ধীমান দাশগুপ্ত
----------------------------------------------------------------------------
১৯৮২
----------------------------------------------------------------------------
(জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর সঙ্গে পরিচয় ও হৃদ্যতা ছিল বার বছরেরও বেশি সময় ধরে। তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার নিই ১৯৭১-এর জুলাই মাসে, শেষ ফর্মাল সাক্ষাৎকার নিই ১৯৮২-র গোড়ায়। এ ছাড়াও মধ্যবর্তী সময়ে বহুবার সাধারণভাবে সাহিত্য নিয়ে ও বিশেষ করে তাঁর সাহিত্য নিয়ে অজস্র আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এই সমস্ত সাক্ষাৎকার ও আলাপ-আলোচনা থেকে প্রশ্ন ও উত্তর সংগ্রহ করে সাক্ষাৎকারটি সাজানো।)
----------------------------------------------------------------------------
ধীমান দাশগুপ্ত
সাহিত্যমঞ্চে আপনার প্রবেশের পর বছর পঁয়তাল্লিশ কেটে গেছে। এই সময়টা চিন্তা করলে আপনার কী মনে হয়?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
মনে হয় খুব বেশি দিন আমি সাহিত্যচর্চা করছি না। পূর্বসূরিদের সাহিত্যে যথাযথ তৃপ্তি আমি পাই নি, যেন আরো কী দেবার রয়ে গেছে। তা দিতে হবে আমাদের, তাই আমার সাহিত্য মঞ্চে প্রবেশ। তারপর তো কত বছর কেটে গেল। যতটা ক্ষমতা ছিল সেই অনুযায়ী স্বীকৃতি বোধ হয় আজও পাই নি। তাতে অবশ্য আমার কোন আফসোস নেই। যা দিয়ে গেছি বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছুকাল তার স্থান অক্ষুণ্ন থাকবে, এতেই আমার সান্ত্বনা।
ধীমান দাশগুপ্ত
আপনার গল্প ও উপন্যাস পড়ে মনে হয় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নিয়ে লিখতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
হ্যাঁ, মধ্যবিত্তদের প্রতি আমার একটা স্বাভাবিক আগ্রহ আছে। আর তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে উচ্চবিত্তদের নিয়ে যারা লেখেন, তাদের সৃষ্টি করা চরিত্রগুলো তো মানসিকতার বিচারে ঐ মধ্যবিত্তই।
ধীমান দাশগুপ্ত
সাহিত্যে আমার মনে হয় দ্রষ্ঠার ভূমিকাতেই আপনার বেশি উৎসাহ। কিন্তু ‘খাল পোল ও টিনের ঘরের চিত্রকর’, ‘রাবনবধ’, ‘তারিনীর বাড়ি বদল’-য়ে একটা চাপা দর্শনবোধের পরিচয় স্পষ্ট। এটা কি ইচ্ছাকৃত?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
ঠিকই বলেছ, ভূমিকা মূলতঃ দ্রষ্ঠার। যেগুলোর নাম করলে সেগুলো ছাড়াও ‘বনের রাজা’, ‘সেই ভদ্রলোক’-য়ে অবশ্য আমার ভূমিকা দার্শনিকের। পরিশ্রম করে লিখি আমি, সেখানে যেমনটি সার্থকতম মনে হয় সেই ভূমিকাই নিই।
ধীমান দাশগুপ্ত
আপনার লেখার কোন্ গুণটা আপনার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
আলাদাভাবে কোনটাই নয়।
ধীমান দাশগুপ্ত
