রামকুমার মুখোপাধ্যায়
আখ্যান শব্দের অর্থ হল কথন, উক্তি, বচন। ‘বিবরণ’ অর্থে শব্দটির যে ব্যবহার তাকে সংস্কৃত সমালোচকেরা দুটি ভাগে ভাগ করেছেন—একটি হল ‘আখ্যায়িকা’ এবং অন্যটি হল ‘কথা’। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে বাণভট্টের হর্ষচরিত হচ্ছে আখ্যায়িকা এবং একই লেখকের কাদম্বরী হল কথা। প্রথমটির ক্ষেত্রে লেখক একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কল্পনার মাধ্যমে একটি কাহিনী সৃষ্টি করেছেন। আবার ‘কথা’র পাশাপাশি ‘গাথা’ শব্দটিও প্রচলিত ছিল পদ্য বিবরণের জন্য। এই ‘গাথা’ গোত্রে শ্লোক থেকে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য পালাগান ইত্যাদি অনেক কিছুই পড়ে।
আখ্যানের জন্ম-রহস্য বিষয়ে আলোচনায় পণ্ডিতেরা বলেছেন গোষ্ঠীগত, সামাজিক এবং পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এর সৃষ্টি। যে কোনো আচার-অনুষ্ঠান মানেই এক-একটি কিংবদন্তী। সে-সব পরে কাহিনীর রূপ নেয়। আর তার ভেতর জীবনের ছোট-বড়ো নানান কথা, দেবদেবী পশুপাখি ইত্যাদি নানা জন এবং নানা কিছুর উপস্থিতি। সময় এবং পরিসরের দিক দিয়ে এক মহাব্যাপ্তি তার ভেতর। অন্যদিকে অতীতের কথা বললেও তা সমসাময়িক, দেবদেবীদের কথা শোনালেও তা মানবিক, কৌমের যৌথ ও সমবেত অনুভূতির কথা বর্ণনা করলেও তা ব্যক্তি-প্রাসঙ্গিক।
সাহিত্য আখ্যানের যে ইতিহাস তার দুটি ধারা—একটি পাশ্চাত্যের এবং অন্যটি প্রাচ্যের। পাশ্চাত্য ধারার দুটি মূল রীতি হল গ্রিসিয় ও ইহুদীয়।
গ্রিসিয় আখ্যানের দুটি স্তম্ভ হচ্ছে ইলিয়াড ও ওডিসি। কাহিনী দুটি বহুকাল ধরে প্রচলিত থাকলেও অষ্টম শতাব্দির মাঝামাঝি ইলিয়াড ও একই শতাব্দির শেষের দিকে ওডিসি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের অনুমান। গ্রিসিয় বিক্রয়, সংহতি, নৈতিকতা এবং দৈনন্দিনের জীবনচর্চার এক ছবি মহাকাব্য দুটিতে। এতো গভীরভাবে আর কোনো কাহিনি গ্রিসিয় জীবনে প্রভাব ফেলেনি। হোমার ছিলেন চারণ কবি এবং তাঁরই গাওয়া কথা কেউ লিখে গেছেন বলে অনুমান। কিন্তু অন্য গায়কদের তুলনায় কি অর্থে হোমার ভিন্ন, কোথায় তাঁর নির্মাণের অনন্যতা? এটি হোমারের প্রধান অবদান যে তিনি কাহিনীটির বিস্তার ঘটিয়েছেন, নতুন বিবরণে প্রবেশ করেছেন এবং একই সঙ্গে জীবনের অনেক জটিল স্তর স্পর্শ করেছেন। উপস্থাপনা এতই মিশ্র যে ইতিহাসের নির্দিষ্টি সময়ে কাহিনি দুটিকে বাঁধা যায় না। কিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গির হদিশ মেলে না, জীবনের প্রচলিত হিসেব মেলে না অথচ সব কিছু মিলে জীবনের আশ্চর্য ছবি ফুটে ওঠে। দুটি মহাকাব্য গঠনের দিক দিয়ে যেন বেশ ঢিলেঢালা কিন্তু কোথাও আশ্চর্য সংহতি আছে। আর পরবর্তী পর্বের কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিকরা—শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এই বই দুটি থেকে চিন্তা ও সৃষ্টির নানা উপাদান সংগ্রহ করেছেন।
