স্নিগ্ধতা মাঙছিল। জায়গাটি খুব ছায়াচ্ছন্ন ছিল না। আমাদের অফিসবাড়িটা পশ্চিমমুখো। ফলে ছায়া ক্রমে খর্ব হচ্ছিল। দুপুরের ডালহৌসিতে সূর্যকে মাথার ওপর নিয়ে প্রাকারের ছায়ারা যেন লুকিয়ে থাকে। এককালে ত তুমি ছবি আঁকতে। কলকাতা সিরিজের কয়েকটা ছবি আঁকবে বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সারা কলকাতা টো টো। স্কেচে ভর্তি খাতাটা আমার কাছেই আছে। আমি জানি ভবিষ্যতে আবার আঁকলেও, ঐ স্কেচের ছবি তুমি আৱ-কোনোদিন আঁকবে না। আমার কাছে আছে, থাক। মাঝেমধ্যে পুরনো কাগজপত্র ঘাটতে-ঘাটতে চোখে পড়বে। কিন্তু সেই স্কেচবুকের কলকাতা কি কলকাতা নাকি 'কলকাতা : আমার স্বপ্নে । অবিশ্যি...।।
যাক। এখন আমার মনে হচ্ছে, দুপুরের ডালহৌসির একটা ছবি আঁকতে পারো, দুর্গের মতো ডালহৌসি। মত আবার কেন, দুর্গই তো। প্রাকার আর পরিখা আর প্রহরা-সবই আছে, কিন্তু ছবিটাতে এই প্রাকার আর পরিখা আর প্রহরা আসবে খুব হালকা রঙে, খুব হালকা, যেন রোদে সব দেয়াল থেকে রঙ মুছে গেছে, আর পায়ের নীচের ছোট ছোট ছায়ারা থাকবে গভীর রঙে, যেন দেওয়ালগুলো থেকে সব রঙ ধুয়ে-গলে ঐখানে পড়ে—দেখবে কী দারুণ ছবি হয়। একটা ট্র্যামগাড়ির ছবি দিতে পারো, আলোয় গলে যাচ্ছে গতি-- আমি সেই গতিতে ভাসছি। মনে পড়ছে ''পাথরের রঙ গলে যাচ্ছে"-এই অনুষঙ্গ দেখার জন্য তুমি আমাকে নিয়ে একসময় প্রতিদিন যাদুঘরে যেতে। আর আমি জানতাম রাতেও তুমি সামনে ছবির অ্যালবাম নিয়ে বসে থাকো : কীভাবে ইমপ্রেশনিস্টরা নতরদ্যমের ছবি এঁকেছে দেখতে, কীভাবে প্রাচীনেরা চীনের মহাপ্রাচীরের রেখা টেনেছে জানতে ! তুমি অত স্কেচ করা, অত খাটাখাটুনি, আত তৰুতালাশের পর ও শেষ পর্যন্ত আঁকলে না। কলকাতার ছবি তুমি আর আঁকলে না। স্কেচবই আমার কাছে পড়ে। আমি জানিনা তুমি কেন আঁকনি। তুমি জানো না তুমি কেন আঁকনি। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত তুমি আবিষ্কার করতে পেরেছিলে কলকাতা--নতরদ্যম নয়, সে ঐতিহ্য কালীঘাটের মন্দিরে নেই, বা চীনের মহাপ্রাচীরও নয়--প্রাচীরের পাশে ধানখেতের সে বিস্তার নেই এখানে। আমার সন্দেহ তুমি শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছিলে--কলকাতা শুধু ইট বা সিমেন্ট বা রিইনফোর্স কনক্রিট। হায়রে শিল্পী-- রবিঠাকুরের ষাট-সত্তর বছর পরে জন্মেও ‘ইটের পর ইটের' সাত পুরনো চিন্তা তাড়াতে পারলে না। হায়রে শিল্পী--এত তন্ন তন্ন খুঁজেও কলকাতার আত্মাকে পেলে না, সম্ভবত মাঝ থেকে খোয়া গেল নিজেরই আত্মা ! হায়রে শিল্পী-সারাটা জীবনে তুমি নিজের একটা প্রতীক খুঁজে পেলে না।
সারাটা জীবন, সারাটা জীবন নিজের একটা প্রতীক খুঁজে পেলাম না। কতই না বড় জীবন, তিরিশ-চল্লিশ, তৰু এত দীর্ঘ মনে হয়। এতগুলো বছর ধরে খুঁজলাম অথচ জানতে পেলাম না আমি একটা গাছ না পোকা, আলো না মোটরের হেডলাইট, একটা খোয়া ওঠা পথ নাকি গঙ্গা। নিজের প্রতীক খুঁজে ফিরে শেষে আমি আত্মবিস্মৃত। কলকাতার পথ দিয়ে যখন অন্যমনস্ক থাঁটি, একা একা, তাকাতে চাই না তবু চোখে পড়ে ঐ অসংখ্য ছাত ছাড়িয়ে হঠাৎ একটা চিলেকোঠার উদাসীনতা। ভাবতে চাই না তবু ভেবে ফেলি ঐ উদাসীন চিলেকোঠটি বুঝি আমার প্রতীক। তাকাতে চাই না তবু চোখে পড়ে বন্ধ দোকানের সিঁড়ির উপর কুঁকডে শুয়ে কোনো নাবালক, আর কর্পোরেশনের কলে নির্জন