আমার ধারণা সংলাপ, পরিবেশ ও মানসিকতার ডিটেলের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর আর মনোবিশ্লেষণে গভীর আগ্রহ আপনার সাহিত্যের দুটি প্রাথমিক গুণ।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
তা বলতে পার। ক্রমপরিণতির দিকে আমার একটা স্বাভাবিক ঝোঁক রয়েছে। দুম করে কিছু বলে ফেলায় আমার মন ওঠে না। আমার মনে হয় এমনটি হওয়া উচিৎ, সুতরাং ধীরে ধীরে বিশ্লেষণ করে দেখাই কীভাবে অমনটি হল। ওই যে বলেছি, ক্রমপরিণতির দিকে ঝোঁক। চলতে চলতে বা বসে বসে এই বিশ্লেষণের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকা আমার ধাতে নেই, লিখতে গিয়ে সহজভাবেই ওটা হয়ে যায়। আমার ৯৮% লেখার শেষ আমি জানতাম না।
ধীমান দাশগুপ্ত
মনস্তত্বের কথায় বলা যায়, আপনার লেখায় নির্জনতা ও প্রকৃতির একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে। প্রেম ও যৌনতা আপনার সাহিত্যে অনেক সময়ে এই নিঃসঙ্গতাবোধ ও প্রকৃতি থেকেই জন্ম নেয়। প্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতির এই সম্পর্কের ধারণাটা কতদূর সত্যি বলে মনে হয়?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
হ্যাঁ, এটা ঠিক। আমার ‘চাওয়া’ গল্পেও তো তাই হয়েছে, যেমন ‘প্রেমের চেয়ে বড়’তে। শাশ্বত কিছু আর কী! যেমন ধরো না, সাধারণতঃ রাত্রিতেই যে লিখি আমি--সেই নির্জনতা, স্তব্ধতা, তার প্রভাব তো অস্বীকার করা যায় না।
ধীমান দাশগুপ্ত
বাংলা একটা পরিভাষা প্রথমে বীতশোক ভট্টাচার্য আপনার লেখা সম্পর্কে ব্যবহার করেন, এখন আমিও করছি, তা হল : দ্বিধাসমতা--unity because of contrast of diversity, যেমন উইট ও সিনিসিজম, প্যাশন ও নিরাসক্তি, মানিকের বিজ্ঞানবোধ ও বিভূতির সৌন্দর্যচেতনা... আপনার লেখায় এগুলো এসে মিলেছে। এই দ্বিধাসমতা আপনার বিষয়বস্তু নির্বাচনে কাজ করে। যেমন কামনার কাছে অসহায় মানুষের গল্প ‘ মঙ্গলগ্রহ’, মানুষের কামনা-প্রবৃত্তির বিপরীতে নিবৃত্তি নিয়ে ‘সামনে চামেলি।’ ‘ছিদ্র’-য়ের অসুস্থ মানস ‘সোনার চাঁদ’-য়ে এসে সুস্থতার প্রতিভাত : ‘অসুখ হয়েছিল সেরে গেছি।’ ‘হিংসা’-য়ে অপ্রত্যাশিত হত্যা, ‘বুনো ওল’-য়ে সম্ভাব্য হত্যা থেকে সরে আসা। ‘ছিদ্র’-য়ে চরম অভাবে স্বামী স্ত্রী আত্মহত্যা করে মরে গেল, ‘ক্ষুধা’-য় চূড়ান্ত প্রাচুর্য স্ত্রীর হাত দিয়ে স্বামীকে মেরে গেল। এর কোনটিই আকস্মিক নয়, জীবনের প্রতি আপনার প্রেম অপ্রেম, নারী প্রকৃতি, সময় স্মৃতি, আলো অন্ধকারের দ্বন্দ্ব সন্ধি ও সমাসের একটা মোচড় দেওয়া, বাঁকিয়ে ধরা ভঙ্গিই আপনার শিল্পকৌশল। আমার প্রশ্ন হচ্ছে--এই দ্বিধাসমতা আপনার সাহিত্যকে উপদানগতভাবে কতটা নিয়ন্ত্রণ করে?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
