ভ্যালেন্টাইন পার্কের উল্টোদিকে দাঁড়ানো জর্জিয়ান বাড়িটা বেঁচে এখানে রেড ব্রীজে নতুন একটি ফ্ল্যাটে উঠেছি। এত ফকফকা যে হোটেলের মত লাগে। বাতিগুলো ঘোমটা মারা কিন্তু ক্লিক করলে চ্যাঁতে যায়। কয়লা খনীর টর্চের মত গেঁথে ফেলে।
রাতকে দিন আর সন্ধ্যাকে দুপুর করে তোলে। দেয়ালে জংলি ছোপের কোন ওয়াল পেপার নেই। অহেতুক আংটাওলা ওয়ার্ডোব তাক ঘুলঘুলি নেই। নিট এ্যান্ড নাইস। টয়লেটও এমন ডিজিটাল যে আবশ্যকীয় শেষে পিস মার্কের মত রূপালী গোলকে হাত ছুঁয়েছো কি ছোঁওনি ম্যাজিকের মত বর্জ্য উধাও। বারো ফ্ল্যাটের মধ্যে জ্যানেট, ব্যারল ও আমি ছাড়া বাকি ন’ফ্ল্যাটেই ইয়ং প্রফেশনাল দম্পতি ও কচি বাচ্চারা। এরকম ফ্ল্যাটে কোন ভূত প্রেত পরী থাকার কথা না। কিন্তু তাই ছিল। আমার ফ্ল্যাটে না, তিন তলায়। আমিতো থাকি গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
রাতকে দিন আর সন্ধ্যাকে দুপুর করে তোলে। দেয়ালে জংলি ছোপের কোন ওয়াল পেপার নেই। অহেতুক আংটাওলা ওয়ার্ডোব তাক ঘুলঘুলি নেই। নিট এ্যান্ড নাইস। টয়লেটও এমন ডিজিটাল যে আবশ্যকীয় শেষে পিস মার্কের মত রূপালী গোলকে হাত ছুঁয়েছো কি ছোঁওনি ম্যাজিকের মত বর্জ্য উধাও। বারো ফ্ল্যাটের মধ্যে জ্যানেট, ব্যারল ও আমি ছাড়া বাকি ন’ফ্ল্যাটেই ইয়ং প্রফেশনাল দম্পতি ও কচি বাচ্চারা। এরকম ফ্ল্যাটে কোন ভূত প্রেত পরী থাকার কথা না। কিন্তু তাই ছিল। আমার ফ্ল্যাটে না, তিন তলায়। আমিতো থাকি গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
ফ্ল্যাটের পেছনে শর্ষে রঙা নাসপাতি ও রূপালী ওকের নিচে সাদা চৌকোণ চত্বর। রাতের বেলা এর ভেতরের মুথা ঘাস থেকে চুমকি বাতি জ্বলে। দিনে, সামারে সেখানে বসা যায়, চা খাওয়া যায়। আজাদ থাকতে আমি আর ও চা খেতাম আর দেখতাম ঝপাঙও ঝোপের ভেতর থেকে গলা বের করে আছে লাল মুরগীর ঝুটির মত র্যাবসবেরী, ব্লুবেলের নীল চোঙা। ওখান থেকে থেকে ১২ টি ফ্ল্যাট গুচ্ছের সকলের ব্যালকনি দেখা যায়। সব চেয়ে ফুলধরা, রঙভরা যে ফ্ল্যাট সেটাই ছিল সাদা পরীর।
অবশ্য মানুষের জন্য তার একটা নাম ছিল। তার ব্যালকনী থেকে ঝুলে পড়া ফুলগুলো ফলের মত। ফুলের রঙগুলো পাখির মত। ঝাঁড়ের আকারগুলো বিস্কুটের মত আর ব্যালকনীর আরাম চেয়ারটা রথের মত। যেন একটি আর্ট ইন্সস্টলেশন। সে ছিল তাকে ঘিরে জেগে ওঠা আমার প্রথম বিহ্বলতা। কৌতূহল ছুটেছে তার পরে। এ কি সম্ভব।!