জলধারা সজীব সরীসৃপের মতো বয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। ভাবতে চাই না, তবু ভেবে ফেলি ঐ জলধারার নির্জনতাটি বুঝি আমার প্রতীক। তাকাতে চাই না তবু চোখে পড়ে যায় কোনো শহিদের নামাঙ্কিত দুপুরের জনহীন পার্কে মেহেদিগাছের বেড়ায় টকটকে লাল কাপড়ের চিৎকার আর মেহেদিপাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় কোনো শরীরের গামছাতে ঢাকা-না-পড়া পায়ের একাংশ । ভাবতে চাই না, তবু ভেবে ফেলি ঐ অযত্নলালিত যৌবন আর লাল কাপড়ের চিৎকার আমারই প্রতীক। এ-রকম হঠাৎ হঠাৎ দেখে ফেললে, ভেবে ফেললে মনে হয় সারাটা কলকাতা শহরে নানাদৃশ্য এঁকে রেখে দিয়েছি আমিই। সারাটা কলকাতা যেন আমার কোনো বিশ্বত প্রদর্শনী। সে-প্রদর্শনীতে আমি ভ্রাণ্যমান। আর তখনি আমার ভয় করে যে কলকাতার ম্যানহোলগুলি হঠাৎ খুলে গিয়ে আমাকে গ্রাস করে নেবে বা পাড়ার ছেলেরা আমাকে পাগল বলে চিলবে। কারণ শেষ পর্যন্ত কলকাতা আমার হতে পারেনি। আমি একটা দেশ স্থান, খুঁজছিলাম। কলকাতা আমার দেশ নয়। কলকাতা আমার দেশ নয় । অথচ কলকাতার পথঘাট, চিলেকোঠা, মেহেদিবেড়াতে ঝোলা কমদামি লালরঙ, জলধারা, আমার প্রতীক, আমারই প্রতীক।
অনেকদিন আগে লেখা তোমার একটা চিঠির অংশ--''আসলে এই প্রশ্নের উত্তরটি পাওয়ার আগে আমার পক্ষে কোথাও এমনকি একটি ব্যক্তির কাছেও অনুগত হওয়া সম্ভব নয়। আমার কোনো দেশ নেই। পূর্ববাঙলা সরিয়তি শাসনের কল্যাণে আমার বিদেশ। পশ্চিম বাংলায় আমি একটি নম্বর, একজন উদ্ধাস্ত--আমার দেশ কোথায়, না জানা পর্যন্ত আমার পক্ষে কোনো একটি মানুষের অনুগত হওয়া সম্ভব নয়। 'জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে'-- এ আত্মপরিচয়েও মানুষ বাঁচতে পারে। বাঁচতে পারে না দেশহীনতায় "-এই চিঠির কাগজে একটা স্কেচ আঁকা, আমার বেণীর, আগের দিন আঁক কাটছিলে ।
তোমার একদিনের সংলাপ--
’তুমি জানো না, ভাবতে পারবে না, আমি যখন পাকিস্তান থেকে চলে এলাম, আমাকে উদ্বাস্ত সার্টিফিকেট দিতে রাজি হচ্ছিল না, তার কারণ আমি মুসলমান। আমাকে ঝগড়া করতে হয়েছে যে কোন নিয়ম অনুযায়ী একজন মুসলমান উদ্বাস্তু হতে পারবে না। একবার ভেবে দেখো, পাকিস্তানে মুসলমানদের হাতে মার খেয়ে ভয়ে পীড়নে পাগল হয়ে, কেউ-বা সর্বস্ব খুইয়ে কেউবা প্রাণটুকু নিয়ে এপারে এসেছে। তারা যদি চোখের সামনে দেখে একজন মুসলমান নিজেকে উদ্বাস্ত বলে দাবি করছে, ঝগড়া করছে, উদ্বাস্তু সার্টিফিকেট নিচ্ছে, তবে তাদের ইচ্ছে করবে না আমাকে মেরে ছিড়ে টুকরোটুকরো করতে ? আমি জানি না, আমি মনে-মনে তাই চেয়েই পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলাম কিনা। কিন্তু সামান্য কিল-চড়-ঘুষি ছাড়া আমার কপালে কোনোদিনই কিছু জুটল না। তোমাদের কলকাতা শহরের দাঙ্গাতেও আমাকে কেউ মারল না। শেষ পর্যন্ত আমাকে যদি কেউ মুসলমান বলে খুনও করত, আমি বেঁচে যেতাম—-'
