ইমতিয়ার শামীমের গল্প : বাসনার মতো শূন্যতায়

সকাল হতেই হামজা আজ বুঝতে পারে, নদীমোড়দিয়া গাঁয়ের পুরানো বটগাছটা সবুজ পুরু পাতাগুলোতে বুভুক্ষ অজগরের গ্রাস ছড়িয়ে তরতাজা চড়চড়ে রোদ শুষে নিচ্ছে। কিন্তু কা-জুড়ে সালোকসংশ্লেষণের তীব্র আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পুরানো বটগাছের এই লেলিহান সাধকে পাত্তা না দিয়ে ডালপালা আর পাতা-ঝুড়ির ফাঁক গলিয়ে বিস্তর ঝা ঝা রোদ দিব্যি রেলের পতিত জমিতে ঢুকে টান হয়ে শুয়ে পড়ছে লেবারদের সারবাধা ছাপরার সামনে-পেছনে আর চান্দি জুড়ে। রোদের এত আঁচ পাওয়ার আনন্দে ঝিমুনি নামছে বটগাছটার পাতায় পাতায়, ঝিমুনি ধরছে ডালের ফাঁকফোকড়ে হাসফাঁস করতে থাকা সাপ আর পাখিদের চোখে আর পালকে। বটগাছ থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলেই নদীর ঢালু, ফুলঝোর নদী মরতে মরতেও জেগে আছে যৌবনের তা-বলীলা নিয়ে।
শ দেড়েক বছর আগে রেলব্রিজ বানিয়ে ফুলঝোরকে প্রথম ডলা দেয়া হয়েছিল; আর এখন বাঁশ-কাঠের খাঁচা, মাচা বসিয়ে সড়কসেতু বানিয়ে তার স্রোতের বুকে শেষ পেরেক বসানো হচ্ছে। কড়াইয়ে করে ইঁটসুড়কি টানতে টানতে হানিফদের জিভ বেরিয়ে আসছে, ইট ভাঙতে ভাঙতে হাপর আটকে আসছে সোলেমানদের। ঘাটের মনোহারি দোকানটার মাচায় বসে লম্বা দমে সিগারেট টানতে টানতে গাফফার প্রস্তুতি নিচ্ছে গালাগালি করার। সোলেমান আর হানিফরা কাজে একটু ঢিলা দিলেই খুলে যাবে তার মুখের লাগাম। ঝা ঝা রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গালিগালাজের তুফান তুলবে সে। এরকম করার জন্যেই রাখা হয়েছে তাকে, এরকম করার জন্যেই ঠিকাদার ওহিদুর আচানক তার দিকে আধখাওয়া ফিল্টার সিগারেট বাড়িয়ে ধরে। এরকম আধাসিগারেট মার্কা দাম অবশ্য হামজারও আছে--হামজা তা ষোলো আনাই জানে, এরকম চুপচাপ বিশ্বস্ত লোক ঠিকাদারের আর কেইবা আছে--কিন্তু ওই দামটা পুষিয়ে সমান করার জন্যেই গাফফার এত কথা বলে, কথার দাপট দেখিয়ে চেষ্টা করে এগিয়ে থাকার। ঠিকাদারের আসার বেশি দেরি নেই আর, অথবা বলা যায়, সময় হয়ে গেছে গাফফারের গালিগালাজ করার। খুঁত ধরার জন্যে ওৎ পেতে আছে সে। ঠিকাদারের অবয়ব দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা না একটা কারণ সে বের করে ফেলবেই। ওদিকে নদীর পানি ঝিম ধরে আছে, স্থির হয়ে আছে এলোমেলো কচুরিপানা তীরের কাছে, অনেক দূরে সাইকেল থামিয়ে কেউ পায়জামার নিচের অংশ বেঁধে নিচ্ছে খুচরো দড়ি দিয়ে, মনে হচ্ছে অন্তহীন এক মরুভূমির প্রেক্ষাপটে সে দাঁড়িয়ে আছে। ধেই ধেই করে বেলা বাড়ছে, লোকজন বাড়ছে বটগাছের নিচে। ঢালু বেয়ে নামলেই নদীর ঘাটের বাঁশের মাচা। যদিও কেউ নেই সেখানে, ওপার থেকে নৌকা আসার আগে আর কেউ এগুবে না ওইদিকে। কার এত ঠ্যাকা পড়েছে আগেভাগে নৌকায় ওঠার জন্যে এগিয়ে গিয়ে এক মাথা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার!

