মতি নন্দীর গল্পের ভূমিকা—লিখব আমি ? অসম্ভব, সে হয়না। এমন ঘটনা কেউ কখনও দেখেছেন নাকি যে, দেওয়ালে ঝোলানো সাবেকী একটা ফটো ঝুঁকে পড়ে পড়ে ঘরের মানুষদের, চলছে ফিরছে যারা তাদের, চিনিয়ে দিচ্ছে ? মতি জ্যান্ত, এবং কিকিং—বাংলা কী ?—এদিক ওদিক দমাদম লাথি ছুঁড়ছে । গনগনে উনুনটাকে টর্চের আলো ফেলে দেখিয়ে দেওয়ার বোকামি করতে সাধ যাচ্ছে না ।
মতি নন্দীর গল্প কেমন ; আর কী ? যদি জানতে চান, পাঠক ! তবে পাতা উলটে যান, সেটা বলে দিতে গল্পগুলোই তো আছে। পরের মুখে ঝাল খাওয়ার অর্থ নাস্তি । আমি বরং অনেক দিন আগে একবার হঠাৎ মুখে ঝাল লেগে কেমন চমকে উঠি,
সেই গল্পটা বলি। তখন কলকাতা থেকে অনেক দুরে থাকি। একবার ‘দেশ' পত্রিকার একটা লেখা পড়ামাত্র অস্থির হয়ে যাই, জিভে, চোখে, বুকেও ; সেই অস্থিরতাকেই ঝাল বলেছি । সেই অস্থিরতার আর এক নাম হয়তো ঈর্ষাও ।
গল্পটা একটা গলির । একটি উঠতি বয়সের মেয়েকে ঘিরে ঘুরছে ; কিংবা, বলা যায়, মেয়েটাই ঘুরছে পাড়াটার বাড়ি বাড়ি । ছোট মেয়ে, সব দিক থেকেই সে খুব ছোট। এই পর্যন্ত মনে আছে । আর মনে আছে আমার ভিতরে যেটা কাঁটার মতো ফুটছিল, সেই কথাটা : আরে, মেয়েটাকে আমিও তো চিনি, অন্তত চিনতাম এককালে । কিন্তু তার কথা এভাবে তো লিখতে পারিনি ?
এর পরে, কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে, তার আরও কয়েকটা গল্প পর পর পড়ে ফেলি। পরিচয়’ ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় । লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ও হয় । আসলে আমিই তাকে ধরে ফেলি, সে নয় । মতির স্বভাবে ধরাধরি বস্তুটা বস্তুতই নেই। বয়সের তুলনায় একটু বয়স্ক সে, একটু গোঁয়ার। যে মেজাজটা মেলে তার লেখাতেও ! লেখার সঙ্গে লেখক এদেশে প্রায়ই মেলে না, মতি অন্যতম ব্যতিক্ৰম । শিবের গীত গাইছি না, ধানই ভানছি। মানুষটা কেমন জানা হয়ে গেলে তার লেখাটেখা বোঝাও সহজ হয় । মতি নন্দীর লেখা পড়াটাই যেমন একটা আবিষ্কার, তেমনই আবিষ্কার মানুষটাও । স্যাঁতসেতে ব্যাপার একদম নেই, সর্বদাই খটখট করছে ।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে যে, ভূমিকা এটা আদৌ হচ্ছে না, একজন গল্পলেখককে নিয়ে লিখতে বসেছি একটা গল্প । “বিশ্বসাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান বঙ্গ সাহিত্যের। সে সাহিত্যে আবার ছোট গল্পের স্থান বিশিষ্ট । রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার মখোপাধ্যায় হইতে তারাশংকর, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নরেন্দ্র মিত্র-ছোট গল্পের ধারাটি বাঁকের পর বাঁক অতিক্ৰম করিয়া বহিয়াই চলিয়াছে, কল্লোলোত্তর কাল অধুনা মতি নন্দী প্রভৃতি নবীন