কলকাতাকে আমি আমার দেশ করতে চেয়েছিলাম। কলকাতার ছবি আকঁবো বলে স্কেচ বই বগলে নিয়ে সারা কলকাতা চষে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি আমার কোনো প্রতীক খুঁজে পাইনি, আমার সঙ্গে কলকাতার যোগের কোনো প্রতীক। বিশ্বামিত্র রাজা ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে পাঠালেও ত্রিশঙ্কু স্বর্গকে নিজের দেশ ভাবতে পারেনি, ত্রিশঙ্কু স্বর্গের সঙ্গে নিজের যোগের কোনো প্রতীক খুঁজে পায়নি। আর মাটির সঙ্গে যোগেরও তার কোনো শিকড় ছিলো না। ভেবেছিলাম গঙ্গানদীতে নিজেকে পাব। একটা বড় ছবি এঁকেছিলাম। গঙ্গানদীর । কলকাতার গঙ্গানদীর । আমার একমাত্র আত্মপ্রতিকৃতি প্রাচীন চীনাচিত্রে যেমন দুই পাশে সবুজ সমতলের মধ্য দিয়ে মহাপ্রাচীরের ধূসর স্থবিরতা বয়ে যায়--নির্মম, কোমল, অনতিউচ্চ ও অনতিপ্রশস্ত-বিশেষণ রচে রচে, তেমনি গঙ্গানদী বয়ে যাচ্ছে, অতিসারল্যের একটা মিথ্যা অজুহাত ছড়িয়ে ছড়িয়ে--কিন্তু সেই বয়ে যাওয়ার দুই পাশে সবুজ সমতল নয়, টকটকে লাল । এমন টকটকে যে গঙ্গার গেরুয়া ধারাকেও মনে হয় সাদা। এতো লাল যে মনে হয় ফুসফুস ফেটে ছড়িয়ে--মাঝ দিয়ে শ্বাসনালীর অকেজো নল ; পরে ছবিটার নাম দিতে হয়েছিল--বার্নিলওয়াল। যদি ছবিটিতে আমি সত্যসত্যই আমার প্রতীকরূপে গঙ্গাকে আনতে পারতাম বোধহয় তাহলে আত্মদানের পথ খুঁজে পেতাম। কিন্তু গঙ্গাধারা গিয়ে শেষ হয় বার্নিলের ওয়ালে। আমার দেশ মিলবে কোত্থেকে । আমি কিছু জন্মের ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার অসংলগ্নতা বোধহয় জন্মের প্রতীকে সংলগ্নতা পাবে। ভেবেছিলাম আমার উপাধিহীনতা বোধহয় জন্মের প্রতীকে উপাধি পাবে । রক্তাক্ত জন্ম, বেঁচেথাকার জন্য। সাল বনের মধ্যে গোলাপী শিশু। রক্ত গোলাপ--অন্য অর্থে। সব ছবিতেই জন্মের চাপচাপ রক্তই যেন প্রধান হয়ে উঠল । সব ছবিতেই সেই গোলাপ রঙের শিশু সেই রক্তকে দ্বিধা করেছে। পরে সেইসব ছবির নাম দিতে হয়েছিল বাঙলা—উনিশ শ সাতচল্লিশ । আমি যদি লালরঙের ব্যবহার ভুলতে পারতাম। যদি পারতাম। আমি কিছু মৃত্যুর ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার সব নাস্তিক্য নিখিল নাস্তির আগ্নেয় মহিমায় লোপ হয়ে যাবে। যাক। লোপই হয়ে যাক। কিন্তু কোদাল দিয়ে ওপড়ানো মাটি আমার তুলিতে লাল হয়ে গেল। যেন মৃত্যুর আশ্রয় নয়, ধরণীর হত্যা । মাটির ভেতরে এত রক্তের মত লাল থাকে কে জানত। কিছু দাহনের, শববাহনের ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম। যাক, আমার অস্তিত্বহীনতার গ্লানি লোপ পেয়ে যাক । কিন্তু আগুনের শিখার ক্ষুরধার রক্তাক্ততা যেন হত্যার রক্ত হয়ে উঠলো। আর সেই হত্যার রক্তের মধ্যপথে একটা সূত্রাকার বিচ্ছেদ রেখা। পরে এইসব মৃত্যুর ছবির নাম দিতে হয়েছিল 'কোরিয়া' 'ভিয়েতনাম । আমি যদি বিচ্ছেদরেখার ব্যবহার ভুলতে পারতাম, যদি পারতাম। একটা পুরো ক্যানভাস জুড়ে একটা পুরো ছবি আমার আঁকা হল না। ছবির ভেতর থেকে শাদা এক রেখা ফুটে দ্বিধা এনে দেয়। হায়রে আমার অসংলগ্নতা। হায়রে আমার দ্বিধা। আমি কেন কোথাও লগ্ন হতে পারি না। ঈশ্বর, আমাকে লগ্নতা দাও। তুমি একদা আমার ঈশ্বর হতে অভিলাষ করেছিলে, তুমি আমাকে লগ্নতা দিতে পারনি ।