**
এখানে ওঠার পর ঠিক মার্চের মাঝামাঝি, প্রতিবেশীদের ফ্ল্যাটে গেছি দু টুকরা করে বুটের বরফি আর একটি ফুল নিয়ে পরিচিত হতে। বুদ্ধিটা পুত্র সজীবের। নিজে পরিপাটি হয়ে আজাদকে দিবা নিদ্রায় শায়িত করে। এটা করতে গিয়ে কাউকে ঘরে পেয়েছি কাউকে পাইনি। কিন্তু সেই তিন তলায় দরোজায় টোকা দিলে কপাট খুলে সে অসাধারণ পুষ্পগুচ্ছের জননী জ্যানেট এসে দাঁড়ালে মনে হল পরী এসেছে। কেমন সদ্য ফেঁপে ওঠা সুগন্ধি সাবানের ফেনার মত। সাদা বেলির নরমের মত। অড্রে হ্যাপবার্ণের মত নিষ্পাপ অবয়ব। হাত দিলে মিলিয়ে যাবে। তার সুন্দরতা দেখে আমি উষ্ঠা খেলাম। বাপরে! মনে হল তিনি বুঝি কখনো টয়লেটে যাননা। তার গায়ের ত্বক ফাটে না। তাকে আমাশার অষুধ বা গ্যাভিসকোন খেতে হয় না। এমনকি যখন একান্ত কাছে যখন গেলাম সুগন্ধ ছাড়া গায়ের গন্ধ পেলাম না।
ঘরের সাজ সজ্জা অন্যরকম। নদীর রঙে সোফা, সবুজ ঝোপের মত টেবিল, নক্ষত্রের মত বাতি, পাইনের পেছনে আকাশের মত দেয়াল আর ম্যাগপাইর মত ফলের বাটি। এ ঘরটা যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এমন শব্দহীন কিন্তু নিজ বানীময় বাঙময়। ফিস ফিস করে কানে কানে এক জিজ্ঞাসা এল, আমার ৭৬ বছর হল তোমার কি মনে হয়? লাফ দিয়ে বলি -না একদম না।
আর কি মনে হয়?
-তুমি মানুষ না! একথা আমি কেন বললাম, কি ভেবে বললাম জানিনা। ঘোরে পাওয়া মানুষের মতই বলে ফেললাম। আমি কি করবো, আসলেই আমার তাকে সত্যিপরী মনে হচ্ছিল। সাদা ডিসার্টের মত, কাঁচে তৈরি ভ্যানিলা ক্রিমের মত দেখতে। পরী মিশে আছে তার ঘরের, চেয়ারের, আলোর, অন্ধকারের সঙ্গে। একটা ধূসর ল’কাট লংড্রেস মাছের আঁশের মত তার গা জড়িয়ে আছে। জ্যানেট মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেন, তুমি বাংলাদেশী বলেই এত অন্যরকম।– কি রকম? আমিতো জানিনা পরীদের চোখে আমরা কেমন!
পশ্চিমে এসব কেউ ধরতেই পারে না। তোমার পরিবারেও তো এমন আছে তাই না? আমার নানীর কথা মনে হল। যে ছিল আমার প্রথম পরী। নানীও ছিল সাদাপরী। সরভাজা খেত, তার সাদা থান থেকে আমাকে ছোট ছোট পরী পুতুল বানিয়ে দিত। আর আমি নারাণগঞ্জের চিলেকোঠায় তাদের সঙ্গে পার্টি করতাম।
ঐ কথাগুলো বলেই না সাঁড়াশী আক্রমণ। আচমকা আমার দুহাত জাপটে ধরেন। আমি ছুটতে পারিনা। উঃ উঃ করি। ঘর হারিয়ে যায়। কোথা থেকে এক খনখনে গলা বলে উঠলো, তোমাকে দিয়েই আমার কাজ হবে। কি হবে , কেন আমাকেই তার পছন্দ হল, ঐ নরম শরম মহিলার হাত হঠাৎ এভাবে শক্ত হয়ে উঠে মানুষ হয়ে গেল কিভাবে! আমার গোল মাথা যেন হাত । আমার হাত যেন মাথা। কি দিয়ে কি হয় বুঝতে পারলাম না। সে এক মুহূর্ত মাত্র। তারপর পরই পরী ফিরে এসে সাবানে ফড়িং হয়ে বসে। নরম নরম সুরে অড্রের মত আল্লাদী হয়ে বলে শোন, তুমি তুমিই না কেবল আমাকে মুক্তি দিতে পারো। দু পায়ে হেঁটে হেঁটে ব্যথা হয়ে গেল। আমি ক্লান্ত। আর পারি না। তুমি আমার ডানা জোড়া এনে দেবে?
