দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
১. ০.
‘তা’ কি করা হয় তোমার?
আঁদাড়ে বাঁদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে এমত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি বহুবার এবং সযত্নে এড়াতেও শিখে গেছি, কেননা আমার পেশাদারি জগৎ বলতে ‘ভাষাতত্ত্ব’ বা ‘লিংগুইস্টিক্স’ এবং এ বিষয়টার নাম করলেই হাজারো হাবিজাবি প্রশ্ন এসে ঠেলা মারতে থাকে : ‘আরে, তুমি তো অনেক ভাষা জানো?’ ‘আচ্ছা, শব্দের ব্যুৎপত্তি বের করতে পারো তো তুমি?’ ‘অমুক ভাষার উৎসটা কি তুমি বলতে পারবে?’
আগে ধীরে ধীরে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতুম৷ বলতুম, ভাষাতাত্ত্বিক (লিংগুইস্টিক) আর বহুভাষাবিদে (পলিগ্লট) তফাৎ আছে৷ ভাষাতাত্ত্বিক ভাষার বিশ্লেষণ করেন; সেই বিশ্লেষণ করার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে-- সেই বিশ্লেষণের সংগে ব্যাকরণের কচকচির উদ্দেশ্য- বিধেয়র বহুৎ তফাৎ; ভাষার উত্স- ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো উনিশ শতকের শব্দ তাত্ত্বিকরা করতেন, সে সব ব্যাপারগুলো আমার কাছে নেহাৎ-ই বেহুদা ব্যাপার৷ এ নিয়ে আমি অযথা মাথা ঘামাই না, কেননা প্রথম যিনি কোনো এক বস্তুর নামকরণ করেছিলেন, তিনি যে বস্তুটাকে ঠিকঠাক চিনে নাম দিয়েছিলেন তা’ তো নয়৷ তাহলে বস্তুর ব্যুৎপত্তি বা আস্লি মানে বের করে আমার কি মোক্ষ সম্ভাবনা হবে? বিশ শতকের ভাষাতত্ত্ব ভিন্ন এক ব্যাপার ... ব্যাকরণ এবং শব্দতত্ত্ব (ফিললজি) এর সংগে ঠিক খাপ খায় না৷
কিন্তু এবার যিনি প্রশ্ন করলেন, এক লোটাকম্বলওলা ভবঘুরে, তিনি আমায় বেশ কাহিল করেই ছাড়লেন৷ ‘কি করা হয় তোমার?’- -এর মতো বারংবার- করা প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে ‘লিংগুইস্টিক্স’ বলে পার পাবো ভেবেছিলুম, কিন্তু ভবঘুরে ভদ্দরলোক এর পরে কথার পিঠে যে কথা চাপালেন, তাতে হাড়ে হাড়ে মালুম হল যে তিনি সহজে ছোড়নেবালা পাত্তর নন৷ তিনি ওই সব চিরকেলে প্রশ্ন না করে বললেন, “ওঃ কথা নিয়ে কারবার তোমার? মানে তুমি হচ্ছো গিয়ে কথা- বণিক৷ কথা নিয়ে কথা কও৷ কথার উপর অধি-কথা মাত্রে মেটা- স্পীকিং— এলিতেলি ব্যাপার নয় গো সেটা! তা’ বলি, ওগো কথার কারবারি, কথা নিয়ে বেওসা কর, অথচ দেখছি কথা কইতে তোমার বড়ো আপত্তি৷ এতোক্ষণ যে ট্রেনে চেপে চলছি, মুখ ফুটে কথা তো কইতে দেখলুম না বাপু! বুঝেছি, ‘কথার দাম’ বলে একটা কতা আছে৷ তোমার ‘কথার দাম’ তো অনেক, তাই হয়তো আমাদের সংগে কতা কও না৷ আরে বাবা ‘ভাষাতত্ত্ব’ মাড়াচ্ছো, অথচ সংলাপে যেতে পারো না?”
যদিচ ঘা লাগলো আঁতে, তবু কথাগুলো মনে ধরলো বেশ৷ কে এমন করে তো ভাবিনি আগে! আসলে চাদ্দিকে এ্যাতো কথা, কথা আর কথা যে মন একটু নীরবতা চাইছিলো৷ চারপাশে সবাই এ্যাতো সব ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস্ নিয়ে ত্বরিৎ কথা কয়ে চলেছে আর বকবক শুনে চলেছে যে আর যেন কথা শুনতেই ইচ্ছে হয় না, কথা কইতেও ইচ্ছে হয় না৷ নীরবতা খোঁজার তাগিদে তাই বেরিয়ে পড়েছিলুম নিরীশ্বর তীর্থ-যাত্রায়৷ একটা ফান্ডেড প্রজেক্ট ছিলোঃ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ভাষিক রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন হচ্ছে, তা বুঝে শুনে সরকার বাহাদুরকে জানানোর বয়াতি পেয়েছিলুম৷ সেই সরকারি