কল্লোল লাহিড়ী
প্রথম পর্বের লিঙ্ক
ঝাঁ-চকচকে শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল বহুতলের ওপরে, সৌর বিদ্যুতের অসংখ্য চাকতি লাগানো এ্যান্টেনার নীচে, একটা গুপ্ত ঘর আছে। সেটাকে ঠিক গুপ্ত বলা যায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। যাহা চোখের সামনে বিরাজমান, তাহা গুপ্ত হয় কেমনে? ভাষা-বিদ্যার লোকজনেরা চোখ পাকাতেই পারেন। প্রশ্ন করতেই পারেন। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও চোখের সামনে দন্ডায়মান ঘরটা গুপ্তই। কেউ ওখানে প্রবেশ করেনা সচরাচর। সভ্য জামাকাপড় পড়া পাহাড়াদাররা ওটাকে বলে মেশিন ঘর।
নীচের উঠোন থেকে বাইশতলার মেশিন ঘরের হদিশ তারাও খুব একটা রাখে না। রাখলে জানতে পারতো ওখানে ছড়িয়ে আছে রাশি কৃত বিদ্যুৎবাহী তার মাকড়সার জালের মতো। তারা ছড়িয়ে পড়েছে কংক্রিটের পাঁজরে পাঁজরে। এ- বি- সি ব্লকে। শহরের তথাকথিত সেলিব্রিটিদের খাঁচায় খাঁচায়। যাঁরা এক মুহূর্ত ঠান্ডা ছাড়া থাকতে পারেন না। যাঁরা এই মুহূর্তে জমিয়ে রেখেছেন নিজেদেরকে হিমাঙ্কের নীচে।
হঠাৎ ট্রান্সফরমার উড়ে গেলে...
শহরে হঠাৎ ঝড় উঠলে...
নিছকই অসাবধানতায় অন্ধকার নেমে এলে...
ভোটের আগের দিন বদমাইশের লোডশেডিং হলে...
গোটা শহরকে কানা করে এই বহুতলে আলো জ্বলে ওঠে। সেই সময় এই ঘরে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ইলেকট্রনিক মেশিন গুলো হঠাৎই কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। চিক চিক...টিক টক...পিঁ পিঁ শব্দ তুলে। এই ভাষা, এই ঘরে আশ্রিত উদ্বাস্ত ভুতুম পেঁচার দলটা বুঝতে পারে না। প্রাথমিকে ইংরাজী শিক্ষা তুলে দেওয়ার ভুলে বাঙালীরা যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি এক অবাধ্য আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হয় ভুতুমের দলটি। কুলকুন্ডলিনী যোগে তখন তারা ডানা ঝাপটায়। দেওয়ালে গা ঘষে। অথবা রাতের অন্ধকারে উড়ে যায় খেতে না পাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া ইঁদুর গুলোকে ধরতে। ওরা চলে গেলে ঘর ফাঁকা হলে নজরে পড়ে দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা স্টিকার। যা বহুদিন আগে মন্টু সেঁটে দিয়েছিল নিজের অজান্তে।
তার মন্টু নামটা খসিয়ে দেওয়ার পরে।
অমিতাভ হবার সূচনায়।
সরকার হবার দিবা স্বপ্নের ক্রান্তিলগ্নে।
ঠিক এই মুহূর্তে রাজ্যে যখন নতুন সরকার শপথ নেবে। গোটা রাজ্যে বিজয় উল্লাসের মিছিল থেকে ঢাকের দ্রিম দ্রিম শব্দের বদলে মানুষের চামড়া বাজানোর চড়াম চড়াম আওয়াজ নির্গত হবে। তখনও লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের তেত্রিশ নম্বর টেবিলের দুই নম্বর ড্রয়ারে একটা হলুদ ফাইল ঘুমিয়ে থাকবে। যাকে আর কেউ কোনো দিন জাগাবে না। পাতা গুলো উলটে দেখবে না। মেটা ডেটা ফাইলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের আর্কাইভে সংরক্ষণ হবে না। মন্টু নামটা ধূসর অতীত হয়ে ঝুলে থাকবে একটা হারিয়ে যাওয়া, ভেঙে ফেলা, বর্তমান প্রজন্মের না দেখা সিনেমা হলের প্রজেক্সান রুমে।