- কি বলে এসব? কার কাছে তার ডানা? আমি ভয়ে ভয়ে তার পিঠের দিকে তাকাই। সে জায়গাটা কি দাবানো! কোনমতে উঠে লিফটে উঠে আয়নায় তাকাই। নাহ, ঠিকাছিতো। ফ্ল্যাটে দরোজা খুলে দেখি আজাদ ঘুমোচ্ছে। উঠলে স্যূপ ও ওষুধ দিলাম। কিছু বললাম না। বললেই বলবে, দুনিয়ার সব পাগল তোমার কাছেই আসে শামীম। আর যে ও নাতো ঐ তিন তলায়। আমি কি এনিয়ে ব্যারলকে জিজ্ঞেস করবো। ওরা আমাদের আগে থেকে এখানে আছে।
কিন্তু আমি কি আর জিগাইরে বন্ধু! আমি কল্পনায় তার সঙ্গে আমার ঘোড়া বাঁধি...
**
এলো ইস্টার তারপর এলো ক্রিসমাস। দু বারই আমার দরোজার সামনে পেলাম কেইক ও কার্ড। জ্যানেট পাঠিয়েছে। ভিক্টোরিয়ান স্পঞ্জ কেইক উইথ এ্যা চেরী অন দা টপ। ক্রিসমাসের সময় পেলাম হাতে বানানো ক্রিসমাস পুডিং। বিলেতের ক্রিসমাস পুডিং আসলে আমাদের পুডিংএর মত না। এটা অনেকটা ঘন খয়েরি ফ্রুট কেইকের মত। ওপরে কাঠ বাদাম আর আইসিং সুগার পেইস্ট এর ঘনবদ্ধ স্তর। জ্যানেট এর এক টুকরো মুখে দিয়ে আমার চোখ বুজে গেছিল। আমি ঘুমোবার জন্য বালিশ খুঁজেছিলাম। আর কার্ড হাতে নিয়ে চোখ খুলে গেছিল। আমি ওয়াও ওয়াও করে লাফিয়ে ওরাং ওটাং হয়ে গেছিলাম। স্বাদে বিস্ময়ে। এত সুস্বাদু! এত সৌন্দর্য। স্বর্গের না হয়ে যায় না। সেই কথাটাই সে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে দেখি এক এ্যাম্বুলেন্সে করে পরী চলে যাচ্ছে হুইপ্সক্রশ হাসপাতালে। সে হাসপাতালের হস্পিসেই পরে আজাদের প্রয়াণ হয়। হসপিসে নিলে বুঝতে হয় সে আর ফেরে না।
আমি মাত্র কেক খেয়ে মাতাল হয়ে তাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য লিফট তিন তলায় উঠেছিলাম। সেখান থেকে তার বদলে সে খান থেকে তা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো ব্যারল। সঙ্গে এক প্যারামেডিক ও এক পুলিশ অফিসার। গত রাত থেকে সে নাকি বাথরুমে পড়ে ছিল। ছেলেমেয়েরা ফোন করে না পেয়ে ব্যারলকে জানাতেই সে পুলিশ ও এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে তার কাছে রাখা স্পেয়ার চাবি দিয়ে দরজা খুলেছে। আমি তাদের পেছন পেছন দালান থেকে বেরিয়ে এলাম। উল্টোদিকের ব্যাপটিস্ট চার্চের মাথায় অনেক বড় উঁই ঢিবি। উঁইরা কিলবিল করছে। সামনের সিলভার ওকে জঘন্য এক জাল এসে পড়েছে। আমাদের প্যামব্রীজ কোর্ট এর ক্রিসমাসের আলো কালো হয়ে গেছে। মানে কি! পরী চলে যাচ্ছে? না...