পয়সায় ভারত- বেড়ানোর সুবাদে ট্রেনের মধ্যে এই ভবঘুরে রসিকের সঙ্গে আলাপ হওয়াটা আমার কাছে উপরি- পাওনা, তাই এই উত্তরের একটা সপাট চাপান মারবার সুযোগ হারালুম না৷ তাঁকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলুম, “মশাই একটা ধাঁধার উত্তর দিতে পারেন : সবাই দাম দিয়ে কথা কইছে, অথচ আমার মনে হচ্ছে কেউ কথা কইছে না৷ ‘ইটজ্ এ টেল টোল্ড বাই এ্যান ইডিয়ট, সিগ্ নিফাইং নাথিং’ কেন এমন হল বলুন তো? তারপর আমি না হয় সংলাপে যাবো৷”
ভদ্দরলোক এবার হো হো করে হেসে ফেল্লেন, বল্লেন, “এখানকার অ্যাম্বি অ্যান্স্টা বড্ডো লাউড৷ চলো একটু টয়লেটের ধারে গিয়ে বিঁড়ি ফুকে আসি৷”
পুব থেকে পশ্চিম ভারতের অভিমুখে সেই দীর্ঘ যাত্রায় আমি হাঁক ছেড়ে বাঁচলুম বলা যায়৷ যাক্ একটা মনের মতো সঙ্গী পাওয়া গেছে৷ ক্লিশে হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলোর আর উত্তর দিতে হবে না৷ ভদ্দরলোক বল্লেন, “মনে হচ্ছে সংলাপে যেতে গিয়ে ঝাড় খেয়েছো খুব৷ তাই এতো চুপচাপ প্রথমে ভেবেছিলুম এ তোমার বিদ্যে-- ব্যবসায়ী- সুলভ ঔদ্ধত্য৷ এখন মনে হচ্ছে ভেতরে ক্ষত আছে, দাগা পেয়েছো নইলে এমন প্রশ্ন তুমি আমায় করতে না৷ আরে বাপু, দাগা পেয়ে কথা বন্ধ করলে চলে নাকি? যাঁদের রক্ত- ঘাম- ক্লেদ ঝরা পরিশ্রম থেকে তোমার খাবারদাবার- জামাকাপড় আসে, যাঁরা তোমায় তাঁদের পরিশ্রমের বিনিময়ে ভাষাতত্ত্ব- চর্চার অবসর দিচ্ছেন, তাঁদের জন্য যদি কিছু না করো, তাঁদের সংগে যদি সংলাপে না যাও, তাহলে তো তুমি একটা প্যারাসাইটের বেশি কিছু নও৷ তুমি তো তোমার ভাত- কাপড় বানাতে পারো না, আগডুম বাগডুম পেপার লিখে লপচপানি মারো ...৷”
এবার আমার রাগ হয়েছে৷ মনে হলো ভদ্দরলোক জ্ঞান দিচ্ছেন৷ আমি ভুরু কুঁচকে বললুম, “দেখুন অনেক কষ্ট করে এই বিষয়টা আমায় শিখতে হয়েছে৷”
— তো কি হল? পারবে আমাকে ভাষাতত্ত্ব শেখাতে? সহজ ভাষায় চাষা ভুষো - কুলি কামিনদের তোমার জ্ঞানতত্ত্ব বোঝাতে পারবে? নাকি সরকারি পয়সা ধ্বংস করে সেমিনারে অকিঞ্চিৎকর পেপার ভাটাবে?
— তাঁরা ভাষাতত্ত্ব শিখে করবেনটা কি?
— এ্যা- ই- ই, এটাই বলতে চাইছিলুম৷ তোমার জ্ঞান সংখ্যা- গরিষ্ঠের কোনো কাজেই লাগে না পারবে আমাকে ভাষাতত্ত্ব বোঝাতে?
— হ্যাঁ, আমি পারবো৷ দেখিয়ে দেবো কি কাজে লাগে ভাষাতত্ত্ব — আমার মতো এক ‘অপর’ অন্য ভাষাতত্ত্ব পড়াবে৷ এটা আমার চ্যালেঞ্জ! তবে আপনার কথাটা বড্ডো উপযোগিতাবাদী — আমার স্বোপার্জিত জ্ঞান সব্বার কাজে লাগবে— এমন দাওয়াই দেওয়ার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না৷
— স্বোপার্জিত জ্ঞান বলে বড়াই করছো? চোখ- কান খোলা রাখা মানুষের কাছে ‘জ্ঞান’ স্বোপার্জিত নয়, সামাজিক ভাবে আহ্নত৷ এই আহ্নত জ্ঞানকে তোমরা ‘স্বোপার্জিত’ বলে বড়াই করে স্বাক্ষর দাও — ব্যক্তিক স্বাক্ষর এবং তারপাশে বসিয়ে দাও ©- চিহ্নটা৷ এটা তঞ্চকতা ছাড়া আর কী? মুখে বলো “অথর ইজ্ ডেড”, আর কামে করো তার উল্টোটা ...
আমি বিষণ্ণ হলুম আরো৷ সত্যিই তো যাঁরা অথরের অথরিটিকে প্রশ্ন করেছেন, তাঁরা কেউই কপিরাইট ছাড়েন নি৷ তারমানে এসব তত্ত্বকথা এ ভদ্দরলোক জানেন৷ আমি শুধু বল্লুম, “আসলে অথর মরেন নি৷ মরে গেছেন পাঠক৷ আমি পাঠক খুঁজে পাচ্ছি না ...”
উনি বল্লেন, “ঘরের পাশেই তো আয়না শহর আছে, আয়নায় আপুনার মুখ আপুনি দেখো, মনের মানুষ ঠিক পেয়ে যাবে৷”
১. ১.