গঙ্গার ধারে মহাদেব জুটিমিলের নাগকেশর ফুল গাছের তলায়।
একটা উচ্চমাধ্যমিকে স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর লাস্ট বেঞ্চে।
এক বহুতল বিলাসবহুল বাড়ির মেশিন ঘরে।
দুঃখের বিষয়টা হলো মন্টু নিজেও, মারা যাবার এতোগুলো বছর পরেও মেনে নিতে পারে না তার সাক্ষী থাকা সেই হলুদ ফাইলটার মধ্যে কোথাও এই জায়গা গুলোর নাম নেই। এমনকি লেখা নেই মেশিন ঘরের দেওয়ালে ধূসর হওয়া এক স্টিকারের কথা। যেখানে অমিতাভ হাতে একটা বাজ পাখি নিয়ে ঠোঁটের কোনে বিড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীচে পেন্সিলের কয়েকটা হরফ। ‘মন্টু অমিতাভ হতে চেয়েছিল’।
যা নেই তা নিয়ে কথকের মাথা ব্যাথা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যা আছে তা নিয়ে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। হলুদ রঙের ফাইলটার মধ্যে সুইমিং পুলের নীল জলে মন্টুর ক্ষত বিক্ষত দেহের সাঁতার কাটার ছবি ছাড়াও রয়ে গেছে বেশ কিছু তাবড় শুহুরে বিখ্যাত বেঁচে থাকা মনীষীদের ছবি। একজন কবি, একজন চিত্র পরিচালক, পার্কস্ট্রিটের এক পরিচিত ম্যাসাজ পার্লারের ছেলে-বেশ্যা, আর একজন দালাল। এদের মধ্যে শেষ দুজনকে গুম করে ফেলা হয়েছে। কবি, চিত্র পরিচালককে ছোঁওয়া যায়নি। সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকার কথা ভেবে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়ে নেওয়া হয়েছে। এইসব হুজ্জুতিতে তাদের কিছু এসে যায়নি। বোম্বে ফেরত পরিচালক এখন শহরে শ্যুটিং করছেন। কবি তাঁর তেত্রিশ খন্ডের শেষ কবিতাটা নিয়ে মক্সো করছেন। আর ঠিক তখনি তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে পার্কস্ট্রিটের এক লুকোনো ছোট্ট ঝাঁ চকচকে মাসাজ পার্লার। এক আঠারো পেরোনো ছেলে। তার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁওয়া। কবি কলম রাখলেন পাশে।
ভুতুম গুলো ডানা ঝাপটালো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাছে ও দূরের পথ নিরীক্ষণ করতে থাকলো। আর কবি কলম তুলে নিয়ে একটা পেল্লাই শব্দের আঁক কষতে গিয়ে হঠাৎ মনে করে ফেললেন সেই লোড শেডিং রাতের কথা। পুলিশ এসে দরজা ধাক্কালো। বরুণ মজুমদার আকাশবাণী কলকাতা থেকে খবর পড়লেন। দিল্লীর দরবার থেকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা হলো। এক আকাশ তারার মাঝে মন্টু জন্মালো পেয়ারা গাছের নীচে। কবিকে ডেকে তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী একটা অফার দিলেন। শব্দ গুলো দুমড়ে, মুচড়ে ভেঙে ফেলার। কবি তার সামনে দুমড়ে মুচড়ে শব্দ গুলোকে ভেঙে ফেললেন। সে বছর শারদীয় পত্রিকায় তার সতীর্থদের বাদ দিয়ে একমাত্র তারই গুচ্ছ কবিতা বেরোলো। অনেক পরে সেই কবিতার বই হাতে এলে মন্টু সাজিয়েছিল আলমারীর তাক। তারও অনেক পরে এই কবির সাথে মন্টুর যখন দেখা হলো তখন অবাক বিস্মরণে ধাঁধিয়ে গিয়েছিল চোখ তার। বৃদ্ধ কবির ঠোঁট ছোওয়ানো ছিল সদ্য কৈশোর পেরোনো এক ছেলের ঠোঁটে। বাসনা ছিল এক কবিতা জন্মানোর। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
মর্গের টেবিলে মন্টুর উদোম হওয়া দেহের থেকে রাশীকৃত বুলেট বার করতে গিয়ে ডোমটা দেখেছিল তার ভুরুর পাশে কাটা দাগ। তার ঠোঁটের নীচে একটা ছোট্ট তিল। তার নাভির অসামঞ্জস্যতা। তারও নীচে তাকাতে গিয়ে ডোমটার হিসি পেয়েছিল। আর মন্টু শুয়েছিল পাশ ফিরে। তার শীত করছিলো। নিরাভরণ শরীর থেকে প্রাণের যাবতীয় উষ্ণতা চলে যাবার পর নিজেকে তার কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিলো। হালকা লাগছিলো মাথা। ওপড়ানো খুলিটার ভেতর দিয়ে হাওয়া ঢুকছিলো। বুকের কাটা অংশ থেকে হৃৎপিন্ড উঁকি দিচ্ছিলো অল্প অল্প করে। বীরেন ভদ্র রেডিওতে মহালয়ার স্তোত্র পাঠ করছিলেন। খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসছিলো ভোরের শিউলির গন্ধ। আর ঠিক তখনি মন্টুর মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ইচ্ছে করছিলো মাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে। যে মাকে সে হারিয়েছে সেই কবেকার পেয়ারা গাছের তলায়। জন্মানোর সময়। এক আকাশ তারার নীচে।
ডোম ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয়েছিল। জীবনে প্রথম লাশকে পাশ ফিরে শুতে দেখে উল্লুক বনে গিয়েছিল সে। চোখে মুখে জল দেওয়ার পরেও নিশ্বাসের সাথে বাংলার ঝাঁঝালো গন্ধটা মন্টুর ঠিক নাকের পাশে এসে পড়ছিল। লোকটা মাথা নীচু করে সেলাই করছিল মন্টুর কপাল। যে কপালে সে না হতে পারলো মন্টু। না হতে পারলো অমিতাভ। না হতে পারলো সরকার।
তাহলে মন্টু ঠিক কী হয়েছিল?
মন্টু হয়েছিল এক মৃত প্রায় অঞ্চলের সময়। যে সময় তাকে দিয়ে এমন একটা কাজও করায়নি যা আসলে মন্টু করতে চেয়েছিল।
ওয়াগান ভাঙা। লুঠ। গুম করে দেওয়া। রাহাজানি। সিন্ডিকেট রাজ। অনৈতিক ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট। লোহার ছাঁট। মন্ত্রী কেনা-বেচা। বর্ডারের ওপারে গরু পাচার। সবশেষে নিজেই আইন হয়ে যাওয়া। এমন এক গুচ্ছ নালিশের লাল কালির তালিকা ওই হলুদ ফাইলে দাগানো আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যেটা নেই সেটা হল মন্টু আসলে অমিতাভ হতে চেয়েছিল। মন্টু চেয়েছিল এই রাজ্যের সরকার হতে।
গোটা দেহ সেলাই হয়ে গেলে ডোম ভেবেছিল নতুন জন্ম পেলো যেন ছেলেটা।
সেদিন আবার আকাশে তারা উঠেছিল।
ভ্যাপসা দম বন্ধ করা পচা মাংসের ঘরে ঢুকে পড়েছিল শিউলির সুবাস।
শুধু
সেদিন বরুণ মজুমদার খবর পড়ছিলেন না।
বাংলায় আরো বেশি করে যাতে মন্টুদের জন্ম হয় তার দিকে নজর রাখছিলেন কলম পাশে রাখা সেই পুলিশ মন্ত্রীর কবি। (ক্রমশ)
প্রথম পর্বের লিঙ্ক
ঝাঁ-চকচকে শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল বহুতলের ওপরে, সৌর বিদ্যুতের অসংখ্য চাকতি লাগানো এ্যান্টেনার নীচে, একটা গুপ্ত ঘর আছে। সেটাকে ঠিক গুপ্ত বলা যায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। যাহা চোখের সামনে বিরাজমান, তাহা গুপ্ত হয় কেমনে? ভাষা-বিদ্যার লোকজনেরা চোখ পাকাতেই পারেন। প্রশ্ন করতেই পারেন। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও চোখের সামনে দন্ডায়মান ঘরটা গুপ্তই। কেউ ওখানে প্রবেশ করেনা সচরাচর। সভ্য জামাকাপড় পড়া পাহাড়াদাররা ওটাকে বলে মেশিন ঘর।
নীচের উঠোন থেকে বাইশতলার মেশিন ঘরের হদিশ তারাও খুব একটা রাখে না। রাখলে জানতে পারতো ওখানে ছড়িয়ে আছে রাশি কৃত বিদ্যুৎবাহী তার মাকড়সার জালের মতো। তারা ছড়িয়ে পড়েছে কংক্রিটের পাঁজরে পাঁজরে। এ- বি- সি ব্লকে। শহরের তথাকথিত সেলিব্রিটিদের খাঁচায় খাঁচায়। যাঁরা এক মুহূর্ত ঠান্ডা ছাড়া থাকতে পারেন না। যাঁরা এই মুহূর্তে জমিয়ে রেখেছেন নিজেদেরকে হিমাঙ্কের নীচে।
হঠাৎ ট্রান্সফরমার উড়ে গেলে...
শহরে হঠাৎ ঝড় উঠলে...
নিছকই অসাবধানতায় অন্ধকার নেমে এলে...
ভোটের আগের দিন বদমাইশের লোডশেডিং হলে...
গোটা শহরকে কানা করে এই বহুতলে আলো জ্বলে ওঠে। সেই সময় এই ঘরে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ইলেকট্রনিক মেশিন গুলো হঠাৎই কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। চিক চিক...টিক টক...পিঁ পিঁ শব্দ তুলে। এই ভাষা, এই ঘরে আশ্রিত উদ্বাস্ত ভুতুম পেঁচার দলটা বুঝতে পারে না। প্রাথমিকে ইংরাজী শিক্ষা তুলে দেওয়ার ভুলে বাঙালীরা যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি এক অবাধ্য আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হয় ভুতুমের দলটি। কুলকুন্ডলিনী যোগে তখন তারা ডানা ঝাপটায়। দেওয়ালে গা ঘষে। অথবা রাতের অন্ধকারে উড়ে যায় খেতে না পাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া ইঁদুর গুলোকে ধরতে। ওরা চলে গেলে ঘর ফাঁকা হলে নজরে পড়ে দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা স্টিকার। যা বহুদিন আগে মন্টু সেঁটে দিয়েছিল নিজের অজান্তে।
তার মন্টু নামটা খসিয়ে দেওয়ার পরে।
অমিতাভ হবার সূচনায়।
সরকার হবার দিবা স্বপ্নের ক্রান্তিলগ্নে।
ঠিক এই মুহূর্তে রাজ্যে যখন নতুন সরকার শপথ নেবে। গোটা রাজ্যে বিজয় উল্লাসের মিছিল থেকে ঢাকের দ্রিম দ্রিম শব্দের বদলে মানুষের চামড়া বাজানোর চড়াম চড়াম আওয়াজ নির্গত হবে। তখনও লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের তেত্রিশ নম্বর টেবিলের দুই নম্বর ড্রয়ারে একটা হলুদ ফাইল ঘুমিয়ে থাকবে। যাকে আর কেউ কোনো দিন জাগাবে না। পাতা গুলো উলটে দেখবে না। মেটা ডেটা ফাইলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের আর্কাইভে সংরক্ষণ হবে না। মন্টু নামটা ধূসর অতীত হয়ে ঝুলে থাকবে একটা হারিয়ে যাওয়া, ভেঙে ফেলা, বর্তমান প্রজন্মের না দেখা সিনেমা হলের প্রজেক্সান রুমে।
গঙ্গার ধারে মহাদেব জুটিমিলের নাগকেশর ফুল গাছের তলায়।
একটা উচ্চমাধ্যমিকে স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর লাস্ট বেঞ্চে।
এক বহুতল বিলাসবহুল বাড়ির মেশিন ঘরে।
দুঃখের বিষয়টা হলো মন্টু নিজেও, মারা যাবার এতোগুলো বছর পরেও মেনে নিতে পারে না তার সাক্ষী থাকা সেই হলুদ ফাইলটার মধ্যে কোথাও এই জায়গা গুলোর নাম নেই। এমনকি লেখা নেই মেশিন ঘরের দেওয়ালে ধূসর হওয়া এক স্টিকারের কথা। যেখানে অমিতাভ হাতে একটা বাজ পাখি নিয়ে ঠোঁটের কোনে বিড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীচে পেন্সিলের কয়েকটা হরফ। ‘মন্টু অমিতাভ হতে চেয়েছিল’।
যা নেই তা নিয়ে কথকের মাথা ব্যাথা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যা আছে তা নিয়ে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। হলুদ রঙের ফাইলটার মধ্যে সুইমিং পুলের নীল জলে মন্টুর ক্ষত বিক্ষত দেহের সাঁতার কাটার ছবি ছাড়াও রয়ে গেছে বেশ কিছু তাবড় শুহুরে বিখ্যাত বেঁচে থাকা মনীষীদের ছবি। একজন কবি, একজন চিত্র পরিচালক, পার্কস্ট্রিটের এক পরিচিত ম্যাসাজ পার্লারের ছেলে-বেশ্যা, আর একজন দালাল। এদের মধ্যে শেষ দুজনকে গুম করে ফেলা হয়েছে। কবি, চিত্র পরিচালককে ছোঁওয়া যায়নি। সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকার কথা ভেবে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়ে নেওয়া হয়েছে। এইসব হুজ্জুতিতে তাদের কিছু এসে যায়নি। বোম্বে ফেরত পরিচালক এখন শহরে শ্যুটিং করছেন। কবি তাঁর তেত্রিশ খন্ডের শেষ কবিতাটা নিয়ে মক্সো করছেন। আর ঠিক তখনি তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে পার্কস্ট্রিটের এক লুকোনো ছোট্ট ঝাঁ চকচকে মাসাজ পার্লার। এক আঠারো পেরোনো ছেলে। তার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁওয়া। কবি কলম রাখলেন পাশে।
ভুতুম গুলো ডানা ঝাপটালো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাছে ও দূরের পথ নিরীক্ষণ করতে থাকলো। আর কবি কলম তুলে নিয়ে একটা পেল্লাই শব্দের আঁক কষতে গিয়ে হঠাৎ মনে করে ফেললেন সেই লোড শেডিং রাতের কথা। পুলিশ এসে দরজা ধাক্কালো। বরুণ মজুমদার আকাশবাণী কলকাতা থেকে খবর পড়লেন। দিল্লীর দরবার থেকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা হলো। এক আকাশ তারার মাঝে মন্টু জন্মালো পেয়ারা গাছের নীচে। কবিকে ডেকে তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী একটা অফার দিলেন। শব্দ গুলো দুমড়ে, মুচড়ে ভেঙে ফেলার। কবি তার সামনে দুমড়ে মুচড়ে শব্দ গুলোকে ভেঙে ফেললেন। সে বছর শারদীয় পত্রিকায় তার সতীর্থদের বাদ দিয়ে একমাত্র তারই গুচ্ছ কবিতা বেরোলো। অনেক পরে সেই কবিতার বই হাতে এলে মন্টু সাজিয়েছিল আলমারীর তাক। তারও অনেক পরে এই কবির সাথে মন্টুর যখন দেখা হলো তখন অবাক বিস্মরণে ধাঁধিয়ে গিয়েছিল চোখ তার। বৃদ্ধ কবির ঠোঁট ছোওয়ানো ছিল সদ্য কৈশোর পেরোনো এক ছেলের ঠোঁটে। বাসনা ছিল এক কবিতা জন্মানোর। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