সবাই পেইভম্যান্টের পাশে জানাজার মত দাঁড়ানো। এ্যম্বুলেন্সের এক পাশের দরোজা খোলা রেখেই প্রস্তুতি চলছে যে কোন মুহূর্তে হাসপাতাল অভিমুখে ছেড়ে যাবার। চোখ বোজা পরীর প্রেশার মাপা হচ্ছে, ইসিজির যন্ত্রের রেখা দেখছে আরেকজন। এ্যাম্বুলেন্স থেকেও ছিটকে বেরুচ্ছে বেগুনি আলো। তার ফ্রিলি জামার ওপর বেগুনি কম্বল। কিছু কি বলছে পরী প্যারামেডিককে? নায়ক বা দেবদূতের মত দেখতে সে লোক বেরিয়ে ব্যারলের সঙ্গে কি যেন বলল, ব্যারল প্রশ্ন বোধক দেহে আমার দিকে ফিরল, সেই সুদর্শন আমাকে আলতো ভাবে আকর্ষণ করে বলে, হ্যারি আপ। সি ওয়ান্টস ইয়্যু। এতগুলো ককেশিয়ান স্বজাতি থাকতে আমাকেই কিছু বলতে ডাকছে শুনে আমি এবং জানাজার দল এক অবাক অস্বস্তিতে তাকাতাকি করলাম। টাইম নেই আমি উঠে গেলাম তার কাছে। তুমি কি আমার কাজটা দেবে? বলো দেবে? বল দেবে? না হলে যে আমি উড়তে পারছি না। কেউ বিশ্বাস করে না।
-কি বিশ্বাস করে না? আমিও ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করি।
যা তুমি কর।
-মানে? তিনি হাসলেন। এ্যাম্বুলেন্স ভেঁপু বাজাতে বাজাতে চলে গেল। ব্যারল তাকালে কিছু না বোঝার ভান করে সরে গেলাম।
**
আজাদের শরীরও ভালো না। হ্যালুসিনেশনে কি সব দেখে আজকাল। ঘরে ঢুকতেই বলে, এরা কারা শামীম? সারা বাসা ভরা মানুষ। ডিমেনশিয়ার ওষুধে এমন রিয়েকশন হতে পারে তা ডাক্তার আগেই বলেছে। আমি উলটো তর্ক করে তাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা না করে তুলে ভাপানো ফেস টাওয়েলে মুখ মোছাতে মোছাতে বললাম, বাড়িতে কারা আজাদ? সে শূন্যে মাছি তাড়ানোর মত হাত করে বলে, ইস দেখোনা কি বড় বড় পাখি সাইজের ময়ূর পেখম মাছি!