কিন্তু ঠিকাদার আসতে আসতে দুপুর এগিয়ে এলো। গলায় সে গামছা রেখেছে আজ। ঘন ঘন মুখ মুছছে। নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাঁশের মাচায় নেমেই সে তাকিয়ে থাকল নির্মীয়মান সেতুর দিকে। বিড় বিড় করে কী বলল বোঝা গেল না। তার পর গাফফারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল লেবারদের মধ্যে। এইসবে তার কোনও ভূমিকা নেই--হামজা তাই চুপচাপ বসে থাকল বটগাছের নিচে। অবশ্য তার ভূমিকা যে কী--সেটাও ভালো করে জানা নাই তার। ঠিকাদার যা করতে বলে, চুপচাপ তাই করে সে--বড় জোর ফিসফিসিয়ে দুর্বলকণ্ঠে নিজের আপত্তিটা জানিয়ে রাখে। কিন্তু তার ওই দুর্বল কণ্ঠটুকুই বড় আপনার ঠিকাদার ওহিদুরের। শুনতে শুনতে মাথা নাড়ে সে, হ্যাঁ কি না বলে বোঝা যায় না, তবে তার পর নিজেকে গুটিয়ে নেয় আস্তে করে। তার ওপর আজ এমনিতেই রোদ উঠেছে খুব, আজ সে আগে থেকেই গুটিয়ে আছে, গুটিয়ে রেখেছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। চোখ সরু করে দেখে নেয় সে, বাঁশপাড়ার জবা রোদের এই ঝাঝালো আঁচ থেকে গা বাঁচাতে সানকির ময়লা পানিটুকু চ্যাংগা দিয়ে মাটিতে ফেলেই চুলার ঘরের ছাউনির নিচে ঢুকে পড়ে সুরুৎ করে। যদিও খুব বেশি লাভ নেই তাতে--ছাউনির ওপরেও যেন আগুন জ্বলছে গনগনিয়ে। তারপরও আরাম লাগে, ঠিক চাঁন্দি বরাবর সূর্যটা থাবা বসাতে পারে নি বলে আরাম লাগে। দুপুরের খাড়াখাড়ি সূর্যটার তাতে পিত্তি জ্বলে, আরও খরখরিয়ে ওঠে। তখন দিয়ারপাড়া কিংবা বাঁশপাড়া কিংবা হতে পারে হালটপাড়াও, কিংবা সব মিলিয়ে নদীমোড়দিয়া গাঁ থেকে হৃষ্টপুষ্ট পোকার লোভে লোভে ছুটে আসা মুরগিগুলো মাটি আর বালির মধ্যে ধুলি¯œান করতে করতে নখের আঁচড়ে খানিকটা ঠা-া মাটির আভাস পেয়ে বসে পড়ে সেখানেই। আহ্, এইখানে সামান্য একটু ঠা-ার মধ্যে কত না আরাম! ঠোঁটের নিচের নরম চামড়াটুকু মুরগির দল নাড়িয়ে চলে ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে। লেবারদের কী সব বলেটলে হনহনিয়ে ঠিকাদার ওহিদুর এগিয়ে আসে, বটগাছের নিচে রাখা হাতলভাঙা চেয়ারটাতে বসে, মাছের আঁশটে গন্ধ স্থির হয়ে থাকে আকাশ আর মাটির মাঝামাঝি কোনওখানে, আর দু টান দিতে না দিতেই সিগারেটটা ফেলে দিতে দিতে ওহিদুর ঠিকাদার রেডিওতে খবর শোনে : ‘...চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরকে এক নাম্বার, আমি আবারও বলছি এক নাম্বার সতর্ক সংকেত দেখাতে হবে। কখনও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। দেশের অন্যান্য স্থানের আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকবে।...’ তার মানে আজ বৃষ্টি হতে পারে, আবহাওয়ার সংবাদে যা বলে আসলে তার উল্টোটাই তো ঘটে, শুনতে শুনতে চিন্তা করে ঠিকাদার, আর তারপরই চিন্তাটা চলে যায় অন্যদিকে-- সিগারেটটা তত ভালো না, দু টানের বেশি টানা যায় না, মুখের মধ্যে আবারও পচা বিচাকলার গন্ধ জেগে উঠছে, আবার কষ-কষও লাগছে। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিগারেট কিনতে গেলে নতুন একটা প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলেছিল আফছার, ‘নতুন সিগারেট, খায়্যা দেখেন আইজ।’ একই দামের, প্যাকেটটা বরং আরও ভালো, অতএব সে আপত্তি করে নি। তা ছাড়া অত মনযোগও ছিল না। সকাল থেকেই রঙিন টেলিভিশন কেনার জন্যে স্কুলপড়–য়া মেয়েটা ট্যা-ট্যা- করছিল, তাকে কয়েকটা চড়থাপ্পর মেরে মেজাজটা একটু ঠা-াও হয়েছিল, কিন্তু বেরুনোর আগ দিয়ে বউও ঠিক একই কথা বলায় তাকেও এক হাত দেখাতে হয়েছে আজ। ‘সি’ গ্রেডের ঠিকাদারদের বাসায়ও টেলিফোন লেগে গেছে, আর সে বছর দুয়েক হলো ‘বি’ গ্রেডের ঠিকাদার হয়েও এখনও বাসায় একটা টেলিফোন লাগাতে পারল না, ডিমান্ড নোটে লোকাল এমপির সুপারিশ নিয়েও কাজ হলো না, শালার লাইনম্যানরা পর্যন্ত ভালো করে কথা বলে না, টাকা ছাড়া মুখ হা করে না। আর এখন তো টাকা সেধেও কাজ হচ্ছে না, ক্ষমতার বড়াই দেখাতে গিয়ে ফেঁসে গেছে সে, পকেটে টাকা নিয়ে দৈনিক একবার টিঅ্যান্ডটি অফিস তো আরেকবার কমপ্লেইন অফিসে ঘোরাঘুরি করেও লাইন মিলছে না। দোকান থেকে টেলিফোন করে ঠিকাদারি আর কয়দিন করা যায়? বউ-মেয়ে এইসব বোঝে না, টেলিভিশন রঙিন না হওয়াতে তাদের চোখ জ্বালা করে। ওহিদুরের ইচ্ছা করছিল লম্বা সময় নিয়ে বউ-মেয়ের দুই গালে তালে তালে জুতা মারার। কোনও মতে রাগ নামাতে নামাতে ছিটকে সে বেরিয়ে এসেছিল বাসা থেকে, তার পর দোকান থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে তুলেই হাঁটা পথে রওনা হয়েছিল ঘাটের দিকে। তার পর দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসবে এখন, কিন্তু সিগারেটটা ওহিদুরের মুখেই ধরছে না। ইচ্ছে করছে প্যাকেট ধরে মুচড়ে ফেলে দিতে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আজ রাত দশটা পেরিয়ে যাবে, আফছারের দোকানটা অবশ্য খোলা থাকে তখনও; লোহা-রড-পাইপের দোকানের কর্মচারী, পেট্রোল পাম্পের গার্ড আর কয়েকজন ভ্যানওয়ালা বসে বসে গাঁজা টানে আফছারের দোকানের সামনে, ওহিদুরকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা করে সালামও ঠোকে। এত সম্মান তার যদি না-ও থাকত, তার পরও আফছারের কাছে থেকে সিগারেট বদলে নেয়া যেতো। কিন্তু রাত তো আসবে রাতে, এতক্ষণ সে সিগারেট না টেনে থাকে কী করে! মুশকিল হলো, এখানে নূরালির দোকানেও আজ সিগারেট নেই। নেই মানে তার ব্র্যান্ডের সিগারেটটাই নেই। সেটার চেয়ে বেশি দামিটা আছে, কম দামিও আছে, কিন্তু তারটাই নেই। অথচ যে গ্যাঁড়াকলে পড়েছে সে, তাতে ঘন ঘন সিগারেট না টানলে আর চলছে না তার।

বিরস মুখে ছুঁড়ে ফেলা অত বড় সিগারেটটার দিকে হামজা আখাঊয়ার মতো তাকিয়ে আছে দেখে ওহিদুর ঠিকাদারের পিত্তি আরও জ্বলে, একবার শুকনো খরখরে খড়ির আগুন হয়ে, আরেকবার তুষের আগুন হয়ে। গড়-গড় করে ওঠে ওহিদুর ঠিকাদার, রেডিও থামা...

তারপর রেডিওটা কে থামায় বোঝা না গেলেও চারপাশ সুনসান হতে হতেও ইট ভাঙার ঠকঠকানো শব্দে একটা ভ্যাঁপসা ভয় ছড়াতে থাকে। কাঁচা ইটপাতা দীর্ঘ সড়কটা এক তালগাছ উঁচু রেললাইনের পাশাপাশি এগুতে পারলেও ভ্যাঁপসা ভয়টা শুয়েই থাকে বটগাছের নিচে। সারবাধা ইটের ফাঁক দিয়ে একটা বড়সড় গিরগিটি তাকাতে গিয়েও চোখমুখ ভেতরের দিকে টেনে নেয় বিদ্যুৎগতিতে। তখনও হাতুড়ি দিয়ে কয়েকজন ইটের পর ইট ভেঙে চলেছে। সেদিকে তাকালে ঝা ঝা রোদের মতো ঝা ঝা বিরক্তি ওহিদুরের চোখ থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে টান মেরে শুয়ে পড়ে। হামজা গামছাটা এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে নিতে নিতে বলে, বন্ধ কইরতে কমু?

ক্যা, বন্ধ কইরতে ক’বি ক্যা? ইট কি তর বাপে আইসা ভাইঙ্গা দিয়া যাইবো?

