কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়
নারী-অধিকার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক প্রচারিত এবং প্রবাদ-প্রতিম উচ্চারণের একটি বক্তব্য হলো : ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার দাও অধিকার (১৯৯৫ক : ৪১৩)।’ এখানে তাঁর অবস্থানে একটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ পরিমিতি আমি লক্ষ করি, যা কারো মর্যাদা-রক্ষার পূর্বশর্ত। কারো হাতে কিছু তুলে দেয়ার মধ্যে, দান করার মধ্যে ওই মর্যাদাটি যে থাকে না, রবীন্দ্রনাথ সে-পরিস্থিতিটি লক্ষ করতে বলেন। অমনভাবে পাওয়া যে প্রকৃত পাওয়া নয়, নয় হয়ে-ওঠা, ক’জন সেটা লক্ষ করেন? চিত্রাঙ্গদা গীতিনৃত্যনাট্যেও চিত্রাঙ্গদার কণ্ঠে একই তাৎপর্যের একটি আহ্বান (১৯৯৫খ : ৪৮৯) :
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
এভাবে এগোতে-এগোতে যা পাওয়া যায়, তা নারী-পুরুষ সকলকেই নির্মোহভাবে দেখার দুর্লভ প্রয়াস, আদর্শায়নমুক্তভাবে দেখা। এবং তারই অংশ হলো সমালোচনামূলক-ভাবে দেখা। আমার ধারণা : পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন এবং উন্নতির পরে এখন সময় হয়েছে রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর অনালোচিত এবং স্বল্প-আলোচিত কিছু মতাবস্থানকে লক্ষ করার ─ নারী-বিষয়ে, নরনারীর সম্পর্ক বিষয়ে। কোথাও এমন কিছু পলকা নেই, যা এতে ভেঙে পড়বে। বরং, পরিস্থিতির উন্নতির পরবর্তী ধাপে পৌঁছনোর জন্যে এ-যাবৎ অলক্ষিত-স্বল্পলক্ষিত ধারণা এবং বক্তব্যে এবারে-এখন যাওয়াটাই জরুরি।
এরূপ আলোচনা শুরুর পক্ষে সাহায্য নেয়া যায় শেষের কবিতা উপন্যাসের অমিত রায়ের বলা বিখ্যাত কিছু কথার। কথাগুলো যে সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কিংবা ঔপন্যাসিকের নয়, তা আমরা মনে রাখব। কিন্তু, কথাগুলোর নিজস্ব মূল্য বা সত্যাসত্যকেও তো লক্ষ না করার কিছু নেই। এ-প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর পক্ষে কথাগুলোর (তথ্যসূত্র: কাজল; ২০০৯ : ১১৪) প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য : ‘যে পক্ষের দখলে শিকল আছে সে শিকল দিয়েই পাখিকে বাঁধে অর্থাৎ জোর দিয়ে। শিকল নেই যার সে বাঁধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে। শিকলওয়ালা বাঁধে বটে, কিন্তু ভোলায় না; আফিমওয়ালী বাঁধে বটে, ভোলায়ও। মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি-শয়তানী তার যোগান দেয়।’
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প “স্ত্রীর পত্র”-কেও নারী-অধিকার-বিষয়ে মেনিফেস্টোর মর্যাদা দিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ করা হয় “পয়লা নম্বর”ও। “স্ত্রীর পত্র” গল্পটি নিয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাইব। এই ‘পত্র’টি একটি তীর্থস্থান থেকে লেখা, পত্রের আকারেই গল্পটি লেখা। এ-গল্পটি নিয়ে কিছু কথা আমি হেনরিক ইবসেনের অ’ ডলস হাউস-বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলেছিলাম। এ গল্পটির পত্রলেখক মৃণাল স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে যায় ─ শ্রীক্ষেত্রের তীর্থে। পত্রে সে তার স্বামীর সংসারে দিনযাপনের অভিজ্ঞতাগুলো বয়ান করে। তার জায়ের বোন বিন্দুকে নিয়েই কথা অনেক বেশি। স্বামীর একান্নবর্তী সংসারে তার নিজের এবং অন্য মেয়েদের দুঃখকষ্টের বিবরণে মৃণালের চিঠিটি পূর্ণ। মৃণালের কাছেই বিন্দু বেশি আশ্রয় এবং সুরক্ষা পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এ-গল্পে সংসারে মেয়েদের দুর্দশা ও লাঞ্ছনার যে সত্য ছবি এঁকেছেন, তা মর্মস্পর্শী। বিন্দুর মতো অসহায় এবং আশ্রিত পরিস্থিতির ছেলে/পুরুষদেরও যে নানা দুর্দশা ঘটে, সেটা আমরা ভুলতে বসি। মৃণালের শ্বশুরবাড়ির লোকজন শেষ পর্যন্ত অসহায় বিন্দুকে বিয়ে দিয়ে তাকে তাদের ঘাড় থেকে নামাতে চাইল। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিন্দু দেখতে পেল যে তার স্বামী পাগল। এ-ব্যাপারে মৃণালকে বিন্দু যা বলেছিল, তা হুবহু উদ্ধৃত করা প্রয়োজন (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫০৪), সংসারের পরিস্থিতিগুলো যে মিশ্র এবং বিরোধপূর্ণ, অন্যথায় তা বোঝা যাবে না। মৃণাল ঠেসে-চেপে প্রশ্ন করলে বিন্দু তার শ্বশুর সম্পর্কে জানালো, ‘...শ্বশুরের এই বিবাহে মত ছিল না কিন্তু তিনি আমার শাশুড়িকে যমের মতো ভয় করেন। তিনি বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন। শাশুড়ি জেদ করে তাঁর ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।’ অত্যন্ত সংক্ষেপে বর্ণিত এই পরিস্থিতিটি কি প্রকৃতপক্ষে ছোট এবং গুরুত্বহীন? উল্লিখিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমি বলেছিলাম যে “স্ত্রীর পত্র” গল্পে এটিও একটি তীর্থযাত্রার-তীর্থবাসের ঘটনা। এটি এরূপ দ্বিতীয় ঘটনা। বিন্দুর শ্বশুর, বিন্দুর ভাষ্য-অনুযায়ীই, স্ত্রীকে ‘যমের মতো ভয় করেন’। এবং পাগল ছেলের বিয়েতে জড়িত থাকতে না-চেয়ে এবং সংশ্লিষ্ট অনেক কিছু এড়াতে ‘বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন।’ শ্রীক্ষেত্রবাসিনী মৃণালের গল্প রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বিন্দুর কাশীবাসী শ্বশুরের গল্প কি কেউ লিখবেন? কোনো মানবতাবাদী, নারীবাদী? রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে দ্বিতীয় তীর্থযাত্রার উল্লেখ নিশ্চয় অসচেতন নয়, কিন্তু তিনি তাকে অত্যন্ত অসম গুরুত্বে উল্লেখ করেছেন। মেয়েদের দুর্দশার পরিস্থিতিগুলো নিয়ে লেখা একটি সাহিত্যিক ধারায় পরিণত হয়েছিল বলেই এই ভারসাম্যহীনতা কি-না, কে বলবে? কোনো অগভীর এবং অন্যায় জনমতকে সমীহ করার মতো মনোভাব বুঝি! প্রসঙ্গক্রমে বলি যে এই জনমতকে কথিতরকম সমীহ করেই বোধ হয় জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিপুল-অধিকাংশ গদ্য লেখা─গল্প, উপন্যাস। অপ্রকাশিত রেখেই প্রয়াত হন। সম্ভাব্য বিরূপ জনপ্রতিক্রিয়ার এই যে পরিস্থিতি, যার মুখে আমরা প্রায় সকলেই অসহায়, জীবনানন্দ দাশ প্রায় সমুদয় গদ্য লেখা অপ্রকাশিত রেখে যান, তা আর কতদিন এভাবে আলোচনা-বিশ্লেষণের বাইরে থাকবে?
“স্ত্রীর পত্র” গল্পে পরবর্তী অনুচ্ছেদে মৃণালের ভাষ্যে বিন্দুর শ্বাশুড়ি সম্পর্কে আরো জানা যায়, ‘শ্বাশুড়ি তার প্রচন্ড, রাগলে জ্ঞান থাকে না। সেও পাগল, কিন্তু পুরো নয় বলেই আরো ভয়ানক।’ ইত্যাদি। এমন শ্বাশুড়ির ভয়ে বিন্দুকে তৃতীয় রাতে তার পাগল স্বামীর ঘরে ঢুকতে হয়েছিল। তারপর স্বামী ঘুমোবার পরে বিন্দু পালিয়ে চলে এসেছিল মৃণালের কাছে। এখন বিবরণ-মতে, ‘পাগল, কিন্তু পুরো নয় বলেই আরো ভয়ানক’ যে-নারী, তার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটানোর কাহিনী শেষ পর্যন্ত কাশীবাসী যে-পুরুষের, তার গল্প কে লিখবেন? সাহিত্যিক এবং তাত্ত্বিক ঝোঁক বলি বা চল বলি, তার মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ থাকবে সমগ্র সাহিত্যচর্চা, বুদ্ধিবাজি? কোনো ভারসাম্যহীনতার পরিণতিই তো কল্যাণকর নয় বলে বলা হয়।
রবীন্দ্রনাথের আর একটি ছোটগল্প, “শেষের রাত্রি” আমাদের আলোচনার পক্ষে আরো প্রাসঙ্গিক। বিস্ময়কর যে এ-গল্পটি নিয়ে কোথাও তেমন কোনো আলোচনা নেই। বর্তমান যে বিশ্ব পরিস্থিতিতে শ্রেণি-প্রশ্নটি অনেক পেছনে চলে গেছে, একে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এবং সে-জন্যেই লিঙ্গ বিষয়টি চাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ─ তাতে অবশ্য এ রকম ঘটাই স্বাভাবিক। লৈঙ্গিক সমতা-ন্যায্যতার যে দাবি নারীবাদীদের, “শেষের রাত্রি” গল্পে উপস্থাপিত পরিস্থিতি এবং ঘটনার আলোচনায় তো সেক্ষেত্রে তাদেরও আগ্রহ থাকতে পারত। তা যে নেই, তাঁরা যে “স্ত্রীর পত্র” কিংবা “পয়লা নম্বর” সম্পর্কে বলেই শেষ করেন, তা-ই প্রমাণ করে যে সমতা-ন্যায্যতা তাঁদেরও সত্য আগ্রহ নয়। তাদের বিপুল-অধিকাংশের প্রকৃত আগ্রহ আত্মমঞ্চায়নে।
“শেষের রাত্রি” গল্পে মৃত্যুপথযাত্রী যতীনের পরিস্থিতি গল্পটি যতটা জানাতে পারে, অন্য কোনোভাবে তা করা কঠিন। মৃত্যুর আগে একবারের জন্যেও কেন সে তার স্ত্রীর দেখা পর্যন্ত পায় না, গল্পে সে-প্রশ্নের তেমন কোনো উত্তর নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে জানাচ্ছেন। স্ত্রী মণির অনাগ্রহ-উপেক্ষা-অবহেলা পাহাড়প্রমাণ। যতীনের মাসির দিক থেকে মণির এই নির্মমতাকে আড়াল করার কিংবা লুকনোর করুণ চেষ্টাগুলো বরং এক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ। সেগুলোই বোধ করি মণির আচরণ যে অকারণ, অগ্রহণযোগ্য, তা জানায়। আরো চোখে পড়ে মণির প্রতি যতীনের নিজের এক অন্ধ অনুরাগ, বুঝি তাকে তার ভালোবাসতেই হবে! মিথ্যেকে সত্য ভাবার এক ঘোর তার! একি কোনো দুরারোগ্য মানসকাঠামো তার, এবং জগৎসংসারের আরো অনেকের? মণির যত অনাগ্রহ, বিকর্ষণ, যতীনের যেন ততই আস্থা, আকর্ষণ! যতীনের এই নির্বিচার ভালোবাসা যে অবকাশ তৈরি করে, মণির মনোভাব এবং আচরণকে তার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তবে সাফাই নয়। কারণ, সুযোগ নেওয়াটা সমতা কিংবা ন্যায্যতার মনোভাব নয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা অনেকেই তা নিই না।
