অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের লেখালেখির সালতামামি


গল্পপাঠ :  ২০১৫ সালে কি কি গল্প লিখতে চেয়েছিলেন? 

অর্ক চট্টোপাধ্যায় :  লেখালেখির কি কোনো পরিকল্পনা করেছিলেন? না, সেরকম কোন পরিকল্পনা ছিল না। লেখা হয়। হলে লেখা হয়। কল্পনা থাকলেও তার নির্দিষ্ট প্রকল্প থাকে না আমার লেখায়। লিখতে চেয়েছিলাম নানা ধরণের গল্প।
নানা ফর্ম, নানা রকমের কন্টেন্ট। প্রযুক্তি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের যাপনে যে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার পরিসর যুক্ত হয়েছে সেগুলো নিয়ে গল্প লিখতে চেয়েছিলাম বলতে পারেন। আমি এক্কেবারে ক্ষুদে গল্প বেশি লিখে থাকি। প্রশ্নটা কিছুটা স্বাচ্ছন্দের আর বাকিটা দাবির। উপন্যাস যেটা অনেকদিন ধরে লিখছি, ভেবেছিলাম ২০১৫য় শেষ করতে পারব, পারিনি। এবার ২০১৬। দেখা যাক। 


২. কি কি লিখেছেন? 

মূলত অনুগল্প লিখেছি। নানা প্রিন্ট এবং ওয়েব ম্যাগে। একাধিক জঁর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। গোয়েন্দা, রহস্য, ভূত, ফার্স নানা রকম ফর্ম নিয়েও খেলাধূলা করার চেষ্টা করেছি। সময় যেভাবে এগোয় তার সেই আপতিক চলন ব্যক্তি এবং সমষ্টিগতভাবে লেখাকে যেভাবে ইমপ্যাক্ট করে তার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছি। লেখা ফর্মালি এবং কন্টেন্টের দিক থেকে আরো ডার্ক, আরো পলিটিকাল হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে যখন আর কিছু না হলেও সন্ত্রাস গোলকায়িত হতে পেরেছে তখন যাহা ব্যক্তিগত তাই রাজনৈতিক এমনটা মনে করি। এই গোলকায়িত সময়ের গল্প কেমন হবে, আদৌ আর গল্প হবে কিনা এসব ভেবে লেখায় আনার চেষ্টা করেছি যেমন কালিমাটি অনলাইনে 'মৌল...বাদ আর গল্পের মৃত্যু' কিম্বা অ্যাশট্রের 'রক্তমাংস' সংখ্যায় 'রক্তের ধূলো' গল্প। 'মধ্যবর্তী' পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় 'জোত্স্নায় কারা রাইফেল কাঁধে হাঁটবে' বা 'গল্পপাঠ' এ 'আলো হারানোর দিন' জাতীয় গল্পে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত হারানোর অভিজ্ঞতাগুলিকে পলিটিসাইজ করতে চেয়েছি। বাকিটা পাঠক বলুন।





৩. যা লিখতে চেয়েছিলেন সেগুলো কি লিখতে পেরেছিলেন? 

হ্যা এবং না। যেমন বললাম, লেখা হয়, তার নিজস্ব এক বলনপথ রয়েছে। সে পোষ মানে না। মানুষ হিসেবে আমি হাজার আপোষ করতে পারি, লেখা করবে না, এই বিশ্বাস থেকে আমি লিখি। লিখি যাতে আমি আর আমি না থাকে, তুমি হয়ে যায়, সে হয়ে যায়। এই বহুস্বরিকতা রাজনৈতিক। এই আত্মহননের রাজনীতি ছাড়া লেখা হয় না। লেখাকে তাই লেখকের প্রতিস্ব দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। সে নিজেই নিজের বলয় খুঁজে নিক। কিছু নতুন অভিজ্ঞতা যা নিয়ে লিখতে চাইছিলাম বললাম, হয়ত লিখতে পেরেছি। যেমন অনলাইন পাইরেটেড সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি অনুগল্প লিখেছি। নারীস্বরে লিখতে চেয়েছি, লেখাকে আরো ডায়ালগ-নির্ভর করতে চেয়েছি। 'ইন্ডিয়ারি'র গল্পসংখ্যায় নারী-সংলাপের আধার রয়েছে 'অনির্দেশ পাখি' গল্পে। ৪. যেভাবে লিখতে চেয়েছিলেন সেভাবে কি লেখাগুলো লিখতে পেরেছেন? খানিকটা। আসলে লিখতে চাওয়া পূর্বপরিকল্পনা। লিখতে বসলে সব বদলে যায়। একটা বাক্য, একটা ইমেজ থেকে শুরু হয় লেখা কিন্তু তারপর লেখা কি চাইছে সেটা শুনতে পারাটা বেশি জরুরি। সেটাই করতে চেয়েছি। কিছুটা হয়েছে, সবটা নয়। 'ব্রজী' পত্রিকায় যে মনোলগ লিখেছি তা গল্পে সংলাপের ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতাকে ব্যবহার করতে চেয়েছি। দেশ থেকে দেশান্তরে যাওয়া বিপন্ন রিফিউজিদের নিয়ে যা বলতে চেয়েছি আমি, আর চেয়েছে লেখা, তাতে ডায়ালগ নেই, রয়েছে বিচ্ছিন্নতার মনোলগ, তাই তাকে ফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছি। 


৪. সে লেখাগুলো কি নিয়ে কি আপনি তৃপ্ত? 

