বিপাশা চক্রবর্তী
ছোটখাট অথচ পেশীবহুল/পেটানো শরীরের সাথে কেশহীন নির্লিপ্ত মুখ আর নিষ্প্রাণ চোখের মানুষটি ছিলেন ভীষণ অন্তর্মুখী ও নিঃসঙ্গ। ব্যক্তিগত বেয়াড়া একটি জীবনের কুখ্যাতি থাকা স্বত্বেও তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকমের অপ্রকাশ্য ও নিভৃতচারী। কৈশোর যৌবনে স্কুল থেকে যেমন পালিয়েছেন তেমনি পালিয়েছেন কারাগার থেকে। বেশ কয়েকবার। ছিলেন ভ্যাগাবন্ড। জীবনের বেশ ক’বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভবঘুরের মতন কাটিয়েছেন। চুরি, সমকামিতা, বেশ্যাবৃত্তি আর কারাবাস ছিল সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের অংশ। অথচ বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক লেখক ও সমালোচক জ্যাঁ পল সার্ত্রে কি-না তাঁকে বললেন ‘সন্ন্যাসী’!
জাঁ জেনে। নাট্যকার উপন্যাসিক কবি । বিশ শতকের একজন বিপ্লবী শিল্পী। স্বাকীরোক্তিমূলক সাহিত্যের অগ্রদূত। সেই সময়ে ফরাসী নাট্যজগতের মুষ্টিমেয় সৃষ্টিশীল নাট্যকারদের মাঝে অন্যতম জাঁ জেনে। তিনি ব্যতিক্রমী ছিলেন তাঁর ‘মহাকাব্যিক ধ্বংসবাদ’এর জন্য। এর স্বপক্ষে জনমত তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
মাঝে মাঝে মুখোশের আড়ালে তাঁকে মঞ্চে দেখা যেত অভিনেতা হিসেবে। যেন সমাজকে ব্যঙ্গ করতেই মঞ্চে উঠতেন। তিনি নাটকের একজন সত্য বলিয়ে চরিত্র ছিলেন। সে সময়ে আলজেরিয়ায় সঙ্গে ফ্রান্সের আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন তিনি। গণহত্যা আর স্বৈরশাসনের মেঘাচ্ছন্ন দিনগুলিতে তিনি যেন আলোর মশাল হাতে পথের দিশা উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন--মানুষের কি অর্জন করা উচিত, আর কি ত্যাগ করা উচিত।
অথচ তিনি নানা ধরনের অপবাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। কখনো চোর, কখনো সমকামিতা কখনো একজন দালাল হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটেছেন। তখন তিনি ছিলেন জীবন ও শিল্পের এক নিষিদ্ধ দস্যু। কিন্তু তিনি নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে কঠিন এক শরনিন্দার শিল্প তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঠিক যেমন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, ঠিক তেমনি সেই সমাজের এক বিকৃত প্রতিরূপ নির্মাণ করেছিলেন যে সমাজ তাকে নির্মাণ করেছিল। এটা অনেকটা বিস্ময়কর মনে হবে তাদের কাছে যারা তাঁর কর্ম আর জীবন সম্পর্কে এখনো অপরিচিত রয়ে গেছেন। জাঁ জেনে আজও নির্বাসিত বিস্মৃত একজন শিল্পী হিসেবেই আমাদের কাছে ধরা দেন। যদিও বৈচিত্র্যময় নিষ্ঠুরতা ছিল তাঁর চরিত্রে; তা স্বত্বেও হৃদয় থেকেই তিনি নৈতিকতাকে ধারণ করেছিলেন। নিজেকে একজন নীতিবাগীশ হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যে প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায় নি। তাঁর জন্মই কি তাঁকে অপরাধী বানিয়েছে না-কি একজন শিল্পী বানিয়েছে? জেনের জন্ম হয়েছিল প্যারিসে ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ ১৯১০ সালে। ঐতিহাসিকদের মতে, মা ছিলেন সেবিকা অথবা গৃহপরিচারিকা, কারো মতে পতিতা। সাত বছর বয়সে মা জেনে’কে ত্যাগ করেন। এরপর অজ্ঞাত পরিচয়ের কুঁড়িয়ে পাওয়া শিশু হিসেবে তাকে দত্তক নেয় একটি পরিবার। তাদের কাছে কিছুকাল থাকার পর আবার আরেকটি পরিবারের ‘পালিত সন্তান’ হিসেবে জেনে আশ্রয় পায়। এভাবেই জেনের কৈশোর অতিবাহিত হয়। ২১ বছর বয়সে জেনে তাঁর জন্মসনদ থেকে মায়ের নামটি জানতে পারেন ‘গ্যাব্রিয়েল জেনেত’। কিন্তু কোনদিনও বাবার নাম জানতে পারেননি।
কৈশোরে পালক মায়ের পার্স থেকে টাকা চুরি করা দিয়ে অপরাধ জীবন শুরু। তাকে ‘ছোট্ট চোর’ বলে ডাকত সবাই। এই ভূমিকাটাই যেন পরবর্তীকালে জেনের উপর আরোপিত হয়। জেনের নির্মম স্বীকারোক্তি “পরিবার থেকে পরিত্যক্ত হয়ে প্রকৃতির এক শোচনীয় নিয়ম আবিষ্কার করি, চুরির প্রতি পুরুষের প্রেম, এই প্রেমের ফলে একের পর এক চুরি করি। এই চুরি কাজগুলোই আমাকে আবদ্ধ করে ফেলে এক জটিল অপরাধ চক্রে”। আর এভাবেই জন্ম হয় এক ইউরোপীয় যাযাবরের।
