মা যখন আমাকে নিয়ে গর্ভবতী হয় তখন সে অবিবাহিত ছিল, অপ্রাপ্তবয়স্কও। ধারনা করি- ভালবাসা, তারুণ্য তাড়না ও বয়সের অযৌক্তিকতা, এসব ছাড়া অন্য কোন ব্যাখ্যা এর হতে পারে না। বিশেষত এ সমাজে, যে সমাজে এইসব কিছুর একটা সামাজিক ব্যাখ্যা থাকা দরকার ছিল। পরে জেনেছি, এই যে আমি মায়ের গর্ভে চলে এসেছিলাম এতে খুব ‘জাত’ গিয়েছিল বলে কথা আছে।
জাত যতো না মা-বাবা অথবা দাদা-দাদীর তারচেয়ে বেশী গিয়েছিল পাড়া প্রতিবেশীর। মা’র কাছে জানতে ইচ্ছে করতো জাত যাওয়া বিষয়টিকে সে কী ভাবে দেখে থাকে? হয়তো তার সেই বোধই ছিলনা। অথবা জিনিষটা আমিও বুঝতাম কিনা। কেননা সবার যেখানে মনে হয় যে জাত গেছে আমার কেন উল্টা মনে হচ্ছে? ‘জাত’ সম্পর্কে অজ্ঞানতা আরও ঘনতর হয়। ভাবি কোনও এক সময় মা’র কাছ থেকে জেনে নেবো। জিজ্ঞাস করা আর হয়না।
শুনেছি গর্ভপাত ধারনা ছিল: প্রধান কারণ কন্যা পক্ষের অর্থাৎ মায়ের পরিবারের অভিযোগ, সম্পর্কটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, নাবালেগদের মেলা-মেশা দোষে-দুষ্ট। এছাড়া বরিশাল শহরে তাদের পরিবার অভিজাত হিসাবে খ্যাত। এবং যেহেতু আমার দাদা মহুরি থেকে মোক্তার ও আইনজীবী হয়েছে ফলে এই ধরনের বেখাপ্পা সম্পর্কের নাকি কোন মানে হয়না, যৌক্তিকতাও ছিলনা। কোথায় ভারতের সেরা, কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের বিলাতী শিক্ষকদের হাতে পাশ করা এডভোকেট (নানা) আর কোথায় ফুডা পয়সার মুহুরি পর, আনা-ছটাকের মোক্তার, আবার নাইট কলেজ পাশ করা মফস্বলী আইনজীবী (দাদা)! এইসব যাবতীয় অসম ভিত্তির মূল্যায়নে গর্ভপাতই ছিল একমাত্র পরামর্শ ও পরিকল্পনা।
কিছুদিন আগে ৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তাসকেন্ড ডিক্লারেশনের মাধ্যমে কেবল শেষ হয়েছে। যুদ্ধে ঠকে পাকিস্তান বিজয়ী সেই আলোচনা তখনো ছোট্ট শহরময় ঘিরে থাকে। তারই মধ্যে এই ঘটনা, গর্ভধারণ (পরে জানা গেল তা আমাকে নিয়ে)। তা হোক শহরের সেরা খানদান, জর্ডান রোডের এডভোকেট সাব্দার চৌধুরী’র কন্যা, সেই কন্যা অবশেষে ‘জারউয়া-পোলা” পেটে ধরেছে মর্মে কথা রাষ্ট্র হয়। বিয়ে বিকল্প কথা ওঠে ‘জারজ’ ঠ্যাকাতে কিন্তু- “এই বিবাহ হবেনা, হতে পারেনা” বলে পুরো বরিশাল শহরে শোরগোল লেগে যায়- ‘হবে না’। কিন্তু এডভোকেট কমরেড শাহ আলী আমার দাদু, একদিন শীতের দেরি করা সন্ধ্যা রাতে ব্রাউন কম্পাউন্ডে সাব্দার এডভোকেটের বাড়ীর চেম্বারে গিয়ে ওঠে। গায়ে জরানো নতুন কাশ্মীরি শাল। তখন সব মক্কেলরা চলে গেছে, মোক্তার হরগোবিন্দ অপেক্ষায় আছে কখন সাব্দার চৌধুরী উঠবেন। ঠিক সেসময় মাথার শাল সরিয়ে কমরেড চেম্বারে ঢোকে। হরগোবিন্দ এক সময় কমরেডের মুহুরি