রাত্তিরে ট্রেনটা থমকে দাঁড়িয়ে আছে৷ খবর এসেছে, সামনে নাকি বোমা পোঁতা আছে৷ কে জানে মানুষ মানুষকে কেন মারতে চায়! সম্পর্কটা কেন যে সহযোগিতার না হয়ে প্রতিযোগিতার সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ঠিক ঠাহর করতে পারি না৷ সংলাপ তো দূর অস্ত৷
একথাটা বল্লুম তাঁকে৷ তিনি বল্লেন, “দাঁড়াও দাঁড়াও৷ আগে তোমার কাছে মেইন স্ট্রীম ভাষাতত্ত্বটা বুলে নিই৷ তারপর শেষকালে না হয় সংলাপ- সহযোগিতার তত্ত্বকথা ফাঁদবো৷ আমি যদ্দূর অনুভবে বুঝি সংলাপ- সহযোগিতার সঙ্গে ভাষাতত্ত্বের যোগসজ্জা আছে৷ কিন্তু হামাগুড়ি না দিতে শিখে দৌড়বো কি করে? তাই তোমার কাছে মূলধারার ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসটা একটু বুঝে শুনে নিতে চাইছি৷”
— সে তো বিরাট গপ্পো৷ তার জন্য আলাদা কিতাব ফাঁদতে হবে৷ প্রায় শ’ বছরের ইতিহাস! তবে হ্যাঁ, আমি সংক্ষেপে তিনটে বিপ্লবের কথা কইবো৷ যাকে বলে ধরতাই দেওয়া আর কি৷ আপনি শুনবেন সে কথা?
— কেন শুনবো না! আমরা তো কথা নিয়ে অধিকথা বা মেটা স্টাকিং-এ পৌঁছতে চাইছি — বকবক করার ওপর বকবক করা৷
— বকবক করার ওপর বকবক তো অনেকেই করেন, গ্রামার করে, ব্যাকরণ করে, শব্দবিদ্যা বা ফিললজি করে, কিন্তু এই মেটা- বকবকে শাস্তর হিসেবে ভাষাতত্ত্বের বিদ্যা সমুদ্দেশ সম্পূর্ণ আলাদা৷
— কি রকম ব্যাপার গো সেটা?
— গ্রামার লেখা হয় কেন্দ্রীয় ভাষার —ঐ যাকে বলে স্ট্যান্ডর্ডভাষা আর কী! কোনো ভাষা ‘কেন্দ্রীয়” হয়ে ওঠে ভাষার গুণগত কোনো কারণে নয়, অ- ভাষা তাত্ত্বিক অর্থ সামাজিক কারণে কোনো একটা ভাষা বৈচিত্র্য বেশি পাত্তা পেয়ে যায় ...
— ভাষা বৈচিত্র্য ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলো তো দেখি৷
— ঐ যে আপনি বল্লেন ‘© -চিহ্ন’৷ এটা চিহ্নের খেলা৷ এই চিহ্নের খেলার ধরতাইটা দিলেন সোস্যুর মশাই৷ ঐ যে ঠাকুর বলেছিলেন না হল -একোয়া- পানি- ওয়াটার যাই ‘নাম’ দাও না কেন, জল তো জল- বস্তুই৷ যে নামেই ডাকো না কেন যা কিছুকে, তাতে ঐ ‘যা কিছু বস্তু’- র কিস্সু যায় আসে না৷ চিহ্ন আর চিহ্নিত বস্তুর সম্পর্ক অবাধ, যা- ইচ্ছে- তাই বা -আরবিট্রারি৷
এবার মুশকিল হলো কি এই সব চিহ্নে আমরা নানান মূল্য বা ভ্যালুস্ আরোপ করি৷ অবাধ যা- ইচ্ছে- তাই চিহ্ন ‘ভালো- মন্দ’ মূল্য পায়৷ ‘কেন’ পায় সেটা সমাজ- সংস্কৃতির স্তরে অনুসন্ধানযোগ্য৷ সে ভাষা- চিহ্ন গুলো ‘ভালো’ মূল্য পেলো, সে প্রান্তীয় ভাষা বৈচিত্র্য (যাদের আমরা ‘উপ’- ‘অপ’ ভাষা বলি আর কী!)- গুলোকে কলোনাইজ করলো৷ তাদের মাতৃভাষার মাতৃদুগ্ধের বদলে পেলো প্যাকেজ্ড বেবি ফুড উইথ ওয়াটার বটল : নাম তার গ্রামার, ‘যাহার দ্বারা শুদ্ধ ভাবে লিখিতে পড়িতে পারা যায় ....”৷ এই তারা হয়ে পড়লো পরাজিত ভাষাবৈচিত্রের বন্দী বক্তা- শ্রোতা৷ কল্পিত বেশনের নগরের ভাষার ‘উপ’- গ্রাম্য ভাষা৷
— তুমি কি শুদ্ধ- অশুদ্ধ ভাষার মাপামাপিটা রিজেক্ট করছো? — দুর, আমি করার কে! ভাষাতত্ত্বের জনক সোস্যুর- উত্তর অধ্যায়ে জল গড়িয়েছে অনেক দূর৷ যদি ভাষাতত্ত্বের একটা সহজ পাঠ লিখি তাহলে বাংলা ভাষায় একথাগুলো বিস্তারিত বলবো৷ এখানে শুধু একটা ধরতাই দিয়ে দিই৷ আচ্ছা ধরুন, আমি আপনার সঙ্গে লুডো খেলতে বসলুম ...
— বুলাদির কথা কইছো নাকি
— বুলাদির কথা না হয় হবে পরে, সোহাগের ভাষাতত্ত্ব লিখবো যখন... লুডোর প্লাস্টিকের ঘুঁটি গেলো হারিয়ে, তাহলে আমরা কি করবো? বোতাম বা তেঁতুল- বিচি দিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে পারি তো?
— হ্যাঁ, নিশ্চিত৷ লাল- সবুজ- নীল- হলুদ ঘুঁটি কোন কোনটা, তা ধরে নিলেই তো খেলা চলবে৷ যেমন, শতরঞ্জ এর দুই খিলাড়ী গজদাঁতের ঘুঁটি থেকে কাঠের ঘুঁটি এবং শেষ অব্দি ফলমূল সবজি দিয়ে খেলা চালিয়ে গেছেন৷
— হ্যাঁ, চমৎকার উদাহরণ৷ এ উদাহরণ আমি বহুবার ভাষাতত্ত্বের ক্লাসে বলতে বলতে হেজিয়ে গেছি৷ তাহলে ব্যাপারটা দেখুন, কাঁচামাল বা র’মেটিরিয়ালস্ বা সাবসাট্যান্সেস্ বদলাচ্ছে, কিন্তু খেলা দিব্য চলছে৷ কিসের জোরে চলছে?