কৈশোরের অপরাধপ্রবণতার কারণে জেনে’কে কয়েকবছর কাটাতে হয় সংশোধনাগারে। ওখান থেকে যখন মুক্তি পান তখন বয়স একুশ। যোগদান করেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্র সেনাবাহিনীতে। পরে ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজটি ছেড়ে হয়ে যান ভবঘুরে।পরের দশটি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাযাবরের মতন জীবন কাটান। প্রায়ই অপরাধে জড়িয়ে গেলে তাকে ঐ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হতো, নয়তো নিজেই অন্য কোন স্থানে পালিয়ে যেতেন। নাৎসি জার্মানির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। নাৎসিদের ‘এক চোর জাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি। এবং একজন চোর হিসেবে নিজেকে কখনো বিশেষ কোন কিছু বা আলাদা কেউ মনে হয় নি।
ফ্রান্সে ফিরে আসেন । আবার তাঁর জেল জীবন শুরু হয়। পর পর বেশ কিছু অপরাধ সংগঠনের জন্যই এ কারাবাস বরণ করেন। তবে ব্যাপারটা শাপেবর হয়। কারাগার থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। এখান থেকে প্রথম সাহিত্যকর্ম তিনি সৃষ্টি করেন সেটি ছিল একটি কবিতা। ‘আন্ডার সেনটেনস অফ ডেথ’/ ‘মৃত্যুদন্ডের রায়ের নিচে’ কবিতাটি ছিল স্মৃতিচারণমূলক। সতীর্থ একজন কয়েদীকে কবিতাটি লিখেছিলেন। কয়েদীটিকে আদালত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কবিতাটি ফ্রান্সের সে সময়কার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, কবি, শিল্পী, নাট্যকার জাঁ কক্তো নজরে পড়ে। তিনি বিস্মিত হন একজন চোর ও কয়েদীর সাহিত্যিক ক্ষমতা অনুভব করেন। পরে তিনিই জেনের শিল্পী-জীবনের একজন পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এবং জেনের লেখা প্রকাশে সহযোগিতা করেন।
কারাগারেই জেনে লিখতে থাকেন পেন্সিল দিয়ে বাদামী কাগজে । কিন্তু তাঁর লেখা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। তিনি পুনরায় লিখতে শুরু করেন। এরই মধ্যে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের পঁয়াতারা শুরু করে সরকার। তখন জাঁ কাক্তো, জাঁ পল সার্ত্রে,পাবলো পিকাসো’র মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এর বিরুদ্ধে আপিল করেন। ফলে তৎকালীন ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট সেই রায় বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য হন। জাঁ জেনে মুক্তি পান। এরপর তাঁকে আর কারাগারে ফেরত যেতে হয় নি। কারাগারে থেকেই জেনে রচনা করেছিলেন “আওয়ার লেডি অব দ্য ফ্লাওয়ার” উপন্যাসটি। জাঁ কক্তোর সহযোগিতায় উপন্যাসটি ১৯৪৩ সালে সীমিত সংস্করণে প্রথম প্রকাশিত হয় ফ্রান্সে। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজীতে। উপন্যাসটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে অসাধারন এক শিল্পীস্বত্বার জন্ম হয়। তাই এই উপন্যাসটিকে জাঁ জেনে’র বিস্ময়কর সাহিত্যজীবনের জননী বললে ভুল হবে না।
জাঁ জেনের অসামান্য কাজ হল তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস দি থিফ’স জার্নাল বা চোরের জার্নাল। এই উপন্যাসটির অর্ধেক হল তার নিজের অভিজ্ঞতা আর বাকিটা তার কল্পনা। তিরিশের দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন গোপনে ভবঘুরেদের মতো জীবনযাপন করেছিলেন সে সময়কার আখ্যান। এ সময়ে তিনি ছেড়া শার্ট প্যান্ট পরে ঘুরতেন। অনাহারে কাতর থাকতেন। নিয়মিত ভিক্ষে করতে হত তাকে। আর মিলতো অপমান, অবমাননা, জেল-জরিমানা। সব সময়ই ক্লান্তি আর অবসাদ তাকে ঘিরে থাকত। আর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকত পাপ। স্পেন, ইতালি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, নাৎসি জার্মানি, বেলজিয়াম—যেখানেই তিনি গিয়েছেন সেখানেই তার