পরিবেশ যতটা টেনে আনে। ইচ্ছে করে এটা করব ওটা করব না এরকম মন নিয়ে আমি লিখি না। যেমন ধরো ‘শ্বেতপায়রা’, গল্পটা আমি যে মন নিয়ে লিখেছি ‘বাবার চোখ’ ঠিক সেই মন নিয়ে তো আর লিখি নি। ‘সেই ভদ্রলোক’ বলে যে গল্প লিখেছিলাম সেই বছরই ‘জীবন’ গল্প লিখেছি। দেখলাম যে সেই ধরনের গল্প আমাকে টানছে। ‘সেই ভদ্রলোক’-এর মত গল্পটা যাতে না হয় সেই উদ্দেশ্যে আমি গল্পে হাত দিই নি। আমি ভেবেছি ওই ধরনের একটা গল্প লেখার ইচ্ছে এসেছে আমার ব্রেনে, আমার বুদ্ধিতে, আমার বোধে, ঠিক পরের গল্পই হয়তো হয়ে গেল ‘ডলি মলি বসন্তকাল ও টি মজুমদার’, আমার রুচি বিভিন্ন দিক চায়। আমার মেজাজ বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার জন্য আঁকুপাকু করে। কখন কোন্টা লিখি ঠিক নেই। এবং সে সম্পর্কে আমি সচেতন নই।
ধীমান দাশগুপ্ত
আপনি নিজেই একবার বলেছিলেন, কী লিখব তা যেমন ভাবি, তেমনি কীভাবে লিখব তাও আমাকে ভাবতে হয়। এখানে আপনার আঙ্গিক সচেতনতার প্রমাণ। আবার আপনি যখন বলেন, আঙ্গিক হবে নিঃশ্বাসের বাতাসের মত তখন বোঝা যায় আঙ্গিকসর্বস্বতায় আপনার বিশ্বাস নেই। ফলে আপনি সুষম আঙ্গিক যা বিষয়ের সঙ্গে যায় এবং বিষয়ের জন্যই যে আঙ্গিক আসা উচিত সেই আঙ্গিকে বিশ্বাস রাখছেন। সাধারণভাবে আপনার সাহিত্যে আঙ্গিকের সংজ্ঞা ও ধারণা বলতে কী বোঝেন সে সম্পর্কে বলুন।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
সেটা বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তাও সেটা সরাসরি বলা যায় আমি আঙ্গিকগত খুঁটিনাটির মাধ্যমে বলার কথা ভাবি। এ ব্যাপারে আসল হচ্ছে গল্পের এ্যাপ্রোচ। কীভাবে গল্পটা আরম্ভ করব এবং তার সারা অঙ্গ কীরকম হবে, সেখাবে বর্ণনা বেশি থাকবে না সংলাপ বেশি থাকবে সে সম্পর্কে আমাকে সতর্ক থাকতে হয়। এবং প্রত্যেকটারই দরকার। ধর ‘ছিদ্র’ গল্পে সংলাপ বেশি, সেখানে বর্ণনার দরকার হয় না, ওটা আপনা থেকেই এসে যায়। কিন্তু ‘সামনে চামেলি’ গল্পে বর্ণনার দরকার হয়ে পড়েছে। সে জন্য গল্পের সিচুয়েশন বুঝে, থিম বুঝে, চরিত্র সমঝে আঙ্গিক বাছতে হয়। এবং গল্পটা চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। তারপর কোথায় শেষ করব আমি সেটাকে আঙ্গিকের মধ্যেই ধরি, তার কারণ সেটা আঙ্গিকের একটা প্রধান অঙ্গ, সেটাকে আমি অত্যন্ত গুরুত্ব দিই। পাঠকের হাতের মুঠোয় যাতে গল্প না চলে যায়, আবার কম্যুনিকেশন হবে না পাঠকের সঙ্গে তাও যেন না হয়, মোটামুটি একটা ইঙ্গিত যাতে থাকে এবং সেটা উইটি হওয়া চাই, এটা আমার লক্ষ্য। ব্যাপারটা যেমন একটা ম্যাজিক খেলা, কোথায় গিয়ে শেষ করব পাঠক সেটা বুঝবে না, সে জন্য পাঠক তৈরিও থাকবে না। সেটা যে একটা বিস্ময় একটা চমক তাও নয়। একটা মাত্রাবোধে, একটা ছন্দে, সমে এসে থেমে যাওয়া, তারপর যদি একটা শব্দ ব্যবহার করা হয়, মনে হয় যে আঙ্গিকটা নষ্ট হয়ে গেল, আমি আঙ্গিককে এতটা গুরুত্ব দিই।
ধীমান দাশগুপ্ত