এ-গল্পটির আলোচনায় আরো বলার আছে। রবীন্দ্রনাথ যে শুধু ঘটনার স্তরে থেকেছেন এবং যতীনের একপেশে অনুরাগ সম্পর্কে জানিয়েই যে শেষ করেছেন, তা নয়। গল্পটির একপর্যায়ে যতীন-মণির সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর কিছু মন্তব্য এবং বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তাতে তাদের অমিলের চরিত্রটা বোঝা যায়, দু’জনার প্রকৃতিগত দূরত্ব সম্পর্কেও কিছু মন্তব্য। যা আরো উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে এই দুরতিক্রম্য দূরত্ব নিয়ে মণির পীড়িত-ক্লিষ্ট-ভাবিত হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, আর যতীনের গোটা জীবনজুড়েই যে এই দূরত্বের বেদনা, যন্ত্রণা, গল্পটি তা-ই নিয়ে। দাম্পত্য-সংকটের এক অংশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে পর্যবেক্ষণ “শেষের রাত্রি” গল্পে, আমরা এখন যা উদ্ধৃত করব, বিস্ময়কর যে জীবনানন্দ দাশের অসংখ্য গল্প-উপন্যাসে যেন তারই বিশদতর-বিস্তৃততর বিবরণ। সেখানে নারীর পক্ষ থেকে প্রত্যাহার, উপেক্ষা-অবহেলা আর শীতলতারও বহুলাংশে একই ছবি। জীবনানন্দের লেখা সেসব ছবি তো দেখা যায় না, সওয়া যায় না! যা-ই হোক, আপাতত যতীন-মণির অমিলদীর্ণ দাম্পত্যের যে ধরণ কিংবা প্রকৃতি সে সম্পর্কে জানা যাক (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২১) :
যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালো করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই। দুই যন্ত্র দুই সুরে বাঁধা, এক সঙ্গে আলাপ চলা বড়ো কঠিন। মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে হাসিতেছে, দূর হইতে তাহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে। যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছেÑ সে কেন অমন সামান্য যাহা-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না। পারে না যে তাহাও তো নহে, নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না। কিন্তু, পুরুষের যাহা-তাহা তো মেয়েদের যাহা-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না। বড় কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্যপক্ষ মন দিল কিনা খেয়াল না করিলেই হয়; কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যোগ থাকা চাই। বাঁশি একাই বাজিতে পারে, কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না। এইজন্য কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটো-চারটে টানাবোনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিঁড়িয়া ফাঁক হইয়া গেছে; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে। যতীন বুঝিতে পারিয়াছে; মণি পালাইতে পারিলে বাঁচে; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনো-একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে। কেননা, দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ।
এই বিবরণ-বিশ্লেষণ গল্পে একটি ঘটনা কিংবা কিছুটা সময় সম্পর্কে উপস্থাপিত হলেও, যতীন-মণির সামগ্রিক সম্পর্ক সম্পর্কেও এ কোনো কিছু কম মূল্যবান নয়। এক কিংবা ছোটকে কেন্দ্র করে, উপলক্ষ করে বরং ভিন্ন এবং বৃহৎ বিষয়ে বলা অনেক কথা এগুলো। দাম্পত্য বা সংসারের ব্যাপক/অনেক ক্ষেত্র সম্পর্কে এরা কিছু গভীর সত্যকে ধারণ করে। প্রেম এবং রোমান্টিকতার জীবনদর্শন এখানে প্রশ্ন এবং পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে। এই বিবরণের দু’-একটি পর্যায় আমাকে স্মরণ করিয়েছে অন্য দু’-একটি সাহিত্যকর্মে প্রাপ্ত কিছু পরিস্থিতি সম্পর্কেও। প্রাসঙ্গিক বিধায় এগুলো সম্পর্কেও একটু জানাতে চাই।
“মাই লাস্ট ডাচেস”-খ্যাত রবার্ট ব্রাউনিং-এর একটি প্রায়-বিপরীত উন্মোচনের কবিতা হচ্ছে “এ্যান্ড্রিয়া ডেল সার্টো”। এ্যান্ড্রিয়া নামের এক চিত্রকরের প্রতি তার স্ত্রী লুক্রেজিয়ার শীতলতা এবং প্রবঞ্চনার গল্পটি ব্রাউনিং এখানে লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত ড্রামাটিক মনোলগ রীতিতে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এখানে এ্যান্ড্রিয়া নামের শৈলীসফল চিত্রকর মানুষটির মধ্যেও দেখা যায় লুক্রেজিয়ার প্রতি এক ধরনের নিঃশর্ত তথা ভীরু মুগ্ধতার মনোভাব। যার সম্পূর্ণ সুযোগ লুক্রেজিয়া গ্রহণ করে। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য হলো এখানে কবিতার শুরুতেই দেখা যায় এ্যান্ড্রিয়া-লুক্রেজিয়ার যোগাযোগহীনতা, অন্তঃসারশূন্য সংলাপ কিংবা সে-লক্ষ্যে তাদের কোশেশ (তথ্যসূত্র : রবার্ট; ১৯৫১ : ৩৪৩):
But do not let us quarrel any more,
No, my Lucrezira; bear with me for once :
Sit down and all shall happen as you wish.
You turn your face, but does it bring your heart?
... ... ...
I often am much wearier than you think,
This evening more than usual, and it seems
As if─ forgive now ─ should you let me sit
Here by the window with your hand in mine
And look a half-hour forth on Fiesole,
Both of one mind, as married people use,...
এখানে এ এক ভীরু এবং করুণ আর্তি-- সংযোগ, সম্পর্ক এবং বোঝাপড়ার জন্যে, যা পূরণ হয় না সংশ্লিষ্ট নারীর উপেক্ষা এবং ঔদ্ধত্যের কারণে। একাধিক কবিতায় রবার্ট ব্রাউনিং দাম্পত্য তথা সম্পর্কের এরূপ সংকটকে উপস্থিত করেছেন, এবং এ জন্যে নারী-পুরুষ দু’য়ের দায়িত্বের সত্য এবং সম্ভাবনাকেই নির্দেশ করেছেন এক ব্যতিক্রমী মনস্বিতার সঙ্গে; বিখ্যাত “নারী” কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম (তথ্যসূত্র: কাজল; ২০০৯: ১১৪) যেমন এক দুর্লভ এবং মূল্যবান সমগ্রতায় বিষয়টিকে দেখেছিলেন,
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপতাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককু- বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয় জ্ঞান?
তারে বল, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর শয়তান।
অথবা পাপ যে ─ শয়তান যে ─ নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
ওপরে উদ্ধৃত অংশের শেষ দু’টি লাইন কি এ-যুগে আমাদের, নারীবাদীদের কোনো বিবেচনা পায়?
যোগাযোগ কিংবা সংযোগের প্রশ্নটি প্রকট হয়ে আসে নারী-অধিকার বিষয়ে বহুল-উল্লেখিত নাটক অ’ ডলস্ হাউস-এও। বিস্ময় এবং পরিহাসের হচ্ছে যে-ঘর ছেড়ে নোরা বেরিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই সে এবং হেলমার স্বীকার করে নেয় যে তাদের মধ্যে দীর্ঘ দাম্পত্যের কোনো একদিনও সত্যিকার অর্থে সংলাপ যাকে বলে, তেমন কিছু ঘটেনি। এ-হেন পরিস্থিতি তো ঘরহীন ঘরের কথাই বলে, যা থেকে বেরিয়ে যাওয়া-না-যাওয়াটা সমান (হেনরিক ইবসেন; ১৯৮৪ : ৬২-৬৩):
নোরা : আমাদের বিয়ের আট বছর হয়েছে। তোমাকে কি এটা ভাবাচ্ছে না যে এই প্রথমবার আমরা দু’জন ─ তুমি আর আমি ─ কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছি।
হেলমার : ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলতে কি বোঝাতে চাইছো?
নোরা : এই গোটা আট বছরে ─ তার চেয়ে বেশী সময় হবে ─ আমাদের পরিচয়ের শুরু থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা একটি শব্দও বিনিময় করিনি।
হেলমার : এটা কি সম্ভব ছিল যে আমি অবিরাম এবং সারাক্ষণ তোমাকে তেমন উদ্বেগ সম্পর্কে বলে যাবো যার নিরসনে তুমি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবে না?
নোরা : আমি কাজের বিষয়াদি নিয়ে বলছি না। বলছি যে আমরা কোনোদিন কোনো বিষয়ের মর্মে পৌঁছার জন্যে ঐকান্তিকতা নিয়ে একত্রে বসিনি।
নোরা সংলাপ বা আলোচনার প্রয়োজন সম্পর্কে বলছে দেখছি; এক বৃহত্তর পরিহাস এই যে একটু পরেই দেখা যাবে যে সর্বশেষ এবং একবারের জন্যে বিবেচিত এই সংলাপেরও তোয়াক্কা না-করেই গৃহত্যাগের চূড়ান্ত এবং অনড় সিদ্ধান্ত সে একাই নিয়ে ফেলেছে।
কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মে উপস্থাপিত এও হচ্ছে দাম্পত্যের ছবি। এরই পটভূমিতে দেখা যেতে পারে “শেষের রাত্রি” ছোটগল্পে যতীন-মণির সম্পর্ককে। একটি অর্থপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় যতীনের মাসির কাছ থেকে, লেখক রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে। এ-বিবরণও অবশ্য শুরু হয় যতীনের একটি ভুল বক্তব্য থেকে, মণিকে ইঙ্গিত করে যতীন বলেছে : ‘সেই জন্যেই ওর ছেলেমানুষিতে কোনোদিন কিছু মনে করি নি।’ এর পরেই রয়েছে গল্পের বর্ণনাকারী কিংবা লেখকের ভাষ্য (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫১৯) :
মাসি এ কথার কোনো উত্তর করিলেন না। কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। কতদিন তিনি লক্ষ করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাঁট আসিয়াছে, তবু ঘরে যায় নাই। কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া; একান্ত ইচ্ছা, মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয়। মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাঁধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়োজন করিতেছে। তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে। সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা তিনি জানিতেন। কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন, ‘বাবা, তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়ো না─। ও একটু চাহিতে শিখুক ─ মানুষকে একটু কাঁদানো চাই।’ কিন্তু এ-সব কথা বলিবার নহে, বলিলেও কেহ বোঝে না। যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে। সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে, একথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই পূজা চলিতেছিল, অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আসা পরাভব মানিতেছিল না।
এতো প্রচলিত পতি-দেবতার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি এবং তদ্ভিত্তিক ডিসকোর্স! এখানে রয়েছে ‘নারীদেবতা’র ধারণা, রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে! রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে নারীবাদ-বিরোধী এক তত্ত্ব একে বলা যাবে কি-না, আমার প্রশ্ন সেটাই। কেউ স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন যে যতীনের যে পূজা করে ঊর্ধ্বে-রাখা, রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী নারী চিত্রাঙ্গদা তো তাকেও একইভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে!