অভিজ্ঞতা একই রকম। তার থাকার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। পথে পথে ঘুরতেন। বারে ঢুকে পকেটমারি করতে হত। ছিচকে চোর, ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সঙ্গে ছিল ওঠাবসা। নিতেন ড্রাগ। এই উপন্যাসটিতে সিরিজ আকারে বেশ কয়েকটি সমকামী প্রেমের ঘটনা, পুরুষ বেশ্যার আখ্যানের সমাহার। তার আখ্যানে নেই কোনো প্রচলিত হিরো--আছে এন্টি হিরো। তারা কেউ ভয়ঙ্কর অপরাধী, ধোঁকাবাজ, দালাল, ধান্ধাবাজ। গোয়েন্দা চরিত্রও আছে। তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে পুরুষবেশ্যার উপস্থিতি লক্ষনীয়।আদর্শের বিপর্যয়, ভক্তির চূড়ান্ত রূপ বিশ্বাসঘতকতার জয়গান, কর্তব্যে অবহেলা, নির্লজ্জ বীরত্ব এবং কারাবাসের স্বাধীনতা হল এই দি থিফ’স জার্নালের মূল বিষয়। তিনি ঘোষণা করেন—বিশ্বাসঘতকতাই হল আসল সৌন্দর্য। শয়তানের সাধনার মধ্যে দিয়েই আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছানো যায়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে।ঘন সন্নিবদ্ধ লিরিক্যাল গদ্যে লেখা এই উপন্যাসটি পড়েই জাঁ পল সার্ত্রে তাকে নিয়ে সন্যাসী জেনে নামের বইটি লেখেন।
এই উপন্যাসটি জাঁ জেনের আত্ম-আবিষ্কারের একটি অভিযাত্রা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নৈতিকতার প্রতি উপহাসমিশ্রিত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পারভারটেড দার্শনিকতায় ভারাক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন প্রচলিত নৈতিকতাকে। অবক্ষয়ের একটি নান্দনিক কাজ হয়ে উঠেছে জঁ জেনের দি থিফ’স জার্নাল। এ ধরনের বই লেখা হতে পারে এ ধরনের ধারণা সেকালে কারো ছিল না।
সাহিত্য জীবন শুরু হবার পর বিভিন্ন সময় রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত হবার পরেও জেনে রচনা করে গেছেন ব্যতিক্রমী সব সাহিত্যের। প্রথমে তাঁর কর্মজীবন কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলা যায় বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে জন্ম নেয়া কল্পনা। এটা ছিল কিনা সম্পূর্ণরূপে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত। ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে শুরু করেন নাটক রচনা। তাঁর প্রথম রচিত নাটক ‘ডেথওয়াচ’। যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন সমাজের সাধু ব্যক্তিদের আড়ালে আদতে শয়তান লুকিয়ে থাকে। নাটকটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম যে নাটকটি মঞ্চায়ন হয় সেটি ছিল “ দ্য মেইডস’(১৯৪৭)। দুই সহোদরার মৃত্যু, পতিতাপল্লীর ভেতর বাহির ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি কেন্দ্র করে এক নাটকীয় সত্য ঘটনা নিয়ে নির্মিত যুগান্তকারী নাটক। ‘ডেথওয়াচ’ এবং ‘দ্য মেইডস’ তাঁর শিল্পী জীবনে বড় ধরনের সাফল্য ও সম্মান এনে দেয়।এই সাফল্যের ধারা পরবর্তী বছরগুলোতেও অক্ষুণ্ন থাকে। এরপর একে একে তিনি রচনা করেন ‘দ্য ব্যালকোনী’(১৯৫৭) ‘দ্য ব্ল্যাকস’(১৯৫৯) ‘দ্য স্ক্রিনস’(১৯৬৪)এই নাটকগুলো। প্রতিটি নাটকই সফলতার সাথে বহুবার মঞ্চস্থ হয় । এমনকি আমেরিকাসহ সর্বত্র একই সাথে দর্শক প্রিয়তা অর্জন করে ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হয়।প্রতিটি নাটকেই ধর্ম, যৌনতা, রাজনীতি, ও বর্ণবাদের নিকষতম দিকগুলিকে নাটকীয় অথচ বিভ্রম সৃষ্টিকারী উপায়ে তীব্রভাবে সমালোচনা করেন ।মুখোশ আটা সমাজে সভ্যতার নামে ভণ্ডামিকেই তিনি উন্মোচন করেন দর্শকদের সামনে।
পরবর্তীতে ‘দ্য ব্যালকোনী’সহ জেনের কয়েকটি নাটক চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হয়। জেনে নিজেও একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন ১৯৫০ সালে। সেটি ছিল এক সমকামী কয়েদীর গল্প নিয়ে ২৬ মিনিটের সাদাকালো চলচ্চিত্র।