তুমি একদিন একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছিলে--ঈশ্বরী আমার, আমাকে জন্মহীনতা থেকে পরিত্রাণ করো!--আমি জানি না তোমার জন্মহীনতার পরিত্রাণ কোথায়। আমি জানি না আমি তোমার ঈশ্বরী কিরূপে। একদিন তুমি বলেছিলে আমার একটি ছবি আঁকবে । কয়েকমাস পর দেখিয়েছিলে একটা ছবি । দেখে মনে হয়েছিল অসম্পূর্ণ। তুমি বলেছিলে, না-এটাই সম্পূর্ণতা। ছবিটির প্রধান রঙ ছিল সোনার! দূর থেকে দেখলে মনে হয় যে এক গুলমোহরের গাছের সর্বাঙ্গে ফুল। আর তারই মধ্যে যেন এক নারীদেহের আভাস আগে। কিন্তু সে নারীদেহের বুকের মাঝখান দিয়ে একটা সুতোর মত রেখা, ছবির নীচে লেখা ছিলো ‘সেঁউতির উপর পদ রাখিতে রাখিতে/ সেঁউতি হইল সোনা দেখিতে দেখিতে' । উল্লাসে আত্মহারা হয়ে তুমি বলেছিলে—‘লালরঙ ব্যবহার না করে এই পুরো ছবিটি আমি এঁকেছি, এখন ঐ মাঝখানের রেখাটি--- আমি বুঝিনি। কিন্তু সেদিন আমি ভয় মেনেছিলাম--তবে আমাকেই তুমি তোমার জননীত্বে বরণ করেছ। হায়রে, আমার অজ্ঞাতেই আমার গর্ভে তুমি তোমার অধিকার সাব্যস্ত করেছিলে। আমি জানি এতদিনে সে-ছবির নীচের কবিতার চরণদুটি তুমি মুছে দিয়েছ। ঐ একটিমাত্র ছবিতে তোমার উল্লাস ছিল, হয়ত কিছু প্রেমও। আর-সব ছবিতে শুধু রক্ত, শুধু হত্যা শুধু দ্বিধা।
ক্ষুদিরামকে নিয়েই ত গানটা : দশমাস দশদিন পরে / জন্ম নেব মাসির ঘরে/ চিনতে যদি না পারো মা/ গলায় দেবো ফাঁসি!! যে বিচ্ছেদ রেখাটিকে আমার ছবি থেকে আমি দূর করতে পারিনি, আমার গলায় মালার মত সেই রেখাটিকে ধারণ করবো চিরতরে। অন্ধকারে, মিলিয়ে মা গাছের ডালে। দশ মাস দশ দিন পরে, জন্ম নেব মাসির ঘরে, চিনতে যদি না পারো মা, গলায় দেবো ফাঁসি- -পরজন্মেও এই ফাঁসির দাগ গলায় থাকবে, এই দ্বিধা চিহ্ন, এই বিভক্তিরেখা। কিন্তু শরিয়তি শাসনের দেশ থেকে গণতন্ত্রের দেশে আসা এক উদ্বাস্ত -- আমার আত্নহত শবদাহ হবে কোন রীতিতে? আমি কিরূপে জানতে পাৱব--মর্গে আমার দেহের ভিতরে ডাক্তার যখন মৃত্যুর কারণ খুঁজছিলেন তখন সেখানেও এমন কোনো বিভক্তিচিহ্ন দেখেছেন কিনা। আত্মহত্যার পূর্বে আমি একটা শেষ ছবি আঁকব। প্যানেল। তাতে শুধু থাকবে অসংখ্য মানুষের ফিগার, শুধু মানুষের ফিগার, নানা ভঙ্গিতে, নানা চেহারায়। কিন্তু কোনো একটি ফিগারের কোনো একটি অঙ্গও সম্পূর্ণ নয়। পায়ের পাতা থেকে আঙ্গুলগুলি আলাদা। গোঙালি থেকে হাটু পর্যন্ত আলাদা। হাটু থেকে সন্ধি পর্যন্ত আলাদা, পেট-বুক আলাদা, মাথা আলাদা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বুঝিবা কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি—যথ কুরুক্ষেত্রের পর । কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে না। ওগুলো মানুষের খণ্ডিত অঙ্গ নয়, সমগ্র মানুষ। সমগ্র মানুষই নয় শুধু খণ্ডিত সমগ্র মানুষ উভয়ত। সব অঙ্গই আছে, সামঞ্জস্যও আছে নেই শুধু অঙ্গগুলির যোগাযোগ। অথচ সেই বিভক্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়েই মানুষগুলি এরোপ্লেন চালাচ্ছে, রেলগাড়ি বানাচ্ছে, সমুদ্রের তলায় নামছে, মরুভূমি পার হচ্ছে, পাহাড়ের ওপর উঠছে। ত্রিকোণের সমাবেশে ছবিটিতে এই ব্যঞ্জনা আনতে হবে যে কখনো মনে হবে সমবেত একটি কর্মকাণ্ডের ছবি, কখনো মনে হবে খণ্ডিতদেহ মানবজাতির ছবি। যে-রঙটি আমাকে সারাটা জীবন তাড়া করে ফিরল, একবার তাকে মাত্র ভোলা গিয়েছিল, যে-রঙটি চিতার আগুনের মত, রক্তের মত, আমাকে সারাজীবন পুড়িয়ে দিল, ভাসিয়ে দিল, সেই রঙের ব্যবহার করব এই ছবিতে-আমার মনের সুখে। যে-রেখাটি আমাকে সারাজীবন তাড়িয়ে ফিরল, যে-রেখাটি ছবির ভেতর থেকে ফুটে উঠে আমার সমগ্র ছবিকে দুভাগ করে দিল, যে-রেখাটি মৃত্যুরোগের মত নিয়ত আমাকে পীড়িত করল—সেই বিচ্ছেদ রেখাটির পূর্ণ ব্যবহার আমি এই ছবিটিতে করব, ছবিটির নাম দেব, পৃথিবী ১৯৬৫, ছবিটি জাতিপুজ্ঞে পাঠানো হবে নিখিল উদ্বাস্ত বৎসরের প্রধান পোস্টার করার জন্য।