যতীনের মাসি অর্থাৎ একজন সংসার-অভিজ্ঞ নারীর দৃষ্টি দিয়ে যতীন-মণির সম্পর্ককে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ─ এতে ওই-গল্পের নানা বিবরণ এবং মন্তব্যের মূল্য বেড়েছে। ওপরে মাসির যে বিবরণ-পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত, গল্পে তারপরও তা এগিয়ে যায়, আর তাতে আসন্নমৃত্যু যতীনের জীবনের করুণ পরিস্থিতি আরও মর্মান্তিক মনে হতে থাকে (রবীন্দ্রনাথ : ১৯৯৮ : ৫১৯) :
মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি। তাই তার উপর রাগ করতে। কিন্তু, মাসি সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতোসমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে যায়। জীবনে কত ভুল করি, কত ভুল বুঝি, তবু তার ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি। কোথা থেকে আমার মনের ভিতরটি আজ এমন আনন্দে ভরে উঠেছে।
মাসি আস্তে আস্তে যতীনের কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার দুই চক্ষু বাহিয়া যে জল পড়িতেছিল তাহা কেহ দেখিতে পাইল না।
রবীন্দ্রনাথের উপস্থাপনায় যতীনের আত্মমর্যাদাবোধই শুধু কম নয়, তার উপলব্ধিগুলোও অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের, ব্যতিক্রমী। মণিকে নিয়ে তার মনে এক অপরিমেয়-অস্বাভাবিক উচ্ছ্বাস, মণির প্রশ্নে সে যে কতো বেশি বাড়িয়ে ভাবতে অভ্যস্ত! মাসি যখন চাইছে, তখনই মণির সম্পর্কে বানোয়াট যে কোনো কিছু বলে অত্যন্ত বিশ্বাসপ্রবণ যতীনকে তা গেলাতে পারছে। গল্পে এর পরে ঠিক এরূপ আরো কিছু কথোপকথন (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২০) :
“কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তোমার আর ঘুম এল না, তাই আজ তোমাকে সকাল-সকাল ঘুমোতে বলছি।”
“মণি কি ঘুমিয়েছে?”
“না, সে তোমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি করে তবে ঘুমোতে যায়।”
“বলো কী মাসি, মণি কি তবে ─”
“সেই তো তোমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে।”
“আমি ভাবতুম, মণি বুঝি ─”
“মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয়। দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয়।”
“আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝোল হয়েছিল তাতে বড়ো সুন্দর একটি তার ছিল। আমি ভাবছিলুম তোমারই হাতের তৈরি।”
“কপাল আমার! মণি কী আমাকে কিছু করতে দেয়। তোমার গামছা তোয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে। জানে যে, কোথাও কিছু নোংরা তুমি দেখতে পার না। তোমার বাইরের বৈঠকখানা যদি একবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্তকে করে রেখে দিয়েছে; আমি যদি তোমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত। ও তো তাই চায়।”
“মণির শরীরটা বুঝি ─”
“ডাক্তাররা বলে, রোগীর ঘরে ওকে সর্বদা আনাগোনা করতে দেওয়া কিছু নয়। ওর মন বড়ো নরম কি না, তোমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে।”
“মাসি, ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী করে।”
“আমাকে ও বড্ড মানে বলেই পারি। তবু বার বার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয় ─ ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে।”
ওপরে উদ্ধৃত কথোপকথনেও যতীন-চরিত্রের কিছু ত্রুটি পাওয়া যাচ্ছে, তা এ-ত্রুটির যে-নামই আমরা দিই না কেন। এ হয়ত দমন-নিপীড়ন-নির্যাতন একবারেই নয়, কিন্তু এও নিশ্চয় ভিন্ন এক ভারসাম্যহীনতা-সৃষ্টির কারণ। মণির মধ্যে যতীনের প্রতি যে-বেপরোয়া উপেক্ষা-অবহেলা, অবিবেচনা-অমর্যাদা, যতীনের প্রশ্রয় এবং প্রশস্তি পেয়েই যে তা তৈরি হয়েছে, এ-কথা আমি বলব না, কিন্তু এ সবের ফলেই যে তার বাড়বাড়ন্ত একটি চেহারা হয়েছে, আমার তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। গল্পের পাঠক নিশ্চয় আরো এক ব্যাপারে একমত হবেন যে যতীনের প্রতি এক অপার মাতৃস্নেহ এবং রক্ষকের মনোভাব থেকে তার মাসি এক্ষেত্রে শুধু তাকে নয়, মণিকেও রক্ষা করতে চলে গিয়েছে। মণির অনেক অবিচার-অন্যায়কে আড়াল করতে দেখা যাচ্ছে মাসিকে, যদিও এক পর্যায়ে দেখা যায় তিনি দাবি করেছেন মণির প্রতি প্রশ্রয় কমানোর পরামর্শ তিনি যতীনকে দিয়েছিলেন। সেটা হয়ত তাঁর যতীনের অসুস্থ হওয়ার পূর্বের ভূমিকা। এখন অসুস্থ যতীনের মনোকষ্ট লাঘবের জন্যে কিন্তু তিনি সত্য গোপন এবং মিথ্যে ভাষণের একশেষ করে চলেছেন। অসুস্থ এবং মৃত্যুপথযাত্রীর ক্ষেত্রে বৈ এ যে এক সর্বনাশা স্নেহে, কে তা না বলবে? সংসারে ন্যায়-অন্যায়ের নিয়ামক কত বহু এবং বিচিত্র শক্তি যে কাজ করে, সৃষ্টিশীল রচনায় অর্থাৎ সাহিত্যকর্মে প্রাপ্ত তার ছবি এবং বিবরণই বরং অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ এবং নির্ভরযোগ্য। মাসির বিভিন্ন এবং জটিল ভূমিকার নিয়ামক হিসেবে যতীনের কাছ থেকে সম্পদ-সম্পত্তি প্রাপ্তির কম-বেশি আকাক্সক্ষাও কাজ করেছে কি-না, “শেষের রাত্রি” নামের একটি ছোটগল্পেও রবীন্দ্রনাথ সে-প্রশ্নটি তুলতে ব্যর্থ হননি। এরূপ বহু জটিল বাস্তবই যে মানুষের আচরণকে দৃষ্ট সব জটিলতা দানে চলে যায়, তাতে সন্দেহ নেই। অসহায়ত্ব এবং নির্ভরশীলতাকে অতিক্রম করে সত্য-ভাষণ সংসারে ক’জন করতে পারে, এসব সত্ত্বেও দৃঢ়তা, প্রতিবাদ, ইত্যাদির শক্তি ক’টি ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে?
গল্পে এর পরের গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটিতে দেখা যাচ্ছে মণি মৃত্যুপথযাত্রী যতীনকে একবার না-দেখেই তার নিজের বোনের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সীতারামপুরে যাচ্ছে। অবস্থা এবারে বেগতিক দেখে দীর্ঘকাল-প্রশ্রয়দাতা (যতীনের) মাসি তুলনামূলক শক্ত একটি অবস্থান নেন। স্বামী যতীনের প্রতি অবিবেচনার বেলায় মণিকে এটা উল্লেখ করতে দেখা যায় যে সে ‘তিথি বার’ মানে না। অমানবিকতার বেলায় প্রাচীন এবং আধুনিক উভয়বিধ ভাবাদর্শকে ব্যবহারের ইতিহাসজোড়া সব ঘটনার এ-এক অতি ক্ষুদ্র এবং কৌতুককর দৃষ্টান্ত। দৃশ্য এবং সংলাপ এখানে মর্মন্তুদ এবং অত্যন্ত শিক্ষামূলক (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২১) :
“একি বউ, কোথাও যাচ্ছ নাকি।”
“সীতারামপুরে যাব।”
“সে কী কথা। কার সঙ্গে যাবে।”
“অনাথ নিয়ে যাচ্ছে।”
“লক্ষী মা আমার, তুমি যেয়ো, আমি তোমাকে বারণ করব না─ কিন্তু আজ নয়।”
“টিকিট কিনে গাড়ি রিজাভ্র্ করা হয়ে গেছে।”
“তা হোক, ও লোকসান গায়ে সইবে─ তুমি কাল সক্কালেই চলে যেয়ো ─ আজ যেয়ো না।”
“মাসি, আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে, আজ গেলে দোষ কী।”
“যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে।”
“বেশ তো, এখনো সময় আছে ─ আমি তাকে বলে আসছি।”
“না, তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ।”
“তা বেশ, কিছু বলব না, কিন্তু আমি দেরি করতে পারব না। কালই অন্নপ্রাশন ─ আজ যদি না যাই তো চলবে না।”
“আমি জোড়হাত করছি বউ, আমার কথা আজ একদিনের মতো রাখো। আজ একটু মন শান্ত করে যতীনের কাছে এসে বসো ─ তাড়াতাড়ি কোরো না।”
“তা, কী করব বলো, গাড়ি তো আমার জন্যে বসে থাকবে না। অনাথ চলে গেছে ─ দশ মিনিট পরে সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই বেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসি গে।”
একালের মতান্ধ নারীবাদীদের জন্যে এখানে বিবেচনাযোগ্য (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২২) একজন নারীর উদ্দেশে আর এক নারীর ─ মণির উদ্দেশে যতীনের মাসির এ-বক্তব্য : ‘ওরে অভাগিনী, তুই যাকে এত দুঃখ দিলি সে তো সব বিসর্জন দিয়ে আজ বাদে কাল চলে যাবে...’ ইত্যাদি। মণির আচরণের নির্মমতায় ব্যথিত মাসি যতীনের উদ্দেশে এও বলেন, ‘ওরে বাপ রে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ! পাপের যে শেষ নেই─ আমি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলুম না।’ কিন্তু, তা হলে কী হবে, পরক্ষণে দেখা গেল যতীনের মাসি যতীনের ঘরে গিয়ে বিশাল বিস্তৃত মিথ্যেয় ঢেকে দিচ্ছেন মণির অবিবেচনা এবং নির্মমতাকে: ‘কী হয়েছে। মণি এল না? এত দেরি করলে কেন, মাসি।’ যতীনের এসব কথার উত্তরে তার মাসি বললেন, ‘গিয়ে দেখি, সে তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে ব’লে কান্না। আমি বলি, হয়েছে কি, আরো তো দুধ আছে। কিন্তু, অসাবধান হয়ে তোমার খাবার দুধ পুড়িয়ে ফেলেছে, বউয়ের এ লজ্জা আর কিছুতেই যায় না। আমি তাকে অনেক ঠান্ডা ক’রে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছি। আজ আর তাকে আনলুম না। সে একটু ঘুমোক (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২২)।’ এই করুণ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং পরবর্তী সংলাপ নিুরূপ (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২২) :