— নিয়মের জোরে? আমার তো তাই মনে হয়৷
— এই নিয়ম বা গণনা ভিত্তিক কার্যক্রমটা কে দিচ্ছে? স্বভাব না প্রভাব? মানব প্রকৃতি না সংস্কৃতি? মানব- মনের অন্দর না বাহির?
— এটা একটু ভেবে চিন্তে বলতে হবে, কেননা আমার একটা ঘটনা আছে৷ শতরঞ্চ কি খিলাড়ি ছবিটা মনে করার চেষ্টা করি৷ আচ্ছা ইংরেজরা যখন ব্যান্ড বাজিয়ে ঢুকছে, তখন ঐ দুই খেলোয়াড় তাঁদের রাজা- মন্ত্রীর ঠাঁইবদল করে য়ুরোপীয় মতে দাবা খেলতে শুরু করেন৷ তাহলে তো ‘প্রভাব’- এ খেলার নিয়মের ‘স্বভাব’ বদলায়?
— এই রে, এ্যাদ্দিন ‘ভাষাতত্ত্ব’ পড়িয়েছি, এই উদাহরণ দিয়ে, এমন প্যাঁচালো প্রশ্ন তো কেউ করে নি! তবে কিনা আপনার এই প্রশ্নটা আমার সুবিধে করে দিল৷ ‘ভাষা’ সামাজিক ভাবে আহৃত জ্ঞান নাকি ‘মহজাত’ ‘স্বাভাবিক’ জ্ঞান — এটা নিয়ে একটা প্যারাডক্স আছে৷ আপনার এমত প্রশ্নে সেটা পাড়বো; এর নাম ‘সোস্যুর’স্ প্যারাডক্স’ : ভাষা স্বভাব না প্রভাব, তা নিয়ে ভাষাতত্ত্বের জনকের একটা দ্বিধা ছিলো৷ একবার তিনি ভাবছেন ভাষা হলো গিয়ে আত্মহত্যার মতোই ‘সোশাল ফ্যাস্ট’ বা সামাজিক ঘটনা (দুর্খেইম নামের এক সমাজবিজ্ঞানীর প্রভাব খেয়াল রাখতে হবে এখানে), আর একবার ভাবছেন এটা সাইকো— ফিজিওলজিকাল ঘটনা৷ আপনার প্রশ্নে ঐ প্যারাডক্সটা আগেভাগেই এসে পড়লো৷
— তা’ না হয় বুঝলুম ব্যাপারটা৷ একটা জিনিস আমার কাছে পরিস্কার৷ ভাষার একটা দিক আছে, যেটা যা- ইচ্ছে তাই বা অবাধ চিহ্নের লীলা৷ এটা কাঁচামাল, সেটাও বুঝলুম৷ কিন্তু এই নিয়মটা কোথা থেকে আসছে সেটা নিয়ে ধন্দ রয়েই গেল৷
— এই কাঁচা মাল অবাধ চিহ্ন নিয়ে কারবার করেন শব্দবিদরা৷ তাঁরা এটাকে এমনই এক জান্তব/জ্যান্ত অস্তিত্ব বলে মনে করেন যে এর ওপর মানবিক গুণ আরোপ করে এর জৈবিক বিবর্তন বের করে ফেলেন৷ ভদকা আর উদকে মিল খুঁজে বেড়ান৷
আমি একথা বলা মাত্র উনি একটা রুমের পাঁইট বের করে আলগোছে মুখে ঢেলে দিলেন এবং অবশ্যই আমার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ তারপর আবার সংলাপ চল্লো৷ উনি বললেন, “জানো কার্ল মার্কসের একটা অসম্পূর্ণ উপন্যাস পড়েছিলুম, স্করপিয়ন অ্যান্ড ফেলিক্স৷ সেখানে শব্দবিদ্যা নিয়ে হেব্বি তামাশা করেছেন মার্কস সাহেব৷ ব্যাপারটা এখন সমঝে গেলুম৷ ভাষার অবাধ চিহ্নের অরিজিন আর ডেভলপ্মেন্ট খোঁজার মধ্যে নিশ্চিত অন্য রাজনৈতিক ধান্দা আছে৷
— হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা ভাষা- নাম মানে তো একটা কল্পিত নেশনস্টেট৷ তার ঐতিহ্য দেখাতে গেলে ঐসব খোয়াব রচনা করতে হয়৷ নইলে স্টেটের গৌরবময় ঐহিত্য দর্শাবো কি করে? কিন্তু আমি সেটা যেহেতু অন্যত্র বিস্তারিত বলেছি, তাই এখন আর এটা নিয়ে ভাটাতে চাই না৷ আমি আপাতত চমস্কির দিকে এগুচ্ছি৷ তাই ব্যাকরণ/গ্রামার এবং শব্দবিদ্যার সঙ্গে তফাৎটা একটু খেয়াল করিয়ে দিচ্ছি মাত্র৷ ঐ অবাধ কাঁচামাল চিহ্নের (যার ওপর নানান ‘মূল্য’ আরোপ করি আমরা) প্রসঙ্গ আপাতত একটু পাশে সরিয়ে রাখি বাহ্যিক ভাষা বা এক্সটারনালাইজড্ ল্যাঙ্গুয়েজ নাম দিয়ে৷ এখন আমরা পৌঁছচ্ছি দ্বিতীয় বিপ্লবে — সোসুরের প্রথম থেকে চমস্কির দ্বিতীয়ে৷ আমরা কথা কইবো এখন আভ্যন্তরীন ভাষা বা ইন্টারনালাইজড ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে৷ কিন্তু, তার আগে একটু সলতে পাকিয়ে নিতে হবে৷ ভাষার নিয়ম কোথা থেকে আসে এ নিয়ে বেশ সমস্যা ছিল বিশ শতকের প্রথম পাদে৷ তখন কিছু মার্কিনী মনস্তত্ত্বের মানুষ সদ্য আবিষ্কৃত স্নায়ুতন্ত্র ও তার প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ে একটা ঘরানা বানিয়ে ফেলেছিলেন-- আচরণ বাদ বা বিহেভি অরইজম্৷ রুশি পাভলভের তত্ত্ব একটু অন্যভাবে পড়ে ফেলেছিলেন সামচাচার দেশের মনস্তত্ত্ববিদ্রা৷ তাঁরা মনে করছিলেন, ওসব মনটন বলে কিস্সু নেই — সবটাই উদ্দীপক- প্রতিক্রিয়ার খেলা মাত্তর৷ একটা উদ্দীপক এলো, “আলো জ্বালাও৷” আমি প্রতিক্রিয়ায় আলো জ্বালালুম বা জ্বালালুম না৷ কথার উদ্দীপকে কথা প্রতিক্রিয়া৷ স্রেফ কন্ডিশনিং এর ব্যাপার৷ ভাষা সাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়া মাত্র--
— দাঁড়াও বাপু, ব্যাপারটা আমি পড়েছি মনে হচ্ছে৷ ধীরেন গাঙ্গুলি মশাই- এর পাভলভ্ পরিচিত বই- এর দুটো খণ্ডে তো এই আচরণ তাদের নিন্দেবান্দা করা হয়েছে খুব৷ গাঙ্গুলি- মশাই- এর মতে এর পেছন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন মার্কিনী ধান্দা ছিল৷ দাঁড়াও মনে করি নামটা-- ও হ্যাঁ বি. এফ স্কিনার! বিহেভিঅরিস্ট! ভার্বাল বিহেভিসর বলে একটা বই লিখেছিলেন, সেইসঙ্গে একটা উপন্যাস-- ওয়াল্ডেন টু৷ পড়েছি বইটা৷ খুব বদমাইশ লোক৷ লোকটা বলে কিনা, একটা নিঠুর দরদী রাজা বা বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটর যা ‘ভালো’ তা সববাইকে কন্ডিশনিং মারফৎ শিখিয়ে পড়িয়ে দেবেন আর সবাই সেইমতো চলবে৷ মানবিক সৃজনশীলতার তাহলে কি হবে? স্বাধীনতার কি হবে? নাকি এসব শব্দ পালটি খেয়ে যাবে?
— আপনি মশাই অনেকটা জানেন৷ এরকম ছাত্তর পেলে পড়িয়েও মজা৷ বাংলা ভাষায় পাভলভ পরিচিতি -র মতো বই থাকতে আর চিন্তা কি৷ আচরণবাদের গলতি সেখানে দেখানো আছে৷ এই আচরণবাদের বিরুদ্ধেই চমস্কির প্রতিবাদ৷ গত শতকের পাঁচের দশকের কথা৷ এই ভদ্দরলোক ভাষা সৃজনের ব্যাখ্যা দিলেন৷ বুঝুন অবস্থা, সৃজনের সংজ্ঞার্থ দিচ্ছেন চমস্কি —
— এই তুমি ‘সৃজন’ বলছো কেন? কথাটা তো ‘সর্জন’?
— দেখুন আমরা যারা ভাষাতাত্ত্বিক, তারা প্রথম দেখি ইউসেজ বা প্রচলন৷ এই চলতি ‘সৃজন’ শব্দটা কমুনিকেট করছে তো? ব্যাস! দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, আমরা প্রথম আর দ্বিতীয় বিপ্লবের আর ভাষার অবাধ কাঁচামাল বা বাহ্যিক ভাষা নিয়ে মাথা ঘামাই না, মাথা ঘামাই ‘নিয়ম’- এর খেলা নিয়ে৷ এই নিয়ম এলো কোথা থেকে? ফের সেই প্রশ্ন৷ চমস্কি সোজা সাপটা বলে দিলেন, নিয়মটা ‘সহজাত’— কর্ণের কবচ কুণ্ডলের মতো৷ এখানে তাঁকে প্রভাবিত করলেন, দার্শনিক রেনে দেকার্তে৷ তাঁর নাম অনুসারে চমস্কি- বিপ্লব পরবর্তী ভাষাতত্ত্বকে বলা হয় কার্টেসিয়ান লিংগুইস্টিক্স৷
— এতো ভারি মজার ক্লাস৷ পড়তে এলুম ভাষাতত্ত্ব, আর পড়ছি কিনা মনস্তত্ত্ব আর দর্শন, তার ওপর আবার স্নায়ুতত্ত্ব- প্রতিবর্ত ক্রিয়া৷ ভাষাতত্ত্বের কেলাশে এসব পড়ানো হয় নাকি?
— আজ্ঞে, আমি ঠিক বলতে পারবো না৷ তবে আমি তো অবশ্যই পড়াই৷
— কিন্তু, এই যে ‘ভাষা’- র নিয়ম মনের অন্দরে থাকে, এটা প্রমাণ করবে কি করে বাপু?