‘আওয়ার লেডি অব ফ্লাওয়ার’ ছাড়াও ‘দ্য মিরাকল অফ দ্য রোজ’ ‘ফানেরাল রাইটস’ ‘দ্য থিফ জার্নাল’ এবং ‘কুইরেল’ ছিল তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের তালিকায়। এসব লেখার মাধ্যমে তিনি ফরাসী সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেন। ভেঙ্গে দেন সাহিত্যকর্মের ইতিহাসে চিরাচরিতরূপকে। প্রতিটি রচনায় সমাজের মনস্তত্ব নিয়ে খেলেছেন জাঁ জেনে।
১৯৫২ সালে বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক লেখক ও সমালোচক জ্যাঁ পল সার্ত্রে জেনেকে নিয়ে প্রকাশ করেন এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ। ‘সন্ত জেনে: অভিনেতা ও শহীদ’ ।
টাইম পত্রিকা এই গ্রন্থ’কে নিয়ে লেখেন “ এযাবতকালে রচিত একজন লেখককে নিয়ে আরেকজন লেখকের এক চমকপ্রদ বিধ্বংসী অধ্যয়ন”।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস সন্ত জেনেকে “এক অসামান্য অর্জন’- বলে আখ্যায়িত করে।
সন্ত জেনে'কে জীবনীগ্রন্থ বা কথাসাহিত্য নয়। বরং বলা যায়, জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁর অস্তিত্ববাদী দর্শনেকেই এক অসাধারণ উপায়ে উপস্থাপন করেছেন জেনের জীবন ও কর্মকে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে। এই বইটির মাধ্যমেই জেনে বৃহত্তর পাঠক সমাজের দৃষ্টি কাড়েন। অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ সেসময় গ্রন্থটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখাও করেন। কেউ কেউ সমালোচনাও করেন।
তা স্বত্বেও, ঐ সময় জীবিত কোন ব্যক্তির জীবনীসংক্রান্ত অবিশ্বাস্য এক সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয় সন্ত জেনে। গ্রন্থটি একই সাথে একজন প্রতিভাবান পণ্ডিত ব্যক্তির ভাবাবেগহীন সমবেদনা আর মানবতার এক বিস্ময়কর আখ্যান। জেনের ঘটনাবহুল জীবনের চিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে যেন বাইবেলের সমালোচনাই করেছেন সার্ত্রে এক শিল্পের উন্নত স্তরে উপনীত হয়ে।
জীবনের শেষ কয়েকবছর প্যারিসের এক ছোট্ট হোটেল রুমে কাটান জাঁ জেনে। পুনরায় যেন নিজেকে নিয়ে যান পেছনে ফেলে আসা কারাবাসের দিনগুলিতে। এসময়টিতে কারো সাথে যোগাযোগ রাখেননি। অনেকটা রহস্যময়ভাবেই যাবতীয় প্রয়োজনীয় সকল কিছুই ছোট্ট একটি সুটকেসে নিয়ে ঐ কক্ষে একা নিভৃতে দিনাতিপাত করেছেন। তাঁর কাছে প্রেরিত চিঠিগুলি আসত প্রকাশনী গালিমার’এর ঠিকানায়। এমনকি পাসপোর্টেও একই ঠিকানা দেয়া ছিল। জেনের প্রকাশকও অনুমতি পেতেন না সাক্ষাতের ।দরকারি কাগজ ও চিঠিপত্রগুলি হোটেল বয় পৌঁছে দিত জেনের রুমে। জানা যায়, জীবনের শেষদিন গুলিতে গলার ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসা চলছিল। কয়েকদফা রেডিয়েশন নিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল প্যারিসের ৭৫ বছর বয়সে ঐ হোটেল রুমেই মারা যান।সবার অল্যক্ষে অতিসঙ্গোপনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান অসাধারন এই শিল্পী স্বত্বা। জাঁ জেনে জীবন ও কর্ম আজও এক বিস্ময়। যে বিরূপ জীবন থেকে তিনি নিজেকে শিল্পের আশ্চর্য শিখরে নিয়ে তা রীতিমতো গবেষণার দাবিদার। তাঁর শিল্পীজীবন আজ অবধি বিরল এক উপাখ্যান হিসেবে রয়ে গেছে সাহিত্যজগতে।
ছোটখাট অথচ পেশীবহুল/পেটানো শরীরের সাথে কেশহীন নির্লিপ্ত মুখ আর নিষ্প্রাণ চোখের মানুষটি ছিলেন ভীষণ অন্তর্মুখী ও নিঃসঙ্গ। ব্যক্তিগত বেয়াড়া একটি জীবনের কুখ্যাতি থাকা স্বত্বেও তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকমের অপ্রকাশ্য ও নিভৃতচারী। কৈশোর যৌবনে স্কুল থেকে যেমন পালিয়েছেন তেমনি পালিয়েছেন কারাগার থেকে। বেশ কয়েকবার। ছিলেন ভ্যাগাবন্ড। জীবনের বেশ ক’বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভবঘুরের মতন কাটিয়েছেন। চুরি, সমকামিতা, বেশ্যাবৃত্তি আর কারাবাস ছিল সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের অংশ। অথচ বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক লেখক ও সমালোচক জ্যাঁ পল সার্ত্রে কি-না তাঁকে বললেন ‘সন্ন্যাসী’!