তৃপ্ত মানুষ মৃত। লেখাগুলো পাঠকের চোখে পড়বার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি কখনো। পলিটিকাল ইনফরমেশন কিভাবে পৌঁছয় রাজনীতিবিচ্ছিন্ন একাকী মানুষের কাছে, কিভাবে ব্যক্তিগত গল্পগুলো রেজিস্ট করে প্রাইভেসি। এই যাত্রাপথে গল্পের ফর্ম ভাঙতেই হয়, ভেঙেছি। দেঁতো ছেলের মজার গল্পে ঢুকে পড়েছে ইয়াকুব মেমনের প্রাণদন্ড। পলিটিকাল ডিসকোর্স দিয়ে ন্যারেটিভকে বিনির্মাণ করে গেছি। তবে নারীস্বর নিয়ে যেটুকু ভেবেছি তার তুলনায় প্রায় কিছুই করা হয়নি। ওদিকে অনেক পথ বাকি। 


৫. ২০১৬ সালে আপনার লেখালেখির পরিকল্পনা কি? কি কি লিখবেন বলে মনে করছেন? 


উপন্যাস শেষ করবার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু লিখতে লিখতে একটা চোরাবালি তৈরী হয় যা অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি লেখাকেও গ্রাস করে। 'উপন্যস্ত' সেরকম একটা ইমপাসে পৌঁছেছে। দেখা যাক তার থেকে বেরোনো যায় কিনা। এটাই লেখার বীভত্স মজা। অনুগল্প লিখে যেতে চাই। লেখার মধ্যে দিয়ে সময়ের সাংবাদিকতাও। মিতভাষ চলতে থাক। হোক আরো পরীক্ষা। নতুন কিছু লিখতে না পারলে লিখব না। কিন্তু ঐটাই যে মুশকিল। লেখা ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। চতুর্দিকে কত গল্প পড়ে রয়েছে, বলতে চাইছে নিজেদের। মানুষের বাইরে বৃহত্তর প্রাণ-পৃথিবীর গল্প। সেটা খানিক লেখার চেষ্টা করেছি ২০১৫য়, যেমন 'কাঁকড়াকাহিনী' । আরো বেশি করে সেই অ-মানুষদের কাছে যাবার তাগিদ আছে। অবমানুষের গল্প তো অনেক হল। 


৬. কিভাবে লিখবেন? লেখার জন্য আপনি কি ধরনের প্রস্তুতি নেবেন বলে মনে করছেন? 

প্রস্তুতি নিই না সেই অর্থে। গল্পবিশেষে কিছু পড়াশোনা করতে হয়, রেফারেন্স, ইনফরমেশন, ডিটেইল -- এসব ব্যপারে সজাগ থাকতে হয়। এছাড়া আমার লেখার প্রস্তুতি বলতে লেখার সময় যথাসম্ভব অভিনিবেশ। লেখার সময় লেখা ছাড়া বিশ্ব-সংসারে কিছু নেই যেন। প্রতিটা শব্দ যাতে লালিত হয় ভেতর থেকে, সেই চেষ্টা করে যাওয়া, লিখে জোরে জোরে নিজেকে পড়ে শোনাতে থাকা, যাতে ভয়েস তৈরী হয় লেখায়। এইটুকুই। 

৭. আগামী লেখাগুলোর মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন আনার কথা ভাবছেন? কী ধরনের পরিবর্তন আনতে বলে মনে করেন? 


পরিবর্তনকে পরিবর্তন করা, করেই চলা-- লেখালিখি মানেই স্বতত এবং অন্তহীন পরিবর্তন। নির্দিষ্ট করে ভাবিনি। তবে শৈলী, কাহিনীনির্মাণ, বিনির্মাণ, বিষয়, বিষয়ী, বাক্যবিন্যাস, কাঠামো--সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজের লেখাকে ভেঙে ভেঙে, কিছুটা আক্রমণ করে, এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে যাওয়া যায় কিনা তাই দেখব। যখন আর বদলাবার কিছু থাকবে না, লেখাও থাকবে না। কিন্তু বদলের শেষ নেই বলে লেখার আকাশে 'মেঘাংশিক' লেগেই থাকবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো লাগলো। তোমার লেখা তেমন কিছুই পড়া হয় না। নিজস্ব ব্লগে প্রকাশিত এই সব লেখা দেওয়া যায় না? পড়তে আগ্রহ হচ্ছে বেশ।

    উত্তরমুছুন