মণি আসিল না বলিয়া যতীনের বুকের মধ্যে যেমন বাজিল তেমনি সে আরামও পাইল। তাহার মনে আশঙ্কা ছিল যে, পাছে মণি সশরীরে আসিয়া মণির ধ্যানমাধুরীটুকুর প্রতি জুলুম করিয়া যায়। কেননা, তাহার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। দুধ পুড়াইয়া ফেলিয়া মণির কোমল হৃদয় অনুতাপে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহারই রসটুকুতে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিতে লাগিল।
“মাসি।”
“কি বাবা।”
“আমি বেশ জানছি, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু, আমার মনে কোনো খেদ নেই। তুমি আমার জন্যে শোক করো না।”
“না বাবা, আমি শোক করবো না। জীবনেই যে মঙ্গল আর মরণে যে নয় এ কথা আমি মনে করি নে।”
“মাসি তোমাকে সত্য বলছি, মৃত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে।”
“শেষের রাত্রি” ছোটগল্পে এর পরের দৃশ্যেও দেখা যাচ্ছে যতীনের মাসি তাকে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় রেখে মণির তার ভাইয়ের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সীতারামপুরে চলে যাওয়ার ঘটনাটিকে যতীনের কাছ থেকে লুকিয়েই চলেছেন। পুরনো ধরনের কিন্তু বর্ধিত পরিহাস হচ্ছে যে এসব সত্ত্বেও মৃত্যুর পূর্বে প্রস্তুতকৃত উইলে যতীন তার যাবতীয় সম্পদসম্পত্তি এই মণিকেই দিয়ে যাচ্ছে; এমনকি এর একটি অংশের ওপর যতীনের মাসির মালিকানা থাকলেও তিনি যতীনের কাছ থেকে কিছুই পাচ্ছেন না, এবং সে জন্যে তার কোনো অভিযোগও নেই। এতে কি যতীনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার বোধে কোনো পরিবর্তন আসবে? এ কোনো উপেক্ষিত এবং অভিমানী মানুষের আত্ম-অবনমন (self-degradation)? অভিভাবক হিসেবে যাঁকে যতীন অনেক পেয়েছে, বার্ধক্যের ভরসা হিসেবেও উইলে তাঁকে যতীনের কিছুই না-দেওয়ার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? সংসারে অবিচার-অন্যায় কি কোনো একটি দু’টি মানুষের? অন্যায় উপেক্ষার শিকার যে-ব্যক্তি, ঘটনার পরবর্তী স্রোতধারায় সে-ই কি হয়ে উঠছে না শিকারী-অন্যায়কারী, স্বয়ং যতীন? তার মাসির ক্ষেত্রে, তার প্রতি? যতীনের মাসিকে সহায়-সম্পত্তি কিছুই না-দেওয়া এবং তাকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ-সময়ে এ দুটো মানুষ যে ভাববাদী এবং সান্ধ্য ভাষায় বাক্যবিনিময় করে, তা অত্যন্ত লক্ষণীয় (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৩), যেমন─
“আমি মণিকে সব লিখে দিলুম বটে, কিন্তু তোমারই সব রইল মাসি। ওতো তোমাকে কখনো অমান্য করবে না।”
“সেজন্য অত ভাবছ কেন, বাছা।”
“তোমার আশীর্বাদেই আমার সব, তুমি আমার উইল দেখে এমন কথা কোনোদিন মনে কোরো না ─”
“ওকী কথা যতীন। তোমার জিনিস তুমি মণিকে দিয়েছ বলে আমি মনে করব! আমার এমনি পোড়া মন! তোমার জিনিস ওর নামে লিখে দিয়ে যেতে পারছ বলে তোমার যে সুখ সেই তো আমার সকল সুখের বেশি, বাপ।”
যতীনের মণিকে সব সহায়-সম্পত্তি দিয়ে যাওয়াটা যে নানা অর্থে অপাত্রে দান হচ্ছে, তার মাসির সেই পুরনো অবস্থান দেখা যায় তিনি খানিকটা ধরে রেখেছেন, বলছেন, ‘যা তুমি দিয়েছ তাই মাথা পেতে নেবার শক্তি বিধাতা ওকে দিন, এই আশীর্বাদ ওকে করি।’ কিন্তু পরক্ষণেই এও দেখা যায় যে রাশি-রাশি মিথ্যেয় তিনি মণির অনুপস্থিতি-উপেক্ষা-অবহেলাকে আড়াল করছেন, যেমন, এবারে বলছেন, ‘জানিস যতীন? এই শালটা মণির তৈরি, এতদিন রাত জেগে জেগে সে তোমার জন্যে তৈরি করছিল। কাল শেষ করেছে।’ আর সঙ্গে সঙ্গে যতীনের বিশ্বাসপ্রবণতা, প্রেমোচ্ছ্বাস, ইত্যাদি উথলে উঠেছে (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৪)। ─
যতীন শালটা লইয়া দুই হাত দিয়া একটু নাড়াচাড়া করিল। মনে হইল, পশমের কোমলতা যেন মণির মনের জিনিস; সে যে যতীনকে মনে করিয়া রাত জাগিয়া এইটি বুনিয়াছে, তার মনের সেই প্রেমের ভাবনাটি ইহার সঙ্গে গাঁথা পড়িয়াছে। কেবল পশম দিয়া নহে, মণির কোমল আঙুলের স্পর্শ দিয়া ইহা বোনা। তাই মাসি যখন শালটা তাহার পায়ের উপর টানিয়া দিলেন তখন তাহার মনে হইল, মণিই রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া তাহার পদসেবা করিতেছে।
এর পরে যেন দ্রুতই মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে যায়। মণির অনুপস্থিতি তথা প্রস্থান তথা নির্মমতার সত্যটি আকস্মিকভাবে ফেটে পড়ে। যতীনের মাসির কোনো পরিকল্পনাই তাকে রোধ করতে পারে না। যতীন যখন চেপে-ঠেসে অনুরোধ করে, মাসিকে, ‘কেবল তাকে দু’ মিনিটের জন্যে ডেকে দাও’, এবং বলে আরো কিছু মর্মস্পর্শী কথা, মাসি তখন চাকর শম্ভুকে দরজার কাছে রেখে মণিকে ডেকে আনতে যান, বৃথাই, ব্যর্থ-নির্ধারিত। কারণ, সে তো তখন এ-বাড়িতেই নেই। আর এই অবসরেই প্রকাশ পায় এই ভয়ঙ্কর সত্যটি। চাকর শম্ভু না-জেনে, না-বুঝে, তা জানিয়ে দেয়, ‘জানিয়ে দেয় যে মণি তখন থেকে তিনদিন পূর্বে সীতারামপুরে গিয়েছে।’ ‘ক্ষণকালের জন্য যতীনের সর্বাঙ্গ ঝিম্ঝিম্ করিয়া আসিল─ সে চোখে অন্ধকার দেখিল। এতক্ষণ বালিশে ঠেসান দিয়া বসিয়াছিল, শুইয়া পড়িল। পায়ের উপর সেই পশমের শাল ঢাকা ছিল, সেটা পা দিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল।’
এমন একটি সত্য জানার পরও কিছুক্ষণ বাদে বুঝি যতীন শান্ত হতে পারে। তখন তার মাসি কাছে এলে সে তাকে শুধু তার গত রাতের স্বপ্নটির বিবরণ দেয়, এভাবেই শুধু তার ক্ষিপ্ত-ক্ষুব্ধ মনোভাব জানায়, ‘মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্য দরজা ঠেলছিল ─ কোনোমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না, সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই ঢুকতে পারল না। মণি চিরকাল আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। তাকে অনেক ক’রে ডাকলাম, কিন্তু এখানে তার জায়গা হল না।’ যতীনের স্বপ্ন বিবরণটিকে তার মাসিও উদ্দিষ্ট অর্থেই গ্রহণ করলেন। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন যে এতে তিনি ভাবলেন (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৫), ‘যতীনের জন্য মিথ্যা দিয়া যে একটুখানি স্বর্গ রচিতেছিলাম সে আর টিকিল না। দুঃখ যখন আসে তাহাকে স্বীকার করাই ভালো ─ প্রবঞ্চনার দ্বারা বিধাতার মার ঠেকাইবার চেষ্টা করা কিছু নয়।’
“শেষের রাত্রি” ছোটগল্পে এই স্বপ্ন-বিবরণটির উল্লেখ আবারও ঘটে। কিন্তু, তার আগে দেখি যে যতীন আর তার মাসি তখন ‘আর জন্মে’ ছেলে এবং মেয়ে হয়ে জন্মানো নিয়ে বিপরীত কথা যা বলছে তার অর্থ গভীরতর। এই সব পরিচয়ের চেয়ে যে কর্মের পরিচয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তারা বোধ হয় তা-ই বললেন, প্রকারান্তরে। মণির আচরণ এবং ভূমিকার কারণেই বোধ করি সেখানে মাসির আর মেয়ে হয়ে না-জন্মানোর মনোভাব। এরপরে যতীন যে বলে “চিরটা দিন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা যে কী ফাঁকি তা আমি বুঝেছি”, তার ইঙ্গিতও কি মণির নির্মমতার দিকে, আত্মকেন্দ্রিকতার? কারণ, তারই উত্তরে মাসি যতীনকে বলেন, “যাই বল বাছা। তুমি নিজে কিছু নাও নি, পরকেই সব দিয়েছ (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৬)।”
এরপরে ছোটগল্পটির এক বড় পরিসমাপ্তিতে রবীন্দ্রনাথ যতীনের দেখা স্বপ্নের প্রসঙ্গটিকে ফিরিয়ে আনেন। সেও যেন এক স্বপ্নদৃশ্য। মণির নির্মমতার সত্যটি যতীনের কাছে দিবালোকের মতো ধরা পড়েছে দেখা যায়। কিন্তু, তা তার মৃত্যুর প্রাক্কালে। এ সত্য বর্তমান বিশ্বের মণিদের কাছে স্পষ্ট হওয়ার সমস্যা যে থেকে গেল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তথাপি এবং তাই বর্তমান কালে “শেষের রাত্রি”র মতো ছোটগল্প এবং তার লেখক রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিক মতাবস্থান নিয়ে আলাপ-আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। “শেষের রাত্রি”র শেষটুকু নিম্নরূপ (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৭) :
বাবা যতীন, একটু চেয়ে দেখো ─ ঐ সে এসেছে। একবারটি চাও।
কে এসেছে। স্বপ্ন?