তাকে বেশ কাহিল লাগছে। আমি মুখ মোছার পর ঠোঁটে ভ্যসলিন দিয়ে বলি, চল পেছনে হাঁটবে। তারপর খাবে। আমাকে ধরে ধরে লাঠিভর করে হাঁটতে হাঁটতে সে
এক দম স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমি জ্যানেটের ফ্ল্যাটে তাকাতেই তার মেয়ে হাত নাড়ল। বোধহয় ঘর ঠিকঠাক করছে। অথবা হাসপাতালের জন্য কিছু নিতে এসেছে। আমাকে দেখেই ব্যাল-কনিতে বেড়িয়ে চিৎকার করে যা বলল তার অর্থ এই, যে ফ্ল্যাট পরিষ্কার করছে। কোত্থেকে যে অসংখ্য সবুজ পাখির মত মাছি! স্প্রে করছি, বের করতে পারছি না। এদের তাড়িয়ে সে হাসপাতালে যাবো। তুমি কি যেতে চাও আমার সঙ্গে? মা বার বার তোমার কথা বলছিল। বললাম যাবো। সজীব আসুক ওর কাছে আমার বরকে রেখে তবে যাবো। মনে মনে বললাম, আমিতো কোন সবুজ পাখি-মাছি
বা মাছি-পাখি দেখি না।
হাসপাতালে গিয়ে আমরা দুজনই অবাক। আশ্চর্য, সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখনো তাকে ওয়ার্ডে নেয়নি। এখনো এ্যাক্সিডেন্ট ও এমার্জেন্সি রুমে নেতিয়ে পড়ে আছেন। খামোখা আমরা বাংলাদেশের সিস্টেমকে দোষ দেই। তো রোগীর পাশে এক জনের বেশি লোক থাকা যায় না। জ্যানেট কন্যা বেরিয়ে এসে করিডোরে মোবাইল ফোনে আত্মীয়দের সর্বশেষ অবস্থা জানাতে থাকলে আমি প্রবেশ করি। মাথার কাছে স্যালাইন স্ট্যান্ড। হাতে ইন্ট্রাভেনাস। আমি নাম ধরে ডাকতেই চোখ খুলে ক্লান্ত কিন্তু একদম স্বাভাবিক হাসি দিয়ে বলেন, কাগজে লেখো, মরিসের ঠিকানা বলছি। সে ই আমার ডানা ধরে টান মেরে রেখে দিয়েছিলো আর আমি ক্ষত নিয়ে রাগ করে চলে এসেছিলাম। কিন্তু সেই থেকে আর উড়তে পারিনা। দেখো না আমাকে বার বার নিতে এসে ওরা ফিরে যাচ্ছে।-কারা? গ্রীন ফ্লাইজ।–কি! আমার রক্ত জমে গেল।
মহা মসিবতে পড়লাম? কি করি। কাকে বলি? সবুজ বা পীতরঙা মাছিতো দুজন সত্যি দেখেছিলো। কেউতো তা বিশ্বাসই করবে না। করার কথা না। আমিও করি না। এক কাজ করি আগে এই ঠিকানাটা গুগল সার্চ করে দেখি, এমন ঠিকানায় সত্যি কোন বাড়ি আছে কিনা। এসব ভাবতে ভাবতে ফিরে এলাম। কাউকে কিছু বললাম না।
**
এক দিন পর ব্যারল দরজায় টোকা দিল। জ্যানেটের কন্যা খবর দিয়েছে তাকে লিলি ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে এতে খুশি হবার কিছু নেই। জীবনটাতে সে লটকে আছে শুধু। এবং আমাকে যেতে বলেছে। আমি গেলাম। এঘটনা একটু ছোট করে বলতে চাই।
আমি তার কাছে বসার পর নাক থেকে অক্সিজেনের নালিটা সরিয়ে পূর্ণচোখে পরী যা বলল সেটার বাংলা করলে এমন দাঁড়ায় “সেক্সপীয়র ক্লাবের ডিজে মরিস ছিল আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। কিন্তু তার অসাধারণ কম্পোপোজিশন ও মিক্সিং জন্য আমি আর আমার কলিগ ক্যাথি পাগল ছিলাম। প্রায়ই আমরা দুজন মরিসের ক্লাবে চলে যেতাম। সে আমাকে পছন্দ করলো, আমি প্রেমে পড়লাম। উইক এ্যান্ড ও হলিডেতে আমার কাজ শেষেই আমি উড়ে চলে যেতাম মরিসের কাছে। লী’র তীরে ওর হাউস বোট নোঙর করা থাকতো। ব্রমলী