কালের কলিগ ছিলেন। ডিসট্রিক্ট কোর্টের কাচারিতে আসন দিয়ে পাশাপাশি বসতেন, টেবিলের বিকল্প জলচৌকি দুটিও একসঙ্গে রাখতেন, পান-সুপারি বিনিময় করতেন, একই সময়ে বিড়ি ধরাতেন, ভাগ করে বিড়ি টানতেন। পরস্পরকে নাম ধরে ডাকতেন। কিন্তু আইনজীবীতে উত্তীর্ণ হলে মোক্তার হরগোবিন্দ আর নাম ধরে ডাকেন না, ‘কমরেড সাহেব’ সম্বোধন করেন। এখন তো নতুন সমস্যা, হোক বৈধ নয়, তারপরও চৌধুরী সাহেবের মেয়ের সংগে কমরেডের ছেলের সম্পর্ক। এরা বেয়াই হলে হতে কতক্ষণ। হরগোবিন্দ তাকে দেখে বললেন, ‘কমরেড সাহেব’। এডভোকেট সাব্দার শীতল হয়ে থাকলেন নিজের চেয়ারে। কমরেড সোজা টেবিলের উলটা দিকে দাঁড়ালেন, শালের বাম দিকটা সরিয়ে দিলে শাল ঝুলে পরল। তখন ডান কাঁধের উপরের বেল্টে ঝোলানো বাম বগলের নীচ আড়াআড়ি ঝুলে থাকা দোনলা বন্দুক দেখা গেল। আসলে বন্ধুকটা দেখানোই হলও। কোন কুশলাদি বিনিময় হলো না। বলল, “চৌধুরী সাহেব, আমার ছেলের হবু বউয়ের সন্তান যদি গর্ভপাত করানো হয় তবে তাকে একটি মার্ডার ধরে নেবো, সেই মার্ডারের নিজেই বিচার করব, অতঃপর নিজে খুনের আসামী হবো”। মেয়ের বাবা প্রস্তুত ছিলেন যেন, টেবিল রাখা চোখ তুলে কমরেডের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিক আছে বিয়ের ব্যবস্থা করেন”।
বাবা-মা দুজনই বরিশাল মিশনারি স্কুল উদয়নের দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী ছিল। আনুষ্ঠানিক বিয়ে হলও। কিন্তু আমি কথিত ‘জারজ’ই রয়ে গেলাম! গোপনে, পেছনে, লোকেরা ওই উচ্চারণ আমার সম্পর্কে করত। এখনো করে।
ছোট সময় হতেই খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গে। তখন একা নিজের সঙ্গে কথা বলি। একা কথা বলায় মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে ভেবে শীতের কাপর পরে বাইরে নির্জন রাস্তায় হাটতে যাই। যতক্ষণে ফিরে আসি সে সময়ের মধ্যে ম’র রুটি বানিয়ে ভাজা শেষ হবে। তখন খুব নতুন রুটি খাওয়ার চলন হয়েছে, ৭৪এর দুর্ভিক্ষের কিছুদিন আগে। বাড়ীর সীমানায় ঢুকতেই রুটি ভাজার গন্ধ পাওয়ার কথা। তা পাই না। রান্নাঘর ঢুকে দেখি ফাঁকা, মা নেই। তার ঘরে যাই, দেখি মা শাড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আছে। অমন ঝুলে থাকা দেখে বলি “এমন ভাবে ওইখানে ফ্যানে ঝুলে রয়েছ কীভাবে মা?”। তখনো মানুষের মৃত্যু, তাও আত্মহত্যা, আবার ফ্যানে ঝুলে গলায় ফাঁস, এসব বুঝি না। দাদী চিৎকার দিয়ে দরজার সামনে এসে বলল “ও বউ এয়া কী করলা, ছ্যামরাডারে একলা থুইয়া এয়া কী করলা”। আত্মহত্যার দিনটি ১৯৭৩ সালের ৮ই ডিসেম্বর।
তার বছর দুয়েক পরে হবে, কেনোনা মনে পরে দাদু এইভাবে বলত, শেখ সাহেবের মাসুম বাচ্চা, আমার নাতির বয়সী, হেই ছ্যামরাডারে তোরা রেহাই দিলি না। সেসময়ে একদিন দেখি রাগান্বিত দাদু ঘরে ঢুঁকে বন্দুকে গুলি ভরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ে অদূরে একটি বাসার সামনে গিয়ে চিৎকার করছে, “রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার, তোর সাহস কত” (পেছনে লোকেরা ওই লোককে রসুল রাজাকার বলত)। লোকটি সামনেই, দিশেহারা। বলি “দাদু, গুল্লি কইরো না কিন্তু, তুমি না এডভোকেট”? সে লোকটির উদ্দেশ্যে ঠিকই গুলি করে, পায়ের কাছে। বলে, “তোর বুকের উপর বা মাথায় গুল্লিটা করলাম না, একটা সুযোগ দিলাম, যদি ফের কোনোদিন আমার এতিম নাতিরে লইয়া কিছু কইছ”। দাদুর একথা শোনার পর বুঝলাম আমাকে রসুল রাজাকার জারজ বলেছে। “ফের যদি ঘটে তয় তুই আর দুনিয়া নাই”। লোকটা দাদুর পায়ে পড়ে “মেয়া ভাই, এইবারের মতন মাফ করেন”। কমরেড শান্ত স্বভাবের সজ্জন বলে পরিচিত। গুলি ছুড়বার মতন রাগে তাকে কল্পনায় করা যায় না। বন্দুকে হাত ছোঁয়ালাম, বললাম- দাদু চলো। আমাকে বুকে ঝাপটে ধরল,এতিম সম্বোধনে ডাকল। বুকের দাপুনি অনুভব করলাম। ভিজে ওঠা চোখ মুছল।
মায়ের নিজ দায়িত্বে এই চলে যাওয়ার কারণ, হয়ত একটা জীবন কল্পনা করেতে পারেনি বাবাকে ছাড়া। হয়তো মনে হতো ছেলের জারজ পরিচিতি তার উপর বাবার অনুপস্থিতি, এই দায় দীর্ঘ বেঁচে থাকা কাল বহন করবার জন্য তার প্রস্তুতি ছিলনা। দায়িত্ব পালনের অক্ষমতা বোধ হয়েছিল নিশ্চয়ই। গমন পথ সে সিলিং ফ্যানে পেয়েছিলো। দাদু জানিয়েছিল মৃত্যু নোট লিখে গেছে। পর্যাপ্ত বড় হলে তা পড়তে দেয়া হবে। আত্মহত্যা করলেও নিজ হাতে বাবার কয়েকটা ছবি বাধিয়ে রেখেছিলো। বাবার সংগে সেই আমার স্মৃতি ও বড় হওয়া। বাবা মারা গিয়েছিল মায়ের মৃত্যুর দু’বছর আগে একই তারিখে। অর্থাৎ মা তার বালিকা বয়সের বালক প্রেমিকের চলে যাওয়ার দিনটিই বেছে নিয়েছিলেন, নিজেরও চলে যাওয়ার দিনে হিসাবে। ৮ই ডিসেম্বর। ‘যশোর রোডের’ পাশে কোথাও। স্থান ঠিক কারোরই জানা নাই। মিলিয়ে দেখেছি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১’এর ঠিক আট দিন আগে। পাঞ্জাব থার্ড ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের কিলার প্লাটুনের সংগে এক সম্মুখ যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের দলিল গ্রন্থে তার মৃত্যুকে ‘শহীদ’ বলা আছে।
মা নোটে কীসব লিখে গিয়েছিল কে জানে। হয়তো দাদু, দাদী জানত। আমি না। পর্যাপ্ত বড় হওয়ার পর সেই নোট একদিন হারিয়ে গেছে। ইচ্ছে করেই হারিয়ে দিয়েছিলাম।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পটা এক চুমুকে পড়লাম। অসাধারণ এক অনুভতি...। অভিনন্দন গল্পকার আনোয়ার শাহাদাত।
উত্তরমুছুন