জাঁ জেনে। নাট্যকার উপন্যাসিক কবি । বিশ শতকের একজন বিপ্লবী শিল্পী। স্বাকীরোক্তিমূলক সাহিত্যের অগ্রদূত। সেই সময়ে ফরাসী নাট্যজগতের মুষ্টিমেয় সৃষ্টিশীল নাট্যকারদের মাঝে অন্যতম জাঁ জেনে। তিনি ব্যতিক্রমী ছিলেন তাঁর ‘মহাকাব্যিক ধ্বংসবাদ’এর জন্য। এর স্বপক্ষে জনমত তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
মাঝে মাঝে মুখোশের আড়ালে তাঁকে মঞ্চে দেখা যেত অভিনেতা হিসেবে। যেন সমাজকে ব্যঙ্গ করতেই মঞ্চে উঠতেন। তিনি নাটকের একজন সত্য বলিয়ে চরিত্র ছিলেন। সে সময়ে আলজেরিয়ায় সঙ্গে ফ্রান্সের আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন তিনি। গণহত্যা আর স্বৈরশাসনের মেঘাচ্ছন্ন দিনগুলিতে তিনি যেন আলোর মশাল হাতে পথের দিশা উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন--মানুষের কি অর্জন করা উচিত, আর কি ত্যাগ করা উচিত।
অথচ তিনি নানা ধরনের অপবাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। কখনো চোর, কখনো সমকামিতা কখনো একজন দালাল হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটেছেন। তখন তিনি ছিলেন জীবন ও শিল্পের এক নিষিদ্ধ দস্যু। কিন্তু তিনি নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে কঠিন এক শরনিন্দার শিল্প তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঠিক যেমন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, ঠিক তেমনি সেই সমাজের এক বিকৃত প্রতিরূপ নির্মাণ করেছিলেন যে সমাজ তাকে নির্মাণ করেছিল। এটা অনেকটা বিস্ময়কর মনে হবে তাদের কাছে যারা তাঁর কর্ম আর জীবন সম্পর্কে এখনো অপরিচিত রয়ে গেছেন। জাঁ জেনে আজও নির্বাসিত বিস্মৃত একজন শিল্পী হিসেবেই আমাদের কাছে ধরা দেন। যদিও বৈচিত্র্যময় নিষ্ঠুরতা ছিল তাঁর চরিত্রে; তা স্বত্বেও হৃদয় থেকেই তিনি নৈতিকতাকে ধারণ করেছিলেন। নিজেকে একজন নীতিবাগীশ হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যে প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায় নি। তাঁর জন্মই কি তাঁকে অপরাধী বানিয়েছে না-কি একজন শিল্পী বানিয়েছে? জেনের জন্ম হয়েছিল প্যারিসে ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ ১৯১০ সালে। ঐতিহাসিকদের মতে, মা ছিলেন সেবিকা অথবা গৃহপরিচারিকা, কারো মতে পতিতা। সাত বছর বয়সে মা জেনে’কে ত্যাগ করেন। এরপর অজ্ঞাত পরিচয়ের কুঁড়িয়ে পাওয়া শিশু হিসেবে তাকে দত্তক নেয় একটি পরিবার। তাদের কাছে কিছুকাল থাকার পর আবার আরেকটি পরিবারের ‘পালিত সন্তান’ হিসেবে জেনে আশ্রয় পায়। এভাবেই জেনের কৈশোর অতিবাহিত হয়। ২১ বছর বয়সে জেনে তাঁর জন্মসনদ থেকে মায়ের নামটি জানতে পারেন ‘গ্যাব্রিয়েল জেনেত’। কিন্তু কোনদিনও বাবার নাম জানতে পারেননি।
কৈশোরে পালক মায়ের পার্স থেকে টাকা চুরি করা দিয়ে অপরাধ জীবন শুরু। তাকে ‘ছোট্ট চোর’ বলে ডাকত সবাই। এই ভূমিকাটাই যেন পরবর্তীকালে জেনের উপর আরোপিত হয়। জেনের নির্মম স্বীকারোক্তি “পরিবার থেকে পরিত্যক্ত হয়ে প্রকৃতির এক শোচনীয় নিয়ম আবিষ্কার করি, চুরির প্রতি পুরুষের প্রেম, এই প্রেমের ফলে একের পর এক চুরি করি। এই চুরি কাজগুলোই আমাকে আবদ্ধ করে ফেলে এক জটিল অপরাধ চক্রে”। আর এভাবেই জন্ম হয় এক ইউরোপীয় যাযাবরের।