— একটা আড়াই তিন বছরের বাচ্চার দিকে তাকান৷ ধরে নিন সে ‘স্বাভাবিক’ বাচ্চা৷ খেয়াল করে দেখবেন, সে বাচ্চাটা যে পরিবেশে থাকে, সেখান থেকে সে এই অবাধ কাঁচামালটা সংগ্রহ করে নেয়৷ এই চিহ্নগুলো সসীম বা ফাইনাইট৷ এবার খেয়াল করে দেখুন৷ সে এই সসীম ধ্বনি আর শব্দ দিয়ে অসীম বা ইনফাইনাইট বাক্য বানায়৷ এসব ব্যাখ্যা সে বানায়, যা আগে সে শোনে নি; এমন বাক্য বোঝে, যা আগে সে শোনে নি৷ এই তো মানবিক সৃজন পারঙ্গমতা! এই সৃজনপারঙ্গমতা আসছে কোথা থেকে? মন/মস্তিষ্ক থেকে! এবার এই অসীম বাক্য- সৃজনের তরিকা যদি বাক্য- বিশ্লেষণ (যাকে বলে সিনট্যাক্স) করে বুঝে নিই তাহলে মনের জৈবিক ধাঁচাটা বুঝে ফেলবো৷
— বুঝলুম, বৈজ্ঞানিক এবার মনের অন্দরে সেঁধোচ্ছেন৷ কি চমৎকার সত্য- জানার সদিচ্ছে৷
— আপনি কি নীৎসে পড়েছেন নাকি? এত বড় একটা তত্ত্ব ফাঁদার পর আপনি ঠেস মেরে কথা কইছেন?
— তা একটু- আধটু পড়েছি বৈ কি! সত্যকে জানবার ইচ্ছে তো একধরনের বিমারি৷ তোমরা সত্য’ জানতে চাইছো মানে ক্ষমতাবান হতে চাইছো৷ মানব- মনের সত্য জ্ঞান তোমাদের এমন ক্ষমতাশালী করবে যে তোমরা অন্য/অপর মানুষকে শাসন দখল করবে৷ দেখো, আমি ভাষাতত্ত্বের এতশত ব্যাপার জানতুম না, কিন্তু ঐ মার্কিনী বিহেভি অরিস্টদের ধান্দা জানতুম ....
— দাঁড়ান একটু বলে নি৷ সোস্যুরের সংগঠন— গ্রন্থনা বা যাকে বলে স্ট্রাকচারালিজ্ম চারটে জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলো-- ফ্রান্স, প্রাহা, কোপেনহেগেন এবং আমেরিকা৷ ভাষাকে- বস্তু হিসেবে বিশ্লেষণ৷ ভাষা হয়ে উঠলো অপর না- আমি বস্তুবিশেষ- যার সুনির্দিষ্ট সংগঠন- গ্রন্থনা আছে৷ এর মধ্যে মার্কিনী সাহেবরাই হয়ে উঠলেন বিজেভিঅরিস্ট৷ এঁরা শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন আমার দেহকে তাই নয়, হরেক ভাষার তথ্য জড়ো করার কাজ শুরু করলেন নৃতত্ত্বের দোর ধরে৷ প্রশ্ন হল: কেন এই তথ্য জড়ো করা?
— এর উত্তর আমি রাজনীতি করার সূত্রে জানি৷ ওঁরা তথ্য জড়ো করতেন স্পাইং- করার তাগিদে৷ এই মার্কিনী ভাষাতত্ত্বকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজে লাগিয়েছিলো সামচাচা- সরকার৷ তোমাদের কিসব ভাষাতত্ত্বের তারিকা আছে, যাতে একটা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি শিখে নেওয়া যায় — এই বোধ হয় তিন মাসের মধ্যে৷ তা মার্কিনী মিলিটারি ক্র্যাশ কোর্সে এই সময় ভিনদেশি ভাষা শিখিয়ে ফেলা হত এখনও হয়৷ তাই তোমাদের বিষয়ের একটা ‘বদ’- নাম তো মিলিটারি বা প্যারাট্রুপার্স লিংগুইস্টিক্স৷
— মিশনারিরাও এই একই কাজ করেছেন৷ তাই কেউ কেউ মিশনারি লিংগুস্টিকস্ বলেন এই প্রাক্- চমস্কি ভাষাতত্ত্বের গুপ্তচরবৃত্তিকে আরো ব্যাপার আছে, খেয়াল করে দেখবেন, খুব অল্পজন জানে এমন ভাষাগুলোকে আজকাল বিলুপ্তপ্রায় ভাষা বা এন ডেঞ্জারড্ ল্যাংগোয়েজ বলে, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে৷ আপাতত ভাববেন বুঝি, বিলুপ্তপ্রায় ভাষার জন্য বোধহয় দরদ উথলে উঠছে ...
— অবাধ কাঁচামাল বাহ্যিক ভাষার জন্য দরদ? কর্তার কি দয়া!
— ঠিক বলেছেন৷ আসলে কম- জানা ভাষা গুলোকে দিয়ে গুপ্তভাষা বানানোর সুবিধে অনেক৷ গুপ্তভাষা মানে ক্রিপটিক ল্যাংগোয়েজ৷ সেটা বানাতেও ভাষাতাত্ত্বিক (?) লাগে, আবার সেটার রহস্যভেদ করতেও (যাকে বলে ডিসাইফার) ভাষাতাত্ত্বিক লাগে৷ আরে মশাই সদাগর- পোষিত রাষ্ট্রের কাজে না লাগে যদি আমার কাজ, কর্পোরেট কে যদি সার্ভ- ই না করতে পারি, তাহলে আর আমার পেশার মূল্য কি?