অন্যদিকে ইহুদি বাইবেলটি আর এক অর্থে মানুষের জীবন এবং কথন-লেখনকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে। বাইবেলের গ্রন্থটি তিন ভাগে ভাগ করা হয়—
ক. বিধানশাস্ত্র (বাইবেলের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থ যা গ্রন্থপঞ্চক নামে পরিচিত)
খ. অবতারদের বাণী (যোশুয়া, বিচারক চরিত, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্যামুয়েল, প্রথম ও দ্বিতীয় রাজাবলি, ইসাইয়া, জেরেমিয়া, ত্রজেকিয়েল, হোসেয়া, যোয়েল, আমোন, ওবাদিয়া, যোনা, মিথা, নাহুম, হাবাকুক, সেফানিয়া, হগয়, জাখারিয়া এবং মালাখি)
গ. রচনাবলী যার আর এক পুণ্য শাস্ত্রাবলি ( এগুলির মধ্যে রয়েছে সামসঙ্গীত, যোর, প্রবচন, রূপ, পরমগীত, উপদেশক, বিলাপ, এসথার, বৃহত্তর রচনার প্রবক্তাদের অন্যতম দানিয়েল, এজরা, নেহেমিয়া এবং বংশাবলি ১-২)
বাইবেল কে লিখেছেন জানা যায়নি। আদি বাইবেলের লেখক হিসেবে মোজেজ-এর কথা বলা বলা হয় কিন্তু তিনি অনেক সময়েই থার্ড পার্সনে উল্লিখিত। ফলে মনে হয় আদি বাইবেল যেন এক সমবেত দৃষ্টি এবং তার বেড়ে ওঠা গাছ কিংবা পাহাড়ের মতো প্রাকৃতিক। মনে হয় এটি ৭০ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা হয়। বইটিতে মোট চব্বিশটি পর্ব। বাইবেল প্রসঙ্গে দস্তয়েভস্কির মতো স্বপ্ন দুর্ভিক্ষ, ভাগ্যমন্ত সংখ্যা ইত্যাদি নানা কিছু বিষয়ের ওপর নানা শৈলীর নানা স্বরবিন্যাসের কাহিনী।
চিনা আখ্যানের ইতিহাসের যে দুজন মানুষ গভীরভাবে ছাপ ফেলে গেছেন তাঁরা হলেন লাও-ৎস (খ্রিস্টপূর্ব ষোষ্ঠ-পশচম) এবং খুং-ফুৎস (জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১)। লাও-ৎসের লেখা তাও-তে-চিং এবং খুং-ফুৎসের লূন-ইয়ু শুধু দর্শনচিন্তার দিক থেকে নয়, চিনজাতির মনোজগৎকে একটি বিশেষ রূপ দিয়েছে শতকের পর শতক ধরে। লাও-ৎসের ক্ষেত্রে দর্শনের দিকটি বেশী আর খুং-ফুৎস জোর দিয়েছেন সামাজিক, নৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্বের প্রতি। প্রথমটি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বাণীর সংকলন, দ্বিতীয়টি ভক্তদের সঙ্গে কথোপকথন। জীবনের দৈনন্দিন, যৌথজীবনচর্চা, যুদ্ধক্ষেত্রের হিসেবনিকেশ ইত্যাদির সঙ্গে জীবনের বৃহত্তর অর্থ-সন্ধান বই দুটিকে অনন্য করে তুলেছে। চিনা জীবন ও সাহিত্য এই কথ্যশৈলী প্রভাবিতও করে এসেছে বহুকাল।