ঝোঁকের মাথায় বলুক আর সাপের মাথায় পা দেয়ার জন্যেই বলুক, ওহিদুর ঠিকাদারের কথাটা হামজা আর কানে নেয় না। এখনও তার বাপের কবরের ওপর পোঁতা খেঁজুরের ডাল থেকে কোনও নতুন কুড়ি বের হয়নি, এখনও কাঁচা কবরের গন্ধ লেগে আছে তার নাকে, তারপরও কথাটা সে গায়ে মাখে না। মারা যাওয়ার সময় বাপ তার ছিল লতিফার বাড়িতে। খবরটা শুনে কান্না পাওয়ার আগেই বিস্ময় ও আতঙ্ক তাকে তাই ছেঁকে ধরেছিল। অবশ্য লতিফার বাড়িতে থাকা এক অর্থে কোনও বড় ঘটনা না। তাদের এই ছোট টাউনে বেশ্যা আর আছেই বা কয়জন! আর যারা আছে, তারা তো ব্যবসাটা আড়েঠারেই করে। লতিফাও তাই করত, লোকজন লতিফাকে ঠ্যাকা কামের জন্যে ডাকতে যেত, আর ওই আসাযাওয়ার মধ্যে লতিফার ঘরে বসতে দিলে উত্তেজনাটুকু থামতে সময় তো খুব বেশি লাগে না। ডাকতে যেতে যেতেই শরীরটা তৈরি হয়ে যায়। অতএব সময় খুব বেশি লাগে না। আর লতিফারও ঠ্যাকা কাম করতে যাওয়ার মতো সময় জোটে না। গজর-গজর করলেও প্রসন্ন মনে বাড়ি ফেরে লোকজন। কেউ আবার ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলে, আইজ না পাইরল্যা, কাইল একবার যায়্যা থালাবাসন মাইজা ঘরদোর মুইছা রাইন্ধা দিয়্যা আইসো। সেই কাল আর কখনোই আসে না। যারা যায়, তারাও জানে, কোনওদিনই আসবে না সে কাল। কিন্তু ফলাও করে তো ব্যবসাটা করা যায় না, তাই মাঝেমধ্যে ঝাড়– আর ধামা নিয়ে বের হয় সে। খড়িজাবা কুড়ায়, ডাকবাংলো আর অফিসার্স ক্লাবের মাঠ ঝাড়– দেয়, তখন কলেজ রোডের দোকানদারগুলো তাদের দোকান বরাবর রাস্তার জায়গাটুকুও ঝাড়– দিয়ে যেতে বলে, বলে কয়েক বালতি পানি এনে ড্রামটাকে ভরে দিতে। কাজ করতে করতে নাকের ওপর জমে ওঠা স্বেদবিন্দুসমেত লতিফাকে এত সুন্দর লাগে যে, কারও আর মনে হয় না সে শরীরও বেচে। কিন্তু তারপরও হামজার বাবার মৃত্যুর সংবাদটা তেমন একটা দুঃখজনক হতেই পারল না। ‘কীভাবে মারা গেল’ জানতে গিয়ে শোকের আবহ দূর হয়ে গেল লোকজনের চোখমুখ থেকে। তারপর তারা হাসাহাসি না করুক, লুকিয়েচুরিয়ে হাসতে লাগল, চরম উত্তেজনা নিয়ে সওয়ার হওয়ার মাঝপথে হার্ট ফেইল করে তার বাবা মরে গেছে বুঝতে পেরে। আর খালি লোকজন কেন, ওহিদুর ঠিকাদারও তো বলেছিল ওইদিন, তোর বাপ তো মইরা গেল তোর জইন্যেই!

আমার জইন্যে?

না তো কী? তুই বিয়া কইরলি, লতিফার ঘরে যাওয়া বাদ দিলি, পাশের ঘরে তোগারে চকির নড়াচড়ার শব্দে বাপ তোর শেষ বয়সে বিগড়ায়া গেল, তোর চাটা দইয়ের ডুহির মইধ্যে জিভ ডুবাইলো...

খ্যাক খ্যাক হাসি ফরফরাতে থাকে ঠিকাদারের চোখে-মুখে-ঠোঁটে, কথা আর বলতেই পারে না সে, হাসি থামিয়ে আবারও কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু হাসির ঠেলায় বলতে পারে না কিছুই। দেখেশুনে হামজাও হেসে ওঠে, চালাক বলেই হাসে, আর ওহিদুর ঠিকাদারের দিকে চেয়েই হাসে। বোকা-বোকা হাসির সঙ্গে মিশে থাকে শৃগালের ধূর্ত অলসতা, অলসতার প্রলেপে ঢেকে রাখে ক্রোধ। এখন একবার জবা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলে কষ্ট করে এইভাবে হাসতে হতো না তাকে, জবার দিকে চোখ তুলে তাকালেই ল্যাঠা চুকে যেতো। হয়তো বা ঈর্ষায়, হয়তো বা নতুন কোনও মক্করে ঠিকাদার তখন চলে যেত অন্য প্রসঙ্গে। কিন্তু এখন গোমড়া মুখে বসে থাকলে ঠিকাদার ধরে নেবে, রাগ হয়েছে তার। তখন দুঃখের দিন শুরু হবে হামজার, তখন রাতের বেলা আচানক ওহিদুর ঠিকাদার তার কাছে লোক পাঠাবে শেষ রাতে উঠেই মুচিপাড়ায় যাওয়ার আদেশ দিয়ে, অথবা সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরার আগে পিছু ডেকে বলবে, ফজরের সময় আমাকে ডাইকা তুলিস। কিংবা ভর দুপুরে কারও কাছে পাঠিয়ে দেবে পাওনা টাকা তুলে আনতে, মাইলচারেক দূরে খনখনির বিল--সেখানে যেতে বলবে তেলজমা একটা রুইমাছ ধরে আনতে, শীতের দিন হলে বলবে সাতসকালে খেঁজুরের রস পেড়ে আনতে। কাজের তো অভাব নাই, বেছে বেছে এমন সব কাজ দেবে যাতে কেবল হয়রানই হতে হবে তাকে। ঠিকাদারকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে, মাংসে মাংসে চেনে, হাড়েমাংসে কোনওখানেই সুখ পাওয়া যায় না একে দিয়ে। সুখ বলতে এটুকুই, চালডাল আর টাকাপয়সা যা দেয় তা দিয়ে তিনবেলা হাড়ি চড়ে চুলাতে। আবার কখনও হয়তো ঠিকাদারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, তখন হাতে একটা লাউ-কুমড়া ধরিয়ে দেয় ঠিকাদারের বউয়ে। ঠিকাদারের সামনে সে তাই কচুপাতা হয়ে থাকে, যত বৃষ্টিই ঝরুক পানি জমে না তাতে, যত রোদই উঠুক আঁচ লাগে না তাতে। সবুজ-সবুজ কচুপাতার মতো হাসি-হাসি সে। যেমন এখনও সে হাসে, বোকার মতো হাসে একটু। অবশ্য সঙ্গে কিছু বলতেও চেয়েছিল; বলতে চেয়েছিল, বাপে তো আইসতে পাইরবো না--মইরা গ্যাছে না? কিন্তু বাপ ওইভাবে মারা যাওয়ার পর হাঙ্গামা যা গেল... বেশ্যার ঘরে গিয়ে মারা গেছে বলে দাফন করাতে কেউ আর আসে না! তখন এই ওহিদুর ঠিকাদারই তো ‘ক্যা রে, লোকজন সব কোনে?’ বলতে বলতে তার বাড়িতে এলো, সঙ্গে সঙ্গে লোকজনও সব এলো, তখন জানাজা পরানোর জন্যে মওলানা পাওয়া গেল, জানাজার নামাজের লোকজনও পাওয়া গেল। আর মওলানা সাহেব তার খুৎবায় তার বাবার এত সব গুণের কথা বলল যে, হামজাও অবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগল, বাপের এত সব গুণ ছিল তা হলে! বাপকে নিয়ে সে আর তাই কথা বাড়ায় না ওহিদুরের সঙ্গে। বোকা-বোকা গলায় ঢেকুর তোলার মতো অস্পষ্ট হাসি দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে, যেমন বসে থাকে অনেক দূর থেকে মনিবকে দেখে দৌড়ে এসে পায়ের গোড়ালি চেটে দেয়ার পর লাথি খাওয়া নেড়ি কুত্তা, চুপচাপ বসে থাকে আর জিভ ও লেজ নাড়িয়ে চলে এক নাগাড়ে। সিগারেটটা ওহিদুর ঠিকাদার দুমড়েমুচড়ে ফেলে না দিলে তুলে নিয়ে সে টান দিতে পারত, এই দুঃখে বাপের কথা খুব দ্রুত ভুলে যায় সে। তবে জবা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলে তাকে ফের দেখে নিতে ভোলে না, আর এ কথাও ভোলে না, হাঁটু দিয়ে গুতা মেরে এই মেয়েই না কি ইমাম মেম্বারের বিচি দুইটা ছেঁচে দিয়েছে, এই মেয়ে লতিফা না যে গা এলিয়ে শুয়ে পড়বে। এইরকম বেসম্ভব একটা ঘটনা ঘটানো মেয়েটাকে সে এখনও উঁচু গলায় কথা বলতে শুনল না, ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক না!