বাই বো’তে ঠিক টেস্কো সুপার মার্কেটের কার পার্কের পেছনে। ওই যে যেখানে প্রাচীন সময়ে ইংল্যান্ডে জলকলে বিদ্যুৎ হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বারুদ তৈরি হত ওখানেই। আমরা সেখান থেকে ক্যামডেন লখে, সেইন্ট ক্যাথারিন ডকে আর সামারে স্যান্ডারল্যান্ডের সমুদ্র পাড়ে চলে যেতাম। রাতে পাব মেতে উঠত ওর বাজনায়। আমি নাচতাম পিতরঙা ডানা উড়িয়ে। সবাই যখন তুঙ্গে সে তখন ডেক ছেড়ে লাফিয়ে পড়তো ফ্লোরে আর আমাকে শূন্যে তুলে মিউজিকের তালে তালে হাত থেকে ঘাড়ে, ঘাড় থেকে পিঠে, পিঠ থেকে বুকে রিদমে রিদমে নাচাতে থাকতো। সবাই আমাদের ফ্লোর ছেড়ে গোল হয়ে মুহুর্মুহু তালি বাজাতে থাকতো।“
এপর্যন্ত বলার পর জ্যানেটের মুখে মাস্ক লাগাতেই হল। নার্স এসে বলল, বেশি কথা না বলাতে। আর আমি দেখলাম আমার সাদা পরী মানুষ হয়ে আছে। সব বলিরেখা দেখা যাচ্ছে। বয়স বোঝা যাচ্ছে। ওষুধ খেতে হচ্ছে। অসুখ হয়েছে। তার বিছানার আশে পাশে মৃত্যুময় মানুষেরা কাতরাচ্ছে। স্যালাইন ঝুলছে লাইনকে লাইন। কেউ কেউ ওয়াকার টেলে কোনক্রমে টয়লেট যাচ্ছে। উঁচু ভিক্টোরিয়ান ছাদের বীমগুলোও বিমর্ষ হয়ে আছে। জীবন আটকে আছে ইনকুবেটারে।
মন খারাপ হয়ে গেল। সে যা বলেছে তাই করবো। ওকে বিশ্রামে রেখে একটু চা খেতে বেরিয়ে বাসায় ফোন করলাম। শনিবার ছুটির দিন, আজাদকে আজও সজীব দেখে রাখছে। সজীবের গলার স্বরে উচ্ছ্বাস। আজ বাবা অনেক কথা বলছে। গল্প করছে ছোটবেলার সেই খন্তার হাঁটের কথা, কবে তাদের বাড়িতে পুকুর কাটা হল আর ঈদের জুতো কিনতে গেছিল। কিন্তু মা তুমি যে বলেছিলে পাখি-মাছি তা নিয়ে কিন্তু কিছু বলেনি।
ফোনে কথা শেষে ফিরে এসে দেখি ভিজিটিং আওয়ার শেষ। জ্যানেট কাতর মুখে ঘুমচ্ছেন। আমার হাতে সময় আছে। গুগল সার্চ লাগবে না। এক্ষুণি ১০ মিনিট ড্রাইভ করলে চলে যেতে পারবো। ওখানেইতো উল্টোদিকে কিংসলী হলে আমি স্টোরি টেলিং করেছি।
টেস্কো কার পার্কে গাড়ি দাঁড় করেই দেখি লীর বাঁধানো পাড় ঘেঁষে কয়েকটি হাউস বোট। জোয়ার নেই বলে হাল্কা হাওয়ায় দুলছে। হেঁটে সেতু পেরিয়ে ওপারে নামবার আগেই আমি হতবাক, সত্যি সত্যিই ঐ তো ‘দি লেইট শো’। জীর্ণ ছাদে সেইন্ট জর্জের লাল-সাদা পতাকা। মিলে যাচ্ছে। সব। জ্যানেট বলেছে বোটটা মরিসের বাবার ছিল। সে ইনহেরিট করার পর ওরা দুজন মিলেই এটা মেটাল পিংক ও সবুজে পেইন্ট করেছিলো। চেইন দিয়ে পাড়ের কংক্রিট পিলারে বাঁধা। ভেতরে বাতি জ্বলছে, রেডিওর গান আসছে। পেছনে উইপিং উইলোর সবুজ থির থির কাঁপছে। ঘাসের মধ্যে চোরা কাঁটা। আর কিছু পরেই বাইরের আলো চলে যাবে। থ্রি মিলস ক্যাফে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারা যেন কিছু কাঁচ ভাঙা ও দুমড়ানো শূন্য বিয়ার ক্যান ফেলে গেছে। কি করবো ভাবতে না ভাবতেই সামনে দেখি এক প্রবল সুপুরুষ। ব্রীজের ওপাড়ের অস্তগামী সূর্যের আলো পড়েছে তার কাঁচাপাকা চুলে, এক হাতে বই অন্যহাতে বিয়ার ক্যান।
-মরিস!