অন্যদিকে জাপানি মহিলা আখ্যানকার মুরাসাকি শিকিবুর (৯৭৮-১০১৬) গেন্জি মোনোগাতারি পৃথিবীর প্রথম উপন্যাসটি লিখেছেন কিছু সমালোচকের অভিমত। চুয়ান্ন পরিচ্ছেদের এই বইটিতে ব্যক্তি মানুষের এক-দুদিনের ক্ষণস্থায়ী জীবনের কথা। আর সেই মরণশীল জীবনের মধ্যে কেমন করে সে মৃত্যুহীনতার সন্ধান পায়—রয়েছে সে কথাও। এটি হল হিকারু গেন্জি (হিকারু শব্দের অর্থ উজ্জ্বল) নামের এক যুবকের কথা যে নানা চরিত্রের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে চলে এবং শেষ পর্যন্ত করুণ পরিণতি ভোগ করে। রাজসভার ক্ষয়িষ্ণু চরিত্র ধরা রয়েছে বইটিতে। ঔপন্যাসিকরা পটচিত্র খোলার ভঙ্গিতে কাহিনীটি উপস্থাপন করেছেন। জীবনের দৈনন্দিনের সঙ্গে সন্ধান করেছেন বুদ্ধের বিশ্বদর্শন। শিকিবুর এই কাহিনীটি বিগত নশো বছর ধরে শুধু জাপানি উপন্যাস নয় জাপানি কবিতা, হস্তশিল্প, এমনকি বাগান পরিকল্পনাকেও প্রভাবিত করেছে।
ভারতীয় মহাভারত ও রামায়ণ অন্য দুই আশ্চর্য কাহিনি-কাব্য যা ভারতীয় ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য, সংগীত, ছায়াছবি এবং অন্যান্য শিল্প মাধ্যমকে বহুকাল ধরে প্রভাবিত করে আসছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক ভারতবাসীর জীবনের নানা অনুভূতি যেন ধারণ করে আছে বই দুটি। প্রতিটি খণ্ড এক অর্থে সম্পূর্ণ আবার খণ্ডগুলি জুড়ে অন্য অন্য এক অখণ্ডতা তৈরি হয়। এ দুই মহাকাব্য যেন আমাদের ইতিহাস যা পুনর্কথনে আবার বর্তমানও হয়ে ওঠে। কাহিনি-কাব্য দুটি এগোয় সুখ ও দুঃখ, প্রতিহিংসা ও ক্ষমা, যুদ্ধ ও শান্তির মধ্য দিয়ে। প্রতিটি খণ্ড সত্য তেমনই সমগ্রও সত্য—এমন এক গঠন রহস্য চোখে পড়ে দুটি মহাকাব্যেই।
এই বৃহৎ ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিক আখ্যানেরও নানা রূপ চোখে পড়েছে অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকেই। উপন্যাসের পাশাপাশি জন্ম নিয়েছে ছোটোগল্প। কাহিনি গদ্যের যেমন শিল্প-রূপ-নির্দিষ্টতা তৈরি হয়েছে তেমন আবার প্রাচীন ভেঙেও যাচ্ছে নানা ভাষার নানা কলমে। কোথাও মিথ ঢুকে পড়ছে দৈনন্দিনে, কোথাও আবার ভ্রমণসাহিত্য এবং কথাসাহিত্যের মাঝের বেড়া উঠে যাচ্ছে। নারীর কলমে অন্য এক অনুভূতি আকার পাচ্ছে কথাসাহিত্যের। । কালোমানুষের কাহিনি ভিন্ন এক বাচনে কিছু কথা বলে নিতে চাইছে দলিত কথাকারদের মতোই। এই বিশ্বায়নের অন্য কিছু কথাও প্রকাশ পাচ্ছে বিদেশি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কলমে। এ-ভাবেই ভাঙা-গড়া চলছে আখ্যানের মন ও শরীরে।