তবে ঘটনা তো খালি এইটুকু না-- নিশ্চয়ই ওহিদুর ঠিকাদারের এইখানে চোখ পড়েছে। নইলে দৈনিক ঠা ঠা দুপুরে লেবারদের ছাপড়ার সামনে এসে বসে থাকে কেন! ছাপড়া অবশ্য সড়ক নদী আর বটগাছটা ঘেষেই, আর দোকানও কাছেই, কিন্তু তার কি উচিত না গাফফারের সঙ্গে সঙ্গে লেবারদের কাছাকাছি থাকা? তা ছাড়া চারদিন হয়ে গেল, ঠিকাদারের যাওয়ার কথা নদীর চরে বালু দেখতে, কিন্তু বালুর কথা সে মুখেই আনছে না। আগেরবারের বালু খারাপ ছিল, ঠিকমতো জমলো না সিমেন্টের সঙ্গে, খালি কি গাফফার, তাকেও একগাদা অকথা-কুকথা শুনতে হলো, তখন বার বার ঠিকাদার ফাল দিলো, আমি নিজেই যামু নে বালু দেখতে... আর এখন বালু আনার সময়, কিন্তু ঠিকাদার পকেটে টাকা না থাকার ভং ধরে বসে আছে। বাতাসে উড়ে আসা ধুলাবালু গিলছে, রোদে হাতপা দাপাচ্ছে, সিগারেট একটান দিতে না দিতেই ফেলে দিচ্ছে আর হা করে তাকিয়ে আছে, কখন ওই জবা বাইরে এসে খানিকটা ময়লা পানি ঢালবে, ঢোকসার মধ্যে নতুন করে পানি নেবে, মাছের আঁশগুলো জড়ো করে রাখবে একখানে বিড়ালের জন্যে, কয়েকটা খড়ি পাঁজা কোলে করে চুলার ধারে নিয়ে রাখবে--এইসব কি কোনও পুরুষ মানুষের দেখার বিষয়! আর লেবারদের সঙ্গে কথা বলতে হলে তো বসার কথা ওই দিকে মুখ ফিরিয়ে--দৈনিক এসে লেবারদের ছাউনির দিকে মুখ করে বসার কোনও মানে হয়! আড়েঠারে ব্যাপারটা সে যে ঠিকাদারকে বোঝায়নি, তাও তো নয়। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছে, যেদিন রাতে সে ঠিকাদারের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ইমাম মেম্বারের বিচি ছেচার গল্প করেছে, সেদিন থেকে ঠিকাদারকে মনে হয় আরও বেশি পেয়ে বসেছে। সকালে এসে নতুন সড়কের কাজ একটু দেখে কি দেখে না, লেবারদের বকাঝকা করতে থাকে, তারপর ‘আমি গাছের নিচে বইলাম। দরকার হইলে ডাক দিস’ বলে এসে বসে এই গাছের নিচে। লেবারদের ছাউনির দিকে মুখ করে বসবে, ফুরুৎ ফুরুৎ করে সিগারেট টানবে, আজকে আবার সিগারেটটায় ২-১ টান দিতে না দিতেই ফেলে দিচ্ছে, আর হামজার বুকের মধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠছে ওইভাবে সিগারেট ফেলে দিতে। কিন্তু প্রতিদিন তো আর এরকম হয় না, এইভাবে প্রতিদিন ঠিকাদার সিগারেট ফেলে না। গভীর চিন্তা করতে করতে সিগারেট টেনে চলে। মনে হয় এই দ্বীনদুনিয়ার প্রতি তার কোনও দৃষ্টিই নেই। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠিকাদারের শরীরে গরমকালের নিষ্ঠুরতা ঘরঘরায়, কিন্তু চোখজুড়ে মোমের আলো জ্বলে। মাঝেমধ্যে ভয়ই লাগে হামজার, কবে না কখন আবার বলে বসে, ‘একটা ব্যবস্থা করছেন হামজা।’ এখন পর্যন্ত অবশ্য এইরকম কিছুর জন্যে ঠিকাদার তার ওপর ভর করেনি--কিন্তু করতে কতক্ষণ! তা ছাড়া নিজের জন্যে কিছু না করুক, এসব কি আর তার কানে আসে না-- ওইবার যে নতুন ইউএনও’র বউ বাপের বাড়ি গেল, পোলাপানও তার সঙ্গে নানাবাড়ি গেল, তখন এক কলেজ গার্ল তার বাপের সঙ্গে জমিজিরাতের ঝামেলা মেটানোর জন্যে একেবারে বাসাবাড়িতে গিয়ে হাজির হলো সন্ধ্যা বেলা? জমিজিরাতের ঝামেলা না ইউএনও’র শরীরের ঝামেলা, তা কি আর বোঝে না হামজা? ঝামেলা যতই হোক, সেজন্যে কি একেবারে টায়-টায় সন্ধ্যাবেলাই আসতে হবে? আবার লোকটা না কি দারোয়ানকে বলেছে, ফজরের ওক্তের পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে। এই দেশে এমন কোন গাঁ আছে যে, সেখান থেকে উপজেলায় আসতে পুরো দিন লাগে! তা ছাড়া জমিজিরাতের ঝামেলা মেটাতে মানুষ কি আর নিজের মেয়েকে নিয়ে ইউএনও’র কাছে আসে!? আবার ইউএনও স্যারদের শরীরেও কি আর এত দয়া আছে যে, চেনা নাই জানা নাই কোথাকার কোন তদবির করতে আসা মানুষকে আগ বাড়িয়ে নরম গলায়, ‘রাতের বেলায় এত দূরের রাস্তা যাবে?’ বলে বাসাবাড়িতেই রেখে দেবে? হু, বাঙালিরে হাইকোর্ট চেনায়! মনে হয়, হামজা খালি সাগুবার্লি খেয়েই বড় হয়েছে, এইসব টের পায় না! তাকে দিয়ে ব্যবস্থা না করাক, তার তো জানা আছে এরকম সূক্ষ্মভাবে মাগী সাপ্লাই করার বুদ্ধি ওহিদুর ঠিকাদার ছাড়া আর কারও মাথাতেই নাই। তা ছাড়া যে রোগের যে দাওয়াই--ইউএনও’র জন্যে সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা কি আর হামজাকে দিয়ে হবে--তার দৌড় তো ওই বড়জোর লতিফা। যত বেশি পয়পরিষ্কার থাকতে যায়, গা দিয়ে তত বেশি সোডা-সোডা গন্ধ বের হয়, ওইখানে তো এখন সে নিজেই তাকায় না। তার নিজেরই যখন এই অবস্থা, তখন ঠিকাদার তো হিসেবেরই বাইরে, ঠিকাদারের নজর খালি টাকার দিকে, টাউনের জমির দিকে--এমনকি চাষের জমিতেও তার চোখ পড়ে না। তবে জবার কথা আলাদা, নজর না দিয়ে থাকা যায় না--জামাই হেলালকে ও না কি সমিতি থেকে টাকা তুলে দিয়েছিল রিকশার জন্যে; একদিন সেই রিকশা বেচে গাঞ্জা, দুধ আর গরুর মাংস নিয়ে হেলাল বাড়ি ফেরার পর কী দিব্যি ‘এক তালাক, দুই তালাক, দিলাম তোক তিন তালাক’ বলে দুধভর্তি দোনায় লাথি মেরে বাড়ি ফিরে এসেছে। ঠিকাদার মনে হয় এইরকম ত্যাড়া মেয়েকেই বেশি ভালো পায়। তার বউটাও তো কেমন রুঠা কিছিমের, মার্কেটে গেলে বাড়ি ফিরে কুসুম কুসুম গরম পানিতে পা ডুবিয়ে কাজের মেয়েকে পায়ের গোড়ালি কচলিয়ে দিতে বলে! এইরকম একটা রুঠা বউকে সামলে রাখার দাপটে ঠিকাদার এখনো বুঝতে পারছে না, হাঁটু দিয়ে গুতা মেরে ছেঁচতে না পারলেও দুই হাত পেছনে বাড়িয়ে জবা তখন বিচি দুইটায় এমন পোঁচ মারবে যে, সেগুলো থেকে ধুতুরার বিচির শাদা শাদা কষ বেরুতে থাকবে। তা যদি বুঝতো তা হলে কি এইখানে এইভাবে বসে বসে দৈনিক জবার পেছন দিকটা দেখে!