ইয়েস, হু ইস দিস! মাই গড, কথা বলার স্বরওতো দেখি প্রেমে পড়ার মত।
- হ্যালো, আসতে পারি! বলে নাম বললাম।
হোয়াই নট। কি মিষ্টি নরম টোল ফেলা হাসি। আমাকে হাতে ধরে বোটে নামিয়ে নিলেন। এদিকে
আমার তো সময় নেই, সব কিছু মিলে গেলেও জ্যানেটের অবাস্তব সেই ডানাজোড়ার কথা কি করে বলি? আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম ঐ নামে তিনি কাউকে চেনেন কিনা। যেন তার দিকে মারাত্মক এক তীর মেরেছে কেউ। আ করে চিৎকার দিয়ে এত সুন্দর মানুষটি হয়ে উঠলো এক মহা খ্যাপচুরিয়াস বুড়ো। বুনো শুয়োর। ছোট্ট বেড ঢুকে খামচা মেরে কি উঠিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেই হড়বড় করে বলে যেতে থাকলো, “ কই কোথায় সে অসভ্য নারী? তাকে মেরেই ফেলবো। আমার জীবনটা শেষ করেছে সে।“
এবার আবার একটু সংক্ষেপে মরিস যা বলল বলছি। তবে তা একদম নতুন কিছু না। সেই পুরাতন ট্রাই এঙ্গেল লাভ স্টোরি। “ মাঝে মাঝে জ্যানেটের সঙ্গে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ক্যাথিও আসতো। জানতাম আমাকে তারও পছন্দ। তখনতো বয়স মাত্র আটত্রিশ। আমি মজা পেতাম।একদিন ক্যাথি একা এসেছিল। আমি ওকে গিটারে নতুন গানের সুর শোনাচ্ছিলাম। তখন ঐ জানালায় দেখি জ্যানেটের মুখ। এই স্কার্ফ তার কাঁধে। মুহূর্ত মাত্র, তারপরই সে নৌকায় ঢুকেই ক্যাথির উপর লাফিয়ে পড়ে বাঘিনীর মত। খামচে রক্ত বের করে ফেলে। আমাকে লাথি মেরে জিনিস ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে। নিখোঁজ হয়ে যায়। এই তার সেই স্কার্ফ। এ নিয়ে আমি কাটিয়ে দিয়েছি ত্রিশ বছর।“
দেখি তার উত্তেজিত হাতের উপর কেঁপে কেঁপে উঠছে ফিনফিনে সবুজ ময়ূর পুচ্ছ রঙের মসলিন প্রায় স্কার্ফ। ভয়ে ভয়ে ছুঁতেই তা আমার হাতে চলে এল। ভদ্রলোক ঘেমে গেছেন, ক্লান্ত হয়ে গেছেন, অসুস্থ হয়ে গেছেন, হাঁপাচ্ছেন। আমি সব বললাম। তিনি শিশুর মত জারে জার কাঁদতে থাকলেন। “ সে ছিল আমার গানের পরী ...আমি তাকে পরী ডাকতাম।“
**
মরিসের বার্তা বহ হয়ে সকালে পৌঁছেই শুনি তাকে স্থানান্তর করা হয়েছে হসপিসে। দৌড়ে যাই। কি এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। দেখে মনে হয় যেন এক বসত বাড়ি। রান্না ঘর, বসার ঘর, সে ঘরে বইর তাকে বাইবেল, কোরান সবই আছে।নার্সরা যেন দেবী। এত যত্ন। পাশাপাশি সব ঘরেই মানুষ। সাদা বাড়িটিকে মনে হয় যেন ইহকাল পরকালের যোগাযোগ জাহাজ এক দল মৃত্যু পথযাত্রী নিয়ে ভেসে চলেছে। এখন এ অবস্থায় কয়েক মুহূর্ত থেকে কয়েক মাস। কেউ জানে না কখন। কিন্তু কেউ আর ফিরবে না তা নিশ্চিত। পরীর মুখে প্রবল যন্ত্রণা ও বিরক্তি। তার কন্যা আমার কথা বলতেই বোজা চোখ নড়ে উঠলো। কপালে জিজ্ঞাসার ভাঁজ। আমি ফিস ফিস করে কানে কানে সব বলে যেতে লাগলাম। মৃত্যুকালে সব শেষ পর্যন্ত নাকি থাকে শোনার ক্ষমতা। তার মুখে ক্রমশ ফুটে উঠতে থাকলো মিহিন হাসি। নিথর ডান হাত মমতায় সবুজ স্কার্ফটির উপর উঠে এল। বোজা চোখের কোলে জল ।