নামগুলি কেন্দ্র করিয়া কল্লোলিত”–এইভাবে আরম্ভ করলে বেশ গ্রাম্ভারী, প্রামাণিক জাতের ভূমিকা হত। কিন্তু সেসব আমার আসে না। দ্বিতীয়ত কথাগুলো মিথ্যেও হত। খুব বেশি ছোট গল্প কি লেখা হচ্ছে আজকাল ? এখনকার বাজারে বেশির ভাগ যা বেরোচ্ছে তা না ছোট গল্প, না উপন্যাস, মাঝারি সাইজের বড় গল্প । ব্যাঙের মতো পেট ফুলিয়ে যা নিজেকে উপন্যাস বলে জাহির করে, তারই ফরমাস বায়না কদর। যেদন ডিমান্ড তেমনই সাপ্লাই চলছে, ছোট গল্প লিখতে উৎসাহ বোধ করেন ক'জন ? একেবারে ঋতু শেষ তার, এই সেদিনও যে ছিল ছোট্ট মেয়েটি। নখাগ্রে মুখের বিশ্ব, গালের টোলটি—আমাদের সাহিত্য থেকে এ-সব জিনিস উবে যাচ্ছে।
আপাতত যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই—মতি নন্দীর গল্পে। যে-কোন পাঠক কিছুটা পড়লেই বুঝতে পারেন, তার গল্প বস্তু বাদ দিয়ে নয়-বস্তুবাদী। তার মানে কি এই যে, ফিক্সনাল ক্রাইসিস’ অধুনা সর্বব্যাপী, গত শতকে ভূমিষ্ঠ কাফকা, জর্জ লুই বোরজেস, ইত্যাদির মধ্যেও যার ইঙ্গিত মেলে। কোরটাজার, নাবোকভ প্রভৃতি পরবর্তীরা তো আছেনই— সেই মহামারী থেকে মুক্ত সে বর্তমান বহাল তবিয়তে ? লক্ষ্য করে দেখা যায়, এখনও তার বেশির ভাগ গল্পই থার্ড পারসন’ – এ, সেই আবহমান রীতি— সর্বজ্ঞ সবদর্শী লেখকেরই জবানী। "থিওরি অব ইনডিটারমিসেসি'-র আভাস মাত্র তার মধ্যে দেখি না, কোথায় “সাইকেডেলিক" অভিজ্ঞতার ব্যবহার, যা লভ্য মারিহয়ানার প্রসাদে, ঝাপসা আয়না মনের। প্রতীকী অর্থের প্রয়োজনে ভাষার কাঠামোটাকেও আগাগোড়া ভেঙে-চুরে দিয়ে সব প্রচলিত রীতির বহিস্কার? মনে হয়, হাল আমলের রাস্তার ধারের সমতা দোকানে মতি নন্দী সওদা করেনি। অতিবাদী মহাবিশ্বে মহাকাশে নিঃসহায় নিঃসঙ্গ মানুষদের টেনে নামানোর জন্যে লম্ফঝম্ফ তার মোটে দেখি না, কেন না সে দিব্যি দণ্ডায়মান তাঁর নিজের শুকনো ডাঙায়, রাঢ় মাটিতে। সেইখানে দাঁড়িয়ে সে একে চড় মারছে, ও-কে চাপড়, কাপড় চোপড়ও খুলে নিচ্ছে কারও কারও, একে খোঁচা, ওকে গাঁট্টা মারছে । মারছে তাদের, যারা রক্তাল্পু মানুষ নয়, বরং রক্তাক্ত, যারা বাস করে পাড়ায়, পরিবারে ; মেটারনিটি ওয়ার্ড থেকে "ট্যাকসি” করে বাড়ি যেতে চায়, কট করে বিস্কুট কামড়ে “খুকির মতন হাসে" ( রাতা )। যারা অফিসের পিওন লটারিতে টাকা পেলে উত্তেজিত বোধ করে, ক্লান্তিও, যে ক্লান্তি, “ক্রমশ তাকে দীনতার মধ্যে ডোবায় ।” এবং পরে "কামনার দ্বারা প্রবলভাবে আক্ৰান্ত হয়" (জীবনযাপন প্রণালী)। যারা ধর্মতলাব মোড়ে ব্যস্ত হয়ে নামা লোকটার তালগোল পাকানো মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে অহেতুক, পরে, তেমনিই অহেতুক, নিজেকে কুরু ক্ষেত্রে সব্যসাচীর মতো নিমিত্তমাত্র ভেবে একেবারে হালকা হয়ে যায় ( পাষাণভার ) । এরইমধ্যে একটু দুরে গিয়ে পিকনিক সেরে আসে কারা, ফেরার সময় সারা পথ সেই মেয়েদের পায়ের কাছে শাড়িঢাকা শব শোয়ানো-অসফল এক তরুণের। গ্রাম্য সন্ত্রীকে শহর দেখাতে এনে ভারিক্কী স্বামী "বিদেশীকে নিজের সাম্রাজ্য দেখাবার ভঙ্গিতে" বলে “বিশতলা...