আর আত্মহত্যার সময় আমি এই বুকটাকে দুইভাগ করে একটা ডাবলফুলস্ক্যাপ সাইজের ব্লটিঙ কাগজে হৃৎপিণ্ডের ও রক্তের দাগ তুলে দেব। আমার রক্তের বিচ্ছেদ রেখাটিকে বের করতে সেটাও জাতিপুঞ্জে পাঠানো হবে।
১৯৬৫
যাক। এখন আমার মনে হচ্ছে, দুপুরের ডালহৌসির একটা ছবি আঁকতে পারো, দুর্গের মতো ডালহৌসি। মত আবার কেন, দুর্গই তো। প্রাকার আর পরিখা আর প্রহরা-সবই আছে, কিন্তু ছবিটাতে এই প্রাকার আর পরিখা আর প্রহরা আসবে খুব হালকা রঙে, খুব হালকা, যেন রোদে সব দেয়াল থেকে রঙ মুছে গেছে, আর পায়ের নীচের ছোট ছোট ছায়ারা থাকবে গভীর রঙে, যেন দেওয়ালগুলো থেকে সব রঙ ধুয়ে-গলে ঐখানে পড়ে—দেখবে কী দারুণ ছবি হয়। একটা ট্র্যামগাড়ির ছবি দিতে পারো, আলোয় গলে যাচ্ছে গতি-- আমি সেই গতিতে ভাসছি। মনে পড়ছে ''পাথরের রঙ গলে যাচ্ছে"-এই অনুষঙ্গ দেখার জন্য তুমি আমাকে নিয়ে একসময় প্রতিদিন যাদুঘরে যেতে। আর আমি জানতাম রাতেও তুমি সামনে ছবির অ্যালবাম নিয়ে বসে থাকো : কীভাবে ইমপ্রেশনিস্টরা নতরদ্যমের ছবি এঁকেছে দেখতে, কীভাবে প্রাচীনেরা চীনের মহাপ্রাচীরের রেখা টেনেছে জানতে ! তুমি অত স্কেচ করা, অত খাটাখাটুনি, আত তৰুতালাশের পর ও শেষ পর্যন্ত আঁকলে না। কলকাতার ছবি তুমি আর আঁকলে না। স্কেচবই আমার কাছে পড়ে। আমি জানিনা তুমি কেন আঁকনি। তুমি জানো না তুমি কেন আঁকনি। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত তুমি আবিষ্কার করতে পেরেছিলে কলকাতা--নতরদ্যম নয়, সে ঐতিহ্য কালীঘাটের মন্দিরে নেই, বা চীনের মহাপ্রাচীরও নয়--প্রাচীরের পাশে ধানখেতের সে বিস্তার নেই এখানে। আমার সন্দেহ তুমি শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছিলে--কলকাতা শুধু ইট বা সিমেন্ট বা রিইনফোর্স কনক্রিট। হায়রে শিল্পী-- রবিঠাকুরের ষাট-সত্তর বছর পরে জন্মেও ‘ইটের পর ইটের' সাত পুরনো চিন্তা তাড়াতে পারলে না। হায়রে শিল্পী--এত তন্ন তন্ন খুঁজেও কলকাতার আত্মাকে পেলে না, সম্ভবত মাঝ থেকে খোয়া গেল নিজেরই আত্মা ! হায়রে শিল্পী-সারাটা জীবনে তুমি নিজের একটা প্রতীক খুঁজে পেলে না।
সারাটা জীবন, সারাটা জীবন নিজের একটা প্রতীক খুঁজে পেলাম না। কতই না বড় জীবন, তিরিশ-চল্লিশ, তৰু এত দীর্ঘ মনে হয়। এতগুলো বছর ধরে খুঁজলাম অথচ জানতে পেলাম না আমি একটা গাছ না পোকা, আলো না মোটরের হেডলাইট, একটা খোয়া ওঠা পথ নাকি গঙ্গা। নিজের প্রতীক খুঁজে ফিরে শেষে আমি আত্মবিস্মৃত। কলকাতার পথ দিয়ে যখন অন্যমনস্ক থাঁটি, একা একা, তাকাতে চাই না তবু চোখে পড়ে ঐ অসংখ্য ছাত ছাড়িয়ে হঠাৎ একটা চিলেকোঠার উদাসীনতা। ভাবতে চাই না তবু ভেবে ফেলি ঐ উদাসীন চিলেকোঠটি বুঝি আমার প্রতীক। তাকাতে চাই না তবু চোখে পড়ে বন্ধ দোকানের সিঁড়ির উপর কুঁকডে শুয়ে কোনো নাবালক, আর কর্পোরেশনের কলে নির্জন জলধারা সজীব সরীসৃপের মতো বয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। ভাবতে চাই না, তবু ভেবে ফেলি ঐ জলধারার নির্জনতাটি বুঝি আমার প্রতীক। তাকাতে চাই না তবু চোখে পড়ে যায় কোনো শহিদের নামাঙ্কিত দুপুরের জনহীন পার্কে মেহেদিগাছের বেড়ায় টকটকে লাল কাপড়ের চিৎকার আর মেহেদিপাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় কোনো শরীরের গামছাতে ঢাকা-না-পড়া পায়ের একাংশ । ভাবতে চাই না, তবু ভেবে ফেলি ঐ অযত্নলালিত যৌবন আর লাল কাপড়ের চিৎকার আমারই প্রতীক। এ-রকম হঠাৎ হঠাৎ দেখে ফেললে, ভেবে ফেললে মনে হয় সারাটা কলকাতা শহরে নানাদৃশ্য এঁকে রেখে দিয়েছি আমিই। সারাটা কলকাতা যেন আমার কোনো বিশ্বত প্রদর্শনী। সে-প্রদর্শনীতে আমি ভ্রাণ্যমান। আর তখনি আমার ভয় করে যে কলকাতার ম্যানহোলগুলি হঠাৎ খুলে গিয়ে আমাকে গ্রাস করে নেবে বা পাড়ার ছেলেরা আমাকে পাগল বলে চিলবে। কারণ শেষ পর্যন্ত কলকাতা আমার হতে পারেনি। আমি একটা দেশ স্থান, খুঁজছিলাম। কলকাতা আমার দেশ নয়। কলকাতা আমার দেশ নয় । অথচ কলকাতার পথঘাট, চিলেকোঠা, মেহেদিবেড়াতে ঝোলা কমদামি লালরঙ, জলধারা, আমার প্রতীক, আমারই প্রতীক।
অনেকদিন আগে লেখা তোমার একটা চিঠির অংশ--''আসলে এই প্রশ্নের উত্তরটি পাওয়ার আগে আমার পক্ষে কোথাও এমনকি একটি ব্যক্তির কাছেও অনুগত হওয়া সম্ভব নয়। আমার কোনো দেশ নেই। পূর্ববাঙলা সরিয়তি শাসনের কল্যাণে আমার বিদেশ। পশ্চিম বাংলায় আমি একটি নম্বর, একজন উদ্ধাস্ত--আমার দেশ কোথায়, না জানা পর্যন্ত আমার পক্ষে কোনো একটি মানুষের অনুগত হওয়া সম্ভব নয়। 'জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে'-- এ আত্মপরিচয়েও মানুষ বাঁচতে পারে। বাঁচতে পারে না দেশহীনতায় "-এই চিঠির কাগজে একটা স্কেচ আঁকা, আমার বেণীর, আগের দিন আঁক কাটছিলে ।
তোমার একদিনের সংলাপ--
’তুমি জানো না, ভাবতে পারবে না, আমি যখন পাকিস্তান থেকে চলে এলাম, আমাকে উদ্বাস্ত সার্টিফিকেট দিতে রাজি হচ্ছিল না, তার কারণ আমি মুসলমান। আমাকে ঝগড়া করতে হয়েছে যে কোন নিয়ম অনুযায়ী একজন মুসলমান উদ্বাস্তু হতে পারবে না। একবার ভেবে দেখো, পাকিস্তানে মুসলমানদের হাতে মার খেয়ে ভয়ে পীড়নে পাগল হয়ে, কেউ-বা সর্বস্ব খুইয়ে কেউবা প্রাণটুকু নিয়ে এপারে এসেছে। তারা যদি চোখের সামনে দেখে একজন মুসলমান নিজেকে উদ্বাস্ত বলে দাবি করছে, ঝগড়া করছে, উদ্বাস্তু সার্টিফিকেট নিচ্ছে, তবে তাদের ইচ্ছে করবে না আমাকে মেরে ছিড়ে টুকরোটুকরো করতে ? আমি জানি না, আমি মনে-মনে তাই চেয়েই পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলাম কিনা। কিন্তু সামান্য কিল-চড়-ঘুষি ছাড়া আমার কপালে কোনোদিনই কিছু জুটল না। তোমাদের কলকাতা শহরের দাঙ্গাতেও আমাকে কেউ মারল না। শেষ পর্যন্ত আমাকে যদি কেউ মুসলমান বলে খুনও করত, আমি বেঁচে যেতাম—-'
কলকাতাকে আমি আমার দেশ করতে চেয়েছিলাম। কলকাতার ছবি আকঁবো বলে স্কেচ বই বগলে নিয়ে সারা কলকাতা চষে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি আমার কোনো প্রতীক খুঁজে পাইনি, আমার সঙ্গে কলকাতার যোগের কোনো প্রতীক। বিশ্বামিত্র রাজা ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে পাঠালেও ত্রিশঙ্কু স্বর্গকে নিজের দেশ ভাবতে পারেনি, ত্রিশঙ্কু স্বর্গের সঙ্গে নিজের যোগের কোনো প্রতীক খুঁজে পায়নি। আর মাটির সঙ্গে যোগেরও তার কোনো শিকড় ছিলো না। ভেবেছিলাম গঙ্গানদীতে নিজেকে পাব। একটা বড় ছবি এঁকেছিলাম। গঙ্গানদীর । কলকাতার গঙ্গানদীর । আমার একমাত্র আত্মপ্রতিকৃতি প্রাচীন চীনাচিত্রে যেমন দুই পাশে সবুজ সমতলের মধ্য দিয়ে