কৈশোরের অপরাধপ্রবণতার কারণে জেনে’কে কয়েকবছর কাটাতে হয় সংশোধনাগারে। ওখান থেকে যখন মুক্তি পান তখন বয়স একুশ। যোগদান করেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্র সেনাবাহিনীতে। পরে ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজটি ছেড়ে হয়ে যান ভবঘুরে।পরের দশটি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাযাবরের মতন জীবন কাটান। প্রায়ই অপরাধে জড়িয়ে গেলে তাকে ঐ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হতো, নয়তো নিজেই অন্য কোন স্থানে পালিয়ে যেতেন। নাৎসি জার্মানির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। নাৎসিদের ‘এক চোর জাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি। এবং একজন চোর হিসেবে নিজেকে কখনো বিশেষ কোন কিছু বা আলাদা কেউ মনে হয় নি।
ফ্রান্সে ফিরে আসেন । আবার তাঁর জেল জীবন শুরু হয়। পর পর বেশ কিছু অপরাধ সংগঠনের জন্যই এ কারাবাস বরণ করেন। তবে ব্যাপারটা শাপেবর হয়। কারাগার থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। এখান থেকে প্রথম সাহিত্যকর্ম তিনি সৃষ্টি করেন সেটি ছিল একটি কবিতা। ‘আন্ডার সেনটেনস অফ ডেথ’/ ‘মৃত্যুদন্ডের রায়ের নিচে’ কবিতাটি ছিল স্মৃতিচারণমূলক। সতীর্থ একজন কয়েদীকে কবিতাটি লিখেছিলেন। কয়েদীটিকে আদালত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কবিতাটি ফ্রান্সের সে সময়কার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, কবি, শিল্পী, নাট্যকার জাঁ কক্তো নজরে পড়ে। তিনি বিস্মিত হন একজন চোর ও কয়েদীর সাহিত্যিক ক্ষমতা অনুভব করেন। পরে তিনিই জেনের শিল্পী-জীবনের একজন পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এবং জেনের লেখা প্রকাশে সহযোগিতা করেন।
কারাগারেই জেনে লিখতে থাকেন পেন্সিল দিয়ে বাদামী কাগজে । কিন্তু তাঁর লেখা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। তিনি পুনরায় লিখতে শুরু করেন। এরই মধ্যে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের পঁয়াতারা শুরু করে সরকার। তখন জাঁ কাক্তো, জাঁ পল সার্ত্রে,পাবলো পিকাসো’র মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এর বিরুদ্ধে আপিল করেন। ফলে তৎকালীন ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট সেই রায় বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য হন। জাঁ জেনে মুক্তি পান। এরপর তাঁকে আর কারাগারে ফেরত যেতে হয় নি। কারাগারে থেকেই জেনে রচনা করেছিলেন “আওয়ার লেডি অব দ্য ফ্লাওয়ার” উপন্যাসটি। জাঁ কক্তোর সহযোগিতায় উপন্যাসটি ১৯৪৩ সালে সীমিত সংস্করণে প্রথম প্রকাশিত হয় ফ্রান্সে। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজীতে। উপন্যাসটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে অসাধারন এক শিল্পীস্বত্বার জন্ম হয়। তাই এই উপন্যাসটিকে জাঁ জেনে’র বিস্ময়কর সাহিত্যজীবনের জননী বললে ভুল হবে না।
জাঁ জেনের অসামান্য কাজ হল তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস দি থিফ’স জার্নাল বা চোরের জার্নাল। এই উপন্যাসটির অর্ধেক হল তার নিজের অভিজ্ঞতা আর বাকিটা তার কল্পনা। তিরিশের দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন গোপনে ভবঘুরেদের মতো জীবনযাপন করেছিলেন সে সময়কার আখ্যান। এ সময়ে তিনি ছেড়া শার্ট প্যান্ট পরে ঘুরতেন। অনাহারে কাতর থাকতেন। নিয়মিত ভিক্ষে করতে হত তাকে। আর মিলতো অপমান, অবমাননা, জেল-জরিমানা। সব সময়ই ক্লান্তি আর অবসাদ তাকে ঘিরে থাকত। আর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকত পাপ। স্পেন, ইতালি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, নাৎসি জার্মানি, বেলজিয়াম—যেখানেই তিনি গিয়েছেন সেখানেই তার অভিজ্ঞতা একই রকম। তার