তবে তেমন কিছু বললে, হামজাকেও তো একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু ব্যবস্থাটা তখন কিভাবে করা যাবে, সে বুদ্ধি তার মাথাতেই আসে না। তার আগেই ওই দৃশ্যটা চোখের সামনে দপদপাতে থাকে-- ধুতুরার শাদা শাদা কষে মাটির মেঝে ফর্সা হয়ে যায়, আর সেই ফর্সার মধ্যে চোখ ডুবাতে ডুবাতে তার আরাম লাগে। বাপের কাঁচা মৃত্যু নিয়ে উপহাস শোনার পর এরকম দৃশ্য চিন্তা করে মন ভরে যায় তার। আর মন ভরতে ভরতে দেখে ঠিকাদারের চোখমুখও কেমন ভরা-ভরা হয়ে উঠেছে। বলছে, যা--জবার কাছ থেইক্যা এক গেলাস পানি নিয়া আয়। কুঁজোর পানি দিতে কইস।

হামজা উঠে দাঁড়ায়। ‘খা শালা, জন্মের খাওয়া খায়্যা নে। বুঝবি, এই জবা কেমন জিনিস, একদিন তা ঠিকই বুঝবি’-- মনে মনে শাপশাপান্ত করতে করতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে।


ঠিকাদার হাতলছাড়া চেয়ারে বসে ঝিমুতে থাকে। দোকান থেকে নূরালি নেমে এসে রেলের জমি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে তার সঙ্গে। কিন্তু সে উৎসাহ পায় না। রেলের এই পতিত জমি রেললাইনের দু পাশ ঘেঁষে, নদীর দু কিনার ঘেঁষে। মনে হয় পুরো দেশ জুড়েই তা ছড়িয়ে আছে, এক রেলস্টেশন থেকে পরেরটিতে, সেটি থেকে আবার আরেকটিতে, কোথাও পতিত জমি হিসেবে, কোথাও দখল হয়ে যাওয়া জমি হয়ে--এইভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা পুরো মানচিত্রে রেললাইনের দু পাশ ধরে। নদীমোড়দিয়া আর মঙ্গলহাটের লোকজন অন্তত সেরকমই মনে করে। যদিও কে সেসব দখলে রাখবে, ক’বছর হলো তা নিয়ে আর মারামারি হয় না নদীমোড়দিয়া কিংবা মঙ্গলহাট গাঁয়ে। একটা অলিখিত ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে তাদের সকলের মধ্যে। বোঝাপড়া হয়ে গেছে মাতব্বর আর মাতব্বরে, মাতব্বর আর প্রশাসনে, মাতব্বর আর বর্গাদারে। অথবা অপেক্ষার কাল চলছে, সে কাল শেষ হলেই শুরু হবে নতুন রক্তপাত। রেললাইনের ওপর চাকার ঘর্ষণে তীক্ষè রূপালি হয়ে যাওয়া পথটুকু বাদে লোহার পাতে শুকিয়ে লালচে জং হয়ে যেন স্থির হয়ে গেছে পুরানো রক্তপাত। হলঙ্গার ঘায়ে, রামদার কোপে আর ছুঁড়ে মারা বল্লমে ঝরে পড়া রক্তকে ঢেকে রাখতে যেসব ঘাষের দল লকলকিয়ে উঠেছিল লাইনের আশপাশে, তারাও এখন ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে পুরানো রক্তপাতের জেল্লা দেখে। তারপরও থামেনি ব্রিজ বানানোর কাজ। বরষা আর আগের মতো হয় না এখন, নদী মরে পড়ে থাকে বছরের ৭-৮ মাস, এইসব বলেকয়ে ব্রিজটাকে আনা গেছে, আর ব্রিজটা যখন আনা গেছে তখন রেললাইনের কোল ঘেঁষে পড়ে থাকা মাটির সড়কটাকে পাকা বানানোর কাজটাও আনা যাবে। রেললাইন আছে, ট্রেনগুলো ঠিকঠাকমতো চললেই হয়, ২/৪টা ট্রেন যদি বাড়িয়ে দেয়া যায়, তা হলে তো আরও ভালো হয়, কিন্তু তাতে কী? সড়ক পাকা করার কাজটা পাশ করানো গেলে, আবারও কিছু টাকাপয়সা টানাটানি করা যাবে। এমপি তাই এখন খুবই ব্যস্ত সড়কটাকে নিয়ে। ‘ধরেন ব্রিজ হচ্ছে, আর কয়েকদিন পর সড়কটাও পাকা হয়ে যাবে, তার পর ধরেন ইলেকট্রিসিটি আসবে, আমাদের মতো আপনাদের বাড়িতেও বাতি জ্বলবে, তখন তো কাকা মনে করেন, টাউনটাই ঘরের মধ্যে আইসা যাবে।’ এরকমই বলাবলি করে নতুন এমপি এখন। বাসার সামনের রোডটাতে ইলেকট্রিসিটির লাইন ঠিক করতে গিয়ে কয়েকদিন আগে টেলিফোনের তার কাটা পড়েছে তার, তারপর থেকে অনেক চেষ্টা করছে সে কাটা তার জোড়া দেয়ার, কিন্তু বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন না কি ব্যাপারটাকে এখনও বাগে আনতে পারছে না। অতএব সেও না কি আর রাস্তা পাকা করার বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারছে না ঢাকার কারও সঙ্গে। তা ছাড়া, সময় তো লাগবেই--এই ব্রিজের দেনদরবারই তো চললো অনেকদিন। তারপরও বলা যায় না, হয়তো আরও বহুদিন চলতো, কিন্তু নতুন এমপি অনেক চালাক, কবে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, কবে নিজে থেকেই ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম করবে, তার আশায় বসে থাকতে রাজি নয় সে--ছোট হোক, বড় হোক প্রকল্প মানেই টাকাটুকার ব্যাপার, খালি খালি পরের বারের এমপির জন্যে এইসব রেখে যাওয়ার মানে হয় না। মিনিস্ট্রিতে দৌড়াদৌড়ি করে সে তাই প্রজেক্টটা বের করে এনেছে, ফান্ড এনেছে, তারপর কোন ফাঁকে যেন কাজকামও শুরু করে দিয়েছে। এখন কাজ শেষ হলেও লাভ, না হলেও লাভ। ভাগের টাকা সে টান মেরে নিয়েছে বরাদ্দের প্রথম কিস্তিতেই, এখন ব্রিজ না হলেও তার কোনও কিছু আর আসে যায় না; আবার হতে থাকলেও পুরোটাই লাভ তার, পোলাপান এখন অনায়াসেই শ্লোগান দিতে পারে ‘ নদীমোড়দিয়া সেতুর কাম/ এমপি সাহেবের অবদান...।’ শুনতে যেন কেমন লাগে, কিন্তু এইসবের দরকারও তো আছে। এখন এমপি অনায়াসে বলাবলি করতে পারে, ব্রিজটার প্রজেক্ট তো আমিই নিয়ে গেলাম ওই মিনিস্ট্রিতে, তারপর পাশও করিয়ে নিলাম, তারপরও যদি অফিসার আর ঠিকাদারদের গাফলতিতে আর টাকার অভাবে কাজটা যদি শেষ না হয়, সে দায় কি আমার, বলো? ও জন্যে ইউএনওর কাছে যাও, থানায় যাও, দরকার হলে টিএনও অফিস ঘেরাও কর, তারপর দরকার হলে আমার কাছে আসো... এইসব বললেও এমপি আবার আসে মাঝেমধ্যে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে কীভাবে কাজ করছে ওহিদুর ঠিকাদার তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে।

এমপি এলেই কি আর না এলেই বা কী, ঠিকাদারকে আসতেই হয়। গাফফার, হামজাদের ওপর ভরসা করা মানে নিজের কপালে নিজেই থাপ্পর মারা। তা ছাড়া এমপি যে আসে না, তা তো না। হুটহাট করে চলে আসে, সব সময় খবরও দেয় না, ভাগ্য ভালো থাকলে কোনও কোনও দিন থানা থেকে বাড়িফেরতা কেউ ঘাটে এসে জানায়, দুপুরের পর তিনি আসতে পারেন মোটর সাইকেলে চড়ে। আবার কোনোদিন খবর না দিয়েই আসে কোনওখানে আসা-যাওয়ার পথে, এইভাবে আসতে যেতেই থাকে, কমিশন পাওয়ার পরও তার দেখভাল শেষ হয় না। এই নিয়ে অবশ্য ওহিদুরের তেমন কোনও টেনশন নেই, কমিশন তো দিতেই হয়, অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে সে এমপিকে কমিশন দেয়া বরং অনেক ভালো। সরকারি কর্মকর্তাদের কমিশন দিলে তারা ফুটানি করে, ব্যাংকে রাখে, বাড়ি করে, বউয়ের জন্যে গয়না বানায়, পোলাপানকে বনবনি খাওয়ার টাকা দেয় সকালবিকাল। কিন্তু এমপি আর পলিটিশিয়ানরা কমিশন নিলে বাড়ি ফেরার আগেই তা ফুরিয়ে ফেলে, এ গাঁয়ের এ বুড়িকে শাড়ি কেনার জন্যে টাকা দেয় তো ও গাঁয়ের ক্লাবে চাঁদা দেয়, এইখানে এমপিও না পাওয়া স্কুলের মাস্টারদের টাকা দেয় তো ওইখানে কাউকে শহরের হাসপাতালে গিয়ে অসুখ দেখানোর খরচাপাতি দেয় --এইভাবে বাড়ি ফিরতে ফিরতে পকেট তাদের ফাঁকা হয়ে যায়। তারপরেও একেবারে যে থাকে না, তা তো না। একেবারে না থাকলে এমপি তার টিনের ঘরটার মেঝে পাকা করে কেমন করে।