স্বপ্ন নয় বাবা, মণি এসেছে-- তোমার শ্বশুর এসেছেন।
তুমি কে।
চিনতে পারছ না বাবা, ঐ তো তোমার মণি।
মণি, সেই দরজাটা কি সব খুলে গিয়েছে।
সব খুলেছে, বাপ আমার, সব খুলেছে।
না মাসি, আমার পায়ের ওপর ও শাল নয়, ও শাল নয়। ও শাল মিথ্যে, ও শাল ফাঁকি।
শাল নয় যতীন। বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে-- ওর মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ কর। ─ অমন করে কাঁদিস্ নে বউ, কাঁদবার সময় আসছে ─ এখন একটুখানি চুপ র্ক।
গ্রন্থপঞ্জি
কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। (২০০৯)। কথা কালান্তরের, প্রগতির, ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।
রবার্ট ব্রাউানং। (১৯৫১)। সিলেক্টেড পোয়েট্রি অব রবার্ট ব্রাউনিং, কেনেথ এল. নিকারব্রুকার (সম্পা.), নিউ ইয়র্ক : মডার্ন লাইব্রেরি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। । (১৯৯৫ক)। “সবলা”, সঞ্চয়িতা, ঢাকা : প্রতীক।
─ (১৯৯৫খ)। গীতবিতান, ঢাকা : প্রতীক ।
─ । (১৯৯৮)। গল্পগুচ্ছ, ঢাকা : প্রতীক।
হেনরিক ইবসেন। (১৯৮৪)। ফোর গ্রেট প্লেজ বাই হেনরিক ইবসেন, লন্ডন : ব্যান্টাম বুকস্
নারী-অধিকার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক প্রচারিত এবং প্রবাদ-প্রতিম উচ্চারণের একটি বক্তব্য হলো : ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার দাও অধিকার (১৯৯৫ক : ৪১৩)।’ এখানে তাঁর অবস্থানে একটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ পরিমিতি আমি লক্ষ করি, যা কারো মর্যাদা-রক্ষার পূর্বশর্ত। কারো হাতে কিছু তুলে দেয়ার মধ্যে, দান করার মধ্যে ওই মর্যাদাটি যে থাকে না, রবীন্দ্রনাথ সে-পরিস্থিতিটি লক্ষ করতে বলেন। অমনভাবে পাওয়া যে প্রকৃত পাওয়া নয়, নয় হয়ে-ওঠা, ক’জন সেটা লক্ষ করেন? চিত্রাঙ্গদা গীতিনৃত্যনাট্যেও চিত্রাঙ্গদার কণ্ঠে একই তাৎপর্যের একটি আহ্বান (১৯৯৫খ : ৪৮৯) :
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
এভাবে এগোতে-এগোতে যা পাওয়া যায়, তা নারী-পুরুষ সকলকেই নির্মোহভাবে দেখার দুর্লভ প্রয়াস, আদর্শায়নমুক্তভাবে দেখা। এবং তারই অংশ হলো সমালোচনামূলক-ভাবে দেখা। আমার ধারণা : পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন এবং উন্নতির পরে এখন সময় হয়েছে রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর অনালোচিত এবং স্বল্প-আলোচিত কিছু মতাবস্থানকে লক্ষ করার ─ নারী-বিষয়ে, নরনারীর সম্পর্ক বিষয়ে। কোথাও এমন কিছু পলকা নেই, যা এতে ভেঙে পড়বে। বরং, পরিস্থিতির উন্নতির পরবর্তী ধাপে পৌঁছনোর জন্যে এ-যাবৎ অলক্ষিত-স্বল্পলক্ষিত ধারণা এবং বক্তব্যে এবারে-এখন যাওয়াটাই জরুরি।
এরূপ আলোচনা শুরুর পক্ষে সাহায্য নেয়া যায় শেষের কবিতা উপন্যাসের অমিত রায়ের বলা বিখ্যাত কিছু কথার। কথাগুলো যে সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কিংবা ঔপন্যাসিকের নয়, তা আমরা মনে রাখব। কিন্তু, কথাগুলোর নিজস্ব মূল্য বা সত্যাসত্যকেও তো লক্ষ না করার কিছু নেই। এ-প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর পক্ষে কথাগুলোর (তথ্যসূত্র: কাজল; ২০০৯ : ১১৪) প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য : ‘যে পক্ষের দখলে শিকল আছে সে শিকল দিয়েই পাখিকে বাঁধে অর্থাৎ জোর দিয়ে। শিকল নেই যার সে বাঁধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে। শিকলওয়ালা বাঁধে বটে, কিন্তু ভোলায় না; আফিমওয়ালী বাঁধে বটে, ভোলায়ও। মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি-শয়তানী তার যোগান দেয়।’
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প “স্ত্রীর পত্র”-কেও নারী-অধিকার-বিষয়ে মেনিফেস্টোর মর্যাদা দিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ করা হয় “পয়লা নম্বর”ও। “স্ত্রীর পত্র” গল্পটি নিয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাইব। এই ‘পত্র’টি একটি তীর্থস্থান থেকে লেখা, পত্রের আকারেই গল্পটি লেখা। এ-গল্পটি নিয়ে কিছু কথা আমি হেনরিক ইবসেনের অ’ ডলস হাউস-বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলেছিলাম। এ গল্পটির পত্রলেখক মৃণাল স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে যায় ─ শ্রীক্ষেত্রের তীর্থে। পত্রে সে তার স্বামীর সংসারে দিনযাপনের অভিজ্ঞতাগুলো বয়ান করে। তার জায়ের বোন বিন্দুকে নিয়েই কথা অনেক বেশি। স্বামীর একান্নবর্তী সংসারে তার নিজের এবং অন্য মেয়েদের দুঃখকষ্টের বিবরণে মৃণালের চিঠিটি পূর্ণ। মৃণালের কাছেই বিন্দু বেশি আশ্রয় এবং সুরক্ষা পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এ-গল্পে সংসারে মেয়েদের দুর্দশা ও লাঞ্ছনার যে সত্য ছবি এঁকেছেন, তা মর্মস্পর্শী। বিন্দুর মতো অসহায় এবং আশ্রিত পরিস্থিতির ছেলে/পুরুষদেরও যে নানা দুর্দশা ঘটে, সেটা আমরা ভুলতে বসি। মৃণালের শ্বশুরবাড়ির লোকজন শেষ পর্যন্ত অসহায় বিন্দুকে বিয়ে দিয়ে তাকে তাদের ঘাড় থেকে নামাতে চাইল। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিন্দু দেখতে পেল যে তার স্বামী পাগল। এ-ব্যাপারে মৃণালকে বিন্দু যা বলেছিল, তা হুবহু উদ্ধৃত করা প্রয়োজন (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫০৪), সংসারের পরিস্থিতিগুলো যে মিশ্র এবং বিরোধপূর্ণ, অন্যথায় তা বোঝা যাবে না। মৃণাল ঠেসে-চেপে প্রশ্ন করলে বিন্দু তার শ্বশুর সম্পর্কে জানালো, ‘...শ্বশুরের এই বিবাহে মত ছিল না কিন্তু তিনি আমার শাশুড়িকে যমের মতো ভয় করেন। তিনি বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন। শাশুড়ি জেদ করে তাঁর ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।’ অত্যন্ত সংক্ষেপে বর্ণিত এই পরিস্থিতিটি কি প্রকৃতপক্ষে ছোট এবং গুরুত্বহীন? উল্লিখিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমি বলেছিলাম যে “স্ত্রীর পত্র” গল্পে এটিও একটি তীর্থযাত্রার-তীর্থবাসের ঘটনা। এটি এরূপ দ্বিতীয় ঘটনা। বিন্দুর শ্বশুর, বিন্দুর ভাষ্য-অনুযায়ীই, স্ত্রীকে ‘যমের মতো ভয় করেন’। এবং পাগল ছেলের বিয়েতে জড়িত থাকতে না-চেয়ে এবং সংশ্লিষ্ট অনেক কিছু এড়াতে ‘বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন।’ শ্রীক্ষেত্রবাসিনী মৃণালের গল্প রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বিন্দুর কাশীবাসী শ্বশুরের গল্প কি কেউ লিখবেন? কোনো মানবতাবাদী, নারীবাদী? রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে দ্বিতীয় তীর্থযাত্রার উল্লেখ নিশ্চয় অসচেতন নয়, কিন্তু তিনি তাকে অত্যন্ত অসম গুরুত্বে উল্লেখ করেছেন। মেয়েদের দুর্দশার পরিস্থিতিগুলো নিয়ে লেখা একটি সাহিত্যিক ধারায় পরিণত হয়েছিল বলেই এই ভারসাম্যহীনতা কি-না, কে বলবে? কোনো অগভীর এবং অন্যায় জনমতকে সমীহ করার মতো মনোভাব বুঝি! প্রসঙ্গক্রমে বলি যে এই জনমতকে কথিতরকম সমীহ করেই বোধ হয় জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিপুল-অধিকাংশ গদ্য লেখা─গল্প, উপন্যাস। অপ্রকাশিত রেখেই প্রয়াত হন। সম্ভাব্য বিরূপ জনপ্রতিক্রিয়ার এই যে পরিস্থিতি, যার মুখে আমরা প্রায় সকলেই অসহায়, জীবনানন্দ দাশ প্রায় সমুদয় গদ্য লেখা অপ্রকাশিত রেখে যান, তা আর কতদিন এভাবে আলোচনা-বিশ্লেষণের বাইরে থাকবে?
“স্ত্রীর পত্র” গল্পে পরবর্তী অনুচ্ছেদে মৃণালের ভাষ্যে বিন্দুর শ্বাশুড়ি সম্পর্কে আরো জানা যায়, ‘শ্বাশুড়ি তার প্রচন্ড, রাগলে জ্ঞান থাকে না। সেও পাগল, কিন্তু পুরো নয় বলেই আরো ভয়ানক।’ ইত্যাদি। এমন শ্বাশুড়ির ভয়ে বিন্দুকে তৃতীয় রাতে তার পাগল স্বামীর ঘরে ঢুকতে হয়েছিল। তারপর স্বামী ঘুমোবার পরে বিন্দু পালিয়ে চলে এসেছিল মৃণালের কাছে। এখন বিবরণ-মতে, ‘পাগল, কিন্তু পুরো নয় বলেই আরো ভয়ানক’ যে-নারী, তার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটানোর কাহিনী শেষ পর্যন্ত কাশীবাসী যে-পুরুষের, তার গল্প কে লিখবেন? সাহিত্যিক এবং তাত্ত্বিক ঝোঁক বলি বা চল বলি, তার মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ থাকবে সমগ্র সাহিত্যচর্চা, বুদ্ধিবাজি? কোনো ভারসাম্যহীনতার পরিণতিই তো কল্যাণকর নয় বলে বলা হয়।
রবীন্দ্রনাথের আর একটি ছোটগল্প, “শেষের রাত্রি” আমাদের আলোচনার পক্ষে আরো প্রাসঙ্গিক। বিস্ময়কর যে এ-গল্পটি নিয়ে কোথাও তেমন কোনো আলোচনা নেই। বর্তমান যে বিশ্ব পরিস্থিতিতে শ্রেণি-প্রশ্নটি অনেক পেছনে চলে গেছে, একে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এবং সে-জন্যেই লিঙ্গ বিষয়টি চাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ─ তাতে অবশ্য এ রকম ঘটাই স্বাভাবিক। লৈঙ্গিক সমতা-ন্যায্যতার যে দাবি নারীবাদীদের, “শেষের রাত্রি” গল্পে উপস্থাপিত পরিস্থিতি এবং ঘটনার আলোচনায় তো সেক্ষেত্রে তাদেরও আগ্রহ থাকতে পারত। তা যে নেই, তাঁরা যে “স্ত্রীর পত্র” কিংবা “পয়লা নম্বর” সম্পর্কে বলেই শেষ করেন, তা-ই প্রমাণ করে যে সমতা-ন্যায্যতা তাঁদেরও সত্য আগ্রহ নয়। তাদের বিপুল-অধিকাংশের প্রকৃত আগ্রহ আত্মমঞ্চায়নে।
“শেষের রাত্রি” গল্পে মৃত্যুপথযাত্রী যতীনের পরিস্থিতি গল্পটি যতটা জানাতে পারে, অন্য কোনোভাবে তা করা কঠিন। মৃত্যুর আগে একবারের জন্যেও কেন সে তার স্ত্রীর দেখা পর্যন্ত পায় না, গল্পে সে-প্রশ্নের তেমন কোনো উত্তর নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে জানাচ্ছেন। স্ত্রী মণির অনাগ্রহ-উপেক্ষা-অবহেলা পাহাড়প্রমাণ। যতীনের মাসির দিক থেকে মণির এই নির্মমতাকে আড়াল করার কিংবা লুকনোর করুণ চেষ্টাগুলো বরং এক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ। সেগুলোই বোধ করি মণির আচরণ যে অকারণ, অগ্রহণযোগ্য, তা জানায়। আরো চোখে পড়ে মণির প্রতি যতীনের নিজের এক অন্ধ অনুরাগ, বুঝি তাকে তার ভালোবাসতেই হবে! মিথ্যেকে সত্য ভাবার এক ঘোর তার! একি কোনো দুরারোগ্য মানসকাঠামো তার, এবং জগৎসংসারের আরো অনেকের? মণির যত অনাগ্রহ, বিকর্ষণ, যতীনের যেন ততই আস্থা, আকর্ষণ! যতীনের এই নির্বিচার ভালোবাসা যে অবকাশ তৈরি করে, মণির মনোভাব এবং আচরণকে তার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তবে সাফাই নয়। কারণ, সুযোগ নেওয়াটা সমতা কিংবা ন্যায্যতার মনোভাব নয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা অনেকেই তা নিই না।