— আচ্ছা, চমস্কি তো রাজনীতি নিয়েও কথা কন৷ তাঁর জনপ্রিয়তা যতখানি, ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে, তার থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট ও ভাষ্যকার হিসেবে৷ তিনি তো তাঁর ভাষাতত্ত্বে মনে হচ্ছে, ভাষাতত্ত্বের এই রাজনৈতিক ব্যবহারকে রুখে দিলেন৷
— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বাহ্যিক ভাষাবৈচিত্র্যের ঔপনিবেশী— করণ চালু ছিল৷ তারপর বলা যায়, চমস্কি ঐ ‘কলোনাইজ’ -করার ব্যাপারটা থেকে একে উদ্ধার করলেন৷ কিন্তু, তারপর, ১৯৫৭- র চমস্কীয় কার্টেজিয়ান লিংগুইস্টিক্স -এর আবির্ভাবের পর, চমস্কি স্বয়ং ভাষা- বিশ্লেষণ করে মনের ধাঁচা জানার প্রক্রিয়া কম করে অন্তত পাঁচবার বদলেছেন৷ বেসিক যে ভাষা- সৃজনের তত্ত্ব, সেটা এক থাকলেও বদলে গেছে ভাষা- বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া৷ সেই প্রক্রিয়াগুলো এক একটা মডেল৷ মডেলের মধ্যে ফেলে ভাষাকে বিশ্লেষণ করে একটাই জিনিস দর্শাতে হবে: সমস্ত হোমো স্যাপিএন্স সৃজন- পারঙ্গম৷ সার্বত্রিক একটা ব্যাপার মানে যুনিভার্সলি ....৷
— এই মডেল কথাটা শুনলেই আমার কেন জানি ফ্যাশন মডেলের কথা মনে পড়ে যায়৷ ফ্যাশন শো- এর র্যাম্পে যেমন অপুষ্টিতে ভোগা রোগা পটকা মেয়ে গুলো যেমন হাঁটে, তেমনি এই ম্যানহাটন- প্রকল্প- উত্তর বৈজ্ঞানিকরা অপুষ্টিতে ভুগে মডেল টোকেন৷ ঐ মেয়ে গুলোর রোগটার নাম অ্যানোরেক্সি আ নার্ভোসা অথবা বুলিমিআ৷ ইচ্ছে করে অপুষ্টি- তৈরি করে তো! ইচ্ছুক বৌদ্ধিক অপুষ্টির একটা নাম আছে: ইন্টেলেক চু আল অ্যানোরেক্সিআ৷
— ঠিকই বলেছেন৷ এই পাঁচটা মডেল্সে ভাষিক তথ্য পুরে কি হল? পাঁচ পাঁচটা মডেলস্ দিয়েও কি ‘মন’- কে ধরা গেল? তা’ তো প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল৷
— মন পিছলে পিছলে যাচ্ছে৷ মডেলস্ দিয়ে তাকে ধরা যাচ্ছে না বুঝি? কিন্তু, লক্ষ্য করছি একটা ব্যাপার: নানান ভাষার বিপুল তথ্য জড়ো হচ্ছে৷ পি এইচ ডি, গবেষণা পত্রের দৃব্বা লেগে গেছে৷ অর্থাৎ এক দিকে ভাষার তথ্যের ভেতর দিয়ে সংস্কৃতির অন্দরে সেঁধোনো যাচ্ছে অথবা হয়তো মনেরই অন্দরে, আবার এতো গবেষণার দোলতে ছাপাখানার পুঁজিবাদ সমৃদ্ধ হচ্ছে৷ তা’ চমস্কির তত্ত্বটা ছেড়ে দিলে যে বিশ্লেষণ প্রণালী পড়ে থাকে, তা দিয়ে তো সেই আগের মতোই কাজকম্মো চলছে?
— এটা আমি আপাতত বলতে পারবো না৷ অনেক সাংবাদিক তথ্য দিয়ে এতো বড়ো কথা কইতে হবে৷
— কিন্তু, তুমি বাপু কি করছো বলতো? সাহেব টোকা পণ্ডিত হয়েই আছো, নাকি কোনো ‘নূতন দেখার দেখা’ এবার দেখাতে পারছো? তোমার তো দেখছি ভারতীয় তত্ত্বের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই
— আছে, বলিনি আপনাকে৷ আমি শুধু সোস্যুরের প্রথম বিপ্লবে অবাধ ভাষা- চিহ্নের ব্যাপারটা বলে, কাঁচামাল থেকে মনের গণনা ভিত্তিক সৃজনশীল কার্যক্রমে চলে গেছি (অর্থাৎ দ্বিতীয় বিপ্লবে—)৷ সোস্যুরের সংগঠন- গ্রন্থনা থেকে মার্কিনী আচরণবাদী ভাষাতত্ত্বের ভাঙন দেখিয়ে দিয়েছি ছোট্ট করে এরই মধ্যে৷ তারপর চমস্কির দ্বিতীয় বিপ্লব —
— কিন্তু চমস্কীয় দ্বিতীয় বিপ্লবের পর আর কী?
— সেটা আপনি নিজেই বলে ফেলেছেন৷ ঐ যে যখন বলছিলেন না, নীৎসে থেকে মনে রেখে সত্য খোঁজার বিমারির কথা, তখনই তৃতীয় বিপ্লবের ধরতাইটা আপনি দিয়ে ফেলেছেন৷
— তাই নাকি? কিরকম? নীৎসে তো মারা গেছেন ১৯০০ সালে৷ তারপর যদ্দূর জানি সোস্যুর আর চমস্কির কার্যকলাপ৷ তাহলে নীৎসে তৃতীয় হন কি করে? কালের হিসেব তো মিলছে না! তৃতীয় বিপ্লব কি সরলরৈখিক কাল- অনুক্রম ভেঙে দিল?