**
লিখতে লিখতে ড্রইং রুমে কোলে কম্পিউটার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষ রাতে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলাম। আজাদের নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি না। লাফিয়ে উঠে আজাদের কাছে গিয়ে দেখি খয়েরী কম্বলের বাইরে মুখখানা বড় নীরব। ব্লাইন্ডের ফাঁক দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে। ভয়ে সন্তর্পণে ওর নাকের সামনে হাত রাখতেই পরিষ্কার গলায় বলে ওঠে, আছি আছি। মরিনি। কণ্ঠে কৌতুক। আমি সামলে নিয়ে চনমনে গলায় বলি- জীবনে কারো নাক ডাকার শব্দ এমন মধুর লাগবে জানতাম? নাক ডাকছিলে না কেন?
ঘুমালেতো ডাকবো!
- চা খাবে? চল খাই আর তোমাকে গল্প বলি- এক সবুজ ডানা সাদা পরীর গল্প।
রাত জেগে লিখে লিখে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখন ঘুমাও। সকালে শুনবো।
আমি ড্রইং রুমে এসে কম্পিউটার গুটাতে গুটাতে শুনি ওর ঘর থেকে সেই পরিচিত শব্দ ভেসে আসছে। স্বস্তিতে হেসে ফেলি। ঘুমোতে যাই।
লন্ডন
মে ২০১৫
লেখক পরিচিতি
শামীম আজাদ
বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখেন। কবিতা,অনুবাদ সংকলন, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও নাটক সহ গ্রন্থ সংখ্যা ত্রিশের ওপর। তৃতীয় বাংলা বলে খ্যাত বিলেতে তিনি বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা-বাংলাদেশ, ইয়ার অব দা আর্টিস্ট-লন্ডন আর্টস কাউন্সিল, সংহতি সাহিত্য, সংযোজন পুরষ্কার, সিভিক এওর্য়াড, চ্যানেল এস এবং হুস হু এওর্য়াড-লন্ডন পুরষ্কার লাভ করেছেন।
শামীম আজাদ
বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখেন। কবিতা,অনুবাদ সংকলন, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও নাটক সহ গ্রন্থ সংখ্যা ত্রিশের ওপর। তৃতীয় বাংলা বলে খ্যাত বিলেতে তিনি বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা-বাংলাদেশ, ইয়ার অব দা আর্টিস্ট-লন্ডন আর্টস কাউন্সিল, সংহতি সাহিত্য, সংযোজন পুরষ্কার, সিভিক এওর্য়াড, চ্যানেল এস এবং হুস হু এওর্য়াড-লন্ডন পুরষ্কার লাভ করেছেন।
1 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুন