সেলিনা হোসেনের 'মতিজানের মেয়েরা' গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। গল্পকার 'মতিজানের মেয়েরা' গ্রন্থের গল্পগুলোয় সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা আর নারীর জীবনভাষ্য চিত্রিত করেছেন। নারীর দুঃখকষ্ট, তাদের পাওয়া আর না পাওয়ার আর্তি নানা কৌণিক দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রন্থটির নামের এ গল্পটির আখ্যান গড়ে উঠেছে অনগ্রসর সমাজের মেয়েদের দুঃখ কষ্টের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে মেয়েরা যে কতটা অসহায়, তাদেরকে কত লাঞ্চনার শিকার হতে হয় তার একটি বাস্তব চিত্র আছে, আছে সমাজের অভিশাপ- যৌতুক প্রথার ছবি। এসব লাঞ্চনার মাঝেও মেয়েদের প্রতিবাদী হয়ে ওঠার চিত্রও আছে গল্পটিতে।
গল্পের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের বর্ণনাটা এরকম "মতিজানের শাশুড়ি গুলনূর, তার ছেলে আবুল। ছেলের জন্মের দেড় বছরের মধ্যে বিধবা হয়েছিল, এভাবে বাইশ বছর কেটেছে। স্বামীর ভিটে-জমি যা ছিল বেশ শক্ত হাতে তার দেখাশোনা করে সংসারটা টিকিয়েছে, ছেলেকে বড় করেছে। না, শ্বশুরকুল- না, বাপের কুল কারো কাছে কোনো সাহায্যের জন্যে গিয়ে দাঁড়ায়নি। গাঁয়ের লোকে বলে, বড়ো শুক্ত ম্যায়ামানুষ গো। এই অহংকার আছে গুলনূরের মনে। শক্ত হওয়াটাকে ও গৌরব মনে করে। "
বিরূপ পরিবেশ-পরিস্থিতির মাঝেও মেয়েদের সাবলম্বি হওয়ার এবং শক্তহাতে সবকিছু সামলিয়ে চলার যে চিত্র আছে এই গল্পটিতে- নিঃসন্দেহে তা আমাদেরকে আশান্বিত করে। শোকতাপে ভেঙে না পড়ার যে সক্ষমতা তা সমাজে শক্তি যোগায়। কিন্তু গুলনূরের অর্জন করা এই শক্তি তার ছেলে আবুলকে করে রাখে অকমর্ণ্য, বউয়ের উপর অত্যাচারের খড়গ হয়ে নামে তা।
মতিজান যখন সেই ছেলের বউ হয়ে এ সংসারে আসে তখন সে আশাহত হয়। গল্পের শুরুটাই এই আশাভঙ্গের বর্ণনা দিয়ে। " বিয়ে হলে নতুন সংসারে মেয়েদের একটি অবস্থান নির্ধারণ হয়, সে বাড়ির বউ হয়, বউ হওয়া মানে একটি নতুন জন্ম সুখ দুঃখ অনেক কিছু মিলিয়ে আপন ভুবন-সংসারের কর্তৃত্ব-এমন একটি ধারণা ছিল মতিজানের। কিন্তু এই সংসারে ওর অবস্থানটা যে কোথায় তা ও বুঝতে পারে না। এই সংসারের ওর কি প্রয়োজন সেটাও জানে না। মাথার ওপর আছে শাশুড়ি, সংসার তার, সে সংসারে মতিজান বাড়তি মানুষ। এই বাড়তি মানুষ হওয়ার কষ্ট ওর বুক জুড়ে। শাশুড়ির তীক্ষ্ন বাক্যবাণ বুক পুড়িয়ে খাক্ করে দেয়। তখন মতিজানের হৃদয় থেকে সংসারের সাধ উবে যায়। ও বিধবা হতে চায়।"
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের সমাজে শ্বাশুড়ী-পুত্রবধুর যে-চিরন্তন সংঘাত তা সবকিছু ছেড়ে আসা একটি মেয়ের জীবনকে বিষিয়ে তোলে। প্রতিপদে তাকে লাঞ্চনার স্বীকার হতে হয়। যৌতুকের খোটাটাও আসে শাশুড়ি-ননদের পক্ষ থেকে। সমাজের এই চিত্রটি 'মতিজানের মেয়ে' গল্পটিতে তুলে ধরেছেন সেলিনা হোসেন। বউয়ের উপর শাশুড়ির নির্যাতনের ছবি দেখে আমরা শিউরে উঠি। এ ছবি শহুরে পাঠকের কাছে অতিরঞ্জন মনে হতে পারে কিন্তু এটাই বাস্তবতা। এমন ছবিই পাওয়া যায় অনগ্রসর সমাজের ঘরে ঘরে।
যৌতুক প্রথা কতটা বিষময় করে তোলে নতুন আসা বউয়ের জীবনকে তার একটি বর্ণনা আছে গল্পটিতে-
"গুলনূর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বিহার সুময় তুমহার বাপে কহাছিল আমার আবুলক ঘড়ি দিবে, সাইকেল দিবে। অক্যুনও প্যাঠালে না ক্যানহে?
মতিজান চুপ করে থাকে। তর্জনী দিয়ে থালার বুকে আঁকিবুকি কাটে। বাপের অবস্থা ও জানে, যা আয় তার চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয় সংসারে। কেমন করে ঘড়ি আর সাইকেল কিনবে? কোথা থেকে এতকিছু জোগাড় হবে না জেনেই ওর বাবা এইসব দেয়ার কথা কবুল করেছিল। এখন ? গুলনূর ঝাঁকিয়ে ওঠে, কথা কহাচ্ছো না যে ? মতিজান কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে, হামি কিছু জ্যানি না।
গুলনূর চিৎকার করে ওঠে, জ্যানবে না ক্যানহে? জ্যানতি হবে।"
এ সংসারে মতিজানের বর আবুলের কোন কর্তৃত্ব নেই। সে আছে বাজারের রসুই ঘর আর মদ গাঁজা ভাঙ নিয়ে। বউয়ের উপর তার মায়ের অত্যাচারের প্রতিবাদ করার সাহস তার নেই বরং মায়ের পক্ষ নিয়ে সে মতিজানের উপর অত্যাচার করে। স্বামী-স্ত্রীর চিরন্তন যে প্রেমপ্রীতি ভালবাসার সম্পর্ক তার কোনও ছিটেফোঁটা নেই মতিজানের সংসারে। দৈহিক সম্পর্ক তার কাছে অত্যাচার আর অসহ্য মনে হয়।
বিয়ের কয়েকমাস পরেও মতিজানের যখন সন্তান হয় না তার সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ে মতিজানের উপর। মতিজানের সন্তান হয়। পরপর দুটি মেয়ে সন্তান হলে তার শ্বাশুড়ীর অসহ্য বাক্যবানে দিশেহারা হয়ে ওঠে মতিজান। তার শ্বাশুড়ী যখন বলে -মাইয়া ছাওয়াল বিয়াবার পারব্যা না। যে বউ কেবল মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় তাকে সে সংসারে রাখবে না। ছেলে বাড়ি এলে এই বউকে তালাক দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।
গল্পের এহেন অবস্থার মাঝেও মতিজানের প্রতিবাদী হয়ে ওঠার একটা চিত্র পাওয়া যায় । ও ভাবে, আমিও একটা শক্ত মেয়েমানুষ হব।
শাশুড়ি যখন তার খাওয়া বন্ধ করে দেয় তখন সে ঘরে ঢুকে মতিজান ঠাণ্ডা গলায় বলে, হামি ভাত খ্যামো। হামার ভুক ল্যাগেছে।
গুলনূর বলে, ভাত ন্যাই।
মতিজান চেঁচিয়ে ওঠে, ক্যানহে?
গুলনূর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হাত উল্টে বলে, ভাত দ্যামো না। ঘাস দ্যামো।
হামি তো এই বাড়ির কামের মানুষ। কাম কর্যা ভাত খ্যাই। বস্যা বস্যা ভাত খ্যাই না। হামাক ভাত দেয়্যা ল্যাগবি। মানষে কামের মানুষক ভাত দ্যায় না ?
গল্পের শেষে আবুলের সন্তান উৎপাদনের অক্ষমতার কথা সবার সামনে বলে দেয় মতিজান। মূলত এটিও তার একটি প্রতিবাদের ভাষা। গল্পের শেষে পাঠকের জন্য এটি নতুন তথ্য হলেও সেলিনা হোসেন তার বীজ বপন করেছিলেন গল্পের মাঝামাঝি। যে-কারণে এটিকে অস্বাভাবিক মনে হয়নি।
গুলনূর চেঁচিয়ে বলে, আজ থিকা হামার সংসারে তুমহার ভাত ন্যাই। হামি হামার ছাওয়ালোক আবার বিয়া করমো। হামার বংশে বাত্তি লাগবে।
সবাইকে সচকিত করে দিয়ে খি খি করে হেসে ওঠে মতিজান। বলে, বংশে বাত্তি ? আপনের ছাওয়ালের আশায় থ্যাকলে হামি এই দুডাও পেতাম না।
– কি কহালা ?
গ্রামের শক্ত মেয়েমানুষ গুলনূর বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মতিজানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন।
দু’হাতে দু’মেয়েকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রেখেছে মতিজান। মায়ের বুকের ভেতর থেকে জ্বলজ্বলে চোখে সবার দিকে তাকায় মতিজানের মেয়েরা।
সেলিনা হোসেন 'মতিজানের মেয়েরা' গল্পে নারীর জীবনভাষ্য চিত্রিত করেছেন। নারীর দুঃখকষ্ট, তাদের পাওয়া আর না পাওয়ার আর্তি নানা কৌণিক দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এ গল্প শুধু বেদনার কথকতাই নয় বরং সমাজিক অবক্ষয়ের ভিতর থেকে আমাদের মনকে নাড়া দেয়।
0 মন্তব্যসমূহ