আখ্যান শব্দের অর্থ হল কথন, উক্তি, বচন। ‘বিবরণ’ অর্থে শব্দটির যে ব্যবহার তাকে সংস্কৃত সমালোচকেরা দুটি ভাগে ভাগ করেছেন—একটি হল ‘আখ্যায়িকা’ এবং অন্যটি হল ‘কথা’। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে বাণভট্টের হর্ষচরিত হচ্ছে আখ্যায়িকা এবং একই লেখকের কাদম্বরী হল কথা। প্রথমটির ক্ষেত্রে লেখক একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কল্পনার মাধ্যমে একটি কাহিনী সৃষ্টি করেছেন। আবার ‘কথা’র পাশাপাশি ‘গাথা’ শব্দটিও প্রচলিত ছিল পদ্য বিবরণের জন্য। এই ‘গাথা’ গোত্রে শ্লোক থেকে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য পালাগান ইত্যাদি অনেক কিছুই পড়ে।
আখ্যানের জন্ম-রহস্য বিষয়ে আলোচনায় পণ্ডিতেরা বলেছেন গোষ্ঠীগত, সামাজিক এবং পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এর সৃষ্টি। যে কোনো আচার-অনুষ্ঠান মানেই এক-একটি কিংবদন্তী। সে-সব পরে কাহিনীর রূপ নেয়। আর তার ভেতর জীবনের ছোট-বড়ো নানান কথা, দেবদেবী পশুপাখি ইত্যাদি নানা জন এবং নানা কিছুর উপস্থিতি। সময় এবং পরিসরের দিক দিয়ে এক মহাব্যাপ্তি তার ভেতর। অন্যদিকে অতীতের কথা বললেও তা সমসাময়িক, দেবদেবীদের কথা শোনালেও তা মানবিক, কৌমের যৌথ ও সমবেত অনুভূতির কথা বর্ণনা করলেও তা ব্যক্তি-প্রাসঙ্গিক।
সাহিত্য আখ্যানের যে ইতিহাস তার দুটি ধারা—একটি পাশ্চাত্যের এবং অন্যটি প্রাচ্যের। পাশ্চাত্য ধারার দুটি মূল রীতি হল গ্রিসিয় ও ইহুদীয়।
গ্রিসিয় আখ্যানের দুটি স্তম্ভ হচ্ছে ইলিয়াড ও ওডিসি। কাহিনী দুটি বহুকাল ধরে প্রচলিত থাকলেও অষ্টম শতাব্দির মাঝামাঝি ইলিয়াড ও একই শতাব্দির শেষের দিকে ওডিসি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের অনুমান। গ্রিসিয় বিক্রয়, সংহতি, নৈতিকতা এবং দৈনন্দিনের জীবনচর্চার এক ছবি মহাকাব্য দুটিতে। এতো গভীরভাবে আর কোনো কাহিনি গ্রিসিয় জীবনে প্রভাব ফেলেনি। হোমার ছিলেন চারণ কবি এবং তাঁরই গাওয়া কথা কেউ লিখে গেছেন বলে অনুমান। কিন্তু অন্য গায়কদের তুলনায় কি অর্থে হোমার ভিন্ন, কোথায় তাঁর নির্মাণের অনন্যতা? এটি হোমারের প্রধান অবদান যে তিনি কাহিনীটির বিস্তার ঘটিয়েছেন, নতুন বিবরণে প্রবেশ করেছেন এবং একই সঙ্গে জীবনের অনেক জটিল স্তর স্পর্শ করেছেন। উপস্থাপনা এতই মিশ্র যে ইতিহাসের নির্দিষ্টি সময়ে কাহিনি দুটিকে বাঁধা যায় না। কিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গির হদিশ মেলে না, জীবনের প্রচলিত হিসেব মেলে না অথচ সব কিছু মিলে জীবনের আশ্চর্য ছবি ফুটে ওঠে। দুটি মহাকাব্য গঠনের দিক দিয়ে যেন বেশ ঢিলেঢালা কিন্তু কোথাও আশ্চর্য সংহতি আছে। আর পরবর্তী পর্বের কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিকরা—শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এই বই দুটি থেকে চিন্তা ও সৃষ্টির নানা উপাদান সংগ্রহ করেছেন।