মহাপ্রাচীরের ধূসর স্থবিরতা বয়ে যায়--নির্মম, কোমল, অনতিউচ্চ ও অনতিপ্রশস্ত-বিশেষণ রচে রচে, তেমনি গঙ্গানদী বয়ে যাচ্ছে, অতিসারল্যের একটা মিথ্যা অজুহাত ছড়িয়ে ছড়িয়ে--কিন্তু সেই বয়ে যাওয়ার দুই পাশে সবুজ সমতল নয়, টকটকে লাল । এমন টকটকে যে গঙ্গার গেরুয়া ধারাকেও মনে হয় সাদা। এতো লাল যে মনে হয় ফুসফুস ফেটে ছড়িয়ে--মাঝ দিয়ে শ্বাসনালীর অকেজো নল ; পরে ছবিটার নাম দিতে হয়েছিল--বার্নিলওয়াল। যদি ছবিটিতে আমি সত্যসত্যই আমার প্রতীকরূপে গঙ্গাকে আনতে পারতাম বোধহয় তাহলে আত্মদানের পথ খুঁজে পেতাম। কিন্তু গঙ্গাধারা গিয়ে শেষ হয় বার্নিলের ওয়ালে। আমার দেশ মিলবে কোত্থেকে । আমি কিছু জন্মের ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার অসংলগ্নতা বোধহয় জন্মের প্রতীকে সংলগ্নতা পাবে। ভেবেছিলাম আমার উপাধিহীনতা বোধহয় জন্মের প্রতীকে উপাধি পাবে । রক্তাক্ত জন্ম, বেঁচেথাকার জন্য। সাল বনের মধ্যে গোলাপী শিশু। রক্ত গোলাপ--অন্য অর্থে। সব ছবিতেই জন্মের চাপচাপ রক্তই যেন প্রধান হয়ে উঠল । সব ছবিতেই সেই গোলাপ রঙের শিশু সেই রক্তকে দ্বিধা করেছে। পরে সেইসব ছবির নাম দিতে হয়েছিল বাঙলা—উনিশ শ সাতচল্লিশ । আমি যদি লালরঙের ব্যবহার ভুলতে পারতাম। যদি পারতাম। আমি কিছু মৃত্যুর ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার সব নাস্তিক্য নিখিল নাস্তির আগ্নেয় মহিমায় লোপ হয়ে যাবে। যাক। লোপই হয়ে যাক। কিন্তু কোদাল দিয়ে ওপড়ানো মাটি আমার তুলিতে লাল হয়ে গেল। যেন মৃত্যুর আশ্রয় নয়, ধরণীর হত্যা । মাটির ভেতরে এত রক্তের মত লাল থাকে কে জানত। কিছু দাহনের, শববাহনের ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম। যাক, আমার অস্তিত্বহীনতার গ্লানি লোপ পেয়ে যাক । কিন্তু আগুনের শিখার ক্ষুরধার রক্তাক্ততা যেন হত্যার রক্ত হয়ে উঠলো। আর সেই হত্যার রক্তের মধ্যপথে একটা সূত্রাকার বিচ্ছেদ রেখা। পরে এইসব মৃত্যুর ছবির নাম দিতে হয়েছিল 'কোরিয়া' 'ভিয়েতনাম । আমি যদি বিচ্ছেদরেখার ব্যবহার ভুলতে পারতাম, যদি পারতাম। একটা পুরো ক্যানভাস জুড়ে একটা পুরো ছবি আমার আঁকা হল না। ছবির ভেতর থেকে শাদা এক রেখা ফুটে দ্বিধা এনে দেয়। হায়রে আমার অসংলগ্নতা। হায়রে আমার দ্বিধা। আমি কেন কোথাও লগ্ন হতে পারি না। ঈশ্বর, আমাকে লগ্নতা দাও। তুমি একদা আমার ঈশ্বর হতে অভিলাষ করেছিলে, তুমি আমাকে লগ্নতা দিতে পারনি ।
তুমি একদিন একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছিলে--ঈশ্বরী আমার, আমাকে জন্মহীনতা থেকে পরিত্রাণ করো!--আমি জানি না তোমার জন্মহীনতার পরিত্রাণ কোথায়। আমি জানি না আমি তোমার ঈশ্বরী কিরূপে। একদিন তুমি বলেছিলে আমার একটি ছবি আঁকবে । কয়েকমাস পর দেখিয়েছিলে একটা ছবি । দেখে মনে হয়েছিল অসম্পূর্ণ। তুমি বলেছিলে, না-এটাই সম্পূর্ণতা। ছবিটির প্রধান রঙ ছিল সোনার! দূর থেকে দেখলে মনে হয় যে এক গুলমোহরের গাছের সর্বাঙ্গে ফুল। আর তারই মধ্যে যেন এক নারীদেহের আভাস আগে। কিন্তু সে নারীদেহের বুকের মাঝখান দিয়ে একটা সুতোর মত রেখা, ছবির নীচে লেখা ছিলো ‘সেঁউতির উপর পদ রাখিতে রাখিতে/ সেঁউতি হইল সোনা দেখিতে দেখিতে' । উল্লাসে আত্মহারা হয়ে তুমি বলেছিলে—‘লালরঙ ব্যবহার না করে এই পুরো ছবিটি আমি এঁকেছি, এখন ঐ মাঝখানের রেখাটি--- আমি বুঝিনি। কিন্তু সেদিন আমি ভয় মেনেছিলাম--তবে আমাকেই তুমি তোমার জননীত্বে বরণ করেছ। হায়রে, আমার অজ্ঞাতেই আমার গর্ভে তুমি তোমার অধিকার সাব্যস্ত করেছিলে। আমি জানি এতদিনে সে-ছবির নীচের কবিতার চরণদুটি তুমি মুছে দিয়েছ। ঐ একটিমাত্র ছবিতে তোমার উল্লাস ছিল, হয়ত কিছু প্রেমও। আর-সব ছবিতে শুধু রক্ত, শুধু হত্যা শুধু দ্বিধা।