আমি একবার উপরতলায় উঠেছিলাম।”. আর পকেটের সব পয়সা-ফেরার ট্রেন ভাড়াও-চায়ের দোকানের বেয়ারাকে দিয়ে, সেলাম কিনে, যখন হেঁটে হেঁটে ফিরে যায়, তখন তার বউ বলে “যখন সেলাম করল, তোমাকে দারোগাবাবুর মতো লাগছিল । ( শহরে আসা ) ।
“বয়সোচিত" গল্পটিতে বয়স যে যায়নি, সেটা প্রমাণ করতে একটি মানুষকে অফিসের স্পোর্টস-এ হাঁটার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তে দেখি ; নইলে, তার ভয়, সে রিটায়ার হয়ে যাবে। বিস্ময় সেখানে নয়। বিস্ময় এইখানে, সেই মানুষই পরদিন অফিস থেকে বউকে বলে “আর রিটায়ার করাতে পারবে না।” কেন ?—"রিজাইন দিয়ে এলাম।” বাতিল-নম্বর এক ফুটবলারে মৃত্যুই তার “প্রত্যাবর্তন । তার শেষ কয়দিনে তার ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল একটা ন্যাড়া নিমগাছ। "গাছ তো তার পাতার মধ্য দিয়ে যা শুষে নেয়, তাই দিয়েই বেঁচে থাকে। পাতাই নেই? তা-হলে ও বেঁচে আছে কী করে ?" ( এই গল্পেরও পশ্চাৎপট পোটাস, বলা যায়, মতিই প্রথম বাংলা গল্পে পোট'কে যথার্থ সাহিত্যের বিষয় করেছে । )
এই সব গল্প, এইসব মানুষের। ুপরো ফর্দ দেব না, গোড়ায় বলেই তো নিয়েছি, রানিং কমেনটারি আমার কর্ম নয়! বায়বীয় নয়, এই মানুষেরা বাস্তব, মাংস-মজ্জা-চামড়ার । ভৌতিক নয়, ছায়া পড়ে, তাদের ফটো তোলা যায়। মতি তাদের দেখেছে। দেখাটাই অবশ্য সব কথা নয়, দ্যাখে তো সকলেই । দেখাটাকে সে লেখাও করেছে । তার আদ্যোপান্ত দেখা জগৎকে । তার দৃষ্ট জগৎ, সৃষ্ট জগৎ নয়। এখানে তার সরাসরি আত্মীয়তা কোন পূর্বসুরীর সঙ্গে :- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পারিবারিক চেহারার মিলটা সহজেই চেনা যায়।
মতিরও বড় শক্তি, তার অভিজ্ঞতা। মাল মশলা যার আছে, তাকে, ফুঁ দিয়ে কিছু তৈরী করতে হয় না। এদেশে সেকালের লোকে যেমন চেচিয়ে ‘গোমাংস ভক্ষণ করেছি বলে মুখে পুরত, সে ডিক্লেয়ার করে তেমন অশাস্ত্রীয় কিছু করে না। গল্পের শুরু আছে, মধ্য আছে এবং শেষ আছে, সে মানে । মাঝখানটাকে শেষে টেনে এনে শুরুকে ঢুকিয়ে দিয়ে মাঝখানে, লাগ-ভেলকি ? সে লাগায় না। তার ন্যারেটিভ। নারী শরীরের বর্ণনা যেমন ধ্রুপদী ও সমুচিত, তেমনিই : মাথা থেকে ক্ৰমে নেমে পায়ের পাতা অবধি। গোড়ালি থেকে আরম্ভ করলে মুখে এসে মেয়েরা ফুরিয়ে যায়। আর প্রকরণ শাস্মীয়-অশাস্ত্রীয় যেমনই হোক না, হোক ‘অ্যানটি’-সব কিছু, তবু নঙর্থক বস্তু, বোধ বা বিষয়ও তো কিছু থাকবে ? বোধ, না থাকলেও প্রশ্ন ? মতি নন্দীর গল্প এই জীবনবোধ, জ্ঞান ও জিজ্ঞাসায় বিলক্ষণ ভরে আছে। তবু-