তাহলে আঙ্গিক প্রসঙ্গে জরুরি হয়ে পড়ে ভাষারীতির কথা। ভাষাকে আমরা শব্দপ্রয়োগ, বাক্যগঠন, বাক্যসমূহকে সাজানো--এইভাবে ভাগ করে নিতে পারব--
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
আমার কথা হচ্ছে শব্দ বসাবার ব্যাপারে যাতে যতটা সম্ভব হ্যাক্নিড্ শব্দ বাদ থাকবে। খুব একটা পেরেন্টিজম থাকবে না। খুব কমন, খুব ফ্রি শব্দ যদি এসে যায়, আমি ফ্রি শব্দই দেব। আমি অনেককে দেখেছি গল্প লেখার সময় বিশেষভাবে সচেতন হয়ে যাচ্ছে। এমন শব্দ বসিয়ে দিল যেটা ভাবনার সঙ্গে মেলে না। আমি এ ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন। একটা গেরস্থ মেয়ের চিন্তাধারায় আমি কোন সফিস্টিকেটেড শব্দ করব না। ওই পরিস্থিতি শব্দ টেনে আনবে। আমার নিজের ইচ্ছে কোন ইচ্ছে থাকবে না। সেখানে আমি পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্থন করব।
ধীমান দাশগুপ্ত
ভাষারীতির পর্যালোচনা করলে মোটিমুটিভাবে আমরা দুটো ধরন দেখি--অনেকে সমগ্র ভাষা তৈরির ক্ষেত্রে ভীষণভাবে কলাকৌশল সচেতন। আবার অনেকে ভাষার কলাকৌশলগত দিক ছাড়াও ভাষার আবেগগত, নান্দনিক দিকটার কথাও বিশেষ মনে রাখছেন, যেমন হেমিংওয়ে একবার বলেছিলেন, Sometimes I make some technical deficiency in order to make it emotionally more valid. আমার প্রশ্ন আপনার ভাষা কি ওই টেকনিক্যালিটিকে মেনে তৈরি হয়, না অসাধারণ শিল্পবোধ থেকে লেখা আপনার ভাষা আপনা-আপনিই টেকনিক্যালিটি কর্তৃক সমর্থিত হয়ে পড়ে? অর্থাৎ একই সঙ্গে সুদক্ষ ও শিল্পিত ভাষা নির্মাণে আপনি ভাষার কৌশল ও ভাষা রহস্য-- কার উপর কেমন জোর দেন?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
আমি দুয়ের উপরেই জোর দিচ্ছি। তবে আমি প্রথম ভাষার কৌশলটার উপর জোর দিই। ভাষার কৌশল ইমোশনের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে ওজন করে নিই, তার একটা গড় ভ্যালু বার করে মাঝামাঝি অবস্থায় আনি। তবে কোথাও কোথাও ভাষার রহস্যতাও বেশি জোর পেয়েছে, ‘চশমখোর’, ‘ভয়’ সেগুলো হল ভাষার রহস্যভিত্তিক। আজকাল আমি টেকনিকটা আরও বেশি ফ্রি করতে চাই। যেন আলো বাতাসের মত চরিত্র এবং পরিবেশের সঙ্গে মিলে যায়। লেখক কিছু করে না। লেখকের কিছু করার নেই। আমি সেদিক থেকে এখন কিছুটা হেমিংওয়েপন্থী।
ধীমান দাশগুপ্ত
ভাষার রহস্য প্রসঙ্গে বলা যায় আপনার ভাষা উপমাপ্রিয়। হিউমারের জন্য আপনি কখনো কখনো উপমা ব্যবহার করে থাকেন। সমান্তরাল, দ্বান্দ্বিক, সদৃশ ও আপাত বিসদৃশ ইমেজ ও আইডিয়া ইন্টার-কানেক্ট করার কাজে আপনার গঠনও তুলনামূলক। এটা বাইরের দিক।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
দেখ, আমার লেখায় এখন উপমা কমেছে, আমি ইচ্ছে করেই কমিয়ে দিয়েছি। যেখানে আমি যথার্থ শব্দ দিয়ে অর্থ পরিষ্কার করতে পারি, সেখানে খামকা উপমা টেনে আনব কেন?