থাকার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। পথে পথে ঘুরতেন। বারে ঢুকে পকেটমারি করতে হত। ছিচকে চোর, ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সঙ্গে ছিল ওঠাবসা। নিতেন ড্রাগ। এই উপন্যাসটিতে সিরিজ আকারে বেশ কয়েকটি সমকামী প্রেমের ঘটনা, পুরুষ বেশ্যার আখ্যানের সমাহার। তার আখ্যানে নেই কোনো প্রচলিত হিরো--আছে এন্টি হিরো। তারা কেউ ভয়ঙ্কর অপরাধী, ধোঁকাবাজ, দালাল, ধান্ধাবাজ। গোয়েন্দা চরিত্রও আছে। তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে পুরুষবেশ্যার উপস্থিতি লক্ষনীয়।আদর্শের বিপর্যয়, ভক্তির চূড়ান্ত রূপ বিশ্বাসঘতকতার জয়গান, কর্তব্যে অবহেলা, নির্লজ্জ বীরত্ব এবং কারাবাসের স্বাধীনতা হল এই দি থিফ’স জার্নালের মূল বিষয়। তিনি ঘোষণা করেন—বিশ্বাসঘতকতাই হল আসল সৌন্দর্য। শয়তানের সাধনার মধ্যে দিয়েই আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছানো যায়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে।ঘন সন্নিবদ্ধ লিরিক্যাল গদ্যে লেখা এই উপন্যাসটি পড়েই জাঁ পল সার্ত্রে তাকে নিয়ে সন্যাসী জেনে নামের বইটি লেখেন।
এই উপন্যাসটি জাঁ জেনের আত্ম-আবিষ্কারের একটি অভিযাত্রা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নৈতিকতার প্রতি উপহাসমিশ্রিত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পারভারটেড দার্শনিকতায় ভারাক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন প্রচলিত নৈতিকতাকে। অবক্ষয়ের একটি নান্দনিক কাজ হয়ে উঠেছে জঁ জেনের দি থিফ’স জার্নাল। এ ধরনের বই লেখা হতে পারে এ ধরনের ধারণা সেকালে কারো ছিল না।
সাহিত্য জীবন শুরু হবার পর বিভিন্ন সময় রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত হবার পরেও জেনে রচনা করে গেছেন ব্যতিক্রমী সব সাহিত্যের। প্রথমে তাঁর কর্মজীবন কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলা যায় বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে জন্ম নেয়া কল্পনা। এটা ছিল কিনা সম্পূর্ণরূপে তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত। ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে শুরু করেন নাটক রচনা। তাঁর প্রথম রচিত নাটক ‘ডেথওয়াচ’। যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন সমাজের সাধু ব্যক্তিদের আড়ালে আদতে শয়তান লুকিয়ে থাকে। নাটকটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম যে নাটকটি মঞ্চায়ন হয় সেটি ছিল “ দ্য মেইডস’(১৯৪৭)। দুই সহোদরার মৃত্যু, পতিতাপল্লীর ভেতর বাহির ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি কেন্দ্র করে এক নাটকীয় সত্য ঘটনা নিয়ে নির্মিত যুগান্তকারী নাটক। ‘ডেথওয়াচ’ এবং ‘দ্য মেইডস’ তাঁর শিল্পী জীবনে বড় ধরনের সাফল্য ও সম্মান এনে দেয়।এই সাফল্যের ধারা পরবর্তী বছরগুলোতেও অক্ষুণ্ন থাকে। এরপর একে একে তিনি রচনা করেন ‘দ্য ব্যালকোনী’(১৯৫৭) ‘দ্য ব্ল্যাকস’(১৯৫৯) ‘দ্য স্ক্রিনস’(১৯৬৪)এই নাটকগুলো। প্রতিটি নাটকই সফলতার সাথে বহুবার মঞ্চস্থ হয় । এমনকি আমেরিকাসহ সর্বত্র একই সাথে দর্শক প্রিয়তা অর্জন করে ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হয়।প্রতিটি নাটকেই ধর্ম, যৌনতা, রাজনীতি, ও বর্ণবাদের নিকষতম দিকগুলিকে নাটকীয় অথচ বিভ্রম সৃষ্টিকারী উপায়ে তীব্রভাবে সমালোচনা করেন ।মুখোশ আটা সমাজে সভ্যতার নামে ভণ্ডামিকেই তিনি উন্মোচন করেন দর্শকদের সামনে।