তবুটা কী ? তবু এই যে, ভরে আছে কিন্তু ভরাট হতে চায় না । যেখানে মতির শক্তি, সেখানেই তার সীমা, তার চরিত্রেরা যেন ভয় পায় গলির বাইরে পা বাড়াতে । অথচ এটা তো ঠিক, প্রায় সব গলিই, শেষ পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায় কানা ? তাই মুখ ফিরিয়ে ফের তেপান্তরের মাঠে, এমনকি সমুদ্দুরেও যেতে হয় ।
এই তত্ত্বটা মতি নন্দী নিশ্চয়ই জানে, নইলে সে একবার "ফেরারী" হত কি ? তার ‘চতুর্থ সীমানা" গল্পের কাহিনীটার পাত্র-পাত্রী কেনা জমির চৌহন্দির চারটে খুঁটি হারিয়ে ফেলত না। হারিয়ে ফেলার যে-মুক্তি তা চকিতে আভাস দিচ্ছে, পরমুহূর্তেই আবার বিমষ ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে ।
সাহিত্যের সত্য এই দুটোই। কাঁটা-ছোঁড়ায় নির্মম ছুরি, আর প্রলেপের মলম, দরকার এই দুই-ই। ঝকঝকে ছুরি দেখতে পাচ্ছি মতির হাতে, কিন্তু – এ-কথা লেখার জন্য সে আমাকে যেন মাপ করে— তাকে এখন মলম কিনতে হবে । মানুষের ভ্যানিটি ব্যাগের নাড়িভুড়ি সে বের করে এনেছে ; চিৎ করে উপড়ে করে দেখিয়ে দিয়েছে আত্মপ্রতারণা আছে যত রকম ["ওখান (কোনারকে) সত্যি দেখবার জিনিস আছে।” “আপনি গেছেন ?” “আমার নন্দাই গেছল "] — এখন আর একটু ভালবাসাও চাই। শুকনো খেজুরের সঙ্গে সঙ্গে আঙুর, একটু টকটক হলেও ক্ষতি নেই। আঙুর অবশ্য মিলছে এক আধটা। এক বোন যখন ভাবছে “মানুষের মুখ মরচে ধরা টিনের কোঁটোর মতো", তখন অন্য বোন দেখল, “হাসতে হাসতে ট্রেনের মুখ চলে যাচ্ছে"- এ কথা মতি নন্দীই লিখেছে।
লিখেছে, লিখে যেতে হলে তাকে আরও লিখতে হবে । বেলা যত পড়বে, জ্বালাও তত জুড়োবে। ছায়া ঘনাবে জমতে থাকবে মমতা । মলম আপনা থেকেই লেগে যাবে। শেষবেলার একটা গল্প মতি তো ইতিমধ্যেই লিখেছে—ছ’টা পায়তাল্লিশের ট্রেন।" -
ওর (বুড়োর) শরীর থেকে বন্য গন্ধ আসছে।..ঘন ভুরু, দাড়িতে ভরা মুখটা রাস্তার আলোয় বিক্ষত দেখাল ।
"জানো, আমি আর কিছু বুঝতে পারি না।...একটা মেয়ে কাল ভাত দিল, খেলুম স্বাদ পেলুম না।•••কাল পেচ্ছাপ করে ফেললুম, তাতেই সারারাত শুয়ে রইলুম। বুঝলে, আমার শীত করল না।"
"ছ’টা পয়তালিশের গাড়িতে চলে গেল, আমাকে ফেলে", বুড়ো বলেছিল। তার আগে ট্রেনটা আমার “নিয়তি," বলেছিল এই লেখাটাই আর-এক চরিত্র-বিনোদ । এই গল্পটা পৰ্যন্ত পড়ে থেমে গেছি, আর এগোতে পারছি না। শুনছি "ছ’টা পয়তাল্লিশের ট্রেন আজ আর আসবে না।" কিন্তু ও-ট্রেন তো আমার নয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি, এগোরোটা বেজে পঞ্চান্ন। কার ট্রেন কখন ?
0 মন্তব্যসমূহ