ধীমান দাশগুপ্ত
আপনার আগেকার লেখায় আপনার এই উপমা নির্বাচনে আমরা শ্লেষ দেখতাম, এখনও আপনার লেখায় একটা শ্লেষ থাকছে। এটা কি আপনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, না আপনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে লিখছেন? আপনার লেখা সম্পর্কে আমি মনে করি তা কোথাও একটু বেশি পরিমাণে তির্যক হয়েছে।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
ঠিক। ক্রমেই আমি সিনিক হচ্ছি। আগে যেমন প্যাশন হলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, রূপ দেখলে দিশেহারা হয়ে যেতাম-- এখন তা হয় না। এখন নেগেটিভের দিকে ঝোঁক এসে গিয়েছে। এবং ভবিষ্যতে হয়ত আমি এমন একটা উপন্যাস লিখব যে একটা লোক অনেক কিছু করছে, অনেক কিছু দেখছে, অনেক কিছু পেয়েছে। তা সত্ত্বেও তার মনে হয় কিছুই হল না। জীবনানন্দের আট বছর আগের একদিনের ভূত এখন আমার মধ্যেও কাজ করছে।
ধীমান দাশগুপ্ত
এটাকে অবশ্য নতুন বলব না। ‘মঙ্গলগ্রহ’ বা ‘শালিক কি চড়ুই’ গল্পেও এই শ্লেষ বিশেষভাবে দেখেছি। তবে আপনার আগের লেখা থেকে এখনকার লেখায় এর একটা মাত্রাগত তফাত আছে, আগেকার শ্লেষটা সদর্থকভাবে এনে ঋণাত্মকভাবে ব্যবহার করেছেন, এখন ঋণাত্মকভাবে করলেও, শেষমেষ তার যে অভিঘাতটা পাই তা সদর্থক। এটা ‘ভাত’ গল্প থেকে শুরু হয়েছে, আমার ধারণা এটা অ্যাটিচুডের সদর্থকতা থেকে এসেছে।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
যদি তাই হয় তবে ত ভালই, It’s a boon to me.
ধীমান দাশগুপ্ত
যত দিন যাচ্ছে আপনার লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ততা। বর্ণের বদলে ধ্বনি, ধীর ও ধারাবাহিক নির্মাণের বদলে কল্পমূর্তিকে গতিময়তা দেওয়া, অ্যানিমেটেড কম্পোজিশন ইত্যাদি। যা আগে স্থান কাল ও ভাবের দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আসত তা এখন অন্যভাবে আসছে। এখনকার লেখার যে পার্থক্যের কথা আপনি বললেন এটা কি সেইসব পার্থক্যের অঙ্গ, না আপনা থেকেই এসেছে?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
এসে যাচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতার দরুণ বয়সের দরুণ এসে যাচ্ছে। আমার মানসিকতা এভাবে লেখাচ্ছে। আমি চাইছি আমার লেখা যেন স্বচ্ছন্দভাবে এগিয়ে যায়। একটা গল্প আগে যত সময় নিয়ে লিখতাম এখন তার চেয়ে কম সময়ে লিখি। তার কারণ আগে ভাষা বা বর্ণনার অলংকরণ আমার লেখায় ছিল, এখন আমার ঐ লেখা পড়ে মনে হয় আজ হলে গল্পটা অযথা ভারি করতাম না। এই ভার ভাষার দিক থেকেই বেশি, শব্দের ব্যবহারে উপমায় দৃষ্ঠান্ত। রূপ বাড়াবার জন্য, এখন মনে হয়, ওগুলো পোষাকের বাহুল্য। আমার খুব অনুশোচনা হয় আমি কেন ওসব লিখতে গেছিলাম।
ধীমান দাশগুপ্ত