এ-গল্পটির আলোচনায় আরো বলার আছে। রবীন্দ্রনাথ যে শুধু ঘটনার স্তরে থেকেছেন এবং যতীনের একপেশে অনুরাগ সম্পর্কে জানিয়েই যে শেষ করেছেন, তা নয়। গল্পটির একপর্যায়ে যতীন-মণির সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর কিছু মন্তব্য এবং বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তাতে তাদের অমিলের চরিত্রটা বোঝা যায়, দু’জনার প্রকৃতিগত দূরত্ব সম্পর্কেও কিছু মন্তব্য। যা আরো উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে এই দুরতিক্রম্য দূরত্ব নিয়ে মণির পীড়িত-ক্লিষ্ট-ভাবিত হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, আর যতীনের গোটা জীবনজুড়েই যে এই দূরত্বের বেদনা, যন্ত্রণা, গল্পটি তা-ই নিয়ে। দাম্পত্য-সংকটের এক অংশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে পর্যবেক্ষণ “শেষের রাত্রি” গল্পে, আমরা এখন যা উদ্ধৃত করব, বিস্ময়কর যে জীবনানন্দ দাশের অসংখ্য গল্প-উপন্যাসে যেন তারই বিশদতর-বিস্তৃততর বিবরণ। সেখানে নারীর পক্ষ থেকে প্রত্যাহার, উপেক্ষা-অবহেলা আর শীতলতারও বহুলাংশে একই ছবি। জীবনানন্দের লেখা সেসব ছবি তো দেখা যায় না, সওয়া যায় না! যা-ই হোক, আপাতত যতীন-মণির অমিলদীর্ণ দাম্পত্যের যে ধরণ কিংবা প্রকৃতি সে সম্পর্কে জানা যাক (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২১) :
যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালো করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই। দুই যন্ত্র দুই সুরে বাঁধা, এক সঙ্গে আলাপ চলা বড়ো কঠিন। মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে হাসিতেছে, দূর হইতে তাহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে। যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছেÑ সে কেন অমন সামান্য যাহা-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না। পারে না যে তাহাও তো নহে, নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না। কিন্তু, পুরুষের যাহা-তাহা তো মেয়েদের যাহা-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না। বড় কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্যপক্ষ মন দিল কিনা খেয়াল না করিলেই হয়; কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যোগ থাকা চাই। বাঁশি একাই বাজিতে পারে, কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না। এইজন্য কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটো-চারটে টানাবোনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিঁড়িয়া ফাঁক হইয়া গেছে; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে। যতীন বুঝিতে পারিয়াছে; মণি পালাইতে পারিলে বাঁচে; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনো-একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে। কেননা, দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ।
এই বিবরণ-বিশ্লেষণ গল্পে একটি ঘটনা কিংবা কিছুটা সময় সম্পর্কে উপস্থাপিত হলেও, যতীন-মণির সামগ্রিক সম্পর্ক সম্পর্কেও এ কোনো কিছু কম মূল্যবান নয়। এক কিংবা ছোটকে কেন্দ্র করে, উপলক্ষ করে বরং ভিন্ন এবং বৃহৎ বিষয়ে বলা অনেক কথা এগুলো। দাম্পত্য বা সংসারের ব্যাপক/অনেক ক্ষেত্র সম্পর্কে এরা কিছু গভীর সত্যকে ধারণ করে। প্রেম এবং রোমান্টিকতার জীবনদর্শন এখানে প্রশ্ন এবং পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে। এই বিবরণের দু’-একটি পর্যায় আমাকে স্মরণ করিয়েছে অন্য দু’-একটি সাহিত্যকর্মে প্রাপ্ত কিছু পরিস্থিতি সম্পর্কেও। প্রাসঙ্গিক বিধায় এগুলো সম্পর্কেও একটু জানাতে চাই।
“মাই লাস্ট ডাচেস”-খ্যাত রবার্ট ব্রাউনিং-এর একটি প্রায়-বিপরীত উন্মোচনের কবিতা হচ্ছে “এ্যান্ড্রিয়া ডেল সার্টো”। এ্যান্ড্রিয়া নামের এক চিত্রকরের প্রতি তার স্ত্রী লুক্রেজিয়ার শীতলতা এবং প্রবঞ্চনার গল্পটি ব্রাউনিং এখানে লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত ড্রামাটিক মনোলগ রীতিতে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এখানে এ্যান্ড্রিয়া নামের শৈলীসফল চিত্রকর মানুষটির মধ্যেও দেখা যায় লুক্রেজিয়ার প্রতি এক ধরনের নিঃশর্ত তথা ভীরু মুগ্ধতার মনোভাব। যার সম্পূর্ণ সুযোগ লুক্রেজিয়া গ্রহণ করে। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য হলো এখানে কবিতার শুরুতেই দেখা যায় এ্যান্ড্রিয়া-লুক্রেজিয়ার যোগাযোগহীনতা, অন্তঃসারশূন্য সংলাপ কিংবা সে-লক্ষ্যে তাদের কোশেশ (তথ্যসূত্র : রবার্ট; ১৯৫১ : ৩৪৩):
But do not let us quarrel any more,
No, my Lucrezira; bear with me for once :
Sit down and all shall happen as you wish.
You turn your face, but does it bring your heart?
... ... ...
I often am much wearier than you think,
This evening more than usual, and it seems
As if─ forgive now ─ should you let me sit
Here by the window with your hand in mine
And look a half-hour forth on Fiesole,
Both of one mind, as married people use,...
এখানে এ এক ভীরু এবং করুণ আর্তি-- সংযোগ, সম্পর্ক এবং বোঝাপড়ার জন্যে, যা পূরণ হয় না সংশ্লিষ্ট নারীর উপেক্ষা এবং ঔদ্ধত্যের কারণে। একাধিক কবিতায় রবার্ট ব্রাউনিং দাম্পত্য তথা সম্পর্কের এরূপ সংকটকে উপস্থিত করেছেন, এবং এ জন্যে নারী-পুরুষ দু’য়ের দায়িত্বের সত্য এবং সম্ভাবনাকেই নির্দেশ করেছেন এক ব্যতিক্রমী মনস্বিতার সঙ্গে; বিখ্যাত “নারী” কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম (তথ্যসূত্র: কাজল; ২০০৯: ১১৪) যেমন এক দুর্লভ এবং মূল্যবান সমগ্রতায় বিষয়টিকে দেখেছিলেন,
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপতাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককু- বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয় জ্ঞান?
তারে বল, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর শয়তান।
অথবা পাপ যে ─ শয়তান যে ─ নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
ওপরে উদ্ধৃত অংশের শেষ দু’টি লাইন কি এ-যুগে আমাদের, নারীবাদীদের কোনো বিবেচনা পায়?
যোগাযোগ কিংবা সংযোগের প্রশ্নটি প্রকট হয়ে আসে নারী-অধিকার বিষয়ে বহুল-উল্লেখিত নাটক অ’ ডলস্ হাউস-এও। বিস্ময় এবং পরিহাসের হচ্ছে যে-ঘর ছেড়ে নোরা বেরিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই সে এবং হেলমার স্বীকার করে নেয় যে তাদের মধ্যে দীর্ঘ দাম্পত্যের কোনো একদিনও সত্যিকার অর্থে সংলাপ যাকে বলে, তেমন কিছু ঘটেনি। এ-হেন পরিস্থিতি তো ঘরহীন ঘরের কথাই বলে, যা থেকে বেরিয়ে যাওয়া-না-যাওয়াটা সমান (হেনরিক ইবসেন; ১৯৮৪ : ৬২-৬৩):
নোরা : আমাদের বিয়ের আট বছর হয়েছে। তোমাকে কি এটা ভাবাচ্ছে না যে এই প্রথমবার আমরা দু’জন ─ তুমি আর আমি ─ কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছি।
হেলমার : ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলতে কি বোঝাতে চাইছো?
নোরা : এই গোটা আট বছরে ─ তার চেয়ে বেশী সময় হবে ─ আমাদের পরিচয়ের শুরু থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা একটি শব্দও বিনিময় করিনি।
হেলমার : এটা কি সম্ভব ছিল যে আমি অবিরাম এবং সারাক্ষণ তোমাকে তেমন উদ্বেগ সম্পর্কে বলে যাবো যার নিরসনে তুমি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবে না?
নোরা : আমি কাজের বিষয়াদি নিয়ে বলছি না। বলছি যে আমরা কোনোদিন কোনো বিষয়ের মর্মে পৌঁছার জন্যে ঐকান্তিকতা নিয়ে একত্রে বসিনি।
নোরা সংলাপ বা আলোচনার প্রয়োজন সম্পর্কে বলছে দেখছি; এক বৃহত্তর পরিহাস এই যে একটু পরেই দেখা যাবে যে সর্বশেষ এবং একবারের জন্যে বিবেচিত এই সংলাপেরও তোয়াক্কা না-করেই গৃহত্যাগের চূড়ান্ত এবং অনড় সিদ্ধান্ত সে একাই নিয়ে ফেলেছে।
কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মে উপস্থাপিত এও হচ্ছে দাম্পত্যের ছবি। এরই পটভূমিতে দেখা যেতে পারে “শেষের রাত্রি” ছোটগল্পে যতীন-মণির সম্পর্ককে। একটি অর্থপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় যতীনের মাসির কাছ থেকে, লেখক রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে। এ-বিবরণও অবশ্য শুরু হয় যতীনের একটি ভুল বক্তব্য থেকে, মণিকে ইঙ্গিত করে যতীন বলেছে : ‘সেই জন্যেই ওর ছেলেমানুষিতে কোনোদিন কিছু মনে করি নি।’ এর পরেই রয়েছে গল্পের বর্ণনাকারী কিংবা লেখকের ভাষ্য (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫১৯) :
মাসি এ কথার কোনো উত্তর করিলেন না। কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। কতদিন তিনি লক্ষ করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাঁট আসিয়াছে, তবু ঘরে যায় নাই। কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া; একান্ত ইচ্ছা, মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয়। মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাঁধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়োজন করিতেছে। তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে। সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা তিনি জানিতেন। কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন, ‘বাবা, তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়ো না─। ও একটু চাহিতে শিখুক ─ মানুষকে একটু কাঁদানো চাই।’ কিন্তু এ-সব কথা বলিবার নহে, বলিলেও কেহ বোঝে না। যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে। সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে, একথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই পূজা চলিতেছিল, অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আসা পরাভব মানিতেছিল না।
এতো প্রচলিত পতি-দেবতার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি এবং তদ্ভিত্তিক ডিসকোর্স! এখানে রয়েছে ‘নারীদেবতা’র ধারণা, রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে! রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে নারীবাদ-বিরোধী এক তত্ত্ব একে বলা যাবে কি-না, আমার প্রশ্ন সেটাই। কেউ স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন যে যতীনের যে পূজা করে ঊর্ধ্বে-রাখা, রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী নারী চিত্রাঙ্গদা তো তাকেও একইভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে!