ব্রিজের কাজ করতে রেলের জমিতেই ছাউনি তোলা হয়েছে লেবারদের জন্যে। মরা কার্তিকে এইসব ক্ষেত শূন্য পড়ে থাকে, এই অবস্থা চলতে থাকে পুরো কার্তিক জুড়ে। গাঁয়ের পোলাপান এসে খড় দিয়ে বানানো ফুটবল খেলে আর হল্লা করে খালি মাঠে। রাতে জ্যোৎ¯œা উঠলে লোকজন জুয়া খেলতে বসে, অথবা কেউ আসে ফাঁকা মাঠে বসে বসে বাঁশি বাজাতে। তখন পিছু পিছু উচ্চুঙ্গা পোলাপানও আসে বাঁশি বাজানো শিখে রাখালবন্ধু হওয়ার সংগুপ্ত বাসনা নিয়ে। নদীটা এইখানে মোড় নিয়ে চলে গেছে দক্ষিণের দিকে, রেখে গেছে ঘূর্ণায়মান কিলবিলানো ¯্রােত, শীত এলেও দাপট কমে না তার, রেলব্রিজের থামগুলোর গোড়াটাকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায় তা। নতুন করে ব্রিজের কাজ শুরু করার আগে তাই ছোটখাটো একটা বাঁধ দেয়া হলো আগবাড়িয়ে। ব্রিজে লেবার খাটছে, গ্রামে তাই কামলার আকাল পড়েছে, মজুরিও বেড়েছে। শরীরস্বাস্থ্য দেখে, খোঁজখবর করে ওহিদুর ঠিকাদার পছন্দ করেছে লেবারদের। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ নামাতে হবে, লেবারদের জন্যে তাই ছাউনিও তুলেছে। দিনরাত কাজ চলছে, ‘নির্মাণ কাজ চলিতেছে’ সাইনবোর্ডটা এখন ধুলায় ধূসর। ভাতের সঙ্গে কত ধুলাই যে পেটে চলে যাচ্ছে, কে তা জানে! প্রথম দিকে কয়েকদিন লেবাররা নিজেরাই রান্না করেছিল। কিন্তু ২-৩ দিনের মধ্যেই ঝামেলা লেগে গেল। সবাই রান্না করতে চায়, বাজারঘাট করার দায়িত্ব নিতে চায়। মনে করে, ওই কাজে বেজায় মধু, দৈনিকই কিছু না কিছু টাকাপয়সা মারা যাবে, তা ছাড়া পরিশ্রমও কম করতে হবে। ঝগড়াঝাটি হচ্ছে দেখে হামজাই পরামর্শ দিয়েছিল, তার চেয়ে ছার একটা মেয়েকে জোগাড় করেন, সে এসবের দেখভাল করবে, লাগলে আরও ২-১ জনকে না হয় সঙ্গে নেবে। তা হামজা কি তখন জানত, এইরকম সাংঘাতিক এক জবা উড়ে এসে জুড়ে বসবে লেবারদের রান্নাঘরে! মুখ দেখে তো তার নিজেরও ভালো লেগেছিল, কিন্তু পূবপাড়ার সোলেমান সাবধান করেছিল, খবরদার, ওইভাবে তাকায়া থাইকো না। এই মেয়ে কিন্তু ভীষণ ড্যাঞ্জারাস।

ড্যাঞ্জারাস মানে বিপজ্জনক--জানা আছে হামজার। কিন্তু জেনেশুনে মেম্বারের বিচিগলানো এরকম ড্যাঞ্জারাস মেয়েকে এখানে নিয়ে এলো কে! সোলেমান জানে, গাফফারের সঙ্গে হামজার বোঝাপড়া কম, কুমন্ত্রণার স্বরে সে তাই চুপে চুপে বলে, ‘আমি মানা করছিলাম, শোনে নাই। কইলো, এইরহমই দরকার, লেবারগারে মইধ্যে আর ঝামেলা লাইগব না।’ তা গাফফার অন্তত এই কাজটা ভালোই করেছে, নিজেদের মধ্যে রঙ্গরস যতই করুক, পানি টানা মেয়েদের সঙ্গে যত হাসিতামাশাই করুক, জবাকে দেখলে সব লেবার চুপ মেরে যায়। হামজার মনে হয়, তার মতো লেবারদেরও নিজের অজান্তেই অ-কোষ দুটো কুঁচকে আসে। ওদিকে কে কী করছে, জবার মনে হয় সেদিকেও কোনও হুশ নাই, মনে হয় সাত চড়েও রা করবে না। কিন্তু চোখকান যে খোলা আছে, সেটা বোঝা যায় কথা শুনলে। পানির জন্যে লম্বা লম্বা পা ফেলে হামজা ছাউনির কাছে গেলে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করে সে, খাওয়ার পানি লাইগবে?

কী সাংঘাতিক! বাপ রে বাপ! একেবারে মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছে। হামজার গলা একটু কাঁপে, গত পরশুও এই জবা তার সঙ্গে কথা বলেছে ধানচালের বাজার নিয়ে। তাও প্রায় মিনিট দশেক। লেবারদের সকালের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে তখন, কুঁজা কাজেমের নাতনি আফিয়া থালাবাসন মাজতে গেছে নদীর ধারে, আর তাকে বাজারের হিসাব বুঝিয়ে দিচ্ছে জবা। তখনই তারা কথা বলে, বাজারে চালের চালান কম, বলা যাচ্ছে না দাম আরও বাড়বে কি না। আর সেই সূত্রে হামজার এখন বিশ্বাসই হয় না, মেয়েটা এরকম থমথমানো স্বরে কথা বলতে পারে। সকালে মেজাজ একরকম, বিকালে মেজাজ অন্যরকম, এরকম হলে তো খুবই বিপদ। নিজের অজান্তেই সে তার অ-কোষের দিকে মনযোগ দেয় এবং আশ্বস্ত হয় সেখানে কোনও ঝামেলা হয়নি বলে।

ঠিকাদার কী কায়দা করে তার বাপের অকামের কথা মনে করিয়ে দিল, এখন আবার এই জবাও এত রুঠা স্বরে কথা বলল যে হামজা আর নিজের ওপর ভরসা খুঁজে পায় না। তার বাপের কীর্তিকাহিনী এই মেয়েও জেনে গেছে না কি! তা জানবে কোথা থেকে? নিজে নিজেই সান্ত¦না খোঁজে হামজা, আমার বাড়ি তো নদীর ওপাড়, নদী তো নদী--থানারও পরে, তা হলে সেইখানের এইসব কা-কারখানা এখানে আর কেমনে আসে! না কি ঠিকাদারই কথায় কথায় বলে দিয়েছে! কাল বিকালে হামজা তো আর ঘাটে ছিল না, ঠিকাদার তাকে টাউনে পাঠিয়েছিল রড-সিমেন্ট কেনার কাজে। কথাবার্তা মনে হয় ওই সময়েই হয়েছে। ঠিকাদার নিশ্চয়ই তার সাত গুষ্টির প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়েছে! তার প্রেস্টিজ পাংচার করে সাধু সাধু ভাব দেখিয়ে নিজের প্রেস্টিজ হাই করেছে।