পরবর্তীতে ‘দ্য ব্যালকোনী’সহ জেনের কয়েকটি নাটক চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হয়। জেনে নিজেও একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন ১৯৫০ সালে। সেটি ছিল এক সমকামী কয়েদীর গল্প নিয়ে ২৬ মিনিটের সাদাকালো চলচ্চিত্র।
‘আওয়ার লেডি অব ফ্লাওয়ার’ ছাড়াও ‘দ্য মিরাকল অফ দ্য রোজ’ ‘ফানেরাল রাইটস’ ‘দ্য থিফ জার্নাল’ এবং ‘কুইরেল’ ছিল তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের তালিকায়। এসব লেখার মাধ্যমে তিনি ফরাসী সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেন। ভেঙ্গে দেন সাহিত্যকর্মের ইতিহাসে চিরাচরিতরূপকে। প্রতিটি রচনায় সমাজের মনস্তত্ব নিয়ে খেলেছেন জাঁ জেনে।
১৯৫২ সালে বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক লেখক ও সমালোচক জ্যাঁ পল সার্ত্রে জেনেকে নিয়ে প্রকাশ করেন এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ। ‘সন্ত জেনে: অভিনেতা ও শহীদ’ ।
টাইম পত্রিকা এই গ্রন্থ’কে নিয়ে লেখেন “ এযাবতকালে রচিত একজন লেখককে নিয়ে আরেকজন লেখকের এক চমকপ্রদ বিধ্বংসী অধ্যয়ন”।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস সন্ত জেনেকে “এক অসামান্য অর্জন’- বলে আখ্যায়িত করে।
সন্ত জেনে'কে জীবনীগ্রন্থ বা কথাসাহিত্য নয়। বরং বলা যায়, জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁর অস্তিত্ববাদী দর্শনেকেই এক অসাধারণ উপায়ে উপস্থাপন করেছেন জেনের জীবন ও কর্মকে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে। এই বইটির মাধ্যমেই জেনে বৃহত্তর পাঠক সমাজের দৃষ্টি কাড়েন। অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ সেসময় গ্রন্থটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখাও করেন। কেউ কেউ সমালোচনাও করেন।
তা স্বত্বেও, ঐ সময় জীবিত কোন ব্যক্তির জীবনীসংক্রান্ত অবিশ্বাস্য এক সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয় সন্ত জেনে। গ্রন্থটি একই সাথে একজন প্রতিভাবান পণ্ডিত ব্যক্তির ভাবাবেগহীন সমবেদনা আর মানবতার এক বিস্ময়কর আখ্যান। জেনের ঘটনাবহুল জীবনের চিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে যেন বাইবেলের সমালোচনাই করেছেন সার্ত্রে এক শিল্পের উন্নত স্তরে উপনীত হয়ে।
জীবনের শেষ কয়েকবছর প্যারিসের এক ছোট্ট হোটেল রুমে কাটান জাঁ জেনে। পুনরায় যেন নিজেকে নিয়ে যান পেছনে ফেলে আসা কারাবাসের দিনগুলিতে। এসময়টিতে কারো সাথে যোগাযোগ রাখেননি। অনেকটা রহস্যময়ভাবেই যাবতীয় প্রয়োজনীয় সকল কিছুই ছোট্ট একটি সুটকেসে নিয়ে ঐ কক্ষে একা নিভৃতে দিনাতিপাত করেছেন। তাঁর কাছে প্রেরিত চিঠিগুলি আসত প্রকাশনী গালিমার’এর ঠিকানায়। এমনকি পাসপোর্টেও একই ঠিকানা দেয়া ছিল। জেনের প্রকাশকও অনুমতি পেতেন না সাক্ষাতের ।দরকারি কাগজ ও চিঠিপত্রগুলি হোটেল বয় পৌঁছে দিত জেনের রুমে। জানা যায়, জীবনের শেষদিন গুলিতে গলার ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসা চলছিল। কয়েকদফা রেডিয়েশন নিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল প্যারিসের ৭৫ বছর বয়সে ঐ হোটেল রুমেই মারা যান।সবার অল্যক্ষে অতিসঙ্গোপনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান অসাধারন এই শিল্পী স্বত্বা। জাঁ জেনে জীবন ও কর্ম আজও এক বিস্ময়। যে বিরূপ জীবন থেকে তিনি নিজেকে শিল্পের আশ্চর্য শিখরে নিয়ে তা রীতিমতো গবেষণার দাবিদার। তাঁর শিল্পীজীবন আজ অবধি বিরল এক উপাখ্যান হিসেবে রয়ে গেছে সাহিত্যজগতে।
1 মন্তব্যসমূহ
ভালো লাগল🌿
উত্তরমুছুন