যতীনের মাসি অর্থাৎ একজন সংসার-অভিজ্ঞ নারীর দৃষ্টি দিয়ে যতীন-মণির সম্পর্ককে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ─ এতে ওই-গল্পের নানা বিবরণ এবং মন্তব্যের মূল্য বেড়েছে। ওপরে মাসির যে বিবরণ-পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত, গল্পে তারপরও তা এগিয়ে যায়, আর তাতে আসন্নমৃত্যু যতীনের জীবনের করুণ পরিস্থিতি আরও মর্মান্তিক মনে হতে থাকে (রবীন্দ্রনাথ : ১৯৯৮ : ৫১৯) :
মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি। তাই তার উপর রাগ করতে। কিন্তু, মাসি সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতোসমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে যায়। জীবনে কত ভুল করি, কত ভুল বুঝি, তবু তার ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি। কোথা থেকে আমার মনের ভিতরটি আজ এমন আনন্দে ভরে উঠেছে।
মাসি আস্তে আস্তে যতীনের কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার দুই চক্ষু বাহিয়া যে জল পড়িতেছিল তাহা কেহ দেখিতে পাইল না।
রবীন্দ্রনাথের উপস্থাপনায় যতীনের আত্মমর্যাদাবোধই শুধু কম নয়, তার উপলব্ধিগুলোও অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের, ব্যতিক্রমী। মণিকে নিয়ে তার মনে এক অপরিমেয়-অস্বাভাবিক উচ্ছ্বাস, মণির প্রশ্নে সে যে কতো বেশি বাড়িয়ে ভাবতে অভ্যস্ত! মাসি যখন চাইছে, তখনই মণির সম্পর্কে বানোয়াট যে কোনো কিছু বলে অত্যন্ত বিশ্বাসপ্রবণ যতীনকে তা গেলাতে পারছে। গল্পে এর পরে ঠিক এরূপ আরো কিছু কথোপকথন (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২০) :
“কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তোমার আর ঘুম এল না, তাই আজ তোমাকে সকাল-সকাল ঘুমোতে বলছি।”
“মণি কি ঘুমিয়েছে?”
“না, সে তোমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি করে তবে ঘুমোতে যায়।”
“বলো কী মাসি, মণি কি তবে ─”
“সেই তো তোমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে।”
“আমি ভাবতুম, মণি বুঝি ─”
“মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয়। দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয়।”
“আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝোল হয়েছিল তাতে বড়ো সুন্দর একটি তার ছিল। আমি ভাবছিলুম তোমারই হাতের তৈরি।”
“কপাল আমার! মণি কী আমাকে কিছু করতে দেয়। তোমার গামছা তোয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে। জানে যে, কোথাও কিছু নোংরা তুমি দেখতে পার না। তোমার বাইরের বৈঠকখানা যদি একবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্তকে করে রেখে দিয়েছে; আমি যদি তোমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত। ও তো তাই চায়।”
“মণির শরীরটা বুঝি ─”
“ডাক্তাররা বলে, রোগীর ঘরে ওকে সর্বদা আনাগোনা করতে দেওয়া কিছু নয়। ওর মন বড়ো নরম কি না, তোমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে।”
“মাসি, ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী করে।”
“আমাকে ও বড্ড মানে বলেই পারি। তবু বার বার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয় ─ ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে।”
ওপরে উদ্ধৃত কথোপকথনেও যতীন-চরিত্রের কিছু ত্রুটি পাওয়া যাচ্ছে, তা এ-ত্রুটির যে-নামই আমরা দিই না কেন। এ হয়ত দমন-নিপীড়ন-নির্যাতন একবারেই নয়, কিন্তু এও নিশ্চয় ভিন্ন এক ভারসাম্যহীনতা-সৃষ্টির কারণ। মণির মধ্যে যতীনের প্রতি যে-বেপরোয়া উপেক্ষা-অবহেলা, অবিবেচনা-অমর্যাদা, যতীনের প্রশ্রয় এবং প্রশস্তি পেয়েই যে তা তৈরি হয়েছে, এ-কথা আমি বলব না, কিন্তু এ সবের ফলেই যে তার বাড়বাড়ন্ত একটি চেহারা হয়েছে, আমার তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। গল্পের পাঠক নিশ্চয় আরো এক ব্যাপারে একমত হবেন যে যতীনের প্রতি এক অপার মাতৃস্নেহ এবং রক্ষকের মনোভাব থেকে তার মাসি এক্ষেত্রে শুধু তাকে নয়, মণিকেও রক্ষা করতে চলে গিয়েছে। মণির অনেক অবিচার-অন্যায়কে আড়াল করতে দেখা যাচ্ছে মাসিকে, যদিও এক পর্যায়ে দেখা যায় তিনি দাবি করেছেন মণির প্রতি প্রশ্রয় কমানোর পরামর্শ তিনি যতীনকে দিয়েছিলেন। সেটা হয়ত তাঁর যতীনের অসুস্থ হওয়ার পূর্বের ভূমিকা। এখন অসুস্থ যতীনের মনোকষ্ট লাঘবের জন্যে কিন্তু তিনি সত্য গোপন এবং মিথ্যে ভাষণের একশেষ করে চলেছেন। অসুস্থ এবং মৃত্যুপথযাত্রীর ক্ষেত্রে বৈ এ যে এক সর্বনাশা স্নেহে, কে তা না বলবে? সংসারে ন্যায়-অন্যায়ের নিয়ামক কত বহু এবং বিচিত্র শক্তি যে কাজ করে, সৃষ্টিশীল রচনায় অর্থাৎ সাহিত্যকর্মে প্রাপ্ত তার ছবি এবং বিবরণই বরং অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ এবং নির্ভরযোগ্য। মাসির বিভিন্ন এবং জটিল ভূমিকার নিয়ামক হিসেবে যতীনের কাছ থেকে সম্পদ-সম্পত্তি প্রাপ্তির কম-বেশি আকাক্সক্ষাও কাজ করেছে কি-না, “শেষের রাত্রি” নামের একটি ছোটগল্পেও রবীন্দ্রনাথ সে-প্রশ্নটি তুলতে ব্যর্থ হননি। এরূপ বহু জটিল বাস্তবই যে মানুষের আচরণকে দৃষ্ট সব জটিলতা দানে চলে যায়, তাতে সন্দেহ নেই। অসহায়ত্ব এবং নির্ভরশীলতাকে অতিক্রম করে সত্য-ভাষণ সংসারে ক’জন করতে পারে, এসব সত্ত্বেও দৃঢ়তা, প্রতিবাদ, ইত্যাদির শক্তি ক’টি ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে?
গল্পে এর পরের গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটিতে দেখা যাচ্ছে মণি মৃত্যুপথযাত্রী যতীনকে একবার না-দেখেই তার নিজের বোনের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সীতারামপুরে যাচ্ছে। অবস্থা এবারে বেগতিক দেখে দীর্ঘকাল-প্রশ্রয়দাতা (যতীনের) মাসি তুলনামূলক শক্ত একটি অবস্থান নেন। স্বামী যতীনের প্রতি অবিবেচনার বেলায় মণিকে এটা উল্লেখ করতে দেখা যায় যে সে ‘তিথি বার’ মানে না। অমানবিকতার বেলায় প্রাচীন এবং আধুনিক উভয়বিধ ভাবাদর্শকে ব্যবহারের ইতিহাসজোড়া সব ঘটনার এ-এক অতি ক্ষুদ্র এবং কৌতুককর দৃষ্টান্ত। দৃশ্য এবং সংলাপ এখানে মর্মন্তুদ এবং অত্যন্ত শিক্ষামূলক (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২১) :
“একি বউ, কোথাও যাচ্ছ নাকি।”
“সীতারামপুরে যাব।”
“সে কী কথা। কার সঙ্গে যাবে।”
“অনাথ নিয়ে যাচ্ছে।”
“লক্ষী মা আমার, তুমি যেয়ো, আমি তোমাকে বারণ করব না─ কিন্তু আজ নয়।”
“টিকিট কিনে গাড়ি রিজাভ্র্ করা হয়ে গেছে।”
“তা হোক, ও লোকসান গায়ে সইবে─ তুমি কাল সক্কালেই চলে যেয়ো ─ আজ যেয়ো না।”
“মাসি, আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে, আজ গেলে দোষ কী।”
“যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে।”
“বেশ তো, এখনো সময় আছে ─ আমি তাকে বলে আসছি।”
“না, তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ।”
“তা বেশ, কিছু বলব না, কিন্তু আমি দেরি করতে পারব না। কালই অন্নপ্রাশন ─ আজ যদি না যাই তো চলবে না।”
“আমি জোড়হাত করছি বউ, আমার কথা আজ একদিনের মতো রাখো। আজ একটু মন শান্ত করে যতীনের কাছে এসে বসো ─ তাড়াতাড়ি কোরো না।”
“তা, কী করব বলো, গাড়ি তো আমার জন্যে বসে থাকবে না। অনাথ চলে গেছে ─ দশ মিনিট পরে সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই বেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসি গে।”
একালের মতান্ধ নারীবাদীদের জন্যে এখানে বিবেচনাযোগ্য (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২২) একজন নারীর উদ্দেশে আর এক নারীর ─ মণির উদ্দেশে যতীনের মাসির এ-বক্তব্য : ‘ওরে অভাগিনী, তুই যাকে এত দুঃখ দিলি সে তো সব বিসর্জন দিয়ে আজ বাদে কাল চলে যাবে...’ ইত্যাদি। মণির আচরণের নির্মমতায় ব্যথিত মাসি যতীনের উদ্দেশে এও বলেন, ‘ওরে বাপ রে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ! পাপের যে শেষ নেই─ আমি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলুম না।’ কিন্তু, তা হলে কী হবে, পরক্ষণে দেখা গেল যতীনের মাসি যতীনের ঘরে গিয়ে বিশাল বিস্তৃত মিথ্যেয় ঢেকে দিচ্ছেন মণির অবিবেচনা এবং নির্মমতাকে: ‘কী হয়েছে। মণি এল না? এত দেরি করলে কেন, মাসি।’ যতীনের এসব কথার উত্তরে তার মাসি বললেন, ‘গিয়ে দেখি, সে তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে ব’লে কান্না। আমি বলি, হয়েছে কি, আরো তো দুধ আছে। কিন্তু, অসাবধান হয়ে তোমার খাবার দুধ পুড়িয়ে ফেলেছে, বউয়ের এ লজ্জা আর কিছুতেই যায় না। আমি তাকে অনেক ঠান্ডা ক’রে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছি। আজ আর তাকে আনলুম না। সে একটু ঘুমোক (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২২)।’ এই করুণ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং পরবর্তী সংলাপ নিুরূপ (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২২) :