হামজা পানি নিয়ে এসে ঠিকাদারকে দিয়ে গুম মেরে বসে থাকে। মাথায় খেলে না কিছুই। একবার মনে হয়, এরকম হয় নাই। খায়খাতির হলে তো ঠিকাদারই চিক্কুর দিয়ে বলত জবাকে, পানি দিয়া যাও। আবার মনে হয়, ওপরে ওপরে ভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু কাল ঠিকই অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। তার সঙ্গে যেরকম চালডালের বাজার নিয়ে কথা হয়েছিল, ঠিক তেমনি কোনও কিছু নিয়ে। এত লেবারের খাওয়াদাওয়া তো মাত্র দুইজনের পক্ষে সামলানো ভীষণ কঠিন, তাকে যেমন তেমনি ঠিকাদারের কাছেও নিশ্চয়ই বলেছে জবা। তা বললে বলেছে, কিন্তু এই নিয়ে এত চিন্তার কী আছে! ভাবতে ভাবতে হামজা সূক্ষè প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুভব করে ঠিকাদারের সঙ্গে। ঠিকাদার পানি খেতে খেতে গাফফারকে ডাকে, আবারও ব্রিজের নকশা বোঝাতে থাকে, টানা রোদ এখনও শুয়ে আছে ছাউনি জুড়ে, ছাউনির সামনে খোলা মাঠে। এইখানে তার ছিটেফোটা খুব কমই লাগে, কিন্তু তার পরও প্রচ- উষ্ণতায় দম আটকে আসে। কথাবার্তা যদি খানিকটা হয়েই থাকে, তা হলে ঠিকাদার নিশ্চয়ই তার ওপর আর ভরসা করবে না। তাকে আর দরকারও হবে না। না কি দরকার হবে? একটা জায়গা তো লাগবে। বাড়িতে তো আর নিয়ে যেতে পারবে না। আর মেম্বারের কাছে রাজি হয় নাই বলে জবা এখানেও যে রাজি হবে না, তা কি কেউ দিব্যি দিয়ে বলতে পারে? ঘাউরা গাফফার কোন মতলবে এটাকে এখানে এনেছে কে জানে। হয়তো এরকম একটা স্যাম্পল দেখিয়ে ঠিকাদারের কাছে নিজের দাম বাড়াচ্ছে। তাই যদি হয়, তা হলে তারও তো একটা না একটা হিসাবনিকাশ করা দরকার। সে হিসাব কি সে আজকেই করবে, না কি আরও একটু সময় নেবে? কিছুই সে বুঝে ওঠে না।

বোঝা না-বোঝার মধ্যে দিয়ে দুপুর গড়াতে থাকে। ঠিকাদার আজ এখানেই খায় আর হামজার চোখমুখ আরও থমথম করে। ঘেমে ওঠার ভান জাগিয়ে কী নির্লজ্জের মতো বার বার দেখছে মেয়েটাকে। রোদে শুয়ে থাকা রডের ঝকমকানি ঠিকাদারের দু চোখ জুড়ে। কিন্তু বেহুদাই সে গাফফারের সঙ্গে আলাপ জুড়েছে ব্রিজের ভেতরকার গাঁথুনি নিয়ে। গাফফার লোকটা তার চেয়ে অনেক কাজের, মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয় সে। কিন্তু হামজার এই নীরব স্বীকৃতিতে গাফফারের কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। মনযোগ দিয়ে সে ঠিকাদারের সঙ্গে আলাপ করতে থাকে।

এত কথা--ঠিকাদার এত কথা বলতে পারে! হামজার বিরক্তিই লাগে। সে নিজে থেকেই বাঁশের হিসাব করতে থাকে। রাস্তা-ব্রিজের কাজ যখন শেষ হয়ে যায়, তখন এই আলগা বাঁশ বেচা টাকা দিয়ে তারা ফুর্তি করতে পারে। হামজা মনে মনে হিসাব কষে, ফুর্তির সেই দিন কবে আসবে। রাতে যখন ফিরে আসছে থানা শহরে, তখনও তার সেই হিসাব শেষ হয় না। ঠিকাদার কথা জুড়লে সে সেই হিসাবের খাতা গুটিয়ে রেখে দেয় মাথার ভেতর। অন্ধকারের গুটানো ডানায় অস্পষ্ট জ্যোৎ¯œার ছায়া পড়েছে তখন আর পায়ের নিচে আচানক ২-১টা ভাঙা ইটের টুকরো পড়ে তাদের বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে। হামজা রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে থাকে কখন ওহিদুর ঠিকাদার মুখ খুলবে, কখন সে বলবে, ‘মেয়েটাকে একটা দরকারে লাগবে।’ তেমন আলাপই যদি করে, তা হলে তা তাড়াতাড়িই করা ভালো। সামনের মোড় ঘুরে পাকা সড়কে উঠলেই তো সব শেষ, তখন ভ্যানওয়ালার দল এসে ছেঁকে ধরবে, আসেন ছার, আসেন ছার চিৎকারে চারপাশ ভরে উঠবে এবং হামজাদের আর কোনও কিছুই বলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু তারপরও সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে, ঠিকাদার চকমকি থেকে আগুন জ্বালানোর গল্প শোনায়, এই গল্প তাকে না কি তার বাবা শুনিয়েছিল, বাবার কথা বলতে বলতে ঠিকাদার হঠাৎ একটু চুপ মেরে যায়, হয়তো হঠাৎ মনে হয় বাবা কখনোই চায় নাই যে সে ঠিকাদার হোক। কিন্তু ঠিকাদার নিজেকে সামলে নেয় এবং আবারও গল্প বলতে থাকে; বলে, আফছার যে এত খারাপ সিগারেট দেবে, আমি তা চিন্তাও করতে পারি নাই। তারপর গাফফারকে নিয়ে কী একটা বলতে গিয়েও কিছু আর বলে না। কিন্তু এই নিয়ে হামজার মধ্যে কোনও উৎকণ্ঠাই দেখা দেয় না, তার ওই উৎকণ্ঠাহীনতা ঠিকাদারকে আবার ঠেলে দেয় নীরবতায়। নীরবতার মধ্যে হামজা অপেক্ষা করে, অপেক্ষায় জ্বলতে থাকে এবং একসময় সত্যিই শুনতে পায় -- জবার সাথে তোর কথাবার্তা হয়?

যেন এটুকু শোনার জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল কত যুগ ধরে! ঠিকাদারের কথাকে টেনে নিয়ে যায় সে-- আমার সাতে? কী যে কন না ভাই! আপনেক কইছি না, এডো লতিফা না, ইমাম মেম্বারের বিচি ছেইচা দিছে... কতা কী কমু, আমার শরীল তো ওরে দেখলিই হিম হয়্যা আসে... গাফফার এইটাকে কোত্থেন যে ধইরা নিয়া আইসছে...

কিন্তু ঠিকাদার বোধহয় তার কথা শুনতেই পায়নি। অথবা তখনও তার কথা শেষ হয়নি। আগের কথার জের ধরেই যেন সে পরের কথাগুলোও বলতে থাকে, ‘লেহাপড়া না জানুক, আমাগারে মিয়াগুলাও যদি এরকম হইতো... এরকম সাদাসিধা, এরকম ঝাঁঝওয়ালা...’

কী কয় ঠিকাদার! হামজা কান আর মাথায় ঝাঁকি দেয় ভালো করে, কিন্তু নতুন কিছুই আর আটকায় না কান দুটোতে। কোনও কথাই আর ভেসে আসে না নতুন করে। কান দুটো গেল বোধহয়। বোধহয় আর কোনও কথাই শুনতে পাবে না সে। অথবা হতে পারে, ঠিকাদার আসল কথা বলার আগে ধান ভানছে। আরেকবার শুনতে পারলে ঠিকই বুঝতে পারবে সে। কিন্তু আবারও যে বলতে বলবে, তেমন সাহসও জোটাতে পারে না সে। খানিকটা বেকুবের মতোই সে আধোআলো আধোঅন্ধকারে ওহিদুর ঠিকাদারের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।


লেখক পরিচিতি
ইমতিয়ার শামীম
কথাসাহিত্যিক। প্রবন্ধকার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