তার মানে আপনি বলছেন মোবিলিটি আপনার কাছে এসেছে সারল্য ও সহজতার প্রতীক হিশেবে। এই মোবিলিটির পাশাপাশি আমি আর একটা ব্যাপার দেখতে পাই, যাকে বলব ইনোসেন্স।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
Yes, right you are. আমি ঠিক শব্দটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তুমি ধরিয়ে দিলে। আমায় শিল্পীই বল আর লেখকই বল যত বয়স বাড়ছে ততই আমার মনে হচ্ছে লেখা যত সরলভাবে এগোন যায়, যত ডায়নামিক হয় ততই ভাল। ছোটগল্প যেন তাই হওয়া উচিত।
ধীমান দাশগুপ্ত
রাসেলের অত্যন্ত ভারি প্রথম দিককার লেখার সঙ্গে শেষ দিককার লেখার যে মাত্রাগত ও গুণগত পার্থক্য আপনার এখনকার লেখায়ও সেটা দেখা যায়।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
বাহঃ এটা তুমি ঠিক ধরেছ।
ধীমান দাশগুপ্ত
যেন আর কোন আড়ম্বর, অলংকারের প্রয়োজন নেই আপনার যা কেবল একজন মুক্ত লেখকই লিখতে পারেন। এই কি আপনার শিল্পের চরম পর্যায়?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
চরম পর্যায় বলতে তুমি কি বলছ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এটাই আমি চাইছি, চেয়েছি।
ধীমান দাশগুপ্ত
অন্নদাশঙ্কর নিজের সাহিত্য জীবনে তাঁর ছেলের মৃত্যুর ঘটনাকে বিশেষ তাৎপর্যময় বলে মনে করেন। আপনার সাহিত্যজীবনে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে কি?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
তেমন কিছু নেই। কোন একক ঘটনাকে আমি প্রশ্রয় দিই না।
ধীমান দাশগুপ্ত
শিশু ও কিশোরদের নিয়ে লেখার সময়েও আপনি বেশ প্রাপ্তবয়স্ক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে লেখেন। এ ব্যাপারে একটু আলোচনা করলে ভাল হয়।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
সে আমি কী করে বলি? কখনো কখনো হয়েছে। ‘রাবনবধ’-য়ে ‘অভিনয়’-য়ে একটু, ‘কেষ্টনগরের পুতুল’-য়ে। এগুলির মানসিকতা,অনুভূতি ও আবেগের যন্ত্রণাবিদ্ধ ছেলেমানুষি কিশোরসুলভ। সহজ ভাষা, ছোট বা সরল বাক্য, স্মৃতি ও অভিমানের সরল চিত্রায়ন। সহজ সিদ্ধান্তে আসার ও দূর প্রতিতুলনা টানার প্রবণতা তো কৈশোরক। প্রেমের উল্লেখে বড়মানুষি কিছু নেই। শিশুদের কাছে প্রেম তো তাদের ঈশ্বর-উচ্চারণের মত, স্বাভাবিক ও দুর্বোধ্য।
ধীমান দাশগুপ্ত
বড়দের কাছে? আপনার নিজের কতটা বিশ্বাস ঈশ্বরে--আদৌ যদি থাকে?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই। পবিত্রতা ও ন্যায়বোধের প্রতীক হিসেবে কোন একটা চেতনায় আমার বিশ্বাস স্থাপিত। জীবনে জ্ঞাতসারে কোন অন্যায় অপরাধ করিনি সেই তৃপ্তিই আমার ট্রুথ।
ধীমান দাশগুপ্ত
এবারে শেষ প্রশ্নটি করা যাক। সাধারণভাবে মানুষের সঙ্গ আপনার কেমন লাগে?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
ভালোই লাগে। বুদ্ধিমান মানুষ বুদ্ধি দেখাতে এলে ভালো লাগে না। প্রদর্শনপ্রিয়তা ভালো লাগে না। নিরপেক্ষ মানষের সঙ্গ ভালো লাগে।
১৯৮২
0 মন্তব্যসমূহ