মণি আসিল না বলিয়া যতীনের বুকের মধ্যে যেমন বাজিল তেমনি সে আরামও পাইল। তাহার মনে আশঙ্কা ছিল যে, পাছে মণি সশরীরে আসিয়া মণির ধ্যানমাধুরীটুকুর প্রতি জুলুম করিয়া যায়। কেননা, তাহার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। দুধ পুড়াইয়া ফেলিয়া মণির কোমল হৃদয় অনুতাপে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহারই রসটুকুতে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিতে লাগিল।
“মাসি।”
“কি বাবা।”
“আমি বেশ জানছি, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু, আমার মনে কোনো খেদ নেই। তুমি আমার জন্যে শোক করো না।”
“না বাবা, আমি শোক করবো না। জীবনেই যে মঙ্গল আর মরণে যে নয় এ কথা আমি মনে করি নে।”
“মাসি তোমাকে সত্য বলছি, মৃত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে।”
“শেষের রাত্রি” ছোটগল্পে এর পরের দৃশ্যেও দেখা যাচ্ছে যতীনের মাসি তাকে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় রেখে মণির তার ভাইয়ের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সীতারামপুরে চলে যাওয়ার ঘটনাটিকে যতীনের কাছ থেকে লুকিয়েই চলেছেন। পুরনো ধরনের কিন্তু বর্ধিত পরিহাস হচ্ছে যে এসব সত্ত্বেও মৃত্যুর পূর্বে প্রস্তুতকৃত উইলে যতীন তার যাবতীয় সম্পদসম্পত্তি এই মণিকেই দিয়ে যাচ্ছে; এমনকি এর একটি অংশের ওপর যতীনের মাসির মালিকানা থাকলেও তিনি যতীনের কাছ থেকে কিছুই পাচ্ছেন না, এবং সে জন্যে তার কোনো অভিযোগও নেই। এতে কি যতীনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার বোধে কোনো পরিবর্তন আসবে? এ কোনো উপেক্ষিত এবং অভিমানী মানুষের আত্ম-অবনমন (self-degradation)? অভিভাবক হিসেবে যাঁকে যতীন অনেক পেয়েছে, বার্ধক্যের ভরসা হিসেবেও উইলে তাঁকে যতীনের কিছুই না-দেওয়ার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? সংসারে অবিচার-অন্যায় কি কোনো একটি দু’টি মানুষের? অন্যায় উপেক্ষার শিকার যে-ব্যক্তি, ঘটনার পরবর্তী স্রোতধারায় সে-ই কি হয়ে উঠছে না শিকারী-অন্যায়কারী, স্বয়ং যতীন? তার মাসির ক্ষেত্রে, তার প্রতি? যতীনের মাসিকে সহায়-সম্পত্তি কিছুই না-দেওয়া এবং তাকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ-সময়ে এ দুটো মানুষ যে ভাববাদী এবং সান্ধ্য ভাষায় বাক্যবিনিময় করে, তা অত্যন্ত লক্ষণীয় (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৩), যেমন─
“আমি মণিকে সব লিখে দিলুম বটে, কিন্তু তোমারই সব রইল মাসি। ওতো তোমাকে কখনো অমান্য করবে না।”
“সেজন্য অত ভাবছ কেন, বাছা।”
“তোমার আশীর্বাদেই আমার সব, তুমি আমার উইল দেখে এমন কথা কোনোদিন মনে কোরো না ─”
“ওকী কথা যতীন। তোমার জিনিস তুমি মণিকে দিয়েছ বলে আমি মনে করব! আমার এমনি পোড়া মন! তোমার জিনিস ওর নামে লিখে দিয়ে যেতে পারছ বলে তোমার যে সুখ সেই তো আমার সকল সুখের বেশি, বাপ।”
যতীনের মণিকে সব সহায়-সম্পত্তি দিয়ে যাওয়াটা যে নানা অর্থে অপাত্রে দান হচ্ছে, তার মাসির সেই পুরনো অবস্থান দেখা যায় তিনি খানিকটা ধরে রেখেছেন, বলছেন, ‘যা তুমি দিয়েছ তাই মাথা পেতে নেবার শক্তি বিধাতা ওকে দিন, এই আশীর্বাদ ওকে করি।’ কিন্তু পরক্ষণেই এও দেখা যায় যে রাশি-রাশি মিথ্যেয় তিনি মণির অনুপস্থিতি-উপেক্ষা-অবহেলাকে আড়াল করছেন, যেমন, এবারে বলছেন, ‘জানিস যতীন? এই শালটা মণির তৈরি, এতদিন রাত জেগে জেগে সে তোমার জন্যে তৈরি করছিল। কাল শেষ করেছে।’ আর সঙ্গে সঙ্গে যতীনের বিশ্বাসপ্রবণতা, প্রেমোচ্ছ্বাস, ইত্যাদি উথলে উঠেছে (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৪)। ─
যতীন শালটা লইয়া দুই হাত দিয়া একটু নাড়াচাড়া করিল। মনে হইল, পশমের কোমলতা যেন মণির মনের জিনিস; সে যে যতীনকে মনে করিয়া রাত জাগিয়া এইটি বুনিয়াছে, তার মনের সেই প্রেমের ভাবনাটি ইহার সঙ্গে গাঁথা পড়িয়াছে। কেবল পশম দিয়া নহে, মণির কোমল আঙুলের স্পর্শ দিয়া ইহা বোনা। তাই মাসি যখন শালটা তাহার পায়ের উপর টানিয়া দিলেন তখন তাহার মনে হইল, মণিই রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া তাহার পদসেবা করিতেছে।
এর পরে যেন দ্রুতই মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে যায়। মণির অনুপস্থিতি তথা প্রস্থান তথা নির্মমতার সত্যটি আকস্মিকভাবে ফেটে পড়ে। যতীনের মাসির কোনো পরিকল্পনাই তাকে রোধ করতে পারে না। যতীন যখন চেপে-ঠেসে অনুরোধ করে, মাসিকে, ‘কেবল তাকে দু’ মিনিটের জন্যে ডেকে দাও’, এবং বলে আরো কিছু মর্মস্পর্শী কথা, মাসি তখন চাকর শম্ভুকে দরজার কাছে রেখে মণিকে ডেকে আনতে যান, বৃথাই, ব্যর্থ-নির্ধারিত। কারণ, সে তো তখন এ-বাড়িতেই নেই। আর এই অবসরেই প্রকাশ পায় এই ভয়ঙ্কর সত্যটি। চাকর শম্ভু না-জেনে, না-বুঝে, তা জানিয়ে দেয়, ‘জানিয়ে দেয় যে মণি তখন থেকে তিনদিন পূর্বে সীতারামপুরে গিয়েছে।’ ‘ক্ষণকালের জন্য যতীনের সর্বাঙ্গ ঝিম্ঝিম্ করিয়া আসিল─ সে চোখে অন্ধকার দেখিল। এতক্ষণ বালিশে ঠেসান দিয়া বসিয়াছিল, শুইয়া পড়িল। পায়ের উপর সেই পশমের শাল ঢাকা ছিল, সেটা পা দিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল।’
এমন একটি সত্য জানার পরও কিছুক্ষণ বাদে বুঝি যতীন শান্ত হতে পারে। তখন তার মাসি কাছে এলে সে তাকে শুধু তার গত রাতের স্বপ্নটির বিবরণ দেয়, এভাবেই শুধু তার ক্ষিপ্ত-ক্ষুব্ধ মনোভাব জানায়, ‘মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্য দরজা ঠেলছিল ─ কোনোমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না, সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই ঢুকতে পারল না। মণি চিরকাল আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। তাকে অনেক ক’রে ডাকলাম, কিন্তু এখানে তার জায়গা হল না।’ যতীনের স্বপ্ন বিবরণটিকে তার মাসিও উদ্দিষ্ট অর্থেই গ্রহণ করলেন। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন যে এতে তিনি ভাবলেন (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৫), ‘যতীনের জন্য মিথ্যা দিয়া যে একটুখানি স্বর্গ রচিতেছিলাম সে আর টিকিল না। দুঃখ যখন আসে তাহাকে স্বীকার করাই ভালো ─ প্রবঞ্চনার দ্বারা বিধাতার মার ঠেকাইবার চেষ্টা করা কিছু নয়।’
“শেষের রাত্রি” ছোটগল্পে এই স্বপ্ন-বিবরণটির উল্লেখ আবারও ঘটে। কিন্তু, তার আগে দেখি যে যতীন আর তার মাসি তখন ‘আর জন্মে’ ছেলে এবং মেয়ে হয়ে জন্মানো নিয়ে বিপরীত কথা যা বলছে তার অর্থ গভীরতর। এই সব পরিচয়ের চেয়ে যে কর্মের পরিচয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তারা বোধ হয় তা-ই বললেন, প্রকারান্তরে। মণির আচরণ এবং ভূমিকার কারণেই বোধ করি সেখানে মাসির আর মেয়ে হয়ে না-জন্মানোর মনোভাব। এরপরে যতীন যে বলে “চিরটা দিন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা যে কী ফাঁকি তা আমি বুঝেছি”, তার ইঙ্গিতও কি মণির নির্মমতার দিকে, আত্মকেন্দ্রিকতার? কারণ, তারই উত্তরে মাসি যতীনকে বলেন, “যাই বল বাছা। তুমি নিজে কিছু নাও নি, পরকেই সব দিয়েছ (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৬)।”
এরপরে ছোটগল্পটির এক বড় পরিসমাপ্তিতে রবীন্দ্রনাথ যতীনের দেখা স্বপ্নের প্রসঙ্গটিকে ফিরিয়ে আনেন। সেও যেন এক স্বপ্নদৃশ্য। মণির নির্মমতার সত্যটি যতীনের কাছে দিবালোকের মতো ধরা পড়েছে দেখা যায়। কিন্তু, তা তার মৃত্যুর প্রাক্কালে। এ সত্য বর্তমান বিশ্বের মণিদের কাছে স্পষ্ট হওয়ার সমস্যা যে থেকে গেল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তথাপি এবং তাই বর্তমান কালে “শেষের রাত্রি”র মতো ছোটগল্প এবং তার লেখক রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিক মতাবস্থান নিয়ে আলাপ-আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। “শেষের রাত্রি”র শেষটুকু নিম্নরূপ (রবীন্দ্রনাথ; ১৯৯৮ : ৫২৭) :
বাবা যতীন, একটু চেয়ে দেখো ─ ঐ সে এসেছে। একবারটি চাও।
কে এসেছে। স্বপ্ন?
স্বপ্ন নয় বাবা, মণি এসেছে-- তোমার শ্বশুর এসেছেন।
তুমি কে।
চিনতে পারছ না বাবা, ঐ তো তোমার মণি।
মণি, সেই দরজাটা কি সব খুলে গিয়েছে।
সব খুলেছে, বাপ আমার, সব খুলেছে।
না মাসি, আমার পায়ের ওপর ও শাল নয়, ও শাল নয়। ও শাল মিথ্যে, ও শাল ফাঁকি।
শাল নয় যতীন। বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে-- ওর মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ কর। ─ অমন করে কাঁদিস্ নে বউ, কাঁদবার সময় আসছে ─ এখন একটুখানি চুপ র্ক।
গ্রন্থপঞ্জি
কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। (২০০৯)। কথা কালান্তরের, প্রগতির, ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।
রবার্ট ব্রাউানং। (১৯৫১)। সিলেক্টেড পোয়েট্রি অব রবার্ট ব্রাউনিং, কেনেথ এল. নিকারব্রুকার (সম্পা.), নিউ ইয়র্ক : মডার্ন লাইব্রেরি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। । (১৯৯৫ক)। “সবলা”, সঞ্চয়িতা, ঢাকা : প্রতীক।
─ (১৯৯৫খ)। গীতবিতান, ঢাকা : প্রতীক ।
─ । (১৯৯৮)। গল্পগুচ্ছ, ঢাকা : প্রতীক।
হেনরিক ইবসেন। (১৯৮৪)। ফোর গ্রেট প্লেজ বাই হেনরিক ইবসেন, লন্ডন : ব্যান্টাম বুকস্
0 মন্তব্যসমূহ