মর্গের টেবিলে মন্টুর উদোম হওয়া দেহের থেকে রাশীকৃত বুলেট বার করতে গিয়ে ডোমটা দেখেছিল তার ভুরুর পাশে কাটা দাগ। তার ঠোঁটের নীচে একটা ছোট্ট তিল। তার নাভির অসামঞ্জস্যতা। তারও নীচে তাকাতে গিয়ে ডোমটার হিসি পেয়েছিল। আর মন্টু শুয়েছিল পাশ ফিরে। তার শীত করছিলো। নিরাভরণ শরীর থেকে প্রাণের যাবতীয় উষ্ণতা চলে যাবার পর নিজেকে তার কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিলো। হালকা লাগছিলো মাথা। ওপড়ানো খুলিটার ভেতর দিয়ে হাওয়া ঢুকছিলো। বুকের কাটা অংশ থেকে হৃৎপিন্ড উঁকি দিচ্ছিলো অল্প অল্প করে। বীরেন ভদ্র রেডিওতে মহালয়ার স্তোত্র পাঠ করছিলেন। খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসছিলো ভোরের শিউলির গন্ধ। আর ঠিক তখনি মন্টুর মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ইচ্ছে করছিলো মাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে। যে মাকে সে হারিয়েছে সেই কবেকার পেয়ারা গাছের তলায়। জন্মানোর সময়। এক আকাশ তারার নীচে।
ডোম ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয়েছিল। জীবনে প্রথম লাশকে পাশ ফিরে শুতে দেখে উল্লুক বনে গিয়েছিল সে। চোখে মুখে জল দেওয়ার পরেও নিশ্বাসের সাথে বাংলার ঝাঁঝালো গন্ধটা মন্টুর ঠিক নাকের পাশে এসে পড়ছিল। লোকটা মাথা নীচু করে সেলাই করছিল মন্টুর কপাল। যে কপালে সে না হতে পারলো মন্টু। না হতে পারলো অমিতাভ। না হতে পারলো সরকার।
তাহলে মন্টু ঠিক কী হয়েছিল?
মন্টু হয়েছিল এক মৃত প্রায় অঞ্চলের সময়। যে সময় তাকে দিয়ে এমন একটা কাজও করায়নি যা আসলে মন্টু করতে চেয়েছিল।
ওয়াগান ভাঙা। লুঠ। গুম করে দেওয়া। রাহাজানি। সিন্ডিকেট রাজ। অনৈতিক ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট। লোহার ছাঁট। মন্ত্রী কেনা-বেচা। বর্ডারের ওপারে গরু পাচার। সবশেষে নিজেই আইন হয়ে যাওয়া। এমন এক গুচ্ছ নালিশের লাল কালির তালিকা ওই হলুদ ফাইলে দাগানো আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যেটা নেই সেটা হল মন্টু আসলে অমিতাভ হতে চেয়েছিল। মন্টু চেয়েছিল এই রাজ্যের সরকার হতে।
গোটা দেহ সেলাই হয়ে গেলে ডোম ভেবেছিল নতুন জন্ম পেলো যেন ছেলেটা।
সেদিন আবার আকাশে তারা উঠেছিল।
ভ্যাপসা দম বন্ধ করা পচা মাংসের ঘরে ঢুকে পড়েছিল শিউলির সুবাস।
শুধু
সেদিন বরুণ মজুমদার খবর পড়ছিলেন না।
বাংলায় আরো বেশি করে যাতে মন্টুদের জন্ম হয় তার দিকে নজর রাখছিলেন কলম পাশে রাখা সেই পুলিশ মন্ত্রীর কবি। (ক্রমশ)
1 মন্তব্যসমূহ
দারুণ লেখা। মন্টুর মন্টু হয়ে ওঠার অপেক্ষায় থাকলাম।
উত্তরমুছুন