— ঠিকই৷ আসলে কি জানেন, নীৎসের ভূত তাড়া করেছে আমাদের৷ নীৎসের ভূতের আবির্ভাব ঘটেছে গত শতকের ৬ ও ৭- এর দশকে৷ তাঁর দেরিদা নামক এক প্রশিষ্য ‘গ্রামাটোলজি’ নামে এক রণকৌশল তৈরি করেছেন৷ লিংগুইস্টিক্ম্- এর বদলে ‘গ্রামাটোলজি’ দাঁড়িয়ে চমস্কীয় তত্ত্বে ঘাপলা পাকানোই যায়৷ নীৎসের এই পুন: আবির্ভাবকেই বলছি তৃতীয় বিপ্লব!
— লোকটা ফিললজির ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দেন৷ স্বেচ্ছায়৷ এই পাগলাটা অবসর জীবনে কী ফাটাফাটি করলেন এমন যে তোমাদের ভাষাতত্ত্বে ফাটল ধরলো?
— সেটা এখনও কেউ ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছেন না৷ প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তের সময় এটা৷ প্রযুক্তি এমন ভাবে ভ্যাকসিনেটেড করেছে আমাদের শরীরকে যে দর্শনের শান্ত চিন্তনের ভাইরাসগুলো এখন আমাদের আক্রান্ত করে না৷ তাই যা চলবার চলছে এখনকার ভাষাতত্ত্বে —কম্পুটারকে দিয়ে কথা কওয়ানোর চেষ্টা! এটা এখন খুব দামি বিষয়৷ কম্পুটারকে মানুষ- বানানোর বাসনায়- কামনায় ব্যাপক তথ্য পোরা হচ্ছে যন্তরে৷ এই তথ্য- পোরার করণিক কাজটা করলেই ঘ্যাম নেওয়া যাচ্ছে৷ কে এখন নীৎসে ফিৎসে পড়বে! আর দেরিদা? আমাদের ভাষাতত্ত্ব কেলাসে তিনি এখনও প্রবেশ করেন নি! ভাগ্যিস!
— তুমি চমস্কির তত্ত্বে ঘাপলা পাকাবে বলছিলে না?
— না ঠিক ঘাপলা পাকানোর জন্য ঘাপলা পাকানো নয় ব্যাপারটা৷ প্রথমত: দেখতে হবে ব্যাপারটা আমার গভীর গোপত্র থেকে উঠে আসা কোনো সমস্যা কিনা; দ্বিতীয়ত: সে সমস্যার কোনো সমাধান আছে কিনা — না, থাকলে নেই, প্রতিপাদ্য সমস্যাটা তুলে ধরতে পারছি কিনা সেটাই বিবেচ্য; তৃতীয়ত: আমার সমস্যা নির্মাণ আর পাঁচজনের কাজে লাগছে কিনা — সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে৷ স্রেফ গবেষণা পত্র লিখে পদোন্নতি করার ব্যাপার নয় এটা৷
— কোনো সমস্যায় পড়েছো কি?
— হ্যাঁ, ঝাড় খেয়ে কথা কইতে পারছি না৷ গরুখোঁজা থুড়ি গো- এষণা করেও চমস্কির সৃজনশীল কথা- বলা- বিষয়টির সন্ধান পাচ্ছি না ....
এ সময় আচমকা দাঁড়িয়ে- থাকা ট্রেনটার সমস্ত আলোগুলো নিভে যায়৷ আমরা আর পরস্পরের মুখ দেখতে পাচ্ছি না৷ এ আঁধারে কোনো উৎসারিত ধ্বনি খুঁজে পাই না, অথচ সারা ট্রেন জুড়ে তখন ব্যাপক হল্লা৷
১. ২.
তারপর কাজ সেরে বাড়ি ফিরে এসে একটা ছোট্ট পোস্টকার্ড পেলুম৷ ঐ ভদ্দরলোক একটা ছোট্ট চিঠি পাঠিয়েছেন৷ তাতে আমায় সম্বোধন করে যা লিখেছেন--
সেদিন ভাষাতত্ত্বের ক্লাস করে বেশ উপকৃত হয়েছি৷ ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না নিজেকে৷ তবে ঝাড় খেয়ে কথা বন্ধু হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে পারো৷ তবে তুমি কথা- বন্ধ হওয়ার ব্যাপারটাকে বড্ডো নেতিবাচক হিসেবে দেখছো৷ আদ্ধেক পেয়ালা খালি
দেখলেই চলে? আদ্ধেকটা যে ভর্তি আছে, সেটা দেখবে না? ‘বাক্পথাতীত’ কোনো সন্ধান কি তুমি করবে না? সৃজনশীল মানুষের তত্ত্বে তো অগম পারের আভা আছে৷
শুভেচ্ছা সহ,
...........
বলা বাহুল্য, চিঠির শেষ কথাগুলো আমার বোধগম্যতার বাইরে—৷
লেখক পরিচিতি
Debaprasad Bandyopadhyay (born 1965) is a professor (honoris causa) of Linguistics, La Filológica Por La Causa (USA/MEXICO) and one of the distinguished members and collaborators of INTRADEPARTMENTAL LEXICOGRAPHICAL STUDIO, Saint-Petersburg State University. He is also a worker of Linguistic Research Unit, Indian Statistical Institute (Kolkata). He has published more than ten books and 200 articles in journals and magazines on 29 different topics. He has also attended and organized numerous international and national seminars and chaired sessions in seminars. He is a member of the editorial boards of different journals and member of learned societies. He, as a socio-political commentator, is regularly participating in T.V. talk shows.
0 মন্তব্যসমূহ