অন্যদিকে ইহুদি বাইবেলটি আর এক অর্থে মানুষের জীবন এবং কথন-লেখনকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে। বাইবেলের গ্রন্থটি তিন ভাগে ভাগ করা হয়—
ক. বিধানশাস্ত্র (বাইবেলের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থ যা গ্রন্থপঞ্চক নামে পরিচিত)
খ. অবতারদের বাণী (যোশুয়া, বিচারক চরিত, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্যামুয়েল, প্রথম ও দ্বিতীয় রাজাবলি, ইসাইয়া, জেরেমিয়া, ত্রজেকিয়েল, হোসেয়া, যোয়েল, আমোন, ওবাদিয়া, যোনা, মিথা, নাহুম, হাবাকুক, সেফানিয়া, হগয়, জাখারিয়া এবং মালাখি)
গ. রচনাবলী যার আর এক পুণ্য শাস্ত্রাবলি ( এগুলির মধ্যে রয়েছে সামসঙ্গীত, যোর, প্রবচন, রূপ, পরমগীত, উপদেশক, বিলাপ, এসথার, বৃহত্তর রচনার প্রবক্তাদের অন্যতম দানিয়েল, এজরা, নেহেমিয়া এবং বংশাবলি ১-২)
বাইবেল কে লিখেছেন জানা যায়নি। আদি বাইবেলের লেখক হিসেবে মোজেজ-এর কথা বলা বলা হয় কিন্তু তিনি অনেক সময়েই থার্ড পার্সনে উল্লিখিত। ফলে মনে হয় আদি বাইবেল যেন এক সমবেত দৃষ্টি এবং তার বেড়ে ওঠা গাছ কিংবা পাহাড়ের মতো প্রাকৃতিক। মনে হয় এটি ৭০ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা হয়। বইটিতে মোট চব্বিশটি পর্ব। বাইবেল প্রসঙ্গে দস্তয়েভস্কির মতো স্বপ্ন দুর্ভিক্ষ, ভাগ্যমন্ত সংখ্যা ইত্যাদি নানা কিছু বিষয়ের ওপর নানা শৈলীর নানা স্বরবিন্যাসের কাহিনী।
চিনা আখ্যানের ইতিহাসের যে দুজন মানুষ গভীরভাবে ছাপ ফেলে গেছেন তাঁরা হলেন লাও-ৎস (খ্রিস্টপূর্ব ষোষ্ঠ-পশচম) এবং খুং-ফুৎস (জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১)। লাও-ৎসের লেখা তাও-তে-চিং এবং খুং-ফুৎসের লূন-ইয়ু শুধু দর্শনচিন্তার দিক থেকে নয়, চিনজাতির মনোজগৎকে একটি বিশেষ রূপ দিয়েছে শতকের পর শতক ধরে। লাও-ৎসের ক্ষেত্রে দর্শনের দিকটি বেশী আর খুং-ফুৎস জোর দিয়েছেন সামাজিক, নৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্বের প্রতি। প্রথমটি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বাণীর সংকলন, দ্বিতীয়টি ভক্তদের সঙ্গে কথোপকথন। জীবনের দৈনন্দিন, যৌথজীবনচর্চা, যুদ্ধক্ষেত্রের হিসেবনিকেশ ইত্যাদির সঙ্গে জীবনের বৃহত্তর অর্থ-সন্ধান বই দুটিকে অনন্য করে তুলেছে। চিনা জীবন ও সাহিত্য এই কথ্যশৈলী প্রভাবিতও করে এসেছে বহুকাল।
অন্যদিকে জাপানি মহিলা আখ্যানকার মুরাসাকি শিকিবুর (৯৭৮-১০১৬) গেন্জি মোনোগাতারি পৃথিবীর প্রথম উপন্যাসটি লিখেছেন কিছু সমালোচকের অভিমত। চুয়ান্ন পরিচ্ছেদের এই বইটিতে ব্যক্তি মানুষের এক-দুদিনের ক্ষণস্থায়ী জীবনের কথা। আর সেই মরণশীল জীবনের মধ্যে কেমন করে সে মৃত্যুহীনতার সন্ধান পায়—রয়েছে সে কথাও। এটি হল হিকারু গেন্জি (হিকারু শব্দের অর্থ উজ্জ্বল) নামের এক যুবকের কথা যে নানা চরিত্রের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে চলে এবং শেষ পর্যন্ত করুণ পরিণতি ভোগ করে। রাজসভার ক্ষয়িষ্ণু চরিত্র ধরা রয়েছে বইটিতে। ঔপন্যাসিকরা পটচিত্র খোলার ভঙ্গিতে কাহিনীটি উপস্থাপন করেছেন। জীবনের দৈনন্দিনের সঙ্গে সন্ধান করেছেন বুদ্ধের বিশ্বদর্শন। শিকিবুর এই কাহিনীটি বিগত নশো বছর ধরে শুধু জাপানি উপন্যাস নয় জাপানি কবিতা, হস্তশিল্প, এমনকি বাগান পরিকল্পনাকেও প্রভাবিত করেছে।
ভারতীয় মহাভারত ও রামায়ণ অন্য দুই আশ্চর্য কাহিনি-কাব্য যা ভারতীয় ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য, সংগীত, ছায়াছবি এবং অন্যান্য শিল্প মাধ্যমকে বহুকাল ধরে প্রভাবিত করে আসছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক ভারতবাসীর জীবনের নানা অনুভূতি যেন ধারণ করে আছে বই দুটি। প্রতিটি খণ্ড এক অর্থে সম্পূর্ণ আবার খণ্ডগুলি জুড়ে অন্য অন্য এক অখণ্ডতা তৈরি হয়। এ দুই মহাকাব্য যেন আমাদের ইতিহাস যা পুনর্কথনে আবার বর্তমানও হয়ে ওঠে। কাহিনি-কাব্য দুটি এগোয় সুখ ও দুঃখ, প্রতিহিংসা ও ক্ষমা, যুদ্ধ ও শান্তির মধ্য দিয়ে। প্রতিটি খণ্ড সত্য তেমনই সমগ্রও সত্য—এমন এক গঠন রহস্য চোখে পড়ে দুটি মহাকাব্যেই।
এই বৃহৎ ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিক আখ্যানেরও নানা রূপ চোখে পড়েছে অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকেই। উপন্যাসের পাশাপাশি জন্ম নিয়েছে ছোটোগল্প। কাহিনি গদ্যের যেমন শিল্প-রূপ-নির্দিষ্টতা তৈরি হয়েছে তেমন আবার প্রাচীন ভেঙেও যাচ্ছে নানা ভাষার নানা কলমে। কোথাও মিথ ঢুকে পড়ছে দৈনন্দিনে, কোথাও আবার ভ্রমণসাহিত্য এবং কথাসাহিত্যের মাঝের বেড়া উঠে যাচ্ছে। নারীর কলমে অন্য এক অনুভূতি আকার পাচ্ছে কথাসাহিত্যের। । কালোমানুষের কাহিনি ভিন্ন এক বাচনে কিছু কথা বলে নিতে চাইছে দলিত কথাকারদের মতোই। এই বিশ্বায়নের অন্য কিছু কথাও প্রকাশ পাচ্ছে বিদেশি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কলমে। এ-ভাবেই ভাঙা-গড়া চলছে আখ্যানের মন ও শরীরে।
0 মন্তব্যসমূহ