ক্ষুদিরামকে নিয়েই ত গানটা : দশমাস দশদিন পরে / জন্ম নেব মাসির ঘরে/ চিনতে যদি না পারো মা/ গলায় দেবো ফাঁসি!! যে বিচ্ছেদ রেখাটিকে আমার ছবি থেকে আমি দূর করতে পারিনি, আমার গলায় মালার মত সেই রেখাটিকে ধারণ করবো চিরতরে। অন্ধকারে, মিলিয়ে মা গাছের ডালে। দশ মাস দশ দিন পরে, জন্ম নেব মাসির ঘরে, চিনতে যদি না পারো মা, গলায় দেবো ফাঁসি- -পরজন্মেও এই ফাঁসির দাগ গলায় থাকবে, এই দ্বিধা চিহ্ন, এই বিভক্তিরেখা। কিন্তু শরিয়তি শাসনের দেশ থেকে গণতন্ত্রের দেশে আসা এক উদ্বাস্ত -- আমার আত্নহত শবদাহ হবে কোন রীতিতে? আমি কিরূপে জানতে পাৱব--মর্গে আমার দেহের ভিতরে ডাক্তার যখন মৃত্যুর কারণ খুঁজছিলেন তখন সেখানেও এমন কোনো বিভক্তিচিহ্ন দেখেছেন কিনা। আত্মহত্যার পূর্বে আমি একটা শেষ ছবি আঁকব। প্যানেল। তাতে শুধু থাকবে অসংখ্য মানুষের ফিগার, শুধু মানুষের ফিগার, নানা ভঙ্গিতে, নানা চেহারায়। কিন্তু কোনো একটি ফিগারের কোনো একটি অঙ্গও সম্পূর্ণ নয়। পায়ের পাতা থেকে আঙ্গুলগুলি আলাদা। গোঙালি থেকে হাটু পর্যন্ত আলাদা। হাটু থেকে সন্ধি পর্যন্ত আলাদা, পেট-বুক আলাদা, মাথা আলাদা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বুঝিবা কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি—যথ কুরুক্ষেত্রের পর । কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে না। ওগুলো মানুষের খণ্ডিত অঙ্গ নয়, সমগ্র মানুষ। সমগ্র মানুষই নয় শুধু খণ্ডিত সমগ্র মানুষ উভয়ত। সব অঙ্গই আছে, সামঞ্জস্যও আছে নেই শুধু অঙ্গগুলির যোগাযোগ। অথচ সেই বিভক্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়েই মানুষগুলি এরোপ্লেন চালাচ্ছে, রেলগাড়ি বানাচ্ছে, সমুদ্রের তলায় নামছে, মরুভূমি পার হচ্ছে, পাহাড়ের ওপর উঠছে। ত্রিকোণের সমাবেশে ছবিটিতে এই ব্যঞ্জনা আনতে হবে যে কখনো মনে হবে সমবেত একটি কর্মকাণ্ডের ছবি, কখনো মনে হবে খণ্ডিতদেহ মানবজাতির ছবি। যে-রঙটি আমাকে সারাটা জীবন তাড়া করে ফিরল, একবার তাকে মাত্র ভোলা গিয়েছিল, যে-রঙটি চিতার আগুনের মত, রক্তের মত, আমাকে সারাজীবন পুড়িয়ে দিল, ভাসিয়ে দিল, সেই রঙের ব্যবহার করব এই ছবিতে-আমার মনের সুখে। যে-রেখাটি আমাকে সারাজীবন তাড়িয়ে ফিরল, যে-রেখাটি ছবির ভেতর থেকে ফুটে উঠে আমার সমগ্র ছবিকে দুভাগ করে দিল, যে-রেখাটি মৃত্যুরোগের মত নিয়ত আমাকে পীড়িত করল—সেই বিচ্ছেদ রেখাটির পূর্ণ ব্যবহার আমি এই ছবিটিতে করব, ছবিটির নাম দেব, পৃথিবী ১৯৬৫, ছবিটি জাতিপুজ্ঞে পাঠানো হবে নিখিল উদ্বাস্ত বৎসরের প্রধান পোস্টার করার জন্য।
আর আত্মহত্যার সময় আমি এই বুকটাকে দুইভাগ করে একটা ডাবলফুলস্ক্যাপ সাইজের ব্লটিঙ কাগজে হৃৎপিণ্ডের ও রক্তের দাগ তুলে দেব। আমার রক্তের বিচ্ছেদ রেখাটিকে বের করতে সেটাও জাতিপুঞ্জে পাঠানো হবে।
১৯৬৫
0 মন্তব্যসমূহ